#হৃদপিন্ড_২
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পার্ট_১৫
_______________
সাত দিন যাবৎ দিন রাত এক করে বুঝিয়ে যাচ্ছে মুরাদ মুসকান কে। কিন্তু আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না৷ খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা কথা বলা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে মেয়েটা। তাঁর আচরণেই পরিলক্ষিত হচ্ছে তাঁর ম্যাচিওরিটির অভাব। নয়তো এভাবে এতোটা কেউ ভেঙে পড়ে?
মুসকানের শারীরিক, মানসিক দু অবস্থা দেখেই তাঁর মা মরিয়ম আক্তার ক্ষেপে গেলেন। ছেলের জেদের জন্য মেয়েটা দিন দিন এভাবে শেষ হয়ে যাবে আর মা হয়ে সে চুপচাপ নিরব দর্শক হয়ে দেখে যাবে? কখনোই না৷ অল্প ভাত নিয়ে মুসকানের সামনে বসে আছে মরিয়ম আক্তার। মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে কিছুটা মাংস নিয়ে মেয়ের মুখে দিলেন। অনিহা নিয়ে খাবারটা মুখে পুড়ে নিলো মুসকান। একগাল ফুলিয়ে বসে আছে। চোখ, মুখ দেখে মনে হবে কতো অসহায়, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান সে। অথচ তাঁর এই করুন অবস্থার জন্য দায়ী দু বন্ধু। তাঁদের মধ্যে একজন তাঁর ভাই আরেকজন তাঁর ভালোবাসার মানুষ। দু লোকমা ভাত খেতেই গা গুলিয়ে বমি করে দিলো মুসকান। মরিয়ম আক্তারের দুচোখ ভরে এলো৷ এভাবে চলতে থাকলে এই মেয়েকে যে বাঁচানো সম্ভব হবে না৷ মা হয়ে সন্তান কে এভাবে প্রতিনিয়ত নিঃশ্বেষ হতে দেখা যে আর কুলোয় না।
.
মুরাদ স্কুলে চলে গেছে ভাসুরও বাড়িতে নেই। রিমি আর নিলুফা ছাড়া আর কেউ নেই। তাই ভাবলো ইমনকে ফোন করে বাড়ি আসতে বললে কেমন হয়?ভাবা মাএই মেয়ের সামনে ফোন করলো ইমনকে। ভাগ্য ভালো আজ ইমনের অফিস নেই৷ সে নিজের রুমে বসে কিসব কাগজপএ ঘাটাঘাটি করছে। সে সময়ই বেজে ওঠলো ফোন। স্ক্রিনে মরিয়ম আক্তারের নাম্বার দেখেই চমকে গেলো সে। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। হৃদপিন্ড যেনো ধাপড়া-ধাপড়ি শুরু করে দিয়েছে। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন রিসিভ করলো। গলাটা এমনভাবে শুকিয়ে গেছে যে হ্যালোটুকুও বের করতে পারলো না। তাঁর কিছু বলার অপেক্ষায় না থেকেই মরিয়ম আক্তার আদেশের সুরে বললেন,
—– আব্বা তুমি যদি ফ্রি থাকো ব্যাস্ততায় না থাকো এখনি এসে আমার আম্মাকে সামলাবে। আমার আম্মার যদি কিছু হয় আমি কিন্তু কোনদিন তোমাকে ক্ষমা করবো না। আমার ছেলে না হয় পাগল, অবুঝ তুমি তো তেমন না আব্বা তাহলে তুমি কেনো আমার আম্মা কে এতোটা ভোগাচ্ছো?
উত্তেজনায় হাত কাঁপছে ইমনের সেই সাথে বুকের ভিতর শুরু হয়েছে উথাল-পাতাল। “মুসকান কি করছে? কি এমন হয়েছে যে এভাবে সামলাতে বলছে? মারাত্মক কিছু করে বসেনিতো? না তা কি করে করবে তা হলে কি কাকিমা এতোটা স্বাভাবিক হয়ে কথা বলতো”? নানারকম চিন্তার মাঝে ফোন কেটে দিলো ইমন৷ দ্রুত সব কিছু গুছিয়ে রেখে পড়নের কাপড় পাল্টে ঘড়ি,ফোন, ওয়ালেট নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
.
জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে মুসকান। তাঁর সামনে চেয়ারে বসে আছে ইমন। মরিয়ম আক্তার রান্না বসিয়েছেন এতো দিন পর ইমন এসেছে। তাঁর বাবা এসেছে না খাওয়িয়ে কোন মতেই যেতে দেবে না। রিমিকে দিয়ে কফি পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে ইমন চুপ হয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে মুসকানের দিকে৷ ভয়ে ভয়ে একটু করে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললো মুসকান৷ ইমন একইভাবে চেয়েই আছে। গলা শুকিয়ে গেছে, বুকের ভিতর ধড়ফড় ধড়ফড় করছে মুসকানের৷ যে মানুষ টাকে কাছে পাওয়ার জন্য এতো উতলা ছিলো এ কটা দিন। যাকে এক নজর দেখার জন্য বুকটা খাঁ খাঁ করছিলো সেই মানুষ টার থেকেই এখন পালাতে ইচ্ছে করছে। ইমন চোখ দিয়ে যেনো শত শাসন করছে আর মুসকান ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দুজনের অমন শোচনীয় অবস্থায় রিমি ঢুকলো রুমে৷ ইমনকে কফি দিতেই সে গম্ভীর কন্ঠে বললো খাবেনা। রিমি জোর করতে গিয়েও থমকে গেলো। ইমনের চোখ জোরা দেখে ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেলো তাঁর। মুসকানের দিকে এক পলক চেয়ে জোর পূর্বক হেসে দ্রুত রুম ছেড়ে বেড়িয়ে বুকে দুটো ফুঁ দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে গেলো রান্না ঘরে।
রিমির যাওয়ার পরই ইমন বসা থেকে ওঠে দরজাটা ঠাশ করে লাগিয়ে দিলো। দরজার শব্দে কেঁপে ওঠলো মুসকান৷ ভয়ে এবার তাঁর চোখ উপচে পানি বের হতে লাগলো। ইমন বিছানায় গিয়ে বসলো। মুসকান নিজেকে আরেকটু গুটিয়ে নিলো। তা দেখে ইমন আরেকটু সড়লো মুসকানের দিকে। মুসকানও আরেকটু সড়ে গেলো৷ মিনমিন করে বললো,
—– আমি আম্মুর কাছে যাবো।
—– কেনো আমার কাছে আসার জন্য এতো কাহিনী করলি এখন কাছে এসেছি তো এখন আম্মু আম্মু করছিস কেনো?
