#হঠাৎ_হাওয়া (১৭)
হালকা আবছা আলো আঁধারের একটা খেলার মধ্যে মায়া ট্রেন থেকে নামলো, ওর শহরে এই শহরে ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা একসময় থাকতো, আচ্ছা হিমালয় কি দেশে আসে?কথা আপু সাথে থাকে?মায়া আকাশ পাতাল চিন্তা মাথা ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলো এজন্যই এই শহরটা ওর ভালো লাগে না, খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া স্টেশনে দাড়িয়ে রইলো তবে বেশিক্ষণ না একটা পরিচিত অবয়ব দেখতে পেলো জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওর দিকে হেটে আসছে, মায়া নিজ মনেই একটু হাসলো, ছেলেটা পাগল নাকি? এত ভোরে ওর ঘুম ভাঙলো কি করে?
—দে তোর পা টা দে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি এই শহরে তুই তোর পায়ের ধুলো দিলি এই শহর ধন্য হয়ে গেলো
মায়া হাসলো,
—তুই তোর পা এগিয়ে দে, এত সকালে তোর ঘুম ভাঙলো,
সাহিত্য নির্বিকার ভাবে উদাস গলায় বলল,
—আমি রাতে বাসায় যাই নাই।
মায়া এবার অবাক হলো ভীষণ অবাক, তবে কিছু বলল না,
—বাবাই এর কাছে এখন কে আছে?
—তোর ফুপি
—আমার ফুপি তোর কি হয় সাহিত্য?
—এ চুপ কর তো, তোর লেকচার আমার শুনতে ইচ্ছা করে না।
—আচ্ছা এই চুপ করলাম, আর লেকচার দিব না।
—তোর ব্যাগ কই
মায়া হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালো আনে নি,সাহিত্য চোখ ছোট করে বলল,
—কি? জাদু দেখাচ্ছিস? তুই প্রতিবন্ধীর মত হাত পা নাড়াইলেই ব্যাগ চলে আসবে?
মায়া শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
—আমি প্রতিবন্ধী?
—আমি বললেই কিছু হয়ে যায় না মায়া, আমার বেশিরভাগ কথাই ইগনোর করবি,
মায়া চোখ নামিয়ে ফেলল, এই ছেলেটা এমনই যখন মায়া মজা করে কিছু বলে ও সিরিয়াস হয়ে যায় আর মায়া যখন সিরিয়াস হয় তখন এমন সব কথা বলে মায়ার সিরিয়াসনেস আর টেকে না সাহিত্য হাই তুলতে তুলতে বলল,
—চল ভাই এখন যাই আর ভাল্লাগতেছে না, ব্যাগ তো আনিস নাই তাই না?
মায়া আর কিছু বলল না হাটতে থাকলো, খুবই ক্লান্ত ভঙ্গিতে, সকাল বেলাটা মায়ার খুব প্রিয় ওর কাছে সকাল মানে মন খারাপের সময় একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু সময়,আচ্ছা ওর কি মন ভালো করার সময় আছে এখন?কিসে ওর মন ভালো হয়?সাহিত্য একমনে মায়ার দিকে চেয়ে রইলো,সকাল ওর খুব একটা কপালে জোটে না তবে সকালটা সুন্দর তার চেয়েও সুন্দর এই মৃদু কুয়াশায় হেটে যাওয়া রমনীটা এই মেয়ের দিকে হাজার বছর এভাবেই তাকিয়ে থাকা যায় কোনো ক্লান্তি আসে না ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে সাহিত্য মায়ার সাথে হাটতে থাকলো,
—চা খাবি সাহিত্য?
—কি জন্যে?এই যে তোরে নিতে আসলাম তার জন্য পে করতিছিস?তুই কি ভাবছিস দশ টাকার চা খাওয়াইলে শোধবোধ হয়ে যাবে এত সহজ?
