#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_৩১
#তাশরিন_মোহেরা
হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করার এক ফাঁকে ডাক্তার এসে বললো,
‘আপনারা পেশেন্টের কি হোন?’
আমি কান্নারত অবস্থায় বললাম,
‘আমি- আমি উনার মেয়ে।’
ডাক্তার সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
‘আমি এখন যা বলবো, তা শুনে ভেঙে পড়বেন না। আসলে আপনার বাবার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তাই…’
ডাক্তার সাহেব একবার আমার উৎসুক চোখের দিকে তাকালেন। এরপর চোখ নামিয়ে আবারো বললেন,
‘তাই তিনি কোমায় চলে গেছেন। আপাতত আইসিইউতে রেখে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’
আব্বা কোমায় চলে গেছে শুনে আমার মস্তিষ্ক থেমে গেল হঠাৎ। হাত-পা কাঁপা-কাঁপিও বন্ধ হয়ে গেল যেন। চারিদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। বুকের লাফালাফিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একজন মেয়ের কাছে তার বাবা কোমায় চলে যাওয়ার খবরটা ঠিক কেমন শোনায়? ঠিক কেমন অনুভূতি হয় তখন? কিন্তু আমি তো কোনো অনুভূতিই টের পাচ্ছি না নিজের ভেতর! অনুভূতিহীন জড় কাঠে পরিণত হয়ে গেছি যেন! এই আব্বাটা-ই আমাকে নিজের কাছ থেকে আড়াল করতে ভয় পেতেন। আমাকে আশেপাশে না দেখলে হাঁসফাঁস করতেন যন্ত্রণায়। একাকিত্বে দেয়ালে মাথা ঠুকে মরতেন! কিন্তু আজ? এ কেমন নিষ্ঠুরতা তার? নিজের মেয়েটাকেই পেছন ফেলে মৃত্যুর দুয়ারে চলে গেলেন!
আমি ঢুলতে ঢুলতে মাটিতে পড়ে যেতে নিলাম। মুখর পেছনে আমার পিঠে হাত ঠেকিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরলো। আমি তার দিকে করুণ চোখে চেয়ে ডুকরে বলে উঠলাম,
‘আব্বা কেন আমায় এতো কষ্ট দিচ্ছেন, মুখর সাহেব? কেন আমার সাথে এমন মজা করছেন? আমার কষ্টটা তিনি দেখছেন না? আমি পারছি না যে!’
এই বলে অঝোরে কাঁদতে বসে পড়লাম। মনের সব ব্যাথা উজাড় করে শব্দ করে কাঁদছি। এই কষ্ট আমি চেপে রাখতে পারছি না! পারছি না আব্বার এমন অসুস্থতা দেখতে!
মুখর আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে বারবার সান্ত্বনা দিয়েই যাচ্ছেন,
‘কাঁদবেন না, মিস.তিথিয়া! আপনার আব্বা সুস্থ হয়ে উঠবেন জলদি।’
আমি জানি মুখরের কোনো সান্ত্বনা-ই সত্য নয়। আমরা কেউ-ই নিশ্চিত নই, আব্বা কবে কোমা থেকে ফিরে আসবেন। এমনকি মাঝপথে আব্বা এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলেও যেতে পারেন। তাই মুখরের এমন মিথ্যে সান্ত্বনায় কান্নার বেগ আরো বেড়েছে আমার! ভাবছি এ মুহুর্তেই যদি আল্লাহ আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতেন! আব্বার আগে যদি আমার মরণ হতো! তবে আব্বাকে এমন অবস্থায় দেখতে হতো না কভু!
হাসপাতালের বেঞ্চিতে বসে আরো খানিকক্ষণ কাঁদলাম হাঁটু গেড়ে। মুখটা হাঁটুর মাঝে লুকিয়ে ফুঁপিয়েই যাচ্ছি! আম্মাকে খুব মনে পড়ছে আমার! আবার খুব রাগও হচ্ছে উনার উপর। কেন এমন পরিস্থিতিতে আমি একা? কেন একা আব্বা-ই এতো কষ্ট ভোগ করছেন? জীবনে কি এমন ভুল করেছি আমি? এ অবস্থায় আম্মার আদরের পরশের যোগ্য কি আমি নই?
