লাল রঙের গালিচায় কোথাও অমসৃণ কিছু ছিল না তবুও হোচট খেল শুভ্রা। শায়লা হাসান তার নয় বছরের ছোট বোনের দিকে তাকাল কড়া চোখে।
“খ্যাত কোথাকার! আনস্মার্ট!”
শুভ্রা তাকাল অসহায় দৃষ্টিতে। চোখের কোণে জল আসি আসি করলেও সামলে নিলো।
আপু দেখলে অনর্থ করবে।
এখনো পর্যন্ত লোকজন বেশি আসেনি, লাল রঙের গালিচা ফাঁকাই বলা যায়। আসলে খুব জ্যাম ছিল না আজকে, ওরা বাসা থেকে বেরিয়েছিল জ্যাম থাকবে সে সময়টা হিসাব করে।
অনুষ্ঠানের মূল ভেন্যুতে ঢুকলো না শায়লা, এন্ট্রির পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে মনে হিসাব কষতে শুরু করল।
হোটেল সোনারগাঁও আজ সেজেছে রঙ ঝলমলে সাজে। হতেই হবে, প্রাইম গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের বিগ শেয়ারের হোল্ডারের মেয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বলে কথা।
শায়লা হাসান এই কোম্পানির বিনিয়োগকৃত একটা কোম্পানির এক্সিকিউটিভ। সম্প্রতি শুভ্রার সঙ্গে এই কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ শাহরিয়ারের একটা রসায়ন ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
উদ্যোগটা শায়লা হাসানের। শাহরিয়ারের সুন্দরী স্ত্রী কিছুদিন আগেই ডিভোর্স দেওয়ার পরে কোম্পানির ইয়ার এণ্ডিং প্রোগ্রামে অতিথিদের মধ্যে শাহরিয়ারের মাও আমন্ত্রিত ছিলেন।
বুফে হলেও শায়লা হাসান মিষ্টি হেসে খোঁজ খবর নিচ্ছিল তার। আর তাতেই মুগ্ধ হয়ে শাহরিয়ারের মা কথায় কথায় বলে দিয়েছিলেন শাহরিয়ারের ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার খবর আর বলেছিলেন শাহরিয়ারের বিয়ের জন্য একটা মেয়ে দেখতে। ডিভোর্সি হলেও সমস্যা নেই কিন্তু ঘরোয়া হওয়া চাই।
প্ল্যানটা তখনই মাথায় এসেছিল শায়লা হাসানের। ছত্রিশ বছর বয়সের শাহরিয়ার যে কোনো এলিজিবল ব্যাচেলরের চেয়েও আকর্ষণীয়।
অন্যদিকে বোন শুভ্রা বরের সঙ্গে ঝামেলা করে ফিরে এসেছে। ডিভোর্স নেয় নি এখনো পর্যন্ত তবে নেবে নেবে ভাব।
বরটা একটা অপদার্থ, দুপয়সার চাকরি করে। শুভ্রার রুচিটা পর্যন্ত নেমে গেছে তার সঙ্গে থেকে থেকে।
এই অনুষ্ঠানে পর্যন্ত আসতে চায়নি। আসার আগে একটা নরমাল সুতির ব্লকের ড্রেস পরে রওনা দিচ্ছিল।
ধমক দিয়ে চেঞ্জ করিয়েছে শায়লা। আম্মু মারা যাওয়ার কারণে ঝামেলা হয়ে গেছে।
আম্মু আব্বুর শেষ জীবনের বাচ্চা, কোলপোছা সন্তান। আদরের সন্তান বলেই যেন খানিকটা বোকা বোকা ইমম্যাচিওর আর ইমোশনাল রয়ে গেছে মেয়েটা।
বোন হয়ে খুব বেশি শাসন করাও যায় না ছোট বোনকে। একটুতেই চোখে পানি এসে পড়ে।
আর আব্বুর শরীরটা খারাপ, ব্লাড প্রেশার আর ডায়াবেটিস আছে। একটা স্ট্রোক করেছিলেন আম্মু মারা যাওয়ার পরে তাই ওরা সবাই সব সময় সাবধানে থাকতে চেষ্টা করে এখন।
