অরুণিকা পর্ব – ২০+২১+২২

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২০||

৩৬.
তূর্যের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে অরুণিকা। তূর্যও চুপচাপ মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। বাকীরা একবার অরুণিকাকে দেখছে, আরেকবার তূর্যকে।

তূর্যের গিটার নিয়ে খেলতে গিয়ে অরুণিকা গিটারের সব তার ছিঁড়ে ফেলেছে। তাই তূর্য তাকে অনেক বকা দিয়েছে। এর আগে অরুণিকা কখনো তূর্যের বকা খায় নি। আর তূর্যও তার টুইংকেলকে ধমক দিয়ে কিছুই বলে নি। তাই অরুণিকা তূর্যের সাথে অভিমান করে বসে আছে। কিন্তু তূর্য তার অভিমান ভাঙাতে যায় নি।

অরুণিকা আরাফের কাছে গিয়ে বলল,
“আরাফ, আমি রকস্টারের সাথে কথা বলবো না। ও আমাকে বকা দিয়েছে।”

আরাফ বলল,
“তোমাকে বারণ করার পরও তুমি গিটার নিয়ে কেন খেলছিলে?”

অরুণিকা চুপ করে রইলো। এবার ইভান বলল,
“এই মেয়ে কি এক মিনিটও শান্ত হয়ে বসে থাকে? সারাদিন এটা ওটা নিয়ে গুঁতোগুঁতি করবে। ব্যস এখন সবগুলো তারই ছিঁড়ে ফেলেছে। এই মেয়ে কি জানে ও শুধু তূর্যের স্বপ্ন নষ্ট করে নি, নিজের ভবিষ্যতও শেষ করে দিয়েছে। তূর্য যা টাকা পায়, সব ওর পেছনেই তো খরচ করে।”

আহনাফ চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
“চুপ। একদম চুপ।”

আহনাফের চিৎকারে ইভান চুপ হয়ে গেল। বাকীরা অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ বলল,
“খোঁচা দিচ্ছিস? এই কথা বারবার বলার কোনো প্রয়োজন আছে? অরুর খরচ তূর্য দিচ্ছে এইটা বলে কি বোঝাতে চাচ্ছিস?”

ইভান শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি এমন কিছু বোঝাতে চাই নি।”

“গিটারের তার আবার লাগানো যাবে। আমি না হয় লাগিয়ে দেবো।”

তূর্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। গিটারটা নিয়ে বাইরে চলে গেলো। অরুণিকা আরাফের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলো।

আরাফ অরুণিকার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “অরু, কিছু হবে না।”

অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে গেলো।

সেদিনই তূর্য আবার গিটারের তার লাগিয়ে নিলো। কিন্তু বাসায় আসার পর সে অরুণিকার দিকে একবারো তাকালো না। অরুণিকাও তূর্যের কাছে যাচ্ছে নি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পর তূর্যের দিকে তাকাচ্ছে।
পরের দিন সকালে অরুণিকা স্কুলের জামা পরে গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। আরাফ তৈরী হয়ে এলেই তারা বের হবে। তখন তূর্য গিটার কাঁধে নিয়ে বাসা থেকে বের হতেই অরুণিকার মুখোমুখি হলো। অরুণিকা তূর্যকে দেখে একপাশে সরে দাঁড়ালো। তূর্যও কোনো কথা না বলে চলে গেলো। যতোক্ষণ তূর্যকে দেখা যাচ্ছিলো অরুণিকা ততোক্ষণই সেদিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তূর্য একবারো পেছনে ফিরে তাকালো না।

স্কুলে যাওয়ার সময় রিকশায় বসে অরুণিকা আরাফকে বলল,
“আরাফ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হ্যাঁ, করো।”

“আমাদের বাবা-মা কোথায়?”

আরাফ একবার অরুণিকার দিকে তাকালো। তারপর চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল,
“আমাদের বাবা-মা নেই।”

“সবার তো বাবা-মা আছে।”

“কিন্তু তোমার জন্য আমরা আছি।”

“কিন্তু রকস্টার আমাকে ভালোবাসে না?”

“আমি তো ভালোবাসি।”

“ইভানও আমাকে ভালোবাসে না। সবাই আমাকে বকা দেয়। তুমিও বকা দাও। বাবা-মা থাকলে বকতো না।”

“কে বলেছে বকতো না?”

“আমার বন্ধুদের তো বকে না।”

“বকে। সবাইকেই বকে।”

আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“যখন ইমন ছোট ছিল তখন সন্ধ্যায় দেরীতে বাসায় ফিরলে মা কান টেনে দিতো। এখন সেই কান ইভান টেনে দেয়। যখন তূর্য ভাত খেতে চাইতো না, মা এক ধমক দিয়ে তাকে ভাত খাওয়ানোর জন্য ডায়নিংয়ে বসাতো। আর এখন তাহমিদ অরুকে ধমক দিয়ে খেতে বসায়। আহনাফ একটুও পড়তে চাইতো না। মা বকা দিয়ে পড়তে বসাতো। এখন ইভান তোমাকে আর তূর্যকে বকা দিয়ে পড়তে বসায়। মা নেই তো কি হয়েছে? ইভান আর তাহমিদ আছে, আহনাফ আছে, ইমন, তূর্য আর আমি আছি। আর আমাদের সাথে অরুণিকা আছে। আমরা সবাই একজন আরেকজনের জন্য আছি।”

“বাবা-মা কি আর কখনো আসবে না?”