তখনই কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ভেজা চোখ দুটো মেলে তাকালাম মানুষটার দিকে। দেখি আন্টি চোখ বুজে আমাকে শান্ত হওয়ার জন্য বলছেন। তার এই পরশটাই তো আমি চাইছিলাম! আন্টিকে ঠিক এখন আমার মায়ের মতো মনে হলো! আন্টি আমার পাশে বসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত হাতে। চুমু খেলেন আমার মাথায়। আমি চুপচাপ সেই আদরটুকু গ্রহণ করে তার বুকে মাথা দিয়ে রইলাম। নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরলো বৈকি! নিজেকে হঠাৎ করেই কেমন ভাগ্যবান মনে হলো!
.
হাসপাতালে দু’দিন থাকার পর ডাক্তার আমায় বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। আব্বাকে নিয়ে তারা অনিশ্চয়তায় আছেন। আর হাসপাতালে থাকতেও আমার কষ্ট হচ্ছে! ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না হওয়ায় বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছি। তাই অযথা হাসপাতালে থেকে আমায় অসুস্থ হতে দেখতে পারছে না কেউ-ই। এ দু’দিন আন্টিও আমার সাথে থেকেছেন। তাকেও আর কষ্টে রাখতে ইচ্ছে হলো না আমার।
কাচের দেয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে আব্বার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলাম। প্রতিদিন এসে দু’বার দেখে যাবো আব্বাকে। কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না কিছুতেই! যেন এখনি আব্বা জেগে উঠে আমায় খুঁজবেন। আর আমি দৌঁড়ে তার কাছে গিয়ে তাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরবো।
নাকে অক্সিজেন মাস্ক পড়ে নির্লিপ্ত ভাবে শুয়ে আছেন আব্বা। একটুকুও নড়চড় নেই তার! নিথর দেহটা দেখে বুকটা আমার ভেঙে যাচ্ছে। আব্বাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আমার মোটেও ভালো লাগছে না! দু ফোঁটা অশ্রু নাকের ডগায় আসতেই তা মুছে আব্বার উদ্দেশ্যে বললাম,
‘আর কত বিশ্রাম নেবেন, আব্বা? এখন তো অন্তত উঠে পড়ুন। দেখুন, আপনাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছি আমি! আমায় আটকাবেন না? বলবেন না, আমায় একা ফেলে কোথাও যেতে পারবি না তুই?’
কিন্তু ওপাশের মানুষটার কোনো সাড়া নেই। একজন মৃত মানুষের সাথে কথা বলাটা বোধহয় এর চাইতেও বেশি সুখের! আমার অন্তত তা-ই মনে হলো!
আব্বাকে দেখে আবারো বললাম,
‘আমি এ জীবনে কাউকেই ভালোবাসবো না আর, আব্বা। মুখরকেও বিয়ে করবো না। সবসময় আপনার কথা শুনবো! দয়া করে আমার কাছে ফিরে আসুন। আপনার কি মনে নেই আপনার একটা মাত্র মেয়ে আপনার ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছে? আর ঘুমাবেন না, আর স্বপ্ন দেখবেন না, উঠে আপনার তিথিকে দেখুন! প্লিজ!’
কান্নার বেগ বেড়েছে আমার। আন্টি আমাকে আব্বার কাছ থেকে সরিয়ে সামনের বেঞ্চিটাতে বসালেন। কান্না থামানোর অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। গত দু’দিন ধরে একটানা কাঁদার ফলে আমার গলাটাও বসে গেছে। চোখ দুটো ফুলে টমেটো হয়ে গেছে! আন্টিও বোধকরি আমার কান্নায় অতিষ্ঠ। নাক টেনে কান্নাটা কোনোরকম গিললাম। আমার কান্না থেমেছে দেখে আন্টি আমার মুখটা তুলে ধরলেন। আদর নিয়ে বললেন,
‘তোমার বাসায় তো কেউ নেই, তাই না?’
