#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_21
এলাম বাজতেই ঘুম থেকে উঠে পরে অনিন্দিতা। আড়মোড়া ভেঙে এলাম স্টপ করে। মনে মনে ঘুম থেকে উঠার দোয়া পরে নেয়। আজ শরীর টা বেশ ফুরফুরে। নামাজের পর দুই ঘন্টা ঘুম হয়েছে। মাঝে কেঁটে গেছে দুই বছর। অনিন্দিতা যথাসম্ভব নিজেকে পরিবর্তন করছে। নির্ভীকের নাম ই উচ্চারন করে না সে। পুরনো ডায়েরী টা টেবিলের কোনো এক কোনে পরে আছে। কখনো ইচ্ছে হয় না লেখার। ডায়েরী টা কেমন অসমাপ্ত হয়ে আছে। কয়েক পাতা লিখলেই শেষ হয়ে যাবে। অথচ লেখালেখির আগ্রহ পায় না মেয়েটা। হঠাৎ করে ডায়েরীর কথা মনে পরে যাওয়ায় বিদ্রুপ মাখা হাসি তে মত্ত হয় অনিন্দিতা। সমস্ত পিছুটান ফেলে এগিয়ে যায় নতুন আলো তে। ফাইনাল এক্সাম এর লাস্ট ডে আজ। সারাক্ষন পড়াশোনা তে ব্যস্ত থাকায় ঠিক মতো ঘুম হয় নি। প্যাক্টিকাল এক্সাম হওয়াতে আজ ইচ্ছে মতো ঘুমিয়েছে। বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে রেডি হতে থাকে অনিন্দিতা । কাবাড মেলে দিয়ে চিন্তায় পরে যায় কোন ড্রেস পরবে। একটা একটা করে দেখে। হঠাৎ চোখ যায় পার্পল রঙের থ্রি পিসে। কিছু দিন আগে পৃথিবী গিফ্ট করেছে এটা। ড্রেস টা পরা হয় নি। অনিন্দিতার ইচ্ছে হয় না পরার। পরক্ষনেই সমস্ত ধ্যান ধারনা বদলে ফেলে। একটা মানুষের সাথে জড়িয়ে থাকা রঙ কে কেন ইগনোর করবে ওহ ?
জেদ ধরে এই রঙের ড্রেস টাই পরে। ডাইনিং এ আসতেই শাহানা বলেন
” আজ কেই তো লাস্ট এক্সাম তাই না ? ”
” হুমম। কেন বলো তো ? ”
” সারাক্ষন পড়াশোনায় ডুবে থেকে প্রিয় মানুষদের ভুলে যাস। ”
” কি বলছো কিছুই বুঝলাম না। ”
” এতো বুঝে কাজ নেই। সাবধানে যাস , আর শোন আসার সময় এক বক্স চকলেট নিয়ে আসবি। ”
” এই বয়সে এসে বাচ্চা হতে ইচ্ছে হলো বুঝি ? ”
শাহানার দৃষ্টি তে বিরক্ত । ফিঁচেল হাসে অনিন্দিতা। এক টুকরো রুটি মুখে পুরে শাহানা কে জড়িয়ে বলে
” আসছি আম্মু। দোয়া করো , আর আব্বু কে দেখে রেখো। ”
” হুমম। ”
” সময় মতো ঔষধ দিও কেমন। ”
” আচ্ছা দিবো। ”
” আর শোনো আব্বুর খাবারে তেল ঝাল কম দিও। ”
তেঁতে উঠেন শাহানা । টেবিলে ধুম করে গ্লাস রেখে বলেন
” আশ্চর্য । আমাকে রোজ রোজ বলার কি আছে আমি বুঝলাম না। মানলাম তদের মতো ভারসিটি তে পড়ি নি আমি। তবে অশিক্ষিত তো নই ? এক মেয়ে ফোন করে বলবে আরেক মেয়ে রোজ কানের কাছে এসে একি কথা বলবে। তোর আব্বুর জন্য তোরাই চিন্তা করিস। আমার চিন্তা হয় না ? মানুষ টা দু দু বার হার্ট এট্রাক করেছে আর এই দুই মেয়ে আমাকে চিন্তার বুলি শোনায়। আমি কি তোর আব্বুর যত্ন করি না। ”
” উফফ আম্মু। তুমি এখন আমাদের কে হিংসে করছো। একা একাই বরের যত্ন করবে। আর আমরা চিন্তা করবো সেটা তে ও জেলাসি। ইতিহাসে তোমাদের প্রেম অমর হয়ে থাকবে। ”
” আর একটা কথা বললে মার খাবি অনি।”
কথা টা বলার সময় হেসে ফেলেন শাহানা। অনিন্দিতা ও হাসে। দরজার কাছে এসে বলে
” যাচ্ছি আমি। আর শোনো আব্বুর খেয়াল রেখো। ”
কথা টা বলেই জ্বিভ কাঁটে ওহ। রোজ কার অভ্যাস কি না। শাহানা অবাক চোখে তাকায়। এই মেয়ে কে নিয়ে আর পারা গেলো না।
.