মায়া আর কিছু বলল না, এরে কিছু বইলেও লাভ নাই।সাহিত্য একটা টং এর সামনে এসে দাড়ালো মাত্রই দোকানদার দোকান খুলেছে,
—মামা দেরি হবে নাকি?
—পানি বসাইছি মামা
—আচ্ছা দুইটা চা দিয়েন একটা লাল চা আরেকটা দুধ চা, লাল চা তে কড়া লিকার দিবেন মিষ্টিও বেশি
—তুই খালি পেটে দুধ চা খাবি?এসিডিটি হবে না?
—আমার সাথে ডাক্তারি দেখাইতে আসবি না, রোগ শোক তাদের হয় যাদের ডাক্তারের সাথে পরিচয় থাকে আমার পরিচিত কোনো ডাক্তার নাই অতএব আমার ওইসব কিছু হয় না।
মায়া শকড হয়ে তাকিয়ে রইলো এই ছেলেটা দেখতে যতটা সুন্দর ওর কথাগুলো ততটা তিক্ত, ও এমন সহজ ভাবে কঠিন কথা বলে যে কলিজা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় আর ও এমন নির্বিকার থাকে যেন কিছুই হয় নি।মায়ার চোখ ছলছল করে উঠলো চোখের পানি লুকাতে মায়া একটু তফাতে গিয়ে দাড়ালো, এই ছেলের সামনে কেদে ফেললেও ঝামেলা, এখনো চারপাশ পরিষ্কার হয় নি আলো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি মায়া দিগন্তে দৃষ্টি রেখে চোখ ভর্তি পানি বাচ্চাদের মত মুছে ফেলল,সাহিত্য মায়ার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,
—কাদিস না মায়া তুই কান্না করলে আমার সহ্য হয় না,
মায়ার চোখের পানি এবার আর বাধ মানলো না,সাহিত্য মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো বটলগ্রীন কালারের গোল জামার উপরে সাদা রঙের চাদর জড়ানো বেণির ফাকে বেরিয়ে আসা এলোমেলো চুলের একটা মেয়ের এই আবছা ভোরে কান্নার দৃশ্য খুবই অপ্রীতিকর অথচ অদ্ভুত সুন্দর।
—আই এম সরি মায়া,তুই কাদিস না প্লিজ আমি দুধ চা খাবো না দাড়া এক্ষুনি লাল চা বলে আসছি,সামান্য একটা চা খাওয়া নিয়ে তুই যদি এভাবে পরীক্ষায় ফেল করার মত কাদিস তাইলে তো সমস্যা তাই না?
মায়া কপট রাগ নিয়ে তাকালো সাহিত্য বুকের ডানপাশে হাত দিয়ে বলল,
—আহ! ভয় পাইছি হার্ট ধুকপুক করতেছে দেখ?
মায়া খুবই আহত ভঙ্গিতে বলল,
—হার্ট বাম পাশে থাকে
তারপর দুজনেই একসাথে হেসে ফেললো।
প্রাইভেট হসপিটালের একটা কেবিনে আপাতত মায়ার বাবা আছেন ডাক্তার বলেছেন হার্টে রিং বসাতে হবে, তবে যে ডাক্তার অপারেশন করবেন তিনি একটা সেমিনারের জন্য জাপানে আছেন তাই ডাক্তার ফিরলে দুদিন পরেই অপারেশন টা হবে, মায়া ওর বাবার কেবিনে গিয়ে বাবার পাশে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো ওর বাবার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো ওর জন্যেই হয়তো বাবার এত চিন্তা খুব কষ্ট দিয়ে ফেলে ও বাবাকে, খুব বেশি।মায়ার বাবা ঘুম ভেঙে মেয়েকে দেখে শুকনো করে হাসলো,মায়ার বুকের ভেতর গিয়ে হাসিটা বিধলো
—আমি তোমার বুকের ওপর একটু মাথা রাখব বাবা?
