#অপেক্ষারা
২৬ (বোনাস পর্ব)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
পুরোটা যাত্রায় একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না নাজ। প্রাণবন্ত-চঞ্চল এই মেয়েটার নিশ্চুপ ভঙ্গিমার সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নয় সায়েম। একবার মনে হলো, নীরবতার কারণ জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু করলো না।
মুখে কথা না থাকলে মনে হাজারটা প্রশ্ন এসে জমেছে নাজের। মনে হচ্ছে যেন ঠিক এই মুহূর্তে সায়েমের কাছ থেকে প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেলে মরেই যাবে। প্রশ্নগুলো করতে চাইছে, পারছে না। প্রকৃতি এতটা নিষ্ঠুর কেন? এই পরিস্থিতিতে কেন এনে ফেলল তাকে?
সায়েম ব্যাগগুলো নিয়ে লিফটে উঠেছে। নাজ উঠলো না, সিড়ির দিকে পা বাড়ালো। প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করার সময় এসে গেছে। নাজ বারবার মনে মনে কথা গোছাচ্ছে, কিন্তু প্রতিবারই গুছিয়ে রাখা সেই কথাগুলো যাচ্ছে এলোমেলো হয়ে।
বাসায় পৌঁছে নাজ দেখল দরজাটা হাট করে খোলা। সায়েম ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন করছে।
নাজ ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলল, “একটা প্রশ্ন করবো?”
“হুঁ?”
“আপনার জীবনে আমার ভূমিকাটা কী বলুন তো?”
“মানে?”
“সিনেমায় একেক অভিনেতা একেক চরিত্রে অভিনয় করে না? আপনার জীবন যদি একটা সিনেমা হয়, তাহলে সেখানে আমার চরিত্রটা কী?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“অনেক আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। করিনি। আপনি তো জানেন কতোটা বোকা আমি। এখন করছি, বলুন না!”
সায়েম ধীর গতিতে বসেলো ডাইনিং রুমের চেয়ারের ওপরের। তার চোখেমুখে বিভ্রান্তির ছড়াছড়ি। বোঝাই যাচ্ছে প্রশ্নটার উত্তর তার কাছে নেই। কিংবা হয়তো কোনদিন ভেবেই দেখেনি তার জীবনে নাজের ভূমিকা সমন্ধে।
অবশেষে অনেক ভেবে সায়েম শুকনো গলায় বলল, “আমি জানি না। শুধু জানি যে আমার ভবিষ্যতে আমি তোমাকে দেখি না।”
নাজের চেহারা সঙ্গে সঙ্গে রক্তশূন্য হয়ে পড়লো। আর যাই হোক, এমন একটা উত্তর সে আশা করেনি। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কাঁদতে, ছুটে পালিয়ে যেতে দূরে কোথাও। নাজ সেসবের কিছুই করলো না। সাহসী মেয়ের মতো নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে রইল ওই মানুষটার মুখোমুখি।
ধরা গলায় বলল, “তাহলে এতদিন ধরে আমার ছোট ছোট প্রয়োজনগুলোর খেয়াল রাখা, আমার যাতে কষ্ট না সে জন্যে কলেজের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নিয়ে নেওয়া, মাথাটা একটু ঝিমঝিম করলেই ব্যস্ত হয়ে ওষুধ খাওয়ানো – এসবের মানে কী?”
“তো কী করবো? তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবো তোমাকে? তোমার প্রতি তো আমার কোনো ঘৃনা নেই নাজ।”
নাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। তার চোখে মুখে প্রবল জিজ্ঞাসা। কথাটা বাংলাতেই তো বলল সে। তবুও কিছুই বুঝতে পারছে না কেন নাজ?
সায়েম দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে থেমে থেমে বলল “তুমি নিজেই একবার ভেবে দেখ, আমার সঙ্গে কি তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?”
নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “না।”
“তুমি তো এসেছিলি আমার বিয়েতে গেস্ট হয়ে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছো, আমিও তাই। বিয়েটা হওয়ার আগে যদি জানতে পারতাম যে নিজেদের প্রেস্টিজ বাঁচানোর জন্যে আমার মা তোমাকে বাধ্য করেছে, তাহলে আমি কখনো রাজি হতাম না।”
নাজ কী যেন ভেবে অন্যরকম গলায় বলল, “ওহ! তার মানে যে মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছিল, যদি তার সঙ্গেই আপনার বিয়ে হতো – তাহলে দেখতেন তাকে নিজের ভবিষ্যতে?”
সায়েম সরু গলায় বলল, “তুমি ব্যাপারটাকে একেবারে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছো নাজ। বাবা-মায়ের পছন্দে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে রাজি হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু শেষমেশ তো ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ থাকেনি। ফোর্সড ম্যারেজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সম্পর্কের শুরুটাই ভুল দিয়ে, যে সম্পর্কের কোনো ভিত্তি আমার কাছে নেই।”
এই মুহূর্তটাকে একেবারেই বাস্তব বলে মনে হচ্ছে না নাজের কাছে। মনে হচ্ছে কোনো এক স্বপ্নদৃশ্য। বাজে স্বপ্ন তো মানুষ দেখতেই পারে, এটিও তেমন এক স্বপ্ন।
অবিশ্বাসে খাবি খেয়ে নাজ নিচু গলায় বলল, “এই কথাগুলো এতদিন বললেনি কেন?”
