অরুণিকা পর্ব -৫১+৫২+৫৩

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫১||

৮৫.
কলিং বেল বাজতেই উপমা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই সে একটা শাড়ি পরা মেয়েকে দেখে থমকে গেলো। উপমা মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“জ্বি, কাকে খুঁজছেন?”

শতাব্দী এদিক-ওদিক তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
“আমাকে তো দু’তলায় বলেছিল!”

“জ্বি?”

শতাব্দী আমতা আমতা করে বলল,
“না, আমি আসলে অরুণিকাদের বাসা খুঁজছি। আমাকে এই বাসার ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল।”

“হ্যাঁ, এটা ওদেরই বাসা। আপনি কে?”

“আমি শতাব্দী।”

পেছন থেকে তূর্য চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার কাছে এসে শতাব্দীকে দেখে আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আরেহ শতাব্দী, তুমি?”

তারপর সে শতাব্দীর হাত ধরে তাকে টেনে ঘরে ঢুকালো। উপমা অবাক হয়ে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। শতাব্দী ঘরে ঢুকে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“বাসায় কেউ নেই?”

তূর্য বলল, “না, আমিই আছি।”

শতাব্দী এবার উপমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওকে তো চিনলাম না!”

উপমা মুচকি হেসে বলল,
“আমি তূর্যের ওয়াইফ।”

শতাব্দী অবাক হয়ে তূর্যের মুখের দিকে তাকালো। তূর্য লাজুক হেসে বলল,
“বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না?”

শতাব্দী বলল,
“একদমই না। তুমি সত্যিই বিয়ে করেছো?”

“হ্যাঁ।”

“বাহ। আমি তো বলেছিলাম, তুমিই সবার আগে বিয়ে করবে। দেখো, আমার কথা সত্য হলো তো!”

উপমা শতাব্দীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি অরুণিকার কাছ থেকে আপনার নাম শুনেছি। আর আজ আপনার সাথে দেখাও হয়ে গেলো।”

শতাব্দী উপমার থুতনি ধরে বলল,
“বাহ, কি মিষ্টি মেয়ে! তোমাদের ব্যাচেলর ঘরে তাহলে এবার লক্ষী এলো!”

শতাব্দীর কথা শুনে উপমা লাজুক হেসে নিচের দিকে তাকালো। তূর্য একনজর উপমার দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“আমাদের ঘরে লক্ষী তো আগে থেকেই ছিল। আমার টুইংকেল কি কম লক্ষী?”

“আরেহ, আমার ছোট সখীর সাথে তো কারো তুলনায় হবে না।”

এবার শতাব্দী উপমার হাত ধরে বলল,
“গায়ক সাহেব তো আমাকে বিয়েতে দাওয়াতই করলো না।”

উপমা শতাব্দীর কথা শুনে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“তুমি নিজের সংসার থেকে বেরুতেই পারলেই তো তোমার খোঁজ পেতাম! বিয়ের পর তো তোমার কোনো খবরই পাই নি।”

শতাব্দী মলিন মুখে বলল,
“হ্যাঁ, আমিও তো যোগাযোগ করি নি।”

কথাটা বলেই শতাব্দী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। উপমা শতাব্দীর মলিন মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

দুপুরে অরুণিকা স্কুল থেকে ফিরে শতাব্দীকে দেখে তাকে ঝাপটে ধরলো। আরাফ আর আহনাফের সাথেও কুশল বিনিময় হলো। উপমা দুপুরের খাবার টেবিলে সাজিয়ে তূর্যের কাছে এসে বলল,
“খেতে আসো।”

তূর্য হঠাৎ উপমার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। উপমা তূর্যের এমন আচরণে অবাক হয়ে গেলো। তূর্য উপমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“শতাব্দীর সাথে আমাদের ব্যাপারে বেশিকিছু বলো না। আমাদের কিভাবে বিয়ে হয়েছে, বিয়ের দিন কি হয়েছে, এসব একদমই বলবে না। বলবে দেখা হয়েছে, এরপর প্রস্তাব পাঠিয়েছি, এতোটুকুই।”

তূর্য কথাগুলো বলে উপমাকে ছেড়ে দিলো৷ উপমা তূর্যের হাত ধরে বলল,
“আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে!”

“কি কথা?”

“আমাকে কেন বিয়ে করেছিলে?”

তূর্য অপরাধীর চোখে উপমার দিকে তাকালো। উপমা আবার বলল,
“আমাদের বিয়ের দুই মাস হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তোমার চোখে কখনো ভালোবাসা দেখি নি। সারাদিন অরুণিকার সাথেই ব্যস্ত থাকো। কখনো বা ভাইয়াদের সাথে আড্ডা দাও, স্টুডিও বা গিটার নিয়ে ঘরের এক কোণে বসে থাকো। আমি যে এখানে আছি, সেটা তোমার শুধু রাতে বিছানায় গেলেই মনে পড়ে।”

তূর্য স্থির দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে রইলো। উপমা মলিন মুখে বললো,
“খেতে আসো। আজ তোমার পছন্দের তরকারি রান্না করেছি। আরাফ ভাইয়া বাজার করে এনেছিল। তোমাকে তো লিস্ট দিয়েছিলাম, কিন্তু নিয়ে যাও নি।”

