অরুণিকা পর্ব -১+২

১. থেমে থেমে গোলাবর্ষণের শব্দ। পুরো এলাকা জুড়ে আতংক। মানুষজন দরজা-জানালা বন্ধ করে জড়োসড়ো হয়ে বসে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছে। গোলাগুলির শব্দে কেঁপে উঠছে অরুণিকা। তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে আছে। কানে হাত দিয়ে সে বাবার কথামতো চুপটি করে রান্নাঘরের কেবিনেটে লুকিয়ে আছে। কেবিনেটের দরজাটি ভালোভাবে বন্ধ হয় না। হালকা ফাঁকা থাকে। আর সেই ফাঁক দিয়ে অরুণিকা যতোটুকু পারছে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সে কখনোই বাবার কথার অমান্য হয় নি৷ তাই সে যতোক্ষণ বাবা বলবে না ততক্ষণ এখানেই বসে থাকবে। হঠাৎ রান্নাঘরে দৌঁড়ে প্রবেশ করার সময় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো অরুণিকার চাচী। সে ফাঁক দিয়ে চাচীর ক্রন্দনরত মুখটা দেখে ভয় পেয়ে গেলো। তখনই কালো মুখোশধারী একজন লোক এসে বন্ধুক তাক করলো চাচীর পিঠ বরাবর। তারপর ঠা ঠা শব্দ তুলে ঝাঁঝরা করে দিলো তার পুরো শরীর। অরুণিকা ফুঁপিয়ে উঠলো। তার বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। বাবা বলেছিল, “আমি না আসা পর্যন্ত তুমি একটা শব্দও করবে না। এখান থেকে বেরও হবে না।” বাবার কথা মনে পড়তেই সে কেবিনেটে থাকা প্রেসার কুকারের হাতলটি শক্ত করে চেপে ধরলো। সময়টা যেন শেষ হচ্ছে না। বাবা আসবে বলেও আসছে না। তার খুব গরম লাগছে। গরম ভাপে তার শরীর ঘেমে যাচ্ছে। তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। সে ফাঁকা দরজাটি দিয়ে আবার বাইরে তাকালো। দেখলো বাইরে আগুন লেগেছে। রান্নাঘরের আশেপাশে সেই আগুনের ঝলকানি। অরুণিকা এবার মুখে হাত চেপে কেঁদে ফেললো। তার অভ্যাস প্রথমে ফুঁপাতে থাকবে। তারপর কেউ কাছে টেনে নিলে বা আহ্লাদ দেখালেই তার শব্দ করে কান্নাকাটি শুরু হবে। আর এরপর তার সেই কান্না থামানোর ক্ষমতা একমাত্র তার বাবারই আছে। মিনিট পাঁচেক পর কেবিনেটের দরজাটা কেউ বাইরে থেকে খুললো। অরুণিকা কেঁপে উঠলো। সামনে তার বাবা তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার কপাল ছুঁইয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। নাক ফেঁটে গেছে। মুখে দাগ হয়ে গেছে। পুরো পাঞ্জাবীতে রক্ত মাখামাখি হয়ে আছে। বাবাকে দেখে অরুণিকা কান্না করা ভুলে গেছে। সে তার বাবাকে প্রথম এই রূপে দেখেছে। বাবা এভাবে রঙ মাখামাখি করে তার সামনে কেন বসে আছে, এটাই সে বুঝতে পারছে না। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার হাতেও রক্তের দাগ। অরুণিকা বাবার হাতের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, এবার বুঝি বাবা আদর করবে! তাই সে ঠোঁট ফুলিয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। জুবাইয়ের করিম মেয়েকে নিয়ে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অরুণিকা বাবার পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে আছে। গায়ে গরম ভাপ লাগছে। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করে আছে। যতোক্ষণ সে বাবার কোলে থাকবে, তার কোনো ভয় নেই। অরুণিকা বুঝতে পারছে তার বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর বাবা এভাবে দৌঁড়াচ্ছে কেন? বিষয়টা খুব অবাক লাগছে তার। ২. ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আছে ছ’জন মাঝবয়সী ছেলে। আজ তাদের স্কুল থেকে পিকনিকে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের অবশ্য পিকনিকে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু আহনাফের নতুন নতুন জায়গা ঘুরতে যেতে খুব ভালো লাগে, আর সেই তার চাচাতো ভাই আরাফ ও বাকী বন্ধুদের জোর করেই পিকনিকে নিয়ে যায়। তারা একই স্কুলে পড়ে, সেই সুবাধে তাদের একসাথেই ওঠাবসা। আর তাদের বন্ধুত্ব গলায় গলায়। পিকনিকের বাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা সন্ধ্যার পরিবর্তে রাতেই বাসায় ফিরলো। গাড়ি তাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকেই একটা গাড়ি ভাড়া করে ছ’জনই তাদের এলাকায় এসে পৌঁছালো। এলাকার বাইরে যতো বাতি আছে আজ সবই নিভানো। তারা অবাক হয়ে মেইন গেইট দিয়ে ঢুকলো। মেইন গেইটে চার জন গার্ড সবসময় বাড়িটা পাহারা দেয়। কিন্তু আজ তো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তারা ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকতেই গোলাবর্ষণের শব্দ শুনে থেমে গেলো। এরপর পাশে থাকা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। প্রায় আধা ঘন্টা পর বিশ-পঁচিশজন মুখোশধারী লোক তাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। সেই লোকগুলোর হাতে ধারালো অস্ত্র আর বন্ধুক। তারা ঝোঁপের আড়াল থেকে আর বের হলো না। তবে এতোটুকু বুঝে ফেলেছে তাদের সব শেষ হয়ে গেছে। ইমন নিঃশব্দে কাঁদছে। ইভান তার ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “দেখিস বাবা, মা, দাদাভাই, বড় আপু সবাই আমাদের জন্য ভেতরেই বসে আছে। হয়তো এই লোকগুলো কোনো কাজে এসেছে।” ইমন বলল, “কাজে এসেছে এটা তুই বলছিস, ভাই? কাজে এলে আমরা এখানে বসে আছি কেন? ভেতরে যাই চল।” তাহমিদ ফিসফিস করে বলল, “ভাই আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ কর। আমার এখন হাত-পা কাঁপছে। সবাই ঠিক আছে তো!” আরাফ সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “ভাই তোরা চিন্তা করিস না। ভেতরে কি হয়েছে আমরা জানি না। আশা করছি সব ঠিক আছে। ভাবছি রাত হয়ে গেছে, যতোক্ষণ বাসা থেকে ফোন দেবে না, আমরা এখানেই থাকবো। আর আমরা পিকনিক থেকে দেরীতে ফিরছি, একটু পর সবাই চিন্তায় পড়ে অবশ্যই ফোন দেবে।” তূর্য বলল, “যদি কেউ ফোন না দেয়?” এবার আহনাফ বলল, “না দিলে সকাল পর্যন্ত এখানেই বসে থাকবি আর কি! এটা আবার কেমন প্রশ্ন?” আহনাফ আর ইভানের ধৈর্যশক্তি একেবারেই কম। তবুও আজ তারা দু’জন যেন ধৈর্যের উপর ধৈর্য ধরেই যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর পায়ের আওয়াজ পেয়ে তারা ঝোঁপের আড়াল থেকে মুখ তুললো। এলাকায় পাঁচ হাত দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্ট। আর সন্ধ্যার পর পরই সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অথচ আজ একটাও জ্বলছে না। তবুও রাতের আকাশে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত চাঁদের আলো যেন আজ তাদের অন্ধকার থেকে বেরুনোর পথ বের করে দিচ্ছে। আরাফ কাঁপা কন্ঠে বললো, “চাচ্চু!” আরাফের চাচ্চু শব্দ শুনে সবাই ঝোঁপের