অরুণিকা পর্ব – ৩৪+৩৫+৩৬

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৪||

৫৬.
অরুণিকার জন্য রুমের দেয়ালে বড় একটা আয়না লাগিয়েছে আহনাফ। অরুণিকা তা দেখেই খুশিতে আহনাফের হাত ধরে লাফাতে লাগলো। বাসায় যেই আয়নাগুলো আছে, ওগুলোতে নিজেকে দেখার জন্য অরুণিকার টুল-টেবিল টেনে আনতে হয়। এখন সে নিচে দাঁড়িয়েও নিজেকে দেখতে পারবে। সকালে অরুণিকা ঘুম থেকে উঠেই আয়নার সামনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। গোসল করার আগে কি জামা পড়বে তাও গায়ের সাথে লাগিয়ে দেখছে। বিকেলে আয়নার সামনে বসে বসে সাজগোজ করে নিজের গাল নিজেই টানছে। আহনাফ দরজায় হেলান দিয়ে বলল,
“কি করছো তুমি?”

অরুণিকা তার মেকাপের জিনিসপত্রগুলো একপাশে রেখে আহনাফের পকেট ঘাঁটতে লাগলো। আহনাফ কয়েক পা পিছিয়ে বলল,
“কি করছো হ্যাঁ?”

অরুণিকা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ফোন দাও তো।”

“তুমি ফোন দিয়ে কি করবে?”

অরুণিকা কোমরে হাত দিয়ে বলল,
“ফোন দিয়ে কি করে বলো দেখি?”

আহনাফ কপাল ভাঁজ করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা বলল,
“আরেহ ছবি উঠায় আর কি! আমিও ছবি উঠাবো।”

আহনাফ অবাক কন্ঠে বলল,
“ছবি! তুমি ছবি উঠাতে পারো?”

“জানো, আমার বান্ধবীরা ছবি উঠিয়ে ফেইসবুকে দেয়।”

তূর্য রুমে ঢুকে শেষ কথাটি শুনেই বলে উঠলো,
“ওরে বাবা! তারপর, তারা আর কি কি করে?”

“ওদের ছবিতে অনেক লাইক, অনেক কমেন্ট আসে।”

আহনাফ বলল, “ওদের ফেইসবুকও আছে?”

“না, এটা ওদের মায়েদের ফেইসবুক। কিন্তু ওরাই বেশি চালায়। কেউ কেউ নানুর ফেইসবুকে নিজের ছবি দেয়৷ জানো, ওদের ফোনও আছে। আমার তো ফোনও নেই।”

তূর্য অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“ছোট বাবুরা ফোন ব্যবহার করে না।”

“কিন্তু আমি তো বড় হয়ে গেছি।”

“কে বলেছে তুমি বড় হয়েছ?”

“শতু আপুই তো বললো।”

এবার আহনাফ বলল,
“আমাদের কাঁধ বরাবর এলেই তুমি ফোন পাবে৷”

অরুণিকা পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে আহনাফের সামনে রাখতেই সে আরো কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। অরুণিকা কোমরে হাত দিয়ে তাকে টেনে চেয়ারের পাশে দাঁড় করালো৷ তারপর নিজে চেয়ারে উঠে আহনাফের কাঁধ দেখিয়ে বলল,
“দেখো, আমি তোমার সমান হয়ে গেছি।”

আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, বারান্দায় চলো। আমি তোমাকে ছবি উঠিয়ে দিচ্ছি।”

অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে বারান্দায় চলে গেল। আহনাফ তার ছবি তুলে দেওয়ার পর অরুণিকা ফোনটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখে বলল,
“আমার ছবিগুলো তোমার ফেইসবুকে দেই?”

আহনাফ ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলল,
“কোনো দরকার নেই।”

অরুণিকা মলিন মুখে বললো, “কেন?”

“কেন টেন জানি না। যাও এখন!”

অরুণিকা তূর্যের কাছে গিয়েও একই আবদার করলো। তূর্যও রাজি হলো না। অরুণিকা মন খারাপ করে বসে রইল। তাহমিদ অরুণিকার মন খারাপ দেখে, ‘লিটল স্টার অরুণিকা’ নামে একটা ফেইসবুক একাউন্ট খুলে ছবিগুলো আপলোড করল। অরুণিকা তা দেখে অনেক খুশি হলো। সে সারাদিন তাহমিদের ফোনটা কিছুক্ষণ পর পর নিয়ে দেখতে লাগলো। কিন্তু কোনো লাইক পড়লো না। তাহমিদ এবার সেই আইডি থেকেই নিজেদের আর শতাব্দী ও মাওশিয়াতকে রিকুয়েষ্ট পাঠালো। ইভান ছাড়া সবাই অরুণিকার রিকুয়েষ্টটা এক্সেপ্ট করলো। আর একটা একটা করে লাভ রিয়েক্ট দিয়ে গেলো। অরুণিকা তা দেখে খুশিতে লাফাতে লাগলো। তারপর তাহমিদের কাছে এসে বলল,
“দেখো, আমি সাতটা হার্ট পেয়েছি। দেখো কে কে দিয়েছে?”

তাহমিদ বই দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,
“না, তুমিই দেখো।”

অরুণিকা এবার বিছানায় পা ভাঁজ করে বসে ফেইসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলো। শুরুতেই সে তূর্যের আইডিতে ঢুকলো। দেখলো তূর্য অনেকগুলো ছবি ছেড়েছে। সে ইচ্ছেমতো লাভ, হা হা আর ওয়াও রিয়েক্ট দিয়ে গেল। এদিকে তূর্য রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাজ করছিল। তখন ফোনে বার-বার নোটিফিকেশন আসার শব্দ পেয়ে সে এঁটো হাতে ফোনের সামনে গিয়ে দেখলো, নোটিফিকেশনে লেখা,
“লিটল স্টার অরুণিকা রিয়েক্টটিড টু ইউর পোস্ট।”

তূর্য হাত ধুয়ে রুমে এসে দেখলো আহনাফের বিছানায় বসে বসে অরুণিকা ফোন চালাচ্ছে। তূর্য বলল,
“টুইংকেল, কি করছো তুমি?”

অরুণিকা আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“আমি তোমার ছবিতে অনেকগুলো হার্ট পাঠিয়েছি, দেখো।”

তাহমিদ মুখ চেপে হেসে বলল,
“লিটল স্টার ফেইসবুককে ভালোই উদ্ধার করছে।”

তূর্য বলল,
“টুইংকেল, আমাকে আর হার্ট দিতে হবে না, অনেক দিয়েছো।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”

তারপর বাকিদের ছবিগুলোতেও রিয়েক্ট দিয়ে এলো। আহনাফ বিরক্ত হয়ে ফোন সাইলেন্ট করে দিলো। এবার অরুণিকা মেসেজ দেওয়ার জন্য ইমনের আইডিতে ঢুকলো। তারপর লিখলো,
“তুমি এতোক্ষণ বাথরুমে কি করছো? দেখছো না, আরাফ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? তাড়াতাড়ি বের হও।”

অরুণিকা এবার আহনাফকে মেসেজ দিলো। লিখলো,
“হাই, কেমন আছো?”

তাহমিদকে লিখলো, “সুন্দর বই।”

তূর্যকে লিখলো, “ছবিগুলো সুন্দর।”

শতাব্দীকে লিখলো,
“শতু আপু, বাসায় আসবে না আজকে?”

মাওশিয়াতকে লিখতে যাবে তার আগেই আহনাফ রুমে এসে বলল,
“এই কি করলে এটা তুমি?”

তূর্য রুমে এসে হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়লো। তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি হয়েছে?”

তূর্য হাসির জন্য কথাও বলতে পারছে না। আরাফ আর ইভানও রুমে এলো। ইমন বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল,
“তোরা এভাবে হাসছিস কেন?”

তূর্য বলল,
“তুমি এতোক্ষণ বাথরুমে কি করছো? দেখছো না, আরাফ দাঁড়িয়ে আছে? তাড়াতাড়ি বের হও।”

“মানে?”

“মানে তোর মান-সম্মান পানির সাথেই চলে গেছে। সাত মিনিটের মধ্যে বিশজনের হা হা রিয়েক্ট। ভাই তাড়াতাড়ি আইডি অফ কর।”

“মানে কি?”