আমি দু’দিকে মাথা দুলালাম। আন্টি এবার বললেন,
‘তাহলে ক’টা দিন আমাদের বাসায় থেকো, মা! তোমাকে একা রাখতে আমার মন সায় দিচ্ছে না।’
আমি বসে যাওয়া গলায় বললাম,
‘চিন্তা করবেন না, আন্টি! আমি একা থাকতে পারবো!’
কিন্তু আন্টি তার কথায় অনড়। অনেক বলে কয়েও লাভ হলো না। তাই ঠিক হলো আমি তার বাসায় কয়েকদিন থাকবো। তাই আব্বাকে আজকের মতো বিদায় জানিয়ে চলে এলাম মুখরদের বাড়ি।
মুগ্ধ আমাকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলো। তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যেমূলক হাসলাম খানিক।
মুখরদের বাসাটায় তিনটে বেডরুম আছে। বাগানের দিকের রুমটা আগে প্রায় সময়ই বন্ধ থাকতো! তবে এখন আমার জন্য তা খুলে দেওয়া হয়েছে। রুমটাতে ঢুকেই দেখলাম তা বেশ পরিপাটি হয়ে আছে। আন্টি বোধহয় আগে থেকেই আমাকে এখানে আনার প্ল্যান করে রেখেছিলেন।
তিনদিন ধরে এক কাপড়ে হাসপাতালে থেকে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে আমার! গা থেকেও কেমন হাসপাতাল হাসপাতাল গন্ধ! জলদি ফ্রেশ হওয়া দরকার। তবে বিপত্তি বেঁধেছে একটা বিষয়ে। এক ঘরে মোট দুটো বাথরুম। একটা আন্টি আর মুগ্ধের রুমের সাথে সংযুক্ত, যেই রুমটায় আগে মুখর আর মুগ্ধ থাকতো। আর বাকিটা মুখরের রুমের সামনেই। যাকে সচারাচর উন্মুক্ত বাথরুম বলি আমি! সব ঘরেই এমন একটা উন্মুক্ত বাথরুম আছেই! তবে আমি মেয়ে হয়ে দু’দুটো ছেলের ব্যবহৃত উন্মুক্ত বাথরুমে ফ্রেশ হবো তা কখনোই হয় না! মেয়ে হিসেবে একটা প্রাইভেসি তো আছেই, তাই না?
আন্টিকে বলে আন্টির রুমের বাথরুমটায় ফ্রেশ হতে ঢুকলাম। নিজের বাথরুমটা ব্যবহার করতে করতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই আজও রুমের মেইন দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসেছি আমি! প্রায় এক ঘণ্টা সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে লম্বা এক শাওয়ার দিয়ে বেরোলাম। সাদা তোয়ালেটা মাথার সাথে পেঁচিয়ে ধোয়া কাপড়গুলো নিয়ে বাগানের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। বাগানে একটা লম্বা রশি টানানো আছে বলে কাপড় শুকাতে বেশ সুবিধে হয়। ধোয়া কাপড় শুকোতে দিয়ে মাথায় পেঁচানো তোয়ালেটা খুলে চুলগুলো আরেকবার মুছে নিলাম সময় নিয়ে! ভেঁজা চুলগুলো মুছতে মুছতেই বাগানটা ঘুরে দেখলাম। মনে পাহাড়সম কষ্ট থাকলেও বাগানটা দেখে কষ্ট কিছুটা কমলো। বুকের বোঝাটা হালকা লাগছে কিছুটা! তোয়ালেটা শুকোতে দিয়ে পেছন ফিরলাম। পেছনে ফিরেই চমকে উঠলাম। মুখর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে হালকা থু মেরে অপ্রস্তুত হাসলাম। মুখর কবে এসেছে তা-ই তো টের পেলাম না। মুখর হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে আসে। দু’হাত পেছনে গুটিয়ে রেখেছে সে। আমার কিছুটা কাছাকাছি এসে সে তার হাত বের করে আমার সামনে তুলে ধরে। তাতে একগুচ্ছ বেলিফুল শোভা পাচ্ছে। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়েই আমার চোখটা চিকচিক করে উঠলো। আমি তা নিয়ে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলাম। মুখর আমাকে বললো,
‘বেলি আপনার পছন্দ, তাই এনেছি আপনার জন্য।’
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। বললাম,
‘আপনি কি করে জানলেন?’
