#গল্পঃস্বামী
#পর্বঃ৩
#লেখকঃপারভেজ_ইসলাম
🥀
তাকিয়ে দেখি আমার সামনেই আদৃত দাঁড়িয়ে আছেন।তিনি ফোন কেড়ে নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চোঁখ বোলাতে লাগলেন।আমি তাড়াতাড়ি উঠে উনার সামনে দাঁড়ালাম।উনার মুখের হাবভাব দেখেই আমার আর বুঝতে বাকি নেই উনি কোনো বিষয়ে প্রচন্ড রেগে আছেন।রাগ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান তার চেহারায়।উনার ফর্সা গালে একটা লালরঙা ভাব লক্ষ্য করলাম।কিন্তু উনি আমার রুম থেকে যখন বাহির হয়েছিলেন তখনও তো স্বাভাবিক ছিলেন।আমাকে রায়হানের সাথে কথা বলতে বলে ফোন দিয়ে গেলেন।তাহলে?এই অল্পকিছু সময়ের মধ্যেই এমন কি ঘটে গেল যে তিনি এতো রেগে আছেন।আমার এসব ভাবনার ইতি টেনে উনি আমার কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেন যে,
আদৃতঃআপনার স্বামী কি আপনাকে চিট করেছে জান্নাত?দাদি যাযা বললেন তা কি সত্যি?
কি দিয়ে কি ঘটেছে তা আমার আর বুঝতে সময় লাগলো না।আমি দাদিকে যা যা বলেছি তার সবটাই তার মানে দাদি আদৃতকে বলেছেন।আর এই জন্যই এই সামান্য সময়ের ব্যবধানে আদৃতের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গিয়েছে।আমি কিছু না বলে মূর্তির ন্যায় চুপ করে সাদা-নীল টাইলসের দিকে তাকিয়ে রইলাম।লজ্জায় মাথাকাটা যাচ্ছে আমার।মনে মনে ভাবছি যদি আদৃত এখন বলে বসেনঃযার জন্য আমাকে সেইদিন অপদস্ত করেছিলেন,,আমাকে বিয়ে না করে যার সাথে সংসার গড়ে তুলেছিলেন,,সেই আজকে আপনাকে ছেড়ে দিলো।সেই মানুষটাকে নিজের করেও রাখতে পারলেন না জান্নাত?ছি ছি এই ছিলো আপনার ভালোবাসা?এই কয়েক বছর যেতে না যেতেই শেষ হয়ে গেল।”
যদি উনি আমাকে এই প্রশ্ন করে বসেন তখন কি উত্তর দেবো আমি তার।এই রাতেই যদি বের হয়ে যেতে হই?কিন্তু উনি আমাকে আজকে দ্বিতীয়বারের মতো অবাক করে দিয়ে বললেন
ঃমানুষ কতোটা নিকৃষ্ট না হলে আপনার মতো একটা মেয়েকে এভাবে একা ফেলে চলে যাই।তার উপর আপনি অন্তসত্ত্বা।আফসোস হচ্ছে আপনার স্বামীর জন্য এই ভেবে যে সে কতো মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলল তার জীবন থেকে।সর্বদা ভাবতাম আপনার স্বামী নিশ্চয়ই অনেক ভালো একজন মানুষ তাই আপনার মতো কাউকে পেয়েছেন।কিন্তু সে এতো নীচ।
গভীর মনোযোগে তার বলা কথাগুলো শুনছিলাম।উনি বড়ই অদ্ভুত নইলে অসম্ভব ভালো।তিন বছর আগে আমি তাকে আর তার ভালোবাসাকে তাচ্ছিল্য করেছিলাম।আজকে তিনি আমাকে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ পেয়েও আমার হয়েই কথা বললেন।রায়হান আমাকে হারিয়েছে ভেবে রায়হানের জন্য আফসোস প্রকাশ করছেন।মানুষ এতোটাও ভালো হয় আমার জানা ছিলো না।
উনি আবার বললেনঃআপনার স্বামীর নামটা কি জেনো জান্নাত?
