#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৩||
৭৩.
হলুদ শাড়ি আর ফুলের গহনার আবরণের ঢাকা পড়ে গেছে একটা বিধ্বস্ত মন। পিঁড়িতে পুতুলের মতো বসে আছে শতাব্দী। সবাই একে একে এসে তার গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে, আর তার দেহটা যেন সেই হলুদের স্পর্শে শিউরে উঠছে। সে নিজেও জানে না সে কোন ভাবনায় ডুবে আছে। কিছু এলোমেলো আলোছায়া তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই আলোছায়ার ভীড়ে ভেসে উঠছে প্রথম দেখা তাহমিদের সেই বিরক্তিমাখা মুখ, রোদে রাঙা হয়ে যাওয়া গাল, অসহায় চোখ, প্রশান্তির হাসি। এসব ভাবতে ভাবতেই তার চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো। এতোক্ষণ তার চোখ জোড়া পায়ের নখের দিকেই স্থির ছিল, এবার সে চোখ জোড়া উপরে তুলতেই সভার ভীড়ে সবুজ পাঞ্জাবি পরা সেই ছেলেকে দেখতে পেলো, যাকে সে এতোক্ষণ মনের আলোছায়ার ভীড়ে খুঁজছিল।
এদিকে তূর্য আর অরুণিকা শতাব্দীর সামনে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“শতাব্দী দিদি, তুমি আমাদের ফেলে চলে যাবে?”
অরুণিকার মুখে ‘শতাব্দী দিদি’ ডাকটা শুনে শতাব্দীর ভেতরটা আরো খালি হয়ে গেলো। শতাব্দী কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ছোট সখী, এভাবে পর করে দিলে আমায়? আমাকে শতু আপু ডাকবে না?”
অরুণিকা তূর্যের দিকে একবার তাকালো, তারপর বলল,
“আমি তো চেয়েছি তোমাকে আমার আপু করে নিয়ে যেতে। তুমিই তো দিদি হয়ে গেলে। কি হতো তাহমিদকে বিয়ে করলে? তুমি সবসময় আমার সাথেই থাকতে পারতে।”
তূর্য অরুণিকার হাত ধরে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললো। শতাব্দী মলিন হেসে বলল,
“আমার তো আপু হওয়ার যোগ্যতা ছিল না। ঈশ্বর এটাই চেয়েছিলেন। উনি আমাকে তোমার দিদি বানিয়েই পাঠিয়েছিলেন।”
আহনাফ তূর্যের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“কংগ্রাচুলেশন। নতুন জীবন সুখের হোক।”
শ্রীজা এসে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“দিদিকে হলুদ লাগিয়ে দাও।”
অরুণিকা হলুদ লাগিয়ে দিয়ে শতাব্দীকে বলল,
“জানো, কাল আমি তাহমিদকে প্রথম কাঁদতে দেখেছি।”
শতাব্দী চোখ বড় বড় করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা আবার বলল,
“ও কারো সামনে কাঁদে না। ওয়াশরুমে গিয়ে কাঁদে। ওর চোখ অনেক লাল হয়ে যায়। সায়ন্তনী আপু মারা যাওয়ার পর আরাফ যেভাবে কাঁদতো, এখন ঠিক সেভাবেই তাহমিদ কাঁদে। আমি আগে কখনো তাহমিদকে কাঁদতে দেখি না। ও কেন কাঁদে জানো?”
শতাব্দীর গলায় কিছু একটা আটকে যাচ্ছিল। সে কোনো শব্দ বের করতে পারছিলো না। তবুও অনেক কষ্টে অরুণিকার হাত ধরে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বলো না সখী। শুনতে পারবো না।”
অরুণিকা আরো কিছু বলতে যাবে তখনই আহনাফ বলল,
“অরু, এদিকে আসো।”
অরুণিকা নামতেই আহনাফ তার হাত ধরে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে বলল,
“শতাব্দীকে তাহমিদের ব্যাপারে কোনো কথা বলবে না!”
“কেন?”
“তুমি এসব বুঝবে না। এখন এসব বললে ঝামেলা হবে। তুমি কি চাও কোনো ঝামেলা হোক?”
“না, আমি কেন চাইবো? আমি তো চাই, ওরা দু’জন…!”
আহনাফ অরুণিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাকে প্রেম গুরু হতে হবে না। তুমি বয়সে অনেক ছোট। আমাদের এসব বুঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যেখানে আমরা চুপ করে আছি, সেখানে তোমাকে বুঝতে হবে, এটা সম্ভব না, তাই আমরা চুপ করে আছি।”
এদিকে ইমন আর মাওশিয়াত শতাব্দীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একপাশে গিয়ে বসলো। ইভান মেহমানদের খাওয়া-দাওয়ার দেখাশুনায় মাস্টারমশাইকে সাহায্য করছে। আরাফ তাহমিদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদ দূর থেকেই শতাব্দীর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর তূর্য এসে বলল,
“তুই শতাব্দীর সাথে কথা বলবি না?”