“এটাও তো বলিনি যে তোমার জন্যে পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
এ ঘরের পূর্বদিকে বিশাল এক জানালা আছে। নাজ ডাইনিং টেবিলের সামনে থেকে সরে এসে দাঁড়ালো সেই জানালার সামনে। তার ভয়, যেকোনো মুহূর্তে চোখদুটো বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়বে। যার কাছে তার কোনোই নেই, তাকে চোখের জল দেখানো অর্থহীন।
ওপাশ থেকে আবারও শোনা গেল সায়েমের কণ্ঠস্বর, “দেখো নাজ, আমাদের দুজনের সামনেই একটা ভবিষ্যত পড়ে আছে। ফ্যামিলির একটা ভুল ডিসিশনের জন্যে সেই ভবিষ্যতকে ধ্বংস করার কোনো মানে হয় না।”
নাজ জানালা থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, “বুঝলাম না।”
“তোমাকে শুধু শুধু বারবার মন দিয়ে লেখাপড়া করতে বলি না। আমার সঙ্গে থেকে ভবিষ্যতটাকে সুন্দর করার সুযোগ পাচ্ছে, সুযোগটা কাজে লাগাও। আমিও এদিকে ভবিষ্যতের জন্যে সেভিংস করছি। তোমার এইচএসসি পরীক্ষাটা হয়ে যাক, আমার ব্যাংক ব্যালেন্সও ততদিনে একটা স্টেবল পর্যায়ে পৌঁছাবে। তারপর তুমি তোমার রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়।”
বেশ অনেকটা সময় চুপ করে থেকে নাজ বিরস কণ্ঠে বলল, “তার মানে আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবেন?”
সায়েম দৃঢ় কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ।”
“তাহলে এখনই দিয়ে দিন। শুধু শুধু অপেক্ষা করে থাকবেন কীসের জন্যে?”
“ডিভোর্সের পর আমার বাবা-মাকে সামলানোর মতো ধৈর্য আর শক্তি কোনোটাই এই মুহূর্তে আমার নেই। এখন ডিভোর্স নিলে বিষয়টা সহজভাবে মেনে নেওয়াও তাদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়বে। আফটার অল তাদের সামনে আমরা সুখী একটা কাপল। তাদের হাজারটা প্রশ্নের…”
সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “আরেকটা প্রশ্ন করি? আর বিরক্ত করবো না, প্রমিজ!”
“করো।”
নাজ এবার গিয়ে সায়েমের মুখোমুখি থাকা চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল, “আপনার জীবনে কি অন্য কেউ আছে?”
সায়েম ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “দ্যাট’স নান অফ ইওর বিজনেস।”
সঙ্গে সঙ্গে নাজ তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল, “দ্যাট ইস মাই বিজনেস। কাগজে কলমে এখনো আমি আপনার স্ত্রী, ভুলে যাবেন না।”
সায়েম কয়েক মুহূর্ত হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নাজের দিকে। বাচ্চা এই মেয়েটা যে কোনোদিন এভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে পারে, সে ভাবতেই পারেনি।
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে নাজ। বারবার একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়, “আমি এত বোকা কেন?” – বোকা বলেই হয়তো লক্ষ করেনি সায়েম নামের মানুষটা তাকে কখনো নিজের স্ত্রী বলে মনে করেনি। বোকা বলেই হয়তো আশা করেছিল মানুষটা তাকে তার মতো করেই ভালোবাসবে।
তার কোনো দোষ নেই। পৃথিবীতে যারা ভালোবাসে, তারা সকলেই কোনো না কোনোভাবে বোকামির সকল সীমা অতিক্রম করে যায়।
নাজের কাছে একবার মনে হচ্ছে সেই চিঠিটা না লিখতেই বোধ হয় ভালো হতো। ভয়ঙ্কর এই সত্যের মুখোমুখি হতে হতো না তাকে। আবার তার ঠিক পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে, অনিন্দ্য সুন্দর মিথ্যার চাইতে নিষ্ঠুর সত্য ঢের ভালো। ভ্রমর মধ্যে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না।
প্রচুর সাহস সঞ্চয় করে লিখেছিল সেই চিঠি। আজ যেন সেই সাহসটাই যেন একটু একটু করে ভেঙে ফেলছে তাকে।
নাজ ভেবে পায় না, কী করে তার মনে হলো সায়েম তাকে ভালোবাসবে। এ জীবনে কেউ কি কোনোদিন ভালোবেসেছে তাকে? জন্মমুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় আশেপাশের মানুষগুলোর তাকে নিয়ে কটূক্তি।
এক নিঃসন্তান দম্পতির বহু বছরের প্রতীক্ষার ফসল নাজ। আয়েশা বেগম দীর্ঘ এগারো বছরের প্রতীক্ষার পর গর্ভে ধারণ করেছিলেন তাকে। যে মানুষটা এগারো বছর মা হতে পারেনি, তার নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বার মা হবার আশঙ্কা নেই। আয়েশা বেগমের একমাত্র সন্তান হিসেবে সকলের ছেলের আশাই করেছিল, হলো মেয়ে।
মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করেই নাজ নিরাশ করেছিল পুরো পরিবারটাকে। সেই থেকে তাকে ঘিরে কেবল নিরাশাই কাজ করে সকলের। মেয়েটা অসাধারণ ছবি আঁকতে পারে, দুর্দান্ত গান গাইতে পারে। তবে সেসকল গুণ সকলের চোখ এড়িয়ে গেল। চোখে পড়লো শুধু দোষগুলো।
মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো না, আদব-কায়দা জানে না, সারাদিন কেবল বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় – না জানি কত কী! যে মানুষটা কোনোদিন আশেপাশের মানুষগুলোকে মুগ্ধ করতে পারেনি, সে কী করে আশা করে সায়েম তাকে ভালোবাসবে?