পরীক্ষা শেষ করে বের হয় অনিন্দিতা। বাহ আজ থেকে মুক্তি। মাঝে বেশ অনেক দিন সময় পাওয়া গেল। রেজাল্ট এর পর মাস্টার্স কমপ্লিট করলেই হয়ে গেল। জীবন থেকে একটা ধাপ উত্তীর্ণ। ক্যাম্পাসে সবার সাথে হৈ হুল্লর করে বের হয় অনিন্দিতা। গেটের কাছে আসতেই চোখ যায় আসিমের দিকে। গাড়ি তে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখে সানগ্লাস, হিরো দের থেকে কোনো অংশেই কম নয় ছেলেটা। ছুটে যায় অনিন্দিতা। চার্ট দিয়ে লাগাতার মারতে থাকে। নিজেকে রক্ষা করে আসিম বলে
” আরে মেরে ফেলবে তো। ”
” মারবো না তো কি করবো। এখন আদর করতে বলছো ? ”
” করতেই পারো। আমার কোনো অসুবিধা নেই। ”
” আসিম।”
” আরে চিল। আমি এসেছি তুমি খুশি হও নি ? ”
” না হই নি। ”
” আচ্ছা স্যরি। আসলে বিজনেস এ আটকে আছি। এর জন্যই আসতে পারি নি। সমস্ত চাপ আমার উপর দিয়ে রেখেছে। আমার তো মনে হয় অতি দ্রুত বিজনেস লাটে উঠবো। ”
” মোটে ও না। আঙ্কেল সব ভেবে চিন্তেই দিয়েছেন। এক বছর ধরে বিজনেস সামলাচ্ছো। লাভ ই হয়েছে কোনো ক্ষতি তো হয় নি।”
” সেটা ও ঠিক। ”
” এখন আমার কথা বাদ দাও। আগে বলো এক্সাম কেমন হলো ? ”
” উমম ভালোই। তোমার তো দুই মাস পরেই এক্সাম। পড়াশোনা করো তো নাকি ফাঁকি বাজি , আর আড্ডা বাজি? ”
বা হাতে কলার উঁচু করে আসিম। কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে অনিন্দিতার দিকে চোখ নাচায়। ভ্রু কুটি করে তাকায় অনিন্দিতা। আসিম বলে
” রেকর্ড ভেঙেছে কেউ ? লাস্ট ইয়ার এন এস ইউ তে প্রথম হয়েছি তো ? এবারো ভালো রেজাল্ট হবে। ”
” বাহহ। শুধু ভালো হলে হবে ? এবার প্রথম হতে পারবে না বুঝি। ”
একটু ভাবে আসিম। শুকনো মুখে বলে
” এবার হবে না রেকর্ড। ”
” কেন হবে না। হতেই হবে , না হলে কোনো কথা বলবো না। ”
আসিম কে রেখে হাঁটা লাগায় অনিন্দিতা। পেছন থেকে চিৎকার করে আসিম বলে
” আরে রেকর্ড হবে তো। এর জন্য আজ আমরা এক সাথে চিকেন চাপ খাবো। রাজি ? ”
” রাজি। ”
রাস্তার ধারের দোকানে এসে চিকেন চাপ অর্ডার দেয় অনিন্দিতা। প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছিলো তাঁর। বহু দিন পর চিকেন চাপ খাচ্ছে। খাওয়া শেষে আসিম বলে
” চলো। ”
” কোথায় যাবো ? ”
” হীরের শশুর বাড়ি। ”
” হঠাৎ মামা বাড়ি কেন যাবো। ”
” উফফ অনি। সব ভুলে যাও তুমি। আজ কে অরুর জন্মদিন সেটা ও মনে নেই। ”
” উফফফস। এর জন্য ই আম্মু আমাকে চকলেট নিতে বলেছে। ইসস কতো টা দেরি হয়ে গেল। ”
” দেরি হয় নি। আন্টি আর আঙ্কেল অনেক আগেই চলে গেছে। এখন তুমি আর আমি যাবো। ”
” ধ্যাত আগে বলবে না। ”
” পড়াশোনা নিয়ে যেভাবে ডুবে আছো। কোনো কথা শুনতে চাও তুমি ? ”
” বেশি বেশি হচ্ছে। ”