তাহমিদ মাথা নেড়ে সামনে পা বাড়ালো। তাহমিদ কাছাকাছি যেতেই শতাব্দী পিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ালো। তার মা কাছে আসতেই সে বলল,
“মা, স্নান করিয়ে দাও। গা জ্বলছে।”
শতাব্দী ভেতরে চলে যেতেই তাহমিদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। শ্রীজা হঠাৎ কোথা থেকে এসে তাহমিদের হাতে একটুখানি হলুদ লাগিয়ে দিলো। তাহমিদ সাথে সাথেই চমকে উঠলো। শ্রীজা বলল,
“শুনেছি, কনের গায়ে লাগানো হলুদ তার বরের গায়েই লাগে। যদিও এটা কতোখানি সত্য তা আমি জানি না। কিন্তু যদি সত্য হয়, তাহলে দেখবে তুমিই আমার দাদা হবে।”
তাহমিদ পকেট থেকে রোমাল বের করে হলুদগুলো মুছে নিলো। শ্রীজা তা দেখে বলল,
“দাদা, দিদি তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তুমি দিদিকে নিয়ে পালিয়ে যাও। তোমরা তো দেশে চলে যাবে। ওখানে নিয়ে গেলে এরা আর দিদিকে খুঁজে পাবে না।”
তাহমিদ কোনো উত্তর দিলো না। শ্রীজা মলিন হেসে বলল,
“দিদি ঠিকই বলেছে, তুমি তোমার কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারো না। তোমার চোখ দেখলেই সব বোঝা যায়।”
তাহমিদ চোখ বড় বড় করে শ্রীজার দিকে তাকালো। শ্রীজা আবার বলল,
“সবার চোখেই হাসি। শুধু তোমার চোখে বিষন্নতা। কেন দাদা? তুমি কষ্ট পাচ্ছো, তাই তো!”
“এমন কিছুই না।”
তাহমিদ কথাটি বলেই সরে গেলো। তারপর আরাফের সামনে এসে বলল,
“আমি বাসায় যাচ্ছি।”
আরাফও তাহমিদকে আটকাতে পারছিলো না। সে ইভানকে এসে বলল,
“আমি তাহমিদের সাথে বাসায় চলে যাচ্ছি।”
এদিকে ইভান অতিথিদের সাথে কুশল বিনিময় করার সময় খেয়াল করল, একটা অর্ধ বয়ষ্ক লোক বাইরের চেয়ারে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে ইমন আর মাওশিয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান কিছুটা সামনে এগুতেই সালেহ আলী তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ইভান তাকে দেখেই বলল,
“কেমন আছেন, চাচা?”
সালেহ আলী ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“আমি তো ভালো আছি। তুমি এখানে কি করছো? তুমি আমাদের মেহমান। চলো, ওখানে বসো গিয়ে।”
সালেহ আলী তাকে টেনে নিতেই সে পেছন ফিরে দেখলো, সেই লোকটি আর সেখানে নেই। ইভানের এবার সন্দেহ হলো। সে সালেহ আলীর সাথে কথা বলার মাঝেই মেসেজ করে বাকিদের বিষয়টা জানিয়ে দিলো। আরাফ ততোক্ষণে তাহমিদকে নিয়ে বাসায় পৌঁছে গেছে। সে দেখলো, ইভান গ্রুপে মেসেজ দিয়েছে,
“কেউ একজন আমাদের উপর নজর রাখছে। অরুণিকার উপর নজর রাখিস।”
আরাফ মেসেজটি দেখেই তাহমিদকে বলে বাসা থেকে বের হতে যাবে তখনই তাহমিদ এসে দরজা ভালোভাবে আটকে দিলো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“সর। দরজা বন্ধ করে দিয়েছিস কেন? অরুকে আনতে যাবো।”
তাহমিদ লাইট বন্ধ করে দিয়ে আরাফকে নিয়ে বারান্দায় এলো। আরাফ নিচে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটি দেখে বলল,
“এই গাড়িটা এখানে!”
“আমরা ওখান থেকে ফেরার সময় এই গাড়িটা আমাদের পিছু নিচ্ছিল। কিন্তু আমি এতোক্ষণ এটা স্বাভাবিক ভাবছিলাম। এখন ইভানের মেসেজ দেখে নিশ্চিত হয়েছি।”
“কি করবো এখন!”
“বাসা থেকে বের হতে হবে। ওরা জানে না আমরা ক’তলায় থাকি। কিন্তু এভাবে বের হলে তো চিনে ফেলবে।”
“কিন্তু সালেহ আলী তো জানে, আমরা কোথায় থাকি, ক’তলায় থাকি। তাহলে আজই কেন আসলো? আর এভাবেই বা কেন পিছু নিলো?”
হঠাৎ দরজায় বেল বেজে উঠলো। আরাফ আস্তে আস্তে দরজার সামনে গিয়ে পীপহোল দিয়ে দেখলো, একটা কালো কোট পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদ রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি নিয়ে এলো। আরাফ ধীরে ধীরে তার রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়ে আলমারির ভেতর থেকে একটা পিস্তল বের করে আনলো। তাহমিদ পিস্তলটি দেখে বলল,
“এটা কোথায় পেয়েছিস?”
“ইভান দিয়েছিল। ওর এক বন্ধুর বাবার পিস্তল। উনি পুলিশে চাকরি করেন।”
“এটা বেআইনী, আরাফ।”
“আইন কানুন মেনে চলার সময় এই মুহূর্তে নেই। ইভান এটা সিকিউরিটির জন্য এনেছে। আর এই বিষয়ে আমি আর ও ছাড়া কেউই জানে না।”
“আচ্ছা, এখানে কি বুলেট আছে?”
