#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৮||
৬৫.
তূর্য কটেজে ফিরেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই মুহূর্তে তার উপমাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু ফেইসবুকে এতো এতো কমেন্টের ভীড়ে সে উপমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এবার সে ইন্সটাগ্রামে ঢুকলো। অনেকগুলো মেসেজের ভীড়ে পেয়ে গেলো উপমা সিদ্দিকার নাম। ছবি দেখেই তূর্য উপমাকে চিনে ফেলল। এবার সে ইনবক্সে ঢুকলো। পুরো ইনবক্স জুড়ে, “হাই, হ্যালো, একটু তো রিপ্লাই দাও,” এমনই মেসেজ এসেছে। আরো উপরে স্ক্রল করতেই দেখলো উপমা তাকে বিভিন্ন উপলক্ষে ছবি এঁকে শুভেচ্ছা দিয়েছে। আরো উপরে একটা ছবি দেখে থমকে গেলো তূর্য। তার গিটার হাতে একটা ছবি প্রিন্ট করে বাঁধিয়ে উপমা রুমের দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছে, আর পাশে উপমা শাড়ি পরে একটা গোলাপ ফুল এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য ছবিটি দেখে আনমনেই হাসলো। তখনই আহনাফ তার পাশে বসে বলল,
“একা একা হাসছিস কেন?”
তূর্য ফোনটা আহনাফের দিকে এগিয়ে দিলো। আহনাফ সব মেসেজ ভালোভাবে পড়ে বলল,
“মনে হচ্ছে, মেয়েটা তোর জন্য পাগল।”
তূর্য হেসে বলল, “হ্যাঁ।”
আহনাফ তূর্যের মিষ্টি হাসি দেখে একটু নড়েচড়ে বসলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তুই আগে তো কখনো ইনবক্সে ঢুকিস নি। আর আজ হঠাৎ!”
“এই মেয়েটাই গতকালকের সেই মেয়েটা। আজ সকালেও ওর সাথে দেখা হয়েছে। কথার ফাঁকে জানলাম ও রিকির ভক্ত।”
আহনাফ অবাক হয়ে বলল,
“বাহ, কাকতালীয় ভাবে তোর ভক্ত তোর দেখাও পেয়ে গেলো, আর চিনলোও না!”
“হ্যাঁ।”
“এখন তোর এই হাসির রহস্য কি! প্রেমে পড়ে গেছিস নাকি!”
“আরেহ ধুর, প্রেম-টেম আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু এতো বড় সুযোগ হাতছাড়াও করা যায় না।”
“তো কি করবি এখন?”
“মেয়েটার সাথে কথা বলবো। দেখি জল কতোটুকু গড়ায়।”
আহনাফ মনে মনে হাসলো। আর বলল,
“জল গড়িয়ে সমুদ্র হলেই আমি বাঁচি। অন্তত অরুর দিক থেকে তো মনোযোগ সরাবে।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুই হাসছিস কেন?”
আহনাফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“মেয়েটা অনেক সুন্দরী। মাওশিয়াত, শতাব্দী এদের চেয়েও সুন্দর। তোদের ভালোই মানাবে।”
তূর্য বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
“মনে হচ্ছে আমার চেয়ে তুই বেশি খুশি। পছন্দ হলে বল। তোর সাথেই সেটিং করিয়ে দেবো।”
আহনাফ চোখ ছোট করে বলল,
“তোর পাগলা ভক্ত আমার প্রেমিকা হলে দু’দিনও আমার সংসার ঠিকবে না। তোর ভক্ত নিয়ে তুই থাক, আমি গেলাম।”
আহনাফ আনমনে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরুতেই অরুণিকার দেখা পেলো। অরুণিকা তাকে দেখেই বলল,
“আরাফ বলেছে তোমার কান টেনে দিতে। দেবো?”
এবার অরুণিকার পেছনে আরাফ এসে দাঁড়ালো, আর বলল,
“আজকে থেকে বাকি যতো দিন এখানে আছি, তুই আমার রুমে থাকবি। আর আমি ইমনের রুমে।”
আহনাফ বলল, “কেন?”
অরুণিকা বলল,
“এখন থেকে আমরা দু’জন তোমাদের দু’জনকে পাহারা দেবো। যে সিগারেট খাবে, তার কান টেনে দেবো।”
আহনাফ চোখ ছোট করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আমার কান টানবে?”
আরাফ বলল,
“সম্মান বাঁচাতে হলে বদ অভ্যাস ছাড়তে হবে।”
আহনাফ হনহনিয়ে তাদের সামনে থেকে চলে গেলো। আহনাফ চলে যাওয়ার পর অরুণিকা আর আরাফ হাই-ফাইভ দিয়ে একসাথে বলে উঠল,
“মিশন, সিগারেট ছাড়ানো।”
এদিকে শতাব্দী অনেকক্ষণ ধরে তাহমিদ আর আরাফের ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কল ঢুকছে না। তার মন খুব ছটফট করছে। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু একটা হবে। সে ঘরে ঘরে পায়চারি করছিলো, তখনই তার পিসি এসে দরজায় কড়া নাড়লো। শতাব্দী দরজা খুলতেই তিনি ভেতরে ঢুকে বিছানায় পা তুলে বসে পড়লেন। তারপর হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,
“শ্রীজা। ও শ্রীজা, কোথায় মরেছিস! এদিকে আয়।”
শ্রীজা দৌঁড়ে ভেতরে এলো।
শ্রীজা হচ্ছে শতাব্দীর ছোট বোন। পিসি মা ছাড়া সবাই তাকে পুচকি বলেই ডাকে। সে পিসিকে জমের মতো ভয় পায়।
শ্রীজা পিসির পাশে দাঁড়িয়ে ভীত কন্ঠে বলল,
“জ্বি পিসি মা! ডেকেছো আমায়?”