আব্বু একটু পুরনো দিনের মানুষ, ডিভোর্স পছন্দ করে না। তাই শুভ্রার সংসারের টানাপোড়েনের খবর আর জানানো হয়নি তাকে।
তার ওপর পারভেজের মতো অপদার্থের মধ্যে আব্বু কী দেখতে পেয়েছে কে জানে, খুব পছন্দ তার পারভেজকে। অবশ্য পারভেজ প্রথম প্রথম খুব মাতিয়ে রেখেছিল তাদের সবাইকে, শায়লার প্রেমের শিকড় নির্মমভাবে উপড়ে ফেললেও প্রথম থেকেই প্রশ্রয় দিয়েই গেছে পারভেজকে।
অবশ্য পারভেজ প্রথম এই ফ্যামিলির সাথে পরিচিত হয়েছে ভীষণ ক্রাইসিসের সময়। তখন শায়লা তার বর হাসানের সঙ্গে দেশের বাইরে বিজনেস ট্যুরে। বড়ো ভাই তার ফ্যামিলির সাথে সুইডেনে আছে আরও অনেক আগে থেকেই।
আম্মু অসুস্থ হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে হোস্টেল থেকে ছুটে এসেছিল শুভ্রা।
সঙ্গে এসেছিল এই পারভেজ। ততক্ষণে আরো অসুস্থ হয়ে কেবিন থেকে আই সি ইউতে শিফট করে দেওয়া হয়েছে আম্মুকে।
আব্বুর অস্থিরতা আর শুভ্রার হাউমাউ কান্নাকাটির মধ্যে মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিল পারভেজই, সেই মনে করিয়ে দিয়েছিল আব্বু নিজেও অসুস্থ, তারও চার ধরনের ওষুধ খেতে হয় ব্লাড প্রেশার আর ডায়াবেটিসের। রাতে শুভ্রা আর আব্বুকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে আই সি ইউ এর পাশে ওয়েটিং রুমের শক্ত লোহার সোফায় বসে বই পড়ে রাত কাটিয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি।
প্রেমিকার জন্য এত করে কে? তাই বোধহয় গলেছিল আব্বুর বরফ, শুভ্রা পাস করে এলে ওর সঙ্গে বিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।
হাজার বার মানা করেছিল শায়লা। নিজের জন্য এক নিয়ম, আর বোনের জন্য আরেক! এটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল তো বটেই তাছাড়া বিয়ে নিয়ে মিষ্টি রোমান্টিক প্রেম প্রেম ফ্যান্টাসি ততদিনে উবে গেছে তার। ওসব শুধু হুমায়ূন আহমেদের গল্পে আর কারান জোহরের মুভির কাহিনীতে পাওয়া যায়! বাস্তব জীবনে অনেক দিন পোড়খাওয়া শায়লা ততদিনে শক্ত লোহার মতো।
প্রথম বয়সে বেশিরভাগ মেয়ের হৃদয় থাকে গলিত মোমের মতো, স্বামী যেভাবে আকার ধারণ করাতে চায়, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়, মেয়েদের হৃদয়ের মোমবাতি সেই আকার ধারণ করে ফেলে।
শায়লা তার ব্যবসায়ী স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ স্ত্রী তখন, শ্বশুরবাড়িতে তার নিজের প্রতাপ পাকাপোক্ত করে নিতে দেবর মোশাররফের সঙ্গে শুভ্রার বিয়ের কথাটা পাড়বে পাড়বে করছিল। ভেবেছিল সেই বিজনেস ট্যুর থেকে ফিরে এসেই প্রস্তাবটা নিয়ে যাবে। কে জানত এর মধ্যে আম্মু অসুস্থ হয়ে যাবে আর হাসপাতালে শুভ্রা হাজির হবে আস্ত একটা জলজ্যান্ত প্রেমিক নিয়ে! যদিও আলাদা সংসার তবুও পাশাপাশি ফ্ল্যাট তো! অচেনা একটা মেয়ে দেবরের ঘরে বউ হয়ে এলে ঠিক প্রতিপত্তি আগের মতো বজায় রাখা সম্ভব হবে না, সেই জায়গায় নতুন কারো সাথে এডজাস্ট করার চেয়ে নিজের বোন শুভ্রা নিরাপদ হতো। শায়লার হিসাবটা ছিল এইদিকে।