” আচ্ছা আর বলছি না। এখন চলো। ”
” আরে আমি ড্রেস নিয়ে এসেছি না কি। আগে বাসায় যাবো তারপর মামা বাড়ি। ”
” আচ্ছা। আসো এবার না হলে সত্যি লেট হয়ে যাবে। সন্ধ্যার আগে পৌছাতে হবে তো। ”
” কিচ্ছু লেট হবে না। তোমার এরো প্লেনের যে স্প্রিড। ”
গাড়ির দিকে তাকায় আসিম। সত্যি গাড়ি টার গতি বেশ ভালো। নতুন মডেলের বেস্ট ডিজাইন করা।
বাসায় আসে অনিন্দিতা। আসিমের হাতে কফি মেকার ধরিয়ে দেয়। আসিম বলে
” এটা দিয়ে কি হবে ? ”
” কফি বানাবে। ”
” আরে আমি এখন কফি খাবো না। ”
” তোমাকে খেতে বলি নি তো। আমার জন্য বানাতে বলেছি। ”
” এহহ ? ”
” হ্যাঁ মিস্টার আলসে। দ্রুত কফি বানান আমার জন্য। আমি রেডি হয়ে আসছি। ”
অনিন্দিতা চলে যায়। আসিম হাসে , এ যেন ভিন্ন রকমের অনিন্দিতা। দেড় বছর আগে ও কতো টা পাগলামি করেছে মেয়েটা। মেঝে তে গড়াগড়ি খেয়েছে। সারাক্ষন নির্ভীকের নাম উচ্চারন করেছে। পাওয়াফুল ঔষধের জন্য কিছু টা স্থূল হয়ে গিয়েছিলো। তাঁতে ও যেন মেয়েটার প্রতি আকর্ষন কমে নি আসিমের। ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়। রূপের পরিবর্তন ও ভালোবাসায় বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না। পুরনো কথা ভাবতেই গাঁয়ে কাঁটা দেয়। দীর্ঘ সাত মাস ঠিক মতো দু চোখে পাতা এক করতে পারে নি আসিম। হসপিটালে রোজ যাওয়া আসা করতে হয়েছে। তবে একটা কথা বলতেই হয় অনিন্দিতা নিজের পরিবারের সামনে নির্ভীকের নাম কখনো উচ্চারন করে নি। কখনো নির্ভীক কে ছোট হতে দেয় নি। ছেলেটার সম্মান ধরে রেখেছে। হায়রে ভালোবাসা , মানুষ কে কোন পর্যায় নিয়ে যায়।
” এই আসিম। ”
অনিন্দিতার ধমকে চমকে যায় ছেলেটা। বলে
” হ্যাঁ বলো। ”
” কোন রাজ্যে চলে গিয়েছিলে। উঠো , আমি কফি বানাচ্ছি। সারাক্ষন আলসেমি। ”
মাথ চুলকোয় আসিম। অনিন্দিতা কফি কাপ টা এগিয়ে দেয়। আসিমের ভালো লাগে। প্রিয় মানুষ টা কে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য রয়েছে তাঁর। প্রিয় মানুষ টার সাথে একটা আলাদা সময় কাটানোর অধিকার রয়েছে তাঁর। সব ভালোবাসা বোধহয় এমন প্রাপ্তি পায় না। যেমন টা ওর ভালোবাসা অব্যক্ত হয়ে আছে। তবু ও কিছু টা স্বস্তি তো মিলেছে।
বাঁকা পথে গাড়ি চালাচ্ছে আসিম। যাঁর দরুন বেশ সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে অনিন্দিতা। পড়ন্ত বিকেলে কোনো এক প্রিয় মানুষের বড্ড অভাব। যার হাত ধরে সারা বিকেল টা কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো সেই মানুষ টা আজ কতো দূরে। তাঁর অবস্থান হাজার মাইল দূরে এমন কি মন থেকে ও দূরে সরে গেছে। মাঝে মাঝে হৃদয়ের ফাঁক ফোকর গলে ঢুকে পরে দীর্ঘশ্বাস। অনুভব করায় নিজের শূন্যতা। ব্যস্ত শহরে সবাই কে পাশে পেয়ে ও কাউ কে পায় নি অনিন্দিতা। মন থেকে নির্ভীক কে সরিয়ে দিয়ে ও মনের শান্তি মিলে নি। মিলেছে শুধু দীর্ঘশ্বাস আর ক্লান্তির ছাঁপ। ভালোবাসি বলে চিৎকার করা হয় নি আজ বহুদিন। ডায়েরী মেলে অনিন্দিতা। হঠাৎ করেই দুই বছরের স্মৃতি লিখতে ইচ্ছে হয়। ডায়েরী টা অসাপ্ত রেখে লাভ কি ?