(চলবে)#অপেক্ষারা
২৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
পিচ্ছিল ছাদটার রেলিং ঘেঁষে বসে আছে নাজ। জীবনে এই প্রথমবার শীতকালের বৃষ্টি দেখল সে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! তার জীবনের উনিশটি শীতকালে কখনোই কি বৃষ্টি পড়েনি? না-কি সে খেয়াল করেনি? আজকাল মস্তিকের ভেতর তুচ্ছ সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করে ভালো লাগে।
এই যেমন গতকাল নাজ দীর্ঘ সময় চিন্তাভাবনা করলো, বাঙালি রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার এত বেশি কেন? আধুনিকায়নের যুগে আমরা যেখানে জীবনটাকে আরামদায়ক করে তুলতে ব্যস্ত, সেখানে আমাদের মা-খালারা কেন পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে তাদের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করবে? এই পেঁয়াজ জিনিসটা রান্নায় না দিলে কি স্বাদের খুব বেশি পরিবর্তন হবে?
বেশির ভাগ সময়েই নাজের এসব অর্থহীন গবেষণার কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না। সে যে ফলাফল পেতে চায়, এমনটাও নয়। কোনো এক উপায়ে মনটাকে ব্যস্ত রাখা আর কী! মনকে যতটা ব্যস্ত রাখতে পারে, ততই ভালো থাকে নাজ। তবে সমস্যা একটাই, দীর্ঘ সময় জুড়ে মনটাকে ব্যস্ত রাখা সম্ভব নয়। একটা নির্দিষ্ট পর তার সকল চিন্তা-ভাবনা ওই মানুষটার কাছে গিয়েই ঠেকবে।
সায়েম আজকাল দিনের অনেকটা সময় বাড়ির বাইরে কাটায়। অফিস থেকে দেরি করে ফেরে, ফিরেই ফ্রেশ হয়ে আবার বেরিয়ে যায়। অফিসের পর এক বন্ধুর কাছ থেকে ড্রাইভিং শেখে। সম্ভবত যতটা সম্ভব নাজকে এড়িয়ে চলতে চাইছে সে। নাজের প্রবল ইচ্ছে হয় তাকে এড়িয়ে চলতে, তার কথা না ভাবতে। কিন্তু পারে না, বারবার ব্যর্থ হয়। নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হয় তার। যে মানুষটা চিরকাল তাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে এসেছে, তাকে নিয়ে কেন এত ভাবতে হবে তাকে?
রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকালো নাজ। কিছু কিছু মানুষ খুবই কম সহ্যক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তাদের সহ্যক্ষমতা এতটাই কম থাকে যে, কষ্ট আর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঠিক এভাবেই ছাদে উঠে রেলিং বেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নাজের সহ্যক্ষমতাও তো মোটামুটি পর্যায়ের। তারও কি উচিত চোখদুটো বুজে ঝাঁপিয়ে পড়া? তাতে কি মুক্তি মিলবে এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে?
নাজ ঘরে ফিরে এল। আর যাই হোক, রেলিং বেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো মেয়ে সে নয়। ঘরে আসতেই তার চোখদুটো আটকে গেল আয়নার দিকে। আজকাল সবকিছু অসহ্য লাগে তার। সবথেকে বেশি অসহ্য লাগে নিজেকে। নিজের অস্তিত্ব যে কারো কাছে এতটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে পারে, তা ছিল নাজের ধারণারও বাইরে।
চিরকাল নিজেকে লক্ষ্মী একটা মেয়ে হিসেবেই উপস্থাপন করে এসেছে নাজ। কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা চুল, কানে ঝুলন্ত রিংয়ের মতো কানের দুল, ঢিলেঢালা সালোয়ার কামিজ – নিজের এই রুপটাকে একেবারেই সহ্য করতে পারছে না নাজ। যতটাই লক্ষ্মী হয়ে থাকুক না কেন, দিনশেষে তো সকলে তাকে অবজ্ঞার চোখেই দেখবে।
সায়েমের ওপরে বিন্দুমাত্র রাগ নেই তার, সকল রাগ নিজের ওপরে। মানুষটা তাকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভালোবাসেনি, অথচ সে বুঝতেই পারলো না? বরং প্রতীক্ষা করলো, সেও তাকে ভালোবাসবে? এতটা বোকা কী করে হতে পারলো না।
বহুভাবে নিজের প্রতি এই রাগটা প্রকাশ করার চেষ্টা করছে নাজ, পারছে না। তবে আজ আর রাগটা চেপে রাখবে না। নিজেকে একটা শাস্তি দিতেই হবে।
নাজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই বড়সড় এক পার্লার আছে। এর আগেও অনেকবার তুষির সঙ্গে এসেছিল এখানে। নিজের কাছে থাকা নাজের সবথেকে প্রিয় বস্তু হলো তার লম্বা চুল। ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে একবারও চুল কাটেনি। নিজের যত্ন আর পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা চুলগুলোকে আজ নিজেই কেটে ফেলতে নিয়ে এসেছে।
পার্লারের মেয়েটা আঁতকে উঠে বলল, “এত সুন্দর চুল কেটে ফেলবেন আপু?”
নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ! আর সহ্য হচ্ছে না।”
“আরেকবার ভেবে দেখুন, এমন সুন্দর চুল সবার থাকে না।”
নাজ বিড়বিড় করে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “আমার থেকেই বা লাভ কী হলো?”
“কিছু বললেন আপু?”
নাজ সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “না। আপনি কাটুন তো!”
যে চুল আগে কোমর ছাড়িয়ে যেত, তা বহুকষ্টে কাঁধ স্পর্শ করছে নাজের। পার্লার থেকে সোজা চলে গেল শপিং মলে। একগাদা টিশার্ট, টপস আর জিন্স কিনে ফিরল। তুষি প্রায়ই বলত সালোয়ার কামিজের পাশাপাশি এসব আধুনিক পোশাক পড়তে, নাজ চাইত না। তার ইচ্ছা ছিল, সকলের চাইতে ভিন্ন হবার।
ইচ্ছাটা আজ মরে গেছে। ছোট ছোট চুল আর জিন্স-টপসে আজ তাকে আর পাঁচটা শহুরে মেয়ের মতোই লাগছে। চোখমুখ থেকে সেই কোমলতা, সেই চঞ্চলতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
নাজ অবশ্য তাই চায়। অতীতের সকল আবেগ হারিয়ে এক যন্ত্রমানবী হতে চায় সে। সম্পূর্ন নতুন একটা মানুষ হয়ে চায় সে। যে মানুষটার মনে আবেগ বলতে কিছু নেই, যে মানুষটা ভালোবাসতে জানে না। চুল কেটে, পোশাক-আশাকের ধরন পাল্টে বাহ্যিক রূপটা তো যে কেউ পরিবর্তন করতে পারে। তবে ভেতরকার অন্তরাত্মাকে বদলে ফেলা কী এতটাই সহজ?
দীর্ঘ ছুটি শেষে আজ নাজের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। ক্লাসে এসেই দীর্ঘ এক বক্তৃতা দিলেন ম্যাম। যার সারমর্ম, এতদিন যা ভুল করেছ, করেছ। ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার এখনি সময়। আগামী বছরেই এইচএসসি, তাই গায়ে যতটা সম্ভব গায়ে হওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করতে হবে।
সাধারণত শিক্ষকের এসব বক্তৃতাগুলোকে খুব এটা আমলে নেয় না শিক্ষার্থীরা। বক্তৃতা শুরু হওয়া মাত্রই কেউ কেউ নিচু স্বরে গালগল্প করে আবার কেউ শিক্ষকের অগোচরে খাতার পেছনের পাতায় কাটাকুটি খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতদিন নাজ ছিল সে দলেরই সদস্য, তবে আজ সেসব কিছুই করলো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইল পুরোটা সময়।
ক্লাসের সকলের চাইতে একটু বেশিই উচ্ছ্বসিত তুষি। দীর্ঘ দুই বছরের প্রচেষ্টার পর অবশেষে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। সে ঘোষণা করেছে এই উপলক্ষে সকল কাছের বান্ধবীদের চটপটি খাওয়াবে। তুষির কাছের বান্ধবীদের তালিকায় সবথেকে ওপরে নাজের নাম।
তুষি উৎফুল্ল গলায় বলল, “সকলে চটপটি খাওয়া শুরুও করে দিয়েছে আর তুই এখনো বসে আছিস? জলদি উঠে আয়?”
“কোথায় যাবো?”
“ক্যান্টিনে! তোকে বললাম না, আজ সকলকে আমি চটপটি খাওয়াবো। অন্য সবার জন্যে নরমাল চটপটি, কিন্তু তোর জন্যে বেশি করে ঝাল দেওয়া মামার স্পেশাল চটপটি। আয় তাড়াতাড়ি।”
নাজ মলিন কণ্ঠে বলল, “আজ চটপটি খেতে ইচ্ছা করছে না। আরেকদিন খাওয়াস।”
“খেতে ইচ্ছা করছে না মানে? তুই বললেই হলো? তোর কী হয়েছে বল তো নাজ? সেই সকাল থেকে লক্ষ করছি কেমন গোমড়া মুখে বসে আছিস।”
নাজ ফিকে হাসি হেসে বলল, “কিছু হয়নি। কী আবার হবে? সত্যিই আজ চটপটি খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“তাহলে অন্যকিছু খা!”
