অনুভূতি
পর্ব ৩৭
মিশু মনি
.
৫৭.
বেলা বাড়তে বাড়তে মিশুর জ্বর কমে এলো। মেঘালয় যেভাবে সেবা যত্ন করছে তাতে জ্বর ভালো না হয়ে উপায় আছে?
নাস্তা করার পর সবাই বেড়িয়ে পড়লো লালাখালের উদ্দেশ্যে । মিশু একটা চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে। আজকে ওদের মধ্যে বিদ্যাই সবচেয়ে বেশি বকবক করছে। ওর বকবকানি দেখে আরাফের বিরক্ত লাগছে ভীষণ। যে মানুষ টা সারাক্ষণ অনবরত বেয়াদব, মূর্খ এসব বলতে থাকে তার উপর বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওর চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
আজ রাতেই ঢাকায় ফিরবে ওরা। সবাই মিলে একসাথে গাড়িতে যাওয়া কষ্টকর হয়ে যায় সেজন্য মেঘালয় বাসার ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে সিলেটে চলে আসতে বললো। মিশু আজকে বাসে যেতে চাচ্ছে। ড্রাইভার এসে গাড়ি নিয়ে যাবে আর ওরা বাসেই যাবে ঠিক করে ফেললো। আরো একটা দিন থেকে যেতো কিন্তু মিশুর শরীর ভালো নয় আর মেঘালয়ের কনসার্ট থাকায় আজকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হল।
লালাখালে গিয়ে নৌকায় করে পুরোটা ঘুরে এলো ওরা। এক জায়গায় নেমে চা বাগানে যাওয়া হলো। মিশু বাদে বাকিরা সবাই ঝাপাঝাপি করে গোসল করলো আর ও নৌকায় বসে থেকে দেখলো। লালাখাল থেকে বিকেলের দিকেই রওনা দিলো ওরা।
সিলেটে পৌছে খাবার খেয়ে নিয়ে বাংলোয় ফিরলো। মিশুর আবার জ্বর এসে গেছে তাই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কিছু ওষুধ নিলো মেঘালয়। বেড়িয়ে এসে মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে মিশুকে অনেক কিছু কিনে দিলো। মিশু একদম চুপসে গেছে, জ্বর আর মাথা ব্যথার জন্য ও চুপচাপ হয়ে গেছে অনেক। মিশু’র বারবার মনে পড়ছে মেঘালয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর যেদিন নেভারল্যান্ডে যাওয়া হয়েছিলো সেদিন টার কথা। সেদিন ও ওর শরীরে জ্বর ছিলো।
বাংলোয় ফিরে বসে বসে চা আড্ডার সাথে সূর্যাস্ত উপভোগ করলো ওরা। সন্ধ্যার পর আজকেও কাঠখড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বসে গল্প করা হল। কিন্তু আজকের আড্ডা বেশি জমলো না। মিশুকে ছাড়া সবকিছু কেমন যেন নিরামিষ লাগে। কোথাও যেন এতটুকু আনন্দ ও নেই। আগের দিনগুলোতে যেমন আনন্দ হয়েছিলো আজকে সেরকম হচ্ছেনা। মিশুর অসুস্থতার প্রভাব সবার মাঝেই পড়েছে। ঢাকায় ফিরেই একজন ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে ওকে। নিশ্চয় ই অন্য রোগের উপসর্গ এটা।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মিশুর মাথায় তেল মালিশ করে চুল বেঁধে দিলো মেঘালয়। ওকে এখন খুব আনমনা দেখাচ্ছে। মেঘালয় যত্ন করে ওর গা মুছে দিলো, গায়ে লোশন মেখে জামাকাপড় পড়িয়ে দিলো। হালকা সাজগোজ ও করিয়ে দিলো। মিশু শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছে একটা মানুষের ভালোবাসার ধরণ আরো কত রকমের হতে পারে!
বাসে মিশু ও মেঘালয় একসাথে বসলো। পূর্ব ও রোদ একসাথে বসেছে। বিদ্যার সাথে সায়ান ছাড়া আর কারোর ই ভাব হয়নি,তাই বিদ্যাকে সায়ানের পাশেই বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আরাফ একাই বসে হেডফোনে গান শুনতে লাগলো।
পুরোটা রাস্তা মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমালো। মেঘালয় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মিশু যতক্ষণ ঘুমিয়েছে,মেঘালয় ওর মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে মাথা টিপে দিয়েছে ওর। মাঝপথে গাড়ি থামলে মেঘালয় মিশুকে রীতিমত কোলে নেয়ার মত দুহাতে তুলে ধরে বাস থেকে নামালো। হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন হা করে দেখছিলো। রেস্টুরেন্টে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা বাথরুম। মহিলাদের ওদিকে ছেলেদের ঢোকার নিয়ম নেই। মেঘালয় মিশুকে রোদের হাতে তুলে দিয়ে নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর বন্ধুরা অবাক হয়ে দেখছিলো এই মেঘালয়কে। এরকম করেও কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে! মিশু ছাড়া মেঘালয় যেন একদম বাঁচতেই পারবে না। মিশু বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলে মেঘালয় আবারো ওর হাত ধরে নিয়ে এসে মিশুর মুখ ধুইয়ে দিলো। পুরো রেস্টুরেন্টের লোকজনের দৃষ্টি এখন মেঘালয়ের উপর। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেদিকে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মিশুর শরীর দূর্বল, ও একা একা এসব করতে পারবে না এটাই মেঘালয়ের কাছে সবচেয়ে বড়।
মিশু মুখ ধুয়ে এসে টেবিলে বসলো। খাবার এসে গেলে সবাই নিচু হয়ে খেতে লাগলো আর মেঘালয় নিজে খাওয়া বাদ দিয়ে মিশুকে তুলে খাওয়াতে লাগলো। পূর্ব বললো, “মিশু অসুস্থ না হলে আমরা বোধহয় বুঝতেই পারতাম না মেঘালয় ওর এত কেয়ার করে!”