মুখর উত্তর না দিয়ে বাঁকা হাসলো।
আমার ঠোঁটে বেশ একটা সময় পর প্রাকৃতিক হাসি ফুটলো! ঠোঁট দুটো চওড়া করে মুখরের দিকে চেয়ে বললাম,
‘ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ, মুখর সাহেব।’
আমার জ্বলজ্বল করা দৃষ্টিতে চোখ রেখেই মুখর ঘাবড়ে গেল। আমায় হাত দেখিয়ে বললো,
‘এভাবে হাসবেন না, মিস.তিথিয়া!’
আমি বললাম, ‘কেন?’
কিন্তু মুখর আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই প্রস্থান করলো। অপমানবোধ করলাম আমি! এভাবে ‘হাসবেন না’ বলে কেউ চলে যায়? একটা মেয়ের কাছে কতটা অসম্মানের এ ব্যাপার তা কি আপনি জানেন, মুখর সাহেব?
আচ্ছা? আমি কি তবে খুব বাজেভাবে হেসেছি? মুখর কি বিরক্ত হয়ে চলে গেলো তবে?
তড়িৎ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আগের মতো হাসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এমন জোর করে হাসতে গিয়ে আরো বাজে দেখালো আমায়! তার মানে আমি নিশ্চয়ই খুব বিশ্রীভাবেই হেসেছি! যার কারণে মুখরের তা পছন্দ হয়নি, সে আমার এ হাসি দেখেই পালিয়েছে নির্ঘাত! মনটা ছোট হয়ে গেল ক্ষণিকেই!
(চলবে)#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_৩২
#তাশরিন_মোহেরা
আব্বার সামনে চেয়ার টেনে বসে আছি। মানুষটা এখনো নির্বিকার। দু’মাস হতে চলেছে কোনো হেলদোল নেই তার। হবেই বা কেন? তিনি যে মৃত না হয়েও মৃত! দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাসের উপর দীর্ঘশ্বাসই বেরোয়। আর মনটার যে কি এক অবস্থা! কাউকে বলাও যায় না, আবার ভেতরে সবটুকু নিয়েও বসে থাকা যায় না।
বাড়ি অর্থাৎ মুখরের বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম। প্রায়শই আমি দরজা আটকে ভেতরে বসে থাকি। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বেরোই না। কারো মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করে না, কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না আজকাল। কোনো অনুভূতিই প্রকাশ করার সাহস পাই না। নিজেকে বড্ড ক্লান্ত আর শ্রান্ত মনে হয়। যেন বিশাল এক পাহাড় পাড়ি দিয়ে আমার শরীরটাই ভেঙে গেছে!