আহনাফ বলল,
“আরেহ, এই বোকাটা তোকে মেসেজ দিতে গিয়ে তোর টাইমলাইনে লিখে ফেলেছে।”

ইমন তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, অরুণিকার পোস্ট৷ ইমন ছোঁ মেরে অরুণিকার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ডিলিট করে দিলো। অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে ইমনের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আহনাফ বলল,
“বাকিগুলোও ডিলিট কর।”

ইমন রাগী কন্ঠে বললো,
“তোরা দে। আমি পারবো না। সকালটাই খারাপ করে দিয়েছে৷ সবাই কি ভাববে এখন? মাওশিয়াতও দেখে ফেলেছে।”

তাহমিদ এবার ফোন হাতে নিয়ে বাকিগুলোও ডিলিট করে দিলো। তারপর বলল,
“এভাবে মেসেজ দেয় না, অরুণিকা।”

তারপর অরুণিকাকে দেখিয়ে দিলো কিভাবে মেসেজ পাঠাতে হয়। অরুণিকা ইমনকে বলল,
“সরি। আমি তো জানতাম না।”

কয়েক দিন পর সন্ধ্যায়, মাওশিয়াত ফেইসবুকে ঢুকেই চমকে উঠল। সে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে ইমনকে ফোন করলো। এদিকে ইমন মাওশিয়াতের কল দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে রিসিভ করে বলল,
“কি অবস্থা? কেমন আছো?”

মাওশিয়াত গম্ভীরমুখে বলল,
“আমি নতুন সম্পর্কে চলে গেছি।”

ইমন ফোন কান থেকে নামিয়ে দেখলো মাওশিয়াতেরই নম্বর। সে আবার কানের কাছে এনে বলল,
“কি বলছো তুমি, মাওশিয়াত?”

“হ্যাঁ, ফেইসবুকে ঢুকেই দেখো।”

কথাটি বলেই মাওশিয়াত কল কেটে দিলো। ইমন চিন্তিত মুখে সোজা হয়ে বসল। তারপর ফোন হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলো। তখনই তূর্য রুমে এসে হাসতে হাসতে বলল,
“ইমন, তোর প্রেমে তো অন্যজন ভাগ বসিয়ে দিয়েছে!”

ইমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“মাওশিয়াত আমাকে যেভাবে বলেছিল, আমি ভেবেছি অন্যকিছু।”

ইমন তাহমিদের রুমে এসে দেখলো, অরুণিকা তাহমিদের পাশে বসে ফোন চালাচ্ছে। ইমন ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে বলল,
“কি করলে এটা?”

অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে ইমনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ জিজ্ঞেস করল,
“আবার নতুন কোনো ঝামেলা বাঁধিয়েছে নাকি?”

তূর্য রুমে ঢুকে আহনাফের পাশে বসে বলল,
“নতুন শিরোনাম, লিটল স্টার অরুণিকা ইন এ রিলেশনশিপ উইথ মাওশিয়াত।”

তাহমিদ আর আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিলো। অরুণিকা বলল,
“তোমরা হাসছ কেন?”

তূর্য হাসিয়ে থামিয়ে বলল,
“টুইংকেল, তুমি কি দিয়েছ এটা?”

অরুণিকা ফোন হাতে নিয়ে বলল,
“ওহ, এটাতো সামনে এসেছিল।”

“আরেহ, তুমি কি এর অর্থ জানো?”

“হ্যাঁ, জানি।”

“কি, দেখি বলো তো!”

“রিলেশনশিপ অর্থ সম্পর্ক।”

“আচ্ছা! কে বলেছে তোমাকে?”

“আমাদের স্কুলে শব্দের অর্থ শিখতে দিয়েছিল, ওখানে পড়েছি।”

আহনাফ বলল,
“তাহলে কি শুধু মাওশিয়াতের সাথেই তোমার সম্পর্ক? আমরা কি কেউ না?”

“আপুর নাম চলে এসেছিল, তাই ওটাই দিয়েছি।”

এবার ইভান আর আরাফ রুমে এলো। ইভান বলল,
“এগুলো কি অরুণিকা!”

আরাফ বলল,
“বাদ দে। ও কি এগুলো বুঝে?”

“না বুঝলে ফোন ধরবে কেন? তাহমিদ, তুই ওকে ফোন ধরতে দিচ্ছিস কেন? ফেইসবুকে ঢুকে যা তা করছে। গতকাল স্টোরিতে ব্রাশ করার ছবি ছেড়ে দিয়েছে। আর আজকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস। প্রতিদিন এসব কি?”

ইভানের কথা শুনে তূর্য হাসতে হাসতে বলল,
“আর যাই বল, স্টোরিটা কিন্তু চরম ছিল। ভাগ্যিস টুইংকেলের সাথে আমরাই এড ছিলাম। অন্য কেউ দেখলে তোর সম্মানের তেরোটা বেজে যেতো।”

তাহমিদ বলল,
“শতাব্দী তো দেখে ফেলেছিল।”

ইভান বলল, “কি?”

“হ্যাঁ। আমাকে বলেছে, ফোনে উল্টাপাল্টা ছবি না রাখতে।”

“তুই আমার ছবিটা তুলেছিস কেন?”

“আরেহ, তুই ঘরে হেঁটে হেঁটে ব্রাশ করছিলি। আমার রাগ উঠছিল। ব্রাশ করার জায়গা বেসিনের সামনে৷ পরে বললে বলবি, কখন করলাম? তাই ছবি তুলে প্রমাণ রেখেছিলাম। অরুণিকা তো সেটা ভাইরাল করে দিয়েছে।”

সবাই ইভানের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। ইভান অরুণিকার সামনে এসে বলল,
“গতকাল ক্লান্ত ছিলাম, তাই কিছু বলি নি। এখন বলো, আমার ছবি কেন দিয়েছিলে?”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ভুলে চাপ পড়ে গিয়েছিল।”

“আর ফোন হাতে দেখলে হাত কেটে দেবো।”

আরাফ বলল,
“ইভান, ও ছোট মানুষ। আর আমরা ছাড়া ওর সাথে কেউ এডও নেই৷ তাহলে তোর সমস্যাটা কোথায়?”

“মাওশিয়াত আর শতাব্দী তো আছে। ওরা দেখলে কি ভাববে?”

ইমন অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“পরেরবার কিছু করার আগে জিজ্ঞেস করবে, ঠিক আছে?”

ইমন এরপর ফেইসবুকে ঢুকে সব আগের মতো করে দিলো। বাকি সব কিছু অরুণিকাকে শিখিয়ে দিল। অরুণিকা ফেইসবুকে খালি বক্সটা দেখে বলল,
“তাহলে এখানে কি লিখে?”

“তোমার ভালো লাগাগুলো লিখবে। তুমি কি ভাবছো, কি করতে চাও, অন্যকে জানাতে চাইলে এই বক্সে লিখবে। এরপর সবাই তা দেখবে।”

“আচ্ছা, বুঝেছি।”

সন্ধ্যায় ইফতারির পর অরুণিকা পড়াশুনা শেষ করে তাহমিদের কাছ থেকে ফোন নিয়ে খালি বক্সে লিখতে বসে গেলো। প্রায় বিশ মিনিট পর অরুণিকা পোস্ট করলো। তারপর তাহমিদকে বলল,
“দেখো, আমি লিখেছি।”

বাকিরা পাশেই ছিল। তূর্য উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
“দাঁড়া, আমি পড়ে সবাইকে শুনাচ্ছি।”

অরুণিকার পোস্ট দেখে তূর্য মুখ চেপে হাসতে লাগলো। ইমন ব্যস্ত হয়ে বলল,
“তুই পড়বি এখন? নাকি হাসবি?”

“আচ্ছা, আচ্ছা, পড়ছি।”

তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে পড়া শুরু করলো,
“আমি অরুণিকা। আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। আমার স্কুল অনেক বড়।”

তূর্য হাসতে হাসতে বলল,
“এগুলোও কেউ লিখে?”

অরুণিকা অভিমানী কন্ঠে বলল,
“তুমি পড়তেই জানো না? তুমি হাসছো কেন?”

অরুণিকা মন খারাপ করে বিছানা থেকে নেমে অন্য রুমে চলে যেতেই আরাফ তার হাত ধরে ফেললো। তারপর তাকে পাশে বসিয়ে বলল,
“আমি পড়ছি। আমার অরু কি লিখেছে দেখি?”

