#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪০: ১ম ভাগ||
৬৯.
আজ শতাব্দীর এনগেজমেন্ট। শ্রীজা তাকে সাজিয়ে ছেলের পাশে বসিয়ে দিলো। শতাব্দী পাশ ফিরে এক নজর ছেলেটির দিকে তাকালো।
ছেলে দেখতে সুন্দর, সুঠাম দেহ, তাহমিদের চেয়েও সুদর্শন। কিন্তু শতাব্দীর কাছে তো সেই রাঙা হয়ে থাকা মুখটিই বেশি প্রিয়।
আশেপাশে অনেকে অনেক কথা বলছে। শতাব্দীর কানে কিছুই ঢুকছে না। তার মাথায় ঘুরছে তাহমিদ আজ বাংলাদেশে যাচ্ছে। এখন সে কি আর তাহমিদের দেখা পাবে না?
তার পাশে বসা বিরাজ কুমার নামের সেই ছেলেটি তাকে রিং পরিয়ে দিলো। আর সে পুতুলের মতো বসে আছে। পিসি মা শতাব্দীর হাবভাব দেখে হেসে বললেন,
“আমাদের মেয়ে বড়োই লাজুক!”
শতাব্দী আনমনে হাসলো। মনে মনে বলল,
“তোমাদের মেয়ে লাজুক না, পিসি মা। মারাত্মক বেহায়া। তাই তো সব লাজলজ্জা ভুলে সেই মানুষটার কাছে ভালোবাসার কথা জানাতে গিয়েছিলাম। আর সে আমাকে মুখের উপরই ফিরিয়ে দিয়েছে।”
এদিকে তাহমিদ আর ইমন এয়ারপোর্টে বসে আছে। তাহমিদের চোখ স্থির হয়ে আছে। ইমন তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মন খারাপ!”
তাহমিদ ইমনের কথা শুনে জোরপূর্বক হেসে বলল,
“না তো। মন খারাপ হবে কেন? বরং আজ ভালোই লাগছে। কতো বছর পর দেশে ফিরছি!”
ইমন তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কাকে বুঝাচ্ছিস? আমাকে নাকি নিজেকে?”
তাহমিদ ইমনের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ সে আর কিছু বলতে পারলো না। ইমন বলল,
“ও তোকে পাওয়ার জন্য সব ছেড়ে দেবে। তুই শুধু হ্যাঁ বলে দেখ।”
“না, আমি চাই না ও আমার জন্য সব ছেড়ে দিক। প্লিজ ইমন, আমি এসব ব্যাপারে আর কথা বলতে চাচ্ছি না।”
“আচ্ছা, আমি কিছুই বলব না৷ তুই আমার চেয়েও ভালো বুঝিস। তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিস। এখনো সময় আছে। পরে যাতে কোনো আফসোস না থাকে।”
তারা দু’জন সব ফর্মালিটি পূরণ করে প্লেনে উঠে পড়লো। কিছুক্ষণ পরই প্লেন টেইক অফ করবে। তাহমিদ ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সিলেট থেকে সেদিন বাসে করে সোজা কলকাতায় এসেছিলাম। সেদিন আমাদের সবার চেহারায় ভীতি ছিল।”
ইমন প্রশান্তির হাসি হেসে বলল,
“হ্যাঁ, তবে আজ কোনো ভীতি নেই। ভয় তাদের পাওয়া উচিত, যারা অপরাধ করেছে। আমরা তো শুধু তাদের পাপ দেখিয়ে দিতে যাচ্ছি।”
বিকেলে ফোন হাতে বসে আছে তূর্য। এখন তার প্রতিদিন উপমার সাথে মেসেজের মাধ্যমে কথাবার্তা হয়। উপমা তো রিকি বলতেই পাগল। এদিকে উপমার সাথে কথাবার্তা বলে তূর্যের ভালোই সময় কাটছে। কিন্তু উপমা রিকির প্রতি আরো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আজ সকালে মেহেদি দিয়ে পুরো হাতে রিকির নাম লিখিয়ে তাকে ছবি পাঠিয়েছে। তূর্য এসব দেখে অবাক। সে লিখলো,
“কেউ দেখলে কি মনে করবে?”
উপমা রিকির উত্তরে লিখল,
“মনে করলে করুক। আমার কিছু আসে যায় না। আর সবাই জানে আমি তোমার ভক্ত। আর ভক্তরা তো এমনই করে।”
“তোমার মতো ভক্ত পেয়ে আমার ভালোই লাগছে।”
“আচ্ছা, আমার মতো করে কেউ তোমাকে ভালোবাসে না?”