উপমা কথাগুলো বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তূর্য ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। এই মুহূর্তে তার নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। বিয়ের আগে সে নিজের যা ইচ্ছে হতো তাই করতো, এখনো তাই করছে। কিন্তু তার ইচ্ছেমতো চলাফেরায় উপমা বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সারাদিন তার পাঁচ বন্ধু তাকে বলে উপমাকে সময় দিতে। কিন্তু তার উপমার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে না। সে উপমার সাথে বেশিক্ষণ বসলেই বিরক্ত হয়ে পড়ে। কারণ উপমার উষ্ণ ভালোবাসাগুলো তূর্যের কাছে খুবই বেরসিক মনে হয়। তার চেয়ে অরুণিকার সাথে হাসাহাসি করতেই তার অনেক ভালো লাগে। সে গম্ভীর মানুষ খুব কম পছন্দ করে, আর উপমা দিন দিন যেন গম্ভীরই হয়ে যাছে। খুব একটা হাসে না, সবসময় মুখটা মলিন করে রাখে, ঠান্ডা গলায় কথা বলে, যা তূর্যের মোটেও পছন্দ হয় না। উপমা বিয়ের আগে এমন ছিল না। অনেক হাস্যজ্বল ছিল, তাদের যখন প্রথম দার্জিলিং দেখা হয়েছিল, তখনও সে উপমার মধ্যে একটা হাস্যরস দেখেছিল, যা এখন আর খুঁজেই পাওয়া যায় না।

এদিকে তাহমিদ সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকে শতাব্দীকে দেখে থমকে গেলো। শতাব্দী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তাহমিদ ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এসে তাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“কেমন আছ?”

শতাব্দী মলিন মুখে বলল,
“তুমি তো জানোই আমি কেমন আছি।”

তাহমিদ শতাব্দীর চোখের দিকে তাকালো। সে শতাব্দীর চোখে মলিনতা ছাড়া কিছুই দেখলো না। আর সেই চোখ দু’টি তাহমিদের বুকটা কাঁপিয়ে দিল। তার চন্দ্রিমা কি সত্যিই ভালো নেই? কিন্তু কেন ভালো নেই? শতাব্দী কি এখনো তাকে ভুলতে পারে নি?
তবে তাহমিদ নিজেকে শান্ত রাখলো। সে মলিন হেসে বলল,
“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি বসো।”

তাহমিদ নিজের ঘরে এসে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। বারান্দায় গিয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এখন তার চোখ দু’টো জ্বালা করছে। বুকটা ভারী ভারী লাগছে। সে মনে মনে ভাবছে, কেন এসেছে শতাব্দী? কেন শতাব্দী বার বার তার চোখের সামনে এসে তাকে দুর্বল করে দেয়? কেন শতাব্দীকে না পাওয়ার কষ্টে তার দম বন্ধ হয়ে আসে? কেন খুব অধিকার নিয়ে শতাব্দীর হাতটা ধরতে ইচ্ছে করে? তাহমিদ এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পায় না। তার জীবনটা প্রশ্নের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেছে। আর এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর তার কাছে নেই।

বিচিত্র এই জীবনে কেউ ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়েও তার হাতটা ধরতে চায় না, আর কেউ না পেয়ে সেই হাত ধরার মিথ্যে স্বপ্ন বুনতে থাকে।

এদিকে বিক্রম রাহেলার ফোন রেকর্ডিং বের করে ছ’জনকে পাঠালো। যদিও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না। শুধু তারা কি করছে না করছে এসব তথ্য রাহেলা একজন অপরিচিত লোককে জানিয়েছিল। রাহেলা যার সাথে কথা বলেছে সে একজন বাংলাদেশী নাগরিক। বিক্রম সিমটির মালিকের তথ্য বের করে আরাফকে পাঠালো। আরাফ মালিকের নাম দেখে চমকে উঠলো। আহনাফ আরাফের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরাফ, লোকটা কে?”

আরাফ থমথমে কন্ঠে বলল,
“শাহবাজ খান।”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“অরুণিকার মামায় তাহলে আমাদের শত্রু?”

“হ্যাঁ।”

ছ’মাস মাস পর মাস্টার্সের ফলাফল হাতে নিয়েই তারা বাসায় ফিরলো। ছ’জনের পড়াশুনা শেষ। এবার বাংলাদেশ ফেরার পালা। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। সব কাজ সম্পন্ন করে তারা বাসে উঠে পড়লো।