মেঘালয় কারো কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো না। ও মিশুকে তুলে খাওয়াতে লাগলো। মিশু জ্বরের প্রকোপে খেতেই পারছে না। খাবার গিলছে একটু একটু করে। মেঘালয়কে খেতে বললে ও দুবার মুখে দিলো শুধু। পাশেই শো কেসে মিষ্টি সাজিয়ে রাখা দেখে মিশু বললো, “আমি মিষ্টি খাবো।”
মেঘালয় গিয়ে এক কেজি মিষ্টি এনে দিলো ওকে। মিশু এক বসাতেই হাফ কেজি তুলে তুলে খেলো। কাউকে একটা দিলো ও না। মেঘালয় অনেক খুশি হয়েছে। যাক, তবুও তো পেট ভরা থাকবে। মিশুর যে মিষ্টি এত পছন্দ সেটা ওর জানা ছিলোনা। মিষ্টি পেলে মিশু সবকিছু ভূলে যায়।
খাওয়া শেষ হলে মেঘালয় ওকে হাত ধরে নিয়ে আবারো গাড়ির দিকে পা বাড়ালো। একজন লোক বলে উঠলো, “দুনিয়াতে আর কারো বোধহয় বউ নাই, হায়রে প্রেম।”
কথাটা সবার কানে এসে লাগলো। দুজন লোক হাসাহাসি করছে। মেঘালয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। কারো কথায় ওর কিছু যায় আসেনা। কিন্তু আরাফ গিয়ে রীতিমত লোকটার কলার টেনে ধরার মত অবস্থা। পূর্ব ও সায়ান ওকে টেনে ধরে বাসে নিয়ে গিয়ে তুললো। নয়ত লোকটা নির্ঘাত আরাফের হাতে মাইর খেত।
বাসে উঠে মিশু বললো, “তুমি সবসময় আমার এত কেয়ার করো, এরকম পাগলামি কেন করো বলোতো? লোকজন তাকিয়ে থাকে।”
– “তুমি অসুস্থ আর আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ ভাত গিলবো? সেটা আমাকে দিয়ে হবেনা। কে কি বললো দেখার বিষয় না আমার।”
– “আমাদের সমাজে এরকম দেখলে লোকজন হাসাহাসি করবে বোঝোনা?”
– “করুক। আমি প্রেমের নতুন ইতিহাস রচনা করে যাবো। দেশের লোকরা হাসলে যে দেশে লোকজন কেউ কারো দিকে তাকায় না সেই দেশে গিয়ে তোমাকে নিয়ে থাকবো।”
মিশু হাসিতে ঢলে পড়বো। মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি তোমার সাথে মিশতে মিশতে বড় হয়ে যাচ্ছি আর তুমি আমার সাথে থেকে থেকে মিশুর মত বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো।”
মেঘালয় মিশুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “জানিনা রে। আমার কেবলই মনেহচ্ছে পুরো দুনিয়া চলে যাক। শুধু তুমি থাকো, আর কাউকে লাগবে না আমার।”
– “তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো মেঘমনি।”
মিশু ওর বুকে মাথা রেখে হেসেই কুটিকুটি। বাসের লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্ধকার বাসে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিরবতা নেমে এলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাস নিস্তব্ধ। দু একটা জানালা খোলা, সেগুলো দিয়ে শিরশিরে বাতাস আসছে। মিশু চাদর গায়ে দিয়ে মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছে। অন্ধকারে মেঘালয়ের মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। মিশু ওর মুখটা ধরে বললো, “এত ভালোবাসলে আমি তো হুট করেই হারিয়ে যাবো ”
মেঘালয় ওর মুখের উপর হাত দিয়ে বললো, “এইসব ফালতু কথা আর একবার বললে আমিই তোমাকে খুন করে ফেলবো। ”
মিশু আবারো হেসে উঠলো। মেঘালয় সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। কেমন ছেলেমানুষি করছে। প্রেমে পড়লে সবাই বুঝি এরকম পাগল হয়। মিশু অন্ধকারে নিচু হয়ে ঠোঁট দিয়ে মেঘালয়ের ঠোঁট স্পর্শ করলো।
৫৮.