তূর্য মেসেজটা দেখে কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিলো না। তাই সে কোনো উত্তর দিলো না। উপমা অনেকক্ষণ ধরে রিকির মেসেজের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু মেসেজটা দেখার পরও কোনো উত্তর না আসায় সে চিন্তায় পড়ে গেলো। আনমনে ভাবতে লাগলো,
“আমি কি ভুল কিছু বলেছি?”
তখন মিসেস জুলেখার ডাক পড়লো। উপমা রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো তার বান্ধবী ইতু এসেছে তাকে নোট দিতে। ইতুকে সে নিজের রুমে নিয়ে এলো। ইতু চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল,
“সবই তো রিকির ছবি৷”
উপমা লাজুক হেসে বললো,
“হ্যাঁ, রিকি ছাড়া আমার আর কে আছে বল!”
ইতু হেসে বলল,
“তুই কবে যে এসব পাগলামো বন্ধ করবি! আমাদের ক্লাসের অন্তর তোকে কতো পছন্দ করে। আর তুই আছিস অন্য দুনিয়ায়।”
“দেখ, রিকির প্রেমে না পড়লেও আমি অন্তরকে সুযোগ দিতাম না৷ ও একটা খচ্চর। সারাদিন সিগারেট খায়। আর আমার রিকির কোনো বাজে অভ্যাস নেই।”
“তুই কিভাবে জানলি?”
“আমার তো ওর সাথে কথা হয়। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন বলেছিল।”
ইতু হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। উপমা বিরক্ত হয়ে বলল,
“হাসছিস কেন?”
“তোর কল্পনা দেখে হাসছি৷ ওটা রিকি না রে, হয়তো রিকি সেজে তোর সাথে কেউ মজা করছে।”
উপমা তার ইন্সটাগ্রাম খুলে ইতুকে দেখালো। ইতু ভালোভাবে দেখে বলল,
“যতোদূর জানি, এটাই তো রিকির ইন্সটাগ্রাম একাউন্ট। আমার মনে হয়, ওর একাউন্ট থেকে কেউ মজা করছে। এসব সেলেব্রিটিদের একাউন্টগুলোও নিজস্ব হয় না। আর ওর এতো সময় কোথায়, তুই-ই বল। শীঘ্রই ওর মোহ গানটা বের হবে। ওর তো এখন সেই গান নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা। জানিস, কলকাতার একটা সিনেমায় ওর চারটা গান থাকবে?”
উপমা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ জানি। আর ওর সব আপডেট আমার কাছে থাকে। তোকে নতুন করে বলতে হবে না।”
ইতু উপমার কথা শুনে হাসতে লাগলো। ইতু ব্যাগ থেকে নোট বের করতে করতে বলল,
“এমন কারো প্রেমে পড়, যাকে পাওয়া যায়। শুধু শুধু মরীচিকার পেছনে ছুটিস না। কলকাতায় কি সুন্দর মেয়ের অভাব আছে নাকি যে রিকির চট্টগ্রামের দামপাড়ার এক কোণে বসে থাকা উপমাকেই পছন্দ হবে?”
কথাটি শুনে উপমার খুব খারাপ লাগলো। তবে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ইতুকে শুকনো মুখেই বিদায় দিলো। ইতু চলে যাওয়ার পর উপমা কিছুক্ষণ নিরবে কাঁদলো। তারপর রিকির ইনবক্সে ঢুকে বলল,
“তোমার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?”
এবারও রিকি সাথে সাথেই মেসেজটা দেখলো। আর উত্তর এলো,
“হ্যাঁ, আছে। কেন?”
মেসেজটা দেখে উপমার চোখে পানি টলমল করতে লাগলো। আবার রিকির মেসেজ এলো। উপমা ঢুকে দেখলো সে একটা ছবি পাঠিয়েছে। ছবিটা ডাউনলোড করতেই দেখলো, একটা অল্প বয়সী মেয়ে লেহেঙ্গা পরে দোলনায় বসে আছে। উপমা সাথে সাথে লিখলো,
“কে এটা?”
উত্তর এলো,
“এটাই আমার গার্লফ্রেন্ড।”
মেসেজটা লিখে অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে হাসতে লাগলো। তূর্য ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো অরুণিকা তার ফোন হাতে নিয়ে হাসছে। সে তূর্যকে দেখেই ফোন রেখে দৌঁড়ে পালিয়ে গেলো। তূর্য তাড়াতাড়ি ফোন নিয়ে উপমার শেষ কথাগুলো পড়লো। আর দেখলো অরুণিকা নিজের ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে। সে তাড়াতাড়ি ছবিটা ডিলিট করে বলল,
“সরি উপমা, ছবিটা আমার টুইংকেলের৷ ও নিজেই দুষ্টুমি করে পাঠিয়ে দিয়েছে। ছবিটা সেইভ হয়ে গেলে ডিলিট করে দিও প্লিজ।”
উপমা আবার আরেকটা মেসেজ দেখে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে বলল,
“তোমার টুইংকেল মানে? ও কি তোমার গার্লফ্রেন্ড?”