আরাফ ফোনটা নিয়ে পড়তে লাগল অরুণিকার লেখা।

“আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করি। তারপর নাস্তা করে স্কুলে চলে যাই। আরাফ আমাকে স্কুলে দিয়ে আসে। ইমন নিয়ে আসে। আমার অনেক বন্ধু আছে। আমি ওদের সাথে খেলি। তারপর বাসায় এসে ঘুমাই। পড়াশুনা করি। তারপর তাহমিদের ফোনে ফেইসবুক চালাই।”

ইমন তূর্যের দুই ঠোঁট হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে, যাতে ও হাসতে না পারে। কিন্তু এদিকে নিজেই হাসছে। আরাফ অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“অনেক সুন্দর করে লিখেছ। কিন্তু অনেক বানান ভুল হয়েছে। নাস্তা, স্কুল, বন্ধু এরকম অনেক বানান শুদ্ধ হয় নি।”

“আমি কিভাবে লিখতে হয় জানি না। আমি খাতায় লিখতে পারি। কিন্তু ফোনে কিভাবে লেখে জানি না।”

“তো তুমি খাতায় লিখো। খাতায় লিখলে তোমার হাতের লেখাও সুন্দর হবে। আর তোমার চোখেও কোনো সমস্যা হবে না। বেশি ফোন চালানো উচিত না। তুমি তো অনেক ছোট৷ দেখছ না, আমি চশমা ছাড়া সব ঝাপসা দেখি৷ কারণ আমি তোমার বয়সে অনেক ভিডিও গেইম খেলতাম। সারাদিন ট্যাব নিয়ে বসে থাকতাম।”

“কিন্তু আমার ফেইসবুক চালাতে অনেক ভালো লাগে।”

ইভান বলল,
“তুই কাকে বোঝাচ্ছিস, আরাফ?”

আরাফ বলল,
“অরু, আমার কথা শুনে। অরু, এখন থেকে শুধু দশ মিনিট ফেইসবুক চালাবে। এর মধ্যে যা করার করবে। এরপর আবার পড়তে বসবে। ঠিক আছে?”

অরুণিকা ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আরাফের দিকে তাকালো। আর বলল,
“আচ্ছা। কিন্তু যেদিন হোমওয়ার্ক থাকবে না, ওইদিন একটু বেশি দেখবো।”

“আচ্ছা, ওইদিন বিশমিনিট।”

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৫||

৫৭.
সাদা লেহেঙ্গা পরে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো অরুণিকা। অরুণিকাকে দেখেই আরাফ তার কাছে এগিয়ে এলো৷ অরুণিকা বলল,
“ইদ মোবারক, আরাফ।”

আরাফ মুচকি হেসে অরুণিকার হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলো। অরুণিকা টাকা পেয়ে খুশি হয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। তারপর সে ইভানের সামনে এসে দাঁড়ালো৷ ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি সমস্যা?”

অরুণিকা কোনো উত্তর না দিয়ে শুকনো মুখে সরে গেলো। এবার ইমন তার দুই পা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আগে সালাম, তারপর সালামি।”

অরুণিকা সালামি পাবে শুনে ইমনকে সালাম করলো। ইমন একশো টাকার নোট দিয়ে কলার ঝাঁকিয়ে বলল,
“আজ আমি শ’পতি৷ তাই আজ আমি দুই হাত খুলে খরচ করবো।”

অরুণিকা টাকাটা ভালোভাবে দেখে বলল,
“মাত্র একশো টাকা দিয়েছ?”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“একশো টাকা কি তোমার কম মনে হচ্ছে? এই টাকা দিয়ে তুমি কতোগুলো ক্যান্ডি পাবে, জানো?”

এরপর তাহমিদ এসে অরুণিকার হাতে দুইশো টাকা দিয়ে বলল,
“ইদ মোবারক। তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, অরুণিকা।”

অরুণিকা খুশি হয়ে বলল,
“জানো, আমি কার কাছ থেকে মেকাপ করা শিখেছি?”

“কার কাছ থেকে শিখেছ?”

“শতু আপুর কাছ থেকে। শতু আপু তোমার ফোনে মেকাপ ভিডিও পাঠিয়েছিল।”

তাহমিদ মুচকি হাসলো। ইমন বলল,
“বাহ! আজকাল তাহলে তাহমিদের ফোনে ভিডিও পাঠানো হয়!”

তাহমিদ কোণা চোখে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অরুণিকাকেই পাঠিয়েছিল। আমাকে নয়।”

তাদের কথার মাঝখানে তূর্য এসে অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো৷ অরুণিকা মুখে মিষ্টি হাসি টেনে বলল,
“ইদ মোবারক, রকস্টার।”

তূর্য বলল,
“ইদ মোবারক, মাই টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার।”

এবার তূর্য অরুণিকার ব্যাগটা দেখে বলল,
“বাহ, এই ব্যাগটা তো খুব সুন্দর।”

“হ্যাঁ, মাওশিয়াত আপু আমাকে জন্মদিনে দিয়েছিল।”

তূর্য মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা, চোখ বন্ধ করো। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

অরুণিকা তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ পর তূর্য বলল,
“এবার চোখ খুলো।”

অরুণিকা চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে অবাক হলো। তূর্য বলল,
“কেমন লেগেছে?”

অরুণিকা তূর্যের হাত থেকে ট্যাবটা নিয়ে বলল,
“অনেক সুন্দর। এটা কি আমার জন্য?”

“হ্যাঁ। এটাতে তুমি ইচ্ছেমতো গেইমস খেলতে পারবে৷”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তূর্য, তুই ওকে এতো দামি ট্যাব কেন দিয়েছিস?”

“কেন দিলে কি সমস্যা?”

“ওর কি এখন আর পড়াশুনা হবে? সারাদিন তো এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।”

তূর্য বলল,
“না, আমার টুইংকেল পড়ার সময় পড়বে, খেলার সময় খেলবে। তুমি কিন্তু আরাফকে প্রমিজ করেছো বেশিক্ষণ ফোন দেখবে না।”

অরুণিকা বলল, “হ্যাঁ, বিশ মিনিট দেখবো শুধু।”

এবার আহনাফ অরুণিকার ব্যাগে পাঁচশ টাকার একটা বান্ডেল ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে কি দেবে?”

অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “আমাকেও দিতে হবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমি তো ছোট, আমি কি দেব?”

“এখন সেটা তুমিই ভেবে দেখো।”

অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে নিজের রুমে চলে গেলো। তারপর দশমিনিট পর রুম থেকে বের হলো। আহনাফ বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার অরুণিকা একটা চকলেট আহনাফের দিয়ে এগিয়ে দিলো।

আহনাফ চকলেটটা নিয়ে বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো, আর বলল,
“থ্যাংক ইউ।”

ইমন বলল, “আমরা কি পাচ্ছি না?”

অরুণিকা বলল, “না, আমার কাছে তো আর নেই।”

এদিকে আরাফ আর তূর্য টেবিলের উপর পায়েস আর পাস্তার বাটি রেখে সবাইকে ডাকলো। ইমন চেয়ার টেনে বসতে যাবে তখনই আহনাফ বলল,
“তুই তোর শ্বশুড় বাড়ি গিয়েই খাইস। এখন আমাদের খেতে দে।”

ইভান বলল,
“আরেহ, হ্যাঁ। কাল রাতেই মাওশিয়াত ফোন দিয়ে বাসায় যেতে বলেছিল। ইমন, তোকে ফোন দেয় নি?”

ইমন বলল, “মেসেজ দিয়েছিল।”

এবার তূর্য বলে উঠল,
“সায়ন্তনীর কথা তো সবাই ভুলেই গেছিস মনে হয়?”

তূর্যের কথা শুনে ইমন চুপ হয়ে গেলো। টেবিলে কেউ আর কোনো কথা বললো না।

খাওয়া-দাওয়া করে তারা যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে রইলো। অরুণিকা তার সাদা লেহেঙ্গাটি পরে ঘরে ঘরেই হাঁটছে৷ প্রতি বছর এভাবেই তাদের ইদ কাটে। এখানে পরিচিত কেউ নেই। আগের মহল্লায় হিন্দু পরিবাররাও ইদে অংশ নিতো। শতাব্দীসহ মহল্লার ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের বাসায় আসতো। অরুণিকা তাদের সাথেই সবার বাড়িতে যেতো। মাস্টারমশাইও সবাইকে সালামি দিতেন। ওই মহল্লায় অনেক মুসলিম পরিবার ছিল। আর এই মহল্লায় দু’একটা মুসলিম পরিবারই আছে। কিন্তু তাদের সাথে আরাফদের কথাবার্তা হয় না। এমনকি পাশের বাড়ির প্রতিবেশি দম্পতিও কখনো তাদের দরজায় এসে ঠোকা দেয় নি। তবে ছ’বন্ধুর তা নিয়ে আফসোসের চেয়ে স্বস্তি বেশি। কারণ এখন অরুণিকাকে নিয়ে মাসির দরদ দেখাতে কেউ আসবে না। এর আগের মহল্লায় বেশি সামাজিকতা পালন করতে গিয়ে প্রতিবেশিরা তাদের প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিল।

অনেকক্ষণ ধরে মাওশিয়াত ইমনকে ফোন করছে। আর ইমন বারান্দায় অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। তূর্য খাবারের টেবিলে সায়ন্তনীর কথা তোলার পর থেকেই তার মন খারাপ। সায়ন্তনীর সাথে সে যা করেছে, তার জন্য তার এখনো আফসোস হচ্ছে। কিন্তু তার ভুল তো হয়েই গেছে। আর তাই সে সায়ন্তনীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। তবুও এই ভুল যেন জোয়ারের মতো তার জীবনের সব ভালো থাকাগুলোকে আড়াল করে দিচ্ছে। আর ভাটার মতো চলে যাওয়ার সময় আত্মগ্লানিই রেখে যাচ্ছে। এখন এই ভুল তো কারো মস্তিষ্ক থেকে আর মুছে দেওয়াও সম্ভব না।

এদিকে তূর্য ফোনের শব্দ শুনে বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো ইমন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য তার কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“আমার কথায় মন খারাপ করেছিস?”

