#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৪
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
ইমনের সিক্ত বুকে লেপ্টে রয়েছে মুসকান। দু’জনই দু’জনের আর্দ্র উষ্ণতায় মিলেমিশে একাকার। বৃষ্টির বেগ বাড়ার সাথে সাথে ইমনের পায়ের বেগও বেড়ে গেলো। চোখ বুঝে ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে ব্যস্ত মুসকান। ইমনের আর্দ্র শরীরের সুঘ্রাণে মাতোয়ারা মন। কেমন একটা ঘোরে চলে গেছে মুসকান৷ সেই ঘোর থেকেই নাকের ডগা ডাবিয়ে দিলো ইমনের উষ্ণ বুকে। এক পলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সামনে স্থির রাখলো ইমন৷ ওষ্ঠ কোণে ফুটে ওঠলো ঈষৎ হাসি।
গাড়ির ডোর খুলে মুসকানকে অতি সন্তর্পণে বসিয়ে দিলো ইমন৷ তারপর নিজে বসে ডোর লক করে দিলো। আচমকাই চমকে ওঠলো মুসকান। যেনো ভিন্ন এক গ্রহ থেকে সদ্য পৃথিবীতে আবর্তন করেছে সে। ইমন যখন তার সিটবেল্ট বাঁধতে কাছে যায় তৎক্ষনাৎ চিল্লিয়ে ওঠে মুসকান,
“এসব কি হচ্ছে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়? ”
থতমত খেয়ে আবারো কথার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। বলে,
“কি হচ্ছে এসব কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? কোন সাহসে আপনি আমাকে টাচ করলেন বলুন? ”
ততোক্ষণে ইমন সিটবেল্ট লাগিয়ে নিজের সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। মুসকানের শেষ প্রশ্ন শুনে সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
“নিজেকে অনেক বেশীই বড়ো এবং ম্যাচিওর প্রমাণ করতে চাইছো। বাট যতোটা দেখাচ্ছো ততোটাও তুমি নও। ”
“গাড়ি থামান। আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাব না। কোথাও যেতে চাইনা মি. ইমন চৌধুরী। ”
“জাষ্ট স্যাট আপ মুসু! রাগ মানবো, অভিমান মানবো কিন্তু বেয়াদবি নয় ”
সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো ইমন। মুসকান কিছুটা দমে গিয়ে শান্ত গলায় তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করলো,
“আপনি আমায় কোন সাহসে এভাবে নিয়ে আসতে পারেন? এটা কি কোন ভদ্র মানুষের তালিকায় পড়ে? গায়ের জোর আছে বলেই রাস্তাঘাট থেকে একটা মেয়েকে এভাবে তুলে আনবেন? আমি না হয় বেয়াদব আপনি কোন সভ্য, ভদ্র সমাজের বাসিন্দা যে এভাবে নিয়ে আসলেন? কোন অধিকারে এমনটা করলেন আপনি? ”
ছোট মুখে এতো বড়ো বড়ো কথা হজম হচ্ছিল না ইমনের। তারওপর তার সভ্যতা,ভদ্রতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। একত্রিশ বছর বয়সী এক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ’কে মাত্র আঠারো বছর বয়সী এক তরুণী ভদ্রতা, সভ্যতা শেখাচ্ছে! আক্রোশে ফেটে পড়লো ইমন। হুট করেই গাড়ির ব্রেক কষলো। অজানা ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠলো মুসকানের। এক ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে আড় চোখে তাকালো ইমনের দিকে। ইমন চোখে মুখে ক্রোধ ফুটিয়ে চোয়ালজোড়া দৃঢ় করে কিছু বলতে উদ্যত হবে ঠিক তখনি খেয়াল করলো মুসকান কিছুটা ভয় পাচ্ছে । যে ভয়টা তার পুরো মুখশ্রীতেই ফুটে ওঠেছে৷ মেয়েটা হয়তো ভাবছে এখন তাকে জোরালো একটা ধমক খেতে হবে, শুনতে হবে তিক্ত কিছু বুলি। কিন্তু মেয়েটা কি জানে? তার ভয় মিশ্রিত মুখখানি, মায়াবিশিষ্ট দৃষ্টিজোড়া, সিক্ত কোমল ওষ্ঠজোড়ার মৃদু কম্পণ ইমন চৌধুরীর বক্ষঃস্থলে তুলেছে মরণাত্মক ঝড়। এই মোহাবিষ্ট মুখশ্রী, ওষ্ঠকোণের নিম্নাংশে অবস্থিত হার্ট টাচিং তিলক সৌন্দর্য এতোগুলো দিন পর এতো কাছ থেকে দৃষ্টিপাত করতে দেওয়ার জন্য হলেও জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবদি মেয়েটাকে নিজ বক্ষঃস্থলে যত্নে রাখার প্রতিজ্ঞা করবে সে। মেয়েটা কি জানে না ইমন চৌধুরীর হৃৎপিণ্ড সে। এতটুকু ভয় পাওয়া নেহাতই বোকামি। তার বোঝা উচিত ইমন চৌধুরীকে আহত করার জন্য তার ঐন্দ্রজালিক দৃষ্টিজোড়াই যথেষ্ট।
চোখ বুজে ছোট্ট করে একটি শ্বাস ত্যাগ করলো ইমন। তারপর শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মুসকানের দিকে৷ মুসকান কাঁচুমাচু হয়ে বসে রইলো। ইমন তার কাঁচুমাচু ভণিতা দেখে স্মিথ হেসে শান্ত ভণিতায় মোহনীয় সুরে উত্তর দিলো,
“বন্ধুর বোনের সাথে আমার কিসের সম্পর্ক তা পুরো পৃথিবীর লোক জেনে গেলো অথচ বন্ধুর বোনই জানলো না! ”
বিস্ময়ান্বিত হয়ে তাকালো ইমন মুসকান চুপসে গেছে দেখে মুচকি হেসে বললো,
“রিল্যাক্স জানানোর ব্যবস্থা শিঘ্রই করছি। আর হ্যাঁ এ পৃথিবীতে যেসব পুরুষদের বন্ধুর বোন রয়েছে তাদের সকলেরই বন্ধুর বোনের প্রতি কিছু ন্যায্য অধিকার রয়েছে। তাই এ মূহুর্তে আমি সে অধিকারেরই সৎ ব্যবহার করছি।”
আশ্চর্যান্বিত হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মুসকান ইমন ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসি বজায় রেখেই গাড়ি স্টার্ট দিতে উদ্যত হবে এমন সময় হাঁচি দিয়ে ওঠলো মুসকান৷ পরপর দু’টো হাঁচি দিতেই ইমনের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো৷ সেই সাথে চোখে মুখে ফুটে ওঠলো দুঃশ্চিতার ছাপ। অস্ফুট স্বরে ‘ওহ শীট’ বলেই বিচলিত হয়ে মুসকানের ওড়নায় স্পর্শ করলো। মুসকান চমকে ইমনের হাতের ওপর নিজের হাত রাখতেই ইমন সে হাত সরিয়ে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাঁধে লাগানো সেপ্টিপিন গুলো খুলে ফেললো। কাঁদো কাঁদো মুখে মুসকান বললো,
“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না আমি কিন্তু চিল্লাবো। ”
ইমন শান্ত গলায় বললো,
“যতো খুশি চিল্লাতে পারো শুধু আমার কাজে বাঁধা দিও না। ”
“মানে!”