#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_22
নির্ভীক চলে গেছে আজ তিন দিন। অনিন্দিতা যেন নির্বিকার হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া গোসল সব ছেড়ে দিয়ে থম মেরে বসে থাকে। অনুভূতির কোনো স্থান নেই। তবে সে নিজেই জানে তাঁর অনুভূতি গুলো কতো টুকু অবহেলিত। হৃদপিন্ডের শেষ স্পন্দন টি ও যেন ক্রন্দন করে বলতে চায়
” নির্ভীক আমি ভালো নেই। আপনাকে ছাড়া ভালো নেই। পারি নি ভুলতে আমি। ব্যর্থ হয়ে গেছি আমি। আপনাকে ভালোবেসে সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে নিয়েছি। ”
তবে সব কথা যেন গলায় এসে আটকে যায়। শক্ত আদলে গড়া মেয়ের মতো নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পরিবারের থেকে নিজের অনুভূতি সংযত হয়। নির্ভীক কে কেউ অপমান করবে তাঁর কোনো সুযোগ দেয় না। কারন প্রিয় মানুষটির প্রতি ভালোবাসা। নিজে কষ্টে মরে যাবে তবে নির্ভীকের নাম উচ্চারন করবে না। তবে আসিম আর ইশরাকের সামনে ভেঙে পরে অনিন্দিতা। বুক ফাঁটা চিৎকার আসতে চায়। তবু ও সংযত হয়। এভাবেই কেঁটে যায় পনেরো দিন। ডায়েরী আর নির্ভীকের রক্তে মাখা পাতা টুকু বুকে তুলে রাখে। হাসে খেলে মনে মনে কথা বলে। বাইরে থেকে সব ই দেখে ইশরাক। সে বুঝতে পারে অনিন্দিতা যতো দিন যাচ্ছে ততো মানসিক রোগী তে পরিনত হচ্ছে। এভাবে কোনো কথা বার্তা ছাড়া থাকলে অনিন্দিতা বাক শক্তি হারাবে। গভীর চিন্তায় ছুটে যায় আসিমের কাছে। আসিমের অবস্থা ও ভালো নয়। অনিন্দিতার চিন্তায় পাগল হয়ে যায় নি যে এটাই অনেক। ইশরাক বলে
” অনিন্দিতা কে এভাবে থম মেরে থাকতে দিলে সমস্যা হবে। ”
” সেটা আমি ও বুঝতে পারছি। ”
” অন্য কোনো কেস হলে আমি আমার মতো ট্রিট করতাম। বাট এটা পুরোই ভিন্ন। আমি জানি তুমি আমাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো হেল্প করতে পারবে না। তবে তোমার মতামত আমার প্রয়োজন। আমি একা সব কিছু গোছাতে পারছি না।”
” অনি কে বোঝাতে হবে। ”
” কি বোঝাবো ? ”
” নির্ভীক স্যারের স্মৃতি আঁকড়ে থাকলে কখনোই নির্ভীক স্যার ওকে ক্ষমা করবে না। পরিস্থিতি কখনোই বদলাবে না। যেখানে নির্ভীক স্যার অন্য মেয়ে কে নিয়ে সুখে ঘর করার পরিকল্পনায় আছে। যেখানে অনির ভালোবাসা ওনার কাছে অভিনয় স্বরূপ।