“না। ওরা চলে গেছে। আমাদের বলে গেছে একসাথে থাকার জন্য। সবার বাবা-মা থাকে না, অরু। কিন্তু কেউ না কেউ থাকেই। সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনো আপনজন তার কাছ নিয়ে আসে। হয়তো কোনো নামের সম্পর্ক, হয়তো বা আত্মার।”

“আরাফ, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।”

আরাফ হেসে অরুণিকাকে বলল,
“বাসায় গিয়ে তোমার রকস্টারকে সরি বলবে, ঠিক আছে? তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

অরুণিকা স্কুল থেকে ফেরার পর খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লো। ইভান তা দেখেই বলল,
“আজ নিজ থেকেই পড়তে বসেছো। বাহ, গুড গার্ল।”

অরুণিকা ইশারায় ইভানকে চুপ থাকতে বললো। এরপর তূর্য বাসায় আসার পর অরুণিকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা একটা চিরকুট এগিয়ে দিলো। তূর্য অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে চিরকুটটি নিলো। অরুণিকা তার দুই কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। তূর্য অরুণিকার দিকে অবাক হয়ে তাকাতে তাকাতেই চিরকুটটি খুললো। চিরকুটে কাঁচা হাতে ইংরেজি অক্ষরে লেখা সরি। পাশে কাঁচা হাতে আঁকা ফুল আর হাসির চিহ্ন। তূর্য চিরকুটটি দেখে চোখ বন্ধ করলো।

অরুণিকা বলল,
“সরি, রকস্টার। আমি আর তোমার গিটার ধরবো না।”

তূর্য চোখ খুলে অরুণিকার হাত দু’টি তার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে বলল,
“সরি টুইংকেল। আমার অনেক রাগ উঠে গিয়েছিল, তাই বকা দিয়ে ফেলেছি। পরে অনেক কষ্ট লাগছিলো, কিন্তু কিভাবে তোমার অভিমান ভাঙাবো বুঝতেই পারছিলাম না। তুমি কি এখনো রাগ করে আছো আমার সাথে?”

“না, আমি কেন রাগ করবো বলো? রকস্টার, তুমি কি রাগ করেছো আমার সাথে?”

“না, একদমই না। আই লাভ ইউ মাই টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার।”

অরুণিকা তূর্যকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। তূর্য অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শেষমেশ একদিন পর তাদের মান-অভিমান ভাঙলো। বাকী পাঁচজন তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

এরপর তূর্য ইভানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোরা পাঁচজন আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমি আমার পরিবার হারানোর আগে থেকেই তোদের পেয়েছি। তোরা এখনো আছিস। তোরা সবাই আমার প্রেরণা। কিন্তু বাবা-মাকে হারানোর পর টুইংকেলকে পেয়েছি। হয়তো আল্লাহ ওকে দিয়ে আমার কষ্টটা হালকা কমিয়ে দিয়েছিলো। এর আগে টুইংকেল আমার জন্য কিছুই ছিল না। তাই এই কথা কেউ বলিস না যে আমি টুইংকেলের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছি। আমার স্বপ্নের একটা অংশ আমার টুইংকেল। আমরা সবাই এক। ওর খরচ আমি দেই, আরাফ দিক একই কথা। আমি ওর আপন ভাই না। আমি নিজেও ওকে কখনো আমার বোন বলবো না। কিন্তু আমার কাছে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আত্মার সম্পর্ক। টুইংকেলের সাথে আমার একটাই সম্পর্ক, আর সেটা হলো আত্মার। আমি হাজার বার বলবো, আমি ওর ভাই না। আমি চাই না ওর ভাই হতে। কিন্তু একটা ভাই যেই দায়িত্ব নিতে পারে না, তার সব দায়িত্ব আমি নিবো।”

আরাফ তূর্যকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আহনাফের চোখ ছলছল করছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। তাহমিদ আর ইমনের ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। ইভান মাথা নিচু করে বলল,
“অরুণিকা আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমি কাউকে বলবো না। রাগের মাথায় মানুষ অনেক কিছুই বলে ফেলে। মাও আমাকে আর ইমনকে কতো কিছু বলতো।”

এবার ইমন বলল,
“জানি ভাই, তুই কাকে কতোটা ভালোবাসিস। তোর আর আহনাফের সমস্যা এক জায়গায়। ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পারিস না। আর হুটহাট রেগে যাস।”

ইভান অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা তার ড্রয়িং খাতা উল্টেপাল্টে দেখছে। ইভান তার পাশে বসে বলল, “পড়বে না?”

অরুণিকা আরাফের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আজ না পড়ি?”

ইভান হেসে বলল,
“আচ্ছা। কালকে তো ছুটি। এখন খেলো।”

৩৭.

আহনাফ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। যতি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বাকিরা অবাক হয়ে তামাশা দেখছে। তাদের সাথে বসে অরুণিকাও সেই তামাশা দেখায় সঙ্গ দিচ্ছে। আহনাফ যতিকে বলল,
“দাঁড়াও প্লিজ। এভাবে আমার পায়ের সামনে বসে থেকো না।”

যতি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কেন বুঝতে পারছো না?”