আর কোন কথা বললো না ইমন। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে ওড়না চিপে পানিটুকু গাড়ির জানালার বাইরে ফেলে ঘুরে বসে মুসকানের মাথা মুছতে শুরু করলো৷ বিস্ময়ান্বিত হয়ে স্থির বসে রইলো মুসকান। কি করে রাগ, অভিমান ধরে রাখবে সে? জাদুরাজ যে তার ভালোবাসা, যত্ন দিয়ে ঠিক বশীভূত করে নেবে তাকে৷ কান্না পেয়ে গেলো তার পরোক্ষণেই ভাবলো কাঁদলে চলবে না বরং মানুষ টা কে কিছুটা শাস্তি দিতে হবে। সেই সাথে উত্তর দিতে হবে তার সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা প্রশ্নগুলোর।
দীর্ঘসময় মাথা মুছে গায়ের কাপড়ের ওপর স্পর্শ করে ভেজাটা অনুভব করে ওড়না গলায় জড়িয়ে দিলো ইমন। মুসকান আবারো আরেক হাঁচি দিতেই প্রচন্ড চিন্তান্বিত হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো ইমন। ইমনের অমন বিচলিত মুখটা দেখে একটু মায়া হলো মুসকানের সেই সাথে খানিকটা প্যারা দিয়ে পৈশাচিক আনন্দও হলো। তাই মুচকি হেসে মুখটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে রাখলো। প্যারা মানে জটিল প্যারা তার অসুখ করা মানেই ইমন চৌধুরীর জন্য ভয়ানক প্যারা।
.
রাস্তায় থাকা কালীনই ইমন মুরাদকে ফোন করে মুসকানের সিচুয়েশন জানায়। ইমন তার বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে মুরাদ রিমিকে বাইক করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে মুসকানের এক সেট কাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসে। চৌধুরী বাড়িতে যখন ইমন মুসকান পৌঁছায় নিচে শুধু ইরাবতী, মরিয়ম আক্তার,রিমি আর সায়রী ছিলো। মুসকান মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকতেই ইরাবতী বলে ওঠে,
” যাক মহারানীর তাহলে পা পড়লো আমার বাড়ি। ”
ইমন বললো,
” শুধু পা নয় পুরো শরীরই নিয়ে এসেছি ” বলেই মুসকানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও ঠান্ডা লেগে গেছে। আমি মুরাদকে ওষুধ আনতে পাঠিয়েছি হালকা খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। ”
“বাব্বাহ তুই থেকে ডিরেক্ট তুমি! ”
সায়রীর কথা শুনে সকলেই মিটিমিটি হাসতে শুরু করলো। মুসকান চরম অস্বস্তি নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শীত লাগছে খুব কিন্তু ইমনের ঢং দেখে তার একটুও চেঞ্জ করতে মন চাচ্ছে না৷ বার বার শুধু একটিই প্রশ্ন করতে মন চাচ্ছে, গত তিনবছরে এই দরদ গুলো কোথায় ছিলো?
“আমার ভবিষ্যৎ সন্তানের মা এখন বড়ো হয়ে গেছে এখনো তুই তে আঁটকে থাকলে ভারী অবিচার করা হবে না?”
লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো মুসকানের। মরিয়ম আক্তারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। ইমন পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎক্ষনাৎ মুসকানের হাত চেপে ধরে সায়রীকে ইশারা করলো কাছে যেতে। সায়রী যেতেই মুসকানের হাত তার হাতে তুলে দিয়ে বললো,
“ফটাফট ইনাকে রেডি করে নিচে নিয়ে আয়। আর শোন আমার রুম তার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে শুধু আমার পোশাকগুলো কষ্ট করে দিয়ে যাস। ”
ইরাবতী আর মরিয়ম আক্তার ততোক্ষণে ছেলেমেয়েদের থেকে মনোযোগ ওঠিয়ে নিয়েছে। রিমি সায়রী আর মুসকানের সাথেই উপরে চলে গেলো। ইমনও মাথা ঝাঁকিয়ে চুলের পানি ফেলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে উপরে ওঠে গেলো।
.
ড্রয়িং রুমে ইমনের বাবা আকরাম চৌধুরী এবং মা ইরাবতী উপস্থিত রয়েছে। উপস্থিত রয়েছে মরিয়ম আক্তার সহ মুসকানের বড়ো চাচাও। তাদের উপস্থিতির মাঝেই মুরাদ এবং ইমন আসলো। এনগেজমেন্ট এবং বিয়ের ডেট ফাইনাল। যদিও মুসকানকে এসবের কিছুই জানানো হয়নি। ইমনের মতামতের ভিত্তিতেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সিদ্ধান্ত শেষে মুসকানের বড়ো চাচা বেরিয়ে গেলো। মুরাদও মরিয়ম আক্তার আর রিমিকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেলো। দিহান, সায়রী,মুরাদ, মুসকান সকলকেই আজ ইমনের বাড়ি থাকতে হবে৷ অবশ্য এসবের কিছুই জানে না মুসকান। সায়রী তাকে উপরের ঘরেই খাবার দিয়ে ঠান্ডা এবং জ্বরের ওষুধ খাওয়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটার সেই ছোট্ট বেলা থেকেই কোল্ড ফোবিয়া রয়েছে। একটু ভিজতে না ভিজতেই জ্বর, ঠান্ডা লেগে গেছে। নাক দিয়ে সমান তালে পানি আসছে৷ ইমনের পুরো রুম আজ টিসুময়। লম্বা লম্বা চুলগুলো এখনো শুখায়নি। মাথায় তয়ালে বেঁধে চুপচাপ শুয়ে আছে মুসকান৷ সায়রী পাশে বসেই ফেসবুক স্ক্রল করছিলো। এমন সময় রুমে ঢুকলো ইমন। সাদা রঙের টিশার্ট এবং কালো রঙের ট্রাউজার পরিহিত সে। ট্রাউজারের পকেটে একহাত গুঁজে চোখে মুখে গম্ভীর্যতা ফুটিয়ে ধীর পায়ে আগাচ্ছে সে। সায়রী তাকে দেখে ওঠে দাঁড়ালো বললো,
“ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে কমে যাবে। ”
“হুম তুই নিচ থেকে ঘুরে আয়। ”
“কি করবি? শোন এখনি কিছু বলিস না ভয়ানক কাণ্ড বেঁধে যাবে। ”
“যা বললাম তাই কর বাকিটা আমি দেখছি। ”
ভ্রু কুঁচকে মুসকানের দিকে তাকালো সায়রী। মুসকান চোখ বুজে শুয়েই আছে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। ভেবেই এক ঢোক গিলে ইমনের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। সায়রী বেরিয়ে যেতেই ইমন সটান সটান পা ফেলে দরজা লক করে দিলো। তারপর লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে বিছানায় মুসকানের পাশে গিয়ে বসলো। একহাত মুসকানের কপালে ছুঁয়ে জ্বরের মাত্রা দেখে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ওষ্ঠজোড়া ছুঁইয়িয়ে দিলো কপালে। মুসকানের তপ্ত শ্বাস তার চিবুক ছুঁয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস ছাড়লো। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে চোখ জোড়া মেলে মুসকানের পুরো মুখশ্রীতে সন্তর্পণে নজর বুলিয়ে বিরবির করে বললো,
“তোমার মনের ঘরে যে তালা তুমি ঝুলিয়েছো সে তালার চাবিকাঠি কেবল আমার বক্ষঃস্থলেই লুকায়িত রয়েছে। ”
#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৫
#জান্নাতুল নাঈমা
_____________________
“তোমার মনের ঘরে যে তালা তুমি ঝুলিয়েছো সে তালার চাবিকাঠি কেবল আমার বক্ষঃস্থলেই লুকায়িত রয়েছে। ”
ইমন ভেবেছিলো মুসকান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তাই সে যাই বলুক বা যাই করুক না কেন সবটা মুসকানের অগোচরেই থেকে যাবে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে রয়েসয়ে চোখ মেললো মুসকান। অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই তাকালো সে। হকচকিয়ে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো ইমন। মুসকানের দিকে ঝুঁকে থাকা অবস্থায়ই এক হাতে আলতোভাবে মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো,
“ঘুমাওনি?”