—তোর কি মনে হয় তোর বাবা খুব দুর্বল নারে মা?
—উহুহ আমার কাছে আমার বাবা সবচেয়ে শক্তিশালী,
—আমি যতই দুর্বল হই তোকে ধারণ করার ক্ষমতা আমার আছে, আয় তো মা আমার কাছে আয়,
মায়া আলতো করে ওর বাবার হাতের উপর মাথা রাখলো মায়ার বাবা অনুভব করলো তার মেয়েটা কাদছে
—মায়া
—হু
—কষ্ট হচ্ছে মা?
—উহুহ,তোমার কষ্ট হচ্ছে বাবা?
—আমার মেয়েটাকে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে।মা?
—হু?
—তুমি তোমার কষ্ট আমাকে বলো না কেন?
মায়া চুপ করে রইলো,
—পৃথিবী এমন কেন বাবা, খুব আকাঙ্খার জিনিসগুলো এত কষ্ট দেয় কেন বাবা?আমি কেন তোমায় এত কষ্ট দেই?
মায়ার বাবা চুপ করে রইলেন তার মেয়েটা আসলে বড় হয় নি এখনো এলোমেলো কথাই বলে।
মায়া ফুপির হাতে হাত রেখে বলল,
—থ্যাংক ইউ ফুপি তুমি বাবার খুব যত্ন করেছো আমি তোমার প্রতি খুব গ্রেটফুল,
মায়ার ফুপি মায়াকে দেখে মুখ ঝামটা মেরে বলল,
—এসেছিস তাহলে?তা কতদিন থাকবি ব্যাগ রেডি রাখিস পালাইতে সুবিধা হবে, তোর তো লুকোচুরি খেলা খুব প্রিয়।আর তোর বাবা আমার ভাই হয় কথাটা ভুলিস না তোর গ্রেটফুল থাকার জন্য আমি কিছু করি নি।
মায়া মাথা নিচু করে বসে রইলো ওর কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না সাহিত্য কঠিন মুখ করে বলল,
—কি করবে মা, বলো যে হারে ছ্যাচড়া চোর ডাকাত বেরে গেছে ওর বাধ্য হয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়, বলাতো যায় না কে কখন কি প্লান বানায়।তুমি কি জন্য মামাকে দেখছো তাও তো বলতে পারি না।
—সাহিত্য! আজকাল খুব মুখে মুখে তর্ক করো তুমি।ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার মা।
—ইশ যদি ভুলতে পারতাম!ভাইয়া কি সুন্দর ভুলতে পারলো আমি যে কেন পারি না!
মায়ার ফুপি চোখ গরম করে বলল,
—তনয়টার মাথাটাতো তো ওই বেয়াদব মেয়ে ছেলেটার পাল্লায় পড়ে এক্কেবারে গেছে
—ভাবির সম্পর্কে বাজে কথা বলো না মা।এই মায়া তুই কি চলে যাবি?
—নারে অপারেশন টা যতদিন না হয় থাকি, বাবাইকে দেখে খুব মায়া হচ্ছে
—তুই তো ড্রেস ফ্রেস কিছু আনিস নাই এই এক কাপড়েই থাকবি নাকি? সন্ন্যাসী হবি?এই কাপড়েই খাবি, ঘুমাবি?গোসল করে একাই শুকাবি?এই প্লান
মায়া ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—কিনে নেব দু একটা।
—তাহলে বসে আছিস কেন চল।মামা তো এখন ঘুমুচ্ছে, আমি অনেক ব্যস্ত সারাদিন তোর পেছনে ঘুরতে পারব না।
মায়ার ফুপি রাগ করে বললেন,
—দিন তো শেষ ই সাহিত্য তুই তো সারাদিনই এখানে।
—অনেক শেষ মানেই সমাপ্ত না মা, আফসোস তুমি এসব বোঝো না। তোর কি চেয়ারের সাথে প্রেম হয়ে গেছে এইখানেই থাকবি? তাইলে থাক আমি গেলাম।
সাহিত্য কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে মায়ার হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকলো
—কিছুই বুঝিস না তুই মায়া কিচ্ছু না।
চলবে….