হুহু করে কেঁদে ওঠলো মুসকান৷ ভাঙা আওয়াজে বললো,
—– বিশ্বাস করো নানাভাই আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি পারিনি। আমার গলা দিয়ে খাবার নামে নি। আমার কোন কিছুতে মন বসেনি। শুধু কান্না পেয়েছে। দাদাভাই যখনি ওসব বলতো তখনি আমার ভয় হতো কান্না পেতো। আমি কিছুতেই মন বসাতে পারিনা। রাতেও দুঃস্বপ্ন দেখি। প্রতিটা স্বপ্নেই হয় তুমি হারিয়ে যাও আমার থেকে নয়তো আমি হারিয়ে যাই তোমার থেকে। আমি পারছিনা আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি এসব আর নিতে পারছিনা। বলেই হেচকি তুলে কাঁদতে শুরু করলো মুসকান।
রাগ অনেকটাই পড়ে গেলো ইমনের। এমন মুখের এমন বানীতে কি করে রেগে থাকবে সে? কিন্তু এ দৃশ্যও তো সহ্য করা যায় না৷ কতোটা রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা৷ আবার চোখ ফাটিয়ে কাঁদছেও কান্না দেখে আবারো মেজাজ বিগরে গেলো এক ধমক দিয়ে বললো,
—– চুপপ। একদম কাঁদবি না। প্রেমিকা হয়ে গেছিস মহাপ্রেমিকা? নিজেকে কি মজনুর লায়লি মনে করছিস? কতো বার বলেছি তোকে ছয় দিন আগে গভীর রাতে এতো কষ্ট করে গেট টপকে এসে দেখা করে গেলাম৷ পই পই করে বলে গেলাম নিজের যত্ন নিবি। অন্তত খাবারটা ঠিকভাবে খাবি। আমি ঠিক সময় তোকে আমার কাছে নিয়ে যাবো একটুকু ধৈর্য্য নেই?
মুসকানের কান্না দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। ইমন আরেক ধমক দিয়ে বললো,
—– তুই থামবি নাকি কানের নিচে লাগাবো কয়টা?
মুসকান চুপ হয়ে অবুঝ চোখে তাকালো। ওর অমন চাহনী দেখে রাগ পড়ে গেলো ইমনের মুখে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
—– কানের নিচে তো তোর আকর্ষণীয় একটা তিল আছে যা আমাকে মারাত্মক ভাবে ঘায়েল করছে। ওখানে কি হাত লাগাবো নাকি ঠোঁট লাগাবো বল তো?
মুসকান লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিলো। ইমন বললো,
—– দেখ মুসু একদম এমন আচরণ করবি না। সারাদিন কাজের চাপে থাকি। তারওপর তোর হিটলার ভাই তোর সাথে দেখা করার সব সহজ পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তুই ও না খেয়ে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছিস৷ এতো চাপের মাঝেও তোর জন্য প্রতিটা রাত কতোটা ছটফট করি সে আমি আর ওপরওয়ালাই জানি। একদম আমার সাথে অভিমান দেখাবি না৷ সব দোষ তোর ভাইয়ের আমার কোন দোষ নেই।
মুসকান নিশ্চুপ। ইমন মোহময় চোখে চেয়ে মুসকানকের ডান হাত নিজের হাতে মাঝে নিলো। হাতের উল্টোপিঠে কিস করে বললো,
—– এতো অবুঝ কেনো তুই? আমার কথাগুলো মেনে চল সব ঠিক হয়ে যাবে। মুরাদ যাই বোঝাক তুই শুধু শুনবি। এসব নিয়ে কোন প্রকার চিন্তা করবি না। আমি আছি তো আমি থাকতে তোর এতো চিন্তা কিসের? তুই শুধু নিজের যত্ন নে। আমাকেও ভালোবাসতে হবে না মুসু আমাকে ভালোবাসার অনেক সময় পাবি শুধু নিজেকে সময় দে। আমার ভালোবাসা কে আর কষ্ট দিস না।
মুসকান বোকার মতো চেয়েই রইলো। ইমন এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওকে টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে এলো। কপালে আলতো স্পর্শ ছুঁইয়ে দিয়ে আগাগোড়া ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো,
—– অনেক শুকিয়ে গেছিস মুসু৷ শরীরে এক টুকরো মাংস পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এটুকু মেয়ে হয়ে আমাকে ভালোবাসার সাহস দেখিয়েছিস। শুধু ভালোবাসার সাহস দেখালেই তো চলবে না মুসু। আরো অনেক সাহসী হতে হবে৷ নিজেকে ইমন চৌধুরীর অর্ধাঙ্গিনী হয়ে ওঠার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। সারাজীবন ইমন চৌধুরীকে সামলাতে হবে তোর। কিন্তু তুই যা করছিস এতে তো আমি ভরসা পাচ্ছি না৷
—– কি করেছি আমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই তো তোমার জন্য কষ্ট পাচ্ছি।
—– না খেয়ে দেয়ে কঙ্কাল হয়ে গেলেই সেটাকে ভালোবাসা বলে না মুসু৷
—– তুমি আমাকে কঙ্কাল বললে? তুমি আমার ভালোবাসা না দেখে আমার শরীর দেখছো? বলেই অভিমানে দূরে সরে যেতে চাইলো মুসকান।
ইমন তাঁকে জোর করে নিজের দিকে ফেরালো। রাগি গলায় বললো,
—– অযথা রাগবি না একদম। আমি শরীর দেখছি না। শরীর দেখলে তোর মতো চুনোপুঁটিকে আমি ভালোবাসতাম?