“হ্যাঁ, ডেকেছি। তোর দিদিকে দেখা যার সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলাম, তার বিয়ের ছবি।”
শ্রীজা এদিক-ওদিক তাকিয়ে ধীর পায়ে রুম থেকে বের হয়েই দৌঁড়ে চলে গেলো, আবার কোথা থেকে একটা ছবি এনে দৌঁড়ে শতাব্দীর রুমে ঢুকলো। পিসি মা গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“শতাব্দী, দেখ ছবিটা।”
শ্রীজা ছবিটি বোনের হাতে দিতেই শতাব্দী তা নিয়ে নিচে ফেলে দিলো। পিসি রাগী কন্ঠে বললেন,
“এতো টুকুন মেয়ের এতো দেমাগ থাকা ভালো না! বিয়ের বয়স হয়ে গেছে তোর। একটা ছোট বোন আছে। তোর বিয়ে না দিলে এরও বিয়ে হবে না। আমি বুঝি না, এতো পড়াশোনা করে কি এমন করবি!”
শতাব্দী ঠান্ডা গলায় বলল,
“পড়াশুনা করবো কি করবো না, এটা একান্ত আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখন যে আমি বিয়ে করছি না, এটা নিশ্চিত করেই বলছি।”
“বিয়ে তো তোকে এই ঋতুতেই দেবো। আমার বাড়ির পাশেই এক নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে। ছেলের মুখ খানা দেখলে চোখ ভরে যায়। ছেলে আবার যেমন তেমন না, আর্মিতে জয়েন করেছে। খুব শীঘ্রই বড় অফিসার হবে। আমি তোর বাবাকে বলেছি, তাদের ছেলে পছন্দ হয়ে গেছে। কারো কোনো আপত্তি নেই। তোর মা তো এখুনি কন্যাদান করতে পারলেই খুশি। এমন সুপাত্র তো আর হাত ছাড়া করা যায় না।”
শতাব্দী কোনো উত্তর না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে মায়ের কাছে গেলো। মা তাকে দেখেই বুঝলেন সে কেন এসেছে। তিনি বললেন,
“মা রে, ছেলেটা সত্যিই ভালো। সেনাবাহিনীতে আছে। কতো সম্মান পাবি তুই জানিস? না করিস না, মা। এমনিতেই তোর বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।”
শতাব্দী ভেজা কণ্ঠে বলল,
“মা, প্লিজ ওমন কথা বলো না। তোমরা আমাকে জোর করো না, মা। আমি বিয়ের জন্য একদমই প্রস্তুত নই।”
হঠাৎ তিনি গলার স্বর উঁচু করে বললেন,
“আমি এতো কিছু শুনবো না। তোর বাবা রাজি আছে। এমন ছেলে পাগলেই হাত ছাড়া করবে। আগে দেখ ওরা তোকে পছন্দ করে নাকি! ছেলের যা চেহারা, নজর না লাগুক।”
মায়ের কথা শুনে শতাব্দী দমে গেল। মা এর আগে কোনো বিয়ের সম্বন্ধে এতো আগ্রহ দেখায় নি। এই সম্বন্ধ নিয়ে তার এতো আগ্রহ দেখে এবার সত্যিই শতাব্দীর বুক ঢিপঢিপ করছে। শতাব্দী এবার বাবার কাছে গেলো। সেখানেও বাবার একই আগ্রহ। তিনি মেয়েকে বুঝিয়ে বললেন যে এখনই বিয়ে করার উপযুক্ত সময়। শতাব্দীকে মাস্টারমশাই সব ব্যাপারেই সমর্থন করেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তার বাবা তার পক্ষেই নেই। আর বাবার উপর সে কথা বলার সাহসও পাচ্ছে না। কারণ আগে কখনো এমন পরিস্থিতি আসেনি।
শতাব্দী এবার ফোন নিয়ে ছাদে চলে গেলো। সে তাহমিদকে একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে, কিন্তু কল ঢুকছে না। এবার শতাব্দী মাওশিয়াতকে কল করল। মাওশিয়াত কল ধরতেই সে তার বিয়ের কথা জানালো। মাওশিয়াত বলল,
“তুমি কি বিয়ে করতে চাইছো না?”
“না।”
“কিন্তু কেন? এখন তো বিয়ে করার সময়। আর ছেলে যদি তোমাকে পড়াশুনা করাতে চায়, তাহলে তো মন্দ হয় না।”
“তুমি তো বিয়ে করছো না!”
“আরেহ, আমি বিয়ে করবোই বা কি করে, ইমন তো এখনো ব্যাচেলর। ওর আগে সেটেল হতে হবে। কিন্তু তোমার বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ কি?”
“আমি ভালোবাসি একজনকে..”
মাওশিয়াত ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কে সে!”
শতাব্দী কাঁপা কন্ঠে বললো, “তাহমিদ।”
মাওশিয়াত কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,
“শতাব্দী, কি বলছো তুমি! এই সম্পর্ক কেউ-ই মানবে না।”
“আমি তো মানছি।”
“শুনো, বোকার মতো কথা বলো না। এটা সম্ভব না। তাহমিদ তো মুসলিম। তোমার পরিবার এটা মানবে না।”
“আমি কি পালিয়ে যাবো?”
মাওশিয়াত ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না! কি যা তা বলছো! পালিয়ে গেলে তাহমিদ তোমাকে কোথায় রাখবে? কিইবা খাওয়াবে? ওরা নিজেরাই ঠিকভাবে চলতে পারছে না। একজন অন্যজনের টাকায় চলছে।”
“মাওশিয়াত, প্লিজ। কিছু একটা তো বলো। বাবা এই সম্বন্ধ নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে গেছে। এখন যদি কথা পাকাপাকি হয়ে যায়?”