সামিয়া খান মায়া
#হঠাৎ_হাওয়া (১৮)
যে ডক্টর মায়ার বাবার অপারেশন করেছেন তার কেবিনে মায়া আপাতত বসে আছেন তিনি আরেকটা অপারেশন করে মায়ার সাথে দেখা করবেন, মায়ার বাবার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। এদিকে মায়া থরথর করে কাপছে ওর হাত পা পুরো ঠান্ডা হয়ে গেছে, ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুট্টে বের হয়ে যেতে, মায়া কিছুক্ষণ মোচড়া মোচড়ি করে ভাবলো চলে যাবে এক্ষুনি ও এখান থেকে চলে যাবে বাবার তো অপারেশন শেষ হয়েছে, মায়া দরজা খুলে বের হতে গিয়েই থমকে গেলো,
—পালাচ্ছো নাকি মায়া?
মায়া আমতা আমতা করে বলল,
—না আসলে, আবির ভাই আপনি তো আসতে খুব দেরি করছিলেন আমি একটু ওয়াশরুমে যাব ভাবছিলাম, তাই আরকি….
—এখন ওয়াশরুমে যেতে চাও?
—না, না ঠিক আছে আমি পরে যাবো,
—এসো বসো,
আবির গায়ের এপ্রোন টা খুলে চেয়ারে রেখে বসলো,মায়া মাথা নিচু করে আছে মাথা তোলবার সাহস ওর হচ্ছে না আবির শান্ত চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
—কেমন আছো মায়া?
মায়া মাথা নিচু করে রইলো,ও কি বলবে?ভালো আছি? সহজ একটা উত্তর এর পর আর পালটা প্রশ্ন হবে না এরকম একটা জবাব?নাকি সত্যি? আচ্ছা সত্যি কি? এই যে মায়া ভালো নেই একটুও ভালো না ওর জীবন ঠিক দুবছর আগেই থমকে আছে?নিয়ম করে সকাল দুপুর রাত হয় কিন্তু মায়ার কিছু যায় আসে না? অনেকদিন হলো মায়া একটু শান্তিতে ঘুমুতে পারে না,বুকের মধ্যে খুব বড় একটা অংশ জমাট বেধে আছে, ঠিক মতো নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না, একথা কি মায়া বলবে? মায়ার এসব কথা কি কেউ শুনবে? বিশ্বাস করবে?মায়া খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
—ভালো।
—এই ভালোটুকু বলতে এত সময় কেন লাগলো মায়া?
—আপনারা কেমন আছেন আবির ভাই?
—আমরা বলতে কারা মায়া?
মায়া কিছু বলতে পারলো না চুপ থাকলো,
—মিষ্টি চার মাস হলো কন্সিভ করেছে।
মায়ার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মনে হলো কতদিন ভালো কিছু শোনে না, মায়া খুব সুন্দর করে একটু হাসলো
—কংগ্রাচুলেশনস, আমি খুব খুশি হয়েছি।নিরব ভাইয়া আর পুষ্প আপু কি বিয়ে করেছে?
—হ্যা বছর দেড়েক হলো ওরা এখন স্পেনে আছে নিরব ওখানে এক হসপিটালে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে গেছে পুষ্পও ওর সাথে আছে নেক্সট মান্থে ফিরবে হয়তো ওরা।
—ওহ! পুষ্প আপুর বাবা তাহলে সবটা মেনে নিয়েছে?
—না
—তাহলে?!