হিসাব শায়লা আজও কষতে থাকে, কিন্তু ভয় হয় এই বোকা বোকা মেয়েটা সব কাচিয়ে না দেয়। জোর করেও তার কোনো শাড়ি পরাতে পারলো না তাকে, নিজেরই একটা জামদানি শাড়ি পরে হালকা একটা ইমিটেশনের সেট পরেই হাজির হয়েছে।
এতো বেশি ইগো! আচ্ছা শায়লা কিংবা তার বর হাসান কি পারতো না একটা ভালো চাকরির জন্য সুপারিশ করে দিতে! কিন্তু পারভেজ প্রথম থেকেই একগুঁয়ে আচরণ করতে শুরু করেছিল। কী, “না আপু, অনুষ্ঠান ছোট করেই হোক!” পইপই করে বলেও তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য, কিংবা ধার, কিছুই নেওয়ানো যায়নি তাকে। শায়লা চেয়েছিল ফার্নিচার অর্ডার দিতে, সেগুলো পর্যন্ত নেয়নি। শুভ্রার জন্য একটা ছাব্বিশ ভরি সেট দিতে চেয়েছিল, সেটাও না। শুভ্রার বিয়ে হয়েছে তার শাশুড়ি মেহেরজানের দেওয়া ছোট্ট একটা গলার কানের সেট আর আম্মুর কাছ থেকে পাওয়া একজোড়া গোলাপবালা পরে। দেনমোহরের পরিমাণ ছিল মাত্র চার লাখ টাকা, সেটাও সেদিনই উশুল করে বিয়ে হয়েছে শুভ্রার।
আর এইসব কথা নিয়ে কথা বলার সময় টুকটাক কথা কাটাকাটি করে পারভেজের সঙ্গে শুরু থেকেই মন কষাকষির সূত্রপাত শায়লার। শায়লা আগে থেকেই বিরক্তি নিয়ে ছিল অবশ্য, শুভ্রাকে মোশাররফের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারল না বলে। সেই সময় বিরক্তি লুকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য।
তবুও, কি জাদুই যে করেছিল পারভেজ, কে জানে? কত সুখী দেখাচ্ছিল লাল রঙের শাড়ির সঙ্গে কন্ট্রাস্ট করে পরা সবুজ রঙের ব্লাউজের শুভ্রাকে! একটু একটু ঈর্ষাও কি হচ্ছিল না শায়লার! তার বিয়ের সময় এভাবে হাসতে পারেনি তো সে! বিদায়ী কান্নায় আম্মু আব্বুর সঙ্গে সঙ্গে প্রেমিকের সঙ্গে বিচ্ছেদের কষ্টও ছিল মিশে।
আচ্ছা আম্মু আব্বুও পটে গেল কীভাবে? যেটাকে শায়লার কাছে মনে হচ্ছিল উদ্ধতস্বভাব, সেটা আব্বুর কাছে মনে হচ্ছিল বোল্ডনেস। হাসিমুখেই বিদায় জানিয়ে গিয়েছিল শুভ্রা।
কিন্তু কী লাভ হলো? সেই তো ফিরে আসতেই হলো!
মাঝে কেটে গেছে দেড় বছর সময়। কী, না আপু, পারভেজ সময় দিতে পারে না!
ও আর আগের মতো নেই! হাসি পায় শায়লার। ওরে, বাতি বন্ধ করে বন্ধ ঘরে জগতের সকল নারী পুরুষ একইরকম আচরণ করে, এটা প্রেমের বিয়ে করার আগে মানুষ কেন জানি বিশ্বাস করে না।
জগতের সবচেয়ে আলাদা মনে করে তার প্রিয় মানুষটাকে। আসলে সবাই এক।
যাহা পারভেজ তাহাই শাহরিয়ার। তাহলে শায়লা তার জন্য একটা লাভজনক হিসাব কষতে চাইলে অপরাধ হবে কেন?
শুভ্রা শাহরিয়ারের বিয়ে দিতে পারলে তো হলোই। স্ট্যাটাস আপগ্রেড হবে কতো!