ইমন তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “না।”

তূর্য বলল,
“ইমন, আমি জানি তুই যা করেছিস আবেগ আর জেদের বশে করেছিস। কিন্তু সেদিন সায়ন্তনীর কথাগুলো শুনে আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। এমনিতে ও যদি কিছু না বলতো, চুপ থেকেই সরে যেতো, তখন হয়তো এতোটা খারাপ লাগতো না। কিন্তু ও তো অনেক কিছুই বলে ফেলেছে। ওর জন্য সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”

ইমন বলল,
“আমি জানি তুই কেন ভয় পাচ্ছিস।”

তূর্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ইমন বলল,
“চিন্তা করিস না। অরুণিকার সাথে এমন হবে না। ওকে আমরা চোখে চোখে রাখবো। ওকে প্রেমেই পড়তে দেবো না, তখন ধোঁকা খাওয়ার তো প্রশ্নই আসবে না। আর আহনাফ যেই চুক্তিতে অরুণিকাকে ফিরিয়ে এনেছে, সেই চুক্তিটা যদি বাস্তবে রূপান্তরিত হয়, তাহলে হয়তো আমরা আমাদের অরুণিকাকে কখনোই হারাবো না।”

তূর্য বলল,
“আহনাফ চুক্তিটা আরাফের কথায় মেনে নিয়েছিল। ওরা যেহেতু কাজিন, তাই ওই চুক্তির বিষয়টা ভিন্ন ছিল। আর এমনিতেই আরাফ-আহনাফেরই টুইংকেলের উপর আমাদের তুলনায় বেশি অধিকার আছে। বাবা, ভাই, দাদা, চাচা এদের অবর্তমানে কাজিন ভাইরাই তো প্রধান অভিভাবক হয়। কিন্তু সেদিন আহনাফ তো নিজ থেকে কিছুই বলে নি। ওর হয়তো কোনো ইচ্ছেও ছিল না। আর শুরু থেকেও ও টুইংকেলকে পছন্দ করতো না। দেশেও যখন টুইংকেল ওর আশেপাশে আসতো, ও অনেক রুড হয়ে যেতো। আমার মনে হয় না, আহনাফ ওকে নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ চিন্তা করেছে।”

“তাহলে কি অরুণিকাকে বাইরেই বিয়ে দিতে হবে? তাহমিদ তো ওকে বোনের চোখেই দেখে। আরাফকে তো ওর ভাই কম, বাবাই বেশি মনে হয়। তাহলে আমি…”

তূর্য ইমনকে থামিয়ে বলল,
“তুই মানে? আরাফ ঝাড়ু দিয়ে তোকে বিদায় করবে।”

ইমন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমার মাও আছে, বুঝেছিস! আর তুই তো সিঙ্গেলই আছিস। তুই বিয়ে করে ফেলিস ওকে।”

“আমার তো বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই নেই। তোদের প্রেম দেখে আমার আবেগ-অনুভূতি সব হাওয়া হয়ে গেছে। তবে ইভানকে নিয়ে ভেবে দেখতে পারিস।”

ইমন চোখ বড় বড় করে বলল, “ভাই? অসম্ভব।”

“অসম্ভব কেন?”

“আমার জালিম ভাই, অরুণিকার জীবনটাই নষ্ট করে ফেলবে। আর ওই পিচ্চি, আমি যার বমি পরিষ্কার করেছি, সে আমার ভাবী হলে আমার তো মান-সম্মানই থাকবে না। না, না, আমি মানি না এই সম্পর্ক।”

ইমনের ফোন বেজে উঠাই, সে কল রিসিভ করতে করতে ইশারায় তূর্যকে চলে যেতে বলল। তূর্যও উঠে চলে গেলো। মাওশিয়াত ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে বলল,
“ওই, তোমার কি সমস্যা? ফোন ধরছো না কেন?”

ইমন আমতা-আমতা করে বলল, “খেয়াল করি নি।”

“তোমার খেয়াল কোথায় থাকে? বাসায় আসতে বলেছিলাম, মনে নেই?”

“মনে আছে তো!”

“তো আসছো না কেন?”

“একটু পর বের হবো।”

“শুনো, আমি তোমাদের অপেক্ষায় বসে আছি৷ আমি কোথাও যাচ্ছি না আজকে। তোমরা সবাই আসবে, থাকবে, খেয়ে-দেয়ে তারপর রাতেই বাসায় ফিরবে। আমার কাজিনরাও আসবে। তাড়াতাড়ি আসো। আর শতাব্দীকেও আসতে বলেছি। তোমরা ওকে আসার সময় নিয়ে আসবে কিন্তু। ওকে ফেলে আসবে না। আর তাহমিদের জন্য বাবা গাড়ি পাঠাবে বলেছে। গাড়িটা ওতো বেশি বড় না। সামনে পেছনে তিনজনই বসতে পারবে। তোমরা যেকোনো দুইজন তাহমিদের সাথে চলে এসো৷”

“গাড়ি পাঠাতে হবে না…”

মাওশিয়াত ইমনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখো, আমার বাবার উপর কথা বলো না তো।”

ইমন চুপ করে রইল। মাওশিয়াত ‘বাই’ বলে কল কেটে দিলো।

৫৮.

তূর্য তাদের পুরোনো মহল্লার গলিতে রিক্সা দাঁড় করিয়ে শতাব্দীকে মেসেজ করলো। শতাব্দী মেসেজ দেখে বেরিয়ে এলো। তূর্য শতাব্দীকে দেখে রিক্সা থেকে নেমে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শতাব্দী হেসে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থেকো না। চলো।”

তূর্য বলল,
“আমার এই অবস্থা, তাহমিদ তো হুইলচেয়ার থেকেই পড়ে যাবে।”

শতাব্দী লাজুক হেসে রিক্সায় উঠে বসল। আর বললো,
“তুমি কি এখন উঠবে?”

তূর্যও এবার উঠে বসলো। আর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তুমি তো আমার টুইংকেলকেও অনেক কিছু শেখাচ্ছো!”

“হ্যাঁ, ও শিখতে চাইলো। আর আমারও এমন ভিডিও বানানোর ইচ্ছে ছিল। তাই ভিডিও করেই ওকে পাঠিয়ে দিলাম।”

এদিকে আহনাফ তূর্যের মেসেজ দেখে বলল,
“ওরা বের হয়েছে। আমরাও তাহলে বেরিয়ে পড়ি।”

আরাফ বলল,
“আমার একটা জায়গায় যেতে হবে। তোরা যা, আমি পরে আসবো।”

“কোথায় যাবি?”

“একটা বন্ধুর বাসায় যাবো।”

আরাফ চলে যাওয়ার পর তাহমিদ, ইভান আর ইমন গাড়িতে উঠলো। আহনাফ অরুণিকাকে নিয়ে রিকশায় উঠে পড়লো৷ রিকশায় উঠার পর থেকেই অরুণিকার বকবকানি শুরু হয়ে গেলো। আর আহনাফ মনোযোগ দিয়ে সেই কথাগুলো শুনছে। মাওশিয়াতের বাসার কাছে আসতেই অরুণিকা রিকশা থেকে নামার জন্য আহনাফের দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহনাফ সেকেন্ড খানিক সেই হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তার হাতটিও এগিয়ে দিলো। অরুণিকার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিতেই তার মনে পড়ে গেলো, সেই গ্রীষ্মের দিনটির কথা।

সেদিন আহনাফের খুব জ্বর ছিল। সে স্কুলে যেতে পারে নি। তাই দুপুর পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিলো। তার মা-চাচীরা রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কারণ দুপুরে মৈত্রী গ্রুপের একজন ইনভেস্টর তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাইরের দেশ থেকে আসবেন। তারা দুপুরে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করবেন। তাদের জন্যই বাসায় তোড়জোড় চলছিল। সেই মুহূর্তে অরুণিকাকে দেখার জন্য কেউই ছিল না। তাই আহনাফের মা অরুণিকাকে ছেলের পাশে শুইয়ে দিয়ে বললেন,
“আহু, বাবা। অরুকে তোর পাশে রেখে গেলাম। দেখিস ওকে। আমার কাজ আছে। তোর চাচীরাও ব্যস্ত। বুঝেছিস, বাবা?”