“আগে বলো, তাহমিদ কি তোমাকে পছন্দ করে?”
“এখনো জানি না।”
মাওশিয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এটাও জানো না? আবার বিয়েও করতে চাইছো না!”
“ওকে বলার সাহস পাই নি।”
“আচ্ছা, দাঁড়াও। ওরা আগে আসুক। আমি ইমনকে বলবো তাহমিদের সাথে কথা বলতে।”
৬৬.
সাহিল চিন্তিত মুখে গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে। তার পাশেই সানায়া বসে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সাহিল গম্ভীরমুখে বলল,
“আমার আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এখন ওই সুলতান মুন্সীর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি!”
সানায়া বিরক্তির সুরে বলল,
“ক্যান ইউ প্লিজ স্টপ, ভাই? সারাদিন তোমাদের এই ওই গ্রুপের মারামারি যেন লেগেই থাকে। তোমরা দিন দিন হিংস্র হয়ে যাচ্ছ। আমি এসব আর নিতে পারছি না।”
“দেখ, সানায়া। এগুলো মারামারি না। এগুলোই বিজনেস করার টেকনিক। ব্যবসাকে উপরে তুলতে হলে এসব টেকনিক মেনে চলতে হয়।”
“আচ্ছা? তাই তুমি আর মিস্টার মির্জা মিলে আপুর সাথে অন্যায় করছো, যাতে তোমাদের বিজনেসে কোনো ঝামেলা না হয়!”
“দেখ, তুই এসবের জন্য এখনো ছোট। সুলতান মুন্সীর ছেলের সাথে সাবার বিয়ে দেওয়া অসম্ভব। ওদের তো বংশেই দোষ আছে।”
সানায়া চেঁচিয়ে বললো,
“আর আপু তো ওই ছেলেকেই বিয়ে করবে!”
“করলে করুক। ওকে সম্পত্তির ভাগই দেবো না। আর দেখিস এমন হলে সুলতান মুন্সী নিজেই তার ছেলেকে সাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। কারণ সুলতান মুন্সীর কাছে ভালোবাসার চেয়ে পদ গুরুত্বপূর্ণ। আর এই পদ একমাত্র টপ বিজনেসম্যান সাহিল মির্জায় তাকে দিতে পারবে।”
সানায়া ভাইয়ের কথা শুনে বিড়বিড় করে বলল,
“টপ বিজনেসম্যান না, টপ খচ্চর। এই খচ্চর ভাইটা হয়তো আমার বান্ধবীর জীবনটাই নষ্ট করে দেবে।”
সাহিল ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মিনমিন করে কি বলছিস?”
সানায়া শান্ত কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, একটু যদি এসব ছেড়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে, আমরা সবাই অনেক ভালো থাকতাম। এভাবে বডিগার্ড নিয়ে ঘুরতে হতো না।”
সাহিল এই কথার কোনো উত্তর দিলো না। সানায়া এবার রাগী গলায় বলল,
“ক্লাসের সবাই বলে আমার বাবা খুনী মন্ত্রী। সবাই বলে আমি ক্রিমিনাল বংশের মেয়ে। আমার ভাই ভালো না। একই কথা রাহিও শুনছে। ও সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকে। ও চায়, তুমি সাধারণ মানুষের মতো বাঁচো। আর তুমি?”
সাহিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সানায়া, আমি মির্জা গ্রুপের এমডি। কোটি কোটি টাকার মালিক। রাহির ভবিষ্যতে কিসের অভাব হবে?”
“ভালোবাসা আর সময়ের অভাব হবে। প্রাইভেসির অভাব হবে। এখন তো মিডিয়া আর বডিগার্ড ছাড়া কোথাও পা দেওয়া যায় না। আমার এসব অসহ্য লাগছে, ভাইয়া। আমি ট্যুর দিতে পারি না। বডিগার্ড আগে-পিছে ঘুরঘুর করে। আমি রেস্টুরেন্টে গেলেই আমার ছবি তুলে এখানে ওখানে ছেড়ে দেয়। আমি কোনো ছেলে ক্লাসমেটের সাথে বাইরে গেলে ওদেরকে আমার বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে দেয়। কি অদ্ভুত! এখন তো ক্লাসের কেউই আমার সাথে কথা বলে না।”
সানায়া সাহিলকে এসব বলে গাড়ি থামাতে বলল। এরপর সে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। গাড়ি থেকে নামতেই পেছনের গাড়িটাও থেমে গেলো। আর সাথে সাথে দু’জন বডিগার্ড নেমে এলো। সানায়া তাদের দেখে আবার গাড়িতে উঠে বসলো। সাহিল এবার বলল,
“তোকে এসব মেনে নিতে হবে।”
হঠাৎ একটা অচেনা নম্বর থেকে কল আসলো। সাহিল কল ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
“ওরা আসছে মির্জা সাহেব। বাবার কর্মফল ভোগ করার জন্য তৈরী তো?”
সাহিল ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কে বলছেন?”
একটা হাসির শব্দ ভেসে এলো। লোকটি আবার বলল,
“সেই রাত, সেই মুহূর্ত, সেই খুন, আর সেই খুনী সবকটাকেই আমি চিনি।”
সাহিল চেঁচিয়ে বলল,
“কে আপনি, কি সব আজেবাজে বকছেন?”
কল কেটে যাওয়ায় সাহিল হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। সানায়া ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আজেবাজে কাজ করলে আজেবাজে বকবেই। স্বাভাবিক!”
সাহিল বোনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই সে চুপ হয়ে গেলো।
এদিকে রাতে সম্পূর্ণ বিছানা দখল করে হাত পা মেলে অরুণিকা শুয়ে আছে। আহনাফ তার পা সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কোথায় ঘুমাবো?”
অরুণিকা উঠে বসে বলল,
“তা আমি কি করে বলবো?”