দুদিন পর
আজ মেঘালয়ের কনসার্ট। কনসার্টে সবাই মিলে চলে এসেছে। এক সাড়িতে মিশু, পূর্ব,সায়ান, আরাফ, দুপুর, নিখিল আর রোদ সবাই বসেছে। সবাই মিলে এমন একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে যেন ছোটবেলা থেকেই একসাথে আছে ওরা সবাই। মিশুর সাথে সবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এই দুদিন তো দুপুর আর রোদ মিশুর মাথায় পানি ঢেলে দেয়া থেকে শুরু করে,রান্না করা, খাওয়ানো সব কাজে মেঘালয়কে সাহায্য করেছে। যদিও মিশুর জন্য মেঘালয় একাই যথেষ্ট।
ঢাকায় ফিরে ডাক্তার দেখিয়ে ভালো ওষুধ খেয়ে মিশু একদম সুস্থ হয়ে গেছে। এই দুদিন মেঘালয় সবসময় ওর সাথেই বাসায় ছিলো। নিজে তুলে খাইয়েছে, সবসময় খেয়াল রেখেছে মিশুর দিকে। রিহার্সেলে মাত্র একবার গিয়েছিলো। একবার রিহার্সাল করে কিভাবে গান গাইবে এটা নিয়েই সবাই টেনশনে ছিলো। গ্যালারি ভর্তি দর্শক দেখে মিশুর মুখ হা হয়ে গেলো। মেঘালয়কে অনেকেই চেনে। সবাই ওর সাথে কথা বলছিলো। মিশু শুধু দূর হতে খেয়াল করছিলো ওকে। আজকে মেঘালয়কে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। ইচ্ছে করে গিয়ে একটু ছুঁয়ে দেখি!
প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেলো। মেঘালয় স্টেজে উঠেই সর্বপ্রথম মিশুর দিকে তাকালো। মিশু ক্রমাগত উত্তেজিত হয়ে উঠছে। বারবার সায়ানের হাত চেপে ধরছে ও। সায়ান মিশুর মুগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছে। ছলছল করছে ওর চোখ।
মেঘালয় গান গাইতে আরম্ভ করলো,
“কতবার তোর আয়না ভেঙেচূরে ঘুরে তাকাই,
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই,
কতবার তোর কাঁচা আলোয় ভিজে গান শোনাই,
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই…”
মিশু মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো ওর গান আর গানের লিরিক। কেবলই মনেহচ্ছিলো কথাগুলো ওকে ই উদ্দেশ্যে করে বলা হচ্ছে। মেঘালয় গভীর আবেগ নিয়ে গানটা গাইছে। মিশুর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। সায়ান বুঝতে পেরে একবার মুছে দিলো ওর চোখ। মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “মিশু..”
– “মেঘালয়ের মাঝে এত মায়া কেন সায়ান ভাইয়া?”
– “সেটা আমিও ভাবি।”
মেঘালয় এই মুহুর্তে গাইছে,
“তোর উঠোন জুড়ে বিশাল অংক,
কষতে বারণ ছিলো তাই..
কিছুই বোঝা গেলো না প্রায়…”
মিশু কেঁদে ফেললো এবার। সায়ানের হাত চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রইলো। সায়ান মিশুকে বাঁধা দিলো না। ও চুপ করে রইলো। মেঘালয়ের কণ্ঠে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছে। প্রথমে টিএসসিতে হওয়ার কথা ছিলো, এখন প্রোগ্রাম হচ্ছে মিউজিয়ামের অডিটোরিয়ামে। পুরো গ্যালারি ভর্তি দর্শক। সবাই স্তব্ধ হয়ে গান শুনছে। গান যেন নয়,মেঘালয়ের কণ্ঠে আবেগের স্রোত নেমেছে। এই গানটা শেষ করে মেঘালয় অন্য আরেকটা গান ধরলো।
এবার উকিল মুন্সির ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটা আরম্ভ করলো। কিন্তু ওর গানের রাগ রাগিণীর টান শুনে ভেতরটা কেঁপে যাওয়ার মত অবস্থা হলো। বারি সিদ্দিকী যেভাবে রাগিণীতে সুর দিয়েছেন, মেঘালয় ও ঠিক সেভাবে দম বন্ধ করে টান দিলো। শুনে কেমন যেন বিষণ্ণতা ছেঁয়ে যায় ভেতরে।
গানটা শেষ করার পর মিশু চোখ মেলে খেয়াল করে দেখলো মেঘালয়ের চোখে জল। মিশুর ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে মেঘালয়ের পাশে বসে ওর চোখ মুছে দিতে। শান্ত হয়ে ও বসে থাকার চেষ্টা করেও পারলো না। সায়ানের বাহু চেপে ধরে রইলো শক্ত করে।
এরপর আরো দুটো গান গাইলো মেঘালয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যেকটা গানই আলাদা রকমের। একই কণ্ঠে চার রকমের গানে সুর দিয়ে গ্যালারি মাতিয়ে তুললো। শেষের গানে, “তোর চাঁদে যাওয়া হলোনা, তোর ফর্সা হওয়া হলোনা” গানটা বেশ জমে উঠলো। মেঘালয় নেমে আসার পর ছেলে মেয়েরা ওর সাথে গিয়ে ছবি তুলতে লাগলো। মেঘালয় দু মিনিট ছবিতে পোজ দিয়েই হাফিয়ে উঠলো। এসব সেলিব্রেটি টাইপের কাজকর্ম ওকে দিয়ে হবেনা, ওকে দিয়ে শুধু ভালোবাসা বাসিই হবে। দ্রুত হল থেকে বেড়িয়ে সায়ানকে ফোন দিয়ে বললো মিশুকে নিয়ে বাইরে বের হতে।
চলবে..’
অনুভূতি
পর্ব ৩৮
মিশু মনি
.
৫৯.
মিশু বাইরে আসতেই করিডোরে মেঘালয়কে দেখতে পেলো। মেঘালয় ওর হাত ধরে ওকে নিয়ে একটা গ্যালারিতে ঢুকে গেলো। সবাই প্রোগ্রামে গান শুনতে ব্যস্ত। মেঘালয় মিশুর চোখ মুছে দিয়ে বললো, “কাঁদছিলে কেন তুমি?”