আহনাফ অরুণিকার দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলো, সে চোখ পিটপিটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ তাকে দেখেই বালিশটা মাথার উপর দিয়ে পা ধাপিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“পারবো না আমি।”

মিসেস আনিস চৌধুরী, ছেলের কথায় পাত্তা না দিয়েই চলে গেলেন।
অরুণিকার বয়স তখন মাত্র কয়েক মাস চলছিল৷ সে নিজের হাত-পা নিয়েই খেলছিলো। আর আহনাফ নড়াচড়া করে উঠলেই আহনাফের দিকে বার-বার তাকাচ্ছিল। আহনাফ হঠাৎ তার উঁ উঁ শব্দ শুনে মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। অরুণিকা তাকে দেখেই হেসে দিলো। আহনাফ জোর করেই তার মুখটা বন্ধ করে দিল। ব্যস একটু পর অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। পাশে শুয়ে আহনাফ বলল,
“আরো, জোরে জোরে কাঁদো। তারপরই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। নয়তো আমি তোমাকে আরো কাঁদাবো।”

অরুণিকা কি বুঝলো কে জানে, কিন্তু আহনাফের কন্ঠ শুনে সে কান্না থামিয়ে দিলো। পাশ ফিরে আহনাফের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে রইল। আহনাফ তার দিকে ফিরে হাতটা পাশেই রাখলো। অরুণিকা হাতটার মধ্যে কি দেখলো, সে-ই জানে, উলটো হয়ে সে হাতটির দিকেই তাকিয়ে রইলো। আহনাফ অরুণিকার চোখ অনুসরণ করে তার হাতের দিকে তাকালো। আহনাফ হাত উঠিয়ে বলল,
“কি দেখছ, আমার হাতে?”

অরুণিকা হাতটি তার নাগালে পেয়েই ধরে ফেললো। আহনাফও বাঁধা দিলো না। অরুণিকা হাতটি মুখের কাছে এনে তার মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ার আগেই, এক ঝটকায় আহনাফ হাত সরিয়ে নিলো। আর অরুণিকা ভয়ে কেঁপে উঠল। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। আহনাফ এবার বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। মিসেস জুবাইয়ের আর দাদী অরুণিকার কান্নার শব্দ শুনে রুমে চলে এলেন। দাদী আহনাফকে ধমক দিতেই সে চেঁচিয়ে বলল,
“ও আমাকে বিরক্ত করছে। আমি ওকে কাঁদায় নি। ও আমার হাতে কামড় দিতে চাইছিল।”

দাদী বললেন,
“আহু, ওর দাঁত উঠেছে এখনো?”

মিসেস জুবাইয়ের শাশুড়ীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“মা, আহনাফেরও তো জ্বর উঠেছে। ওর তো বিশ্রাম দরকার৷ সেজো অরুকে এখানে না রেখে গেলেই পারতো। মা, আপনিই ওকে দেখেন। আমি রান্নাঘরে গেলাম।”

দাদী অরুণিকাকে কোলে নিয়ে আহনাফকে বললেন,
“আহু, দাদুভাই, তুমি অরুকে কাঁদাও কেন?”

আহনাফ মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আমার ওকে ভালো লাগে না।”

দাদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। আহনাফ চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো। আর ভাবতে লাগল, অরুণিকা হওয়ার পর থেকেই সে সবার বকা খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরাফকে তো কেউই বকছে না। সে না হয় একটা ভুল করে ফেলেছিল, তাই বাবা তাকে অরুণিকার জন্য সবার সামনে বকবে?

আহনাফের ছোটবেলার অভ্যাস, সে কোনো জিনিস হাতে পেলেই তার স্ক্রু খুলে ফেলে। অরুণিকার জন্য একটা দোলনা তৈরী করেছিলেন অরুণিকার বাবা, জুবাইয়ের চৌধুরী। আহনাফ সেই দোলনার স্ক্রু খুলে ফেলেছিল। আর কাউকে জানায়ও নি। তারপর যখন অরুণিকাকে সেখানে শুইয়ে দেওয়া হলো, এর কিছুক্ষণ পরই দোলনটা খুলে নিচে পড়ে গেলো। ভাগ্যিস দোলনার নিচেও একটা স্ট্যান্ড ছিল, যেখানে একটা বেড বসানো ছিল। আর অরুণিকা সেই বেডের উপর পড়ায় ব্যথা পায় নি। কিন্তু ভয় পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছিল। বাসার সবাই তার কান্না দেখে বুঝতেই পারছিলো না, সে ব্যথা পেয়েছে, নাকি ভয় পেয়েছে। এরপর ডাক্তার দেখে যাওয়ার পর সবাই নিশ্চিন্ত হলো। আর তারপরই দোলনায় স্ক্রু নেই দেখে আনিস চৌধুরী আহনাফকে সবার সামনে বকা দিলেন। এরপর থেকেই সে অরুণিকাকে পছন্দ করে না। আর অরুণিকাকে অপছন্দ করার আরেকটা বিশেষ কারণ আছে।

অরুণিকা আহনাফের হাত ছেড়ে দিতেই আহনাফ অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর মাওশিয়াতের বাসায় ঢুকতেই মাওশিয়াত তাদের ড্রয়িংরুমে বসালো।

চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৬||
#নতুন_মোড়

৫৯.
সায়ন্তনীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাফ। সায়ন্তনীর ভাই সায়ান দোকান থেকে সকালের নাস্তা কিনে বাসায় ফিরে আরাফকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরল৷ আরাফ ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো। সায়ান চেঁচিয়ে মাকে ডেকে বলল,
“আম্মা, দেখো না কে এসেছে।”

তারপর আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আসো না ভাইজান। ভেতরে আসো।”

সায়ন্তনীর মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আরাফকে দেখে তার চোখের পানি উপচে পড়লো। তিনি ভেতর থেকে একটা চাটাই এনে মাটিতে বিছিয়ে একটা ময়লা উড়না দিয়ে তা মুছে দিতে লাগলেন। আরাফ তাকে থামিয়ে বলল,
“আন্টি, আমি সায়ন্তনীর সাথে দেখা করতে এসেছি।”

সায়ন্তনীর নাম শুনে তার মায়ের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ তিনি আরাফের হাত ধরে বললেন,
“আমি কতো খুঁজেছি তোমাদের, জানো, বাবা? ছোট বাবু কোথায়? ও আসে নি?”

কথাটি বলেই সায়ন্তনীর মা এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ছোট বাবু!”

সায়ান বলল,
“ইমন ভাইজান! উনি আসবে না? আপা বলল, ভাইজান দেশের বাড়ি গেছে। এখনো কি আসে নি?”

আরাফ কোনো উত্তর দিতে পারলো না। সায়ন্তনীর মা বললেন,
“বাবুর কথা মেয়েটা সারাদিন বলে। হায়রে আমার মেয়েটা! আল্লাহ আমাদের এতো কষ্ট দেখাচ্ছেন কেন?”

কথাটি বলতে বলতেই তিনি কেঁদে দিলেন। সায়ান বলল,
“ভাইজান, আপা অনেক অসুস্থ। ডাক্তার বাবু বলেছেন, আপা আর ভালো হবে না। তুমি তো ডাক্তারি পড়ছো, তাই তোমার কলেজের ওখানে গিয়ে তোমাকে অনেক খুঁজেছি। আপার দোকানেও আসো না এখন। গেল এক সপ্তাহ ধরে আপা দোকানেও যায় নি। আমিই বসেছিলাম। কিন্তু তোমাদের কাউকে দেখি নি। ইমন ভাইজান দেশের বাড়ি থেকে কবে আসবে? আপা ভাইজানকে দেখলে অনেক খুশি হতো।”

আরাফের গলায় কথা আটকে গেছে। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে সায়ন্তনীর?”