“তোমার মতো ন্যাকাবোকা মেয়ের সাথে আমি সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছুক নই।”

“আমি ন্যাকাবোকা?”

আহনাফ বিরক্ত হয়ে বলল,
“এটা কেমন অভ্যাস! কিছু হলেই পায়ে ধরে ফেলো। তোমার কি কোনো ব্যক্তিত্ববোধ নেই? এতোগুলো ছেলের সামনেও তোমার এসব পাগলামো বন্ধ হচ্ছে না!”

তূর্য বলল,
“ভাই, মেয়েটা তোকে ভালোবাসে। সম্পর্কে গেলে সমস্যা কোথায়?”

আহনাফ চোখ বড় বড় করে তূর্যের দিকে তাকালো। এবার ইমন বলল,
“মেনেই নে, ভাই। কতো মাস ধরে তোর পেছনে পড়ে আছে!”

তাহমিদ বলল,
“হয়তো যতি তোকে সত্যিই ভালোবাসে।”

আহনাফ চেঁচিয়ে বললো,
“ভালোবাসে না। পাগল হয়ে গেছে। আর আমি ওর পাগলামোগুলো নিতে পারছি না।”

আহনাফ ধাক্কা দিয়ে যতিকে ঘর থেকে বের করে দিলো। ইভান বলল,
“আমি বুঝি না এই মেয়েগুলোর সমস্যা কি!”

ইমন বলল,
“তুই বুঝবি না, ভাই। এগুলোকে ভালোবাসা বলে। যতি আহনাফকে অনেক ভালোবাসে। আমি ওর অনুভূতিটা বুঝতে পারছি।”

এবার আরাফ বলল,
“যতি একা ভালোবাসলে কি হবে? আহনাফ ওকে ভালোবাসে না। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তোদের জোরাজুরিতেই আহনাফ ওর সাথে বন্ধুত্ব করেছে। আর তোরা যতির সামনে আহনাফের বিরুদ্ধে কেন ছিলি? এখন মেয়েটা আরো সাহস পেয়ে যাবে।”

ইভান বলল,
“ভাই এই মেয়ের যন্ত্রণাগুলো আর নিতে পারছি না। আহনাফ, তুই বরং একবার সম্পর্কটা শুরুই করে দেখ। ভালো না লাগলে বের হয়ে আসবি।”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“শুধু বন্ধুত্ব করেছি, তাতেই দিনে একশো বার ফোন দিয়ে আমার মাথাটা নষ্ট করে ফেলে, যখন তখন ভিডিও কল দেয়। এখনই চাচা-চাচী, মহল্লার অনেকে ধরেই নিয়েছে ও আমার গার্লফ্রেন্ড। সম্পর্কে গেলে সবাই ভাববে একেবারে বিয়েই করে ফেলেছি।”

পুরো রাত ইমন আর তূর্যের অদ্ভুত সব ভালোবাসার যুক্তি, তাহমিদ আর ইভানেরও সেই যুক্তিকে সমর্থন করা আহনাফকে যতির সাথে সম্পর্কে যাওয়ার ব্যাপারে একপ্রকার বাধ্য করে দিয়েছে। শেষ রাতে সবাই যার যার যুক্তি দেখিয়ে ঘুমোতে গেলো। আহনাফ চুপচাপ উঠে একপাশে দাঁড়ালো। আরাফ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“মাঝে মাঝে আমাদের মন যা চাই, পরিস্থিতি তার অনুকূলে থাকে না। আমি জানি তুই কি চাস।”

আহনাফ আরাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“না, আরাফ। আমি ওসব চিন্তাও করি না। সম্ভব না ওটা।”

“দেখেছিস, তুই বুঝেছিস আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। কারণ আমি যা ভাবছিলাম সেটাই তুই চাস।”

আহনাফ আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ বলল,
“অন্যের দেখানো স্বপ্ন আর নিজের দেখা স্বপ্নের মধ্যে অনেক পার্থক্য।”

আহনাফ অরুণিকার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাঝে মাঝে অন্যের দেখানো স্বপ্নগুলোই নিজের স্বপ্ন হয়ে যায়। তখন আর নিজ থেকে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে না।”

পরের দিন আহনাফ যতিকে হ্যাঁ বলে দেয়। যতি আহনাফের সম্মতি পেয়ে অনেক খুশি হয়। সে এরপরের দিন নিজের হাতে নাস্তা বানিয়ে আহনাফদের বাসায় চলে এলো। সবাইকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। ইভান, তাহমিদ আর আরাফ যতির পাগলামো দেখে একপাশে সরে বসলো। এদিকে অরুণিকা আহনাফের কাছে এসে বলল,
“আহনাফ, ফোনাপু কি এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে?”