দশ বছর আগের এপার আর ওপারের গল্প। দশ বছর আগের এক রাতে সিলেট থেকে কলকাতা নামক এক অজানা শহরে এসেছিল ছ’জন মাঝ বয়সী কিশোর। সেদিন তাদের হাতে আবদ্ধ ছিল চার বছর বয়সী ছোট্ট অরুণিকার হাত। চোখে ছিল ভীতি, হতাশা আর ক্লান্তি। এই শহরে এসে দেখা হয়েছিল শতাব্দীর মতো মিষ্টি একটা মেয়ের। সাক্ষাৎ হয়েছিল আলেয়া আপা আর মাস্টারমশাইয়ের মতো উষ্ণ হৃদয়ের মানুষের সাথে। দেখা হয়েছিল হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষ সায়ন্তনীর সাথে। আবার কিছু ভয়ংকর মুহূর্তের সাক্ষী দেওয়া যতি আর বাঁধনদেরও আজ তারা ফেলে আসছে কোনো এক রাস্তার মোড়ে।
কলকাতার রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে এখনো তাহমিদের মিষ্টান্ন ভোজনের গন্ধ পাওয়া যায়, ইমনের মাঠে মাঠে বল নিয়ে দৌঁড়ানো, আর তার প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে থাকা যেন এখনো সেই স্কুলের মাঠে-বারান্দায় গেঁথে আছে। কলকাতার লাইব্রেরিগুলোতে এখন আর ইভানের পদচিহ্ন পড়বে না। তূর্যের স্টুডিও এখন বন্ধ। গেইটে তালা দেওয়া। আহনাফের বাইকটার মালিক আজ অন্য কেউ হয়ে গেছে। যেই বাইকে করে এই শহরে তার নিরব ভালোবাসা নিয়ে ঘুরাফেরার স্মৃতি জেগে আছে। আরাফকে এখন আর কখনোই সায়ন্তনীর দোকানের সামনে দেখা যাবে না, যাবে না অরুণিকাকে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ছুটতে।
ফেলে আসা মানুষগুলোকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়ে এবার জন্ম নিতে যাচ্ছে সাতটি নতুন জীবন। আর আজ দশ বছর পর ঠিক আগের মতো পুরোনো শহরে ফিরছে ছ’জন পঁচিশ বছর বয়সী যুবক। যাদের চোখে এবার জমেছে দুঃসাহসিকতা আর প্রতিশোধের নেশা। আর তাদের হাতের মুঠোয় এবার ভরসার হাত হয়ে আছে চৌদ্দ বছরের বালিকা, অরুণিকা।

চলবে–#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫২||

৮৬.
চার বছর পর-
টুইংকেল হাউজ আজ বিয়ের সাজে সেজেছে। বাড়ির গেইটটি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বাগানের প্রতিটি গাছের সাথে মরিচ বাতি ঝুলছে। ভেতরে ঘর সাজানোর কাজ চলছে। বাইরে থেকে কয়েকজন লোককে কাজে রাখা হয়েছে। রান্নাঘরে বিভিন্ন পদের মিষ্টান্ন তৈরী করছে তাহমিদ, আর তাকে সাহায্য করছে উপমা। পাশেই ডায়নিংয়ে খাবারের প্লেট সাজিয়ে রাখছে তূর্য। বসার ঘরে বসে মেহমানদের তালিকা তৈরী করছে আরাফ আর আহনাফ। এদিকে ইভান ইমনকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য দু’তলায় উঠেছে। ঘড়িতে দুপুর বারোটা। এখনও তার ঘুম থেকে উঠার কোনো লক্ষণ নেই। ইভান ইমনকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
“উঠ না, ইমন। আজ তোর এনগেজমেন্ট, ভুলে গেছিস নাকি? মাওশিয়াতের বাবা-মা আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। বাসায় অনেক কাজ। কখন উঠবি?”

ইমন চোখ কচলাতে কচলাতে বলল,
“ভাই, তুই যা না। আমি আরেকটু ঘুমাবো।”

হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে পুরো ঘর গুঞ্জন করে উঠলো। ইমন সাথে সাথেই বালিশ থেকে মাথা তুলে এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। আহনাফ এসে দরজা খুলে দেখলো আদিল এসেছে, আর তার পাশে ইমান দাঁড়িয়ে আছে। ইমানকে দেখেই আহনাফের মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো। ইমান আহনাফকে দেখেই তার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। এদিকে উপমা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ভাইকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরলো। আর আদিল বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। উপমা এবার ইমানকে দেখে বলল,
“আরেহ, ইমান। কেমন আছো?”

ইমান মাথা নেড়ে বলল,
“জ্বি, আপু। ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?”

“হ্যাঁ, ভালো। বসো বসো।”

ইমান আরাফের পাশে বসলো। আরাফ একবার ইমানের দিকে তাকালো, আরেকবার আহনাফের দিকে। আহনাফের মুখের অন্ধকার ভাবটা বুঝিয়ে দিচ্ছে ইমানের আগমনে সে খুশি হয় নি। এদিকে উপমা দু’তলায় উঠেই ইভানের মুখোমুখি হলো। ইভান তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কে এসেছে?”

“ভাইয়া আর ইমান এসেছে।”

“ওহ আচ্ছা। তাই বলো! আর ইমন ভেবেছে মাওশিয়াতের ফ্যামিলি এসেছে। তাই প্রথম বেল শুনেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছে।”

উপমা হেসে বলল,
“এক প্রকার ভালোই হয়েছে। মাওশিয়াত আপুরা রাস্তায় আছে৷ যেকোনো সময় চলে আসবে। ইমন ভাইয়া আগে থেকেই তৈরী হয়ে নিলে আর দেরী হবে না। আচ্ছা, ভাইয়া, আমি অরুণিকাকে ডাকতে যাচ্ছি। ওরও হয়তো এখনো ঘুম ভাঙেনি।”

উপমা পাশের সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠলো। তিনতলার একদম শেষের ঘরটা অরুণিকার। উপমা তার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“মুনলিট, কোথায় তুমি? দরজা খুলো। বাসায় গেস্ট আসা শুরু করে দিয়েছে। ভাইয়া আর ইমানও এসে গেছে।”

‘ইমান’ নামটি শুনে অরুণিকা লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলো। তার এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর এসে ছড়িয়ে পড়েছে। সে চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বলল,
“ভাবী, আমি উঠে পড়েছি।”

উপমা চলে যেতেই অরুণিকা তাড়াতাড়ি আলমারী খুলে কাপড় খুঁজতে লাগলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে তার পছন্দের লাল রঙের জামাটা বের করে মুচকি হাসলো৷ প্রায় বিশ মিনিট ধরে আয়নার সামনে বসে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে সে ঘর থেকে বের হলো।