মিশু বললো, “তোমাকে ওরকম ফর্মাল ভাবে দেখে আমার বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করছিলো”
মেঘালয় আচমকা জড়িয়ে ধরলো মিশুকে। মিশুও শক্ত করে হাতের বাঁধনে ওকে ধরে ফেললো। ছেড়ে দেয়ার পর আশেপাশে তাকিয়ে মিশু বললো, “ভাগ্যিস এখানে কেউ নেই। তুমি এমন পাগল কেন বলোতো? যদি কেউ দেখে ফেলতো তাহলে তো নির্ঘাত মিডিয়ায় চলে যেতো। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতামাতি শুরু হয়ে যেতো।”
মেঘালয় বললো, “আমি আর কক্ষনো গান গাইবো না। কক্ষনো কিচ্ছু করবো না। লোকজন যেন আমাকে না চেনে। আমি সাধারণ একটা মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “কিন্তু কেন?”
– “আমি তোমাকে ছেড়ে একটা মুহুর্ত থাকতে পারিনা। যখন তখন তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না, দেখতে পারবো না, ছুতে পারবো না। লোকজন সেলিব্রেটির কাতারে ঢুকে দিয়ে সেসব নিয়ে মজা নেবে। সেলিব্রেটিরা স্বাধীনভাবে প্রেম ও করতে পারেনা। আমি চাইনা এই সুনাম,যশ। আমার চাইনা কিচ্ছু।”
মিশু হেসে ফেললো।মেঘালয় সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। ও হাসতে হাসতে বললো, “এরকম বললে কি হবে? আমিতো চাই তুমি অনেক বড় হও।”
– “হুশ, আমার লাগবে না ওসব। আমি তোমাকে নিয়েই থাকতে চাই,আর কিচ্ছু চাইনা।”
– “আল্লাহ! এই প্রখর আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন মেঘালয়ের এ কি হাল! সে প্রেমে পড়ে পুরাই পাগল হয়ে গেছে। তার মাথা গেছে।”
মেঘালয় মিশুকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “আমি প্রেমের নতুন ইতিহাস রচনা করে যাবো বলেছি না? রোমিও জুলিয়েটের মতন আমাদের প্রেম কাহিনী লোকে জানবে।”
– “যাও, অত লাগবে না। তুমি এখন পাগলামি ছাড়ো।”
এমন সময় একজন লোক এদিকে আসায় মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে ছিটকে সরে দাঁড়ালো। লোকটি কাছে এসে বললো, “আরে মেঘালয় না?”
তারপর ভ্রু কুঁচকে মিশুর দিকে তাকালো। মেঘালয়ের সাথে দুটো কথা বলেই লোকটি চলে গেলো। মিশু বললো, “এখানে আবার সিসি ক্যামেরা লাগানো নেই তো?”
– “থাকলে থাকবে। আমার বউকে আমি যখন খুশি ভালোবাসবো। কার কি?”
মিশু হো হো করে হেসে উঠলো- “মেঘমনি, শীঘ্রই আমাকে পাগলের ডাক্তারি শিখতে হবে মনেহচ্ছে।”
– “হু,তুমি আমার মিসির আলী। তুমি একটা করে ডোজ দিলেই হবে।”
মিশু হাসতে হাসতে বললো, “আমি মিসির আলী? হা হা হা।”
মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে মিশুকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত আদর করে দিতে। কিন্তু পারছে না কিছু করতে। ওর মাথা গরম হয়ে উঠেছে। রাগ হচ্ছে কোনো অজানা কারণে। মিশুর হাত ধরে ওকে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো। বের হওয়ার সময় মিশুর হাত ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে হাঁটতে লাগলো। ব্যাগ নিচে রেখে যেতে হয়েছিলো। মিশু ব্যাগ নিচ্ছিলো আর মেঘালয় দাঁড়িয়ে থেকে রাগে ফুঁসছিলো। সেখানে বসে থাকা গার্ডরা মেঘালয়কে কিছু জিজ্ঞেস করতেই ও রেগে রেগে উত্তর দিচ্ছিলো। মিশু বুঝতে পারছে না মেঘালয়ের এত রাগ কোথ থেকে আসলো?
বাইরে বের হয়ে রাস্তায় চলে এলো সোজা। মিশু ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে অথচ ওর হাত ধরতে পারছে না ভেবে মেঘালয় রাগে লাল হয়ে গেলো। মিশু শুধু হো হো করে হাসছে। একটু আগে স্টেজে ফর্মাল ড্রেসে গান গাওয়া মেঘালয় আর এই মেঘালয়ের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। ওই মেঘালয় একজন আর্টিস্ট, আর এই মেঘালয় একজন প্রেমিক!
মিশু হাসছে আর ওর পাশে হাটছে। মেঘালয় হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলার পর বললো, “শালার ড্রাইভার এখন মোহম্মদপুরে।”
মিশু হাসতে হাসতে বললো, “তোমার হয়েছে কি হঠাৎ বলোতো? এরকম পাগলামি কেন করছো?”
– “আমাকে পাগলা কুত্তা কামড়িয়েছে।”
– “হা হা হা।জলাতঙ্ক হয়েছে?”