“হ্যাঁ, চারটা আছে।”
আরাফ পিস্তল নিয়ে দরজার কাছে আসতেই তাহমিদ বলল,
“আরাফ, আগে কখনো পিস্তল চালিয়েছিস?”
“না।”
“তাহলে, অভিজ্ঞতা ছাড়া বুলেটসহ পিস্তল হাতে নিয়েছিস কেন? কিভাবে চালাতে হয়, তা তো জানতে হবে।”
“আরেহ, এটা তো সবাই জানে।”
“না, ভাই। উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে গেলে? দাঁড়া, এক কাজ করি, বিক্রম দাদাকে ফোন দেই।”
“বিক্রম কে?”
“অরুণিকার কেইসে যিনি আমাদের সাথে ছিলেন!”
“তোর উনার সাথে যোগাযোগ আছে?”
“হ্যাঁ, আছে।”
“তাহলে, তাড়াতাড়ি ফোন দে।”
তাহমিদ ফোন দিতেই বিক্রম ফোন রিসিভ করলো। তাহমিদ পুরো ঘটনা খুলে বলতেই তিনি তখনই তার টিম নিয়ে তাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এদিকে লোকটা কিছুক্ষণ পর পর বেল দিচ্ছিল। হুট করে সে কোথায় চলে যাচ্ছে, আবার পাঁচ মিনিট পর পর এসে বেল দিচ্ছে। আরাফ ইভানকে মেসেজ দিয়ে বলে দিলো, বাসায় না আসার জন্য। তাই মাওশিয়াত তার চাচ্চুকে গাড়ি পাঠাতে বললো। আর সেই গাড়ি নিয়ে তারা সোজা মাওশিয়াতের বড় চাচার বাসায় চলে গেলো। মাওশিয়াতের বড় চাচা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। আর এই মুহূর্তে তার বাসাটাই সবার জন্য নিরাপদ। প্রায় দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে বিক্রম তাহমিদকে ফোন করলো। তাহমিদ বারান্দায় এসে দেখলো বিক্রম তার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর আগের গাড়িটাও নেই। পুলিশের গাড়ি দেখে হয়তো সেই গাড়িটা চলে গেছে। এরপর বিক্রম তাদের ফ্লোরে এসে তাদের নিয়ে নিচে নামলো, আর তার গাড়িতে করেই তাহমিদ আর আরাফকে মাওশিয়াতের চাচার বাসায় নামিয়ে দিলো।
তারা সবাই গোল হয়ে একটা রুমে বসে আছে। অরুণিকা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাওশিয়াত এসে বলল,
“অরুণিকাকে পাশের রুমে শুইয়ে দাও।”
আরাফ জোর গলায় বলল,
“না। ও ওখানেই থাকুক।”
“কি বলছো, আরাফ? ও এখন বড় হয়ে গেছে। বাসায় চাচীরা আছে। বড় চাচীই বললো ওকে নিয়ে আসতে।”
এবার ইমন বলল,
“আরাফ যেতে দে ওকে। মাওশিয়াত থাকবে তো অরুণিকার সাথে।”
আরাফ আরো জোর গলায় বলল,
“না, বললাম তো। ও এখানেই থাকবে। আমি আর আহনাফ নিচেই ঘুমাবো।”
মাওশিয়াত বলল,
“না, নিচে কেন থাকবে? পাশে আরেকটা রুম আছে, ওখানে দু’টো বেড পাশাপাশি আছে। তোমরা দু’জন বরং অরুণিকাকে নিয়ে ওখানেই থাকো।”
এরপর সবাই যার যার রুমে শুয়ে পড়লো। আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বসে আছে। তখন আরাফ বলল,
“আমাদের ওই বাসা ছাড়তে হবে।”
আহনাফ বলল,
“হ্যাঁ, আর ভাবছি, আমরা অরুকে নিয়েই দেশে ফিরবো। এখানে তুই আর ইভান একা থাকবি। অরুকে কার ভরসায় রেখে যাবি? ওখানে আমরা সবাই থাকবো!”
“আমি অরুকে কারো ভরসায় ছাড়তে চাচ্ছি না। ওর কিছু হয়ে গেলে?”
“আমি আছি তো।”
“আমি তোর উপর বিশ্বাস করতে পারবো না। অরু তোর কথা শুনবেও না। ও শুধু আমার কথায় শুনে।”
“আচ্ছা, তাহলে ওরা যাক! আমি এখানেই থেকে যাই। তোরা বাইরে থাকলে আমি অরুকে দেখবো।”
“হুম, সেটাই কর। আর আমাদের শুটিং শিখতে হবে। লাইসেন্স গান লাগবে।”
এদিকে সকালে এই বিষয়ে কথাবার্তা হতেই তূর্য বলল,
“টুইংকেল না গেলে আমিও এখানে থাকবো।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ওর সাথে তোর কি!”