ছয় বন্ধুর পরিশ্রমে এই ‘টুইংকেল হাউজে’ তারা গত বছরই উঠেছিল। চারতলা বাড়ি। উপরে ছাদের পাশেই ছোট একটা সুইমিংপুল। সুইমিংপুলের নিচ বরাবার প্রতিটি ঘরের বারান্দা। বারান্দাগুলো এক একটা রুমের সমান বড়। অরুণিকার ঘরটি তিনতলার দক্ষিণ মুখী। পাশেই আরাফের ঘর। আর আরাফের ঘরের মুখোমুখি ইভানের ঘর৷ এরপর সিঁড়ি ঘর। সিঁড়িঘরের সাথে লাগানো বিশাল বড় লাইব্রেরি। এই ঘরটি বই পত্র আর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রে ভরে আছে। ছ’জন এখানে বসেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ আলাপ জমায়। দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ মুখে তূর্যের স্টুডিও। এখানে বসে সে গান করে, আর ভিডিও বানায়। আর উত্তর দিকে আহনাফ, ইমন আর তূর্যের রুম। নিচ তলায় দক্ষিণ মুখে বসার ঘর, উত্তরে রান্নাঘর আর ডায়নিং। তূর্যের বিশেষ অনুরোধে এই বাড়ির নাম রাখা হয়েছে টুইংকেল হাউজ।

এদিকে অরুণিকা দু’তলার সিঁড়ি থেকে নিচের দিকে উঁকি দিয়ে বসার ঘরের দিকে তাকালো। বড় পর্দার জন্য ভেতরের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তাকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে তাহমিদ নিচ থেকে বলে উঠলো,
“অরুণিকা, কি করছো? রান্নাঘরে গিয়ে উপমাকে একটু সাহায্য করো। মাওশিয়াতরা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”

অরুণিকার নাম শুনে ইমান বসার ঘরের পর্দার ফাঁকা অংশের দিকে তাকালো। অরুণিকাও সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। পাশ ফিরতেই আহনাফ তার সামনে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা আহনাফকে দেখেই মুচকি হেসে বলল,
“কেমন লাগছে আমাকে?”

আহনাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। সবে আঠারোতে পা দিয়েছে অরুণিকা। তার চোখে-মুখে, চলন-বলনে যৌবনের সৌন্দর্য ঠিকরে উঠেছে। তার পিঠ বরাবর ঘন চুলগুলো হালকা এলোমেলো হয়ে আছে। তাই আহনাফ হাত বাড়িয়ে তার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কতোবার বললাম চুল বেঁধে আসো। এতো লম্বা চুল খোলা রাখলে এলোমেলো হয়ে যাবে তো।”

অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল,
“এতো কথা না বলে আগে বলো আমাকে কেমন লাগছে?”

আহনাফ মুচকি হেসে বলল,
“সুন্দর লাগছে। খুব সুন্দর লাগছে।”

অরুণিকা লাজুক হেসে রান্নাঘরে চলে গেলো। আহনাফও অরুণিকার পিছু পিছু এলো। উপমা আহনাফকে দেখে বলল,
“ভাইয়া, আপনি এখানে? কিছু লাগবে?”

“না, কিছু লাগবে না। এমনিতেই এসেছি।”

উপমা মুখ চেপে হেসে অরুণিকার দিকে তাকালো। তারপর আস্তে করে সরে গেলো। আহনাফ এমনিতে রান্নাঘরে পা দেবে না, কিন্তু যখনই অরুণিকা রান্নাঘরে ঢুকবে, তখনই আহনাফ তার আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। তাকে টুকটাক জিনিসপত্র এগিয়ে দেবে। অরুণিকাও এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ইদানীং আহনাফ তার পাশে না থাকলে তার কাজে ভুল হয়ে যায়। কখনো পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেঁটে ফেলে, কখনো বা হাতে গরম তেল ছিঁটকে পড়ে, কখনো কাচের জিনিস ভেঙে যায়, কখনো বা ভুল ভাল মশলা দিয়ে রান্নার বারোটা বাজিয়ে আসে।

অরুণিকা শরবত বানিয়ে ট্রে-তে উঠাতেই আহনাফ বলল,
“শরবত কার জন্য বানিয়েছো?”

অরুণিকা বলল,
“আদিল ভাইয়াদের জন্য।”

“উপমা বানিয়ে দিয়েছিল। ওদের নাস্তা দেওয়া হয়ে গেছে।”

“আচ্ছা, আমি না হয় আরেকবার দিয়ে আসি। আজ একটু গরম পড়ছে। দুই বার শরবত খেলে ভালো লাগবে।”

আহনাফ ট্রে হাতে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আমাকে দাও। আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

আহনাফ ট্রে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, আর অরুণিকা মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে রইলো। অরুণিকা মনে মনে ভাবছে, এখন কিভাবে ইমানের সামনে যাবে? কোনো অজুহাত ছাড়া সে এমনিতেই ইমানের সামনে যাবে, এটা অসম্ভব ব্যাপার। কারণ আরাফের নিষেধ আছে, ঘরে কোনো ছেলে, অতিথি হিসেবে আসলে অরুণিকা যাতে তাদের সামনে না যায়। বাসায় মাঝে মাঝে অফিসের লোক আসে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ব্যবসায়িক কাজে কিছু লোকের যাওয়া আসা হয়। ইমানও তেমনই। তবে ইমানের সাথে তাদের পরিচয়টা এক বছর ধরেই। আদিলই প্রথম ইমানের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ইমান একজন সাংবাদিক। সে পত্রিকায় লেখালেখি করার পাশাপাশি, ছোট একটা গোয়েন্দা সংস্থাতে কাজ করে। মূলত ইমান ছ’জনকে তাদের শত্রুপক্ষের সব তথ্য এনে দেয়। আদিল আর ইমানের কারণেই তারা ছ’জন এখন মির্জা গ্রুপ আর বাস্কার গ্রুপ সহ আরো অনেক ব্যবসায়ীক গ্রুপের তথ্য নিয়ে ফেলেছে।