– “না, আমার রোগের নাম মিশুয়াসক্তি। মানুষের যেমন মাদকাসক্তি হয়, আমি সেরকম মিশু আসক্ত হয়ে পড়েছি। আমার এখন নেশাদ্রব্য লাগবে। যারা নেশাখোর, তারা নেশাদ্রব্য না পেলে এরকম পাগল হয়ে ওঠে।”
মিশু আবারো হেসে উঠলো। মেঘালয়কে চিনতে ওর সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। মেঘালয় মাথায় হাত দিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। হাইওয়েতে প্রচুর ভিড়। এই কোলাহলময় জায়গায় একদম ই ওর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। ভালো লাগছে না এসব। ও মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কোথায় যেতে যাও এখন?”
– “কোথায় বলতে? আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও?”
মেঘালয় দুহাতে মাথা চুলকাতে লাগলো। আজকে ওর কনসার্ট, আর সেখানে বাইরে দাঁড়িয়ে এরকম পাগলামি কেন করছে বুঝে উঠতে পারছে না মিশু। মেঘালয় ঠিক আছে তো? পাগলামি করছে ভীষণ। মিশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে। মেঘালয় সামনে তাকিয়ে বললো, “ওটা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় না?”
– “হ্যা, কেন?”
– “আসো মেডিকেলে যাবো।”
মিশু থতমত খেয়ে বললো, “মেঘ তুমি ঠিক আছো? মেডিকেলে কেন যাবা?”
– “মর্গে যাবো মর্গে। মেডিকেলে মানুষ কেন যায়? অসুস্থ হলে যায়। আমি এখন অসুস্থ হয়ে গেছি তাই আমাকে যেতে হবে।”
মিশুর এখন চিন্তা হচ্ছে মেঘালয়ের জন্য। এরকম পাগলামি ও কেন করছে আজকে? কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি তো? মুখটা গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে রইলো ও।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “মেডিকেলে যাবা না?”
– “আজব তো, মেডিকেলে গিয়ে আমরা করবো টা কি?”
– “আচ্ছা তাহলে যেতে হবেনা। আমি একাই যাবো।”
মেঘালয় একটা রিক্সা ডেকে বললো, “মামা শিল্পকলায় যাবেন?”
তারপর রিক্সায় উঠে পড়লো। মিশু থতমত খেয়ে সাথে রিক্সায় উঠে পড়লো। মেঘালয় বললো মেডিকেলে যাবে আবার রিক্সাকে বললো শিল্পকলায় যাবে। কি হচ্ছে ওর ভেতরে? এত রেগে আছে যে কিছু জিজ্ঞেস করাও যাচ্ছেনা। মিশু শুধু চুপচাপ চেয়ে আছে ওর দিকে। মেঘালয়ের চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে।
রিক্সাকে দ্রুত যেতে বললে উনি খুব দ্রুত চালাতে লাগলেন। রাস্তার এপাশে অসংখ্য ফুলের দোকান। মেঘালয় একগাদা ফুল কিনে নিলো সেখান থেকে। মিশু ওর আচরণে অবাক হয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় আবারো এসে রিক্সায় উঠে রাগে ফুঁসতে লাগলো। রিক্সা শিল্পকলায় এসে থামলে ও ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে মিশুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। লিফটের ভেতর মিশুকে কাছে টেনে নিয়ে এত জোরে বুকে চেপে ধরলো যে মিশুর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো। এবার বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে মিশু। মেঘালয় কি সত্যিই কোনো সমস্যায় ভুগছে?
লিফট থেকে বেড়িয়ে একজনকে কল দিতেই গ্যালারির দরজা খুলে একজন মহিলা বের হলেন। মেঘালয়ের মায়ের মতই দেখতে উনি। মেঘালয়কে দেখে জিজ্ঞাস করলেন, “কিরে তোর কনসার্ট কেমন হলো?”
– “কনসার্টের গুল্লি মারি। আমি ছেড়ে দেবো এসব।”
উনি অবাক হয়ে একবার মিশুর দিকে তাকিয়ে মেঘালয়কে বললেন, “মাথা খারাপ হয়েছে তোর? এরকম দেখাচ্ছে কেন তোকে?”
– “গাড়ির চাবিটা দাও।”
– “চাবি দিচ্ছি,কিন্তু বলবি তো কি হয়েছে?”
– “আমার এই শহরে একদম দম বন্ধ হয়ে আসছে। আচ্ছা, কোন দেশে গেলে কেউ আমার দিকে তাকাবে না বলোতো?”
উনি অবাক হয়ে বললেন, “এটা কেমন কোয়েশ্চেন মেঘ? লোকজন তোর দিকে কেন তাকাবে না? তুই যেখানেই যাবি সেখানেই লোকজন তোর দিকে তাকাবে। কি হয়েছে বলবি?”
– “চাবি চেয়েছি,চাবিটা দাও। আমাদের শালার ড্রাইভার এখনো বাড়িতে। বারবার বলেছি তাড়াতাড়ি এসে থাকতে। সে এখনো আসেনাই। চাবি কি দিবা? নাকি চলে যাবো?”
