হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব -৩২+৩৪

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
বিদায়ে কন্দনরত প্রিয়াকে গাড়িতে বসানো হয়। প্রিয়ার সাথে রাহা ও আরো দুইজন কাজিন যাবে। প্রিয়া যেই গাড়িতে যাবে ওরাও একই গাড়িতে উঠে। গাড়িতে প্রিয়ার পাশে জারিফ এসে বসে একবার প্রিয়ার দিকে তাকালো। প্রিয়া নিশ্চুপ বসে আছে। কাঁদছে না। জারিফ প্রিয়ার বাম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। বলল,

“টিল দ্যা লাস্ট ব্রেথ, অ্যাই ওয়ান্না লাভ ইউ।”

প্রিয়া জারিফের চোখের দিকে তাকিয়ে চোখে হাসলো অতঃপর জারিফের হাতটা শক্ত করে ধরলো।

_________

প্রিয়াদের বাসায় সব কেমন শান্ত পরিবেশ। মেয়ে বিদায়ের পর প্রিয়ার মা, নিজের রুমে বসে আছেন। প্রিয়ার বাবা, চাচারা ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। সব কেমন নিরবতা। হই-হুল্লোড় দেখা যাচ্ছে না। কাজিনরা যারা আড্ডা দিচ্ছে একটা রুমে দরজা বন্ধ করে। প্রিয়ার চাচা বলেন,

“ওরা যোগাযোগ করেছে? পৌঁছেছে ওরা? প্রিয়মকে ডাকো তো।”

প্রিয়মকে ডেকে আনার পর প্রিয়ম বলে,
“হ্যাঁ পৌঁছেছে। জারিফ আমাকে জানিয়েছে। তোমরা টেনশন কেনো করতেছো? জারিফের পরিবার প্রিয়ার সাথে খারাপ ব্যাবহার তো করবে না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

এদিকে জারিফদের বাড়িতে বয়োজ্যেষ্ঠ ও কিছু প্রতিবেশিরা প্রিয়াকে দেখতে এসেছে। প্রিয়া অসহায়ের মতো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। জারিফকে ওর বন্ধুরা কই নিয়ে গেছে জানে না। প্রিয়ার সাথে রাহা ও আরেক কাজিন তাসফিও বসে আছে। তামান্নাকে তার শাশুড়ি জরুরী কাজে ডেকেছে। জারিফের অন্য কাজিনরা রুম সাঁজানোতে ব্যাস্ত। একমাত্র ফিহা প্রিয়ার সাথে বসে আছে। মুন্নির মা প্রিয়াকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছেন। না, তিনি প্রিয়াকে কোনো আ*ক্রম*ণা*ত্মক কথা বলবেন না। তিনি শুধু দেখছেন, সেই মেয়েটা যে এতো ভাগ্যবতী। যে কীনা তার মেয়ের সুখটা না চেয়েও পেয়ে গেছে অথচ তার মেয়ে চেয়েও পায়নি। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চাইলে সে খারাপ ব্যাবহার করতে পারে কিন্তু তাতে তার মেয়ের কোনো লাভ তো হবে না! উলটো সবাই কটু দৃষ্টিতে দেখবে।

________

জারিফ বাহির থেকে একটা প্যাকেট হাতে বাড়ি ফিরে ড্রয়িংরুমে প্রিয়াকে সবার মাঝে বসে থাকতে দেখে নিজের রুমের দিকে যায়। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা বাজে। নিজের রুমের সামনে গিয়ে দুই তিনবার নক করলে ভেতর থেকে এক কাজিন ‘কে এসেছে?’ জানতে চাইলে জারিফ জবাব দেওয়ার পর তখন সেই কাজিন বলে,

“এখন তো ঢুকতে পারবা না ভাই। সাঁজানো শেষ হলে তোমার বউকে এখানে বসিয়ে দিয়ে তোমাকে গেটে আ*টকাব। তারপর বখশিশ দেওয়ার পর ঢুকতে পারবে। এখন যাও তো।”

“দেখ সাদিক, দরজা খোল। আমার কাজ আছে।”

জারিফের কথায় ভেতর থেকে জবাব এলো,
“মোটেও না। তোমার কোনো চালাকি চলবে না। শ্যালিকাদের তো ঠিকই বখশিশ দিলে। আমরা কি দোষ করেছি? আমাদের বখশিশ না দিলে আজ তোমার বাসর মিস!”