“চোখ বুজে থাকা মানেই কি ঘুমিয়ে যাওয়া? ”
কথাটি বলেই এক ঝটকায় ইমনের হাতটা নিজের মাথা থেকে সরিয়ে দিলো। কপাল কুঁচকে গেলো ইমনের। মুসকান ওঠতে চেষ্টা করতেই তার থেকে সরেও গেলো। বিছানার এক পাশে প্রচন্ড উদবেগ হয়ে বসে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুসকানের দিকে। মুসকান নিজেকে পরিপাটি করে নিয়ে ইমনের দৃষ্টির দিকে নিজের দ্বিধান্বিত দৃষ্টিজোড়া একবার মিলিয়েই দৃষ্টি নত করে ফেললো। বুকের ভিতরে চলা তীব্র উত্তেজনাকে সংযত করারও তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সন্তর্পণে। ইমন একইভাবে তাকিয়ে আছে বোঝার চেষ্টা করছে মুসকানের মতিগতি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় টা হলো যে মুসকানকে সে বইয়ের পাতার মতো করে পড়তে পারতো সে মুসকানকে আজ সেভাবে পড়তে পারছেনা৷ যার ফলে নিজেকে কিছুটা অসহায় অনুভব করছে সে। তার অসহায়ত্ব দূর করার জন্য অবশ্যই মুসকানের সাথে খোলাখুলি কথা বলা প্রয়োজন। ইমন মনস্থির করে যেই কিছু একটা বলতে উদ্যত হবে তৎক্ষনাৎ মুসকান বললো,
“আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবে তুমি নানাভাই? ”
সংযত হলো ইমন ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,
“সব প্রশ্নের উত্তর দেবো। ”
বক্ষঃস্থলে মৃদু কম্পন অনুভব করলো মুসকান। এক ঢোক গিলে দু’হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে বললো,
“আমি সবটা জানি তবুও তোমার কাছে জানতে চাই কেন চলে গিয়েছিলে? কেন যাওয়ার আগে একটা বার দেখা করোনি? আমি অবুঝ ছিলাম তুমি তো ছিলে না কেন করলে এমনটা? ”
কেন করলে এমনটা? শেষ প্রশ্নটি করতে গিয়ে গলা কেঁপে ওঠলো মুসকানের৷ ইমন হতভম্ব হয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
“তুমি কাঁদবে না মুসকান আমার দিকে তাকাও। ”
“আমার প্রশ্নের উত্তর চাই ব্যস তার জন্য তোমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়বে না।”
“তুমি অনেক ছোট ছিলে এখন যতোটা বোঝো তখন ততোটাও হয়তো বুঝতে না। আমার প্রতি তোমার তখনকার অনুভূতি আবেগই ধরা যায়। সে আবেগকে মুখ্য করে আমি যদি তখন তোমায় বিয়ে করে নিতাম সেটা ভুল হতো। তাই আমি সময় নিতে চেয়েছি। আর এ সময়টাকে অযথা ব্যয় করতে চাইনি৷ আমি যদি এদেশে থাকতাম তাহলে হয়তো তোমার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাটা কষ্টসাধ্য হয়ে যেতো। তাই দেশের বাইরে চলে গিয়েছি পড়াশোনায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। দূর থেকে অপেক্ষা করেছি সঠিক একটা সময়ের জন্য আর সবশেষে সে সময়টা পেয়েও গেছি। ”
তাচ্ছিল্য হেসে মুসকান বললো,
“এটুকুই? আমিতো সবটা শুনতে চাই। ”
“সবটা বলতে কোন কথা নেই কথা একটাই আমি আমার ভালোবাসাকে সময় দিতে চেয়েছি। আমি আমার ভালোবাসার মানুষ’টিকে নিজের অনুভূতিকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য সময় দিয়েছি।”
“হ্যাঁ সময় দিয়েছো। এই সময় দেওয়ার পেছনের সব কারণ টা বলো নানাভাই। না থাক তোমার বলতে হবে না আমিই বলছি। ”
অতিরিক্ত লম্বা হওয়ার সুবাদে মুসকানের দিকে তাকাতে ঘাড় কিছুটা কাত করতে হয়েছে ইমনকে৷
মুসকান তার বাম পাশে বসেছে। তাই ডান হাতটি বিছানায় ঠেশ দিয়ে বাম হাতের কনুই উরুতে ঠেশ দিয়ে আঙুল গুলো নিজের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে বিচরণ করছে। চোখে মুখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। মুসকান তার দৃষ্টিজোড়া নত রেখেই কাঁপা গলায় বললো,
“তোমার বাবার সঙ্গে তো তোমার ঠিক এই কথাটাই হয়েছিলো যে আমি ছোট ভালোবাসার মানেটা আমি বুঝিনা…।”
মুসকানের কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে ইমন দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“তোমার বাবা কি ধরনের বাক্য মুসু? হয় আংকেল বলবে নয়তো ডিরেক্ট বাবা বলবে। ”
মাথা নিচু করেই ঢোক গিলে সরি বললো মুসকান। ছোট্ট একটি শ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো,
” আংকেল তোমায় যা বলেছে সবটাই আমি শুনেছি। তুমি আংকেলের কথায় নিজের সিদ্ধান্ত নিয়েছো। ”
“ভুল আমি কারো কথায় সিদ্ধান্ত নেইনি। আমার জীবন কেবল আমার সিদ্ধান্তের ওপরই চলে আর কারো না। ভবিষ্যতেও তাই হবে তুমি চাইলেও তোমার সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। ভালোবাসি নিজের চেয়েও অনেক বেশী তাই বলে এই নয় তোমার সিদ্ধান্তের ওপর আমি চলবো। যেখানে তোমার সিদ্ধান্তই আমি মানবো না সেখানে বাবা! মা হলে খানিকটা ভেবে দেখা যেতো বিকজ পৃথিবীতে আমি দু’জন মানুষ এবং দু’জন নারীর প্রতি ভীষণ ভাবে দূর্বল একজন আমার পাশে এ মূহুর্তে উপস্থিত রয়েছে অপরজন আমার জন্মদাত্রী। ”
বুকের ভিতর টা চিনচিন করে ওঠলো মুসকানের। না চাইতেও অকস্মাৎ ভাবে ইমনের দৃষ্টিতে নিজের ঝাপসা দৃষ্টিগুলো মেলালো। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে কাঁপা কন্ঠে কাঠিন্যতা মিশিয়ে বললো,
“ভালোবাসা! আংকেল তোমায় বোঝালো আমি আবেগের বশীভূত হয়ে তোমার প্রতি টান অনুভব করছি দূরে গেলেই সেই টান টা বিলীন হয়ে যাবে। আর তুমিও সেই পরীক্ষা নেওয়ার জন্য দূরে চলে গেলে। এটাকে কি ভালোবাসা বলে? ”
মুসকানের কান্নামিশ্রিত কন্ঠস্বর, ঝাপসা দৃষ্টিজোড়া দেখেই এলোমেলো হয়ে গেলো ইমন। গাল থেকে হাত সরিয়ে ঘাড় সোজা করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“ভুল বোঝা হচ্ছে আমাকে। ”
“নাহ ভুল নয় একদম ঠিক বোঝা হচ্ছে। তুমি ঠিক যে কারণে আমায় ছেড়ে চলে গেছো ঠিক সে কারণটাই ঘটেছে। ”
“মানে!”