এদিকে অরুণিকা মন খারাপ করে সিঁড়িতে বসে আছে। এই মুহূর্তে কোনো ভাবেই ইমানের দেখা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইমানকে তার খুব ভালো লাগে। যদিও কখনো তার ইমানের সাথে একা কথা বলার সুযোগ হয় নি। কিন্তু দূর থেকে ইমানের কথা শুনেই তার ইমানকে ভালো লেগে গেছে। অরুণিকার হাবভাব আরাফ আর আহনাফ ধরতে পেরেছে। তাই আরাফ ইমানকে বাসায় আনতে চায় না। তবে মাঝে মাঝে আদিলের সাথে ইমান বাসায় চলে আসে। এদিকে ইমানের প্রতি অরুণিকার দুর্বল হয়ে যাওয়াটা আহনাফের একদমই সহ্য হচ্ছে না। দিনদিন সে মানসিকভাবে ভেঙে যাচ্ছে। এতো বছর ধরে সে নিরবে অরুণিকাকে ভালোবেসে গেছে আর আরাফ ছাড়া কারো কাছেই সে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে নি। কিন্তু আজ তার ভালোবাসার মানুষটি অন্য কারো চোখে ভালোবাসা খুঁজতে ব্যস্ত।

আবার কলিংবেল বেজে উঠতেই আহনাফ দরজা খুলে দিলো। দেখলো মাওশিয়াত ও তার পরিবারের সবাই চলে এসেছে। তারা গতকাল কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিল। আর আজই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসেছে৷ এনগেজমেন্ট আর আক্দের পরই তারা মাওশিয়াতকে নিয়ে চলে যাবে। আর কয়েক সপ্তাহ পর ইমন সময় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মাওশিয়াতকে কলকাতা থেকে উঠিয়ে আনবে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কলকাতায় হবে। তবে বাংলাদেশে ইভান খুব আয়োজন করে ইমনের আক্দ অনুষ্ঠানটা করতে চাচ্ছে। সে আগে থেকেই আক্দের স্থানটি ঠিক করে রেখেছে। যেদিন ইমন আর মাওশিয়াতের আক্দ হবে সেদিনই তাদের জীবনে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ঘটতে যাবে, যেই দিনটির জন্য তারা চৌদ্দ বছর ধরে অপেক্ষা করেছিল।

মাওশিয়াতকে দেখেই অরুণিকা ছুটে গেলো। মাওশিয়াত খুব শক্ত করে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। এই চার বছরে অরুণিকার সাথে শুধু ভিডিও কলেই কথা হয়েছিল। তাই এতো বছর পর অরুণিকাকে দেখে সে আবেগ আটকে রাখতে পারলো না। অরুণিকাও ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। সে মাওশিয়াতের হাত ধরে বলল,
“জানো, আপু। তোমাকে কতো মিস করেছিলাম! ওখানের কথা আমার অনেক মনে পড়ে। আমার খুব ইচ্ছে করতো কলকাতায় যেতে৷ কিন্তু তোমার হবু বর আর তার ভাই-বন্ধুরা এই ঘর থেকে কাজ ছাড়া বেরুতেই চায় না। নিজেরা তো যাবেই না, আর আমাকেও যেতে দেবে না।”

মাওশিয়াত অরুণিকার থুতনি ধরে বলল,
“অরু, তুই কতো বড় হয়ে গেছিস! চাইলে নিজে নিজেই তো যেতে পারতি। থাক, এখন বিয়ে উপলক্ষে তো যাওয়া হবেই।”

সবার সাথেই মাওশিয়াত ও তার পরিবারের কুশল বিনিময় হলো। ইমনও ততোক্ষণে নিচে নামলো। সে এসেই মাওশিয়াতের বাবা-মাকে সালাম করলো। তারপর মাওশিয়াতের সামনে এসে দাঁড়ালো। মাওশিয়াত ইমনকে দেখে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“শেষমেশ আমায় ডেকেছো!”

ইমন মাথা নিচু করে মলিন মুখে বললো,
“সরি, অনেক দেরী করে ফেলেছি, তাই না?”