জারিফ কোমড়ে এক হাত গুঁজে আরেক হাতে কপালে ঘষছে। তামান্না তখন জারিফের রুমের সাঁজসজ্জা দেখতে এসে দেখে জারিফ দাঁড়িয়ে তাই রম্যস্বরে জিজ্ঞেস করে,

“কী দেবরজি? এখানে কী হ্যাঁ? এখনই বাসর করার শখ হলো! কিন্তু তোমার বউ তো ড্রয়িংরুমে!”

“উফ ভাবী! আমি একটা কাজে এসেছি।”

জারিফের তিরিক্ষি পূর্ণ কথায় তামান্না ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
“কী এমন কাজ শুনি? এখন রুম সাঁজাচ্ছে। তুমি আমাদের সারপ্রাইজ নষ্ট করতে পারো না। ভেতর থেকে কিছু আনা লাগলে আমাকে বলো আমি এনে দিচ্ছি।”

জারিফ একরোখা স্বরে বলে,
“তোমরা বুঝবে না। আমার আর্জেন্ট লাগবে। দরজাটা খুলতে বলো। আমি জাস্ট জিনিসটা রেখেই চলে যাবো। তোমাদের বলা যাবে না। ইট’স সিক্রেট।”

তামান্না বলে,

“আমাকে দেও আমি রেখে দিচ্ছি।”

“না। এটা আমিই রাখব।”

তামান্না সন্দেহের সুরে বলে,
“তুমি অন্য কোনো মোটিভ নিয়ে আসোনি তো? সত্যি করে বলো?”

জারিফ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“হোয়াই শুড অ্যাই? ইটস মাই রুম। নিজের রুমে অন্য কী মোটিভ নিয়ে আসব?”

তামান্না কী বলবে ভেবে পেলো না। জারিফ অবশ্য তেমন ছেলে না যে অন্য কোনো মোটিভে আসবে। চেহারার ভাব দেখেও মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছে। তামান্না এবার দরজায় নক করে। ভেতর থেকে জানতে চাইলে তামান্না এসেছে শুনে দরজা খুলে। তামান্না জারিফকে ঢোকাতে নিলে কাজিন মহলে শোরগোল পরে যায় অতঃপর তামান্না ওদের বুঝিয়ে জারিফকে ঢুকতে সাহায্য করে। জারিফ রুমে ঢুকে এদিকওদিক না তাকিয়ে সোজা আলমারির কাছে গিয়ে লক খুলে প্যাকেটটা রেখে আবার আলমারি লক করে চাবি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওর কাজিনরা উুঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো এখন জারিফ যাওয়ার পরে একজন বলে,

“ভাইয়া ব্যাগে করে কী আনতে পারে? এতো লুকানোর কী আছে?”

জায়ান বলে উঠে,
“যা খুশি আনুক। তোরা তোদের কাজ কর। নয়টা বাজতে চলল। আধ ঘণ্টার মধ্যে রুম সাঁজিয়ে প্রিয়াকে এখানে আনতে হবে।”

তামান্না চিন্তিত হয়ে বলে,
“মেয়েটা অনেক্ষণ ধরে বসে আছে। রেস্ট তো নিবে তাই না? নাস্তা দিয়েছিলাম খেলো না। এখন ওকে আমার রুমে নিয়ে গিয়ে একটু ভাত জাতীয় খাবার দেই। যাই তাহলে। মাও বলেছেন যেতে। আমি তোমাদের কাজ কতোদূর দেখতে আসলাম।”

“জলদি যাও। আর ওর দুই বোনকেও ডিনার করিয়ে ফেলো। বিয়ে বাড়িতে কখন না কখন খেয়েছে!”