“হ্যাঁ তুমি এবং তোমার পরিবারের চিন্তা তো এটাই ছিলো মুসকান বাচ্চা মেয়ে। একটা সম্পর্কের মানে বোঝার মতো বয়স ওর হয়নি। তাদের প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের সঙ্গে এই নাবালিকা মেয়ের কোনদিনও মিলবে না৷ জীবনের একটা সময় এসে ঠিক মুসকান ইমন চৌধুরী কে ছেড়ে চলে যাবে। শুধু মাত্র বয়স এবং চাহিদাকে পুঁজি করে! ”
“তারা আমার বাবা, মা সন্তান নিয়ে তাদের এই চিন্তাটাকে স্বাভাবিক নেওয়া উচিত। আজ যদি মরিয়ম আন্টি বা মুরাদ বলে আমার সাথে তোমাকে যাবে না৷ মরিয়ম আন্টি তার মেয়েকে এতো ডিফারেন্ট এইজের ছেলের সাথে বিয়ে দেবে না। এখানে কি ভুল হবে মুসু? ”
“কথা সেটা নয়। ”
“তাহলে কথাটা ঠিক কি। ”
“রাগ দেখাবে না। ”
শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো ইমন৷ মুসকানের কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখে হাসি পেয়ে গেলো। রাগ সে দেখায়নি শুধু সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিলো এতেই পাগলীটা কেঁদে দেওয়ার অবস্থা হয়ে গেছে? ভাবতেই না চাইতেও ঈষৎ হেসে ফেললো। মুসকান দৃষ্টি নত করে বললো,
” তোমরা সবাই আমাকে বড়ো হওয়ার সুযোগ দিয়েছো। আমার অনুভূতিকে সঠিক ভাবে বোঝার সুযোগ দিয়েছো। তুমি চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরীর হৃদয়ে খোদাই করে বীজ বপন করে রেখে গিয়েছিলে। যত্ন করার প্রয়োজন বোধ করোনি। যত্নহীন বেড়ে ওঠেছে আমার ছোট্ট হৃদয়ে সন্তর্পণে থাকা ভালোবাসা টুকু। বৃক্ষ রোপণ করলে তার গোড়ায় অন্তত একটু পানি দিতে হয়। মানুষ সে অল্পখানি যত্ন না করলে সৃষ্টিকর্তা প্রাকৃতিক উপায়ে বৃষ্টির আগমণ ঘটিয়ে সেটুকু করে দেয়। কিন্তু তুমি যে বৃক্ষ বপণ করে গিয়েছিলে তা কি বেড়ে ওঠেছে নাকি বেড়ে ওঠার আগেই পঁচে গলে মরে গেছে সেকথা একবারের জন্যও ভেবে দেখেছো? ”
“আমার ভালোবাসা এতোটা ঠুনকো নয়। ”
“আমার ভালোবাসা খুব ঠুনকো।”
“আই ডোন্ট কেয়ার। ”
“আই কেয়ার…”
“বাচ্চাদের কেয়ারে মাথা ঘামাতে নেই। ”
“আমি বাচ্চা নই আই এম এইটিন ইয়ার্স ওল্ড।”
“দ্যাটস হোয়াই আই উইল গেট ম্যারিড কুইকলি।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মুসকান বললো,
“কিন্তু আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই না। ”
হাসলো ইমন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আর কিছু? ”
” হ্যাঁ। তোমরা আমাকে সময় দিয়েছিলে। তোমাদের ধারণাই সঠিক। সত্যি তখন অবুঝ ছিলাম। প্রেম,ভালোবাসা, ভালোলাগা ভিতর থেকে ফিল করতে পারতাম না৷ তোমার প্রতি উইকনেস ছিলো গত তিনবছরে সে উইকনেস কমে গেছে। আমিও ফিল করেছি লাভ নয় এট্রাকশন ছিলো তোমার প্রতি। যা তুমি দূরে যাওয়াতেই কেটে গেছে। ”
কপালে তিন ভাঁজ পড়লো ইমনের। মুসকানের দিকে কিছুটা ঝুঁকে শান্ত গলায় বললো,
“আমি শান্ত আছি বলে এই নয় যা তা বলবি। আমি তোকে না জানিয়ে চলে গেছি এটা যদি আমার ভুল হয় তাহলে আমি ভুল স্বীকার করছি। কিন্তু আমি যদি তখন চলে না যেতাম তাহলে ক্ষতি তোর হতো আমার না। ”
থমকে গেলো মুসকান। কিছু সেকেন্ড সময় পর তার দু’চোখ বেয়ে অঝরে অশ্রু ঝড়তে শুরু করলো। সে দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে শ্বাস আঁটকে সরে গেলো ইমন। ওঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত মুঠ করে পিছন ঘুরে রইলো। মুসকান দু’হাতে নিজের হাঁটুজোড়া চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি আমার জীবনের তিনটা বছর কিভাবে কাটিয়েছি তা তুমি জানো? এটুকু বয়সে আমার কেন স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমাতে হয় বলবে? কেন তোমাদের সমাজকে পুঁজি করে পরিবার কে পুঁজি করে বয়সকে পুঁজি করে আমাকে বলি দিলে তোমরা? এটাই যদি করবে আমার ছোট্ট মনে কেনো অনুভূতি জাগালে তুমি? একটাবারো হৃদয় কাঁপেনি? একটা বারো মনে হয়নি এই তিনবছরের মধ্যে সব কিছু বদলে যেতে পারে৷ একটা বারো হারানোর ভয় হয়নি আমাকে? ভালোবাসার মানুষের থেকে যে দূরে থাকতে পারে, যার মনে আমাকে হারানোর বিন্দু মাত্র ভয় নেই তাকে আমি চাইনা কখনোই চাই না। ”
” সামনে মাসে আমাদের এনগ্যাজমেন্ট তার পরের মাসেই বিয়ে। বিয়ে আমার বউও আমার আর সিদ্ধান্ত সেটাও আমার। এর বাইরে আর কিছু জানতে বা বুঝতে চাইনা। ”
চমকে ওঠলো মুসকান। তার অনুভূতির কোন মূল্যই নেই ইমনের কাছে? এতোগুলো বছর তাকে তীলে তীলে শেষ করে দিয়ে আজ বিয়ের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে? ক্রোধে সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করলো তার। চিৎকার করে বললো,
“আমি তোমার বউ হতে চাইনা। ”
“আমি তোর একটা কথাও শুনতে চেয়েছি?”