মহিলাটি থতমত খেয়ে ভেতরে ঢুকে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে এনে মেঘালয়ের হাতে দিলেন। বললেন, “ভেতরে আয়। মিটিং হচ্ছে আমাদের।”
– “মিটিং এর গুল্লি মারি। আমি এমন এক জায়গায় চলে যাবো যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না। কেউ না।”
– “তাহলে জংগলে যা।”
– “ভালো আইডিয়া তো। এবার জংগলেই চলে যাবো। অসামাজিক হয়ে যাবো। আর এইযে মেয়েটাকে দেখছো, এটা আমার বউ। সময় পেলে তোমার বাসায় নিয়ে যাবো। আজকে সময় নেই।”
– “বউ!”
– “হ্যা, আমার জিন্দেগি ওলট পালট করে দিয়েছে মেয়েটা। ওর ভয়েস খুব মিষ্টি। তুমি ওকে গান শেখাবা? ও গান গাইবে, আর আমি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ হয়ে যাবো।”
– “হঠাৎ এই ইচ্ছে কেন? আর তুই কেন এরকম বিক্ষিপ্ত হয়ে আছিস আমাকে বলতো?”
– “সেলিব্রেটি অন মাই ফুট, ফালতু লাগছে লাইফটা। যেখানে কেউ চেনেনা, সেখানে গিয়ে আরামে বাস করবো।”
মহিলাটি কি ভাবলেন কে জানে। উনি মিশুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা মেঘের কি হয়েছে বলোতো? ও এরকম কেন করছে? উদ্ভট আচরণ। এরকম কখনো দেখায়নি ওকে।”
মিশু চিন্তিত মুখে বললো, “আমি তো জানিনা। নিজেও বুঝতে পারছিনা হঠাৎ এরকম কেন করছে।”
– “আচ্ছা, আমার বাসায় এসো তখন আলাপ হবে,মেঘালয় রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যায়। ওকে রাগিও না।”
মিশু ঘাড় বাঁকিয়ে আচ্ছা বললো। মেঘালয় সেখান থেকে চলে এলো। মিশু থতমত খেয়ে চলে এলো ওর পিছুপিছু। মেঘালয় বলল,উনি আমার মেজো খালামনি। মিশু কোনো শব্দ করলো না। মেজো খালামনি খুব ভালো মনের আর মিশুক মানুষ সেটা ওনার কথা শুনেই বোঝা গেছে। কিন্তু মেঘালয় হঠাৎ এরকম আচরণ করছে যে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মিশুর। মেজো খালামনির সাথে একটু ভালো মতো দেখা করিয়ে দিলেও পারতো।
খুব দ্রুত গাড়ি চালালো মেঘালয়। গাড়িতে একটাও কথা বললো না মিশুর সাথে। মিশুও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। শুধু হা হয়ে দেখছিলো মেঘালয়ের অদ্ভুত রূপটাকে।বাসায় ফিরে গাড়ি থেকে নেমে কোলে করে মিশুকে রুমে নিয়ে এলো। মিশু চোখ বড়বড় করে মেঘালয়কে দেখছে। ওকে বিছানায় জোরে ছুড়ে ফেলে দিয়েই দুহাতে মিশুর গলা টিপে ধরে বললো, “আজকে তোকে আমি খুন করে ফেলবো ”
এত জোরে গলা টিপে ধরায় মিশুর জিভ বেড়িয়ে এলো। মেঘালয় কি সাইকো হয়ে গেলো হঠাৎ করে? এরকম কেন করছে বুঝে আসছে না কিছুতেই। দুহাতে গায়ের জোরে মিশুর গলার টিপে ধরেছে যে আরেকটু হলে মরেই যাবে মিশু। মিশু দুহাত দিয়ে মেঘালয়ের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।
মেঘালয় নিজে থেকেই হাত ছেড়ে দিয়ে হাফাতে লাগলো। মিশুর গলায় এত জোরে টিপে ধরেছিলো যে দাগ হয়ে গেছে। মিশু নিজের গলায় হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। মেঘালয় মিশুকে এক হাতে বুকে টেনে নিয়ে আরেকহাতে ওর গলায় হাত বুলিয়ে দিলো। মুখটা করুণ করে বললো, “ইস! দাগ বসে গেছে। খুব ব্যথা পেয়েছো তাইনা?”
মিশু অবাক হয়ে গেছে একদম। গলা টিপে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টা করে আবার জিজ্ঞেস করছে ব্যথা পেয়েছে কিনা! এ কেমন আচরণ?
মেঘালয় মিশুর গলায় ঠোঁট রেখে গভীরভাবে চুমু দিলো। অনেক্ষণ ওকে বুকে চেপে ধরে থাকার পর ছেড়ে দিয়ে মেঘালয় একটু শান্ত হলো। কিন্তু ওর চোখেমুখে এখনো রাগ। মিশুর চোখে পানি এসে গেছে। ও জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে তোমার মেঘ? আমাকে কেন মেরে ফেলতে চাইছো?”
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে বললো, “তুমি কেন সায়ানের হাত ধরে বসেছিলে? সায়ান কেন তোমার গাল ছুঁয়ে দিলো?”
মিশু একটু বেশিই অবাক হলো। মেঘালয়কে সত্যিই চিনতে পারছে না ও। সায়ান ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। একটু হাত ধরলে কি হয়েছে তাতে? আর তাছাড়া মিশু কিংবা সায়ানের কারোরই অন্য কোনো লক্ষণ ছিলোনা। ওরা একে অপরকে ভাই বোনের মতই দেখে। মেঘালয় কি সেটা জানেনা?