তামান্না সায় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে প্রিয়ার কাছে যায়। ড্রয়িংরুমে গিয়ে সবাইকে বসতে বলে প্রিয়া, রাহা ও তাসফিকে নিয়ে নিজের রুমে যায়। জারিফের মা তিনটা প্লেটে খাবার সাঁজিয়ে নিয়ে এসেছে। তিনি মুখে হাসি ঝুলিয়ে নরম স্বরে বলে,

“তোমরা একটু খেয়ে নাও। সারাদিন যা ধকল গেলো আর এতো গরমে পোলাও খাবে! তাই ভাত, মাং*স ভুনা, মাং*স দিয়ে মুগ ডাল রান্না করেছি। তাই দেরি হলো। ঝটপট গরম গরম খেয়ে নাও তো।”

প্রিয়া ধীর স্বরে বলে,
“এতো কস্ট করলেন মা। এমনিও অতো খিদে পায়নি। যা ছিল তাতেই হয়ে যেতো।”

“চুপ মেয়ে। সকালের রান্না তোমাদের এখন দিতাম নাকি! আর বিয়ে বাড়িতে খাবার এখন খেলে তো আরও অস্থীর লাগবে। দেখো, সাথে টমেটো, শসা কাঁচা ম*রিচ ও সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে সালাদ বানিয়ে এনেছি। খেতো ভালো লাগবে।”

প্রিয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। শাশুড়ির আদর যত্ন দেখে এখন মায়ের কথা মনে পরছে। জারিফের মা প্রিয়ার অশ্রু টইটম্বুর করা নয়নযুগল দেখে স্নেহের কন্ঠে সুধায়,

“আমি খাইয়ে দেই?”

প্রিয়ার গলায় কথা আটকে গেছে। ঠোঁট কা*ম*ড়ে কান্না আটকানোর প্রচেষ্টায় আছে সে। জারিফের মা হাত ধুয়ে এসে ভাত মাখিয়ে প্রিয়ার মুখের সামনে ধরে। প্রিয়া বহুকষ্টে কান্না আটকিয়ে হা করে। তামান্না, রাহা ও তাসফি এই দৃশ্য দেখে আপ্লুত হয়। তরুণীমা বেগম ওদেরকে বলে,

“তোমাদেরও খাইয়ে দিবো?”

রাহা ও তাসফি ঘার নাড়িয়ে না করে। তারপর ওরাও খেতে শুরু করে। প্রিয়া খাওয়ার মাঝে টিসু দিয়ে চোখের জল গড়াবার আগেই মুছে নেয়। তরুণীমা বেগম খাওয়ানো শেষ করে প্রিয়ার গালে হাত রেখে কপালে চু*ম্বন করেন। বলেন,

“তামান্নার থেকে জেনে নিও আমি শাশুড়ি হিসেবে কেমন। তোমার এতো ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না বুঝেছ। আমার মেয়ের মতো থাকবে তোমরা।”

প্রিয়া ঘার হেলায়। জারিফের মা হালকা হেসে প্লেট হাতে বেরিয়ে গেলেন। ততক্ষণে রাহা ও তাসফিরও খাওয়া শেষ। তুতুল কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে প্রিয়ার কোলে বসে পরে। তুতুল আহ্লাদী কন্ঠে আধো বুলিতে বলে,

“ছোটো আম্মু জানো? চাচ্চুর রুমটা কত্তো সুন্দর লাগছে। একদম ফুলের বাগানের মতন। আমাকে একটা হলুদ ফুল দিয়েছে দেখো। এটা আমি তোমার জন্য এনেছি।”

তুতুলের হাতে একটা গাঁদাফুল। এতক্ষণ তুতুল তার নানুর কাছে ছিল। একটু আগে তার বাবার সাথে জারিফের রুম দেখে এই ফুলটা নিয়ে এসেছে। প্রিয়া তুতুলের দুই গা*লে চু*মু দিয়ে টেনে বলে,

“ইশ! আমার তুতুল সোনা ফুল এনেছে। কতো কিউট।”

তামান্না বলে উঠে,
“আসো বাবা। ছোটোআম্মুকে এখন রেস্ট নিতে পাঠাব ওই ফুলের ঘরে।”

“আমিও থাকব ওখানে।”

তামান্না তুতুলের আহ্লাদপূর্ণ কথায় ভড়কে যায়। এই ছেলেকে এখন মন ভুলাতে হবে নয়তো জেদ ধরে বসে থাকবে।

“না বাবা। তোমার জন্য তোমার বাবা একটা সারপ্রাইজ রেখেছে। ইয়া বড়ো সারপ্রাইজ। দেখবে না?”

“হুম হুম। কই সারপ্রাইজ?”