আড়াল থেকে বের হয়ে জুবাইয়ের করিমের সামনে চলে এলো। জুবাইয়ের সাহেব প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন, নিজের জন্য নয়, তার মেয়ের জন্য। পরক্ষণেই আরাফ আর আহনাফকে দেখে তিনি স্বস্তি পেলেন। তাদের ঝোঁপের দিকে নিয়ে গিয়ে বললেন, “তোমরা এখানে থেকো না। আমি জানি তোমাদের মনে অনেক প্রশ্ন আছে। সব উত্তর দেবার সময় আমার কাছে নেই। শুধু একটাই কথা বলার আছে, এই দেশে থাকা তোমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তাই তোমরা এই দেশ ছেড়ে দেবে।” জুবাইয়ের সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রক্তাক্ত কাগজ বের করে দিয়ে বললেন, “এখানে সব তথ্য দেওয়া আছে। এখন আর সবাইকে বিশ্বাস করার সময় নেই। তোমরা ছ’জনের উপর সৃষ্টিকর্তার রহমত ছিল, তাই বেঁচে গেছো। আমার আরেকটা আমানত তোমাদের কাছে দিয়ে যাচ্ছি।” জুবাইয়ের সাহেব অরুণিকাকে ঘাসের উপর নামিয়ে রাখলেন। মুখ উঠিয়ে দেখলেন, তার ক্লান্ত মেয়ে বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি ঘাসের উপরই অরুণিকাকে শুইয়ে দিয়ে বললেন, “আমাদের শত্রু আমাদের চোখের সামনেই ছিল। আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তোমরাই এখন নিজেদের অভিভাবক। আর তোমাদের দায়িত্ব আমার মেয়ের অভিভাবক হওয়ার। ওকে একা ছাড়বে না। সারাজীবন ওকে আগলে রাখবে। আমার এই একটা আবদার রাখো!” কথাটি বলে তিনি অরুণিকার কপালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আরাফ সাথে সাথে বলে উঠলো, “চাচ্চু, আমরা আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই?” জুবাইয়ের সাহেব বললেন, “আমি সেখানেই যাচ্ছি। কিন্তু একা একাই যাবো। আমি নিশ্চিত ওদের কেউ এখনো বাইরে আছে। যদি থাকে, আমাকে গুলি করে দেবে। আর যদি না থাকে আমি হয়তো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবো। পৌঁছে গেলেও বাঁচবো কিনা সন্দেহ। তোমরা পেছনের গেইট দিয়ে মেইন রোডে উঠবে। সেখান থেকে আমবাগান চলে যাবে। বাকীটা তোমরা বুঝে নিতে পারবে। আর এখনি বেরিয়ে যাও।” জুবাইয়ের সাহেবের অনুমান ঠিকই হলো। মুখোশধারী চার জন লোক বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের ধারণা কেউ যদি বেঁচে থাকে, তাহলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাড়ি থেকে বের হবে। আর নয়তো আগুনে পুড়েই মারা যাবে। আর তারা যেভাবে সবাইকে আঘাত করে এসেছে, রক্তক্ষরণ হয়েই কয়েকঘন্টার মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। তাই কেউ বেঁচে থাকলে মেইন গেইট দিয়ে বের হয়ে অবশ্যই হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করবে, আর সেই সুযোগে তাকেও মেরে ফেলা যাবে। ৩. পর পর চারবার গুলির শব্দ ভেসে আসতেই অরুণিকা কেঁপে উঠলো। চোখ খুলে দেখলো সে এখনো কোলে আছে। চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই কোল তো তার বাবার কোল না! সে ভয় পেয়ে গেলো। আরো শক্ত করে সেই মানুষটিকে চেপে ধরলো। যদি বাবা হয়, তাহলে বুঝবে অরুণিকা ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এই মানুষটা তো থামছে না। দৌঁড়াচ্ছে তো দৌঁড়াচ্ছেই। পেছনের গেইটটি তালা দিয়ে বন্ধ করা। বাইরে অনেক কাঁটাতার। তবে গেইট টপকে বের হওয়ার