“ডাক্তার বাবু বলল ক্যান্সার হয়েছে। এই রোগ নাকি ঠিক হয় না। অনেক টাকা লাগে।”

আরাফ আর শব্দ করতে পারলো না। এবার সায়ন্তনীর মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“বাবা, একটা টাকাও কেউ দেয় না। যাদের বাসায় ঝি’র কাজ করি, তাদের অনেক টাকা আছে। তবুও দেয় না। আমার মেয়েটা কি বাঁচবে না, বাবা?”

আরাফ বলল, “ও কোথায়?”

সায়ান বলল, “আপা ঘরে আছে।”

সায়ান তার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলো। আরাফ সায়ন্তনীকে দেখে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সায়ন্তনী পাশ ফিরে আরাফকে দেখে মলিন হাসলো। আরাফ সায়ন্তনীর পাশে এসে বসলো। সায়ন্তনী ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কেমন আছো, আরাফ?”

আরাফ কোনো উত্তর দিলো না। সে এখনো সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার সবকিছু খারাপ স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সায়ন্তনী মাথা তুলে বলল,
“আমি তো ভেবেছি কেউই আসবে না৷ আর তোমরা ছাড়া আমার কোনো ভালো বন্ধু হয় নি। এখন তোমাদেরও হারিয়ে ফেলেছি।”

আরাফ সায়ন্তনীর হাত ধর‍তে গিয়েও ধরলো না। সায়ন্তনী বলল,
“আল্লাহ, আমাকে পাপের শাস্তি দিচ্ছে। ইমনকে ভালোবেসে পাপ করে ফেলেছি হয়তো। আরাফ, নিজেকে খুব কলুষিত মনে হচ্ছে। নিজের উপরই নিজের বিরক্ত এসে গেছে। সারাদিন জ্বর, মাথা ব্যথা, কাঁশি। এতো রোগ কি ভালো লাগে, বলো? এখন মরে গেলেই এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো।”

আরাফ কোনো কথায় বলছে না। সায়ন্তনী আবার বলল,
“এই রোগ আল্লাহর নেয়ামত হয়ে এসেছে। আমি এতোদিন মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি চেয়েছি। আল্লাহ আমাকে শারীরিক কষ্ট দিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে।”

কথাগুলো বলতে বলতেই সায়ন্তনীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আরাফ পাশে পড়ে থাকা রিপোর্টগুলো দেখে বুঝলো, সায়ন্তনীর এখন লাস্ট স্টেজ। আরাফ বলল,
“এতোদিন ধরে তুমি অসুস্থ ছিলে, অথচ কাউকে জানাও নি!”

“আমি বুঝতে পারি নি, আরাফ। এতো বড় রোগ হবে ওটা কল্পনাও করি নি। আমি তো ভেবেছিলাম, অনেকদিন বাঁচবো। মা-ভাইয়ের জন্য আমার বাঁচা উচিত। এখন আমি মরে গেলে ওদের কে দেখবে?”

সায়ন্তনীর কথায় আরাফের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সায়ন্তনীর মা চাটাইয়ের উপর পান্তা ভাত মেখে ছেলেকে খেতে দিলেন৷ আরাফ বেরুতেই তিনি বললেন,
“বাবা, আজ ইদ। তুমি এসেছো অথচ তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারছি না। ভাত ছাড়া বাড়িতে কিছু নেই। মেয়েটা অসুস্থ। ওকে দেখতে হচ্ছে, তাই বাজার-সদাই করতে পারি নি।”

এবার তিনি আঁচলের বাঁধন থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে দিয়ে বললেন,
“কিছু খেয়ে নিও। ইদে এসেছো, কিছু খেতে দিতে পারলাম না।”

আরাফ সায়ন্তনীর মায়ের মলিন হাসিটা দেখে টাকাটা নিয়ে বলল,
“ইদ মোবারক, আন্টি। এখন চলি।”

আরাফ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টাকাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। আর তার চোখ দুটি ছলছল করছে। অর্ধেক পথ যেতেই সে রাস্তায় বসে পড়লো। তার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। এদিকে ফোনে রিং বাজলো। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো আহনাফের কল। আরাফ কল ধরতেই আহনাফ বলল,
“কোথায় তুই? আসবি না?”

আরাফ ফুঁপিয়ে উঠলো। আহনাফের আশেপাশে মাওশিয়াত ও তার কাজিনরা বসে আছে। সে একপাশে এসে বলল,
“কি হয়েছে আরাফ?”

আরাফ ভেজা কণ্ঠে বলল,
“আমি অলক্ষুণে, আহু। অলক্ষুণে আমি।”

আরাফ কথাটি বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো। আহনাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুই এখন কোথায়?”

আরাফ রোডের নাম বলতেই আহনাফ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো। তূর্য ইভানকে বলল,
“আহনাফকে দেখে মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। ও এভাবে হুট করে কোথায় গেলো?”

ইভান সাথে সাথেই আহনাফকে ফোন করলো। আহনাফ ফোন ধর‍তেই ইভান বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”

আহনাফ বলল,
“আমি তোদের পরে বলবো। আমি এখন রাখছি।”

আহনাফ রিক্সায় উঠে আরাফের বলা জায়গায় চলে গেলো। কাছাকাছি আসতেই রাস্তায় আরাফকে বসা দেখে আহনাফ ভয় পেয়ে গেলো। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দৌঁড়ে আরাফের কাছে গেলো। আরাফ আহনাফকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আহনাফ তার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল,
“কি হয়েছে বল? এভাবে কাঁদছিস কেন? আরাফ, কি হয়েছে, ভাই। বল না।”

আরাফ আহনাফের হাত ধরে বলল,
“মামা ঠিকই বলেছিল, আমি অলক্ষুণে।”

“হঠাৎ তোর মামার কথা কেন বলছিস?”

“জন্মের তিন বছর পর মাকে হারিয়ে ফেললাম। এরপর রুহানি, এরপর বাবা, আর আমার সম্পূর্ণ পরিবার, এখন সায়ন্তনীও। এভাবে কেউ সব হারায়? একটা মানুষই কেন সবকিছু হারাবে? তার জন্য কি কিছুই বাকি থাকা উচিত না?”

“সায়ন্তনীর কি হয়েছে?”

“ক্যান্সার।”

আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর আরাফকে উঠিয়ে বাসায় নিয়ে গেলো। তূর্য ফোন দিতেই আহনাফ বলল,
“আরাফের শরীর ভালো না। আমি ওর সাথে আছি।”

তূর্য বলল,
“কিছু একটা তো হয়েছে। বল কি হয়েছে।”

“আরাফ সায়ন্তনীর বাড়িতে গিয়েছিল। ওখানে গিয়ে জানলো, ও অসুস্থ। ওর ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ।”

তূর্য অবাক হয়ে বলল,
“কি বলছিস এসব? একমাস আগেও তো ও ঠিক ছিল।”

“ঠিক ছিল না। ঠিক থাকার চেষ্টা করতো। টাকার জন্য ডাক্তার দেখায় নি।”

“মেয়েটা কি পাগল! এটা কোনো কথা?”

“কি বলবো আর ভাই! এখন ওর চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে। আরাফ ওর সিনিয়রকে ফোন দিলো একটু আগে। বিকেলে সায়ন্তনীকে নিয়ে যেতে বলেছে। তারপর ট্রিটমেন্ট শুরু করবে।”

ইভান তূর্যকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? কার কথা বলছিস?”

তূর্য কল কেটে রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই তো আর কথায় বলিস না।”

মাওশিয়াত বলল, “কি হয়েছে, তূর্য?”

“সায়ন্তনীর ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ চলছে। অথচ আমরা কেউই জানি না।”

ইমন কথাটি শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাওশিয়াত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহমিদ বলল,
“আমাদের এখন ওখানে যাওয়া উচিত।”

সবাই চলে যাওয়ার পর মাওশিয়াতের মা এসে বললেন,
“কি হয়েছে মৌ। ওরা সবাই চলে গেল কেন?”

মাওশিয়াত তার মাকে সবটা খুলে বলতেই তিনি মাওশিয়াতকে সায়ন্তনীর বাসায় যেতে বললেন।

মির্জা বাড়িতে বড় বড় ইনভেস্টার আর ব্যবসায়ীদের ভীড়। মির্জা গ্রুপের এমডি সাহিল মির্জা ব্যবসায়ীদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করছে। সাহিল মির্জার বাবা, শাহেদ মির্জা গ্রুপের চেয়ারম্যান, তিনি সোফায় বসে ব্যবসায়ীক আলাপ-আলোচনা করছেন। তখনই সিঁড়ি দিয়ে হনহনিয়ে নেমে পড়লো তার কনিষ্ঠ কন্যা সানায়া মির্জা। মেয়েকে বের হতে দেখে তিনি বললেন,
“এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছো?”