যতি আহনাফের বাহু নিজের হাতের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“না, বাবু এখন না। তবে খুব শীঘ্রই।”

আহনাফ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“যেখানে সেখানে গায়ে পড়া উচিত না। এগুলো সুন্দর দেখায় না।”

“যেখানে সেখানে কোথায়? আমরা তো এখন তোমার বাসায়!”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরাফও মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহনাফ কতোটা চাপা স্বভাবের, আর বাস্তবতা মেনে নেওয়ার জন্য সে নিজের অনুভূতি আর ইচ্ছেগুলোকে কিভাবে ত্যাগ কর‍তে পারে, তা আজ আরাফ আরো স্পষ্টভাবে বুঝেছে।

আরাফ মনে মনে বলল,
“এখন কি হচ্ছে আমি জানি না। কিন্তু আমি চাই ভবিষ্যতের সুখটা যাতে আহনাফের নামেই থাকুক।”

এদিকে ভালোবাসার ঢেউ একপাশে আছড়ে পড়তে না পড়তেই অন্যপাশেও এর স্পর্শ দিয়ে গেলো। ইমনের হাস্যকর কথাবার্তা, বড়দের শ্রদ্ধা করা, সবাইকে বিনাবাক্যে সাহায্য করা সায়ন্তনীর মনে দাগ কেটে দিয়েছে। সে হয়তো ইমনকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। কিন্তু ইমনের মনে মাওশিয়াতের বসবাস। আর মাওশিয়াত ডুবে আছে ইভানের ভাবনায়।

তাদের অনুভূতির চতুষ্কোণ একই শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আছে। আর এমন অনুভূতির জন্ম হওয়া একটা সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।

চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২১||

৩৮.
শেক্সপিয়র বলেছিলেন, “একজন ছেলে কখনো একজন মেয়ের বন্ধু হতে পারে না, কারণ এখানে আবেগ আছে, দৈহিক আকাঙ্খা আছে।”
এই কথাটিকে সত্য প্রমাণ করে দিয়েছে মাওশিয়াত আর সায়ন্তনী। সায়ন্তনী তার ভালো লাগার কথা ইমনকে জানানোর সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু মাওশিয়াত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা হওয়ার হোক, সে তার ভালো লাগার কথা ইভানকে জানাবেই।

আজ কলেজের ক্লাস শেষ করে মাওশিয়াত ইভানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাবলো, আজই সব জানিয়ে দেবে। তখনই ইভান মুচকি হেসে তাকে বললো,
“চলো, আজ তোমাকে বাসায় নিয়ে যাই।”

মাওশিয়াত খুশি হয়ে বলল,
“আজ তুমি তোমার বাসায় নিমন্ত্রণ করছো?”

“হ্যাঁ, ইমন তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।”

“শুধু এই জন্য? আর ও তো দেখা করতে চেয়েছে, কিন্তু একবারো যোগাযোগ করে নি।”

“আরেহ, ও উলটো তোমার উপর অভিমান করে বসে আছে।”

“কেন? আমি কি করেছি?”

“ওই যে তুমি ওর সাথে যোগাযোগ করো নি।”

মাওশিয়াত হেসে বললো,
“অভিমানী খেলোয়াড়। আমি তো কারো সাথেই রাখি নি।”

তারপর মাওশিয়াত লাজুক হেসে বলল,
“শুধু তোমার সাথেই আমার সব যোগাযোগ।”

ইভান কথাটি শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এদিকে বাসায় ঢুকেই ইমন মাওশিয়াতকে অরুণিকার সাথে খেলতে দেখে অবাক হলো।

মাওশিয়াত ইমনকে দেখে বলল, “কেমন আছো, ইমন?”

ইমন মাওশিয়াতের সামনে এসে বসলো। আর মাওশিয়াত গালে হাত রেখে বলল,
“তুমি নাকি আমার সাথে অভিমান করেছো?”

ইমন আড়চোখে ইভানের দিকে তাকালো, তারপর বলল,
“তুমি তো একবারো আসো নি এইদিকে। আমি কি তোমার বাসায় যেতে পারবো, বলো? তখন আংকেল-আন্টি কি না কি ভেবে বসে থাকবে!”

মাওশিয়াত হেসে বলল,
“আমার মা অনেক মিশুক মানুষ। আর বাসায় কে আসে না আসে, এসব দেখার মতো সময় বাবার নেই। ভাবছি তোমাদের সবাইকে একদিন বাসায় দাওয়াত করবো। মা, ইভানকেও দেখতে চায়।”

কথাটি বলেই মাওশিয়াত ইভানের দিকে তাকালো। ইমন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“বাকিদের দেখতে চায় না?”

মাওশিয়াত মাথা নেড়ে বলল,
“আরেহ, না। আমি তো ইভানের কথায় মাকে বলেছি। ও তো এখন আমার সাথে একই কলেজেও পড়ছে।”

তখনই তাহমিদ খাবার সাজিয়ে বলল,
“ইমন তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। সবাই খেতে বসো, মাওশিয়াত তুমিও আসো। ব্যাচেলর সংসারের রাঁধুনির রান্না খেয়ে দেখো।”

তূর্য শতাব্দীকেও ডেকে নিয়ে এসেছিলো। শতাব্দী মাওশিয়াতকে বলল,
“মিষ্টিমশাই, মিষ্টি ছাড়া খাবারে ভীষণ ঝালও দেয়। একেবারে মুখ জ্বালিয়ে দেবে।”

অরুণিকা বলল,
“শতু আপু, তাহমিদ তো ইচ্ছে করেই মরিচ বেশি দিয়েছিল..”

তাহমিদ অরুণিকার মুখ চেপে ধরে বলল,
“অরুণিকা, বেশি কথা বলছো তুমি।”

মাওশিয়াত অরুণিকাকে তার কাছে টেনে এনে বলল,
“আমাকে কানে কানে বলো!”