—তুমিতো জানো পুষ্প কি জেদী মেয়ে, অনেক কাহিনী বেশ ভালোই ঝামেলা হয়েছিলো ওদের বিয়েতে, কিন্তু পুষ্প নিরবকে শক্ত করে আকড়ে ধরেছিলো।ছেড়ে দেয় নি।
—যাক ভালোই হয়েছে আঙ্কেলও একসময় মেনে নেবেন,
—হ্যা হয়তো,ধ্রুব আপাতত দেশেই আছে,এই হসপিটালেই, বিয়ে শাদী করেনি ওর ভাব দেখে মনে হয় না ওর কপালে বিয়ে আছে
মায়া হেসে বলল,
—এখনো কি কোনো চুমকির দেখা পায় নি?
—ওর আর পাওয়া,ওহ ভালো কথা দিহানের দিন পনের পর বিয়ে তুমি এটেন্ড করবে নাকি?
মায়া মৃদু হেসে বলল,
—আমি চলে যাবো,আবির ভাই। এই শহর আমার ভালো লাগে না।
—আর কারো কথা শুনবে না?
মায়া উঠে দাড়ালো ওর খুব ইচ্ছে করছে জানতে কথা আর হিমালয় বিয়ে করেছে কি না! কতদিন বিয়ে করেছে ওরা?ওদের সংসার টা কি খুব সুন্দর স্বপ্নের মত!? হিমালয় কি কথা আপুকে তুমুল ভালোবাসে,পাগল করা ভালোবাসা! মায়ার দম বন্ধ হয়ে এলো ওদের কথা শোনার সাহস মায়ার নেই, চলে যাওয়াই ভালো ওকে ফিরে যেতেই হবে।তবে দরজা পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না মায়ার তার আগেই জ্ঞান হারালো,
জ্ঞান ফিরে মায়া দেখলো সাহিত্য বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে আছে,
—তুই জিজ্ঞেস করেছিলি না স্টেশনে যে তুই প্রতিবন্ধী কি না আমি বলছি তুই আসলে প্রতিবন্ধী, তুই হলো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু
—শিশু?
—এক থাপ্পড়ে দাত খুলে ফেলব মুখে মুখে কথা বললে,খাওয়া দাওয়া করিস তুই ঠিক মতো?মরতে চাস? মরতে চাইলে বল, এক কাজ কর ওঠ সিড়ি বেয়ে এই ১০ তলা হসপিটালের ছাদ থেকে তোকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেই,
—সিড়ি বেয়ে না উঠে লিফটে যাওয়া যাবে না?না মানে শরীর দুর্বল তো, তাই বলছিলাম আর কি
সাহিত্য কটকট করে তাকিয়ে থেকে বলল,
—মামার যে ডক্টর অপারেশন করেছে সে স্পেশালি তোকে ট্রিট করছে কেন?
—ওইটা আবির ভাইয়া হিমালয়ের বন্ধু।
—বাহ! বেশ তো ডাক্তারে ডাক্তারে দেশ দুনিয়া ভইরা গেছে, সারাজীবন তো ফ্রি ট্রিটমেন্ট করা যাবে, তুই তো খুব লাকি রে!
মায়া পাশ ফিরে শুয়ে মুখে চাদর টেনে নিলো দ্রুত এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, খুব দ্রুত।
তবে দ্রুত আর মায়ার ফেরা হলো না ওর বাবার অনুরোধে এবার এমন কিছু ছিল মায়া সহজে ছাড়া পেলো না এ কদিন একবারো মায়া ওর বাসায় আসেনি ফুপির বাসাতেই ছিলো আজ ওর বাবাকে রিলিজ করায় বাসায় এসেছে সাহিত্য এসে সব গুছিয়ে দিয়ে গেছে বাবাকে তার ঘরে দিয়ে খাওয়া শেষ করে ওষুধ দিয়ে মায়া নিজের ঘরে এলো, সবকিছু একদম পরিপাটি ঠিক যেমন মায়া রেখে গিয়েছিলো, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে বিস্বাদ স্মৃতি এখানে মায়ার এই ঘরে, মায়া জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো তবে দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে এলো,চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো, যদি সেদিন হিমালয়ের মা না আসতেন বা ও যদি সেদিন বাসায় না থাকতো! তাহলে কতকিছু অন্যরকম হতো! হিমালয়ের সাথে মায়ার বিয়ের তারিখ যেদিন ঠিক হলো, মায়া ঘরে আসতেই হিমালয় ওর পিছু পিছু এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললো,মায়া একদম অবাক হয়ে গেলো এই কঠিন মানুষ টার ভেতরটা কত্ত নরম! মায়া ফিক করে হেসে বলল,
—কি ব্যাপার? আপনার কি আফসোস হচ্ছে নাকি কাদছেন কেন!