সানায়া বুকে হাত গুঁজে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
“আমি বাসায় কখন আসছি, কখন যাচ্ছি, এই বিষয়ে আপনি কবে থেকে প্রশ্ন করা শুরু করেছেন?”

শাহেদ মির্জা তার পাশে থাকা অতিথিদের দিকে এক নজর তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাবাকে উঠতে দেখে সাহিল অতিথিদের একপাশে বসতে বলে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। সানায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে নেবে, তখন সাহিল তাকে বলল,
“তুই বাবাকে কি বলেছিস?”

সানায়া বলল,
“তা তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করো।”

কথাটি বলেই ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে সানায়া ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। সাহিল সানায়াকে থামাতে যাবে তখনই একজন ইনভেস্টর তাদের সামনে এসে বলল,
“কি অবস্থা শাহেদ সাহেব?”

শাহেদ মির্জা বললেন,
“জ্বি, ভালো।”

“মিস্টার সাহিল তো এবার আপনার কোম্পানিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবারের সেরা কোম্পানিগুলোর তালিকায় মির্জা গ্রুপের নাম প্রথমে।”

সাহিল কথাটি শুনে হাসলো। তখনই লোকটি আবার বলল,
“কিন্তু একটা সময় ছিল মৈত্রী গ্রুপের উপরে কোনো গ্রুপই ছিল না।”

শাহেদ মির্জা কথাটি শুনে অন্য প্রসঙ্গ তুলে বললেন,
“ওহ, আপনি ফাইভ নাইন প্রজেক্টের কাজটা দেখবেন না?”

তারপর তিনি সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“সাহিল, তুমি উনাকে আমাদের প্রজেক্টের কাজটা দেখিয়ে আনো।”

সাহিল লোকটাকে নিয়ে সামনে এগুতে লাগলো। লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“সবাই জানে মৈত্রী গ্রুপের আসল শত্রু কে? কিন্তু যেদিন সেই ঘটনা প্রমাণিত হবে, মির্জা গ্রুপের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।”

সাহিল বলল,
“দেখুন মিস্টার। শত্রু আর খুনীর মধ্যে অনেক পার্থক্য। সব শত্রু খুনী হয় না, তবে সব খুনীরাই শত্রু হয়। এখন মির্জা গ্রুপকেই আলাদাভাবে টার্গেট করাটা ভালো দেখাচ্ছে না। আর যখন প্রমাণিত হওয়ার প্রশ্ন আসবে, তখন দ্বিতীয় প্রশ্নটা বরং আমিই করি।”

“কি প্রশ্ন!”

“মৈত্রী গ্রুপের আর কোন উত্তরাধিকারী জীবিত আছে যে সেই রাতটা আবার পুনরুদ্ধার করবে? সেই রাত এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। আর ইতিহাসে সাসপেন্স থাকা ভালো।”

এদিকে সানায়া গাড়ি নিয়ে তার বান্ধবী রাহির বাসায় চলে এলো। রাহি সানায়াকে দেখে বলল,
“এভাবে চলে এলি যে! ইদের জামাটাও পরে এলি না।”

সানায়া চেঁচিয়ে বললো,
“ইদ? আমার জন্য কোনো ইদ আসে নি। প্রতিবছর ইদের আগে টাকা দিয়ে বলবে যাও ইদের কেনাকাটা করে আসো। নিজে তো কখনো আমাকে শপিংয়ে নিয়ে যায় নি। আবার ইদের দিন কোনো ডাকাডাকি নেই। ঘর ভর্তি ওদের ফার্মের মোরগ-মুরগিদের ভীড় থাকবে। ভাইয়া আর মিস্টার মির্জা সেই ফার্মের মোরগদের নিয়েই এখন ব্যস্ত।”

রাহি সান্ত্বনার সুরে বলল,
“সানায়া, ঠান্ডা হয়ে বস। চল, আমার সাথেই ঘুরতে যাবি।”

“প্রতিবছর তোর সাথেই তো যাই।”

“আচ্ছা, আচ্ছা। আগে কিছু খেয়ে নে। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”

“না, খাবো না আমি। মিস্টার মির্জা কি একবারো আমি খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করেছে? তার তো ছেলে খেলেই চলবে। আমি তো তার কেউই না।”

সানায়া এসব বলতে বলতেই পা ধাপিয়ে কাঁদতে লাগলো। রাহি তাকে শান্ত করার জন্য তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আংকেল তোকে অনেক ভালোবাসে। আর মাঝে মাঝে বাবারা ভালোবাসা প্রকাশ করে না। কিন্তু সন্তানদের তা বুঝে নিতে হয়। সাহিল বলেছিল…”

সানায়া রাহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“সাহিল ভাইয়ার কথা আমাকে বলিস না।”

“এভাবে বলিস না। সাহিল তোকে অনেক ভালোবাসে।”

“প্লিজ, রাহি। তোর প্রেমিক তাই তুই ওর পক্ষ নিচ্ছিস। তুই বায়াস হতে পারিস। আমি না। আই হেইট দেম।”

রাহি চুপ করে বসে রইলো। সানায়া আবার বলল,
“তোর চোখে সমস্যা ছিল, নয়তো তোর পছন্দ তো এতোটাও খারাপ ছিল না।”

বেল বেজে উঠায় রাহি বসা থেকে উঠে বলল,
“তুই বসে থাক। আমি আসছি।”

রাহি দরজা খুলতেই সাহিলকে দেখে চমকে উঠলো। সাহিল দরজায় হেলান দিয়ে রাহির পা থেকে মাথা অব্ধি দেখে বলল,
“গর্জিয়াস। বিনা সাজেই যাকে এতো সুন্দর লাগে, মির্জা গ্রুপের এমডির ওয়াইফ হলে তাকে তো রাণির মতো লাগবে।”

রাহি কোনো উত্তর না দিয়ে সাহিলকে বাসায় ঢোকার জন্য দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। সাহিল ঘরে ঢুকেই বলল,
“সানায়া এখানেই এসেছে, তাই না?”

“হুম।”

“আংকেল-আন্টি কোথায়?”

“বাবা বাইরে গেছে চাচাদের সাথে। মা রান্নাঘরে আছেন, নাস্তা বানাচ্ছে।”

“দাদী কোথায়?”

“তোমার অপেক্ষায় বসে আছে।”

সাহিল দাদীর ঘরে চলে গেলো। দাদীর পাশে বসে গল্প জুড়িয়ে দিলো। সানায়া ভাইয়ের কন্ঠ শুনে বিড়বিড় করে বলল,
“উফ! মিস্টার মির্জার ফ্রি বডিগার্ড এখানেও চলে এসেছে।”

রাহি রুমে ঢোকার আগেই সানায়া দরজা আটকে রাহির বিছানায় শুয়ে পড়লো।

রাহি আর সানায়া ছোট বেলার বান্ধবী। আর সাহিল সানায়ার বড় ভাই। সাহিল, সাবা আর সানায়া শাহেদ মির্জার তিন সন্তান। তাদের মা মিসেস মির্জার স্বামীর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তিনি একই বাসায় থাকেন৷ পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে তারা তালাক নেন নি। মূলত সমস্যাটা মিস্টার শাহেদেরই ছিল। তিনি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে এখন আর সেই সম্পর্ক নেই। এরপর থেকেই সাবা আর সানায়া বাবাকে খুব অপছন্দ করে। তবে সাহিল খুবই বাবা-মা ভক্ত। তার বাবা তার মানসিক শক্তি, আর মা তার দুর্বলতা। সাহিল রাহিকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। তবে রাহি যখন নবম শ্রেণিতে উঠেছিল, তখন এই সম্পর্কটা পুরোপুরি শুরু হয়৷ রাহির সাথে সম্পর্কে যাওয়ার পরই সাহিল মির্জা গ্রুপের এমডি নিযুক্ত হয়। সাহিল আর রাহির বয়সে পনেরো বছরের পার্থক্য৷ বর্তমানে রাহি আর সানায়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে৷
অন্যদিকে সাহিল সোজাসুজি কথাবার্তা বলতে পছন্দ করে, তাই রাহি যখন কলেজ পাশ করে ফেলল, তখনই সে রাহির পরিবারকে তাদের প্রেমের ব্যাপারে জানিয়ে দিলো। তবে মিডিয়ার কাছে রাহি সানায়ার বান্ধবী মাত্র। দুই পরিবারের সম্মতি থাকলেও তারা বিষয়টা এখনো কারো সামনেই প্রকাশ করে নি।

৬০.