দরজায় টোকা পড়ছে, কিন্তু ওপাশ নীরব। বুঝে গেছি মানুষটা মুখর। সেও আমার সাথে এখন প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। সে যে আমায় উপেক্ষা করছে তা নয়। সে আমায় নিজেকে সামলে নেওয়ার সময়টা দিচ্ছে! বিষয়টাতে আমি বেশ সন্তুষ্ট! কেননা কারো চোখে নিজের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ পাক, তা আমি চাই না।
মুখর দরজায় গুনে গুনে তিনটে টোকা দেয়। আমি বেরিয়ে সরাসরি ডাইনিং রুমে চলে যাই। কিন্তু স্পষ্ট টের পাচ্ছি, মুখর ঠিক আমার পিঠ বরাবর আমার সাথেই হাঁটছে। আমি নাস্তাটা নিয়ে আবারো পেছন ফিরে রুমের দিকে পা বাড়াই। তাতে একবার মুখরের সাথে ক্ষীণ ধাক্কা লাগে। আমি কিছুই বলিনি! চুপচাপ রুমে গিয়ে দরজা আটকাতে যাবো, এমন সময় মুখর আমার পিছু এসে খপ করে দরজাটা ধরে দাঁড়ায়। অনুনয়ের সুরে বলে,
‘আজ আমাদের সাথে নাস্তা খেলে হয় না, মিস.তিথিয়া?’
আমি তার চোখের দিকে তাকাইনি! আজকাল কারো চোখে চোখ রাখতেও ভীষণ অস্বস্তি হয় আমার। পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে চেয়ে বললাম,
‘অন্য একদিন!’
মুখর আবারো বললো,
‘অন্য একদিনটা কবে আসবে, মিস.তিথিয়া? এখনো কি সময় হয়নি?’
আমি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বোঝালাম সময়টা হয়নি। এরপরই দরজা আটকে দেই। অন্য একদিনটা বোধহয় আর কখনোই আসবে না। আমার সে সাহস নেই। কেন নেই তা আমি জানি না। তবে নিজেকে সবার আড়াল রাখতেই বেশ ভালো লাগে এখন! সে হোক না ভালোবাসার কেউ!
হাতে থাকা নাস্তাটার দিকে চেয়েই বুঝলাম খাবারের রুচি একেবারেই নেই আমার। জোর করে গিলতে গেলেও বমি করে সবটা উগড়ে দেবো। তার চাইতে বরং জানালার ওপাশে রেখে দেই। কাকেরা ঠুকরে খেয়ে নেবে। ঠিক যেমনটা দুঃখেরা ঠুকরে খেয়ে চলেছে আমার হৃদয়!
.
আজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সরাসরি ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সারাদিন ব্যস্ত থাকবো বলে সকালবেলা-ই চলে এলাম আব্বাকে দেখতে! নতুন বৎসরে পদার্পণ করেছি বলে প্রজেক্ট আর অ্যাসাইনমেন্টে ভরিয়ে রেখেছে।
নতুন বছর উপলক্ষে ভার্সিটিতে প্রোগ্রামের আয়োজন করেছে আমাদের ডিপার্টমেন্ট! সেখানে সবাই শাড়ি পড়ে আসার প্ল্যান করেছে। কিন্তু আমার এসবে মোটেও ইচ্ছে নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আমিই বোধহয় প্রোগ্রাম নিয়ে বেশি লাফালাফি করতাম! তবে এখন আব্বার এমন অবস্থায় নিজেকে কিছুতেই বিনোদনে আকৃষ্ট করতে পারছি না। তবে ডিপার্টমেন্টে বলেও লাভ হলো না! ব্যাচমেটরা জোরদার, আমায় আসতেই হবে! কেউ যেন বাদ না যায়। কি আর করা! প্রথমে ভেবেছি, দেখা দেওয়ার জন্য ই শুধুমাত্র প্রোগ্রামে আসবো। শাড়ি কিংবা এতো সাজগোজের দরকার নেই। কিন্তু কাছের বান্ধবীদের জন্য তাও হলো না! তারা শাড়ি পড়ে আসছে মানে আমায়ও পড়ে আসতে হবে। তাই ভাবলাম আজ একটু নিজের বাসায় গিয়ে শাড়ি জোগাড় করি। মা আমাদের ছেড়ে যাওয়ার সময় তার একটা কাপড়ও নিয়ে যাননি! কোনোরকমে এক কাপড়ে পালিয়েছেন। মায়ের ব্যবহৃত আলমিরাটাও ঠিক আগের মতোই রেখে দিয়েছেন আব্বা! আমি কৌতুহলী হয়ে দু একবার আলমিরাটা খুলেছিলাম। সেখানে দেখেছি মায়ের অনেক শাড়ি আছে। বেশিরভাগই আব্বার উপহার দেওয়া!