“দেখো, ফাজলামো করবে না। আমার ঘুম পাচ্ছে।”
“তো ঘুমাও।”
“কোথায় ঘুমাবো সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি। আরাফ এতোদিন কোথায় ছিলো?”
“বাথরুমে ছিল। তুমিও ওখানে গিয়েই ঘুমাও।”
“অরু, ফাজলামো করলে একটা চটকানি দেবো। বেড কোথায় সেটা জিজ্ঞেস করছি।”
অরুণিকা বিছানার নিচে দেখিয়ে দিতেই আহনাফ মাথা ঝুঁকিয়ে বেডটা বের করে, তা খুলে নিচে বিছিয়ে নিলো।
দুই বেডের রুম না পাওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের আলাদা বেড দিয়েছেন। আর অরুণিকা রাতে একা ঘুমাতে ভয় পায়, তাই তার সাথে এতোদিন আরাফ নিচে বিছানা করে ছিল।
এদিকে আহনাফ বালিশ নিয়ে নিচে শুয়ে পড়লো। অরুণিকা বিছানা থেকে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ চোখ খুলে অরুণিকাকে তার মুখোমুখি দেখে বলল,
“কি! এভাবে বানরের মতো ঝুলে আছো কেন?”
অরুণিকা উত্তর না দিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে শুয়ে পড়লো। আহনাফও বিষয়টা না ঘেঁটে চোখ বন্ধ করলো। একটুপর অরুণিকা বালিশের নিচ থেকে আহনাফের ফোনটা বের করলো। আসলে সে ওই মুহূর্তে নিচে ঝুঁকে ফোনটাই নিয়ে নিয়েছিল। অরুণিকা মনে মনে বললো,
“এবার সারারাত আমি গেইমস খেলবো।”
গেইম শুরু করার সেকেন্ড খানিক পরই আহনাফ খপ করে ফোনটা নিয়ে নিলো। অরুণিকা ভয়ে লাফিয়ে উঠলো। আহনাফ বাঁকা হেসে বলল,
“বাচ্চু, তুমি আমাকে বোকা বানাতে পারবে না।”
অরুণিকা আর কিছু না বলে গাল ফুলিয়ে শুয়ে পড়ল। এরপর সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ওয়াশরুম থেকে পেস্ট এনে, অর্ধেক পেস্ট বের করে আহনাফের মুখে ঢুকিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর আহনাফ ঘুমের ঘোরে কাশতে কাশতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। দেখলো তার জিহ্বায় ঝাঁঝালো পেস্টের স্বাদ লেগে আছে। সে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে কুলি করতে গেলেই অরুণিকা দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে আরাফের কাছে চলে গেলো। মনে মনে ভাবলো, আজ সারাদিন সে আরাফের হাত ছাড়বেই না।
চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৯||
৬৭.
উপমা ফোন হাতে নিয়ে ইন্সটাগ্রামে ঢুকতেই লাফাতে লাগলো। আদিল বোনের পাগলামো দেখে একপাশে বসে বলল,
“আবার কি হলো!”
উপমা আনন্দে কথা বলতে পারছিলো না। আদিল বলল,
“মানে তোকে দেখলে মনে হবে বাচ্চা শিশু। আমি বুঝি না, তোর মধ্যে ম্যাচুরিটি কখন আসবে!”
উপমা বলল,
“আপতত এসব ভাবগম্ভীর কথাবার্তা একপাশে রাখো। আর তোমার বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করো।”
“বিয়ে! কার সাথে?”
“রিকির সাথে।”
আদিল বিরক্ত হয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগলো। উপমা মোবাইলে একটার পর একটা চুমু খেতে লাগলো। আদিল বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোকে পাবনা পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। মোবাইল নিয়ে কখনো চুমাচুমি করিস, আবার কখনো কামড়াকামড়ি।”
উপমা বিছানায় উঠে লাফাতে লাফাতে বলল,
“ভাইয়া, এখন আমার লাফাতে ইচ্ছে করছে, আবার উড়তেও ইচ্ছে করছে। আসলে আমি নিজেই জানি না আমি এখন কি করবো।”
আদিল হাঁ করে উপমার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার উপমা যে সত্যিই তার ভারসাম্য হারিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আদিল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“মেয়েটা কি সত্যিই পাগল হয়ে গেল নাকি?”
উপমা আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, রিকি আমার মেসেজের রিপ্লাই দিয়েছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। দেখো, কি লিখেছে!”
আদিল চোখ ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে উপমার দিকে তাকালো আর বলল,
“কি লিখেছে?”
“লিখেছে, চমৎকার ছবি। তুমি খুব সুন্দর।”
আদিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“এই রুমে বড়জোর দুই মিনিট বেশি থাকলে আমিও পাগল হয়ে যাবো।”
উপমা ভাইয়ের কথায় তোয়াক্কা না করে, মেসেজের উত্তর দিলো,
“ধন্যবাদ, মাই স্টার।”
এদিকে তূর্য উপমার উত্তর দেখে মনে মনে হাসলো। তবে সে আর কিছু লিখলো না। তাকে এখন থেকে চিন্তাভাবনা করেই উত্তর দিতে হবে। কারণ সে এখন আর তূর্য নেই, রিকি হয়েই উপমার সাথে কথা বলছে। অন্যদিকে তূর্য এও জানে সে কিছু লিখুক বা না লিখুক উপমা এখন থেকে প্রতিদিন একটা করে মেসেজ তাকে দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যেখানে উপমা একটুখানি সাড়া পেয়েছে, সেখানে আর থেমে থাকার কোনো অর্থই হয় না।
আরো তিনদিন পর তারা দার্জিলিং থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছালো। বাসায় পৌঁছেই ইমন মাওশিয়াতকে কল করলো। মাওশিয়াতও দেরী না করে শতাব্দীর ব্যাপারে ইমনকে সবটা জানিয়ে দিলো। সব শুনে ইমন জিজ্ঞেস করলো,
“ওরা কি এখনো শতাব্দীকে দেখেছে?”