“আরেহ না। বাচ্চা মেয়ে ও। আমার বন্ধুর কাজিন।”
“ও তোমার ফোন কিভাবে পেয়েছে?”
“রুমে ছিল, নিয়ে ফেলেছে হয়তো৷ আচ্ছা এসব বাদ দাও।”
উপমা কিছু একটা ভেবে লিখল,
“তোমার একটা ছবি দেবে?”
তূর্য মেসেজটা দেখে কোনো উত্তর না দিয়েই অফলাইনে চলে গেলো। এরপর রুম থেকে বের হয়ে দেখলো অরুণিকা চেয়ারে বসে বসে আরাফের কেঁটে দেওয়া আপেল খাচ্ছে। তূর্যকে দেখেই সে নড়েচড়ে বসলো। তূর্য চোখ ছোট করে বলল,
“টুইংকেল, এদিকে আসো।”
অরুণিকা আরাফের গা ঘেঁষে বসলো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে একবার অরুণিকার দিকে তাকালো। আরেকবার তূর্যের দিকে। তারপর বলল,
“তোদের আবার কি হয়েছে?”
তূর্য বলল,
“আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে ডাকছি, তুই কিছু বলিস না।”
আহনাফ গার্লফ্রেন্ড শব্দটা শুনেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তূর্য আবার বলল,
“টুইংকেল, আসো।”
আহনাফ অরুণিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ও তোর গার্লফ্রেন্ড না।”
“ও-ই আমার গার্লফ্রেন্ড। তাই না টুইংকেল?”
আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান তাদের দু’জনের চোখ-মুখ দেখে বুঝলো তূর্য কোনো একটা বিষয়ে রেগে আছে। তূর্য সচারাচর রাগ দেখায় না। আর রাগ উঠলেও তা বোঝার উপায় থাকে না। কারণ সে রাগ প্রকাশ করে না। রেগে গেলেও শান্তভাবেই কথা বলে। তবে সূক্ষ্মভাবে বোঝার উপায় হচ্ছে তূর্যের কান লাল হয়ে যায়। যা ইভান খেয়াল করেছে। এদিকে আহনাফেরও রাগ উঠা শুরু করেছে। তাই সে দু’জনকে দু’পাশে সরিয়ে দিয়ে অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“অরুণিকা, তুমি কিছু করেছ? তূর্য রেগে আছে কেন?”
অরুণিকা আরাফের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“আমি তো দুষ্টুমি করেছি।”
আরাফ বলল, “কি করেছো?”
তূর্য শান্ত কন্ঠে বললো,
“ও আমার চ্যাট লিস্টের একটা মেয়েকে লিখেছে ও আমার গার্লফ্রেন্ড। শুধু তাই না, ছবিসহ পাঠিয়ে দিয়েছে।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালো। আরাফ বলল,
“ও বুঝতে পারে নি। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো।”
“ভাই, রিকি নামের আইডিটা থেকে পাঠিয়েছে। আমি যেখানে সবকিছুই হাইড করে রাখি, ও সেখানেই ছবি দিয়ে বসে আছে। মেজাজ খারাপ হয় না বল!”
অরুণিকা মাথা নিচু করে বলল,
“আমি আর তোমার ফোন ধরবো না।”
তূর্য কিছু না বলে রুমে চলে গেলো৷ আহনাফ অরুণিকাকে কিছু বলতে যাবে আরাফ তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললো। ইভানও আহনাফকে টেনে নিয়ে গেলো। অরুণিকা এবার আরাফের কোলে মাথা রেখে বলল,
“আরাফ, রকস্টার কি আমার সাথে রাগ করেছে?”
আরাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“হয়তো একটু করেছে। দেখবে কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখন থেকে কারো ফোন ধরবে না। অনুমতি নিয়েই ধরবে। ঠিক আছে?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”
এদিকে তাহমিদ আর ইমন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ এসে পৌঁছালো। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই আশেপাশে ব্যস্ত মানুষদের দেখে ইমনের চোখ টলমল করে উঠলো। আট বছর পর দেশে ফিরেছে, অথচ তাদের কেউই নিতে এলো না। আসবেও বা কে, আপন কেউই তো আর বেঁচে নেই।
এরপর তারা দু’জনই পাশের একটা হোটেলে উঠলো। তারপর রাতে বিশ্রাম করে, সকালে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। চট্টগ্রাম এসে পৌঁছাতেই দুপুর হয়ে গেলো। স্টেশন থেকে সোজা তারা তাদের পুরোনো এলাকায় ফিরে এলো, যেখান থেকে সেই রাতে তারা পালিয়ে গিয়েছিল। গাড়ি দাঁড় করাতেই ড্রাইভার বলল,
“মামা, এন্ডে কি তোঁয়ারার বাড়ি নে?”