জীবনটা যুদ্ধ ক্ষেত্র৷ এখানে টাকার জন্য যুদ্ধ করতে হয়। যার যতো টাকা, সে-ই জয়ী হয়।

তূর্য সেদিন তার জমানো টাকা দিয়ে সায়ন্তনীর মা, ভাই আর সায়ন্তনীকে জামা কিনে দিয়েছিল। আহনাফ আর ইভান নিজেরাই গিয়ে বাজার-সদাই করে সায়ন্তনীর বাড়িতে দিয়ে গিয়েছিল। শতাব্দী আর তাহমিদ তাদের বাসায় খাবার-দাবার রান্না করে পাঠিয়েছিল। আরাফ আর ইমন সায়ন্তনীকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ছুটাছুটি করেছে। মাওশিয়াত তার ক্লাসমেটদের নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে সায়ন্তনীর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করেছে।
তিন মাস কেটে গেছে। চিকিৎসা চলছে, তাই হয়তো সায়ন্তনী এখনো বেঁচে আছে। আজ ডাক্তার বলে দিয়েছে, চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেই সে মারা যাবে। আর চালালে আল্লাহ যতোদিন তাকে বাঁচায়, তবে তার হাতে বেশিদিন সময় নেই।

সায়ন্তনী কেমোথেরাপি দেওয়ার পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। মাওশিয়াত তার পাশে এসে বসলো। সায়ন্তনী মাওশিয়াতের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“পৃথিবীতে সবাই সব পায় না। আমিও হয়তো এই জীবনে যা চেয়েছি, পাই নি। কিন্তু এখন আর আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কেন জানো?”

মাওশিয়াত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সায়ন্তনী বলল,
“অনেক ভালো বন্ধু পেয়েছি। যারা জীবনের শেষ মুহূর্তে আমার বন্ধু হয়েছে, তারাই প্রকৃত বন্ধু। আমার তোমাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।”

মাওশিয়াত ভেজা কণ্ঠে বলল,
“আই এম সরি। আমি তোমাকে অনেক অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছি।”

“ওসব আগের কথা। আমি সব ভুলে গেছি। এখন এতোটুকু জানি, আমার ভাই একটা বোনের পরিবর্তে তিনটা বোন পেয়েছে। আমার মা এক মেয়ের পরিবর্তে তিন তিনটা মেয়ে, আর ছ’টা ছেলে পেয়েছে। আমার মা আর ভাইকে তোমরা দেখবে তো?”

মাওশিয়াত মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

এদিকে আরাফ শুকনো মুখে হাসপাতালে বসে আছে। অনেকদিন সে নিজের দিকেই তাকায় নি। তূর্য তার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে সে আরাফকে এতোটা বিধ্বস্ত কখনোই দেখে নি। তূর্য আরাফের কাঁধে হাত রাখতেই আরাফের বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এখন শুধু নিশ্চুপ অপেক্ষায় দিন কাটছে। প্রতিটি সেকেন্ডই ভীতি নিয়ে আসছে, যদি এখনই কোনো খারাপ খবর আসে?

অন্যদিকে তাহমিদ এখন ক্রাচের উপর ভার দিয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না। ক্রাচের সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসতে পারে। তাই এখন আর কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। থেরাপি দেওয়াতে অনেক লাভ হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে আরো দুই-একমাস পর পুরোপুরি হাঁটতে পারবে। শুধু নিয়মিত ওষুধটা খেতে হবে।

রাত দুইটা। ইমন জায়নামাজে বসে কাঁদছে। ইভান মেঝেতে বসে আছে। আর তাহমিদ তাদের পাশেই বসে রইলো। ইমন মোনাজাত শেষে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই, ওর কিছু হবে না তো?”

ইভান কোনো উত্তর দিলো না। ইমন জায়নামাজে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ তার ইচ্ছেটা যেন পূর্ণ হওয়ার নয়। হঠাৎ সায়ন্তনীর শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আরাফ, তূর্য আর আহনাফ সেখানেই গিয়েছে। রাত আড়াইটায় আহনাফ বাসায় ফোন দিলো। ইমন ফোনের শব্দ শুনেই সব বুঝে গেলো। সে জায়নামাজে বসেই কেঁদে দিল। ইভান কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিয়ে তাহমিদের দিকে এগিয়ে দিলো। তাহমিদ রিসিভ করতেই আহনাফ বলল,
“সায়ন্তনী আর নেই। তাহমিদ, আমরা আরাফকে সামলাতে পারছি না। ও এভাবে কাঁদছে কেন ভাই? কি করবো এখন?”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আর বলল,
“ওকে হাসপাতাল থেকে কখন আনবি?”

“একটু পর। এখানেই দাফন করাবে ফজরের নামাজের পর।”

“আমরা আসছি।”

ফোন রেখেই তাহমিদ বলল,
“সায়ন্তনীকে ফজরের নামাজের পর দাফন করাবে।”

তাহমিদ শতাব্দীকে মেসেজ দিয়েই অরুণিকাকে ঘুম থেকে উঠালো। তারপর সবাই সায়ন্তনীদের বাড়িতে গেল। আশেপাশে অনেক মহিলা এসে ভীড় জমিয়েছে। মাওশিয়াত জানার পর সায়ন্তনীদের বাসায় আসার জন্য অনেক কান্নাকাটি করছিল। শেষমেশ মাওশিয়াতের মা তার সাথেই এলেন৷ সায়ন্তনীকে বাড়িতে ঢুকানো হলো। আরাফ একপাশে বসে কাঁদছে। আহনাফ তার পাশে বসতেই সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি ওকে বলতেই পারলাম না, যে আমার ওকে ভালো লাগে। আমি ওকে আমার অনুভূতির কথাটাই জানাতে পারি নি। এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আহু।”

আহনাফ আরাফকে জড়িয়ে ধরলো। তূর্যও আরাফের মাথায় হাত রাখলো। তার মনে পড়ে গেলো রুহানির মৃত্যুর কথা।
সেদিন রুহানি আরাফের সাথে প্রতিদিনের মতো মাঠে ফুটবল খেলছিল। রুহানির ফুটবল খেলতে খুব ভালো লাগতো। তারা খেলা শেষে মাঠের একপাশে এসে দাঁড়ালো। তখনই দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক যুবক, তাদের দেখে মাঠে এলো। এরপর তারা রুহানিকে আরাফের সামনেই টেনে নিয়ে গেল। আরাফ তাদের আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় আরাফ তাদের সাথে পেরে উঠতে পারে নি। তারা এক ধাক্কায় আরাফকে দূরে সরিয়ে দিলো। এরপর পাশের একটা নির্মাণরত বাড়ির তিনতলায় নিয়ে গিয়ে রুহানিকে ধর্ষণ করলো। আরাফ তাদের আটকানোর জন্য আশেপাশের অনেকজনকে ডাকলো। কিন্তু কেউই এগিয়ে এলো না। আরাফ তখন নিজেই গেলো। কিন্তু রুহানির অবস্থা দেখে সে নিজেও আর তাদের আটকানোর সাহস পেলো না৷ সে অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এরপর সেই অবস্থায় সে একটা গাড়ি নিয়ে বাসায় এসে বাবা-চাচাদের জানালো। তারা পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে শুধু রুহানিকেই পেলো। সেই ছেলে দুইটাকে আর পেলো না। এরপর রুহানিকে হাসপাতালে ভর্তি করার চারদিন পর সে মারা গেল। পরে অবশ্য সেই ছেলে দুইটাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে আরাফ নিজেকে রুহানির অপরাধী ভেবে এসেছে। আরাফ এতোটা বছর রুহানিকে মনপ্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছিল। আর এখন দ্বিতীয় বারও কাউকে ভালোবেসে হারিয়েছে।

জীবনে সবাই সবকিছু পায় না। আর এই না পাওয়ার মাঝেই জীবনের সমাপ্তি ঘটে যায়। জীবনে আক্ষেপ রেখে লাভ নেই, কারণ সৃষ্টিকর্তা হয়তো সেই আক্ষেপের মাঝেই কোনো মুক্তি রেখেছেন। দিনশেষে মুক্তিটাই আক্ষেপের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অভাগী সায়ন্তনী তার দুর্ভাগ্য নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আর এই জীবনসংগ্রাম থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছে। তার গুরুত্বটাও মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে।

চলবে–

(💜কালকে পরশু দুইদিন বোনাস পর্ব আসবে। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here