#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৪ |
আবির’রা চলে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। ওরা চলে যেতেই মার্জান এবং রথির মধ্যে ভয়ানক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ভয়ানক বলতে মাত্রাতিরিক্ত ভয়াবহ। তাতানকেও হোস্টেল পাঠানো হয়েছে। এই দ্বন্দ্বের কারণ বাড়িতে থাকা নিয়ে। রথির মা রথিকে অনেক বুঝিয়েছে সে ওখানে চলে যাবে কিন্তু রথি অমত জানায়। সে বারংবার তার মাকে এটাই বলে,
-‘কেন মা? এই বাড়ি তোমার, আমি জানি! এই ভাবী জাস্ট নকল কাগজ দেখাচ্ছে তোমাকে। বিশ্বাস না হলে আমি এটা খুব শীঘ্রই প্রমাণ করবো!’
বলেই রথি হনহন করে বেরিয়ে যায়। এদিকে রথির মা এসব সহ্য করতে পারেন না, তার রক্তচাপ বেড়ে যায়। সাইফ তখনই বাড়ি ফিরে৷ মাকে পরে যেতে দেখে সাইফ দ্রুত এগিয়ে যায় মায়ের দিকে। মার্জান রথির মাকে ধরতে গেলে সাইফ চোখ গরম করে থামিয়ে দেয়। থমথমে গলায় বলে,
-‘খবরদার তুমি আমার মাকে ছুঁবে না! আজ যদি আমার মায়ের কিছু হয়, তোমার বাপ-চাচা, তাতান কিছুই মানবো না!’
বলেই আমেনার সাহায্যে মাকে ভেতরের রুমে নিয়ে গেলো। এদিকে মার্জান বারংবার ঘেমে একাকার হচ্ছে। নাহ জলদি কিছু একটা করতে হবে নয়তো সে সব খুইয়ে ফেলবে সব!
রাত নয়টা। বাইরে তীব্র বাতাস চারপাশে ধুলোময় করে ফেলেছে। মানুষের চোখ-মুখে ধুলো-বালি ঢিকে যা তা অবস্থা। এই অবস্থা দেখে নাশিদের বুঝতে বাকি রইলো না ঝড়-বৃষ্টি হবে। তাই সে তার হাতের ফাইলটি রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার দিকে যেতেই দেখলো বাইরে ঠিক তার জানালার পাশে রথি দাঁড়িয়ে। তার মাথা নিচু এবং হাতদুটোও মুঠ করে রেখেছে। রথিকে দেখে নাশিদ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। মৃদু সুরে রথিকে ডাকলো। কিন্তু রথি ভাবলেশহীন, এক চুলও নড়লো না। নাশিদ আবারও ডাকলো। আবারও। কিন্তু রথির কানে ডাকটি প্রবেশ করলো না। নাশিদ উপায় না পেয়ে থানা থেকে বেরিয়ে রথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘কী হলো, এতবার ডাকছি শুনতে পাও না!’
রথি এবার খানিক নাক টানলো। সেই শব্দে নাশিদের বুঝতে বাকি রইলো না রথি কাঁদছে। নাশিদ খানিকটা বিচলিত হয়ে পরলো। এদিকে ঝড় আসবে আসবে ভাব হলেও এখন পরিবেশ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
নাশিদ কিছু বলতে নিবে তার আগেই রথি দু পা এগিয়ে নাশিদের ডান বাহুতে আলতো মাথা ঠেকিয়ে
ভাঙ্গা গলায় বললো,
-‘একান্ত সময় চাই!’
রথির এরূপ আবদার নাশিদকে বিষম খাওয়ালো। তবে নাশিদ রথির আবদার ফেলতে পারলো না। নাশিদ রথির উদ্দেশ্যে বলে,
-‘এখানে থাকবে নাকি অন্য কোথাও যেতে চাও!’
-‘** হোস্টেল যেতে চাই। আমার তাতানের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন নাশিদ সাহেব?’
নাশিদ এ মুহূর্তে বুঝলো না এই তাতান কে? তবে রথি যেই হোস্টেলের কথা বললো ওটার ৮০% ই বাচ্চারা। এর মানে কী কোনো বাচ্চা? তবে নাশিদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো না। সে রথির উদ্দেশ্যে বললো,
-‘ঠিক আছে, তুমি অপেক্ষা করো। আমি আসছি!’
বলেই নাশিদ রথিকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এতক্ষণে রথিও চোখ মুখে ফেললো। নাশিদ আসতেই রথিকে গাড়িতে উঠতে বললে রথি নাশিদকে থামিয়ে বলে,
-‘আমি রিক্সা করে যাবো৷ এই গাড়ি টাড়িতে বিরক্ত হয়ে গেছি।’
এবারও নাশিদ রথির কথার অমত করলো না। কেন যেন রথির এই আবদার গুলো সে ফেলতে পারছে না। এর কারণ কী? কারণটার উত্তর নাশিদের জানা নেই। নাশিদ কথা না বাড়িয়ে রথির সঙ্গে যেতে লাগলো কিন্তু আফসোস কোনো রিকশা নেই। নাশিদের মাথায় এই ঢুকছে না রথি কেন রাত করে বাসা থেকে বেরিয়ে তারই থানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো? নাশিদ রথিকে প্রশ্ন করবে তখনই রথি বললো,
-‘নাশিদ সাহেব, ওইযে রিকশা!’