“না, কিন্তু আজ তাদের বাসায় নেমন্তন্ন করেছে শুনলাম। ছেলের বাড়ির লোকেরা নাকি যাবে।”
ইমন বিষয়টা তাহমিদকে জানাতেই সে থমকে গেলো। তাহমিদ এমন কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইভান তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই কি শতাব্দীকে ভালোবাসিস?”
তাহমিদ কিছু বলার আগেই তূর্য বলে উঠলো,
“কেন ভালোবাসতে যাবে শুধু শুধু। দার্জিলিংয়ে তো ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও তো বললো ভালোবাসে না।”
ইমন তূর্যের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। তূর্য এবার অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“সময় থাকতে ভালোবাসা বোঝা উচিত৷ নয়তো ইমনের মতোই ঝামেলায় পড়তে হবে।”
তাহমিদের চোখ দু’টি মেঝেতেই স্থির হয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, বুকে আর পিঠে একটা বড় পাথর চেপে বসেছে। আর মনের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এদিকে সবাই তাহমিদের উত্তরের আশায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি না ওকে। এটা তো সম্ভব না। আমি তো ওকে নিয়ে কখনো ওভাবে ভাবি নি।”
কথাটি বলতে বলতেই সে ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আরাফ তাহমিদের যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এখন কি আরেকটা মনের মৃত্যু ঘটবে? সায়ন্তনীকে হারিয়ে আরাফ তো নির্জীব হয়েই গেছে। তাহমিদও কি এবার ওর মতোই নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে? তূর্য আর ইভান নিজেদের রুমে চলে গেলো। ইমন আরাফের কাছে এসে বলল,
“তাহমিদ যতোই না বলুক, আমি জানি ও শতাব্দীকে ভালোবাসে।”
আহনাফ চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, সব মেয়ে মানুষই রহস্যের বাণ। যেই বাণ কখনো হয় রক্ষক, কখনো হয় ভক্ষক। একদিকে অরুণিকা তাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা, তাদের মানসিক শক্তি, অন্যদিকে তাদের জীবনে আসা অন্য মেয়েগুলো তাদের একের পর এক ক্ষত দিয়ে যাচ্ছে আর মানসিক ভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। কিন্তু এসব অনুভূতির উপর তো কারো হাত নেই। মানুষের আত্মার সাথে যেহেতু মন সংশ্লিষ্ট, তাহলে এই মন মেয়েলোকের মরীচিকা সৃষ্টি করবেই। কেউ হয়ত সেই মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে তার মনকে জয় করবে, আর কেউ হয়তো হেরে নির্জীব হয়ে পড়বে।
আহনাফ রুমে এসে তাহমিদের পাশে বসলো। তাহমিদ চুপচাপ বসে আছে। আহনাফ বলল,
“কেউ আর এই ব্যাপারে ঘাঁটাঘাঁটি করবে না। কারণ এর আগেও এমন ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে ভুল মানুষকে বেছে নেওয়ার উদাহরণ হিসেবে আমিই আছি। কিন্তু সবাই ভুল মানুষ হয় না। তাই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করতে হয়, ভুল মানুষ কে।”
তাহমিদ বলল,
“ও ভুল মানুষ না। ও শুধু আমার জন্যই ভুল। যেমন গোলাপ ফুল অনেক সুন্দর। কিন্তু তার গায়ে অনেক কাঁটা। তেমনি শতাব্দীও সেই গোলাপের মতোই। সে তার জায়গায় চমৎকার, অতুলনীয়। কিন্তু তাকে ধরতে গেলেই বাঁধা। ফুল গাছে থাকলেই সতেজ, আর ছিঁড়ে ফেললে মূর্ছে যাবে। শতাব্দীকেও আমাদের পরিবেশে আনলে ওর বিশেষত্ব হারিয়ে যাবে।”
“কিন্তু ইমন কি বলেছে শুনিস নি?”
“কি বলেছে?”
“ও তোকে ভালোবাসে।”
তাহমিদের বুকটা কেঁপে উঠল। ধরা গলায় বলল,
“ভালোবাসে, ভালো কথা। সব ভালোবাসা যে ভালো ঘর বাঁধবে, এমন তো হয় না। ও না হয়, অন্য ঘর বাঁধুক। ভালোবাসাগুলো মনেই জমিয়ে রাখুক।”
আহনাফ আর কিছু বলতে পারলো না। সে তাহমিদকে একা ছেড়ে দিলো। পরের দিন বিকেলে শতাব্দী বাসায় এলো। তখন বাসায় সবাই উপস্থিত ছিল। ইমন তাহমিদ আর শতাব্দীকে মুখোমুখি বসিয়ে দিয়ে বলল,
“যা বলার সামনাসামনি বলে ফেলা উচিত। আমরা ভেতরে যাচ্ছি।”
এই বলে ইমনসহ সবাই অন্য রুমে চলে গেলো। অরুণিকা দরজার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাহমিদ আর শতাব্দীকে দেখছে। আহনাফ তার মাথায় ঠোকা দিয়ে বলল,
“এভাবে চোরের মতো কি দেখছো?”
অরুণিকা চোর শব্দটা শুনে ক্ষেপে গেলো। কোমড়ে দুই হাত রেখে বলল,
“কি বললে তুমি? আমি চোর?”
“হ্যাঁ, চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মারছো! মনে তো হচ্ছে চোর।”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তেড়ে এলো। আহনাফ সরে আসার আগেই অরুণিকা তার বড় বড় নখগুলো দিয়ে আহনাফের হাত খামচে ধরলো। আহনাফ ব্যথায় চেঁচিয়ে বলল,
“অরু, আমার হাত ছাড়ো। বদমাশ, ফাজিল, পেত্নী!”