আরো অনেক ক্যালকুলেশন আছে, কিন্তু তার জন্য শুভ্রাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া জরুরি। পইপই করে বলে দিয়েছে শায়লা, যেন বলে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর কত দিনের সংসার এটাও তাকে জিজ্ঞেস না করলে বলা প্রয়োজন নেই। একান্তই জিজ্ঞেস করলে বলে যেন দেয় ছয়মাস, পাখিপড়ার মতো পড়িয়েছে শায়লা।
মেয়ে শুধু “হু!” এর বেশি কিছু বলে না। গাধা মেয়েকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিতে বলছে শায়লা সেই কবে থেকে, রাজি হচ্ছে না গর্দভটা। মনে মনে এখনো পর্যন্ত ফিরে যাওয়ার চিন্তা করে কিনা কে জানে?
তবে তার সুযোগ দেবে না শায়লা, শুভ্রা আব্বুর কাছে ফিরে আসার পর প্রতি দিনই ফোনে যোগাযোগ করে কিংবা সামনাসামনি দেখা করে শুভ্রাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। শুভ্রার সামনে একটা পুরো জীবন পড়ে আছে, ওই দুটো বছর প্রেমের পরে বিয়ে আর বিয়ে করে বছর দেড়েক সংসার করে কি জীবন ফুরিয়ে গেছে নাকি! শাহরিয়ারের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে কতো ভালো থাকবে সে, বছর বছর ফরেন ট্যুর, ইচ্ছামত শপিং মলে ঘোরাঘুরি করতে পারবে আর সংসারের কাজের লোড নিতে হবে না, টাকার টানাপোড়েনের মাঝে কেটে যাবে না জীবন – এই এতো এতো সব সত্যি কথাগুলো বলে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে শুভ্রাকে।
তবুও ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিতে রাজি হচ্ছে না একগুঁয়ে মেয়ে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেছে, “আরেকটু ভেবে দেখি!”
কিন্তু আব্বু একটু একটু বুঝতে পারছে বোধ হয়, ইদানীং শায়লা এ বাড়িতে এলে খুব মুখ কালো করে রাখতে দেখে আব্বুকে। বুঝুক গে। বয়েই গেলো শায়লার।
বিয়ের পরে যখন ভালো থাকবে শুভ্রা, কেউ কি আর দোষ দেবে তার? আচ্ছা এই দেড় বছর সংসার করে কী পেয়েছে শুভ্রা?
ফকিন্নির বাচ্চা কক্সবাজার ছাড়া আর কোথাও নিয়ে গেছে শুভ্রাকে? শাহরিয়ারের সাথে বিয়ের পরে যখন বরফের মাঝে কোমর জড়িয়ে ধরে ছবি তুলে পোস্ট করবে ফেসবুকে তখন না বুঝতে পারবে আপু তার জন্য কখনো কি খারাপ চেয়েছিল নাকি!
অফিসের লোকজন আসতে শুরু করেছে একে একে, হাসিমুখে কথা বলছে শায়লার সঙ্গে। শায়লা পরিচয় করিয়ে দিলো শুভ্রাকে, তার ছোট বোন।
“আসসালামু আলাইকুম “, ছোট্ট একটা সালাম দিয়ে হাসলো শুভ্রা।
এখন আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না মূল ভেন্যুর বাইরে, সহকর্মী বন্ধুর সাথে নিচু স্বরে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেল শায়লা। শুভ্রার পিঠে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল সামনে এগিয়ে যেতে, ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল সে।
শুভ্রার পা আটকে গেল একটা জায়গায়, ভেন্যুতে ঢোকার আগে একটা রিকশা সাজিয়ে রাখা আছে।
চকিতে স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো কিছু টুকরো টুকরো দৃশ্য।
সেই ভরা বর্ষা মৌসুমের প্রথম সকাল! আটটার আগেই ক্লাসে হাজির হতে হবে, নয়তো দরজা বন্ধ করে দেবেন রুবেল স্যার। ওর রুমমেটরা সবাই আগেই ক্লাসে চলে গেছে, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে শুভ্রার।
এখন কী হবে? ছাতার শিক ভেঙে গেছে তার, মাত্র গতকালই সারাতে দিয়ে এসেছে ছাতাওয়ালা মামার কাছে!
এদিকে আকাশ থেকে শুরু হয়েছে অঝোরে বর্ষণ, থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না!
অগত্যা শেষ ভরসা হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা।
” মামা যাবেন?”