“অনেক বেশি। চার বছর ধরে তোমার অপেক্ষা করেছি। অনেকে অনেক কথা বলেছে। সবাই ভেবেছে, তুমি আমাকে কথা দিয়ে পালিয়ে গেছো। কিন্তু আমি জানতাম, আমার ইমন তার মাওকে কতোটা ভালোবাসে। তোমাকে চার বছর সময় দিয়েছিলাম, আমাকে সারাজীবন সময় দেওয়ার জন্য। আজ কিন্তু আমাকে সময় দেওয়ার সময় এসেছে।”

ইমন মাওশিয়াতের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“তুমি আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছ। আমি ভাবতাম, হয়তো স্বপ্ন পূরণ কর‍তে গিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলবো। কিন্তু না। তুমি আমার জন্য অনেক করেছো মাও। তোমাকে এর চেয়ে বেশি অপেক্ষায় রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

ইমন আর মাওশিয়াতের কথোপকথন শুনে তূর্য উপমার দিকে তাকালো। উপমা অপরাধীর মতো তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। চার বছরের সংসারে উপমা এখনো তূর্যের ভালোবাসা পায় নি। বাংলাদেশ আসার পর তারা শুরুর দিকে ভাড়া বাসায় ছিল। যেখানে উপমা আর তূর্য অরুণিকাকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে উঠেছিল। আর পাশের ফ্ল্যাটে বাকিরা ব্যাচেলরদের মতো থাকতো। তিন বছর তারা সেখানেই ছিল। এই তিন বছরে তূর্য বেশিরভাগ সময় বাইরে বা পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে বন্ধুদের সময় দিতো। তবে এর জন্য উপমাও অনেকখানি দায়ী৷ সে তূর্যের কাছে স্ত্রীর অধিকার কখনোই চায় নি৷ তূর্য যা করতো তা-ই সে মেনে নিতো। কখনো তূর্যের অবহেলা গায়ে মাখে নি। নিজেই সব কষ্ট মুখ ভুজে সহ্য করতো। কারণ উপমার মনে একটাই ভীতি ছিল, সে অধিকার চাইতে গেলে যদি তূর্য তাকে ছেড়ে দেয়? আর এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। আর তূর্য তাকে ছেড়ে দিলেই সবাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে। সবাই বলবে, আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখার পরিণতি এমনই হয়।
চার বছর ধরে উপমা নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে একদম নেতিয়ে পড়েছে। কারো সামনে সে কিছুই বলার সাহস পায় না। দুই বছর আগেই উপমা সন্তানসম্ভবা হয়েছিল। তূর্যের চোখেমুখে তখন অনেক আনন্দ ছিল। সেই মুহূর্তে তূর্য উপমার যথেষ্ট খেয়াল রেখেছিল। কিন্তু নিজের বেখেয়ালির কারণে তিনমাসেই উপমার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। এরপর থেকে তূর্য তার কাছ থেকে আরো দূরে সরে যেতে থাকে।
এদিকে তূর্যের পুরোনো অভ্যাস এখনো যায় নি। সে এখনো বিভিন্ন মেয়ের সাথে কথাবার্তা বলে। মাঝে মাঝে দেখাও করে। তবে তার প্রেম ঘটিত কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র বন্ধুত্ব পর্যন্তই গড়িয়েছে। অন্যদিকে উপমাও তূর্যের মেয়েদের সাথে ঘোরাফেরার খবর জানে-বুঝে, তবুও কোনো অভিযোগ করে না। আর উপমার এই চুপ করে থাকাটাই তূর্যকে আরো বেশি সুযোগ দিচ্ছে।

৮৭.

অরুণিকা আর উপমা খাবারের টেবিল গুছিয়ে সবাইকে খেতে ডাকলো৷ ইমানও আদিলের পিছু পিছু ডায়নিংয়ে এসে বসেছে। অরুণিকার সাথে চোখাচোখি হতেই ইমান চোখ নামিয়ে নিলো। অন্যদিকে আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আরাফ তা দেখে অরুণিকাকে বলল,
“অরু, তুমি এদিকে বসো। খেয়ে নাও।”

অরুণিকা আরাফ আর আহনাফের মাঝখানে এসে বসলো। অরুণিকা চেয়ারে বসে কোণা চোখে ইমানের দিকে তাকালো। আহনাফ অরুণিকার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,
“এদিকে দেখো অরু। কি কি দেবো?”

অরুণিকা আহনাফের হাত থেকে চামচ নিয়ে বলল,
“আমি নিচ্ছি।”

আহনাফ চুপচাপ খাচ্ছে। তার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। হঠাৎ আরাফ খাওয়ার মাঝখানে বলে উঠল,
“ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের পর পরই আরেকটা বিয়ের আয়োজন করবো ভাবছি।”

সবাই অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকালো৷ মাওশিয়াতের বাবা, মিরাজ হাসান জিজ্ঞেস করলেন,
“হ্যাঁ, বিয়ে তো একটা না, আরো চার-পাঁচটা হওয়া এখনো বাকি। তোমাদের সবারই তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে৷ মেয়ে পছন্দ থাকলে করে নাও। তূর্য তো আগেই বিয়ের কাজ সেরে ফেলেছে।”

“হ্যাঁ, বিয়ে তো হবে। তবে এবার আহনাফের বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ভাবছি।”

তূর্য একবার আহনাফের দিকে তাকালো, আরেকবার অরুণিকার দিকে। আহনাফ মনে মনে খুশি হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। আর অরুণিকা খাওয়া বাদ দিয়ে বলে উঠল,
“আহনাফ, তুমি সত্যি বিয়ে করবে? আমার তো অনেক ভালো লাগছে। এখন বাসায় আরো দুইজন নতুন সদস্য আসবে।”

অরুণিকার কথা শুনে ইভান আর তাহমিদ গম্ভীরমুখে আরাফের দিকে তাকালো। আর ইমন শব্দ করে হেসে উঠলো। ইমনের হাসির শব্দ শুনে অরুণিকা বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”

আরাফ অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“অরু, চুপচাপ খেয়ে নাও।”

অরুণিকা মাথা নিচু করে আহনাফের দিকে কোণা চোখে তাকালো। দেখলো আহনাফ খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা বাঁকা হাসি দিয়ে কনুই দিয়ে আহনাফের বাহুতে গুঁতো দিয়ে বলল,
“লজ্জা পাচ্ছো, তাই না!”