অভ্যাস তাদের আছে। কিন্তু অরুণিকাকে নিয়ে কিভাবে গেইট দিয়ে বের হবে? ইভান, ইমন আর তূর্য গেইট টপকে সাবধানে নেমে পড়লো। অপর পাশ থেকে কাঁটাতারের কিছু অংশ সরালো। এবার তাহমিদ বলল, “অরুকে উঠিয়ে এদিক থেকে ফেলে দেবো। ইভান আর ইমন ধরে ফেলবে।” তূর্য বলল, “ও যদি ব্যথা পায়?” আরাফ খুব আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলল, “আমি আছি তো! কিচ্ছু হবে না।” আরাফ তার কোল থেকে অরুণিকাকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি তোমাকে উঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি উপর থেকে লাফ দেবে।” অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর আশেপাশে তাকাতে লাগলো। কিন্তু কিছু বললো না। পাশে আহনাফকে দেখে ভয়ে তার মুখ ছোট হয়ে গেছে। আহনাফ তাকে উঠতে বসতে ভয় দেখায়। সে মনে মনে ভাবছে, আহনাফই হয়তো এসব করেছে। এটা হয়তো তাকে ভয় দেখানোর জন্য আহনাফের নতুন ফন্দি। অরুণিকার চলনবলন না দেখে আহনাফ এবার বিরক্ত হয়ে বলল, “উঠবা তুমি, নাকি ছুঁড়ে মারবো?” অরুণিকা আরাফের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজেকে আহনাফ থেকে আড়াল করে রাখলো। ইভান ওপাশ থেকে বিরক্ত হয়ে বলল, “ভাই, প্রচন্ড ভয় লাগছে। এখন এই মেয়ের জন্য আমরা বিপদে পড়বো। ওকে তাড়াতাড়ি তুলে এদিকে আন। ওরা যদি আবার এদিকে চলে আসে?” আরাফ এবার অরুণিকা কোলে করে গেইটের ওপারে নিয়ে এলো। ব্যথায় সে আর হাত নাড়াতে পারছে না। কাঁটাতারের কিছু অংশ তার হাতে ঢুকেছে। রক্তও বেরুচ্ছে হয়তো। কিন্তু এই মুহূর্তে এতোকিছু দেখার সময় নেই। সবাই গেইট টপকানোর পর তারগুলো গেইটের সামনে দিয়ে তূর্য ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তারের উপর ঢেলে দিলো। তূর্যকে পানি ঢালতে দেখে তাহমিদ বলল, “এটা তার, কোনো গাছ না!” “হ্যাঁ, আমি জানি। আরাফের হাত থেকে রক্ত পড়ছে। ওরা যদি এদিকে এসে রক্ত দেখে, ভাববে কেউ পালানোর চেষ্টা করেছে। তাই পানি ঢেলে দিলাম।” তারা পেছন দিয়ে এসে বড় বড় গাছ পেরিয়ে সামনে যেতে লাগলো। আর পেছন থেকে তারা তাদের যার যার বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো। আগুনের ধোঁয়ায় আকাশ লালচে হয়ে গেছে। অথচ কেউ আগুন নেভাতে আসে নি। পান থেকে চুন কষতেই যেখানে মিডিয়ার লোক এসে জড়ো হয়, সেই রাস্তায় একটা মানুষও নেই। তাহলে সবাই কি তাদের ভুলে গেছে? মৈত্রী গ্রুপকে নৃশংসভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এতো বড়ো সাহস কার হয়েছে? আর সাধারণ মানুষ, যারা তাদের ভালোবাসতো, তারা আজ সেই ভালোবাসা কোথায় হারিয়ে ফেলেছে? তারা এতোগুলো মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করছে না কেন? ছ’জন পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে আর তাদের কোলে চার বছর বয়সী অরুণিকা। তারা ছুটে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। এই পৃথিবীতে বাবা-মা বা কোনো অভিভাবক ছাড়া বড় হওয়া সহজ নয়। অনেক জটিল ব্যাপার। আর সেই জটিলতার পথে পা বাড়াচ্ছে সাতটি জীবন। চলবে– #অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-০১|| (কেমন লাগলো কিন্তু)#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০২||