তুতুলের উৎসুক কন্ঠে তামান্না স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“ঘুমানোর আগে দিবে বলেছে। এখন ছোটোআম্মুকে রেখে আসি চলো।”

তুতুল রাজি হয়ে যায়। প্রিয়াকে নিয়ে জারিফের রুমে বসিয়ে দিয়ে হাসি ঠাট্টা করে চলে আসে। প্রিয়া রুমের সাজসজ্জা দেখতে থাকে। লাল, হলুদ, সাদা গোলাপের কম্বিনেশন সাথে রজনীগন্ধা, গাঁদাফুল, বিভিন্ন রঙের জারবেরা ফুল দিয়ে সাঁজানো। বিছানার উপর গোলাপের পাঁপড়ি ছিটানো। ঘরের মেঝেতে একটা বড়ো পাত্রে পানির উপর বিভিন্ন রঙের জারবেরা ফুল, বেলি ফুল ও ছোটো মোমবাতি ভাসছে। রুমে তিন রঙের ডিম লাইট একত্রে জ্বালানো। সাঁজটা প্রিয়ার পছন্দই হয়েছে কিন্তু খুব নার্ভাস লাগছে।
এখন সবাই মিলে জারিফের থেকে গেট আটকিয়ে হাজার দশেক টাকা হাতিয়েও নিয়েছে। জারিফ দেনাপাওনা মিটিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক তরে। রুমের আলোকসজ্জায় সবকিছু আবছা সুন্দর লাগছে। বিছানার মধ্যিখানে লাল টুকটুকে বধূ সাঁজে প্রিয়া বসা। জারিফ ধীর পায়ে আলমারির কাছে গিয়ে সেই প্যাকেটটা বের করে প্রিয়ার কাছে যায়। প্রিয়া চোখ খিঁচে বন্ধ করে বসে আছে। জারিফ প্রিয়ার সম্মুখে বসে বলে,

“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস–
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

কবিতাটা দুটি পঙক্তি বলে জারিফ আবার বলে,

“এখনও তোমার সামনে বলেছি বলে মনে হয় না। আমার হৃদয় হিয়ার মাঝে প্রিয়তমা ভালোবাসার নাম প্রিয়া। দ্যা গার্ল, অ্যাই অ্যাম ইন লাভ উইথ।”

প্রিয়ার মুখশ্রী রক্তিম হয়। শরীরে কম্পনের সৃষ্টি হয়। লোমকূপে কেমন শীতলতা বয়ে যায়। জারিফ প্রিয়ার দিকে একটু এগিয়ে হাতের প্যাকেটটা খুলে একটা ছোটো বক্স বের করে তারপর বক্স খুলে একটা ছোটো ডায়মন্ডের হার্ট শেইপ পেন্ডেন্টের চেইন বের করে প্রিয়াকে নিজ হাতে পড়িয়ে দেয়। তারপর আঙুলে ছোট্ট হার্ট শেইপ ডায়মন্ড পাথরের একটা রিং পড়িয়ে দেয়। প্রিয়া অবাক চোখে জারিফের দিকে তাকিয়ে আছে। জারিফ বলে,

“বিয়ের গহনা আমার মা-বাবার দেওয়া। আমার মা, তার দুই পুত্রবধূর জন্য একই ওজনের সবকিছু বানিয়েছেন। তাও এখনকার উপহার আমার তরফ থেকে। এতো ভারী সাজসজ্জা ছেড়ে এই শাড়িটা পড়ে আসো। সাথে এই নোজপিন ও এয়াররিংটাও (পেন্ডেন্টের সাথে)। আমি তোমাকে এই সাঁজে স্নিগ্ধ বেশে দেখতে চাই। তারপর ঘুমোনোর আগে চেঞ্জ করে নিও নাহয়।”