—– আমি চুনোপুঁটি? ছাড়ো আমাকে আমি থাকবো না তোমার কাছে৷ কেঁদে দিয়ে বললো মুসকান।
ইমন জোর করে বুকে জরিয়ে নিয়ে বললো,
—– আরে আরে শুধু রেগে যায়। পুরো কথাটা তো শোন।
—– শুনবো না আমি, ছাড়ো।
—– মুসু শান্ত হো দেখ দেখ আমার বুকের ভিতর কেমন বাজনা বাজছে তুই চুপ করে শোন আর আমি তোকে বোঝাই।
মুসকান চুপ হয়ে গেলো৷ ইমনের বুকে গভীরভাবে মাথাটা রাখলো সে। ইমন মৃদু হেসে মুসকানের এক হাত নিজের একহাতের মুঠোয় নিয়ে আদুরে গলায় বোঝাতে লাগলো,
—– দেখ আমি কতো বড়সড় মানুষ। আমার হাতও দেখ তোর দুটো হাতের সমান৷ দেখেছিস দেখ এই মাপ দিলাম দেখ প্রমাণ সহ দেখিয়ে দিলাম৷ এই হাত আর বড় হবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। তোর হাইটও বাড়ার নিশ্চয়তা নেই। তবে যা আছে আমার চলবে নো প্রবলেম। কিন্তু ধর তুই এমন পাঠকাঠির মতোই রয়ে গেলি৷ বিয়ের পর কোন কিছু নিয়ে আমার মেজাজ খারাপ হলো। রেগে শক্ত করে একটা থাপ্পড় দিলে তোর গালের হাড়গোড় তো ভেঙে যাবে এখানে তো এক টুকরো মাংসও নেই। বলেই গালে স্পর্শ করলো। মুসকান চমকে তাকালো ইমনের দিকে।
ইমন আবার তাঁর হাত চেপে ধরে বলতেই থাকলো।
—– কোনদিন এই হাত শক্ত করে চেপে ধরলেই তো ভেঙে যাবেরে।
মুসকান ফুঁপিয়ে ওঠলো। বললো,
—– তুমি আমাকে বিয়ে করে এতো মারবে নানাভাই?
—– অবশ্যই কেনো নয়? নানাভাই নানাভাই করে প্রতিনিয়ত আমাকে বুড়ো উপাধি দেওয়ার শাস্তি না দিয়ে এমনি এমনি ছেড়ে দিবো?
ফোঁপানির শব্দ বেড়ে গেলো এবার। ইমন মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
—– আচ্ছা ওসব না হয় বাদ। একটু আদর করতে গেলেও তো তুই বিছানার সাথে মিশে যাবি মুসু।
মুসকান কিছু বললো না ইমন পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে বললো,
—– আমি যেনো এরপর তোকে এরূপে না দেখি। তাহলে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। শরীরের এই হাল দেখলে আর বিয়ে করতে মন চায় না আমার। বলেই পিঠে হাত বুলালো ইমন।
মুসকান সরে গিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললো,
—– তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তুমি এমন করে কেনো বলছো? তুমি জানোনা ভালোবাসলে মন দেখে ভালোবাসতে হয় শরীর নয়।
—– ও তাই নাকি জানতাম না তো তুই মন দেখে ভালোবেসেছিস তাহলে?
—– তা নয় তো কি? তুমি অনেক সুন্দর কিন্তু তোমার মতো সুন্দর সুন্দর ছেলে তো আরো আছে কই আমিতো তাদের ভালোবাসিনি। তুমি ইয়া বড় মানুষ আমি চাইলেই তো পারতাম আমার সমান সমান কাউকে ভালোবাসতে কই বাসিনিতো।
—– না তুই চাইলে পারতি না৷ বাহুতে শক্ত করে চেপে কথাটা বললো ইমন।
মুসকান ভয়ে এক ঢোক গিলে বললো,
—– সত্যি সত্যি না বোঝাচ্ছিলাম।
ইমন এক আঙুলে মুসকানের ঠোঁট চেপে ধরে বললো,
—– কিছু বোঝাতে হবে না। আমি ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাববিনা মুসু। আমি ছাড়া তোর মনের দুয়ারে কাউকে কখনো ঠাই দিবিনা ওকে?
—– হুম। মাথা নাড়ালো মুসকান।
ইমন মুসকানের ঠোঁটের দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
—– চোখ বন্ধ কর।
মুসকান চোখ তুলে তাকালো ইমনের চোখের দিকে। ইমন ইশারা করল চোখ বুজতে। মুসকান চোখ বুজলো তবে তাঁর চোখের পাপড়িগুলো অনবরত কাঁপছে। ইমন মৃদু হেসে এগিয়ে গেলো তাঁর ঠোঁটের দিকে। ইমনের মুখের গরম শ্বাস মুসকানের মুখে পড়তেই ওর শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন হয়ে এলো দুরুদুরু বুকে মুখ সড়িয়ে ফেললো সে। ইমনের খুব ইচ্ছে করছে একটুখানি ছুঁয়ে দিতে কিন্তু মুসকান তাঁর সে ইচ্ছে পূরণ করবে না৷ করলেও সেটা হবে এক পাক্ষিক চোখ বুজে ফেললো সেও৷ কয়েকদফা ঘন শ্বাস ছেড়ে সিদ্ধান্ত নিলো সরে যাবে। কিছু ইচ্ছে দমিয়ে রাখাই ভালো। আবারো চোখ খুলতেই দেখলো মুসকান ঘাড় ঘুরিয়ে ঘনঘন শ্বাস ছাড়ছে। ঘাড়ে থাকা তিলটাও চোখ এড়ালো না তাঁর। আচমকাই মুসকান কে টেনে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো সে।
.