০৪.
বাস স্টেশনের বেঞ্চের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে অরুণিকা। তার পাশে বসে নিরবে চোখের পানি ফেলছে ইমন। অরুণিকা ইমনকে কাঁদতে দেখে মাথা নামিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন কিছুটা বিরক্ত হয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে জিজ্ঞেস করলো,
“এভাবে হাঁ করে কি দেখছো!”

অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। ইমন এবার অরুণিকার মাথার এলোমেলো চুলগুলো আঙ্গুল চালিয়ে ঠিক করে বলল,
“তুমি তো তখন বাসায় ছিলে, তুমি কি কাউকে দেখেছো? ওদের কাউকে চেনো?”

অরুণিকা ইমনের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। সে ইমনের প্রশ্ন শুনে এতোটুকু বুঝলো, ইমন এখন তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী। তাই সে ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা কোথায়?”

ইমন এই প্রশ্ন শুনে আবার ভেঙে পড়লো। তার চোখের কোণে অশ্রু ভীড় জমিয়েছে। সে ঠোঁট চেপে বলল,
“একটা রাক্ষস এসে সবাইকে খেয়ে ফেলেছে।”

অরুণিকা ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবাকেও খেয়ে ফেলেছে?”

“হ্যাঁ।”

অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইলো। এখনি হয়তো কেঁদে দেবে। আরাফ দূর থেকে অরুণিকার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে তার দিকে এগিয়ে এসে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। আর জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? ক্ষিধে পেয়েছে?”

অরুণিকা ইমনকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“ও বলছে বাবাকে রাক্ষস খেয়ে ফেলেছে। আমি বাবার কাছে যাবো।”

আরাফ ইমনের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এসব ওকে কেন বলছিস!”

ইমন বিরক্ত হয়ে বলল,
“ও ভেতরে কেন বসে ছিল? ও কাউকে দেখেই নি। এখন আমরা কিভাবে বুঝবো আমাদের পরিবারকে কে হত্যা করেছে? ভাই, আমরা অনাথ হয়ে গেছি। এভাবে কেউ এসে আমাদের জীবনটা ধ্বংস করে দিলো! এভাবে কাউকে মেরে ফেলা কি এতো সহজ! বাড়ির বাইরে এতো গার্ড? ওরা কি ঘুমাচ্ছিল? এখন আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়, বল?”

“তুই শান্ত হবি? শুন, অরুকে আর কখনো ওমন কথা বলবি না।”

ইমন বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই বুঝা তোর অরুকে।”

ইমন হনহন করে উঠে চলে গেলো। অরুণিকা ফুঁপিয়ে উঠলো। বলতে লাগলো,
“বাবাকে কি সত্যিই রাক্ষস খেয়ে ফেলেছে?”

আরাফ অরুণিকার দুই গালে দু’হাত রেখে বলল,
“না, চাচ্চু বাসায় আছে।”

“বাবা, এখানে আসে নি কেন?”

“চাচ্চু একটু অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে বিশ্রাম নিতে।”

“মা কোথায়?”

“চাচী তো চাচ্চুর সাথেই আছে।”

“আর ওই লোকটা চাচীকে ওভাবে কেন মেরেছে?”

আহনাফ দূরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল। অরুণিকার প্রশ্ন শুনে সে দৌঁড়ে এগিয়ে এলো। ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি দেখেছো লোকটাকে?”

“হ্যাঁ। চাচীকে মেরেছে।”

“কি করেছে?”

“বন্দুক দিয়ে ডিসুম ডিসুম করে মেরেছে। চাচী অনেক কেঁদেছে।”

আহনাফ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বেঞ্চের উপর কয়েকবার জোরে আঘাত করে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“আমি ওদের সবকটাকে মেরে ফেলবো। আমি কাউকে ছাড়বো না।”

আরাফ বলল,
“ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। হয়তো আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন এই হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। কিন্তু এটা এখন সম্ভব না। আমরা জানি না ওরা কারা? কেনই বা এভাবে সবাইকে মেরেছে? বাবা বলেছিল, আমাদের অনেক শত্রু। কিন্তু শত্রু এতো জঘন্য হয়! এতো নিকৃষ্ট হয়! তাদের একটুও মায়া হয় নি? দিশান, ওর তো মাত্র ২ বছর। ওকেও কি মেরে ফেলেছে? ছোট চাচী প্রেগন্যান্ট ছিল। উনাকেও মেরে ফেলেছে? তাহমিদের দাদী প্যারালাইজড, উনাকে দেখেও কি মায়া হয় নি?”

তূর্য আরাফ আর আহনাফের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“এখন রহমত চাচা আমাদের আজ রাতের বাসেই সিলেট চলে যেতে বলছেন। এখানে থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমে যদি জানতে পারে, আমরা স্কুল থেকে পিকনিকে গিয়েছি, ওরা বুঝবে আমরা বেঁচে আছি। রহমত চাচা বলছেন, ওরা তদন্ত করলে করতেও পারে। আবার নাও করতে পারে। আর তদন্ত করলে স্কুল থেকে আমাদের ছবি পাওয়া যাবে। তখন আমরা সবাই শেষ।”