(মামা, এখানে কি তোমাদের বাড়ি?)
তাহমিদ বলল,
“না, মামা। আমরা এমনি একটা জরুরী কাজে এসেছি।”
“ও! এই এলাকার খবর জানো নে?”
(ওহ, এই এলাকার কোনো খবর জানো?)
“কি খবর?”
“বউত বছর আগে এন্ডে এক রাতিয়ে বেগ্গুনো রে মারি ফেলাইয়িল। ঘরত ওউন লাগায় দিইল। বউত জনে কয়, এই এলাকায় জ্বিন ভূত আছে। এহন এন্ডে আর খনিখাই নঁ তাহে। ঘর ফেলায় বেগ্গুন গেইগুই। আহা! যারা মইজ্জি, তারা বউত বালা মানুষ আছিল।”
(অনেক বছর আগে এখানে এক রাতে সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিল। বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। অনেক বলে, এই এলাকায় জ্বিন-ভূত আছে। এখন এখানে আর কেউ থাকে না। বাড়ি ফেলে সবাই চলে গেছে। যারা মারা গিয়েছিল, তারা অনেক ভালো মানুষ ছিল।)
ইমন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“ভালো মানুষ হলে খুন হয়েছিল কেন?”
“ও বাজি, ইন নঁ বুঝিবে তোঁয়ারা। ইন বেগ্গিন ফলিটিক্স। আঁরাও এতিক্কিন নঁ বুঝি।”
(ও বাবা, এসব তোমরা বুঝবে না। এগুলো সব রাজনীতি। আমরাও এতোকিছু বুঝি না।)
ড্রাইভারটা গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল,
“এন্ডে বেশিক্ষণ নঁ থাইক্কু। বউত বছর ধরি খালি তো। কি আছে, নঁ আছে কনে জানে।”
(এখানে বেশিক্ষণ থেকো না। অনেক বছর ধরে খালি তো, ভেতরে কি আছে, না আছে কে জানে!)
তাহমিদ মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা।”
ড্রাইভার চলে যাওয়ার পর ইমন বলল,
“তার মানে এই এলাকায় এখন আর কেউ থাকে না।”
তারা দু’জনই সামনের বড় গলিতে ঢুকলো। রাস্তাটা আট ফুট প্রশস্ত। আট বছর আগে রাস্তার ডানপাশে এলাকার কবরস্থানটি ছিল। আর এখন সেই কবরস্থান বড় বড় গাছ আর ঘাস লতায় ছেয়ে গেছে। বামপাশের চারতলার সেই মান্নান ম্যানশনটা এখনো আছে। তবে সেটা এখন পরিত্যক্ত। আট বছর আগে এই বাড়ির মালিক মান্নান সাহেব অনেক বয়ষ্ক ছিলেন। এতোদিনে তার বেঁচে থাকার কথা না। আবার থাকলেও থাকতে পারেন। মান্নান ম্যানশনের সামনে এলাকার মাঠ। তারা ছোটবেলায় এখানে এসেই এলাকার বাচ্চাদের সাথে খেলতো। মাঠের পাশেই একটা মসজিদ। এখন মসজিদটার বাইরেও তালা দেওয়া। এই গলির শেষ মাথায় দু’টো বড় রাস্তা চলে গেছে। বামপাশের রাস্তাটায় এই এলাকার সাধারণ মানুষরাই থাকতো। রাস্তার বামপাশে মুখোমুখি আর পাশাপাশি মোট বিশটা ভবন ছিল, যার বেশিরভাগই দশতলা। এসব ফ্ল্যাটে অনেক মানুষ থাকতো। আর আজ পুরো এলাকা বিরান।
তাহমিদ অবাক হয়ে বলল,
“এতোগুলো মানুষ এই এলাকা ছেড়ে দিয়েছে? বাড়িগুলোও আগের মতো রয়ে গেছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার!”
ইমন বলল,
“হয়তো ভেবেছে এই এলাকায় থাকলে তাদেরও খুন হতে হবে। এমনিতেই এই এলাকায় যারা ছিল, তারা হয়তো সেদিন রাতে খুনিদের দেখেও থাকতে পারে৷ জুবাইয়ের আংকেল তো সেদিন রাতে এই রাস্তা দিয়েই বের হয়েছিলেন। ওরা এখানেই তার উপর গুলি চালিয়েছিল।”
“এরা কি সবাই তাহলে ভয়ে পালিয়েছে?”