আরাফ অরুণিকার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে আহনাফকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ও আমাকে পেত্নী ডেকেছে।”
আরাফ বলল,
“পেত্নীর মতো নখ বড় করেছো কেন?”
আহনাফ হাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“আরাফ, ওর নখগুলো সব এখনই কাটা। নয়তো আমি সব একেবারে উপড়ে ফেলবো।”
অরুণিকা হাত পেছনে নিয়ে বলল,
“না, আমি নখ কাটবো না। সবাই নখ বড় করে। নখ বড় করলেই তো সুন্দর লাগে।”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“পেত্নী লাগে পেত্নী!”
“তুমি চুপ করো।”
“তুমি আমাকে চুপ করতে বলছো? আমার হাত খামচে দিয়ে আমার সাথে গলা বাজি করছো?”
আরাফ এবার গলার স্বর উঁচু করে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে তোরা চুপ হবি?”
অরুণিকা আহনাফের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
“ও শুরু করেছে।”
আরাফ অরুণিকার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই সে চুপ হয়ে গেলো। এবার আরাফ বলল,
“যাও এখনই নখ কেটে আসবে। নয়তো আমার সাথে আর কথা বলবে না।”
অরুণিকা গাল ফুলিয়ে আহনাফের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। আহনাফও চোখ ছোট করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার অরুণিকা হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
এদিকে তাহমিদ চুপচাপ বসে আছে। কিছুই বলছে না। শতাব্দী চুপ থাকতে না পেরে বলল,
“গতকাল ছেলে পক্ষ আমাকে দেখে গেছে।”
তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হুম শুনেছি।”
“তুমি হয়তো এখন সব বুঝতে পারছো, তাই না?”
তাহমিদ মাথা নেড়ে বলল,
“না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
শতাব্দী এতোক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে এবার তাহমিদের দিকে তাকালো। বলল,
“মাওশিয়াত কিছু বলে নি?”
“হুম, শুনেছি।”
“তাহলে কিছু বলবে না?”
“না, আমার কিছুই বলার নেই।”
শতাব্দী নিজের হাত নিজেই খামচে ধরলো। তাহমিদের এমন উত্তরের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে এমন শান্তভাবে উত্তর দিচ্ছে, মনে হচ্ছে তার কিছুই আসে যায় না। শতাব্দী বড় একটা শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো। তারপর বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাহমিদ। ওরা আমাকে শুধু দেখে গেছে। এখনো কিছুই জানায় নি। তুমি রাজি থাকলে আমি বাবাকে বলবো।”
তাহমিদ এবার শতাব্দীর দিকে তাকালো। তাহমিদের চোখাচোখি হতেই শতাব্দী চোখ নামিয়ে নিলো। শতাব্দী আবার বলল,
“বাবা হয়তো বুঝতে পারবে।”
“কি বুঝবে?”
“আমাদের ভালোবাসা!”
তাহমিদ অবাক হয়ে বলল, “ভালোবাসা!”
শতাব্দী তাহমিদকে অবাক হতে দেখে নিজেও অবাক হলো। তার মনে ভয় ভীড় করতে লাগলো। যদি তাহমিদ না করে দেয়? তখন সে কি করবে? এবার তাহমিদ বলল,
“তুমি তোমার বাবাকে কি বলবে? তুমি আমাকে ভালোবাসো এটাই বলবে?”
“হ্যাঁ।”
“তারপর উনি রাজি হবে, এটা তুমি কিভাবে নিশ্চিত হয়েছো?”
“কেন রাজি হবে না? বাবা তো তোমাকে খুব পছন্দ করে।”
“শতাব্দী, পছন্দ করা আর আত্মীয়তা করা এক কথা না। তুমি ভালোভাবেই জানো, আমাদের ধর্ম আলাদা।”
“আমার তো এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।”
“তাহলে তুমি আমার ধর্মে আসতে চাচ্ছো?”
শতাব্দী চুপ করে রইলো। তাহমিদ হালকা হেসে বলল,
“তুমি আসতে চাইলেও তোমার বাবা-মা এতো সহজে এটা মেনে নেবে না।”
“কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন না করেও…”
তাহমিদ শতাব্দীকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার জীবনটা অনেক এলোমেলো হয়ে আছে। তুমি আমার অতীত জানো না। আর আমার ভবিষ্যৎ কি সেটা আমি নিজেই জানি না। আমার এই অনিশ্চিত জীবনে কোনো প্রেম-ভালোবাসার জায়গা নেই। তবে আমি তোমাকে অনেক ভালো বন্ধু মনে করি। কিন্তু ভালোবাসি না। এখন তোমার উচিত, তোমার বাবা-মার পছন্দে বিয়ে করে ফেলা।”
শতাব্দী তাহমিদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলো। তার চোখ দু’টি ছলছল করছে। তাহমিদ শতাব্দীর চোখের দিকে তাকাতে পারলো না। সে উঠে চলে গেলো। শতাব্দীও চেয়ারের হাতল ধরে উঠে দাঁড়ালো। তাহমিদ ঘর থেকে বেরুতেই বাকিরা রুম থেকে বের হয়ে এলো। ইমন কিছু বলার আগেই শতাব্দী বলল,
“আমার ঝামেলার কারণে তোমাদের একটা কথা বলা হয় নি।”
ইমন বলল, “কি কথা?”
শতাব্দী ডুমুরের কাছ থেকে যা যা শুনেছিল সবটাই তাদের জানালো। সব শুনে ইভান বলল,
“আমার উনাকে সন্দেহ হচ্ছিল!”
তূর্য বলল,
“তাহলে উনি আমাদের কেন বাঁচিয়েছেন?”