পেছন থেকে রহমত সাহেব তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। রহমত সাহেবকে এদিকে আসতে দেখে ইভান, ইমন ও তাহমিদও সেদিকে এগিয়ে এলো। রহমত সাহেব বললেন,
“তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করো। আমি মৈত্রী গ্রুপের সবাইকে চিনি। তোমাদের বাবারা অনেক বছর আগে আমাকে অনেক বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। আরাফের বাবা, আরহাম চৌধুরী আমার মায়ের চিকিৎসার পুরো টাকা দিয়েছিলেন। আমার ছেলেটা এক্সিডেন্টে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল, তাকে দুই পায়ে দাঁড় করাতে সাহায্য করেছিল তাহমিদের বাবা, আলিম হোসেন সাহেব। আমি তাদের প্রতি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমি তোমাদের এলাকার একজন পাহারাদার থেকেই খবর পেয়েছিলাম, তোমাদের বাড়ির কিছু পাহারাদার, মৈত্রী গ্রুপের সাথে সংযুক্ত কিছু কর্মচারী, আর দু’একজন বিশ্বস্ত মানুষ এই ষড়যন্ত্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সাহায্য করেছে। এটা আজ সকালেই আমাকে তোমাদের এলাকার সেই পাহারাদার জানিয়েছে। সে বলেছে তারও হয়তো বাঁচার সম্ভাবনা নেই। আমি তার সাথে আর যোগাযোগ করি নি। আজ সন্ধ্যায় জুবাইয়ের সাহেব আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন, তাদের উপর যেকোনো সময় হামলা হতে পারে। তাদের পালানোর সব রাস্তা বন্ধ। তবুও আমাকে বলেছে এখানে অপেক্ষা করতে। তোমরা বাইরে ছিলে এটা আমি জানতাম। কিন্তু কোথায় ছিলে এটা জানা সম্ভব হয় নি। তোমাদের উপর সৃষ্টিকর্তার রহমত ছিল, তাই তোমরা ওদের সামনে পড়ো নি। এখন আমার দায়িত্ব তোমাদের নিরাপদ স্থানে পাঠানোর। এই ঘটনা যতোদিন শিথিল হবে না তোমাদের সিলেটে থাকতে হবে। এরপর সুযোগ বুঝে তোমাদের ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেবো।”

তাহমিদ অবাক হয়ে বলল,
“আমরা ইন্ডিয়া কেন যাবো? এখানে কেন থাকবো না?”

“তোমাদের এখন নিজেদের তৈরী করতে হবে। তোমরা কি চাও না সেই খুনীদের শাস্তি হোক?”

“অবশ্যই চাই।”

“তাহলে এখন আগে নিজেদের বাঁচাও।”

ইভান বলল,
“কিন্তু আমাদের সাথে তো পাসপোর্ট নেই?”

“ওটা হয়ে যাবে।”

ইমন বলে উঠলো,
“কিন্তু আমাদের কাছে তো কোনো টাকা নেই!”

“টাকার চিন্তা করো না। আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমাদের পড়াশুনা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবো। হয়তো আমার এতো সামর্থ্য নেই। তাই আগে থেকেই বলে দিচ্ছি, তোমাদেরও অনেক কষ্ট করতে হবে। তোমরা যেই পরিবেশে বড় হয়েছ, সেই পরিবেশ সামনে আর পাবে না। যদিও তোমাদের একাউন্টে হয়তো অনেক টাকা জমা আছে। কিন্তু এসব তুলতে গেলে তোমাদেরই ক্ষতি হবে। তাই আপতত তোমরা একটু কষ্ট করো।”

আহনাফ বলল,
“এখন তাহলে আমরা সিলেট যাচ্ছি! কিন্তু ইন্ডিয়ায় তো আমরা কিছুই চিনি না।”

“ওখানে আমার এক আত্নীয় আছে। তোমাদের এতো চিন্তা করতে হবে না।”

০৫.
টিকেট কেটে আমবাগান থেকে সিলেট গামী বাসে উঠে পড়লো সাতজন। সাথে ছিল রহমত সাহেব। অরুণিকা বসেছিল আরাফের পাশে। এই প্রথম সে বাসে উঠেছে। একদিন বাবা তার জন্য খেলনার বাস কিনে এনেছিল, আর আজ সে এতো বড় বাস দেখছে। কারণ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে তাকে বের হতে হয় নি। তার বাবা-চাচারা যশস্বী ব্যক্তিত্ব। তাদেরই বাসা থেকে বের হতে বডিগার্ড প্রয়োজন। আর বাড়ির বাইরে খেলার ব্যবস্থা আছে, ডাক্তারের প্রয়োজন হলে বাড়িতেই চলে আসে, শপিংমলেও যাওয়ার প্রয়োজন হয় নি, সবকিছু অনলাইনে হয়ে যায়। তাই সে চার বছরে শুধু একবার বাবার সাথে ঢাকায় গিয়েছিল, আর অনেক ছোট বয়সে দেশের বাইরে গিয়েছিল। তার তো সেটাও মনে নেই। কিন্তু আজ সে অনেকদিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে। তাই সে খুব উৎসুক। অরুণিকা জানে না, সে কি হারিয়ে ফেলেছে। তার তো এখনো বোঝার বয়স হয় নি। বুঝতে পারলে কি তার কান্না থামিয়ে রাখা যেতো?