“আমার ওকে ছাড়া ভালো লাগে না। ও আমার মন খারাপের বিনোদন।”
ইমন বলল,
“আচ্ছা, তাহলে আমরা সবাই একসাথেই দেশে ফিরবো। আরো একবছর অপেক্ষা করি। এই মুহূর্তে আমাদের একসাথে থাকা দরকার। আলাদা হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।”
ইভান বলল,
“তাহলে আমাদের দ্বিতীয় ধাপটাই আগে শুরু করা উচিত। আপতত বিজনেস দাঁড় করানো উচিত। আর কিছু ট্রেনিং দরকার। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আমরা এখনো শক্ত হই নি। তাই এই এক বছরে আগে আমাদের নিজেদের রক্ষা করার মতো ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তা হোক আর্থিক, বা শারীরিক।”
এদিকে রহমতুল্লাহর ফোনে কল এলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন বলে উঠল,
“কি হলো এটা?”
রহমতুল্লাহ কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“পুরো পরিকল্পনায় নষ্ট হয়ে গেছে, জনাব।”
“ওরা না ফিরলে আমাদের এতোদিনের পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যাবে।”
“দেখুন জনাব। হঠাৎ করেই যে এমন কিছু হবে!”
রহমতুল্লাহকে থামিয়ে লোকটা বলল,
“সব তোমার বোকামীর কারণে হয়েছে।”
“আমি তো ভেবেছি, ওরা ভয় পেয়ে কলকাতা ছেড়ে দেশে ফিরবে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু এখন তো ওরা দেশেই ফিরবে না বলছে।”
“কিন্তু জনাব, আপনি কিভাবে নিশ্চিত হয়েছেন যে ওরা দেশেই ফিরছে না?”
“তুমি কি ভাবছো, ওদের সাথে আমি আমার লোক রাখি নি? ওই ছ’জনের প্রতি পদক্ষেপের খবর আমার কাছে আছে। আমার লোক সবসময় ওদের সাথেই থাকে। ওরা যে তোমার উপর সন্দেহ করে দেশে এসেছিল একমাসের জন্য এটাও আমার লোকেই বলেছে। ভাগ্যিস সব আগেই জানতে পেরেছি, নয়তো ওরা জেনে যেতো, তুমি আমার লোক। এখন ওরা তা-ই দেখেছে, যা আমি দেখিয়েছি। ওরা এখন মুরশিদ জুবাইয়েরকেই সন্দেহ করছে।”
“কিন্তু জনাব, লোকটা কে যে আপনাকে এসব খবর দিচ্ছে!”
“তোমার এসব না জানলেও চলবে। এখন যা করার, আগে ওদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করো। ওদের দেশে আনার ব্যবস্থা করো। নয়তো সেই ছ’টা বুলেট তোমাকেই বিদ্ধ করবে।”
চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৪||
৭৪.
শতাব্দী বিয়ের শাড়ি পরে চুপচাপ বসে আছে। তার এক আত্মীয় তার হাতে শাঁখা পরিয়ে দিচ্ছে। এদিকে বাড়ি ভর্তি অতিথি ভীড় করেছে। মাস্টারমশাই বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ দিয়েছেন তাই ছ’জনই অরুণিকাকে নিয়ে বিয়েতে এসেছে। এদিকে তাহমিদ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ঢাক-ঢোল বাজানোর শব্দ কানে এলো। সবাই ‘বর এসেছে, বর এসেছে’ বলে শোরগোল ফেলে দিলো। মেয়েরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। তাহমিদ এক দৃষ্টিতে তার চন্দ্রিমার হবু বরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিরাজ কুমার, একজন সেনা অফিসার। তাকে দেখে তাহমিদ প্রশান্তির হাসি হাসলো। কারণ তার চন্দ্রিমার রাজপুত্র তার চেয়ে যোগ্যতায় অনেক ঊর্ধ্বে। সে মনে মনে ভাবলো,
“আমার চন্দ্রিমা তো রাজপুত্র পেয়েছে। এখন আর কিসের চিন্তা!”
শতাব্দীর মা মিতুবালা হবু জামাতাকে বরণ করে নিলেন। শ্রীজা বোনের কাছে এসে বলল,
“দিদি, বর এসেছে।”
শতাব্দী ধরা কন্ঠে বলল,
“তোর তাহমিদ দাদা ছিল ওখানে?”
শ্রীজা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হ্যাঁ।”
“তাহলে নিশ্চয় আমার হবু বরকে দেখেছে, তাই না!”
“হ্যাঁ, দেখবেই তো।”
শতাব্দী মলিন হাসি দিয়ে বলল,
“ওর জন্য তো আজ খুশির দিন। নিশ্চয় খুশি হয়েছে!”
শ্রীজা আর কিছু বললো না। এদিকে বিয়ের সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। তাই বরকে বিবাহ মণ্ডপে বসানো হলো। শতাব্দীকেও আনা হলো। পান পাতার আড়ালে ঢেকে আছে শতাব্দীর মুখ। শুধু মেহেদি রাঙা হাত দু’টিই চোখে পড়ছে। তাহমিদ শতাব্দীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার নিজেকে খুব নিঃস্ব মনে হচ্ছে। চোখ দু’টিও জ্বালা করছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। সে কেনই বা কাঁদবে? সে এটাই তো চেয়েছিল!