যেখানে অপাত্রে ভালোবাসা দান করে চলেছে। কিংবা নির্ভীক স্যার এ সবে বিরক্ত হচ্ছে তাই ওর উচিত নিজে কে সংযত করা। ”
” সংযত করতে পারবে না অনিন্দিতা। ”
” সেটার জন্য পাওয়ারফুল মেডিসিন তো আছেই। ”
” রিক্স নেওয়া ঠিক হবে ? ”
” হবে। আমি নিতে চাই রিক্স। অনি কে বাঁচতে হবে। ”
” ওকে। আমি সব ব্যবস্থা করছি। তুমি ওর সাথে কথা বলো। ”
ইশরাক চলে যায়। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আসিম। বেডের এক কোনে বসে আছে অনিন্দিতা। হাতে তাঁর প্রিয় ডায়েরী। যেখানে লেগে আছে নির্ভীকের রক্ত। সেটা তে হাত বুলাচ্ছে মেয়েটা। হঠাৎ করেই চমকে উঠে সে। আসিম ও বিব্রত হয়। অনিন্দিতা ডায়েরী টা তে হাত বুলাতে থাকে। বুকে জড়িয়ে নেয়। যেন কেউ এটা নিয়ে যেতে চাইছে। ছুটে যায় আসিম। অনিন্দিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
” এই অনি। কি হয়েছে তোমার ? ”
কোনো কথা বলে না অনিন্দিতা। ডুকরে কেঁদে উঠে। আসিম বলে
” অনি , শান্ত হও। ফেলো ডায়েরী টা। ”
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় অনিন্দিতা। এই মুহুর্তে আসিম কে তাঁর চির শত্রু মনে হচ্ছে। আসিম আগাতেই ভয় পেয়ে যায় অনিন্দিতা। সামনে থাকা স্টিলের ওয়াটার বোতল ছুড়ে মারে। মাথার ডান সাইটে আঘাত লাগে ছেলেটার। মৃদু আর্তনাদ করে এগিয়ে যায়। চেঁচিয়ে উঠে অনিন্দিতা। দীর্ঘ পনেরো দিন পর মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারন করলো অনিন্দিতা। আসিমের চোখে মুখে উৎকন্ঠা। হাসি মুখে আবারো অগ্রসর হয়। অনিন্দিতা যেন তাতে ও তেঁতে উঠে। এক মুহুর্তের জন্য আসিম কে চিনতে পারে না সে। বলে
” সরে যাও তুমি। আমি তোমায় খুন করে ফেলবো। আমার থেকে নির্ভীক কে সরাতে এসেছো তাই না ? কিছু তেই না। নির্ভীক ভাই কে আমি ভালোবাসি। আমি ভালোবাসি ওনাকে। ”
” অনি আমার কথা শোনো। ”
” নির্ভীক ভাই কোথায় গেলেন। আসিম , এই আসিম কোথায় তুমি ? নির্ভীক ভাই কে খুঁজে আনার কথা ছিলো তাই না। কোথায় গেলে তুমি ? ”
চারপাশে ঘুরে ঘুরে কথা টা বলে অনিন্দিতা । প্রচন্ড অবাক হয় আসিম। অনিন্দিতার বাহু চেপে ধরে বলে
” আমাকে চিনতো পারছো না তুমি ? ”
” তুমি ! তুমি ! হ্যাঁ তুমি। ”
মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অনিন্দিতা। আসিম যেন আকাশ থেকে পরেছে। অনিন্দিতা কে কোলে করে নিয়ে বেডে শুইয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে ছুটে যায় ইশরাকে কাছে।
কোনো এক টা মেডিসিন নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ইশরাক। আসিম কে দেখে হাসে। আসিম বলে
” ডক্টর ইশরাক , অনি আমাকে ও গুলিয়ে ফেলেছে। ”