দরজায় শব্দ হতেই ইমন মুসকান কে ছেড়ে দিলো ইমন৷ মুসকানের শরীরের তীব্র কম্পন ইমনের বুকের ভিতর তীরের মতো আঘাত করছে। এ আঘাতের যন্ত্রণা কতোখানি তীক্ষ্ণ তা শুধু সেই জানে। দ্রুত মুসকানের ওড়না ঠিক করে দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—– রিল্যাক্স কিছু হয়নি। স্বাভাবিক রাখ নিজেকে। বলেই ওঠে গিয়ে দরজা খুললো।
—– ভাইয়া মুসকান কে নিয়ে খেতে আসুন আম্মা ডাকছে। বললো রিমি।
—– ওকে দুমিনিটে আসছি।
_________________
অনেক দিন পর পেট ভরে ভাত খেলো মুসকান৷ সামনে বসিয়ে ইমন মুসকানকে মন ভরে খাওয়িয়েছে মরিয়ম আক্তার। খাওয়া শেষে সবেই ওঠেছে ইমন৷ তখনি ঝড়ের গতিতে বসার ঘরে ঢুকে ইমনের কলার চেপে ধরলো মুরাদ। মা,বোন, স্ত্রীর সামনে বিশ্রি একটা গালি দিয়ে বললো,
—– কোন সাহসে আমার বাড়িতে ঢুকেছিস তুই৷ বেরিয়ে যা আর এক সেকেন্ডও যেনো এখানে না দেখি।
ইমন এবার তাঁর আসল রূপে ফিরে এলো। কয়েক মূহুর্তের জন্য ভুলে গেলো তাঁর সামনে মরিয়ম আক্তার আর মুসকান রয়েছে৷ তাঁর এরূপে মুসকানের মনে তাঁর জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে তা একবারের জন্যও ভাবলো না। মুরাদের কলার চেপে মেঝেতে শুইয়িয়ে হিংস্র জন্তুর মতো গর্জন করে বলে ওঠলো,
—– বোন কে দিয়ে দে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ইমন চৌধুরী কেনো তাঁর বাড়ির কাজের লোকও কোনদিন পা ফেলবে না। বলেই মুখ বরাবর দিলো এক ঘুষি।
#হৃদপিন্ড_২
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পার্ট_১৬
ইমন মুরাদের তর্কবিতর্ক চলছিলো। মুসকান দুহাতে মুখ চেপে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। মরিয়ম আক্তার গর্জন তুলে মুরাদকে বললো,
—- মুরাদ! তোর জন্য আমার মেয়েটার যদি কোন ক্ষতি হয় সকলের সম্মুখে গলায় দড়ি দিব আমি। বলেই তিনিও দৌড়ে মুসকানের রুমের দিকে ছুটলেন।
মুরাদের চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। গায়ের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ইমনের হাত ছাড়িয়ে নিচে ফেলে পেটের ওপর বসে কলার চেপে ধরে হুংকার ছাড়লো,
—- বিয়ে করবি আমার বোনকে? আমার বোনকে তোর চাই? তাহলে যা গিয়ে নিজের পরিবার কে নিয়ে আমার বাড়িতে আয় দুদিন সময় দিলাম এই দুদিনের মধ্যে তোর পরিবার কে আমার বাড়িতে দেখতে চাই। মনে রাখিস যা কথা তাই কাজ এর বাইরে কিছু হলে যতোই বাবাগিরি দেখাস কাজ হবে না। বাবাকে ছাড়া বাবাগিরির মূল্য নেই।
মুরাদের শেষ বাক্যটুকুই যথেষ্ট ছিলো গভীর কিছু উপলব্ধি করার জন্য। এই একটা কথায় কিছু একটা ছিলো যা ইমনের জ্বলজ্বল করে ওঠা রাগটা দপ করে নিভিয়ে দিলো। শান্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,
—- সত্যি করে বল মুরাদ কি হয়েছে? কি লুকাচ্ছিস তুই আমার কাছে?
ধরা পড়ে গিয়ে দুহাত নরম হয়ে এলো মুরাদের। অশান্ত দৃষ্টি ফেললো চারপাশে ইমনের থেকে সড়ে গিয়ে। শার্টের কলার ঠিক করে হাতা গুটিয়ে ময়লা ঝেড়ে পিছন মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে বারকয়েক শ্বাস নিলো। ইমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে গায়ে পরিহিত শার্টের কয়েকটা বোতাম লাগাতে লাগাতে বাঁকা হাসি দিয়ে শান্ত গলায়ই বললো,
—- তাহলে এই ব্যাপার অথচ আমি কি ভুল ধারণা নিয়েই না ছিলাম। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো। আমার বন্ধুর প্রতি বিশ্বাস এবং ভরসা রাখাও উচিত ছিলো। সরি দোস্ত!