“অন্য আরেকদিন চটপটিই খাবো। তুই গিয়ে সকলের সঙ্গে আনন্দ কর। আমি যাই, আমাকে আবার নিতে আসবে।”
বিরক্ত মুখে ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে নাজ, অপেক্ষাটা সায়েমের জন্যে। তাদের বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়, পায়ে হেঁটে নাজ নিজেই চলে যেতে পারে। তবুও প্রতিদিন ক্লাস শেষে ওই মানুষটাকে নিতে আসতে হবে।
কিছুক্ষণ বাদেই সায়েমের মুখোমুখি হতে হবে ভেবেই তার গা বেয়ে প্রবল স্রোত বয়ে গেল। সে চায় না মানুষটার মুখোমুখি হতে। সারাজীবনের জন্যে নিজেকে আড়াল করে রাখার কোনো ব্যবস্থা থাকলে ভালোই হলো।
নাজ বারবার হাতঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে বলে কখন যে ভূতের মতো তার পাশে একটা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই করেনি। ছেলেটা সেই বিখ্যাত রোমিও ঋজু।
ঋজু হাসৌজ্বল গলায় বলল, “কেমন আছ নাজনীন?”
সময়টা আগের মতো হলে ছেলেটাকে দুয়েকটা কঠিন কথা বলে এখান থেকে চলে যেত নাজ। তবে সমস্যা হলো, সময়টা আর আগের মতো নেই। নাজও তো নেই সেই আগের মানুষটা।
তাই সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে স্বাভাবিক গলায় বলল, “ভালো, তুমি?”
“ভালো আর থাকি কী করে? সেদিনের পর থেকে তো আমার সঙ্গে ঠিকমত কথাই বললে না। আমাকে পছন্দ করো না ভালো কথা, তাই বলে এভাবে ইগনোর করবে?”
“ইগনোর কোথায় করলাম? সেদিনের পর তো কলেজই ছুটি হয়ে গেল।”
“তা অবশ্য ঠিক। কী করলে এই লম্বা ছুটিতে? গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলে?”
“হুঁ।”
“কী করলে সেখানে?”
সঙ্গে সঙ্গে নাজের মনে পড়ে গেল গ্রামের বাড়িতে কাটানো যন্ত্রণাদায়ক সেই দিনগুলোর কথা। সেদিনের কথা মনে পড়লেই তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে, মাথার ঠিক মাঝখানে ভোঁতা ধরনের এক ব্যথা শুরু হয়।
নাজ বহুকষ্টে নিজেকে সামলে অস্পষ্ট গলায় বলল, “তেমন কিছু না। তুমি কী করেছ?”
ঋজু ফুর্তির আমেজ নিয়ে বলল, “গত সপ্তাহেই আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। বাড়িতে বিরাট আয়োজন। ছুটির পুরো সময়টা এ নিয়ে প্ল্যান প্রোগ্রাম করেই কাটিয়েছি।”
“ও।”
“আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে ভাইয়ার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করার। কিন্তু কী করে করবো বলো? আমার কাছে না আছে তোমার অ্যাড্রেস, না আছে ফোন নাম্বার। যাই হোক, কয়েক মাস পরেই কিন্তু আমার মেঝ ভাইয়ের বিয়ে। তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে। ভালো কথা, তোমার ফোন নাম্বারটা মুখস্ত আছে?”
নাজ লক্ষ করলো সায়েম দূর থেকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে মুখে প্রবল রাগের আভাস দেখা যাচ্ছে। যাক গিয়ে, তার রাগকে এখন আর ভয় পায় না নাজ। ঋজু নামের গাধাটাইপ ছেলেটার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। তবুও এতটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই – সায়েমকে বুঝিয়ে দেওয়া যে সে নাজকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখলেও বাকিরা দেখে না। বুঝিয়ে দেওয়া, তার জীবনে অন্য কেউ থাকতে পারলে নাজের জীবনেও পারে।
সায়েমকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল না নাজ। কয়েক মিনিট একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কথা বলল ঋজুর সঙ্গে। আগ্রহ নিয়ে নিজের ফোন নম্বর টাইপ করে দিল তার ফোনে। ওদিকে যে একটা মানুষ অপেক্ষা করছে, তার কোনো খেয়ালই যেন নেই।
ভয়াবহ পর্যায়ে রেগে গেছে সায়েম। তার রাগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত নাজ। মানুষটা যখন রেগে যায় অস্পষ্ট এক ছায়া নেমে আসে তার চেহারায়, চোখমুখ হয়ে ওঠে রক্তশুন্য, দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করে। পুরোটা রাস্তায় ফোন করে কাকে যেন উচ্চস্বরে ধমকালো।
কয়েকদিন আগেও তাকে রাগতে দেখলেই বুক ধক করে উঠত, মনটা ব্যাকুল হয়ে জানতে খুঁজে বেড়াত রাগের উৎসটা। তবে আজ নির্বিকার হয়ে বসে রইল মেয়েটা। যেন সায়েমের রাগ পৃথিবী চুরমার করে ফেললেও তার কিছু আসে যায় না।
ঘরে পা রাখতেই সায়েম ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “ছেলেটা কে ছিল?”
আজ কতগুলো দিন পর সায়েমের মুখ থেকে পুরো একটা বাক্য শুনলো নাজ। হয় কয়েকদিনে নিতান্ত প্রয়োজনে দুয়েকটা শব্দ ছাড়া কোনো কথাই হয়নি তাদের মাঝে।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এখনি প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না নাজ। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রাখল, জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে লম্বা এক চুমুক দিয়ে বলল, “তাতে আপনার কী?”