মেঘালয় বললো, “তুমি জানো না তোমাকে আর কেউ টাচ করলে আমি সহ্য করতে পারিনা। ওর হাত ধরে বসে ছিলে,ওর বাহু ধরেছিলে শক্ত করে। ও তোমার গাল ছুঁয়ে দিবে কেন? বের হওয়ার সময় তোমার কাঁধে হাত রাখবে কেন?”
মিশু বললো, “সায়ানের তো অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলোনা। ও তোমার বন্ধু। আমার ভাইয়ের মতন।”
মেঘালয় দুহাতে মিশুর হাত ধরে বললো, “আমি মানতে পারিনা আর কেউ তোমাকে ছুঁয়ে দেখলে। আমার অসহ্য লাগে।”
– “তুমি পাগল হয়ে গেছো এটা কি বিশ্বাস করো মেঘ?”
– “হুম হয়তবা হয়ে গেছি। তুমি আমার মাঝে নেশা ধরিয়ে দিয়েছো। আমার যখন তখন তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় কিন্তু পারিনা। বাইরে গেলে লোকজন তাকিয়ে থাকে কেন?”
– “লোকজন তো তাকিয়ে থাকবেই। আমাদের সমাজে এরকম কিছুর প্রচলন নেই।”
– “কোন সমাজে আছে? আমি সেখানে চলে যাবো। বাইরে গিয়ে থাকতে পারবা?”
– “দেশের বাইরে? তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো মেঘ। তোমার মাথা নির্ঘাত খারাপ হয়ে গেছে। একবার বলছো সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ হয়ে যাবা, আরেকবার বলছো দেশের বাইরে চলে যাবা।”
মেঘালয় মিশুর বুকে মাথাটা গুঁজে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমাকে কখনো কষ্ট দিওনা মিশু। আমি তোমাকে ছাড়া আর কোনোকিছুই ভাবতে পারছি না। আমার সবকিছু জুড়ে তুমি বিরাজ করছো। আমাকে একটু আগলায় রাখবা?”
মিশুর চোখে পানি এসে গেছে। মেঘালয়কে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। যে মানুষ টার ব্যক্তিত্বের জন্য সবাই ওকে শ্রদ্ধা করতো, আজ সে মানুষ টা ওর কাছে দূর্বল হয়ে গেছে। ভালোবাসা কি এমন ই? একজন আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন মানুষ কেও শিশুসুলভ বানিয়ে দেয়। মেঘালয় একদম দূর্বল হয়ে গেছে ওর প্রতি। ওর নিজের বলতে আর কিচ্ছু নেই। সমস্ত কিছুই উৎসর্গ করে দিয়েছে মিশুর তরে।
মিশু মেঘালয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিজের মাঝে টেনে নিতে লাগলো মেঘালয়কে। আজকের এ মিলন সত্যিই খুব সুখের হবে। মেঘালয় এখন সম্পূর্ণ রুপে মিশুর। আর মিশুও নিজেকে পুরোপুরিভাবে শেষ করে দিতে চায় মেঘালয়ের মাঝে। যেন এখন থেকে দুজন মিলে একটা মানুষ হয়ে বাঁচতে পারে। কেউ কাউকে এতটাও ভালোবাসতে পারে!
৬০.
দেখতে দেখতে মাস দুয়েক কেটে গেছে।
মিশু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ও রৌদ্রময়ী আর দুপুর মিলে একসাথে বাসায় থাকে আর মেঘালয় নিজের বাড়িতে থাকে। সারাক্ষণ ফোনে কথা,মেসেজিং, একটু ভিডিও কল এভাবেই প্রেম চলছে ওদের। সপ্তাহে একদিন লং ড্রাইভে যাওয়া, দুটো রাত একসাথে কাটানো, খুনসুটি, ভালোবাসা সবমিলিয়ে দিনকাল বেশ ভালোই চলছে। পুরো ব্যাপার টাকে মিশুই গুছিয়ে এনেছে। মেঘালয় ক্রমাগত মিশুতে আসক্ত হয়ে সবকিছু থেকে দূরে সরে আসছিলো। মিশু নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে ওকে নিজের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। যে সম্পর্কে দুটো মানুষ একইসাথে ক্যারিয়ারে ভালো করতে থাকে,সেটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী সম্পর্ক। মেঘালয়ের সেই কনসার্টের রাতের পাগলামোর কথা ভেবে এখনো হাসি পায়। ভাগ্যিস মিশু একটু গুছিয়ে নিয়েছে,নয়তো সবকিছু সত্যি সত্যিই ছেড়ে দিয়ে ফেলত একেবারে। প্রেম একটা সাংঘাতিক জিনিস, এটা কখনো খারাপের দিকে নিয়ে যায়,আবার কখনো ভালোর দিকে।
এখন বেশ ভালোই উন্নতি হচ্ছে। নিয়মিত রেডিও তে গান গাইছে মেঘালয়। আর্টিস্ট দের সাথে উঠাবসা হচ্ছে, নতুন নতুন গান করছে। বাবার বিজনেসেও মাঝেমাঝে একটু হাত লাগায়। যদিও বাসায় এখনো জানেনা ওর বিয়ের ব্যাপারটা। মিশুর সাথে চুটিয়ে প্রেম চালাচ্ছে শুধু এটুকুই জানে। বাইরের জগতে মেঘালয়ের বেশ সুনাম ছড়িয়ে যাচ্ছে ধীরেধীরে।