—- নেকামো না করে বাড়ি থেকে বিদায় হো। তোর মুখও আমি দেখতে চাইনা। বলেই পিছন ঘুরে আবারো কলার চেপে ধরলো বললো,
—- আমার বোনের কিছু হলে খুন করে ফেলবো তোকে আমি।
—- কিচ্ছু হবে না বর রাজি,বউ রাজি, বন্ধুও রাজি আর কি চাই? বলেই শক্ত করে জরিয়ে ধরলো মুরাদ কে।
মুরাদ তাচ্ছিল্য সুরে বললো,
—- যা যা এতো দরদ দেখাতে হবে না। বের হো বাড়ি থেকে।
ইমন মাথা চুলকে অমায়িক এক হাসি দিয়ে বললো,
—- পাগলীটাকে দেখে রাখিস আর বোঝাস আমি শিঘ্রই আসবো।
______________
আকরাম চৌধুরী সুবিবেচক মানুষ। তাঁর বিচার-বিবেচনা সর্বদাই প্রশংসনীয় এবং সম্মানীও। ছেলে যতোই উচ্চশিক্ষিত হয়ে উচ্চ পদে কর্মরত থাকুক। ছেলে তো ছেলেই। যে বাবা,মা ছেলেকে আম গাছ, জাম গাছ চিনতে শিখিয়েছে। আকাশ, মাটির পার্থক্য বুঝতে শিখিয়েছে। আগুনে স্পর্শ করলে হাত পুরে ছাই হয়ে যাবে বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে আগুন, পানির বিভেদ। সেই বাবা-মা কি ছেলের অমঙ্গল চাইতে পারে? বা ছেলের জীবনে আকস্মিক ভাবে কোন দূর্ঘটনা ঘটে যাক এই প্রত্যাশা করতে পারে? সন্তানরা শিশু বয়সে ভুল ভ্রান্তি করলে যেমন বাবা-মা শুধরে দেয় তেমনি প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েও যদি কোন ভুল করতে যায় বাবা-মায়ের উচিত সঠিক পথ দেখানোর। সন্তান বড় হয়েছে বলে তাঁরা কখনো ভুল করবে না এমন ধারণা কখনোই মনে পুষিয়ে রাখা উচিত নয়। ভুল শুধু শিশুরাই করে না। ভুল প্রাপ্ত বয়স্করাও করতে পারে। বাচ্চাদের ভুল শোধরানো যায় কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্কদের করা ভুল শোধরানো যায় না। তাদের করা ভুলের মাশুল আজীবন দিতে হয় পস্তাতে হয় পুরো জীবন।
ড্রয়িং রুমে সোফায় পাশাপাশি বসে আছে আকরাম চৌধুরী এবং ইমন চৌধুরী। ইরাবতী উত্তেজনায় ছটফট করছে। ছেলের উৎসুক চাহনী আর স্বামীর গম্ভীর মুখশ্রী তাঁর উত্তেজনাকে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। দৃষ্টি নিভে গেলো ইমনের ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে দৃষ্টি স্থির রাখলো। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল মেঝেতে ঘষছে অনবরত এই বুঝি নখটা ঘষায় ঘষায় উঠে গিয়ে চামড়া ভেদ করে রক্ত বেরিয়ে আসে। আকরাম চৌধুরী সেই যে চুপ হয়েছে না কোন কথা বলছে আর না আশেপাশে চেয়ে দেখছে। তাঁর আটাশ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক এবং উচ্চপদে কর্মরত ছেলেটা আজ তাঁর কাছে অবিশ্বাসী এক আবদার করে বসেছে। এতোদিন আড়াল থেকে সব বুঝলেও টু শব্দ টি করেনি। আবেগের বসে ভুল করছে সময় পাস করছে একসময় ঠিক হয়ে যাবে ভেবেই এ বিষয় নিয়ে প্রথমে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু যতোদিন বাড়তে লাগলো বিষয়টা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছিলো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ছেলের বিয়ে দেবে। সেটাও ভেঙে দিলো ইমন। এবার সরাসরি এসে আবদার করছে তাঁর মুসকান কে চাই। বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেও বলছে ভাবতেই কপালের রগ দপদপ করছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাচ্চা একটা মেয়ে। পারিবারিক অবস্থা না হয় দাঁত কামড়ে হজম করা যেতো কিন্তু বয়স? সমাজে মুখ দেখাবে কি করে সে? আইনি লোক হয়ে এমন কাজ করাও তো অপরাধ। তাঁর ছেলের যেখানে ছোট,ছোট ছেলেমেয়ের বাবা হয়ে তাঁদের সাথে হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়িময় উচ্ছাস করে বেড়ানো উচিত সেখানে কিনা হামাগুড়ি দেওয়া এক মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে বিয়ে করার চিন্তা করছে? মান সম্মান আর রাখবেনা এই ছেলে। সেই সাথে আইনের চোখেও অপরাধী করে ছাড়বে। যে করেই হোক এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে ভেবেই মুখ খুললেন আকরাম চৌধুরী।
—- তুমি যা বলছো ভেবে বলছো না কিন্তু আমি যা বলছি খুব নিখুঁত ভাবে ভেবে সন্তর্পণে বিবেচনা করেই বলছি। ঐ মেয়ের চিন্তা মাথায় থেকে ঝেড়ে ফেলো। আগামীকাল আমার বন্ধু আর বন্ধুর মেয়েকে ইনভাইট করেছি। এনগেজমেন্ট সেড়ে ফেলবো।
চটে গেলো ইমন। বসা থেকে ওঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—- আমি মুসকান ব্যাতিত অন্যকাউকে বিয়ে করবো না। তোমরা যদি মুরাদের বাসায় যেতে না চাও জোর করবো না। আমার টা আমি বুঝে নিতে জানি। বেশ দাম্ভিকতার সাথে কথাগুলো বলে ইমন চলে যেতে নিলো।
আকরাম চৌধুরীও ফুঁসে ওঠলো। ইমনের হাতটা চেপে ধরে নিজের পাশে বসালো। ইমন বেশ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। প্রচন্ড রেগে গেছে সে। বুঝতেই আকরাম চৌধুরী তাঁর মাথায় নিজের ডানহাতটা চেপে ধরে অত্যন্ত স্নেহময় গলায় বললেন,
—- রিল্যাক্স মাই বয়৷ তুমি নিজেরটা বুঝে নিতো জানো এটা সবাই জানে আমিও এই জানার বাইরে নেই। তুমি আমার একমাএ সন্তান একমাএ অবলম্বন। তোমার জীবনে মঙ্গল ব্যাতিত অমঙ্গল চাইনা আমি।
বলেই ইরাবতীর দিকে তাকালো। ইরাবতী স্বস্তির এক নিশ্বাস ছেড়ে বাবা, ছেলের জন্য কফি বানাতে চলে গেলো। আকরাম চৌধুরীও স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ইমনের একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন। বললেন,
—- মেয়েটা পারিবারিক দিক দিয়ে আমাদের সাথে জায় না। তাছাড়া মেয়েটাকে তোমার পাশে একেবারেই বেমানান লাগে গায়ের রংটাও,।
বাকিটুকু শেষ করতে দিলো না ইমন। গর্জে ওঠে বললো,
—- প্লিজ বাবা এবার অন্তত এটা বলো না মুসু কালো হ্যান ত্যান।
—- তা না তোর জন্য আরেকটু চড়া কালার প্রয়োজন।
—- এই অহেতুক কথা প্লিজ বাদ দাও। আমি শপিং মলে গিয়ে শার্ট-প্যান্ট কিনছি না যে গাড় রঙ হালকা রঙ বিবেচনা করবো।
—- বয়সটা নিশ্চয়ই বিবেচনা করা উচিত?