মুসকানের দিকে ফিরে চিৎকার করে ওঠলো ইমনও। কেঁপে ওঠে হুহু করে কেঁদে দিলো মুসকান। ইমন ঠোঁট কামড়ে শক্ত চাহনীতে চেয়ে আছে তার দিকে৷ ইমনের ফর্সা মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখে ফুটে ওঠেছে ক্রোধ, ওষ্ঠজোড়া লাল টকটক করছে। চোয়ালজোড়া ফুলে ওঠেছে। টান টান হয়ে দাঁড়ানোতে মনে হচ্ছে একটা সুন্দরমুখো সিংস্র দানব দাঁড়িয়ে আছে। মুসকান ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,
“তুমি খুব খারাপ নানাভাই আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসিনা। আমি তোমাকে একটুও বিয়ে করবো না। ”
ভয়ে ভুলভাল বকতে শুরু করলো মুসকান। ইমন তখনো হুঁশে ফেরেনি তাই দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এক থাপ্পড়ে কান গরম করে ফেলবো। ”
“দাদাভাই…” এক চিৎকার করে ওঠলো মুসকান। প্রায় সাথে সাথে দরজায় করাঘাত শুরু করলো মুরাদ। ইমন চোখ বন্ধ করে কয়েকদফা লম্বা শ্বাস ছেড়ে দরজা খুলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“ডাকতে দেরি আসতে দেরি হয় না?”
মুরাদ ইমনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দ্রুত পায়ে মুসকানের কাছে গিয়ে পাশে বসে মাথায় হাত দিতেই মুসকান মুরাদকে জাবটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। আর বলতে লাগলো,
“দাদাভাই আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। আমি এখানে থাকবো না প্লিজ দাদাভাই আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও। ”
প্রায় তিন বছর পর আজ প্রথম এভাবে ঠিক আগের মতো করেই মুসকান মুরাদের সঙ্গে কথা বলছে৷ কতোগুলো দিন পর তার গম্ভীর বোনটা তার নিজস্ব সত্তায় ফিরে এসেছে ভাবা যায়! হুম ভাবা যায় মোম আর আগুন পাশাপাশি থাকবে অথচ মোম গলবে না তাই কখনো হয়? কিন্তু এমন গলা গলেছে যে আশেপাশে আগুনকে সহ্যই করতে পারছেনা ভাবতেই হাহা করে হাসতে ইচ্ছে করলো মুরাদের। বোনের কান্নায় অবশ্য সেই হাসিটাকে বের করতে পারলো না৷ বোনকে স্বান্তনা দেওয়া জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“এভাবে কাঁদিস না ইমন তোকে ধমক দিছে তাইনা? ঐ তুই কোন সাহসে আমার বোনকে ধমক দিস? তিনবছর বিদেশের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে নিজেকে কি মনে করস হুহ আমার বোনকে ধমকাস আমার বোনকে এতো বড়ো কলিজা তোর? ”
মুসকানের কান্নাটা আর সহ্য হচ্ছে না ইমনের। সেই সাথে মুরাদের ন্যাকামো মার্কা কথা শুনে ভয়ংকর গালি দিতে মন চাচ্ছে তাই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়াটাই মঙ্গল বলে মনে করলো এবং বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এক পা কেবল দরজার বাইরে দিয়েছিলোও মাত্র তখনি শুনতে পেলো ক্রন্দনরত কন্ঠে মুসকানের বলা বাণীগুলো,
“আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো দাদাভাই। ঐ লোকটার আশেপাশে থাকলে আমি মরে যাবো। ঐ লোকটা আমাকে ফেলে চলে গেছিলো কেন ফিরে এলো আবার। আমি চাইনা কিছু চাইনা৷ আমি বিয়ে করবো না, যে আমার কথা না ভেবে সবার কথায় আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তাকে আমি চাইনা। তোমরা যদি আমাকে জোর করে বিয়ে করতে বলো আমি বিষ খেয়ে মরে যাবো, সুইসাইড করবো আমি। নিজেকে শেষ করে দেবো একদম শেষ। ”
মুসকনের কথা শুনে আঁতকে ওঠলো মুরাদ শক্ত করে বুকের ভিতর জরিয়ে নিয়ে বললো,
“মুসু কি বলছিস! এসব বলতে হয় না বোন, এসব বলিস না। তুই না চাইলে কেউ জোর করবে না তোকে কেউ না তোর ভাই তোকে কথা দিচ্ছে। ”
দেয়ালে এক হাত ভর করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ইমন। আচমকাই যেনো তার বক্ষঃস্থলে হাজারটা তীরের ফলা এসে বিঁধলো। এক হাতে দেয়াল ধরে অপর হাতে কপাল থেকে চিবুক অবদি ঘাম মুছে রুমের সামনে থেকে সরে গেলো। আর মনে মনে শুধু একটা বাক্যই আওড়ালো,
” নিজের বয়সের দিকে তাকিয়ে স্বার্থপরের মতো আমি কি পারতাম না তিন বছর আগেই তোকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে নিতে? যেখানে আমার বয়সী পুরুষ রা বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করছে দু,এক সন্তানের বাপ হয়ে গেছে সেখানে ত্রিশের ঊর্ধ্বে গিয়েও আমি শুধু তোর জন্য অপেক্ষা করছি। নিজের সব চাহিদা বিসর্জন দিয়ে শুধু তোকে ঘিরে বেঁচে আছি আজ এই কথা শোনার জন্য এই পরিস্থিতি তৈরী হওয়ার জন্য!”
রাগটাকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না ইমন। সিঁড়ি দিয়ে নামার পূর্বে পাশে থাকা ফুলদানি টা এক ঝটকায় তুলে আছড়ে ফেললো। নিচ থেকে সায়রী, দিহান,আর ইরাবতী চমকে ওঠে তাকালো উপরের দিকে। ইমন সিঁড়ি দিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে নিচে নেমে এলো৷ ইমনের চোখ,মুখ দেখে ভয়ে তিনজনের শরীরই শিউরে ওঠলো। ওদের তিনজনের অমন ভয়ার্ত অবস্থা দেখে ট্রি টেবিলের ওপর থাকা কাঁচের গ্লাসটা তুলে ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। এক লাথি দিয়ে ট্রি টেবিলটা ছিটকে ফেলে চিৎকার করে বললো,
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন তোমরা? সার্কাস হচ্ছে এখানে সার্কাস! ”
চলবে…
#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৬
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
ইমনের বিক্ষিপ্ত আচরণ দেখে অসুস্থ হয়ে পড়লেন ইরাবতী। অসুস্থতার পরিমাণ এতোটাই তীক্ষ্ণ ছিলো যে নিজের ভারসাম্যটুকুও নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না৷ জ্ঞান শূন্য হয়ে মেঝেতে ঢলে পড়ার উপক্রম হলেন৷ আল্লাহ সহায় ছিলেন বিধায় পড়ার পূর্বেই দিহান ধরে ফেললো তাকে। তৎক্ষনাৎ থমকে গেলো ইমন৷ ছুটে এসে জাবটে ধরলো ইরাবতীকে। শঙ্কিত গলায় দিহানকে বললো,
“দিহান ডক্টর আংকেলকে ফোন কর কুইক। ”
ইরাবতীকে পাঁজাকোল করে ত্বরান্বিত হয়ে উপরের দিকে ছুটে চললো ইমন পিছন পিছন যায় সায়রীও। দিহান ডক্টরকে ফোন করার পর আকরাম চৌধুরীকেও ফোন করে। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে আকরাম চৌধুরী বাড়ি ফিরে আসেন৷ মুরাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো মুসকানকে নিয়ে রাতেই বেরিয়ে যাবে। কিন্তু ইরাবতীর অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিবেকে সায় দিলো না৷ মুসকানও পরিস্থিতি বুঝে নিশ্চুপ রইলো। মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত প্রায় হয়ে গেলো ইমন। ডক্টর এসে চেকআপ করে রোগী সহ সবাইকে বেশ বকাঝকা করলেন। ডক্টর সাহেব ইমনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি ব্যাপার ইমন তোমার দেখছি নিজের মায়ের দিকে একদম নজর নেই ব্লাড প্রেশার বেড়ে ১৪০/১০০। ঠিকঠাক প্রেশারের ওষুধটাও দেখছি খাওয়াচ্ছো না মা’কে। ”
আকরাম চৌধুরী ইরাবতীর বাম পাশেই বসা ছিলেন। তিনি উৎকণ্ঠা হয়ে বললেন,
“ইরা প্রতিদিন সকাল ন’টায় প্রেশারের ওষুধ খায় আজো খেয়েছে এ ব্যাপারে তো অনিয়ম হচ্ছে না সাইফুল। ”
ডক্টর সাইফুল চিন্তিত হয়ে ইরাবতীর দিকে তাকালেন । বললেন,
“কি ভাবি এতো কি চিন্তা করেন? কোন কিছুর তো অভাব নেই৷ আমার বন্ধুর মতো খাঁটি জীবনসঙ্গী পাশে আছে একটামাত্র ছেলে সেও স্টাবলিশড আর কি চিন্তা হুম? ”
ইরাবতী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকরাম চৌধুরীর দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকালেন। বললেন,
“আমি একা থাকতে চাই। ”
আকরাম চৌধুরী বিমূঢ় মুখে সাইফুলের দিকে তাকালো। সাইফুল ইশারায় তাকে চিন্তা করতে নিষেধ করে ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“সে আপনি থাকতেই পারেন ভাবি তবে শর্ত একটাই পুরো রিল্যাক্স মুডে থাকতে হবে। আর অবশ্যই অবশ্যই এই ওষুধ গুলো খেয়ে নিতে হবে। ”
সাইফুল সাহেব কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। যার দু’টো অলরেডি ইরাবতীর মেডিসিন বক্সে ছিলো। যে একটি ছিলো না সেটার জন্য ইমন দিহানকে পাঠালো ফার্মেসীতে৷ সাইফুল চলে যাওয়ার পূর্বে ইমনকে রুমের বাইরে নিয়ে গিয়ে বললো,
” কি ইয়াং ম্যান জীবন তো স্যাটেল এবার ঘরে বউ আনতে হবে তো। ভাবি যে এমন অসুস্থ সেদিকে এবার নজর দাও৷ ক্যারিয়ার নিয়ে তো অনেক ভাবলে এবার না হয় পরিবার নিয়ে ভাবো? ”
“জি আংকেল ইনশাআল্লাহ আল্লাহ চাইলে অফিস জয়েন করার আগেই মায়ের ইচ্ছে পূরণ করবো। ”
সাইফুল ইমনের কাঁধে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“সাব্বাস ব্যাটা তাহলে শিঘ্রই বড়োসড়ো দাওয়াত পাচ্ছি। তোমার ছুটি তো প্রায় শেষের দিকে শুনলাম।”
” হ্যাঁ ঐ আর কি দু’মাস তেরোদিন আছে আর। ”
“ওকে মাই বয় এর মধ্যেই আশা রাখছি তোমার বাবা-মায়ের ইচ্ছে পূরণ হবে। বোঝোইতো একটামাত্র ছেলে তাদের বয়সতো বেশ হলো এবার বিয়েটা করে নেওয়া উচিত। তুমি চাইলে আমি নিজে তোমার জন্য পাত্রীর খোঁজ করবো। বয়স যদিও বেশী তবে চেহেরার চাকচিক্যতে সেটা বোঝার উপায় নেই। তুমি অবশ্যই রূপবতী, গুণবতী মেয়ে ডিজার্ভ করো। ”
কথাগুলো বলেই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ডক্টর সাইফুল। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো ইমনের। ডক্টর আংকেল তাকে নিয়ে ঠিক প্রশংসা করে গেলো নাকি ইনডিরেক্টলি অপমানও করে গেলো বোধগম্য হলো না। আপাতত মা’কে নিয়ে সে ভীষণ চিন্তিত তাই ঠুনকো এই বিষয়টি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে রুমে চলে গেলো।
.