” তোমার কি মনে হয় ঔষধ টা শুধু নির্ভীক কে ভুলতেই সাহায্য করবে ? এটা ঔষধ আসিম। কোনো ম্যাজিক নয় যে শুধু মাত্র ওর স্মৃতি থেকে নির্ভীক কেই সরানো যাবে। সব ভুলে যাবে ওহ। ”
দেয়ালে ঘুষি মারে আসিম। চুল খামচে ধরে বলে
” আগে কেন বলেন নি ? ”
” রিক্স নিতে নিতে তুমি ভুলে গেছো অনিন্দিতার মস্তিষ্ক কোনো মেশিন নয়। তোমাকে বলেছিলাম ঔষধ টা এখন দেওয়া উচিত হবে না। এনি ওয়ে পরের রিক্স টা নিতে চাও তুমি ? আমার কোনো অসুবিধা নেই। ইনফেক্ট নির্ভীকের ও কোনো অসুবিধা নেই। ওহ এর মধ্যে ইনভলব হবে না। ”
” ডক্টর ইশরাক ! ”
” বুদ্ধিমত্তা হারিয়ে ফেলেছো আসিম। যেখানে একটা ভালোবাসা গড়তে এতো সময় লাগে। সেখানে তুমি কি করে মুহূর্তেই ভোলাতে পারবে, বলে ভাবলে ? দেখো আসিম তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। তবে সব কিছুর সলিউশন ইস্টার্ন হয় না। নির্ভীক তোমার উপর ভরসা করেছে কেন জানো কারন তোমার সাথে অনিন্দিতার বন্ডিং খুব ভালো। আর তুমি অনিন্দিতার ভালো চাও। ইনফেক্ট এই মুহুর্তে দাড়িয়ে নিজেকে ভরসা করে না নির্ভীক।”
কোনো কথাই বলে না আসিম। ইশরাকের কেবিন থেকে বেরিয়ে পরে। ইশরাকের চোখ মুখে কিছু টা বিস্ময়। হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠে। ছুটে যায় ইশরাক। চার দিকের পাগলামি ওকে পাগল করে দিবে। এরা মানুষ নাকি এক এক টা ভালোবাসার সমুদ্র। কি করে পারে এমন ভাবে ভালোবাসতে ?
.
দীর্ঘ ছয় মাস পর অনিন্দিতা সুস্থ হয়। তবে কথা কম বলে। প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথাই বলে না। নির্ভীক কে ভুলার জন্য কোনো প্রকার ঔষধ দেওয়া হয় নি। শুধু মাত্র মানসিক ভাবে সবল হওয়ার জন্য বল দেওয়া হয়েছে। এই কয়েক মাসে পৃথিবী এফোর ওফোর করেছে আসিম। যতো ভালো ভালো সাহিত্যিক আছে , মানসিক শান্তি দেওয়ার জন্য স্বাক্ষাৎ করিয়েছে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখে নি। তাঁর সাথে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু পাওয়াফুল মেডিসিন । যা মানসিক ভাবে শান্তি তে রাখবে অনিন্দিতা কে। রোজ কয়েক বার করে বুঝিয়েছে আসিম। নির্ভীকের ভালো থাকার জন্য হলে ও ভুলতে হবে বলে মনস্থির করেছিলো অনিন্দিতা। অবশেষে সক্ষম হয়েছে মেয়েটা। তবে ভুলতে পারে নি প্রিয় মানুষটি কে। সবার সামনে নতুন করে অভিনয় করা শুরু করেছে সে। নির্ভীকের চিঠি তে বলা শেষ কথাটাই মেনে নিয়েছে ওহ। অভিনয় , এই অভিনয় ই হবে ওর জীবনের সঙ্গী।