৬৮.
জানালার বাইরে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতাব্দী। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে পড়তে শুকিয়ে গেছে। শ্রীজা বোনের পাশে এসে দাঁড়ালো। শতাব্দীর শূণ্য দৃষ্টি দেখে সে বলল,
“দিদি, কাল তোমায় আশীর্বাদ দিতে আসবে। তুমি বরং পালিয়ে যাও!”
শতাব্দী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বলল,
“কার সাথে পুচকি? যার হাত ধরতে চাই, সে তো আমার হাত ধরতে আগ্রহী নয়। তার তো আমার জীবনে কি হলো না হলো তাতে কিছুই আসে যায় না।”
“তাহমিদ দাদা কি তোমায় ভালোবাসে না?”
শতাব্দী মাথা নেড়ে বলল, “না।”
না শব্দটা বলতেই শতাব্দীর বুক ভারী হয়ে আসছিল। সে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে শ্রীজার হাত ধরে বলল,
“পুচকি, তোর দাদাকে আমি খুব ভালোবাসি রে। খুব ভালোবাসি। সেই ছোটবেলা থেকেই। আট বছর ধরে একটা মানুষকে চুপচাপ শুধু ভালোবেসেই গেলাম। আর আজ আমার এতোবছরের ভালোবাসার প্রতিদান আমি এভাবেই পেয়েছি? আমি কি বোকা রে পুচকি। মানুষটা আমাকে ভালোইবাসতো না রে। আর আমি বোকার মতো, তাকেই চেয়েছি। তার জন্য চুল বাঁধতাম, কারণ সে পরিপাটি থাকা পছন্দ করতো। স্কুল শেষে দূর থেকে দাঁড়িয়ে তার মিষ্টি বিক্রি দেখতাম। রোদে রাঙা হয়ে যাওয়া মুখটার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম রে পুচকি। কিভাবে থাকবো মানুষটাকে ছাড়া? আমি একা একা এই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু এই মনটাতে আর কাউকে বসাতে পারবো না রে পুচকি। কতো যত্ন নিয়ে এই মনে মানুষটাকে বসিয়েছি। এতো সহজে সেই জায়গা কেউ নিয়ে নেবে? কিভাবে নিয়ে নেবে? এমন না হোক। তারচেয়ে ভালো মরণ হোক আমার!”
শ্রীজা ব্যস্ত হয়ে বোনের মুখে হাত দিয়ে ভেজা কণ্ঠে বলল,
“ওমন করে বলো না দিদি। এমন অলক্ষুণে কথা বলো না।”
“পুচকি, এই মনকে কিভাবে বোঝাবো, বল না!”
এদিকে ছাদের এক কোণে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। কাল থেকেই তার মন খারাপ। কারো সাথে কোনো কথা বলে নি। রহমত চাচা সম্পর্কে জানার পরও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। যেন তার ভেতরের সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লোপ পেয়েছে। আরাফ ছাদে উঠে দেখলো তাহমিদ একপাশে কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাহমিদ একটা শুকনো হাসি দিলো। আরাফও হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“তোকে আগে কখনো এতোটা দুঃখী দেখি নি।”
তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি শুধু শুধু কেন দুঃখী হবো?”
“ভালোবাসিস শতাব্দীকে?”
“আরেহ না। তেমন কিছু না।”
“পছন্দ তো করিস। নয়তো তোর কেন খারাপ লাগবে? তোর চুপচাপ হয়ে যাওয়ার কারণ কি! কোনো কারণ ছাড়া তো কেউ দুঃখ পায় না।”
তাহমিদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“আমাদের ভাগ্যে হয়তো সিল মেরে দেওয়া হয়েছে, যাকেই আপন ভাববো, তারাই হারিয়ে যাবে।”
আরাফ মলিন হাসি দিয়ে বলল,
“ভাগ্য! এই ভাগ্যটাই খারাপ। সুখ দেখায় না৷ শূণ্যতা ছাড়া কিছুই দেয় না।”
“হ্যাঁ, আর মাত্র কয়েক মাস। পরীক্ষাটা শেষ করে এই শহর ছেড়ে দেবো। একদিন শতাব্দীও সব ভুলে যাবে।”
“যদি না ভুলে?”
তাহমিদ শুকনো হেসে বলল,
“এটা ওর আবেগ। একটা সময় এই আবেগ কেটে যাবে।”
“আর তুই!”
তাহমিদ আরাফের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকালো। আরাফ আর কিছুই বললো না। সে উত্তর পেয়ে গেছে। তাহমিদের চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছে, সে শতাব্দীকে কতোটা ভালোবাসে। তবে এই ভালোবাসার স্বীকারোক্তি এতো সহজে হবে না। আরাফ মনে মনে বলল,
“আমি ভাবতাম, আমিই সবাইকে সব কথা খুলে বলতে পারি না। কিন্তু তুই তো আমার চেয়েও বেশি অপারগ।”
আরাফ চলে যাওয়ার পর তাহমিদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর শুভ্র মেঘের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,
“সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না চন্দ্রিমা। তোমার নাম চন্দ্রিমা রেখেছি, কেন জানো? কারণ তুমি আমার কাছে চাঁদের মতোই। যাকে শুধু দেখা যায়, স্পর্শ করা যায় না, কাছেও পাওয়া যায় না। চন্দ্রিমা, তুমি সবসময় আমার সাথেই থাকবে। রাতের অন্ধকারে আমি তোমাকে চাঁদের মাঝেই খুঁজে নেবো। তোমাকে না পাওয়ার মাঝেই তো তোমার বিশেষত্ব। চন্দ্রিমা, আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই না। শুধু অনুভব করতে চাই।”
পরের দিন ছেলে পক্ষ শতাব্দীকে আশীর্বাদ করে চলে গেলো। আর যাওয়ার আগে এনগেজমেন্টের তারিখ পাকাপোক্ত করে গেলো। এই সপ্তাহেই এনগেজমেন্ট হবে। তারপর যেকোনো একটা শুভ দিন দেখেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে৷ যেহেতু ছেলে ছুটিতে এসেছে, তাই বিয়ের জন্য এতো তাড়াহুড়ো চলছে। কারণ ছুটি শেষ হলেই ছেলে আবার চলে যাবে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে শতাব্দীর মুখে কোনো হাসি নেই। কারণ কোনো কিছুই তার ইচ্ছেমতো হচ্ছে না।
এদিকে ইভান ফোন নিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে। ইমন তার পাশে বসতেই সে বলল,
“আমাদের হাতে সময় কম। রহমত চাচাকে বিশ্বাস করে আমরা সব উনার ভরসায় ছেড়ে দিতে পারবো না। কিছু একটা করতে হবে।”
ইমন বলল,
“ভাই, আমি একটা ব্যবস্থা করেছি।”
“কি করেছিস?”