থমকে গেলো ইমন৷ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে ওঠলো,
—- যেখানে দুটো হৃদয়ের মিল রয়েছে সেখানে বয়সটা কোন ফ্যাক্টই না।
—- এই মিল কতোদিন থাকবে একদিন,দুদিন,এক বছর,দশবছর তারপর কি হবে ভেবে দেখছিস?
ইমন বিরক্তি প্রকাশ করে তাকালো বাবার দিকে। আকরাম চৌধুরী ইমনের দিকে আরেকটু ঝুঁকে বললেন,
—- বাবা পুরো একটা জেনারেশনের গ্যাপ ভাবতে পারছিস? যে সময়ে তোর দু, একটা বাচ্চা থাকা উচিত সে সময় ঐ মেয়েটা বিয়ের উপযুক্তই হয়নি। আজ মেয়েটা পরিপূর্ণ আবেগবশত তোকে চায় কাল যখন পরিপূর্ণ বয়সে আসবে আবেগটা কি সেই অপিরণত বয়সেই থেমে থাকবে? কখনোই না। তাছাড়া আইনের চোখেও তুই অপরাধী হয়ে যাবি বাল্য বিবাহ হয়ে যাবে এটা।
ইমন আবারো ওঠে দাঁড়ালো। কঠিন স্বরে বললো,
—- মেনে নেবে না ভালো কথা এসব অহেতুক কথা খরচ করতে কে বলেছে?
আকরাম চৌধুরী আবারো টেনে বসালেন। বেশ রাগি কন্ঠে বলে ওঠলেন,
—- এসব অহেতুক মনে হচ্ছে তোর কাছে? নাকি অহেতুক জেদ তুই করছিস ইমন? জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে তোর। এইসব মিডেল ক্লার ফ্যামিলির সন্তান দের সাথে চলাফেরা করতে দেওয়াই উচিত হয়নি তোকে। মেন্টালিটি পুরো বিগরে দিয়েছে এরা তোর। আজ আমার কথা অহেতুক মনে হচ্ছে তাইনা? কাল যখন বউ পরোকিয়ায় জরাবে তখন এই বাবাকে স্মরণ হবে ঠিকই আফসোস করেও লাভ হবে না।
বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালো ইমন। বাবার দুকাধ বেশ শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
—- পাগল হয়ে গেছো বাবা তুমি এসব কি বলছো?
ইরাবতী এসে চমকিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
—- হচ্ছে টা কি বাপ ছেলে মারামারি করবে এখন? কি এতো সমস্যা তোমাদের? আর তুমি এতো জেদ করছো কেনো? ছেলে যেভাবে খুশি থাকে সেভাবেই খুশি করো।
ইমনের হাত ঝাড়া দিয়ে সড়িয়ে ইরাবতীর দিকে তেড়ে গেলো আকরাম চৌধুরী। চিৎকার করে বলতে থাকলো,
—- মা ছেলে পাগল হয়ে গেছো তোমরা। আশেপাশের খবর রাখো তোমরা? অন্ধ হয়ে দুনিয়ায় বাস করো? অন্ধত্বকে বরণ করে সমাজে টিকে আছো? ঘরে ঘরে এতো ডিভোর্স, পরোকিয়া এসব দেখেও তোমাদের বিবেক নাড়া দেয়না? ছেলের সাথে মূর্খের মতো তাল মেলাবেনা ইরা। তোমার ছেলের বয়স যখন এিশ ক্রস করবে ঐ মেয়ে সবে আঠারোতে পা দেওয়া যুবতী থাকবে। তোমার ছেলের প্রতি তাঁর মন বসবে তো? তোমার ছেলে যখন চল্লিশ ক্রস করবে ঐ মেয়ের তখন পঁচিশ, ছাব্বিশে পদার্পণ করবে তাঁরও একটা মন আছে তাঁরও একটা চাহিদা থাকবে। আমাদের কারো অধিকার নেই কারো কৈশোর নষ্ট করার কারো যৌবন নষ্ট করার। আমাদের সমাজে অহরহ ডিভোর্স, পরোকিয়া কেনো হচ্ছে জানো এইসবের জন্যই হচ্ছে। বাবা-মা মেয়ের জন্য তাঁর থেকে দ্বিগুন বয়সী ছেলেকে বাছাই করে। দাম্পত্য জীবনে ছেলেমেয়েদের মধ্যে পুরো একটা জেনারেশনের গ্যাপ কতোটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে তুমি বুঝতে পারো? ছেলের ভালো লাগবে আকাশ মেয়ের ভালো লাগবে মাটি, ছেলের ভালো লাগবে পাহাড় মেয়ের ভালো লাগবে সমুদ্র। সম্পর্কের অবনতি টা ঠিক এখান থেকেই শুরু হবে। মেয়েটার যে সময়টা ঘুরে,ফিরে আনন্দ, উচ্ছাস করে বেড়ানোর কথা থাকবে ছেলেটার সে সময় সংসার, কাজ,ব্যাস্ততাকে ভালো লাগবে। সন্তানের মুখ দেখার জন্য চাতক পাখির মতো বসে থাকবে। সে সময়টা যে মেয়েটার সন্তান ধারণ করার বয়স না এটা যখন মেয়েটা বোঝাতে চাইবে লেগে যাবে গন্ডগোল। পারিবারিক অশান্তি থেকে মেয়েরা যখন একটু শান্তির খোঁজ করবে জরিয়ে যাবে পরোকিয়ায় তখনি সংসারে ভাঙ্গন ধরবে। অপরাধী হয়ে যাবে মেয়েটা। নিঃশ্ব হয়ে যাবে ছেলেটা। গাছ বিষ ফল দিলে আমরা গাছের দিকে আঙুল তুলি কিন্তু গোড়ায় বিষ মিশ্রিত পানি যে আমরাই দিয়েছি এটা কজন মনে রাখি?