বাসায় এসে বেশ যত্ন করে আলমিরাটা খুললাম। তা হতে একেক করে তিনটে শাড়ি বের করলাম। একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, একটা সম্পূর্ণ কালো তবে তাতে খানিক চুমকি চিকচিক করছে আর বাকিটা হালকা জলপাই রঙের জাঁকজমকহীন একটা শাড়ি! শাড়িগুলো শুঁকে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিতে চাইলাম। কিন্তু বেশ আগের হওয়ায় তা থেকে মায়ের শরীরের ঘ্রাণের বদলে আলমিরার কাঠের ঘ্রাণ পেলাম। অতি আদরে শাড়ি তিনটের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। হঠাৎ চোখের সামনে মায়ের মুখশ্রীটা ভেসে উঠলো। তিনি কয়েক হাত দূরেই বিছানায় বসে আছেন। এতোদিনের জমে থাকা কান্নারা বেরিয়ে এসেছে দু ফোঁটা অশ্রু হয়ে। মা’কে সামনে দেখে অভিযোগ করে বললাম,
‘কেন আমায় একা ফেলে চলে গেলে, মা?’
আম্মা নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে হেসেই চলেছেন। তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ভর করেছে! আমি আবারো বললাম,
‘আমার জন্য কি একটুও মায়া হয়না তোমার? একটুও ভাবো না তুমি আমায় নিয়ে? আমার মেয়েটা একা সব সামলাতে পারছে কিনা, ভালোমতো খাচ্ছে কিনা, ঘুমোচ্ছে কিনা, এসব জানতে কি মোটেও ইচ্ছা হয়না তোমার?’
মা ক্ষীণ হেসে জানালেন,
‘আমি তো জানি রে, আমার ছোট্ট তিথিয়া সবটা হাসিমুখে সামলে নেবে। সে পারবে, তার উপর আমার যে পূর্ণ আস্থা আছে!’
আমি কান্না মুছে কপট রাগ নিয়ে বললাম,
‘হ্যাঁ, আমি হাসিমুখে সব সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিদিন। রোজ ভালোমন্দ খাওয়ার, ভালোমতো ঘুমানোর চেষ্টা করি। দিনশেষে ভাবি, তোমার দরকার নেই। কিন্তু, কিন্তু কি করবো বলো? আমিও যে একটা মানুষ! আমারো যে দুঃখ আছে, বেদনা আছে!’
কিন্তু মা আমার অভিযোগ সম্পূর্ণ না শুনেই উধাও হলেন। আমার অভিমানরা ভরসা পেল। মায়ের শাড়ি আঁকড়ে বসে বসে কাঁদতে লাগলাম আমি! আমার সাথেই কেন সবটা খারাপ হয় বারবার? কি করেছি আমি? কি করেছি?
ফোনের ভাইব্রেশনে বিছানাটা চরম ভাবে কেঁপে উঠলো। কান্না থামিয়ে দেখলাম মুখর ফোন করেছে। গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। অশান্ত মনটা শান্ত করার চেষ্টা করে ফোনটা রিসিভ করলাম। মানুষটা চুপ করে আছে। আমি আগ বাড়িয়ে বললাম,
‘আমি একটা কাজে একটু বাসায় এসেছি, মুখর সাহেব!’
মুখর এটুকু শুনে শান্ত গলায় বললো,
‘ঠিক আছে! আমি আপনার বাসার সামনে আসছি, অপেক্ষা করুন।’
আমি বললাম,
‘দরকার নেই। আমি একা-ই যেতে পারবো।’
‘জেদ করবেন না। আসছি আমি!’