হিমালয় কিছু বলল না শুধু মায়াকে জড়িয়ে ধরে রইলো শুধু যাওয়ার সময় বলল,
—আমার সাতাশ বছরের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া তুমি।অনেক কিছু আমি পারি না আর আজকাল তার মধ্যে অন্যতম একটা হচ্ছে তোমাকে মাথা থেকে বের করতে, এক সেকেন্ডের জন্যেও না।
হিমালয় কিছু তীক্ষ্ণ সুখকর কথা বলে বেরিয়ে গেলো।
যেদিন বিয়ে তার ঠিক আগের দিন হিমালয়ের মা এলেন, মায়ার বাবা একটু বিস্মিত হয়ে বললেন
—ভাবি আপনি?
—মায়া বাসায় আছে ভাইজান?
—হ্যা উপরে
—আচ্ছা আচ্ছা বিয়ের কিছু প্লান ওর সাথে করতে হবে তো তাই…আমি উপরে যাচ্ছি।
হিমালয়ের মাকে দেখে মায়া খুব খুশি হলো, মহিলাটা খুবই সহজ সরল যাকে দেখলেই মমতা নজরে আসে,তবে মায়ার খুশি বেশিক্ষণ থাকলো না
—আন্টি আপনি?আন্টি জানেন সেদিন আপনি যে আংটিটা আমায় দিয়েছিলেন ওটা কিন্তু আমি খুলে ফেলি নি,দেখুন দুটো আংটিই আমার হাতে আছে,
হিমালয়ের মা মায়ার খুব কাছে গিয়ে মায়ার মাথায় হাত রেখে বলল,
—মারে আজ আমি এই আংটিটা ফেরত নিতে এসেছি
মায়া একটু ভ্রু কুচকে তাকালো হিমালয়ের মা মায়াকে বিছানায় বসে হাতে হাত রেখে বলল,
—জানিস মায়া, এই পৃথিবী যদি আমাকে কিছু মাত্র দিয়ে থাকে তাহলে সেটা হিমালয়, আমার যখন বিয়ে হয় তখন সতের কি আঠারো বছর বয়স মামার বাড়িতে থাকতাম বাবা মা বেচে নেই বুঝিসই তো তাহলে আমার ছেলেবেলা কেমন সুখের ছিলো, যার সাথে বিয়ে হলো সেখানে স্বামী রুক্ষ মেজাজী ভোগপন্য শাশুড়ি কাছে আমি বিনি পয়সায় পাওয়া কাজের লোক, উনিশ বছরে যখন বুঝলাম আমার মধ্যে কারো অস্তিত্ব আছে সে শুধুই আমার তখন মনে হলো এবার বুঝি দুঃখ ঘুচলো, তবে পরিস্থিতি এমন ছিল যে আমার স্বামী জোর করে আমার সন্তান নষ্ট করালেন, ব্যাস দুঃখ আরো তীব্র হলো তারপরের ৭ বছরেও আর আমার সন্তান হলো না শ্বশুর বাড়ির জায়গা হারালাম,আমাদের এলাকায় কাজেম ভাই দের বাড়ি তিনি তার বিরাট বড়লোক বন্ধুর সাথে আমার জন্য সম্বন্ধ আনলেন বিপত্নীক, এক সন্তান আছে মাস ছয়েক বয়স,মানে বুঝিস তো তাদের একজন লিগ্যাল আয়া লাগবে,ছোট্ট বাচ্চাটাকে যেদিন আমার কোলে তুলে দেওয়া হয় সেদিন মনে হলো এই তো পেয়েছি সুখ আমায় স্বয়ং ধরা দিয়েছে, বেশ কিছু বছর আমার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল না তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে এতই ভালো বাসতেন যে শোক সামলে উঠতে উঠতে তার বছর লেগে যায় কিন্তু আমি সুখী ছিলাম স্বামী পাবার আগে আমি সন্তান পেয়েছিলাম আমার সন্তান হিমালয়! আমি ওর মা,