ইমন অরুণিকার কথা শুনে আরো জোরে হেসে উঠলো। এবার মাওশিয়াত ইমনকে বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”

ইমন ফিসফিসিয়ে বলল,
“সাসপেন্স আছে। শীঘ্রই জানতে পারবে।”

খাওয়া দাওয়ার পর তূর্য আরাফের কাছে এসে বলল,
“এভাবে খাবারের টেবিলে কথাটা কেন তুলেছিস?”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কেন কি সমস্যা?”

“আমাদের আগে টুইংকেলের মতামত জানা দরকার।”

“আমি অরুর ভালো-মন্দ বুঝি৷ আমার সিদ্ধান্ত ওর মতামতের চেয়েও ঊর্ধ্বে। কারণ ওর এই মুহূর্তে সঠিক মত দেওয়ার মতো বয়স হয় নি।”

“দেখ, চুক্তিটা কলকাতায় হয়েছিল। তার অর্থ এই না যে, চুক্তিটা বাস্তবায়ন করতেই হবে।”

“তুই কোন চুক্তির কথা বলছিস?”

“কলকাতায় টুইংকেলের কেইসে যেই চুক্তি হয়েছিল, সেটার কথা বলছি।”

“অবশ্যই না। আমি সেই চুক্তিতে বিয়ের কথা বলি নি। এটা আমার ইচ্ছে। ইনফ্যাক্ট, এটা দাদা-দাদীর শেষ ইচ্ছে। বাবা, চাচ্চুদের শেষ ইচ্ছে।”

তূর্য অবাক হয়ে বলল, “মানে?”

“দাদা আর দাদী অরুর জন্মের কিছুমাস পরই আহনাফের সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার অসিয়ত করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে বাবা দলিলে মৈত্রী গ্রুপে আমাদের ভাগের ৫০ ভাগ সম্পত্তি অরুণিকার নামে লিখে দিয়েছিলেন। কারণ আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। মাও মৃত্যুর আগে এটাই চেয়েছিলেন, যাতে আমি ডাক্তারি পড়ি। তাই আমি মৈত্রী গ্রুপের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ কখনোই পাবো না। আর দিশান তো অরুর ছোট ছিল। তাই তারা আহনাফ আর অরুর বিয়ের কথা বলেছিল। তারা ভেবেছিলেন, অরুর আঠারো হলেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন। আর অরু আমাদের বংশের একমাত্র মেয়ে ছিল। আমাদের কোনো ফুফিও ছিল না। দাদা-দাদি চায় নি, ও অন্য ঘরে যাক। এটাই দাদা-দাদির ওসিয়তনামা ছিল। আমার এটা পালন করতেই হবে।”

“কিন্তু আহনাফ!”

আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“একটা সময় আহনাফ এটা মানতে চায় নি। কারণ ও তখন ছোট ছিল। সবাই যখন ওর সামনে বিয়ের কথা বলতো ও অনেক রেগে যেতো। আর এটা অস্বাভাবিক কিছু না। কাজিন-কাজিনে কতো মারামারি হয়। আর অরুর জন্য ওকে বকা শুনতে হতো, তাই ও ভাবতো বিয়ের পর অরু ওর ঘাড়ে চেপে বসবে। এটা তো ছোট বয়সে মনে আসা স্বাভাবিক। ওর বয়সও তো তখন বেশি ছিল না। তোরো-চৌদ্দ ছিল মাত্র। আর তোরা জানতে চেয়েছিলি না, আহনাফ কেন অরুর ব্যাপারে খিটখিটে ছিল? এই কারণেই। কিন্তু ধীরে ধীরে তো ওর খিটখিটে ভাবটা কেটে গেছে, তাই না?”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তার মানে আমরা যেটা এতোদিন ভাবতাম, ওটাই ঠিক। আহনাফ টুইংকেলকে ভালোবাসে?”

“হ্যাঁ।”

“এটা কি শুধুই আমিই জানতাম না?”

“সবাই তো জানতো। তুইও জানতি। শুধু অজানা হয়েই থাকতি। আহনাফের হাবভাব দেখলে এটা বুঝে যাওয়া স্বাভাবিক।”

“হ্যাঁ, স্বাভাবিক। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু টুইংকেলের দিক থেকে এমন কিছুই নেই। ও আমাদের সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলে, আহনাফের সাথেও ওভাবেই কথা বলে। ও এটা মেনে নেবে তুই কিভাবে ভাবলি?”

“আমার কিছু ভাবতে হবে না। সময় সব ঠিক করে দেবে। আমি শুধু এতোটুকুই জানি, আজ অরুর জীবনের এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া খুবই দরকার। আর আমি জানি অরু আমার কথার অমান্য হবে না। ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের পরই আহনাফ আর অরুর বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।”

চলবে–

(আগামীকাল দুপুরে আরেকটা পর্ব দেবো।)#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৩||