“কই যাইবেন? ”
“কলেজ বিল্ডিং!”
“পনের টাকা! ”
বর্ষা মৌসুমে তার বিপদ দেখে ব্যবসা করে নিতে চেয়েছিল রিকশাওয়ালা, তবে কথা বলার সময় ছিল না। শুভ্রা সেদিন বিনা প্রতিবাদে উঠে পড়েছিল রিকশায়।
বিপত্তি সৃষ্টি হয়েছিল কলেজ বিল্ডিং এ নেমে। তাড়াতাড়ি করে নামতে গিয়ে মানিব্যাগ ব্যাগে ভরতে ভুলে গিয়েছিল শুভ্রা।
ওদিকে ঘড়ির কাঁটা সাতটা বেজে সাতান্ন মিনিট, এখনই ক্লাসে যেতে হবে!
“ও মামা! আমি আসলে মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি! আপনি আপনার নাম্বার দিন, আমার নাম্বার রাখেন! আমি আমার ক্লাস শেষ করেই রুমমেট কারো কাছ থেকে নিয়ে দিয়ে দিব!”
নিতান্ত ঘাড়ত্যাড়ার মতো করে মাথা নেড়েছিল রিকশাওয়ালা। মামার পরিচয় বেমালুম অস্বীকার করে বলেছিল, “বাকি কারবার করি না আপু! ”
ওদিকে ঘড়ির কাঁটা চলমান, রুবেল স্যারের ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস, করাই লাগবে, প্রক্সি দেওয়ার সুযোগও নেই!
আকাশের মতো মুখেও দুশ্চিন্তার মেঘ জমেছিল শুভ্রার, তবে কি আজকের ক্লাস করা হবে না তার? “ওহ্ খোদা! ” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো সে।
ঠিক সেই সময় দেবদূত নাকি ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছিল খোদাই, “কত টাকা ভাড়া হয়েছে?”
শুভ্রার তখন কান্না পেয়ে যাচ্ছে, “পনের টাকা! ”
পকেট থেকে টাকা বের করে আনতে আনতে বলেছিলো সেই অচেনা মানুষ, “তুমি ক্লাসে চলে যাও! আমি দিচ্ছি! ”
কে দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে, শোনার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় ছিলো না, শুভ্রা ছুটে চলে গিয়েছিল ক্লাসে।
আর কত দিন ধরে অপেক্ষা করছিল আরেকবার তার সঙ্গে দেখা হওয়ার।
বহুদিন ধরে অপেক্ষা করতে করতে একদিন হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল ক্যানটিনে, এদিকে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে জুলাই থেকে অগাস্ট পেরিয়ে শুরু হয়েছে সেপ্টেম্বর মাস।
শুভ্রা তখন খাচ্ছে তার রুমমেটদের সঙ্গে, আর সেই মানুষটাও চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আরও কয়েকজনের সঙ্গে।
শুভ্রা সোজা চলে গেল সেই মানুষটার কাছে, “আপনি? ”
প্রথম চিনতে পারছিল না সে। “স্যরি? ”
“কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন আপনি? জানেন আপনাকে আমি কতো খুঁজেছি?”
“আপনি? আমাকে? খুঁজেছেন? কিন্তু কেন? ”
“আপনি আমার কাছে পনের টাকা পান!’
” কীসের পনের টাকা? ”
“ওই যে, সেদিন, রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলেন? ”
“ওহ্! ” আচমকাই মনে পড়ে গেল তার, “ব্যাপার না!”
“ব্যাপার না মানে? ” কেন জানি রেগে গিয়েছিল শুভ্রা, “আপনি কি প্রায়ই এমন অনেকের ভাড়া দিয়ে দেন নাকি? ”
“আরে বাবা, এক নাম্বার গ্যালারিতে রুবেল স্যারকে ঢুকতে দেখলাম, তারপর তোমাকে কলেজ বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে কাদতে দেখলাম, তখন কি আমার আর বুঝতে বাকি থাকে যে রুবেল স্যারের ক্লাস? বিপদে পড়েছিলে, সাহায্য করেছি! মিটে গেল! আচ্ছা.. ”
বলে শুভ্রাকে যেন মশার মতো করে হাত দিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে উঠে পড়েছিলো মানুষটা।
আর রাগে গরগর করতে করতে রুমমেটরা যে টেবিলে বসে আছে সেই টেবিলে ফিরে এসেছিল শুভ্রা।
“তুই পারভেজ ভাইকে চিনিস কীভাবে? ” চোখ কপালে উঠে গেছে তার রুমমেট ঊর্মির।
“কই আর চিনি? এর নাম পারভেজ নাকি? জানি না তো!”