মায়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, রেহেনা আহমেদ মায়ার হাত শক্ত করে ধরলেন,
—কাজেম ভাইয়ের কাছে আমার বিরাট বড় ঋণ মায়া, এই পৃথিবীতে এখন আমি আর হিমালয়ের বাবা বাদে তিনিই তৃতীয় ব্যাক্তি যে জানেন আমি হিমালয়ের সৎ মা, তোর সাথে হিমালয়ের বিয়ে হলে,কথা খুব কষ্ট পাবে তিনি হিমালয় কে জানিয়ে দেবেন মায়া, বাকি জীবন হিমালয়ের কাছে আমার সৎ মা পরিচয়ে বেচে থাকতে হবে,
হিমালয়ের মা মায়ার পা ধরে বসে পড়লেন
—মা তুই দয়া কর আমায়, এই বিয়েটা তুই করিস না আমি তোর কাছে আমার সন্তান চাচ্ছি মায়া আমার হিমালয়
মায়া কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলো ওর মাথার মধ্যে কিচ্ছু ঢুকলো না, মায়া জানে হিমালয়ের কাছে ওর মা কি! আর কতটা, মায়া এটাও জানে যে মায়ার কাছে হিমালয় কি! মায়া ভাবলো ওর সাথেই বারবার কেন এরকম হয় ওর কি দোষ! ওর কোথায় অন্যায় মায়া হিমালয়ের মায়ের সামনে মাটিতে বসে পড়লো, অনেকটা সাহস নিয়ে বলল,
—আপনি তো মহারাজ কে চেনেন আন্টি, উনি কখনোই আপনাকে….
—আমি জানি আমার হিমালয় কেমন কিন্তু মায়া আমি আমার স্বামীর কাছে দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে থাকতে পারলেও আমার সন্তানের কাছে কিভাবে দুই নম্বর হয়ে বেচে থাকব!
—আন্টি আমি মহারাজ কে ভালোবাসি
—কথাও হিমালয় কে খুব ভালোবাসে মায়া, সেই ছোটবেলা থেকে….কিন্তু হিমালয়…
মায়া তাজ্জব হয়ে বসে রইলো মনে হচ্ছে এক্ষুনি দুনিয়া অন্ধকার হয়ে ও পড়ে যাবে, অদ্ভুত! ও ঠিকই বসে রইলো মধ্যমা থেকে আংটিটা খুলে রেহেনা আহমেদেএ হাতে দিয়ে বলল,
—আপনার ছেলে একান্তই আপনার আন্টি আমি অতি নগন্য আমার কোনো ক্ষমতা নেই আপনাদের সংসার নষ্ট করার।আপনি কাজেম আংকেলকে বলবেন আন্টি, কথা আপুকে আমিও খুব ভালোবাসি, কথা আপু আমায় বড় বোনের মত ভালোবাসা দিয়েছে,আমি দুদিন এসে কোনো অধিকার রাখি না তার পৃথিবীটা নষ্ট করে দেওয়ার।
চলবে….
সামিয়া খান মায়া