এদিকে শতাব্দীকে বসানোর পর সে ভীড়ের মাঝে তাহমিদকে খুঁজতে লাগলো। আর তাহমিদ নিজেকে আড়াল করে নিলো। মালাবদল হয়ে যাওয়ার পর মাওশিয়াত ইমনকে বলল,
“আমি এখন যাই। এতোক্ষণ থাকতে পারবো না।”
ইমন বলল,
“চলো, আমি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”
“তুমি একা আসবে আমার সাথে? অন্য কাউকে সাথে নিয়ে আসো। কারণ আমাকে নামিয়ে দেওয়ার পর তুমি তো একাই হয়ে যাবে। একা একা ওই বাসায় ফিরবে নাকি!”
তূর্য তাদের কথা শুনে বলল,
“আমার এখানে ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাবো। চল, ইমন। আমিও তোর সাথে যাবো।”
ইমন বলল,
“তুই থাক। শতাব্দীর সাথে তোর ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। এভাবে চলে যাবি?”
“তো কি করবো? এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাহমিদের বিধ্বস্ত মুখ দেখবো? দেখ কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মধ্যে আল্লাহ এতো ধৈর্য কিভাবে দিয়েছে? আমি ওর জায়গায় হলে হয়তো শতাব্দীকে উঠিয়ে নিয়ে যেতাম, নয়তো বিয়েতেই আসতাম না।”
ইমন আর তূর্য মাওশিয়াতকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেলো। এরপর সেখান থেকেই তারা বাসায় চলে যাবে।
এদিকে মাস্টার মশাই কন্যা সম্প্রদান করে তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। আর বললেন,
“মেয়েটা আমার, সুখে থাকুক, এটাই চাই।”
তাহমিদ মুচকি হেসে বললো,
“সুখে থাকবে, মাস্টার মশাই। ও তো লক্ষী একটা মেয়ে।”
মাস্টার মশাই তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“শতাব্দী কি তোমায় বিয়ের আগে কিছু বলেছিল?”
তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে মাস্টার মশাইয়ের দিকে তাকালো। তিনি আবার বললেন,
“জানি বলেছে। তোমার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাবা, তুমি আমার বিশ্বাস রেখেছো, তার জন্য তোমাকে কোটি কোটি ধন্যবাদ। তুমি আমার মেয়েটাকে গ্রহণ করলে, আমার অনেক সম্মানহানি হতো। শতাব্দী আমার বড় মেয়ে, এরপর পুচকিকেও বিয়ে দিতে হবে। মহল্লায় আমার একটা সম্মান আছে। আজ সব তুমিই রক্ষা করেছ।”
তাহমিদ এই মুহূর্তে কথা বলার ভাষায় হারিয়ে ফেললো। মাস্টার মশাই আবার বললেন,
“শতাব্দী তার মাকে তোমার কথা বলেছিল। এরপর মিতুই আমাকে বলেছে কিছু একটা করার জন্য। কিন্তু আমি বিশ্বাস নিয়ে বলেছিলাম, তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাবে না। ও তো বোকা মেয়ে। কিন্তু তুমি তো বুদ্ধিমান। দেখো, তুমি আমার কথা সত্য প্রমাণ করে দিয়েছো। আর তুমি আজ এসে আরো ভালোভাবে শতাব্দীকে বুঝিয়ে দিয়েছ, তুমি এই বিয়েতে অনেক খুশি। এখন আমার মেয়েটা নতুন সংসারে মন দিতে পারলেই হলো।”
মাস্টার মশাই কথাগুলো বলেই চলে গেলেন। তাহমিদের চোখ দু’টো ছলছল করছিল। আশেপাশের মানুষের বিশ্বাস আর সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে, সে তো নিজের মনকেই ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে। আর আজ সেটা তার কাছে সম্মানের পরিবর্তে কাঁটা হয়ে গেছে। লোকে বলে মহৎ কাজের পর আত্মিক প্রশান্তি আসে। আর তাহমিদের ক্ষেত্রে তো উল্টোটাই হচ্ছে। এখন তার আত্মার আর্তনাদ বাড়ছে। আর সেই আর্তনাদ একমাত্র সে নিজেই শুনতে পারছে।
বিরাজ কুমার শতাব্দীর সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়ার আগেই শতাব্দী শেষবার চোখ জোড়া উঠিয়ে ভীড়ের মাঝেই তাহমিদকে খুঁজতে লাগলো। তাহমিদ এবার সামনে এলো। তাদের চোখাচোখি হতেই তাহমিদ মুচকি হাসলো৷ আর শতাব্দীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সবাই হয়তো তা দেখে ভাবলো, নতুন জীবন শুরুর আনন্দে এই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কে জানতো, সেই ভীড়ে তখন দু’টো আত্মার বিচ্ছেদ হচ্ছিল! শতাব্দীর মুখ বরাবর ঘোমটা টেনে দিতেই তাহমিদ মাথা নিচু করে নিলো। আরাফ তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“বিয়ে শেষ হতে তো অনেক সময় লাগবে। আমি আর আহনাফ অরুকে নিয়ে চলে যাচ্ছি, তুই কি থাকবি ইভানের সাথে?”
তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“না, আমি থাকবো না। দাঁড়া, ইভানকে একা রেখে না যাওয়ায় ভালো।”
ইভান মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। গাড়ি মহল্লা থেকে বের হতেই পাশের অন্ধকার গলি থেকে বের হয়ে একটা কোট পরা ব্যক্তি, তার ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল,
“তাহমিদ ওর বন্ধুদের নিয়ে চলে গেছে।”
মুরশিদ জুবাইয়ের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি ফোনে থাকা লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“শুনো, কেউ একজন ওদের উপর নজর রাখছে৷ তুমি ওদের কাছাকাছি থাকবে। তাহমিদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়।”
“স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের টিম ওদের দিকে নজর রাখবো।”
মুরশিদ জুবাইয়ের ফোন রেখেই মনে মনে বললেন,
“রহমত সাহেবকে এই বিষয়ে কিছুই জানানো উচিত হবে না। লোকটাকে দিন দিন খুব সন্দেহ হচ্ছে। তিনি ছাড়া তাহমিদ আর ওর বন্ধুরা কোথায় থাকে, এটা কেউই জানে না৷ তাহলে সেদিন ওদের বাসার সামনে কে গিয়েছিল? কে তাদের উপর নজর রাখছে?”
মুরশিদ জুবাইয়ের বিড়বিড় করে বললেন,
“ভাগ্যিস, বিক্রমের মাধ্যমে আমি এই ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলাম। ওকে একটা ফোন দেওয়া উচিত।”
মুরশিদ জুবাইয়ের বিক্রমকে ফোন করতেই বিক্রম বলল,
“আংকেল, কেমন আছেন?”
“ভালোই আছি। তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি আমাকে তাহমিদের কথা জানিয়েছ।”
“কি যে বলেন, আংকেল। এটা আমার দায়িত্ব। আফটার অল, আপনি আমাদের পরিচিত মানুষ। বাবার সাথে আপনার ওঠাবসা ছিল। আর আপনি পরিচয় না দিলে আমি তো জানতামই না, তাহমিদ আপনার বোনের ছেলে।”
“হ্যাঁ। আমার এক পরিচিত লোক আছে, সে-ই বলেছিল তুমি নাকি অরুণিকার কেইস নিয়েছিলে। তারপর তোমার ডিটেইলস নিয়ে জানলাম, তুমিই সেই বিক্রম। আচ্ছা, তুমি কিন্তু তাহমিদের সাথে যোগাযোগ রাখবে।”
“জ্বি আংকেল, আমি ওকে মাঝে মাঝে ফোন দেই। যখন থেকে জেনেছি, ও আপনার ভাগ্নে আরো ভালোভাবেই কথাবার্তা হয়। তবে ও জানে না, আমি আপনার বলাতেই ওর সাথে যোগাযোগ রাখি।”
“আরেহ, এটা আবার ওকে বলতে যেও না।”
“না, না বলবো না। চিন্তা করবেন না।”
৭৫.
“আমি দেশে যাচ্ছি।”
তূর্যের এমন কথায় সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। আহনাফ বলল,
“মাস্টার্সে ভর্তি হবি না?”
“হবো, কিন্তু আপতত কিছু দিনের জন্য দেশে যাব।”
তাহমিদ বলল, “কিন্তু কেন?”
“আছে একটা কারণ।”
ইমন মুখে পাউরুটি নিয়েই বলল,
“দামপাড়ার ওই মেয়েটার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে হয়তো।”
ইমনের কথা শুনে তূর্য তাকে ব্যাঙ্গ করে বলল,
“দামপাড়ারা ওই মেয়েটার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে হয়তো।”
ইমন পানি দিয়ে পাউরুটি গিলে বলল,
“ওই তুই আমাকে ভেঙ্গাচ্ছিস কেন? আমি যেটা সত্য সেটাই বলছি।”
আরাফ জোর গলায় বলল,
“সকাল সকাল ঝামেলা করিস না তো। আগামী মাসেই আমরা বাসা চেঞ্জ করবো। আর তুই বলছিস দেশে যাবি।”
তূর্য বলল,
“আমি একা যাবো। তোদের নিয়ে যাবো নাকি!”
ইভান বলল,
“আর আমরা তোকে একা দেশে যেতে দেবো?”
“ভাই, তোরা বাসা চেঞ্জ করলে কর। আমি দেশে যাবো। আমি মেয়েটাকে কথা দিয়েছি। ও বার-বার রিকুয়েষ্ট করছিল।”
ইভান কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমাদের কলেজ থেকে একটা ট্যুরে নেবে বলেছে। আমি ভাবছি, সেই ট্যুরে না গিয়ে তোর সাথে দেশে যাবো।”
ইমন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আর আমরা এখানে ফার্নিচার নিয়ে টানাহেঁচড়া করবো!”