নাশিদ আর প্রশ্ন করতে পারলো না। রিকশা ডেকে দুজনেই উঠে বসলো। নাশিদ আজ ইউনিফর্ম পরেনি, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।
রথি এবং নাশিদ পাশাপাশি একই রিকশায় বসা। এই অনুভূতি যেন প্রকাশ করার মতো নয়। রথি মনোযোগ দিয়ে এই মুহূর্তটি উপভোগ করছে আর নাশিদ নিজেকে বিভিন্ন প্রশ্নে গুলিয়ে ফেলছে। এই মানুষটা তার পাশে থাকলে রথি যেন চোখ বুজে সব ধরণের বিপদ অতিক্রম করতে পারে। হ্যাঁ এতোটাই জায়গা করে নিয়েছে সে রথির মনগহ্বরে। রিকশায় তাদের নিরবতাই চললো, কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহসটা জোগাতে পারলো না।
নাশিদ ভাড়া মেটাতে গেলে রথি তাকে থামালো। অতঃপর থমথমে গলায় বললো,
-‘ভাড়া দুজন মিলিয়ে ঝিলিয়ে দেয়াটাই ঠিক মনে করি!’
নাশিদ এবার রথির কথায় পাত্তা দিলো না। একপ্রকার জোর করে নিজেই ভাড়া দিলো যার কারণে খানিক মন খারাপ হলো। অতঃপর নাশিদ দারোয়ানকে বলে ভেতরে ঢুকলো। রিসিপশনে গিয়ে মেয়েটাকে তাতানের নাম, ক্লাস বলতেই মেয়েটি তাতানকে এখানে আনার ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে তাতান আসলো। নাশিদ রিসিপশনের মেয়েটিকে বলে তাতানকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে আসলো।
রথি তো তাতানকে নিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তার সবকিছু এখন মরিচিকার মতো লাগছে। ভেতরটায় কেমন তুফান হচ্ছে। নাশিদ স্থির দৃষ্টিতে রথির কান্না দেখছে। তার সহ্য হচ্ছে না রথির চোখের জল, তাই সে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ালো।
—————————–
-‘আপনার ননদ তো ভালোই বড়লোকী পোলার লগে ঘুরে বেড়ায়! আমি যখন বললাম আমার হাতে ওরে তুলে দিতে তখন কেন দিলেন না?’
মার্জান খানিক আতকে উঠলো শামুনের জোড়ালো কন্ঠস্বরে। মার্জান কখনোই এই শামুনের হাতে রথিকে তুলে দেবে না। শামুন মারাত্মক খারাপ যা মার্জানের অজানা নয়। হয়তো মার্জান ওদের সহ্য করতে পারে না তাই বলে এই না যে সে রথির খারাপ চায়। মার্জান ভাবনা ছেড়ে থমথমে বলায় বললো,
-‘যা সম্ভব না, তা নিয়ে কথা বলতে আসবে না। নিষেধ করিনি?’
শামুন চোখ গরম করে মার্জানের দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করতে বলে,
-‘আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করছি এখন তবে! (কিছুটা থেমে) রথিকে না পেলে আমি সব তছনছ করে দিবো, এমনকি আপনাকেও!’
বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। এখন মার্জানের মাথায় হাত। সে কী করবে এখন? নাহ কোনো না কোনো সলিউশন তাকে বের করতেই হবে।
রথি কোচিং থেকে ফেরার সময় থানায় উঁকি দিতে দিতেই যাচ্ছিলো তখনই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খায়। রথি মাথা উঁচু করে সামনে তাকাতেই আঁতকে উঠলো কারণ তার সামনে নাশিদ ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে। নাশিদকে দেখে রথি একটি শুকনো ঢোঁক গিললো। এর মানে কী সে ধরা পরে গেলো? নাশিদ একইভাবে ভ্রু কুচকে বললো,
-‘যেভাবে আজ উঁকি দিতে দিতে যাচ্ছিলে, এই উঁকি দেয়া কী রোজ চলে?’
নাশিদের এরূপ কথায় রথি লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হতে শুরু করলো। এরকম কিছু হবে কে জানতো? কী লজ্জা, কী লজ্জা!
নাশিদ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রথির কান্ড দেখছে। রথি এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারলো না। সে নাশিদকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত দৌড়ে চলে গেলো। নাশিদের এই দৃষ্টি রথির সহ্য করার ক্ষমতা নেই, একদমই নেই। নাশিদ পিছে ঘুরে রথির ছুটে যাওয়া দেখছে৷ কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে আপনমনে হেসে উঠলো। থানার সামনে নাশিদকে একা একা হাসতে দেখে নয়ন ভ্রু কুচকালো। সে নাশিদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-‘কী ব্যাপার স্যার, এভাবে হাসছেন কেন?’
-‘কিছু না, মিশনে চলো৷ দেরী হচ্ছে!’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে থানায় ঢুকে একটা ব্যাগ এনে নাশিদের সঙ্গে তাদের মিশনে রওনা হলো। আজকের মিশনটা কিছু মহিলাকে কয়েকটি বেআইনি হোটেল থেকে উদ্ধার করা।
রথি ছুটে বাসায় আসতেই চমকে উঠে। মার্জান এবং তার মা হেসে হেসে কথা বলছে। রথিকে মার্জান দেখতেই মুচকি হেসে রথির মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তাহলে আমি রথিকে নিয়ে কালই গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। কী বলেন মা? বিকালে সাইফকে দিয়ে তাতানকেও নিয়ে আসবো, একবারের জন্য।’
মা যেন অনেকটা খুশি হলেন। আর রথি? সে তো মার্জানের কথার আগা-মুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
~চলবে।