মায়ের পাশে দীর্ঘ সময় বসে ছিলো ইমন। দিহান ওষুধ নিয়ে আসার পর সায়রী ইরাবতীকে খাওয়িয়ে ওষুধ গুলো খাওয়িয়ে দেয়। মুরাদও তখন ইমনের পাশেই বসা ছিলো৷ মুসকান একবার এসেছিলো ইরাবতীকে দেখতে ইরাবতী তার সঙ্গে সুবোধ্য আচরণ না করায় মাথা নিচু করে রুম ত্যাগ করেছে। বিষয় টা সকলের দৃষ্টিতে পড়লেও এ নিয়ে কেউ টুঁশব্দ করেনি। রাত ন’টার দিকে ঘুমিয়ে যায় ইরাবতী। তার পাশে বসা ছিলো সায়রী আর ইমন৷ মুরাদ আর দিহান তখন ছাদে বসে আলোচনা করছে কিভাবে কি হবে। মুসকানের জায়গায় আজ অন্য কোন মেয়ে থাকলে বিষয় টা অন্য রকম হতো৷ কিন্তু মুসকান মুরাদের কলিজার টুকরা বোন। তার প্রতি বিন্দু পরিমাণ জোর প্রয়োগ করাও বরদাস্ত করবে না মুরাদ৷ এদিকে বন্ধুর বোনের প্রতি মারাত্মক পর্যায়ে দুর্বলতা অনুভব করেও ফেঁসে গেছে ইমন৷ না পারবে জোর প্রয়োগ করে কাছে টানতে আর না পারবে স্বেচ্ছায় দুরে সরিয়ে দিতে৷
আকরাম চৌধুরী সায়রী কে বললো,
” মা তুমি ওদের নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নাও। সত্যি তোমাদের মতো বন্ধু আজকাল খুঁজে পাওয়া যাবেনা৷ সুখে, দুঃখে এভাবেই একে অপরের পাশে থেকো। ”
লজ্জা পেয়ে গেলো সায়রী। ইমনের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আবার আকরাম চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ইমন নিশ্চুপ হয়ে ওঠে দাঁড়ালো তারপর রুম ছেড়েও বেরিয়ে গেলো। সায়রীও সৌজন্যসূচক হেসে বেরিয়ে গেলো।
.
মুরাদ আর দিহানকে ডাকতে ছাদে গেলো সায়রী। এদিকে ইমনের শরীর ঘেমে টিশার্ট গায়ের সঙ্গে লেপটে রয়েছে। তাই কাপড় পালটানোর তাগিদে নিজের রুমে ঢুকলো। তৎক্ষনাৎ বক্ষস্থল কেঁপে ওঠলো তার৷ মুসকান দু’হাতে মাথা চেপে ধরে তার বিছানার মাঝ বরাবর বসে আছে। কাতর দৃষ্টিতে কয়েক পল মুসকানের দিকে চেয়ে রইলো ইমন। তারপর কি মনে করে যেনো নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে কাবার্ড খুলে নিজের কাপড় নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। ইমন বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ তুলে সম্মুখে তাকালো মুসকান৷ ইমনের উপস্থিতি বুঝতে পেরে বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে তার। ইরাবতীর অসুস্থতীর কথা শুনে সিচুয়েশন বুঝে রাগ অনেকটাই কমে গেছে তার। অথচ তার রাগের নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং মুখে লাগাম না টানায় কারো হৃদয়ে যে তোলপাড় চলছে এ খবরটি সে জানতেও পারলো না।
ডায়নিং টেবিলে সকলেই বসেছে সবার শেষে এলো মুরাদ এবং মুসকান৷ যদিও মুসকান আসতে চায়নি মুরাদ বুঝিয়ে শুনিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করার কথা বলে জোর পূর্বক নিয়ে এসেছে তাকে। মুরাদের পাশেই বসলো মুসকান তার পাশে দিহান। সম্মুখের চেয়ারে ইমন এবং সায়রী বসেছে৷ ইমন অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার গিলছে। দিহান আর মুরাদ টুকটাক কথা বললেও আর কারো মুখে কোন শব্দ নেই। পরিস্থিতি কেমন গুমোট ধরে আছে। সকলের ভিতরেই হয়তো চলছে প্রবল উত্তেজনা। শুধু একজনের হৃদয়ই হয়তো ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। আর সে হলো ইমন চৌধুরী। হবে নাইবা কেন মুসকান তার ভালোবাসার মানুষ। যাকে কিনা নিজের হৃৎপিণ্ড বলে দাবি করে সেই মানুষ টি আজ বলেছে, সে তাকে বিয়ে করতে চায়না। যদি জোর পূর্বক তার সাথে বিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সে সুইসাইড করবে! এ পৃথিবীতে অহরহ মানব মানবী নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে কবে তারা তাদের ভালোবাসার মনুষটিকে নিজের করে, নিজের বউ বা স্বামী রূপে পাবে। অথচ মুসকান কিনা তার ভালোবাসার মানুষ’কে স্বামী রূপে পেতে চায় না।জোর পূর্বক এই প্রাপ্তি কেউ দিলে সে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপ করবে! মাথা ঘুরে এলো ইমনের। গলায় খাবার আঁটকে কেশেও ওঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে ওঠলো মুসকান। চোখ তুলে ইমনের দিকে তাকাতেই দেখলো সায়রী ইমনের মাথায় পিঠে মৃদু থাপ্পড় দিচ্ছে। দিহান ওঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি ভরেও এগিয়ে দিলো। ইমন পানিটা কোন মতে খেয়ে নিয়ে খাবার ছেড়ে উপরে ওঠে গেলো। একবারের বেশী কেউ ডাকার সাহসও পেলো না। সকলেই নিরব হয়ে বসে নিজেদের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। শুধু মুসকানই টলমল দৃষ্টিতে খাবার নাড়াচাড়া করতে থাকলো। তা দেখে মুরাদ নিচু স্বরে বললো,
“খাচ্ছিস না কেন খেয়ে শুয়ে পড় গিয়ে সকাল সকালই চলে যাবো। রাতটা কষ্ট হলেও থাকতে হবে।”
বুকটা হুহু করে ওঠলো মুসকানের। খাবার ছেড়ে ওঠে পড়লো সেও। বললো,
” আমার বমি পাচ্ছে একটুও খেতে পারবো না। ”
উপর থেকে এ দৃশ্য ইমন দেখে রাগে হনহনিয়ে ছাদে চলে গেলো।
.