“এটাই বুঝতে পারছি না। এতোগুলো বাড়ি! এভাবেই পড়ে আছে? এত বড় এলাকা আট বছর ধরে পরিত্যক্ত। বিষয়টা খুব অদ্ভুত লাগছে। অন্তত এই জায়গাগুলো যাদের, তারা তো বিক্রি করে দিতে পারতো।”
“হয়তো কেউ কিনতে চায় নি!”
তারা এবার ডানপাশের রাস্তায় ঢুকলো। সেখানে একটা বড় লোহার গেইট। আর সেই গেইটটিতে লতাগাছ জন্মেছে। ভাঙা গেইটটির সামনে গিয়ে তাহমিদ সেটা ধাক্কা দিতেই নিরব পরিবেশটা ভূতুড়ে শব্দ তুললো। ইমন কিছুটা ভয় পেয়ে বলল,
“কেউ আমাদের এখানে দেখলে সন্দেহ করতে পারে।”
“এখানে কে আসবে?”
“আসতেই পারে। দাঁড়া, আমার কাছে ক্যামেরা আছে।”
“ক্যামরা দিয়ে কি করবি?”
ইমন ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করতে করতে বলল,
“কেউ এখন দেখলে বলবো, প্যারানরমাল এক্টিভিটি শুট করতে এসেছি।”
“বাহ! চমৎকার বুদ্ধি। তোকে এই বুদ্ধি কে দিয়েছে?”
“তূর্য।”
তারা গেইট খুলে ভেতরে ঢুকলো। আগে গেইটের পাশেই ছোট একটা বাগান ছিল। বাগানের ভেতরেই চারতলা পাকা বাড়ি। মূলত এই বাড়িতেই তাদের বাড়ির সব পাহারাদাররা থাকতো। এরপর সোজা রাস্তা। রাস্তার ডানপাশে বড় বড় গাছ, বামপাশে তাদের বাড়ির সীমানা দেয়াল। প্রায় পাঁচ মিনিট হাঁটার পরই তাদের বাড়িগুলোর প্রধান গেইট। যদিও এই এলাকাটা সম্পূর্ণ তাদেরই ছিল। এই এলাকায় অনুমতি ছাড়া অন্যদের প্রবেশ নিষেধ ছিল৷ মূলত বাড়ির প্রথম লোহার গেইটটিই মৈত্রী ম্যানশনকে এলাকার বাকি সাধারণ বাড়ি থেকে আলাদা করে রেখেছিল। তবে এই দ্বিতীয় গেইটটি তাদের বাড়িতে ঢুকার পথ। এই গেইটটিও ভাঙা। গেইট দিয়ে ঢুকতেই সামনে বড় একটা ইটের তৈরী খোলা রাস্তা। আর সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে একটা কৃত্রিম ঝর্ণা। বামপাশে দুই তলা সেই পুরোনো গ্যারেজ। গ্যারেজের কাচের দেয়ালগুলো ভেঙে গেছে। ভেতরে পোড়া গাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে। গেইটের মুখোমুখি আর ডানপাশে তাদের সেই পোড়াবাড়িগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এসব দেখে তাহমিদ হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ল। সেদিন রাতের সেই আগুনের দৃশ্যটি আবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। ইমন ভেতরে গিয়ে তাদের বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসলো। সেকেন্ড খানিকের মধ্যেই ইমনের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এই নৃশংস হত্যার শাস্তি হবেই হবে। মির্জা গ্রুপ, বাস্কার গ্রুপ, সব’কটা গ্রুপকে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দেব। আর রহমতুল্লাহ, শাহবাজ খান এদের কেউই রক্ষা পাবে না। যে-ই জড়িত থাকবে, সবাইকে শেষ করে দেবো।”
তাহমিদ ইমনের পাশে বসে বলল,
“আমাদের আজ থেকেই প্রতিশোধের প্রথম ধাপ শুরু করতে হবে। যেহেতু আমরা এখনো নিশ্চিত নই, কে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত, তাই এই মুহূর্তে আমাদের ভেবেচিন্তে এগুতে হবে। সবার প্রথমেই রহমতুল্লাহ সম্পর্কে সব তথ্য বের করতে হবে। প্রথমত, সেদিন রাতে জুবাইয়ের আংকেল আমাদের আমবাগান পাঠিয়েছিলেন। সেখানে রহমত চাচার পরিবর্তে অন্য কারো আসার কথা ছিল। তাহলে যার আসার কথা ছিল, সে কে ছিল? আর রহমত চাচা কিভাবে জানলেন আমরা ওখানে যাবো? দ্বিতীয়ত, জুবাইয়ের আংকেল বলেছিলেন, শত্রু আমাদের চোখের সামনেই ছিল। তার মানে আমাদের পরিচিত কেউ। রহমত চাচা, রিয়াজুর রহমান, শাহবাজ খান এরা তিনজনই আমাদের পরিচিত। তৃতীয়ত, এদের মধ্যে কেউ একজন আমাদের শত্রুপক্ষের সাথে জড়িত ছিল। আর মির্জা গ্রুপের শাহেদ মির্জায় আমাদের প্রথম শত্রু। ইমন, আমাদের হাতেই সব ক্লু আছে। অথচ একটা জিনিসই সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। আর সেটা হলো, কেন রহমত চাচা আমাদের সেদিন বাঁচিয়েছিলেন?”
চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪০: ২য় ভাগ||
৭০.
ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে আছে তাহমিদ। রহমতুল্লাহর কিছু তথ্য আগে থেকেই তাদের জানা ছিল। এখন সে পুরোনো তথ্যগুলোর সাহায্যে রহমত চাচার সম্পূর্ণ অতীত-ইতিহাস বের করে নিলো৷ এরপর ইমনের কাছে এসে বলল,
“ইমন, উনি আমাদের নিজের সম্পর্কে কিছুই মিথ্যে বলে নি। উনি যেই কোম্পানিতে কাজ করতো, সেই কোম্পানির মালিকের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। রহমত চাচা একটু জেদি মানুষ ছিলেন। কার সাথে নাকি ঝামেলা হয়েছিল, এরপর চাকরিটা ছেড়ে দেন।”
ইমন বলল,
“এরপরই তিনি মৈত্রী গ্রুপে কাজ নিয়েছিলেন!”
“হ্যাঁ, কিন্তু উনি এতো অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাই বেশিদিন আমাদের কোম্পানিতে কাজ করতে পারেন নি। আর উনার জন্য সেই সময় মৈত্রী গ্রুপ ছোটখাটো একটা সমস্যায় পড়েছিল।”
“উনি কি এই জন্য প্রতিশোধ নিয়েছেন?”
“ইমন, জাস্ট তার অযোগ্যতার জন্যই তাকে কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এর সাথে খুনের কোনো সম্পর্ক নেই।”
“আচ্ছা, তাহলে এখন উনি কোথায় আছেন?”
“যাকে জিজ্ঞেস করেছি, সে আর কিছুই জানে না। তবে তার ঠিকানা দিয়েছে।”
“কোথায় থাকেন?”
তাহমিদ বলল,
“কাপাসগোলা। বাকিটা আমাকে ইমেইলে পাঠাবে বলেছে। ঠিকানাটা পাঠালে আজই আমরা রাতের দিকে ওই বাড়িটা দেখে আসবো।”
সন্ধ্যায় রহমতুল্লাহর খবর দেওয়া লোকটি ঠিকানা পাঠিয়ে দিল। তাহমিদ আর ইমন সেই ঠিকানায় চলে গেল। ইমন রহমতুল্লাহর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই বাড়ি উনার।”
তাহমিদ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“উনি যদি একতলার সেমি পাকা বাড়িতে থাকেন, তাহলে আমাদের প্রতি মাসে বা দুই মাস পর পর এতো টাকা কিভাবে পাঠাতেন? এমন বাড়িতে থাকা মানুষের কাছে ছ’টা ছেলের খরচ বহন করা তো সহজ কথা না।”
“হয়তো উনার এখনই এই অবস্থা, আগে ভালো অবস্থায় ছিল। আর এমনও তো হতে পারে আমরা ভুল ঠিকানায় এসেছি। একটা কাজ করি, আগে আমরা উনার জন্য অপেক্ষা করি। কোনো না কোনো সময় তো উনি বাসা থেকে বের হবেনই। এরপর যদি নিশ্চিত হই, এটা উনার বাড়ি। তাহলে এখানের কাউকে জিজ্ঞেস করে নেবো, তিনি কতো বছর ধরে এখানে আছেন।”
তারা দু’জন সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত রহমতুল্লাহর অপেক্ষায় ছিল। ঘড়ির কাঁটা ঠিক সাড়ে এগারোটার ঘর ছাড়তেই হঠাৎ তাহমিদ ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। ইমন তার হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো!”
তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“পা’টা অবশ হয়ে আসছে।”
ইমন তাকে টেনে উঠালো আর পাশের একটা দোকানের সিঁড়িতে বসালো। তাহমিদ বলল,
“যেই কাজে এসেছি, তুই সেই কাজটা কর।”
“তোর খারাপ লাগলে হোটেলে ফিরে যাই, চল৷ আমরা অন্য একদিন আসবো।”
“না। এতো সময় নেই আমাদের হাতে।”
ইমন তাহমিদের জোরাজুরিতে আবার সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর ইমন এসে তাহমিদকে বলল,
“এমনও তো হতে পারে আমরা এখানে আসার আগেই রহমতুল্লাহ বাসায় ঢুকে পড়েছিল।”
হঠাৎ তাহমিদ চোখ বড় বড় করে সামনে তাকালো। ইমন পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো রহমতুল্লাহ একটা বড় গাড়ি থেকে নামছে। ইমন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“সেমি পাকা বাড়ি, আর এতো বড় গাড়ি। অদ্ভুত তো!”