প্রিয়া দেখে একটা লাল জামদানী শাড়ি। শাড়িটার কারুকাজ একটু অন্যসব সচরাচর কারুকাজ থেকে আলাদা। প্রিয়া মুচকি হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়।
#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৩
প্রায় আধঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর প্রিয়া শাড়ি সামলাতে সামলাতে ওয়াশরুম থেকে বেরোয়। শাড়ি সে কোনোরকম পরা শিখেছিল। তাই পরতে পেরেছে। অনেকটা সময় লেগেছে বলে খারাপও লাগছে কিন্তু শাওয়ার নেওয়াটা জরুরী ছিল। সারাদিন কমতো ধকল গেলো না! তারউপর ভারী মেকআপ! চুলের হালকা পানিতে শাড়ি কিছুটা ভিজেছে। তোয়ালে দিয়ে মোছার পরেও পানি অনেকটাই থেকে গেছে। অবশ্য প্রিয়া চুল খুব হালকা করে মোছে। জারিফ ব্যালকনিতে ছিল এতক্ষণ। এখন ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজে রুমে এসেছে। রুমে এই পর্যায়ে সাদা বাতিই জ্বলছে ডিম লাইটগুলোর বদলে। প্রিয়া ইতস্তত করে আয়নার সামনে বসে। তারপর চুলগুলোর নিচে জমা পানি মুছে চিরুনি নিলো আঁচড়াতে। জারিফ ধীর পায়ে প্রিয়ার পেছোনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়া যখনি চেইন পড়তে নিবে জারিফ বাঁধা দেয়। প্রিয়া আয়না দিয়ে তাকায় তার প্রিয় মানুষটির পানে। তার মুখে ঝুলছে মুগ্ধকরা হাসি যার বিনিময়ে প্রিয়ার মুখশ্রীতে ব্রীড়া মিশ্রিত আভা পরিলক্ষিত। জারিফ নিজ হাতে প্রিয়াকে অলংকারে সজ্জিত করে। পেন্ডেন্টের চেইন, এয়াররিং, আংটি ও হাতে লাল চুড়ি। সাঁজ শেষে জারিফ প্রিয়ার কাঁধে হাত রেখে আয়নায় প্রিয়ার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে,

“আজ আকাশের চাঁদটাও তোমাকে হিংসে করবে জানো! তারই জোৎসনায় তুমি চন্দ্রবিলাশ করবে আর আমি তোমাকে।”

প্রিয়া দৃষ্টি আর তুলতে পারলো না। চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। জারিফ আসার পর থেকে প্রিয়া একদম চুপ হয়ে আছে। একটা কথাও বলছে না। ব্যাপারটা জারিফ লক্ষ্য করল। জারিফ খানিকটা হেসে বলল,

“ফ*ড়ফ*ড়ানি পাখি আজ এতো নিরব? হঠাৎ কী হলো তার? যে সে নিজের স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করছে। সে কী জানে? তার চঞ্চলতা আমার ভিষণ প্রিয়।”

প্রিয়া নত মস্তকেই হাসে অতঃপর আয়নায় জারিফের দিকে চেয়ে বলে,

“তার সংস্পর্শে নিজের নিরবতাতেও প্রশান্তি খুঁজে পাই।”

“তবে চলো তোমার মৌন ব্রতকে আরও দীর্ঘায়িত করতে!”

জারিফের হাসি মিশ্রিত হেয়ালিপূর্ণ কথায় প্রিয়া ভ্রুঁ কুঁচকালো। বলল,

“কোথায়?”

“ওই যে বললাম না? আজ তুমি চন্দ্রবিলাশ করবে আর আমি তোমাকে!”

প্রিয়া আবারও লাজরাঙা হয়। জারিফ প্রিয়াকে উঠতে ইশারা করে। তারপর ওরা দুইজন ব্যালকনিতে যায়। ব্যালকনিতে একটা ম্যাট বিছানো তারউপর কুশন। পাশে একটা গরম পানির ফ্লাস্ক, দুইটা কফি মগ, কফির, গুড়ো দুধ ও মধুর কৌটা রাখা। আর কতোগুলো চিপস, চকলেটের প্যাকেট রাখা। ব্যালকনির ফুলের গাছগুলোর উপর ছোটো ছোটো মরিচবাতির মতো হলুদ বাতি লাগানো তাছাড়া মরিচবাতি দিয়ে গোটা দালানের বহিরাভাগ তো সজ্জিতই। প্রিয়া জারিফের দিকে ঘুরে তাকিয়ে অবাক মিশ্রিত হালকা হাসে। জারিফ একজনকে মেসেজ করলো আর তার কিছুক্ষণ পর দালানে সাঁজানো সব মরিচবাতি বন্ধ হয়ে যায়। প্রিয়া বিস্ময় নিয়ে সুধায়,

“সব মরিচবাতি অফ হয়ে গেলো কেনো?”