পরেরদিন সকাল সকাল বাড়ি ফিরে গোসল সেরে রেডি হয়ে নিলো মুসকান৷ তিন বছর পর দ্বিতীয় বারের মতো শাড়ি পড়লো সে। রিমি যখন তাকে শাড়ি পড়িয়ে দেওয়ায় মগ্ন ছিলো সে তখন অতিতের সেই সব স্মৃতিচারণ করছিলো। সে খুবই ভাগ্যবতী নারী৷ কিশোরী বয়সেই এসেছিলো তার প্রথম প্রেম, প্রথম প্রেম হোক বা ভালোবাসা, বা প্রথম স্পর্শ সবটাই সে পেয়েছে ইমন চৌধুরীর থেকে৷ তবে তাদের ভালোবাসায় সব থেকে স্মরণীয় যেটা ছিলো সেটা হচ্ছে সে বয়সে তার প্রথম শাড়ি পড়া হয়েছিলো ইমন চৌধুরী দ্বারাই৷ ইমন ইউটিউব দেখে শাড়ি পড়ানো শিখেছিলো শুধুমাত্র তাকে পড়িয়ে দেবে বলে। এটা জানার পর নিজে থেকে শাড়ি পড়ার ট্রাই কখনোই করেনি। যেখানে ইমন জানে শাড়ি পড়াতে সেখানে তার শেখার প্রয়োজন কী? কালো রঙের সিম্পল একটি শাড়ি পড়েছে মুসকান। যার পুরো জমিন জুরেই কালো। সোনালী পাড়ের কালো শাড়িতে মুসকানকে দেখতে ভীষণ আবেদনীয় লাগছে। তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণটা যেনো কালো রঙে দ্বিগুণ চড়া হয়ে গেছে। সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া তরুণীরা শাড়ি পড়া মানেই তাদের সৌন্দর্য আচমকাই কয়েক ধাপ বেড়ে যাওয়া। রিমি কুঁচি ঠিক করে দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে চেয়ে রইলো। তারপর উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
“বাব্বাহ শাড়িতে তোকে এতো জোশ লাগে মুসু। ইমন ভাইয়া তোকে এইরূপে দেখলে নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবে। ”
লজ্জা এবং রাগ একই সঙ্গে দু’টো অনুভূতি হলো মুসকানের৷ তাই বললো,
“বেশী কথা না বলে চুলগুলো ঠিক করে দাও আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
এক সাইট সিঁথি করে চুলগুলো খুলে ফেললো রিমি। যত্ন সহকারে আঁচড়ে দিয়ে বললো,
” শোন যতোক্ষণ রাস্তায় থাকবি চুল বেঁধে রাখবি। এতো বড়ো বড়ো চুল খুলে রাস্তায় বের হওয়া ঠিক না এক্সিডেন্ট ঘটার সম্ভাবনা থাকে। ”
মুসকান চোখে মোটা করে কাজল লাগাতে লাগাতে হুম বললো। রিমি চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসে মুসকানের সাজ সজ্জা দেখতে লাগলো। কাজল দেওয়া শেষে মুসকান জিগ্যেস করলো,
“আচ্ছা… গোলাপি রঙের লিপস্টিক দেবো নাকি লাল?”
” একটা দিলেই হলো দু’টোতেই তোকে বেশ ভালো মানায়। ”
“গোলাপিই দেই তাহলে। ”
পড়নে কালো শাড়ি, চোখে গাঢ় কাজল,ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক, গলায় সাদা স্টোনের নেকলেস, কানে সাদা স্টোনের দুল, দুহাতে কালো সাদা মিশ্রণের ব্রাইডাল চুড়ি পরে সাজের সমাপ্তি ঘটিয়েও আবার আচমকা মনে পড়েছে এমন ভণিতায় ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে একজোড়া নুপুর বের করে ধীরপায়ে বিছানার সামনে গিয়ে বিছানার ওপর পা তুলে নুপুর জোড়া পরে নিয়ে রিমিকে বললো,
“ভাবিজান কমপ্লিট এবার আমি যাই। ”
“তোর ভাইয়া কিন্তু স্কুলে যাওয়ার আগে পইপই করে বলে গেছে এভাবে একা একা না বের হতে। ”
” তাহলে এখন দোকা পাবো কোথায় অদ্ভুত! ”
” দিহান ভাইয়া নিতে আসবে তোকে। ”
তাহলে ফোন দাও আমার ফোন তো আমি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছি বলেই কুটিল হাসলো। রিমি সন্দিহান দৃষ্টিতে মুসকানকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে দিহান কে ফোন করলো। ঘটে গেলো আরেক বিপত্তি। দিহানের অফিসে কিছুক্ষণের মধ্যেই ইম্পরট্যান্ট মিটিং শুরু হবে। যার দরুণ তাকে সেখানে উপস্থিত থাকতেই হবে। তাই সে ইমনকে ফোন করে দিয়েছে যাতে সে মুসকানকে স্কুলে ড্রপ করে দেয়। এমন কথোপকথন শুনে মুসকানের বুকের ভিতর আচমকাই কিছু একটা কামড়ে ধরলো যেনো। এক ঢোক গিলে দ্রুত নিজের পার্স নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
“কাউকে লাগবে না আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি একাই যেতে পারবো। ”
রিমি ফোন কেটে এতো পিছন ডাকলো তবুও দাঁড়ালো না মুসকান গেট খুলে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তবেই থামলো সে৷ সেই সাথে বক্ষঃস্থল থেকে হৃৎপিণ্ডটা বেরিয়ে আসার উপক্রমও হলো। সামনে ইমনের গাড়ি ড্রাইভিং সিটে বসে আছে ইমন। মুসকান হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে প্রাণপণে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে গাড়ি পাস করার জন্য উদ্যত হবে তৎক্ষনাৎ সামনের ডোর খুলে দিলো ইমন। পিছন থেকে রিমি বললো,
“মুসু কথা না বাড়িয়ে ওঠে পড়। এভাবে আজ একা যাস না। ”
এমন ব্রাইডাল লুকে একা একা যেতেও মন সায় দিলো না মুসকানের। তারওপর আজি প্রথম এভাবে সেজেছে সে। এর আগে একবারের জন্যও সাজতে ইচ্ছে করেনি৷ আজ এভাবে সাজগোজ করবে একেবারের জন্যও কখনো ভাবেনি। অনুষ্ঠানের জন্য গাউন কিনে রেখেছিলো। অথচ সকাল সকাল বাড়ি ফিরেই রিমির কাছে শাড়ি চেয়ে বসেছে। হয়তো তার অবচেতন মন সামনের এই সুপুরুষটির জন্য তার দেহকে এভাবে সজ্জিত করেছে। ভাবতেই পুরো শরীর এবং মন জুড়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। বাড়তে থাকলো বক্ষঃস্থলে কম্পমান অনুভূতি।
পাশে তাকিয়ে রিমির দিকে একপলক চেয়ে সম্মুখে তাকালো। গম্ভীর মুখে স্থির হয়ে বসে আছে ইমন৷ অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার দরুন গায়ে কালো শার্টটা মারাত্মক আকারে ফুটে ওঠেছে। ব্রাউন কালার কিছু চুল কপালে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো এবং ডার্ক পিঙ্ক কালারের ওষ্ঠজোড়ার দিকে তাকিয়ে এক ঢোক গিললো মুসকান। ইমন একবারের জন্যও তাকায়নি মুসকানের দিকে। অথচ মুসকান এ মূহুর্তে তাকে গিলে খাচ্ছে। মুসকান হয়তো কল্পনাও করতে পারছেনা জাষ্ট একটিবার যদি ইমন চৌধুরীর দৃষ্টিতে আজ সে পড়ে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। অন্তত একবার হলেও আজ যদি ইমন পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতো মুসকান কে তাহলে হয়তো রিমির ভাষ্যমতে সত্যি এট্যাক হয়ে যেতো। অথচ ইমন একটিবার ফিরেও তাকালো না। নাকি সে অপেক্ষায় আছে সঠিক কোন সময়ের? ইমনের এটিটিওট খুব একটা পছন্দ হলো না মুসকানের৷ কিঞ্চিৎ অপমানবোধও করলো সে। ধীরে সুস্থে একহাতে আঁচল ধরে গাড়িতে ওঠে বসলো। রিমি ডোর ধাক্কা দিতে দিতে মুচকি হেসে বললো,
” হ্যাপি জার্নি। ”
চলবে…