আমার খানিক রাগ হলো। হঠাৎ ধমকে বলে উঠলাম,
‘ক’দিন ধরে এমন পিছু নিচ্ছেন কেন আমার, বলুন তো? আমি কি বাচ্চা যে একা যেতে পারবো না? একটু একা থাকতে দিন আমায়, প্লিজ!’
কলটা কেটে দিলাম তৎক্ষণাৎ। কিন্তু কল কেটেই আঁতকে উঠলাম আবার। কি করলাম আমি এটা? এমন ধমকে উঠলাম কেন? মুখরের সাথে এতো রাগ দেখানোটা উচিৎ হয়েছে কি? হয়নি, মোটেও উচিৎ হয়নি। ছেলেটা তো আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তা-ই করছে! এতে দোষের কি আছে? আর আমি কিনা!
ব্যাগে শাড়ি তিনটা পুরে বাসা ছেড়ে বেরোলাম। ইদানীং সবকিছুই গুলিয়ে ফেলছি আমি! অযথা রাগ লাগছে, অযথা অভিমান করছি! যারা আমায় নিয়ে চিন্তা করছেন তাদেরই বারবার কষ্ট দিয়ে ফেলছি!
মুখরকে এখন সরি বলাটাও সম্ভব নয়। তার মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারবো না কিছুতেই! নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে মন চাইছে। কি বিচ্ছিরি রকমের একটা পরিস্থিতিতে আমি পড়লাম!
বাসের হর্নে সম্বিৎ ফিরে পাই। একি! আমি যে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি! ঠিক সামনের বাসটার মুখোমুখি। বাসটা, বাসটার সাথে আমার এই মুহুর্তে সংঘর্ষ হবে, আর! আর কিছুই ভাবতে পারছি না। সামনের বাসটা আমায় মাঝরাস্তায় দেখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আর ক’টা সেকেন্ড! তারপরই আমি কবরে!
চোখ খিঁচে বসে পড়েছি! পা দুটো নড়ছে না কিছুতেই। এরা বোধহয় ধরেই নিয়েছে আমার মৃত্যু এখানেই! হঠাৎ হাতে হেঁচকা টান পড়লো। কারো বুকে লুটিয়ে পাশের ফুটপাতে পড়লাম। তরাক করে চোখটা খুলে দেখি সেই চিরচেনা মুখশ্রী!
ঠোঁট ভেঙে কেঁদে তার বুকে মাথা পেতে দিলাম। মুখর আমায় টান মারায় টাল সামলাতে না পেরে আমায় নিয়েই পাশে পড়ে গিয়েছে। আমার এমন আচমকা কান্নাতেই সেও স্তম্ভিত!
আমায় দু’হাতে আঁকড়ে দাঁড় করিয়ে মুখর জিজ্ঞেস করে,
‘কোথাও লেগেছে?’
আমি হেঁচকি তুলতে লাগলাম। কান্নার মাঝেই বললাম,
‘আমি দুঃখিত, মুখর সাহেব।’
মুখর জিজ্ঞেস করলো,
‘কেন, মিস.তিথিয়া?’
‘আপনার সাথে ঐ সময় এমন রাগ দেখানোর জন্য। আমি রাগ করতে চাইনি! আপনাআপনি হয়ে গেছে।’
মুখর হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো। আমি বুঝলাম না। প্রশ্নবোধক চিহ্ন মুখে এঁটে দাঁড়িয়ে আছি। সে হাসতে হাসতেই বললো,
‘আপনি অনেক মিষ্টি, মিস তিথিয়া!’
(চলবে)
(আমার গল্প দেরিতে দেওয়ার কারণ অনেকেই জানেন। আবারো বলছি, ক’দিন পরই আমার পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। যার কারণে এক দিন পর পর গল্প দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সারাবছর পড়ার কাছে যাইনি, তবে এখন গল্প লিখাতে মনোযোগ কম দিয়ে পড়ায় মন দিচ্ছি! রাগ করবেন না আপনারা কেমন? ভালোবাসা নেবেন।)