জারিফ ম্যাটের উপর বসে প্রিয়াকে হাত ধরে বসতে বলে। তারপর মুচকি হেসে বলে,

“মরিচবাতির আলোয় জোৎসনা বিলাশ ঠিক জমবে না। এখন দেখো, চাঁদের আলোয় কী সুন্দর লাগছে।”

প্রিয়া চমৎকার হাসে। জারিফ কফি বানিয়ে প্রিয়াকে দেয়। প্রিয়া কফি এক চুমুক খেয়ে বলে,

“মধুর সাথে কফি তো আজকেই প্রথম ট্রাই করলাম। মিষ্টতা কম হলেও ভালো লাগছে। আপনাকে আমি একদিন চাফি বানিয়ে খাওয়াব। মালাই চায়ের সাথে কফি। অসাধারণ খেতে ওটা।”

জারিফ কিছুটা শব্দ করে হাসলো। প্রিয়া জারিফকে হাসতে দেখে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালো। জারিফ প্রিয়ার তাকানো দেখে হাসি চেপে বলে,

“ওহ সরি। চাফি নামটা ইন্টারেস্টিং। খেতেও নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টিং হবে।”

“হুহ্। আপনি যদি একবার খেয়ে আরেকবার খেতে না চান তবে আমার নাম….!”

প্রিয়ার অতি উৎসাহী মনোভাব দেখে জারিফ ওকে আটকায়।

“হেই স্টপ। ডোন্ট বি সো মাচ এক্সাইটেড। সবার পছন্দ এক না। তোমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগা জিনিসটা আমার ভালো নাই লাগতে পারে। উই শ্যুড রেসপেক্ট ইচ আদার চয়েস। চাফি নামটা আগে শোনা হয়নি বলেই আমি বলেছি। দ্যাটস ইট।”

প্রিয়া বলে,
“সরি। আপনি একবার টেস্ট করে দেখেন। তারপর বলবেন কেমন লেগেছে। আমার তো ভিষণ পছন্দ। ওটা খেলে আমি এনার্জি পাই।”

“অকে। নাউ এন্জয় দিস কফি।”

ব্যালকনিতে চন্দ্রবিলাশ ও কথা বলেই অনেকটা সময় পার করে ওরা ঘুম আসলে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরে।

________

রাহা অনেক মানুষ ও অপরিচিত জায়গায় ভালো করে ঘুমোতে পারে না। রাত দেড়টা বাজে। সচরাচর এই সময়টা নিস্তব্ধতায় ঘেরা থাকে। রাহা নিচু শব্দে দরজা খুলে রুমের বাহিরে যায়। রুমগুলো সব অন্ধকার। মরিচবাতিও বন্ধ তাই আলোক স্বল্পতা অধিকমাত্রায়। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে খুঁজে খুঁহে ডাইনিংয়ে যায় পানি খেতে। হাতে করে চকোলেটও নিয়ে এসেছে। ব্যাগে কফি পাউডারও আছে কিন্তু অন্যের বাড়িতে গভীর রাতে রান্নাঘরে যাওয়াটা শোভনীয় না। তাই চকোলেটই খাবে। পানি খেয়ে রুমে ফিরে যাচ্ছিল হঠাৎ এক পুরুষালি কন্ঠে থমকে দাঁড়ায়। ভয়ও পেয়েছে অনেকটা। দোয়া-দুরুদ, আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করেছে মনে মনে চোখ মুখ খিঁচে। একটা পায়ের শব্দ ক্রমশ রাহার দিকে আসছে আর ওর ভয় আরও বাড়ছে। হৃৎপিন্ড দ্রুতগতিতে কাজ করছে। এবার অনেকটা কাছ থেকেই কন্ঠস্বরটা শুনলো। কেউ মুখের উপর লাইট ছুড়েছে।

“ওহ তুমি।”

রাহা টিপটিপ করে এক চোখ খুলে দেখতে চাইলো, কে? কিন্তু লাইটা একদম চোখের উপরই পরেছে বলে চোখ মেলতে পারছে না। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। বিপরীত পাশের ব্যাক্তিটি হয়তো এই অস্বস্থি বুঝলো! সে লাইটটা উপরের দিকে ধরলো যার দরুন পুরো রুম হালকা আলোকিত হলো। রাহা আস্তে আস্তে চোখ খুলল। কন্ঠস্বরের মালিকটি আর কেউ নয় নাহান! নাহান জিজ্ঞেস করে,

“এতো রাতে এখানে কী করো? ঘুমোয়নি কেনো?”