সায়েম নাজের দিকে তাকিয়ে রইল অবিশ্বাসে। যেন অন্য কোনো ভাষায় তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে, যে ভাষা তার জানা নেই। তবুও অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
নাজ আবারও বলল, “ভাবলাম, আপনি তো সুন্দরভাবেই নিজের ভবিষ্যতটা গুছিয়ে নিচ্ছেন। আমি কেন শুধু শুধু পিছিয়ে থাকতে যাবো? একদিন তো আপনি আমাকে ছেড়েই দেবেন। তখন আমারও কাউকে না কাউকে প্রয়োজন হবে।”
সায়েম কঠিন গলায় বলল, “তোমার সাহস খুব বেড়ে গেছে তাই না?”
“হ্যাঁ বেড়েছে।”
“তোমার সমস্যা কী নাজ? এমন বিহেভ করছো কেন?”
কিছুটা সময় চুপ করে থেকে মলিন কণ্ঠে নাজ বলল, “চোখের সামনে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছেন না?”
নাজের পাল্টা প্রশ্নকে সম্পূর্ন উপেক্ষা করে সায়েম পরিষ্কার গলায় বলল, “ওই ছেলেটার সঙ্গে যেন আর কখনো না দেখি তোমাকে!”
“দেখলে সমস্যাটা কোথায়? আপনি তো আমাকে ডিভোর্স দিয়েই দেবেন।”
“দিয়ে দেব, কিন্তু এখনো দিইনি। আমার সঙ্গে থেকে কোনো লিমিট ক্রস করার চেষ্টা করবে না।”
“লিমিট ক্রস আমিই করেছি, আপনি করেননি?”
“মানে?”
“আপনার জীবনে অন্য কেউ থাকতে পারে আর আমার জীবনে পারে না?”
“এ নিয়ে তোমার সঙ্গে আর্গুমেন্টে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমার জীবনে আমি করছি না করছি সেটা তোমার দেখার বিষয় না।”
“এই একই কথা তো আমিও আপনাকে বলতে পারি।”
“না, পারো না। কারণ আমি তোমার লিগ্যাল গার্ডিয়ান। ডিভোর্সের আগ পর্যন্ত আমি যেভাবে চাইবো, সেভাবেই চলতে হবে তোমাকে।”
সায়েমের কথাগুলো আর সহ্য হচ্ছে না নাজের। তাই সেখান থেকে উঠে চলে এল নিজের ঘরে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমটায় ঢুকে সবগুলো ট্যাপ ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে নাজ। কান্নার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। এতগুলো দিন ধরে বহু চেষ্টা করেও কাঁদতে পারেনি মেয়েটা, আজ পারছে।
নাজের এই কান্না যেন অভিমানী স্বরে সায়েমের কাছে জানতে চাইছে – “আমাকে ভালোবাসলেন না কেন? আমি কি এতটাই খারাপ?”
(চলবে)#অপেক্ষারা
২৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
মানুষ নিজের চোখদুটো দিয়েই পৃথিবীকে দেখে, নিজের মস্তিষ্ক জুড়েই তার এলোমেলো সব ভাবনাগুলোর বিচরণ, নিজের মন দিয়েই মানুষ অনুভব করে সহনীয়-অসহনীয় অনুভূতিগুলো। এমনটা যদি না হতো?
নাজের প্রবল ইচ্ছা হয়, নিজের অনুভূতিগুলো এক মুহূর্তের জন্যে হলেও সায়েমকে অনুভব করাতে। করিয়ে জিজ্ঞেস করতে, “দেখুন! কতোটা ভালোবেসেছি আপনাকে। এমনটা ভালো কেউ কোনোদিন বাসতে পারবে?” জীবনটা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে ওই মানুষটা তাকে ভালোবাসবে এমন আশা করা অর্থহীন। নাজ সে আশা করেও না। তার কেবল একটাই চাওয়া – মানুষটা জানুক তার ভালোবাসা দুদিনের মোহ নয়।
আচ্ছা, এই ভালোবাসা জিনিসটা আসলে কী? মনসমুদ্রের উত্তাল কোনো ঢেউ না-কি পৃথিবীর জটিলতম সমীকরণ। হাজার বছর চেষ্টা করেও যে সমীকরণের সমাধান বের করা কষ্টসাধ্য। ভালোবাসা শ্রেষ্টতম অনুভূতিগুলো এনে জড়ো করে মনের মাঝে, আবার একই ভালোবাসা মনটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলতে সক্ষম। কী হতো, এই ভালোবাসা জিনিসটা পৃথিবীতে না থাকলে?
প্রকৃতি অতি সহজে কাউকে ভালোবেসে ফেলার ক্ষমতা দেয়নি। আবার অতি সহজে মন থেকে ভালোবাসাটাকে দূর করার শক্তিও দেয়নি। নাজ যেমন প্রথমদিনেই সায়েমকে ভালোবাসেনি, বেসেছে ধীরে ধীরে মনের অজান্তে। তেমনি এখন প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওই মানুষটাকে ভালোবাসা থেকে মনকে বিরত রাখতে পারছে না।
ভালোবাসা ব্যাপারটা যদি এতই জটিল হয়ে থাকে, তাহলে মানুষ অবলীলায় কী করে বলতে পারে ‘ভালোবাসি’? মানুষ কাকে ভালোবাসবে তা কি প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়? তা নাহলে আটশ কোটি মানুষের এ পৃথিবীতে দুটো মানুষ কেন পরস্পরকেই ভালোবাসে?