অরুণিকার বাবারা চার ভাই ছিলেন। বাবা-মা, চাচা-চাচী, দাদা-দাদীদের নিয়েই তাদের বড় পরিবার।

অরুণিকার দাদা কবির চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার ছিলেন। তবে তার ছেলেরা পড়াশুনা শেষ করে ব্যবসায় মনোযোগ দেয়। আরাফ চৌধুরী তারই বড় ছেলে আরহাম চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। আরাফের মা তাকে জন্ম দেওয়ার তিন বছর পর মারা যান। অরুণিকার বাবা জুবাইয়ের করিম চৌধুরী তার দাদা-দাদীর মেঝ ছেলে। অরুণিকার বড় ভাই জিহান চৌধুরী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলো। এক সপ্তাহ আগেই সে ছুটিতে বাড়িতে ফিরেছিল। হয়তো মৃত্যুই তাকে ডেকে এনেছিল। অরুণিকার ছোট ভাই জিসান চৌধুরী এই বছর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সেও ট্রেনিং শেষে বাসায় ফিরেছিল। আহনাফ চৌধুরী অরুণিকার সেজো চাচা আনিস চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। আর তাদের ছোট চাচা জামান চৌধুরীর ঘরে ছিল দুই বছর বয়সী ছেলে দিশান। আর খুব শীঘ্রই হয়তো দিশানের কোনো ভাই-বোন আসতো। কিন্তু ছোট্ট শিশুটি আর পৃথিবীর আলো দেখতে পেলো না।

ইমতিয়াজ মাহবুব ও তার স্ত্রীর তিন সন্তান। ইশিতা, ইভান আর ইমন। আর তাদের এই ছোট পরিবার তাদের দাদাকে নিয়েই ছিল।

তাহমিদ হোসেন তার বাবা-মায়ের ছোট ছেলে। আর তার বড় দুই ভাই মৈত্রী গ্রুপের সাথে সংযুক্ত ছিলো। তাহমিদের দাদী প্যারালাইজড রোগী ছিলেন। আর তার দাদা ছিলেন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।

অরুণিকার বাবার খুব কাছের বন্ধু হাকিম আহমেদের বড় ছেলে তূর্য আহমেদ। তূর্যের তেরো বছর বয়সী ছোট বোন ছিল।

তারা সবাই একই এলাকায় থাকতো। তাদের বাড়িও ছিল পাশাপাশি। তাছাড়া তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও সেই এলাকায় থাকতো। সেই এলাকার মোট আশি-নব্বই জন মানুষ একরাতেই নিঃশেষ হয়ে গেলো।

তাদের বাবাদের মতো তারা ছ’জন ও খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু বন্ধুরা কি একে অপরের অভিভাবক হতে পারে?

অরুণিকা অন্ধকারে বাসের বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাসে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু অরুণিকার ঘুম আসছে না। রাতে মাকে ছাড়া তার ঘুম আসে না। এখন তো মাও পাশে নেই। যখন সেই বন্দুকধারী মানুষগুলো বাসায় ঢোকার চেষ্টা করছিল, তখনই তার বাবা তাকে রান্নাঘরের কেবিনেটে লুকিয়ে রেখেছিল। এরপর সে শুধু সেজো চাচীকেই দেখেছে। অরুণিকা বাসের সিটে পা তুলে বসে রইলো। মশা তার পায়ে কামড় দিয়েছে, এটা নিয়েই সে চুপচাপ গবেষণা করতে লাগলো। নিজে নিজেই পায়ে ফুঁ দিচ্ছে। আর কানে হাত দিয়ে ফোনে কথা বলার ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বলছে,
“বাবা, দেখো আমাকে মশা কামড়াচ্ছে। তুমি আমাকে মশার স্প্রে দাও নি কেন? হ্যালো, বাবা। তুমি সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে এসো।”

অরুণিকার কন্ঠ শুনে আরাফের ঘুম ভেঙে গেলো। সে চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে তোমার?”