“হ্যাঁ, তুই তো হাণ্ড্রেড ডেইজ প্রোগ্রামের শেষ পর্যন্ত ছিলি না! সুন্দর নাটক করে ভাইয়া। ”
বলল জেরিন।
“ভালো।” রুমমেটদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সেদিন স্পর্শ করেনি শুভ্রাকে।
তারপর চার দিন পরে আবারও দেখা বিকেলে হোস্টেলের বাইরে রাস্তায়। পারভেজ তখন ফুটপাতে বসে মনোযোগ দিয়ে এক বাচ্চার গান শুনতে ব্যস্ত।
গান শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল শুভ্রা। গান শেষ হয়ে গেলে বাচ্চার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলো পারভেজ।
“যা এখন। দেখা করে যাবি!”
“বাহ আপনার তো মনে হয় অনেক টাকা! ” কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলেছিল শুভ্রা।
উঠে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে বলেছিল, “না আমার অনেক টাকা নেই, তবে কোনো বাচ্চার বাবা মারা গেছে সেই খবর তার কাছে শুনলে বই কিনে দেওয়ার জন্য যে সামান্য খরচ করা লাগে সেটা আছে। আপনি আপনার টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন তো! দিন টাকা। ”
বলে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল পারভেজ। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল শুভ্রা।
শুধু শুধু তার কণ্ঠে অনাবশ্যক রূঢ়তা যোগ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
“আপনি করে বলছেন যে? সেদিন তো বেশ তুমি করে বলছিলেন! ”
“সেদিন আপনি বিপদের মধ্যে ছিলেন, আর বুঝতে পারছিলাম আপনি আমার জুনিয়র! তারপর যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিনও জুনিয়র বলে তুমি করে বলেছিলাম। কিন্তু আজকে আপনি গিয়ার নিয়ে এসেছেন, আজকে আমার সিনিয়রিটি দেখানো ঠিক হবে না।
পারভেজ হাসলো একটু, আর সেই হাসি দেখে বুকের ভেতর কিছু একটা নড়েচড়ে গেল শুভ্রার। কে বলে বেলা শেষের আলো কেবল কন্যাদের সুন্দর করে?
কে যেন লিখেছিলেন, “প্রহর শেষের রাঙা আলোয়…”
কিন্তু এখন তো চৈত্র মাস নয়, তাই এইসব কথা ভাবা বন্ধ করে দিলো শুভ্রা।
“কই দিন টাকা? যতদিন পর্যন্ত দিতে না পারবেন ততদিন শান্তি হবে না তো?”
“তুমি করে বলেন ভাই, প্লিজ! ”
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বড় একটা শ্বাস ছেড়ে ব্যাগটা খুলে মানিব্যাগে উঁকি দিয়ে দেখে একটা ডাহা মিথ্যা কথা বলেছিল শুভ্রা, “ভাংতি নেই!”
“আচ্ছা! ” বলে চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল পারভেজ।
পেছন থেকে মরিয়া হয়ে বলে উঠেছিল শুভ্রা, “ভাইয়া আপনার নাম্বার দিন, আমি নাহয় পরে যোগাযোগ করে টাকা দিয়ে দেবো? ”
“আরে নাহ, তুমি বরং একটা চকোলেট নাহয় বিস্কুট খেয়ে নিও সেই টাকা দিয়ে! ”
লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল পারভেজ। আর ওর সঙ্গে সঙ্গে যেন নিয়ে গিয়েছিল শুভ্রার সেই রঙিন বিকেলের শেষ হয়ে যাওয়া রক্তিম আলোর শেষ আভাটুকুও।
#রিকশা
পর্ব ১
(আপনাদের ভালো লাগলে চলবে। অনুগ্রহ করে কমেন্ট সেকশনে জানাবেন কেমন লাগলো।)