মোবাইলের রিংটোনের শব্দে নাজের সাতপাঁচ ভাবনায় ছেদ পড়ল। আশেপাশের মানুষগুলো
আজকাল বড্ডো অসহ্য লাগে। কোনো এক অদৃশ্য চাদরে নিজেকে আড়াল করতে পারলে ভালো হতো।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করে নাজ বিরস কণ্ঠে বলল, “বল কনা।”
কনা উত্তেজিত গলায় বলল, “হ্যালো নাজ! কী ব্যাপার? কাল সারারাত তোর ফোন বন্ধ ছিল কেন? আমি আর মালা কম করে হলেও তিন কোটি বার ফোন করেছি তোকে।”
নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাতে আর চার্জ দেওয়া হয়নি।”
“তোর ফোন বন্ধ হয়ে গেছে আর তুই সারারাত চার্জ দিসনি? আগে তো ফোন ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতি না!”
“এখন পারি। তুই কিছু বলবি?”
“বলবোই তো। শুধু শুধু তো আর ফোন করিনি।”
“কী বলবি।”
“শিউলির বিয়ে!”
“বাহ! ভালো তো।”
নাজ কথাটা এমনভাবে বলল যেন সে খবরটা আগেভাগেই জানতো। নিজের সবথেকে ঘনিষ্ট বান্ধবীর বিয়ের সংবাদে মোটেও উচ্ছ্বসিত হলো না সে।
কনা হতবিহ্বল হয়ে বলল, “এই নাজ? তুই বুঝতে পারছিস? শিউলির বিয়ে হতে যাচ্ছে!”
নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “না বোঝার কী আছে? কার সঙ্গে বিয়ে?”
“কার সঙ্গে আবার? শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে! তার বাবা আগামী মাসে পোস্টিং হয়ে চিটাগং চলে যাচ্ছে। একবার পোস্টিং হয়ে চলে গেলে আর কোনোদিন দেখা হয় না হয়, সেজন্যে শিহাব ভাই আগেভাগেই শিউলিকে প্রপোজ করেছে। বউ নিয়ে একেবারে চিটাগংয়ে যাবে। আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে নাজ! তোর আনন্দ হচ্ছে না?”
“হচ্ছে। কবে বিয়ে?”
“আগামী মাসের তিন তারিখে। সময় কিন্তু বেশি নেই। তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আয়। এখানে অনেক কাজ। আমি আর মালা কতিদিক সামলাবো বল তো?”
বিয়েতে গিয়ে আনন্দ-উল্লাস করার মতো মনের অবস্থা এই মুহূর্তে নাজের নেই। তার নিজের ভালোবাসাই যেখানে মানুষের কাছে তাচ্ছিল্যের বিষয়, সেখানে অন্যের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার দৃশ্য মোটেও সুখকর কিছু নয়।
নাজ শুকনো গলায় বলল, “আমি যেতে পারবো না। সামনের মাসে আমার ক্লাস টেস্ট।”
কনা বিস্মিত গলায় বলল, “সামান্য ক্লাস টেস্টের জন্যে তুই শিউলির বিয়েতে আসবি না? পাগল-টাগল হয়ে গেলি না-কি নাজ?”
“না রে। সত্যিই এবার সিরিয়াসলি পড়াশোনা করতে হবে। ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি।”
“তাই বলে তুই শিউলির বিয়েতে আসবি না? তুই না এলে তো মেয়েটা বিয়েই করবে না!”
“তোরা আমার হয়ে ওকে বুঝিয়ে বলিস প্লিজ। আমি সত্যিই যেতে পারবো না।”
এই একই জগতের মাঝে কোটি কোটি ভিন্ন জগত রয়েছে। একেকটা জগত একেক মানুষের মস্তিষ্কে গড়ে ওঠা। সেই জগতে কেবল ওই একটা মানুষেরই বসবাস। নাজ এতকাল এমন এক জগতে বসবাস করে চলছিল যেখানে সে সায়েমকে অসম্ভব ভালোবাসে। ওই মানুষটাও তাকে তার মতো করেই ভালোবাসে।
তবে আচমকাই প্রকৃতি তাকে সেই জগত থেকে টেনে বের করে অন্য এক জগতে এনে ফেলেছে। যে জগতে তার প্রতি ওই মানুষটার এক বিন্দুও ভালোবাসা নেই। সেও চেষ্টা করছে ভালোবাসা নামক যা কিছু আছে, সবই মন থেকে তাড়িয়ে দিতে। কখনো পারছে, কখনো পারছে না।
নাজ বারবার নিজের মনকে বোঝাচ্ছে, মানুষটা যখন একবার বলে দিয়েছে যে সে তাকে ভালোবাসে না, তার মানে বাসে না। কোনো কালে বাসবেও না। জোরাজুরি করে আর যাই হোক, কাউকে ভালোবাসতে বাধ্য করা যায় না। তাই যে করেই হোক এই নতুন জগতটাতে অভ্যস্ত হতে হবে তাকে। কষ্ট হলেও ভালোবাসাটাকে মন থেকে দূর করতেই হবে।
নাজ বুকশেলফ থেকে পাঠ্যবইগুলো বের করে আনলো। অযত্নে বইগুলোতে ধুলো জমে গেছে। হিসাববিজ্ঞানের বইগুলো কেবল পরীক্ষার আগেই খুলে দেখা হয়। নাজ একটা কাপড় এনে যত্ন সহকারে বইগুলো মুছে ফেলল। মনটাকে ব্যস্ত রাখার একমাত্র উপায় হলো লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়া। ব্যস্ত থাকলেই কেবল সকল দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে থাকতে পারবে সে।
লেখাপড়া করে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। সমাজে সায়েম যতটা প্রতিষ্ঠিত, তার থেকেও বেশি প্রতিষ্ঠিত হতে হবে নাজকে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ তাকে দূরে সরিয়ে রাখার সাহস না পায়।
কলিংবেল বাজল, জরিনা এসেছে। ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে ঢুকতেই তার চোখদুটো উঠে গেল কপালে।
হতবাক গলায় বলল, “ওহ্ আল্লাহ! আফা এতসব রান্না কেডা করছে?”