অরুণিকা উঠে জোরে জোরেই বলল,
“শতু আপু ওইদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় তার বন্ধুর সাথে হাসছিলো তাই।”

শতাব্দী অবাক হয়ে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ আমতা-আমতা করে বলল, “মোটেও না।”

ইমন বলল, “আমি বলছি।”

তাহমিদ চোখ গরম করে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলল,
“শতাব্দী, তুমি তোমার ছেলে বন্ধুর সাথে হাসছিলে, এই জন্য সেই মরিচের শাস্তি পাও নি৷ শাস্তি পেয়েছো, তাহমিদকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে এসেছিলে তাই।”

শতাব্দী গোমড়া মুখে তাহমিদকে বললো,
“আমি মায়ের দিব্যি করে বলছি। আমি তোমাকে দেখি নি। হয়তো তোমার মনে হয়েছিল।”

তাহমিদ খাবারের বাটি নিয়ে উঠে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শতাব্দী মনে মনে বলল,
“মিষ্টি মশাই, তুমি বিনা অপরাধে আমাকে শাস্তি দিয়েছ। দাঁড়াও, আমিও তোমাকে ঝাল খাইয়ে ছাড়বো।”

এরপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে শতাব্দী আর মাওশিয়াত বসে অনেক গল্প করলো। আর তাদের গল্প শুনতে লাগলো অরুণিকা। বিকেলে মাওশিয়াত নিজেই সবার জন্য চা বানালো। চায়ের কাপ সবার হাতে দেওয়ার পর মাওশিয়াত ইভানের পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার জন্য আলাদাভাবে বানিয়েছি।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“চা আবার আলাদা হয় কিভাবে?”

“তুমি বুঝবে না।”

মাওশিয়াত মনে মনে হাসলো আর বলল,
“প্রেম দিয়েছি, প্রেম! বোকা ছেলে”

এদিকে ইমন ইভান আর মাওশিয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমনের চোখ অনুসরণ করলো আরাফ আর তাহমিদ। এরপর মাওশিয়াত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইভানের হাত ধরে বলল,
“চলো, আমাকে বাসায় নামিয়ে দেবে!”

ইমন বলে উঠলো,
“আমি নামিয়ে দিয়ে আসি, চলো। সেই সুযোগে তোমার বাসাটাও চিনে নিতে পারবো।”

মাওশিয়াত ইভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে চাইছে ইভান বলুক, সে নিজেই যাবে। কিন্তু ইভান বলল,
“ইমন নামিয়ে দিয়ে আসুক।”

মাওশিয়াত বলল,
“না, না। ও তো মাত্র বাসায় এসেছে। এখন একটু বিশ্রাম নিক।”

ইমন মাওশিয়াতের হাত ধরে তাকে টেনে বাইরে নিয়ে বলল,
“আমি একদম প্রস্তুত।”

মাওশিয়াত ইভানের দিকে এক নজর তাকিয়ে ইমনের সাথে বেরিয়ে পড়লো। পুরো রাস্তা ইমন মাওশিয়াতের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করে গেছে। কিন্তু মাওশিয়াত তেমন কোনো জবাব দেয় নি। ইমন বারবারই দমে যাচ্ছিলো। কিন্তু পরক্ষণেই অন্য বিষয়ে কথা বলে মাওশিয়াতের হাসি দেখার অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু মাওশিয়াতের দৃষ্টি রাস্তার চলন্ত গাড়িগুলোর দিকেই আটকে আছে। ইমন তাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। আজ আমি সেই হাসি দেখার কতো চেষ্টা করেছি, কিন্তু পুরো রাস্তায় তুমি অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলে। কেন মাওশিয়াত?”

মাওশিয়াত ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কোথায়? আমি তো তোমার সব কথা শুনেছি।”

“তাহলে উত্তর দাও। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”

মাওশিয়াত কপাল ভাঁজ করে বলল, “প্রশ্ন!”

“কিছুক্ষণ আগেই করলাম, তুমি কি রাজি আছো?”

মাওশিয়াত কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ রাজি আছি।”

যদিও সে কিছুই শুনে নি। কিন্তু সে ইমনকে তা বুঝতে না দেওয়ার জন্যই মিথ্যে বলল। ইমন মাওশিয়াতের উত্তর শুনে হাসলো আর বলল,
“তাহলে আগামী শুক্রবার দেখা হবে।”

মাওশিয়াত মাথা নেড়ে বাসায় ঢুকে পড়লো। আর ইমন মাওশিয়াতের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পরও এখনো সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সে মাওশিয়াতের ঘরের বারান্দার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, এখন কি মাওশিয়াত বের হয়ে দেখবে সে দাঁড়িয়ে আছে কি না? প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেলো। মাওশিয়াত আর বারান্দায় আসে নি। ইমনও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে লাগলো।

একপাক্ষিক ভালোবাসাগুলো অনেক যন্ত্রণাদায়ক। এই ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খা একটা মানুষকে তার নিজস্ব স্বকীয়তা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। সেদিনের পর থেকেই ইমন কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়। রাত-দিন তার চোখে মাওশিয়াত আর ইভানের একে-অপরের দিকে তাকিয়ে থাকাটা ভাসতে থাকে। সে কোনোভাবেই সেই মুহূর্তটা ভুলতে পারছে না।

এক সপ্তাহ পর শুক্রবার বিকেলে ইমন মাওশিয়াতকে তার ভালো লাগার কথা বলে দেয়। তবে মাওশিয়াত কোনো উত্তর না দিয়েই বাসায় চলে আসে। পরের দিন সকালে কলেজের জন্য বের হওয়ার সময় মাওশিয়াত ইমনের মুখোমুখি হলো। মাওশিয়াত তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে আসতে যাবে, তখনই ইমন তার হাত ধরে বলল,
“তুমি বলেছিলে, রাজী আছো। তাহলে গতকাল চুপচাপ চলে এসেছো কেন?”