বাসায় আসতেই প্রিয় মুখ গুলো যেন অনিন্দিতা কে কাঁদাতে বাধ্য করে। এরি মাঝে দু বার হার্ট এট্রাক করেছেন আরশাদ। বাবা কে জড়িয়ে ডুকরে কাঁদে মেয়েটা। সবার চোখে পানি। চারুলতা ছুটে আসেন অনিন্দিতার কাছে। ছোট থেকে নিজের মেয়ে মতো ভালোবাসেন কি না। সবাই কে নিয়ে শুরু হয় অনিন্দিতার নতুন পথ চলা। ঘুরে দাঁড়ানোর অভিনয়ে অনেক টাই সুস্থ তাঁর মস্তিষ্ক। এখন আর আগের মতো আচারন আসে না। ভেতরে ভেতরে কষ্ট টা ও কমে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে বুক চিরে বের হয় দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার।
তারপর কেঁটে যায় দেড় বছর। দেড় বছরের প্রতি টা সময় নিজেকে নিয়ে ছিলো মেয়েটা। পড়াশোনায় ভীষন মনোযোগী হয়েছে। কখনো নির্ভীকের নাম উচ্চারন করে নি। তবে ভেতরে ভেতরে নির্ভীকের নামেই লিখেছে শত গান। যাঁর প্রতি টা লাইন অব্যক্ত। ইচ্ছে হয়নি কখনো প্রকাশ করার। এই পরিবর্তন যেন চার পাশে সবার জন্য সুখময়। অনিন্দিতা নিজে ও খুশি প্রিয় মানুষ গুলোর হাসির কারন হতে পেরে।
হঠাৎ করেই শরীরে ধাক্কা অনুভব হয়। চোখ পিট পিট করে তাকায় অনিন্দিতা। আসিম বলে
” ঘুমিয়ে পরেছিলে ? ”
” ওহ হ্যাঁ। ডায়েরী টা লিখতে গিয়েই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। তবে শেষ পাতা টা এখনো পরিপূর্ন হচ্ছে না। ”
” হয়ে যাবে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। চা খাবে ?”
” রাস্তায় জ্যাম ছিলো ? ”
” প্রচুর। ”
” ইসস পুচকো টা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ”
” খুব বেশি সময় লাগবে না। আর আধ ঘন্টার পথ। ”
” আচ্ছা চলো, পাশেই তো টং এর দোকান চা খেয়ে আসি। ”
” আসো। ”
আসিমের সাথে নেমে যায় অনিন্দিতা। চায়ের দোকান থেকে মাটির খোঁড়া করে চা নিয়ে আসে পাহাড়ের ঢালে। সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকার নেমেছে কেবল। হালকা আলো তে এখনো চারপাশ স্পষ্ট। ঘাসের উপর বসে দুজনে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঘোলা চোখে তাকায় আসিম। অনিন্দিতার প্রতি পাগলামি করতে ইচ্ছে হয়। পুরো পৃথিবী কে বলতে ইচ্ছে হয় মনের কথা। না হয় তছনছ করে দেওয়ার বাসনা জাগে। না থাকবে ত্রিভুবন আর না থাকবে যন্ত্রণা। কিছু টা অসামাজিক ভাবনায় হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে আসিম। অনিন্দিতার হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নেয়। কিছু বোঝার পূর্বেই অনিন্দিতা কে নিয়ে ছুট লাগায়। পাহাড়ের বাঁকা পথে দুটো তারকাবাজি যেন ঝলমল করছে। অনিন্দিতা নিজে ও খুব ইনজয় করে বিষয় টা। পাহাড়ে দৌড়ানোর মাঝে এতো ভালোলাগা কাজ করে বুঝি ?
বাতাসের গতি বেশ ভালো। কানে যেন বাতাসের শব্দ ই শোনা যায় শুধু। হঠাৎ করেই অনিন্দিতা থমকে যায়। পিছু ফিরে তাকায় মেয়েটা। যেন কানের কাছে ভেসে আসে চিরচেনা একটাই ডাক ” অনিন্দিতা। ”