রাহা থতমত খেয়ে যায়।
“না আসলে। আমার ঘুম আসছিল না। পানি খেতে এখানে এসেছিলাম।”

“ওহ আচ্ছা। লাইট অন করে নিতে। অন্ধকারে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

“না তা লাগবে না। আমি এখনি রুমে চলে যাবো।”

নাহান বলে,
“অ্যাই ডোন্ট থিংক, তোমার এখন ঘুম আসবে। এক মগ কফি খেতে পারো। অনেকসময় কফি খেলে ভালো ঘুমও হয়। কনসানট্রেট থাকে যেটা করতে চাও আর ঘুমোতে চাইলে সেটাও হবে। সো?”

রাহা রাজী হয়ে যায়। তার কফি খেতে ইচ্ছেও করছিলো। নাহান ক্যাটলিতে পানি গরম বসিয়ে দিয়ে মিক্সড কফি পাউডার দিয়ে কফি বানিয়ে নেয়। চিনির বদলে সে মধু দেয় যাতে ঘুমটা ভালো হয়। দুজনে ড্রয়িংরুমে বসে কফি শেষ করে। দুজনে নিশ্চুপই ছিল। কফি শেষ করে রাহা বলে,

“থ্যাংকিউ ফর দ্যা কফি। অ্যাই রিয়ালি নিডেড ইট।”

নাহান হালকা হেসে বলে,
“মাই প্লেজার।”

রাহা মুচকি হেসে রুমে চলে যায় আর নাহানও নিজের রুমে চলে যায়। নাহান অবশ্য ঘুমাবে না। সে একটা মুভি দেখতে শুরু করেছিল একা একা ব্যালকনিতে বসে। মুভিটা শেষ হলে ঘুমোবে। অন্য সব কাজিনরা রাত একটা বাজার পরেই টায়ার্ড হয়ে প্রায় ঘুমিয়ে গেছে। দুয়েকজন অনলাইনে আছে তবে তারা ছাদে।

________

সকালে প্রিয়ার ঘুম ভাঙতে কিছুটা দেরি হয়। আটটা বেজে গেছে। উঠে ফ্রেশ হয়ে রাতে বদলে রাখা শাড়িটা পরে পরিপাটি হয়ে ডাইনিংয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখেছে জারিফ ঘরে নাই। প্রিয়া ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখে, তামান্না সেমাইয়ের বাটি রান্নাঘর থেকে ডাইনিং টেবিলে এনে রাখছে। প্রিয়াকে দেখে হেসে বলে,

“আরে তুমি এসে গেছো? তোমাকেই ডাকতে যেতাম সেমাইটা রেখে। নানী ও কয়েকজন দুঃসম্পর্কের দাদী শাশুড়িরা দেখবে, নাস্তার সময় তোমার হাতের বানানো কিছু খেতে চাইবে।”

প্রিয়া তামান্নার দিকে না বুঝে তাকালো। তামান্না বলে,

“চিন্তা করো না। তুমি পায়েসটা বানাতে পারবে? আমি দেখিয়ে দিবো সমস্যা হলে। মিষ্টি জাতীয় কিছু বানালে খুশি হবে। আমার বিয়ের পরেরদিনও আমি বানিয়েছিলাম। অবশ্য আমি বানিয়েছিলাম তাদের থেকে শোনার পর। খারাপ কিছু বলেনি কিন্তু তাও তারা বলার আগেই তুমি এবার বানিয়ে ফেলো।”

“আচ্ছা ভাবী। আমি পারব। আমি রান্নাবান্নার মধ্যে ডেজার্ট, স্নেক্সগুলো আর টুকটাক কিছু রান্না মোটামোটি পারি। ”

প্রিয়ার কথা শুনে তামান্না খুশি হয়ে বলে,
“তাহলে চলো। জলদি বানিয়ে ফেলো। আমিও নাস্তার জন্য একটা ডাল তরকারিটা বানিয়ে ফেলি। রুটি পাশের হোটেলে তেল ছাড়া বানানোর জন্য তোমার ভাইয়া বলে এসেছে। এতো মানুষের রুটি বাড়িতে বানানো সম্ভব না বাবা!”

প্রিয়া হেসে বলে,
“তা ঠিক বলেছো ভাবী। চলো তাহলে।”

দুই জা রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করতে শুরু করলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।
চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here