মাওশিয়াত বলল,
“আমি ওইদিন তোমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনি নি।”

“তাহলে মিথ্যে কেন বলেছো? সেদিনই এই কথা বলতে পার‍তে। এখন তুমি আমার মনে তো একটা আশা জাগিয়ে দিয়েছ!”

মাওশিয়াত বলল,
“তুমি যাও, ইমন। এই মুহূর্তে আমার বাসার সামনে কেন এসেছো? কেউ দেখলে কি মনে করবে?”

“তুমি বলেছ, তোমার মা অনেক মিশুক মানুষ। তুমি সত্যটাই বলবে। বলবে আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি সেই শুরু থেকেই।”

“কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”

“তাহলে ইভান ভাইকে ভালোবাসো, তাই না?”

মাওশিয়াত কোনো উত্তর না দিয়ে একটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলে গেলো। আর ইমন সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বলল,
“সেদিন আমি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করি নি। ইচ্ছে করে ওই কথা বলেছি। মাওশিয়াত, এখন তুমি আমাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হবে। তুমি আমার মনে মিথ্যে আশা জাগিয়ে, কখনোই নিজেকে ভালো রাখতে পারবে না। তোমার এই ভাবনায় এবার আমাদের এক করবে। কিন্তু আমি আর তোমার কাছে আসবো না। তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে।”

এদিকে ইমন কয়েকদিন ধরেই ইভানের কাছ থেকে দূরত্ব রাখার চেষ্টা করছে। কথাবার্তাও কম বলছে না। ইভান ইমনের এমন ভাব দেখে অনেক কষ্ট পাচ্ছে।

আজ ইভান ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কেন এমন করছিস?”

ইমন হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি এখন ব্যস্ত আছি।”

ইভান ইমনের হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে বলল,
“আমার প্রশ্নের উত্তর দে, ইমন।”

ইমন চেঁচিয়ে বললো,
“তুই আগে আমার মাওশিয়াত ফিরিয়ে দে।”

ইভান অবাক হয়ে বলল,
“পাগল হয়ে গেছিস? কি বলছিস এসব!”

“তুই জানিস, আমি মাওশিয়াতকে ভালোবাসি। তবুও ওকে নিয়েই তোর ব্যস্ততা। তুই ফোনে ওর সাথেই চ্যাট করিস। তোরা সারারাত কথা বলিস। আর আমি এসব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।”

ইভান ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমাদের চ্যাট পড়ে দেখ, আমরা পড়া নিয়েই কথা বলি। ফোনেও পড়ার বিষয়ে কথা বলি।”

“হয়েছে। আমার এতোসব শুনার কোনো ইচ্ছে নেই। তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই। তুই মনে করিস, বাবা-মার মতো সেদিন আমিও মারা গিয়েছিলাম। আমরা এখন থেকে রুমমেটের মতো থাকবো।”

কথাটি বলেই ইমন ইভানকে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

ইভান ইমনের ব্যবহারে অনেক কষ্ট পেয়েছে। বাবা-মাকে হারানোর পর আজ সে প্রথম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করেছে। ইভানকে কাঁদতে দেখে বাকি চারজন মুষড়ে পড়লো। তূর্য বিড়িবিড় করে বলল,
“আমি জানতাম, ওই মেয়ের জন্য একদিন তোদের মধ্যে কোনো না কোনো ঝামেলা হবে।”

ইভান কাঁপা কন্ঠে বললো, “ওর জন্য কেন ঝামেলা হবে?”

“কারণ ইমন শুরু থেকেই মাওশিয়াতকে পছন্দ করতো। কিন্তু মাওশিয়াত তোর ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখাতো। আগে কি ছিল জানি না। কিন্তু কিছুদিন আগে ও যখন বাসায় এসেছিল, তখন ওর হাবভাব দেখেই বুঝেছি, ও তোকে সত্যিই পছন্দ করে।”

ইভান শার্টের হাতায় চোখ মুছে বলল,
“কিন্তু আমি মাওশিয়াতকে ওই দৃষ্টিতে পছন্দ করি না। আমার জন্য ইমনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউই নেই। আমি মাওশিয়াতের কাছ থেকে দূরত্ব রাখবো। যেই বন্ধুত্ব আত্মার সম্পর্ক নষ্ট করে, সেই বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ায় ভালো। কারণ বন্ধু ছাড়া আমি বেঁচে থাকবো, আত্মার সম্পর্ক ভেঙে গেলে আমি হেরে যাবো।”

চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২২||

৩৯.
ইভান এক সপ্তাহ ধরে মাওশিয়াতের কাছ থেকে দূরত্ব রাখছে। এমনকি যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। তবে মাওশিয়াত ইভানের দূরত্ব রাখার কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই আজ সে কলেজে না গিয়েই ইমনের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো। এদিকে মাওশিয়াত দেখা করবে শুনে ইমন মনে মনে খুবই খুশি হলো। সে ভালোভাবে তৈরি হয়ে ফুরফুরে মেজাজে মাওশিয়াতের বলা স্থানে পৌঁছে গেলো। মাওশিয়াত তাকে দেখেই তার হাত ধরে পাশের একটা বেঞ্চে বসিয়ে বলল,
“আমি জানি না তুমি ইভানকে কি বলেছো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তোমার জন্যই ও আমার সাথে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।”

ইমন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। তার মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো। মাওশিয়াত ইমনের হাত ধরে বলল,
“আমি ইভানকে ফেরত চাই। তোমার অনুভূতিগুলো তুমি ওর উপর চাপিয়ে দিও না। তুমি আমাকে পছন্দ করো, তার মানে আমিও তোমাকে পছন্দ করবো, এটা তো সম্ভব নয়, ইমন। আমি ইভানকে পছন্দ করি।”

ইমন মাওশিয়াতের হাত দু’টি নিজের হাতে মধ্যে আবদ্ধ করে বলল,
“মাওশিয়াত, তুমি ভুল ভাবছো। স্কুলে আমরা দু’বছর একসাথে ছিলাম। তুমি ভাইয়ের চেয়ে আমার সাথে বেশি কথাবার্তা বলেছো। এখন তোমাদের কলেজের ক্লাস শুরু হয়েছে এক বছরও হয় নি। আর তুমি এই কয়েক মাসে ভাইকে পছন্দ করে ফেলেছো? এটা তো আমি মানতে পারছি না।”

মাওশিয়াত বলল,
“তোমাকে এটাই মেনে নিতে হবে। প্লিজ, আমার আর ইভানের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করো না, ইমন।”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি, মাওশিয়াত। আমি তোমার আর ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করি নি। আমি তো তোমাকে চাইছি।”

“এটা সম্ভব না। কারণ আমি এটা চাই না।”

ইমন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তাহলে ইভান তোমার অনেক যত্ন নেয়। আমার চেয়েও বেশি, তাই না?”

মাওশিয়াত মলিন মুখে বললো,
“আমি জানি তুমি আমাকে খুব পছন্দ করো। কিন্তু..”

ইমন মাওশিয়াতকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ইভান মাহমুদকে বলবো, তোমাকে আমার ভাবী বানিয়ে নিতে। এরপর তো আমি তোমার দেবর হয়ে যাচ্ছি, তাই না?”

কথাটি বলেই ইমন চলে গেলো। আর মাওশিয়াত শূন্য দৃষ্টিতে ইমনের চলে যাওয়া দেখছে। ইমন আর ইভান আপন ভাই। তাহলে তো এই সম্পর্কে কেউই সুখী হবে না। ইমন তার ভালোবাসার মানুষকে ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে কিভাবে মেনে নিবে? আর ইভান তার ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষকে কখনোই আপন করে নিতে পারবে না। মাওশিয়াত বিড়বিড় করে বলল,
“এটা এতোদিন কেন আমার মাথায় আসে নি? তাহলে কি ইভানকে আমি কখনোই পাবো না? কিন্তু ইভানও যদি আমাকে পছন্দ করে, তাহলে তো সম্ভব। ইমন একদিন অবশ্যই এটা মেনে নেবে।”

মাওশিয়াত ইভানকে সুযোগ বুঝে তার ভালো লাগার কথাটা জানিয়ে দিলো। ইভানও সরাসরি না করে দিলো। বলল,
“আমি তোমাকে কখনোই বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু মনে করি নি। এমন নয় যে আমি ইমনের জন্য তোমাকে মেনে নিচ্ছি না, বা আমার অন্য কাউকে পছন্দ। আমি কখনোই ভালোবাসা বা সম্পর্কে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ খুঁজে পাই নি।”

মাওশিয়াত ইভানের হাত ধরে বলল,
“আজ থেকে আমাদের বন্ধুত্বও শেষ। আমি তোমার উপর রাগ করে থাকবো না। ইমনের উপরও আমার কোনো ক্ষোভ নেই। ও সত্যিই আমাকে ভালোবাসতো। এখনো হয়তো ভালোবাসে। এটা আমি প্রথম দিন থেকেই বুঝেছিলাম। কিন্তু আমি মনে করতাম সম্পর্ক নিজের যোগ্যতার সাথে যাবে এমন মানুষের সাথে করা উচিত। আমার দৃষ্টিতে একজন মেয়ে ডাক্তার আর একজন পুরুষ সাহিত্যিক কখনোই একে অপরের জন্য মানানসই নয়। ঠিক তেমনি আমার পাশে ইমনের চেয়ে তোমাকেই বেশি মানানসই মনে হয়েছে। তাই আমি তোমাকেই চেয়েছিলাম।”

ইভান বলল,
“তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। শুধু তোমার দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিবর্তন করা উচিত৷”