—- সবাইকি এমন হয়? সত্যিকারের ভালোবাসায় এমন কিছু হয়না কখনোই না। বললো ইরাবতী।
—- হ্যাঁ কিন্তু ভালোবাসা সত্যি এটা কি করে বুঝবে ইরা? পনেরো বয়স বছর মেয়েটার জীবনের আসল মানেটাই বুঝতে দিলে না। দুনিয়াটাকেই চিনতে দিলেনা। তাঁর আগেই চোখে রঙিন চশমা পড়িয়ে দিলে? জগৎ টাকে রঙিন ভাবে উপভোগ কখন করে মানুষ জানো? যখন গোটা দুনিয়াকে সে চিনে ফেলে বুঝে ফেলে। গোটা দুনিয়ার মানুষ সম্পর্কে পুরোটা না জানলেও অর্ধেকাংশ জেনে ফেলে পরেই না রঙিনভাবে সব উপলব্ধি করতে পারে। চিনলাম না জানলাম না রঙিন চশমা পড়িয়ে দিলাম। ঘুরতে ঘুরতে বিরক্ত হয়ে চশমা খুলে একবার প্রকৃত দৃশ্য তাঁর অবশ্যই দেখতে ইচ্ছে করবে।
ইরাবতী নিশ্চুপ হয়ে ইমনের পাশে বসলো। আকরাম চৌধুরী আর কিছু বললো না ছেলের নিরবতা, ভয়ংকর রক্তিম চোখ দুটো দেখে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন। ইরাবতী ছেলের মাথায় হাত রেখে বললো,
—- ইমন তোর বাবার কথাগুলো কিন্তু ফেলে দেওয়া যায় না৷ তুই আমার ছেলে তোর প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে কিন্তু মুসুর ওপর নেই। বাচ্চা একটা মেয়ে ভালোবাসার কি বোঝে বলতো? ওর বয়সে আমি ভালোবাসার ভ ও উচ্চারণ করতাম না। মানলাম যুগ পাল্টেছে ছেলেমেয়ে রা এডভান্স হয়ে গেছে। কিন্তু এটাও তো মানতে হবে ছেলেমেয়েদের এই অকালে পেঁকে যাওয়ার কুফলও রয়েছে অনেক।
মাকে আর কিছু বলতে দিলো না ইমন। হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে উপরে ওঠে গেলো। কিন্তু ইরাবতী পিছু ডেকে বললো,
—- বাবা তুমি চাইলে আমরা কালই যাবো মুরাদের বাসায় কিন্তু আমার মনে হয় তোমারও সময় নেওয়া উচিত এবং মুসুকেও সময় দেওয়া উচিত এতে তোমাদেরই মঙ্গল।
মায়ের বলা শেষ কথাটাকে ইমন সমর্থন জানালো। এবং সিদ্ধান্ত নিলো এদেশ ছেড়েই চলে যাবে সে। অনেক দূরে। যেখানে মুসকান নামক পোকাটা তাঁর মাথায় আর কিলবিল করবেনা করলেও সেটা সয়ে নেবে। কিন্তু এদেশে থাকলে মুসকান থেকে দূরে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু দূরে গেলে মুসকান তাঁকে ভুলে যাবে না তো? বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠলো ইমনের। নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়ে দিহান কে ফোন করলো।
_____________
তিনমাস বাড়ি ছাড়া, শহড় ছাড়া থাকার পর পিএইচডি করার জন্য জার্মানির উদ্দেশ্য পারি জমালো ইমন চৌধুরী। সেদিন বাবা-মায়ের সাথে হওয়া কথোপকথন সে আর মুরাদ ছাড়া কেউ জানতেও পারলো না। তবে তাঁর দেশ ছাড়ার ব্যাপারটা চাপা থাকলো না। তিনমাস মুরাদ মুসকানকে ওটা, সেটা বুঝিয়ে সামলালেও দিহানের সাথে গোপন বৈঠকের এক পর্যায়ে ইমনের জার্মানিতে যাওয়ার কথাটা শুনে ফেলে মুসকান। বাড়িতে শুরু হয় তাণ্ডব। যে তাণ্ডব শেষ মূহুর্তে জঘন্য এক রূপ নেয়। নিজের হাতের শিড়া কেটে ফেলে মুসকান। পুরো সাতদিন হসপিটালের বেডে মরার মতো পরে থাকে সে। মরিয়ম আক্তার বিশ্বাস করতে পারেনা ইমনের এই বিশ্বাসঘাতকতা। তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছিল বিশ্বাস করতে সেই সাথে চোখের সামনে নিজের বাচ্চা মেয়েটাকে আধমরা দেখে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলো। মুরাদ নিজের বোনকে সত্যিটা বলতে পারবেনা। বোঝাতে পারবেনা কিন্তু মা কে পারবে তবুও চুপ রইলো সে। কি লাভ বলে কি লাভ বুঝিয়ে? যা বোঝাপড়া সঠিক সময় এলেই করবেনি ইমন। সম্পূর্ণ দায়ভার ইমনের। তাঁর জন্য মুসকানের আজ কতো বড় ক্ষতি হতে যাচ্ছিলো এই দায়ভারও একদিন তাঁকে ঠিক নিতে হবে। মুরাদ মনে মনে অসংখ্য কথা আওড়িয়ে চুপ রইলো। হসপিটাল থেকে ফিরেও স্বাভাবিক হতে পারলো না মুসকান। দিন যায়,সপ্তাহ কেটে মাস যায় মেয়েটা কেমন মিইয়ে যায়। জীবনটা বিষাদে ছেঁয়ে গেছে মেয়েটার। হারিয়ে গেছে সুখ, হাসি,কান্না,আনন্দ,উচ্ছাস। দিনের পর দিন ধ্বংস হতে থাকলো তাঁর কৈশোর। নিভে যেতে থাকলো বুকের ভিতর সন্তর্পণে জমিয়ে রাখা আবেগে মাখামাখি হওয়া ভালোবাসার আগুনটা। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেলো জীবনটা। আলোর দিকে যতোই টানাটানি করা হোক আপনমন না চাইলে কি আলোর প্রতি ঝোঁক আসবে? তাঁর যে বদ্ধ চোখ খুলতে ইচ্ছে করেনা। তাঁর যে বদ্ধ ঘরের চার দেয়ালেই নিজেকে নিমজ্জিত রাখতে ভালো লাগে। মা, ভাই, যখন বলে ‘সকাল হয়েছে ব্রাশ করে নে মুসু ‘ সে তখন তাচ্ছিল্য হেসে ভাবে ‘সকাল হয় কি করে? রাতের পর সকাল আসে। রাতের অবসান তো ঘটেনি সকাল কি করে হয়? কোথায় সকাল চারদিকে অন্ধকার বই আর কিছু তো তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়না, হয়না তো ‘ বলেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। অবাক হয়ে যায় মুরাদ,অবাক হয়ে যায় রিমি,মরিয়ম আক্তার। সকলেই রাতদিন এক করে বোঝায় মুসকান কে। কিন্তু বোঝাবুঝির অবস্থা কি তাঁর আছে? নেই তো!