আরাফ বলল,
“ঠিক আছে, ওরা না হয় যাক। তুই তো এমনিতেই কোনো কাজ করিস না। সারাদিন মাওশিয়াতের সাথেই কথা বলিস। তূর্য আর ইভানের ভাগের কাজ করে, তুই পুরোনো কাজের মাশুল দিয়ে দিস।”
“আরাফ, তুই তো মারাত্মক জালিম। এভাবে আমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলি? আমি কিন্তু তাহমিদের সাথে দেশে গিয়ে অনেক কাজ করেছি।”
আহনাফ বলল,
“হ্যাঁ, মহান কাজ করেছিস। অর্ধেক সময় আমাকেই ল্যাপটপে বসিয়ে রেখেছিস। আর শুন, আমি মাওশিয়াতের চাচার সাথে ওই গাড়ির মালিকের খবর নেওয়ার জন্য অনেক দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছিলাম।”
ইভান চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ করবি তোরা? তোদের সমস্যা কি? তোরা চারজনই সারাদিন ঘরে যতো ঝামেলা বাঁধাস। বাসায় তো আমরা সারাদিন তোদের উদ্ভট কথা শুনার জন্যই বসে থাকি, তাই না? আমাদের তো আর কোনো কাজ নেই।”
তাহমিদ বলল,
“ঠিক বলেছিস, ইভান। তবে আমাদের ব্যাচেলর সংসার নিয়ে আলাদা পত্রিকা বের হলে, প্রতিদিন শিরোনামে আসতো, ‘আজ ইমন আর মাওশিয়াতের ঝগড়া, তাই সারাদিন ইমন কিছুই খায় নি।’ ‘বিশেষ শিরোনাম: তূর্য আর ইমনের ঝগড়া লেগেছে, তূর্য আজ ইমনকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে।’ ‘চলছে আহনাফ, তূর্য আর ইমনের ত্রিকোণ ঝগড়া, কে হবে এই ঝগড়ায় জয়ী?’ ‘আজ আবার অরুণিকার সাথে আহনাফের মারাত্মক মারামারি, মারামারির এক পর্যায়ে অরুণিকা তার নখ দিয়ে আহনাফের মুখ ছিঁড়ে দিয়েছে, পরিস্থিতি সামলাতে মাঠে নামলেন আরাফ চৌধুরী।'”
অরুণিকা বলল,
“তাহমিদ, ওইটাও থাকবে, কেমন! আজ আহনাফ বাথরুম থেকে বের হতেই ধপাস করে নিচে পড়ে গেছে।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আর তুমি যে দু’দিন আগে ঘুমাতে ঘুমাতে বিছানা থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল, ওইটা তো সবার আগেই থাকা দরকার।”
“আর তুমি যে ডাস্টবিন থেকে ঘড়ি নিয়ে পরেছিলে, ওইটাই প্রথম শিরোনাম হওয়া উচিত।”
“আর তুমি যে স্কুলে যাওয়ার সময় ড্রেনে পড়ে গিয়েছিলে, ওইটা তো বড় বড় করে শিরোনামে আসা উচিত।”
অরুণিকা এবার নাক ফুলিয়ে বলল,
“তুমি যে উলটো প্যান্ট পরে বের হয়েছিলে, সেইটা শিরোনামে আসা উচিত।”
আরাফ চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ, একদম চুপ। তাহমিদ তোর সমস্যা কি!”
তাহমিদ চোখ ছোট করে বলল,
“আমি আবার কি করলাম।”
ইভান বলল,
“আগুনে ঘি ঢেলেছিস শুধু। আর কিছুই করিস নি।”
আহনাফ বসা থেকে উঠে চলে গেলো। অরুণিকা আহনাফকে যেতে দেখে পায়ের উপর পা তুলে বলল,
“বালা টালি।”
অরুণিকার কথা শুনে আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। অরুণিকা ঠোঁটে এক আঙ্গুল রেখে ইশারায় বুঝালো, সে আর কোনো কথা বলবে না।
তিন সপ্তাহ পর।
আজ তূর্য আর ইভান বাংলাদেশে এসেছে। তারা ঢাকায় দুই দিন থেকে চট্টগ্রামে চলে এলো। চট্টগ্রাম আসার পর নিজেদের পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িতে গেলো। এরপর ভালো মানের একটা হোটেলে উঠলো। তূর্য উপমাকে মেসেজ করে বলল,
“আমি বাংলাদেশে এসেছি।”
উপমা মেসেজ দেখে খুশিতে লাফাতে লাগলো। সে তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো,
“আজ মা নানুর বাসায় যাবে। এরপর আমি বিকেলে বের হবো।”
“আচ্ছা।”
“রিকি, আমি তোমাকে কিভাবে চিনবো?”
“আমি আমার সেই গিটারটা নিয়েই আসবো।”
“নতুন কিনেছিলে ওইটা?”