আজ রাতে মেঘালয় মিশুর কাছে আসবে। মিশু খুব সুন্দর করে সাজুগুজু করে বসে আছে। রোদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে আর হাসছে। রোদ এখন মেঘালয়ের বাবার অফিসে চাকরী করে। যে চাকরীটা মিশুর হবার কথা ছিলো, সেটা রৌদ্রময়ী করছে। দিনশেষে বাসায় ফিরলে দুজনে মিলে বেশ খানিক্ষণ আড্ডা চলে।
মেঘালয় ফিরলে মিশু ছুটে চলে গেল দরজা খুলতে। দরজা খোলার পর মেঘালয় চোখ বড়বড় করে বললো, “বাব্বাহ! চুল গুলো বেশ বড় হয়ে গেছে দেখছি।”
মিশু হেসে বলল, “সবই বড় হয়েছে। ওজন বেড়েছে।”
মেঘালয় আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কোথাও কেউ আছে কিনা। তারপর মিশুকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। মিশু ওর গলা জড়িয়ে ধরে রইলো দুহাতে। তিনদিন পর দেখা হলো মেঘালয়ের সাথে। অবশ্য রোজ রোজ দেখা হওয়ার চেয়ে এইযে কয়দিন পরপর দেখা করা আর এইযে সংসার সেটাও একটা মজার ব্যাপার। মেঘালয়ের পরিবার ছেলেকে নিয়ে কোনোরকম মাথা ঘামায় না। যদি একটু রক্ষণশীল হতো, তবে হয়ত এভাবে লুকিয়ে সংসার জমানো সম্ভব হতোনা।
মেঘালয় মিশুকে কোলে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলো। মিশু দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “জানো আজকে একটা প্রপোজাল পেয়েছি।”
– “সিরিয়াসলি? কোথায়? কে দিলো?”
– “ভার্সিটিতে। একটা বড় ভাইয়া। অনেক আগ থেকে ফলো করে আমায়। আজকে সরাসরি প্রপোজাল দিয়েছে।”
– “দিনদিন তো একদম তামিল নায়িকার মতন হয়ে যাচ্ছো। আরো কত কিছুই দেবে। এরপর কে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় সেই ভয়েই আমি তটস্থ হয়ে থাকি।”
মিশু মেঘালয়ের কোলে মাথা রেখে বললো, “আমার সতীত্ব তো তুমিই হরণ করেছো। এ মিশু তো শুধুই তোমার।”
– “হুম, আমার পাগলীটা”
মিশু মেঘালয়ের কোলে মাথা রেখে ওর মুখটা ধরে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়। ইচ্ছে করছে গিলে খেয়ে ফেলি। আচ্ছা সন্ধ্যায় অনেক বার ফোন দিলাম ধরলে না কেন?”
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “একটু ব্যস্ত ছিলাম। তখন রেডিওতে প্রোগ্রাম শেষ করে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একটা Rj Hunt হবে সেটা নিয়ে কথা বলছিলো সবাই।”
– “Rj Hunt আবার কি?”
– “একটা প্রোগ্রাম, অনেক নতুন Rj নিয়োগ দেবে। যারা এপ্লাই করবে তাদের কিছু টেস্ট হবে, প্রোগ্রাম হবে এইসব আরকি।”
মিশু ওর গলায় ঝুলে বললো, “আমার না খুব Rj হতে ইচ্ছে করে।”
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, “সিরিয়াসলি!”
– “হুম, আমার ও ওরকম রেডিওতে বকবক করতে ইচ্ছে করে।”
মেঘালয় বলল,”আগে বলোনি কেন? তোমার তো ট্যালেন্ট আছে, সিলেটে লেগুনায় শুনে আমি ইমপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি বরং একটা এপ্লাই করে রাখো। যা যা শিখিয়ে দিতে হবে,আমি শিখিয়ে দিবো। একদিন সেন্টারে নিয়ে গিয়ে সবকিছু দেখিয়ে আনবো। হয়ে যাবে টেনশন করতে হবেনা।”
মিশু উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলো একেবারে। মেঘালয়ের গলা দুহাতে ধরে বললো, “সত্যি! আমি কি পারবো? খুব এক্সাইটেড লাগছে তো।”
– “বাসায় প্রাক্টিস করবা, আমি তো আছি ই।”
মিশু খুশিতে মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “ইস! তুমি এত ভালো কেন? তোমাকে ইচ্ছে করে একদম খেয়ে ফেলি। আমিতো ভাবতেও পারছি না Rj Hunt এ কি কি হবে! আমি পারবো কিনা, কিসব টেস্ট ফেস্ট হবে। উফফ তবুও এক্সাইটেড লাগছে। যদি হয়ে যাই, কত্ত মজা হবে বলোতো!”
মেঘালয় হেসে বললো, “হুম। তখন তোমার প্রোগ্রামে গিয়ে আমি গান গাইবো। তুমি একজন প্রফেশনাল Rj হিসেবে কথা বলবা,কিন্তু মনেমনে আমিতো জানবো তুমি আমার বউ। লুকিয়ে লুকিয়ে চুমুও খাবো আর কেউ তো জানবেই না এই শিল্পীটা কত্ত পাজি।”
মিশু মেঘালয়ের বুকে দুটো কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি আসলেই খুব খারাপ। এত সুন্দর দেখায় কেন তোমাকে? আমার তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
মেঘালয় দুষ্টমি ভরা হাসি দিয়ে তাকালো মিশুর দিকে। আর মিশু ওর বুকে মুখ লুকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
চলবে..