.
দুমাস পর-
এলোমেলো হয়ে উষ্কখুষ্ক চুলে বসে এক ধ্যানে মেঝেতে চেয়ে আছে মুসকান। মরিয়ম আক্তার খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলেন। মেয়েকে দেখে বুকটা হুহু করে ওঠলো তাঁর। চোখে পানি বাঁধ মানলো না। মুরাদ যখন মুসকানের অবস্থার কথা ইমনকে জানায়। ইমন ভেঙে পড়ে সিদ্ধান্ত নেয় ফোনে যোগাযোগ করে মেয়েটাকে স্বাভাবিক রাখবে কিন্তু না। মুসকান এক সেকেন্ড এর জন্যও কথা বলেনি এক পলক দেখা অবদি দেয়নি ভিডিও কলে। জোর করে রিমি ইমনের সম্মুখে নেওয়াতে ফোনটা এক আছাড়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,
—- এই স্বার্থপর বেঈমান টাকে আমার সামনে এরপর কেউ নিয়ে আসার কথা ভাবলে নিজেকেই খুন করে দেবো আমি।
ভয়ে আঁতকে ওঠে সকলেই। মুসকানের ঐরূপ সকলের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে ওঠে। ঐ মূহুর্তে মুসকানকে একদমই পনেরো বছর বয়সী বাচ্চা মনে হয়নি। বরং জীবনের কাছে ভালোবাসার কাছে হেরে যাওয়া পরিপূর্ণ এক যুবতী মনে হয়েছে।
.
চোখের পানি মুছে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন মরিয়ম আক্তার। খাবারের প্লেট মেঝেতে রেখে দুহাত জোর করে বললেন,
—- হয় নিজে স্বাভাবিক হো নয়তো আমাকে গলা টিপে মেরে ফেল। দিনের পর দিন সন্তান কে শেষ হতে দেখা মৃত্যু যন্ত্রণার সমতুল্য। মেরে ফেল আমায় মা মেরে ফেল। তোর বাবার কাছে পাঠিয়ে দে আমি আর নিতে পারছিনা রে মুসু নিতে পারছিনা। তোরা দুজন ছাড়া আমার আর কে আছে বল তো?
মায়ের করুণ আর্তনাদ বোধ হয় মুসকানের মন গলাতে পারলো। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। মা মেয়ে জরাজরি করে অনেকটা সময় কেঁদে কেঁদে নিজেদের হালকা করে নিলো। এবং অন্তিম পর্যায়ে ভাঙা আওয়াজে মুসকান বলে ওঠলো,
—- আমি স্বাভাবিক হবো আম্মু একদম স্বাভাবিক হয়ে যাবো। সবাই যদি স্বার্থপর হতে পারে আমি কেনো পারবো না? সবাই যদি নিজের ক্যারিয়ার কে গুরুত্ব দিয়ে নিজের সুন্দর ভবিষ্যতকে গুরুত্ব দিয়ে ভালোবাসা কে তুচ্ছ করতে পারে আমি কেনো পারবো না? মনে রেখো আম্মু মুসকান যদি একবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তাঁকে আর কেউ বাঁকাতে পারবেনা এক উপরওয়ালা ছাড়া। আজকের পর থেকে মুসকান নিজেকে তৈরী করবে। নিজের মতো করে বাঁচতে শিখবে। অতিতের যে মুসকানকে চিনতে সেই মুসকানকে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছি আম্মু নতুনভাবে মেয়েকে বাঁচতে দেখে তোমার কোন আপত্তি হবে না নিশ্চয়ই? তোমার মেয়ে বাচ্চা বাচ্চা বলে আর মুখে ফেনা তুলবে না তোমার মেয়ে কিন্তু বড় হয়ে গেছে। সামনে না আমার পরীক্ষা দাও খাওয়িয়ে দাও। ভালো রেজাল্ট করে ভালো একটা কলেজে চান্স পেতে হবে তো নাকি?
খুশিতে আবারো কেঁদে ফেললো মরিয়ম আক্তার। মুসকান মায়ের কপালে চুমু খেলো। মরিয়ম আক্তার ও মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
—- সন্তান রা মায়ের চোখে সবসময় বাচ্চাই থাকে রে পাগলী।
মুসকান রেগে গেলো পাগলী কথাটা শুনে এই ডাকটা তো ইমন দিতো আদর করে তাই রেগে গিয়ে বললো,
—- তোমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে আম্মু বড় হতে বয়স লাগে না মন লাগে। আর এই পাগলী ডাকটা আমায় আর ডাকবে না আম্মু আমি পাগলী নই। আমি একদম ঠিক আর স্বাভাবিক আছি। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবো। এবং এতো দিন অস্বাভাবিক জীবন কাটানোর জন্য উপরওয়ালার নিকট ক্ষমাও চাইবো। নেক্সট যেনো এই অস্বাভাবিক ভাইরাস আমাকে আক্রমণ তো দূরে থাক আমার আঙিনায়ও না আসতে পারে সেদিকেও পুরোপুরি সচেতন থাকবো।
সমাপ্ত।