“আমি করেছি। খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে।”
জরিনা অবিশ্বাসে চামচে করে চিংড়ি মাছের ঝোল তুলে মুখে দিয়ে বলল, “ভালোই তো হইছে আফা, কিন্তুক লবণ একটু কম হইছে। সত্যই আফনে রাঁনছেন?”
“কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“হ, তয় আফনে এইসব কোত্থেইকা শিখলেন?”
“ইউটিউব থেকে।”
“হেইডা আবার কী আফা?”
“তোমাকে বুঝতে হবে না। শোনো জরিনা, কাল থেকে তুমি শুধু তরকারি কেটেকুটে দেবে। রান্নাবান্না আমিই করবো।”
জরিনা এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চিংড়ি মাছের দিকে। এক বছর ধরে নাজকে চেনে সে। এই এক বছরে একটা বারও তাকে চুলার আশেপাশে দেখা যায়নি। আজ হঠাৎ কী এমন হলো, যে সে নিজ আগ্রহে রান্না করেছে?
ইদানিং নাজ কোনো কারণ ছাড়াই জেদ করছে। তবে জেদটা যে কার ওপরে করছে বোঝা যাচ্ছে না। সারাজীবন নিজেকে চিনে এনেছে নাজনীন হক নামে। বাবার পদবী পাল্টে ফেলার ইচ্ছা তার কোনোকালেই ছিল না। এজন্যেই বিয়ের পরও নিজেকে নাজনীন হক হিসেবেই পরিচয় দিয়ে এসেছে।
তবে গতকাল আচমকাই কী যেন মনে করে ফেসবুকে নিজের নাম পাল্টে লিখল, নাজনীন চৌধুরী। আরও ভালো হতো নাজনীন সায়েম চৌধুরী লিখতে পারলে।
নাম পাল্টে ফেলা, রান্না বান্না করা – এসব কিছুই সায়েমকে নতুন করে মুগ্ধ করার জন্যে করছে না নাজ। করছে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে। সাজানো গোছানো এই সংসারটা চিরকাল তার থাকবে না। তবে যতদিন থাকবে, নাজ তার দায়িত্বগুলো ঠিকঠাকভাবে পালন করতে চায়।
অফিস থেকে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে আবার বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সায়েম। এই সময়টুকু নাজের জন্যে সবথেকে ভয়াবহ। আগে সারাটাদিন অপেক্ষা করে থাকত কখন সায়েম অফিস থেকে ফিরবে, আর কখন সে সারাদিনের জমে থাকা কথাগুলো একেক করে বলবে। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। মনের কথাগুলো মনেই জমে থাকে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে মানুষটা। এই দূরত্ব যেদিন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে, সেদিন নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে নাজ।
রাত নয়টার কাছাকাছি, নাজ মনোযোগ দিয়ে জটিল একটা হিসাব সমাধানের চেষ্টা করছে। কোনদিকে কোনো খেয়াল নেই। আগে পড়তে বসলেই বারবার হাতটা চলে যেত মোবাইলের ওপরে। কিন্তু আজ সে মোবাইলটাই অসহায়ের মতো পড়ে আছে টেবিলের এক কোণে।
হুট করে ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই বুক ধক করে উঠল তার। সায়েম ফোন করেছে। একই ছাদের নিচে বাস করে যে মানুষটা তার সঙ্গে কথা বলে না, সে এত রাতে ফোন করছে কেন?
“হ্যালো?”
ফোনটা রিসিভ করতেই এক প্রচন্ড স্রোত নাজ শিরদাঁড়া প্রকম্পিত করে বয়ে গেল। সায়েমের মোবাইল থেকে ফোনটা করা হলেও অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটা সায়েম নয়, অন্য কেউ।
নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “কে?”
অপরপ্রান্ত থেকে উদ্বিগ্ন এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “নাজনীন বলছেন?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?”
“তাড়াতাড়ি স্কোয়ার হসপিটালে চলে আসতে পারবেন?”
“মানে? কেন?”
“সায়েম রোড অ্যাকসিডেন্ট করেছে।”
নাজের হৃদস্পন্দনের গতি যেন মুহূর্তেই কয়েক হাজারগুণ বেড়ে গেল, চারিদিকে নেমে এলো অন্ধকার। সে এখন কী করবে? আচ্ছা, মানুষটা ঠিক আছে তো? এতগুলো দিন মনে মনে মানুষটাকে কম ভর্ৎসনা করেনি। তবে তার কিছু হয়ে গেলে নাজ যে বেঁচে থাকতে পারবে না।
(চলবে)