রহমতুল্লাহ হাত নেড়ে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা আগন্তুককে বিদায় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। ইমন তাড়াতাড়ি সিগারেট ধরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো, যাতে রহমতুল্লাহর কোনো সন্দেহ না হয়। তিনি ঘরে ঢোকার পরই তাহমিদ আর ইমন রাস্তায় এসে দেখলো গাড়িটা চলে যাচ্ছে। তাহমিদ বলল,
“আমাদের গাড়িটার পিছু নেওয়া উচিত। হয়তো মির্জা গ্রুপের কেউ হবে।”
ইমন আশেপাশে রিকশা ছাড়া কোনো সিএনজি দেখতে পেলো না। এখন রিকশা নিয়ে এই গাড়ির পিছু করা অসম্ভব। ইমন তাড়াতাড়ি গাড়িটার নম্বর মুখস্থ করে ফোনে লিখে রাখলো। এরপর তারা হোটেলে ফিরে এলো।
রাতে ইমন তাহমিদের পায়ে ওষুধ মালিশ করে দিতে লাগলো। তাহমিদের পা ফুলে গেছে। সে ইমনকে বলল,
“আমি তো মনে হয় পঙ্গুই হয়ে যাবো। বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই পা’টা অবশ হয়ে আসে।”
“তোর কিছু হবে না। তুই রেস্ট কর। কাল আমি একাই বের হবো।”
“না, আমি তোকে একা ছাড়বো না।”
“আমি এখন আর বাচ্চা ইমন নই। আমি একাই যেতে পারবো।”
পরেরদিন ইমন একাই রহমতুল্লাহর বাড়ি গেলো। আশেপাশের লোকেদের সাথে কথা বলে জানতো পারলো তিনি প্রায় বিশ বছর ধরে এই বাড়িতে আছেন। ইমনের এবার সন্দেহ হলো। যেই মানুষ সেমি পাকা বাড়িতে বিশ বছর ধরে আছে, তার পক্ষে এতোগুলো টাকা তাও দুই মাস পর পর পাঠানো এতো সহজ হবে না। তাহলে উনি এতো টাকা কোথায় পেলেন? তিনি অন্তত কোনো বহুতল ভবনে ভাড়া থাকলেও এটা চিন্তা করা যেতো। এবার ইমন সবাইকে কনফারেন্স কল করে বিষয়টা জানালো। আরাফ বলল,
“এমনও তো হতে পারে, আমাদের নামে ব্যাংকে যেই একাউন্ট আছে, সেখান থেকেই তুলেছে।”
তাহমিদ বলল,
“কিন্তু এটা তো সম্ভব না। এর জন্য তো সাইন করা চেকবই লাগবে। আর ওইদিন বাড়িতে আগুন লাগার পর তো সব জরুরী কাগজপত্রও ছাই হয়ে যাওয়ার কথা।”
আহনাফ বলল,
“হয়তো উনার কাছে কোনো সাইন করা চেক বই আছে।”
ইমন বলল,
“আচ্ছা আমরা ব্যাংকে গিয়ে খবর নিয়ে দেখি।”
এর পরের দিন তাহমিদ আর ইমন দু’জনেই একসাথে ব্যাংকে গেলো। অনেকগুলো ব্যাংকেই তাদের একাউন্ট ছিল। সব’কটাই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় আট-নয় বছর বন্ধ থাকায় তাদের নামে থাকা ডিপিএসগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে গেছে। তাদের পুরোনো একাউন্টগুলো চালু করতে হলে তাদের বাবা-মার মৃত্যু সনদ আর তাদের পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে, যা এই মুহূর্তে অসম্ভব। সব খবরাখবর নিয়ে ইমন আর তাহমিদ হোটেলে ফিরে এলো। তাহমিদ ইমনকে বলল,
“এখন এই রহমত চাচা আমাদের মারাত্মকভাবে কনফিউজড করে দিচ্ছে।”
ইমন কিছু একটা ভেবে বলল,
“কেউ কি উনাকে টাকা দিচ্ছে?”
“কেন টাকা দেবে?”
“আমাদের ভরনপোষণের জন্য!”