মাওশিয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলো।

প্রেমানুভূতি এমন একটা রোগ, যেই রোগ বসন্তের হাওয়ার মতো জীবনে চলে আসে। কিন্তু কাউকে জানায় না সে এসেছে। যেমন বসন্তেও এখন আর আগের মতো ফুল ফুটে না।
আর সেই হাওয়া নতুন করে আরাফের কাছে ছুটে এসেছে। রুহানির মৃত্যুর পর সে দ্বিতীয় বার সেই জায়গায় কাউকে অনুভব করতে পারছে। কিন্তু এই কথা সে ঘুণাক্ষরেও সেই মেয়েটিকে জানাবে না। সে দূর থেকেই মেয়েটিকে ভালোবাসবে। কাছেও যাবে না।

সায়ন্তনী দোকান বন্ধ করে বের হতেই আরাফের মুখোমুখি হলো। আরাফ তাকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সায়ন্তনী এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইমনকে খুঁজতে লাগলো। কারণ প্রতিদিন ক্লাস শেষে ইমন সায়ন্তনীর দোকান এসে চা খেয়ে যায়। কিন্তু আজ আসে নি। সায়ন্তনী আরাফকে জিজ্ঞেস করলো,
“ইমন আসবে না?”

আরাফ শূন্য দৃষ্টিতে সায়ন্তনীর চোখের দিকে তাকালো। এই ছেলের দৃষ্টিতে আসলেই কিছু একটা আছে। সায়ন্তনী সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, এই গভীর চোখ দুটি অনেক কিছুই বুঝে ফেলে। আরাফের চোখ দু’টি অদ্ভুতভাবে মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারে। যেমন সে বুঝে ফেলেছে সায়ন্তনী ইমনকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু সায়ন্তনীও তার মতোই অপারগ। আরাফ সায়ন্তনীকে কখনোই তার ভালো লাগার কথা বলবে না, কারণ সে সায়ন্তনীর দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে নি। হয়তো পারবেও না। আর সায়ন্তনী ইমনকে তার ভালো লাগার কথা বলবে না, কারণ সে নিজেকে ইমনের অযোগ্য মনে করে আর এমনিতেই ইমনের মনে মাওশিয়াতের বসবাস।

ভালো লাগাগুলোও খুব অদ্ভুত হয়। এখানে তাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে যেমন থাকে, তাকে না পাওয়ার আক্ষেপও থাকে। তবুও চোখ একটুখানিও ভিজবে না। মনে উথাল-পাতাল সৃষ্টি হলেও চোখে থাকবে শূণ্যতা। তবুও ঠোঁটের হাসি মুছে যাবে না।

এদিকে সবাই যার যার সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত৷ তূর্য সারাদিন তার ভিডিও তৈরীর কাজে লেগে থাকে। ইভান আর ইমনের মধ্যে এখনো কোনো কথাবার্তা হয় না। ইমন রাতেই বাসায় ফিরে। সারাদিন আর বাড়িতে আসে না। অন্যদিকে ইভান কিছুদিনের জন্য তার কলেজ বন্ধুর সাথে থাকছে। আর আরাফ সায়ন্তনীর ভাবনায় ব্যস্ত, তাহমিদ সারাদিন দোকানে বা রেস্টুরেন্টে থাকে, আর সময় পেলে শতাব্দীর সাথে গল্প করে সময় পার করে। এদিকে আহনাফও যতির যন্ত্রণায় এক সেকেন্ড বাসায় থাকতে পারে না। তাকে ক্লাসের পর কোচিংয়ে, আর এরপর দোকানে যেতে হয়। আর বাকি সময়টা যতির জন্য বরাদ্ধ রাখতেই হবে। নয়তো সেদিনই যতি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আহনাফকে নাজেহাল করে ছাড়বে।

এসবের ভীড়ে অরুণিকাকে সবাই ভুলেই গেছে। মহল্লার একটা মেয়ের সাথেই অরুণিকা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে। এখন সে আট বছরে পা দিয়েছে। সে মোটামুটি একা একা আসা যাওয়া করতে পারে। বাসায়ও একা থাকতে পারে। অরুণিকার জন্য গত মাসেই ছোট একটা টিভি কিনে এনেছিলো তূর্য। এখন টিভি দেখেই তার বাকি সময়টা কাটে। কিন্তু তার একা একা যাওয়া আসাটাই মহল্লার উঠতি বয়সী ছেলেদের চোখ এড়ায় নি। তারা মাঝে মাঝে অরুণিকার ব্যাগ টেনে নিয়ে ফেলে, হাত ধরে রাখে, ছোট ছোট ইটের ভাঙা টুকরো তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। এরপর অরুণিকা বাসায় এসে কান্না করে। কিছুক্ষণ পর আবার ভুলে যায়।
আরাফ আর তাহমিদ সন্ধ্যার পর পরই বাসায় ফিরে আসে৷ বাকিরা রাত দশটার পরই ফিরে। কিন্তু বাসায় এসেই তারা পড়তে বসে যায়, বা ঘুমিয়ে পড়ে। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে অরুণিকার সাথে কিছুক্ষণ বসে কথা বলারও সময় হয় না। অরুণিকাও কাউকে কিছু জানায় নি। এমনকি তার মনেও থাকে না। মনে পড়লেও বলার সুযোগ পায় না। কারণ সেই সুযোগটা সে আর ছ’জনের কাছ থেকে পায় না।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here