আমিঃরায়হান ফেরদৌস।
আদৃতঃআপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি এখনি তার অফিসের বস কে ফোন দিয়ে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করিয়ে দিতে পারি।উনি যে অফিসে চাকরি করেন কাইন্ডলি অফিসের নামটা বলবেন।
উনার কথা শুনে কেনো যেনো খুব হাসি পেলো।মনে মনে ভাবছি যেই বসকে রিকুয়েষ্ট করে উনাকে বরখাস্ত করাবেন উনি তো সেই বসের প্রেমেই হাবুডুবু খাচ্ছেন।সেই বসই যে সেই ব্যক্তি যে রায়হানকে কেড়ে নিয়েছেন।এই কথা বলতে চাই না আদৃতকে।তাই ভেবেই উত্তর দিলাম,
আমিঃআসলে আদৃত আমি রায়হানকে নিজের যোগ্যতাই শাস্তি দিতে চাই।ওকে ভুল প্রমাণ করতে চাই।আমিও যে এই সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারি।
আদৃতঃআপনার যেটা ভালো মনে হয় সেটা করবেন।এখন রেস্ট করুন।আর আই আম সো সরি তখন ওইভাবে ফোনটা নিয়ে নেওয়ার জন্য।দাদির থেকে কথাগুলো শুনে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল।রিয়েলি ভেরি ভেরি সরি।
আমিঃএইভাবে বলবেন না।আপনার জায়গায় আমি থাকলেও এমন টাই করতাম।ভাগ্যিস ফোনটা নিয়ে নিয়েছিলেন নইলে আমিও আবেগের বশে এসে বোকার মতো রায়হানকে ফোন দিয়ে ওর সামনে নিজেকে পুনরায় ছোটো করতাম।
আদৃতঃসত্যি আপনি অন্যরকম।আপনার স্থানে যদি অন্যকেউ থাকত তাহলে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করত কিন্তু আপনি পরিস্থিতি টাকে বুঝে সত্যকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।যে আপনাকে অবমাননা করেছে তাকে তার ভুলের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।খুব বেশি খুশি হয়েছি আপনার এমন সিদ্ধান্তে।এখন রেস্ট নেন।
আমিঃআপনার সাথে আমার একটা বিষয় নিয়ে কথা ছিলো।
আদৃতঃজ্বি বলেন আমি শুনছি।
আমিঃআসলে আমার পক্ষে এইখানে থাকা সম্ভব নই।আপনি যদি অনুমতি দেন আমি এইখান থেকে চলে যেতে চাই।
আদৃতঃকোথায় যেতে চান আপনি?
আমিঃআমার মামাতো বোনের বাসায়।চাঁদপুরে।আমি জানি দাদিকে বলে লাভ হবে না।তাই আপনাকেই বললাম।আমি আপনার কাছে শুধু ঋণীই নয় অপরাধীও বটে কারণ আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।এইখানে থেকে আমি আর আমার ঋণ আর অপরাধবোধ বাড়াতে চাই না।
আদৃতঃযতদিন না আপনার সন্তান দুনিয়ায় আসছে না আপনি পারলে এই খানেই থাকেন।আপনি ভেবেন না আমি আপনার উপর দয়া করছি।আমি মানুষ।মনুষ্যত্ব বলে একটা জিনিস আমার মধ্যে আছে।তাই বিপদে আপনাকে চলে যেতে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নই।উপরন্ত আপনার বোন সর্বোচ্চ একমাস আপনাকে তার কাছে রাখতে পারে।তারপর মুখের ভাষায় না হলে ব্যবহারের দ্বারা আপনাকে তার বাসা থেকে চলে যেতে বলে দেবে।কারণ কেউ তার সংসারে বাড়তি একজনকে রাখবে না।যদি ভেবে থাকেন চাকরি করবেন বলে রাখি আপনাকে দেখতে যে ডাক্তার এসেছিলেন উনি বলেছেন আপনি মাত্রারিক্ত দুর্বল এবং হিমোগ্লোবিনো বেশ কম।তাই আপনি যেকোনো সময় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।তাই একজন লোক দরকার যে সর্বদা আপনার আশেপাশে থেকে আপনার যত্ন নেবে,,খেয়াল রাখবে।আপনি যদি এই বাড়ি থেকে চলে যান,,বিপদে পড়েন,,সন্তানের কোনো ক্ষতি হয়,,আপনি যেমন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না।আমিও পারব না।আমি তাই অনুরোধ করছি পারলে এইখানেই থাকেন।বাকিটা আপনার ইচ্ছা।