“আমরা বাংলাদেশ যাচ্ছি।”
“কখন!”
“এক সপ্তাহের মধ্যেই। তাহমিদ আমার সাথে যাবে। তবে এটা রহমত চাচাকে জানানো যাবে না। এই কথা শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে। এখন আমাদের আগে মৈত্রী গ্রুপটা দাঁড় করাতে হবে। তবে এই কাজের জন্য ভালো একজন ইনভেস্টর দরকার। আর আমাদের সেই বিজনেস দাঁড় করানোর জন্য একজন ইনভেস্টরও আছেন।”
“কে সে!”
“মাওশিয়াতের চাচা। উনি আমাদের সাহায্য করবেন।”
“সব বুঝলাম। কিন্তু তোদের তো কয়েক মাস পর পরীক্ষা!”
“আমরা পরীক্ষার আগেই চলে আসবো। আপতত রহমতুল্লাহ কি চায়, এটাই জানতে হবে। পরীক্ষার পর আমরা সবাই দেশে ফিরবো। কিন্তু এই বাসাটাও পরিবর্তন করতে হবে। অরুণিকাকে এখান থেকে সরাতে হবে। তুই আর আরাফ অরুণিকাকে নিয়ে অন্য কোথাও উঠলে ভালো হবে।”
“হুম ভাবছি, অরুণিকাকে অন্য শহরে পাঠিয়ে দেবো। ওখানে একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। আমি আর আরাফ গিয়ে মাঝে মাঝে ওকে দেখে আসবো।”
“হ্যাঁ, এটাই করতে হবে। ও তোদের সাথেই একেবারে দেশে ফিরলে ভালো হবে। আর এমনিতেই আরাফ ওকে আমাদের ভরসায় ছাড়বে না। আর একাও এই শহরে রাখবে না।”
তাদের কথার মাঝখানে তূর্য আর আরাফ এলো। তূর্য দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে বসলো আর বলল,
“বিজনেস দাঁড় করাতে অনেক সময় লাগবে। আর আমাদের পরিচয়ও গোপন রাখতে হবে।”
আরাফ বলল,
“জানিস, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের টপ বিজনেসম্যান সাহিল মির্জা।”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মির্জা! তারমানে মির্জা গ্রুপের এমডি?”
“হ্যাঁ, শাহেদ মির্জার ছেলে।”
ইমন বলল,
“সাহিল মির্জা নতুন এমডি হয়েছে। কিন্তু ওর বাবা মৈত্রী গ্রুপের প্রথম শত্রু ছিল।”
ইভান বলল,
“হুম, আর ওদের ওই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকাটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। যেহেতু ওরা আমাদের শত্রু পক্ষ ছিল।”
এরই মধ্যে আহনাফ আর তাহমিদ এলো। ইভানের কথায় তাল মিলিয়ে আহনাফ বলল,
“ইভান ঠিকই বলেছে। আমার কাছে এই মুহূর্তের আর সেই সময়ের বিজনেস গ্রুপগুলোর একটা লিস্ট আছে।”
আহনাফ তার ফোনটা এগিয়ে দিলো। ইভান ফোন দেখে বলল,
“এটা কি কোনো ক্লু?”
“হ্যাঁ, ওই সময় মৈত্রী গ্রুপের পরই বাস্কার গ্রুপ ছিল। তারপর চতুর্থতে মির্জা গ্রুপ। এখন শুরুতেই মির্জা গ্রুপ। আর বাস্কার গ্রুপ দ্বিতীয়। বাকিগুলো মোটামুটি। এদের কাছাকাছি আসতে বাকিদের অনেক সময় লাগবে। আর মৈত্রী গ্রুপ ডাউন হওয়ার পর পরই মির্জা গ্রুপের এতো উন্নতি হয়েছে।”
ইমন বলল,
“তবে এদের মধ্যে মুন্সী গ্রুপটা হয়তো নতুন। আগে এই গ্রুপের নাম শুনি নি।”
আরাফ বলল,
“হ্যাঁ, সুলতান মুন্সী। লোকটা আগে হোটেলে কাজ করতো। ওখান থেকেই এতো বড় বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। তবে এই গ্রুপটার সাথে মির্জা গ্রুপের একটা দ্বন্ধ আছে।”
“কিসের দ্বন্ধ? তাদের পজিশনে তো আকাশ-পাতাল পার্থক্য।”
“কি বিষয়ে দ্বন্ধ এটা মিডিয়াতে এখনো আসি নি। তবে নিউজে এতোটুকুই দেখেছিলাম।”
চলবে-
(পরের পর্ব ২৫ তারিখ দেওয়া হবে। আমার এক্সাম চলছে তাই। আজকের পর্ব বড় করে দিয়েছি।)