“হ্যাঁ।”
উপমা ভার্সিটির ক্লাস করে বের হবে, তখনই তার এক বান্ধবী এসে বলল,
“চল, মেলায় যাবো। স্টেডিয়ামের পাশে মেলা বসেছে।”
উপমা বলল,
“না, আমার একটা কাজ আছে।”
“হ্যাঁ, আমরা তো ভুলেই গেছি। তুই তো ঘরে বসে ডিম পারিস। তোর আর কোথাও যাওয়া লাগবে না। তুই ডিম পার।”
উপমা মনে মনে বলল,
“আজ তো ঘরে বসে ডিম পারবো না। আজ তো আমার স্টার আসবে।”
উপমা বাসায় এসেই আলমারি খুলে বসে আছে। কি পরবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করার পর তার মনে হলো, শাড়ি পরলেই ভালো লাগবে। কারণ হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন,
“সাদা শাড়ি পরে মেয়েরা অনায়াসে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার সাথে মিশে যেতে পারে।”
উপমার হুমায়ুন আহমেদের এই উক্তি মনে পড়তেই সে সাদা শাড়ি বের করে পরে নিল। কপালে একটা কালো টিপ লাগিয়ে সে আয়নায় নিজেকে দেখে বলল,
“রিকি, মাই স্টার, আজ আমি তোমার জন্য সেজেছি। আজ আমি আমার জীবনের সেরা কাজটা করবো। সবসময় তো ছেলেরাই মেয়েদের ভালোবাসার কথা বলে। কিন্তু আমার ভালোবাসার গল্পটা উলটো হবে। আমিই তোমাকে আমার মনের কথা বলবো।”
এদিকে তূর্য ইভানকে নিয়ে উপমার বলা জায়গায় চলে এলো। ইভান তূর্যের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তূর্য বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”
“তুই সত্যি প্রেমে পড়েছিস, ভাবতে অবাক লাগছে।”
তূর্য অবাক হয়ে বলল,
“প্রেমে পড়েছি! তোকে কে বলল, আমি প্রেমে পড়েছি?”
“তো! এখানে কেন এসেছিস?”
“আমার ভক্তের সাথে দেখা করতে।”
ইভান রাগী কন্ঠে বললো,
“তূর্য আমি তোর মাথা ফাঁটিয়ে এখান থেকে যাবো।”
“সত্যি ইভান। আমি তো জাস্ট….জাস্ট এমনিতেই।”
“জাস্ট এমনিতেই কি? তাহলে তুই মেয়েটাকে ভালোবাসিস না?”
তূর্য হেসে ভাব নিয়ে বলল,
“তূর্য মেয়েদের প্রেমে পড়ে না। মেয়েরা তূর্যের প্রেমে পড়ে।”
“তোর এই পিঠ এখনো অক্ষত আছে কেন জানিস?”
“কেন?”
“কারণ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। এই কথা ইমন, তাহমিদ বা আরাফ শুনলে, তোকে এখানেই পিটিয়ে দম নিতো।”
হঠাৎ সাদা শাড়ি পরা একটা মেয়েকে লাল গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তূর্য নির্বাক হয়ে গেলো। ইভান তূর্যের চোখ অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখলো উপমা দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তূর্য তাদের উপমার ছবি দেখিয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা ছবির চেয়েও বেশি সুন্দর। ইভান তূর্যকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এখন হাঁ করে আছিস কেন? কিছুক্ষণ আগে কতো সুন্দর ভাষণ দিচ্ছিলি, তূর্য মেয়েদের প্রেমে পড়ে না। মেয়েরা তূর্যের প্রেমে পড়ে।”
“এটাকে প্রেমে পড়া বলে না। এটাকে চোখ দিয়ে দেখা বলে। আমি ওকে দেখছি। প্রেমে পড়ছি না।”
তূর্য উপমার সামনে এসে দাঁড়াতেই উপমা অবাক হয়ে গেলো। উপমা কিছু বলার আগেই তূর্য বলল,
“আমি জানি, আমাদের আগেও দার্জিলিং দেখা হয়েছিল। সেদিনই তুমি তোমার স্টারকে দেখেছিলে, অথচ চিনতে পারো নি। আর আজ আমি পরিচয় নিয়ে তোমার সামনে এসেছি। হাই, আমি আসলে রিকি নই। রিকি আমার ছদ্মনাম, আমার আসল নাম তূর্য আহমেদ।”
উপমা এখনো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তূর্য তার চোখের সামনে হাত নাড়াতেই সে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হাই, স্টার, আই মিন, তূর্য। এটা তোমার জন্য।”
তূর্য মুচকি হেসে ফুলটা নিতেই উপমা মনে মনে বলল,
“ইয়া আল্লাহ, তার মানে আমি আমার স্টারকে সেদিনই দেখেছিলাম? আর আজ সে আবারও আমার সামনে? এতো সুন্দর ছেলে, আমার প্রেমে কিভাবে পড়েছে? থাক, ভালোই হয়েছে। এখন বাবা-মাকে সহজে রাজি করানো যাবে। আমার স্টার তো সব দিক দিয়েই পারফেক্ট।”
তূর্য বলল, “কি ভাবছো?”
উপমা মুচকি হেসে বলল, “কিছু না।”
ইভান সামনে এসে তূর্যকে বলল,
“ভাই, তুই ওকে নিয়ে বস। আমি ওদিকটাই যাচ্ছি।”
“আচ্ছা। আর উপমা, মিট মাই ফ্রেন্ড, ইভান।”
উপমা বলল, “হাই, ভাইয়া।”
ইভান মুচকি হেসে বললো,
“হ্যালো। তোমরা বসো আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি।”
ইভান যেতেই তূর্য উপমাকে বলল,
“চলো। স্টেডিয়ামের ওদিকে মেলা হচ্ছে দেখলাম৷ ওখানেই যাই। গল্প করাও হবে, ঘুরাঘুরিও হবে।”
উপমা ভীত কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো, “না, না, না।”
তূর্য অবাক হয়ে বলল, “কোনো সমস্যা?”
“চলুন না, আমরা সামনের রেস্টুরেন্টেই বসি।”
“ওকে।”
চলবে-