শান্তগলায় মেঝের দিকে তাকিয়ে একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললেন।এক মূহুর্তের জন্যও বিরতি নেননি।আমিও স্থির চাহনীতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো শুনেছি।কি সুন্দর গুছিয়ে,বুঝিয়ে কথা গুলো বললেন।আমাকে থাকার জন্য জোড় না করলেও বাধ্য করলেন।সন্তানের ভালোর জন্য যে এইখানেই থাকতে হবে আমার তার কথার দ্বারা এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার কাছে।আমার মামাতো বোন অনু সত্যিই বেশিদিন রাখবে না আমাকে তার কাছে।আর বেশি কিছুদিন পর আমি চাকরিও করতে পারব না।তার এইখানে থাকার ছাড়া সত্যিই উপায় নেই আর।আমি অতিরিক্ত কোনো বাক্য ব্যয় না করে তাকে বললাম,
আমিঃযথেষ্ট যুক্তি দিয়ে কথাগুলো বলে সত্যটা এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।বাবু আসার আগ পর্যন্ত এইখানেই থাকব।কিন্তু আমি কোনো ঋণের বোঝা রাখতে চাই না।তাই বাবু হওয়ার পর চাকরি করে আপনার সব ঋণ শোধ করে দেবো।পারলে আপনি কালকে আমাকে কিছু চাকরির বই এনে দিবেন।
আদৃত মুচকি একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
আদৃতঃআপনি সত্যি অনেক বুদ্ধিমতি।আবেগটাকে প্রাধান্য না দিয়ে বিবেকের সাহায্য নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।আপনার মধ্যে জীবনে সফল হওয়ার যোগ্যতা আর সফল হওয়ার জন্য যে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয় দুইটিই রয়েছে।চাকরি নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না।আমি কালকে আপনাকে বই এনে দেব।এসব চিন্তা বাদ দয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।বেশি রাত জাগা উচিত নই।শুভরাত্রি।
কথাগুলো বলেই উনি বেরিয়ে গেলেন।আমি মনে মনে ভাবছি আবার যেন এমন কিছু না হয় যার কারণে উনি রাগান্বিত হয়ে পুনরায় ফিরে আসেন।খুব চিন্তায় ছিলাম এই নিয়ে উনাকে কিভাবে রায়হানের কথাগুলো বলতাম।কিন্তু আল্লাহ আগাগোড়ায় আমাকে বিপদে সাহায্য করেন।ঠিক আজকে যেভাবে সাহায্য করেছেন।আমি গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোঁখ বুলিয়ে নিলাম।নিজেকে দেখছি আর ভাবছি রায়হানের জন্য কতোটায় না পরিবর্তন করেছি নিজেকে।ওর কথায় নিজের লম্বা মাজা ছাড়ানো চুলগুলো লেয়ার কাটে কেটে ধ্বংস করেছি।শর্ট কামিজ আর সেলোয়ার ওর পছন্দ নয় বলে সব সময় ফুলহাতার কলার দেওয়া লং কামিজ,,চুড়িদার পড়ার অভ্যাস করেছি।কিন্তু আর নই।আর বদলাবো না নিজেকে।যেমন প্রতিবাদি ছিলাম তেমন প্রতিবাদি হয়ে উঠবো।আমাকে নিয়ে বাইরে গেলে রায়হানের নাককাটা যেতো এই কথার উত্তরস্বরূপ আমাকে ছেড়ে দিয়ে কতবড় ভুল করেছে এটা তাকে বোঝাবো।এরই মধ্যে দাদি আসলেন।দাদি এইভাবে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে ভ্রুকুচকিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
দাদিঃবলেছিলাম না মন একদম খারাপ করবে না।
আমিঃমন খারাপ করছিলাম না দাদি আফসোস করছিলাম।
দাদিঃআফসোস তো করবে সে যে তোমার মূল্য দেইনি।এখন ঘুমিয়ে পরো।একা ঘুমোতে পারবে?নাকি আমিও তোমার সাথে ঘুমাবো।
আমিঃনা দাদি পারব।
দাদিঃতাহলে শুয়ে পড়।আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দেই।
দাদির কথা মতো আমি শুয়ে পরলাম।দাদিও আমার। মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলেন।আমি আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
চলবে………….🥀