“কে করবে এমন কাজ! সবাই তো আমাদের শত্রু।”
“এখানে কিছু একটা তো আমরা মিস করে যাচ্ছি। আচ্ছা, ওই গাড়িটা কার হতে পারে? রহমত চাচাকে এতো রাতে কে তার বাসায় পৌঁছে দেবে? আর এতো রাতে উনি আসছেনও বা কোথা থেকে। উনি যেই দোকানে চাকরী করেন ওটা একদম উনার বাসার কাছেই। বাসায় ফিরতে বিশমিনিট লাগবে। আর দোকান বন্ধ করেন আটটার পর। তাহলে এতো রাত পর্যন্ত তিনি কোথায় ছিলেন?”
“ওই গাড়িটা মির্জা গ্রুপের কারো হবে না তো?”
“আহনাফ এটাতে সাহায্য করতে পারবে। গাড়িটা ইন্ডিয়ান কোম্পানির। আর সেটা ইন্ডিয়া থেকেই এসেছে। তাই এই তথ্য পেলেও পাওয়া যাবে। কারণ মাওশিয়াতের চাচার অনেক বড় বড় বিজনেস কোম্পানির মালিকের সাথে সম্পর্ক আছে। উনি এই ব্যাপারে তথ্য নিয়ে ফেলবে।”
ইমন সেদিনই আহনাফকে গাড়ির ব্যাপারে জানালো। মাওশিয়াতের চাচাকেও সব বললো। তিনি আহনাফকে নিয়ে সেই কোম্পানির মালিকের সাথে দেখা করতে গেলেন। সেই মালিকের সাক্ষাৎ পেতে মোটামুটি এক সপ্তাহ লেগে গেলো। এই এক সপ্তাহ ইমন আর তাহমিদ মির্জা গ্রুপ আর বাস্কার গ্রুপের অনেক তথ্য বের করে ফেলেছে। আর এও জেনেছে মুন্সি গ্রুপের সাথে মির্জা গ্রুপের দ্বন্ধের কারণ শাহেদ মির্জার মেয়ে সাবা, সুলতান মুন্সীর ছেলে ইশমামকে ভালোবাসে। এমন খবরও পাওয়া গেছে, তারা কাজি অফিসে বিয়ে করতে গিয়েও করতে পারে নি। তবে এসবের কোনো নিশ্চিত সত্যতা নেই। এসব খবর মিথ্যেও হতে পারে, আবার কোনো অংশে সত্যও হতে পারে।
এদিকে গাড়ির কোম্পানির মালিক বাংলাদেশে তাদের যেই ব্রাঞ্চ আছে, সেখানে খবরটা পৌঁছালো। আর সেখান থেকে গাড়িটির মালিকের খবর আসলো প্রায় বিশদিন পর। আহনাফ নামসহ সম্পূর্ণ তথ্য ইমনকে মেসেজ করে পাঠিয়ে লিখলো,
“চাচ্চু ঠিকই বলেছে। শত্রু আমাদের নাকের ডগায় ছিল।”
ইমন নামটা দেখে চোখ বড় বড় করে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“গাড়ির মালিক কে?”
ইমন বলল, “মুরশিদ জুবাইয়ের।”
তাহমিদ নামটা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো, “মামা!”
“হ্যাঁ, তোর মামা। তোর মামা এই খুনের সাথে জড়িত!”
তাহমিদের হাত কাঁপছে। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“অসম্ভব। মামা আমার বাবা-মাকে খুন করবে কেন?”
“এটা তো উনিই জানবেন।”
ইমন এবার তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“উনি আমাদের সাথে অন্যায় করেছেন। আমি জানি তুই তোর মামাকে খুব ভালোবাসিস। উনি আগে অনেকবার বাসায় এসেছিল। তোকে অনেক আদর করতো। ভাই, এসবের জন্য কি তুই পিছিয়ে যাবি?”
তাহমিদ নিজেকে শান্ত করে বলল,
“অসম্ভব। আমি আমার বাবা-মা, দাদী, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত মুখ সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি। আর এর পেছনে যদি মুরশিদ জুবাইয়েরই থেকে থাকেন, তাহলে আমি উনাকে কখনো ক্ষমা করবো না।”
তারা বাংলাদেশে আরো দুই সপ্তাহ ছিল। এর মধ্যে মুরশিদ জুবাইয়েরের অনেক খবর তারা পেয়ে গেলো। এর মধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য ছিল, মুরশিদ জুবাইয়ের কয়েক বছর আগে বাস্কার গ্রুপে ইনভেস্ট করেছিল। এরও আগে মির্জা গ্রুপকে একটা প্রজেক্ট তৈরীতে সাহায্য করেছিল। এসব জানার পর খুনিদের মুখগুলো তারা চিনে আবার কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এবার তারা ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই স্থায়ীভাবে দেশে ফিরবে।
চলবে-
(