“আরাফ, আমি বাবার সাথে ফোনে কথা বলছি, দেখছো না? বাবাকে বলছি এখানে অনেক মশা।”

আরাফ সিটের উপর থেকে তার ব্যাগটা নামিয়ে তার পরণের একটা টি-শার্ট বের করে সেটা দিয়েই অরুণিকাকে ঢেকে দিলো। অরুণিকার চাদরটা গায়ে দিয়ে আহনাফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাই আরাফ আর তাকে ডাকলো না। আরাফ সিটে বসতেই অরুণিকা বলল,
“আমি চিচি করবো।”

অরুণিকার কথা শুনেই আরাফ চুপসে গেলো। সে জানালা খুলে আশেপাশে দেখতে লাগলো। তারা এখন মহা সড়কে। এখানে আশেপাশে কোনো টয়লেটও নেই। আরাফ রহমত সাহেবকে ডেকে বলতেই তিনি বাস দাঁড় করালেন। আরাফ বাস থেকে নামতেই রহমত চাচা একটা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“ওদিকটাই নিয়ে যাও।”

অরুণিকা অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। আরাফ অরুণিকাকে পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার হয়ে গেলে আমাকে ডাক দিও। আমি ওদিকে দাঁড়াচ্ছি।”

“বাথরুম কোথায়?”

“আমি এখানে বাথরুম কোথায় পাবো?”

অরুণিকা অন্ধকারে একা দাঁড়াচ্ছিলো না। সে কেঁদেই ফেলল। শেষমেশ রহমত চাচা বাস থেকে একজন মহিলা যাত্রীকে ডেকে আনলেন। মহিলা যাত্রীটির একটু সন্দেহ হলো। তিনি অরুণিকাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার বাবা-মা কোথায়?”

“বাবা ডাক্তারের কাছে গেছে। মা বাবার সাথে আছে।”

“তুমি এদের চেনো?”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “হুম।”

এরপর আরাফকে দেখিয়ে বলল, “ওই যে আরাফ।”

মহিলাটি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“ও কে হয় তোমার?”

“ভাইয়া!”

মহিলাটি ভাবলো হয়তো ভাইয়ের সাথেই যাচ্ছে। তিনি আর প্রশ্ন করলেন না। তার সন্দেহ না কাটলেও তিনি মাথা ঘামালেন না। অন্যের সন্তান, তার কিই বা যায় আসে!
মহিলাটি বাসে উঠার সময় আরাফ তাকে ধন্যবাদ জানালো। এরপর বাস আবার চলতে শুরু করলো। এবার অরুণিকা ঘুমিয়ে গেছে। তার ঘুম ভাঙলো সকালে। ঘুম থেকে উঠেই দেখলো সে আরাফের কোলে। আর সবাই ব্যাগপত্র নিয়ে কাঁদা মাখা রাস্তায় হাঁটছে। অরুণিকা আশেপাশে দেখতে লাগলো। আরাফ আহনাফকে বলল,
“এবার তুই ওকে নে। আমার হাত ব্যথা করছে।”

আহনাফ জোর গলায় বলল,
“না, আমি নিজেই হাঁটতে পারছি না। ওকে নিলে আমিই ধপাস করে পড়বো।”

রহমত চাচা বললেন,
“আমাকে দাও।”

অরুণিকা রহমত সাহেবকে আগে কখনোই দেখে নি। তাই সে তার কোলে না উঠার জন্য টুপ করে চোখ বন্ধ করে আরাফের কাঁধে মাথা ফেলে দিলো। ইভান তা দেখে বলল,
“ওকেও হাঁটা। তখন মজা বুঝবে।”

তূর্য ইভানের কথা শুনে বলল,
“ভাই, বাচ্চা মেয়ে। এমন করে বলছিস কেন?”

অরুণিকা চোখ খিঁচে আছে। তার চোখ দেখে রহমত সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোমরাই ওর খেয়াল রাখতে পারবে৷ তোমরাই পারবে ওর দায়িত্ব নিতে।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here