৮৮.
আজ বাসা ভর্তি অতিথি। মাওশিয়াতের খুব কাছের আত্মীয়রাও টুইংকেল হাউজে চলে এসেছে। চারটার পর অনুষ্ঠান শুরু হবে। অরুণিকার খুব ইচ্ছে ছিল এই অনুষ্ঠানে গানের আয়োজন করবে। কেউ পারুক বা না পারুক সবাইকেই গান গাইতে হবে৷ আর গান গাইতে না পারলে তাকে ডেয়ার দেওয়া হবে৷ আর ডেয়ার দেওয়ার দায়িত্ব একমাত্র অরুণিকার কাছেই থাকবে। সে অনেকদিন ধরেই ইমনের কাছ থেকে তার এই আয়োজনের সম্মতি খুঁজছিল। কারণ যার এনগেজমেন্ট সে যদি রাজি হয়, তাহলে সবাই অংশগ্রহণ করতে বাধ্য। তবে অরুণিকার মূল উদ্দেশ্য ইমানের কন্ঠে গান শুনা। আর যদি সে গান গাইতে না চায়, তাহলে তার প্রিয় মানুষের নাম জেনে নিতে পারবে। দু’টোই অরুণিকার অনুকূলে আছে।
কিছুক্ষণ পর আবার বেল বেজে উঠলো। অরুণিকা শব্দ শুনে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সানায়া আপি এসেছে হয়তো।”

ইভান বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে মুখ ঘোরালো। অরুণিকা দরজা খুলেই দেখলো সানায়া দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশে রাহি। দু’জনেই অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। সানায়া অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“তুমি চেয়েছো, তাই আমরা এসেছি।”

তারা ঘরে ঢুকতেই সানায়ার সাথে ইভানের চোখাচোখি হলো। ইভান সানায়াকে দেখেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। সানায়া আর রাহি দু’জনই আকাশি রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। তবে সবচেয়ে বেশি সানায়াই ইভানকে মুগ্ধ করেছে। এই মেয়ের মধ্যে নিশ্চিত কোনো মুগ্ধতা আছে। নয়তো মনে এতো ঘৃণা থাকার পরও এই মেয়েটা তাকে বরাবরই আকর্ষণ করতে পারে। সানায়া জুতোয় টকটক শব্দ তুলে ইভানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ইভানের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। ইভান সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,
“আজকে তোমার সাথে কি বদমাশ লোকগুলো আসে নি?”

সানায়া ইভানের কথা শুনে থেমে গেলো। পিছু ফিরে বলল,
“না, ওদের বলে দিয়েছি, যেখানে যাচ্ছি সেখানে আরেকটা বদমাশ লোক আছে। সেই লোকটা থাকতে ওদের বদমাশি করার প্রয়োজন নেই।”

ইভান রাগী দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকালো। নেহাতই তিন বছর আগে সানায়া অরুণিকাকে একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, তাই ইভান চুপ করে আছে। নয়তো শত্রুর মেয়েকে নিজের চোখের সামনে সে একদমই সহ্য করতে পারছে না।
যদিও সানায়ার সাথে ইভানের আকস্মিকভাবে অনেকবার দেখা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশে আসার পর তারা যেই জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়েছিল, ভাগ্যক্রমে সেই এলাকায় রাহিদেরও বাসা ছিল। সেই সূত্রে সানায়ার সাথে ইভানের অনেকবার দেখা হয়েছিল। আর প্রতিবারই সানায়ার উল্টোপাল্টা আচরণে ইভানের তার প্রতি রাগ বাড়তেই লাগলো।

এদিকে ছ’জনই তখন অরুণিকাকে পাশের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল, যেই স্কুলে রাহি পার্ট-টাইম শিক্ষকতা করতো। আর অল্প সময়ের মধ্যেই অরুণিকার কলকাতার স্বরে কথা বলা, আর তার মায়াবী চেহারার জন্য রাহির তাকে খুব পছন্দ হয়ে যায়। এরপর থেকেই রাহি অরুণিকার সাথে দেখা করার জন্য মাঝে মাঝে তার বাসায় আসতো। একই এলাকায় থাকতো বিধায় তাদের মধ্যে খুব ভাব জমে যায়। বিশেষত উপমার সাথে তার খুব ভাব জমেছিল। দু’জনই বিকেলে কথাবার্তা বলে সময় কাটাতো। আর সানায়াও মাঝে মাঝে রাহির সাথে দেখা করার জন্য তাদের বাসায় আসতো। তখনই প্রথমবারের মতো উপমার সাথে সানায়ার দেখা হয়েছিল। ছ’জন তখন সানায়াকে রাহির বান্ধবী হিসেবেই চিনতো।

কিন্তু একদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে অরুণিকার সাথে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। তার স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা নির্মাণাধীন ভবন সামনে পড়ে। সেই ভবনটির কাঠামো খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখাও ছিল, এই রাস্তা দিয়ে চলাচল নিষেধ। কিন্তু অরুণিকা এসব খেয়াল করে নি। সে নিজের মনেই সেদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখনই উপর থেকে একটা পিলার ভেঙে পড়ার মুহূর্তেই সানায়া তাকে টেনে সরিয়ে দিয়েছিল। যদিও অরুণিকা ভবনটির ঠিক নিচ দিয়ে হাঁটছিল না। তাই পিলারটিও তার থেকে অনেক দূরেই পড়েছিল। কিন্তু অরুণিকার ভাষ্যমতে সানায়া না থাকলে সে পিলারের নিচেই পড়তো। আর সেটাই সে ছ’জনকে ভালোভাবে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে সানায়ার সাথে অরুণিকা আর উপমার আলাদা ভাব জমে যায়। শুরুর দিকে ইভান ছাড়া বাকি পাঁচজনের সাথেই সানায়ার খুব কথাবার্তা হতো। তূর্য তো একপ্রকার সানায়ার সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছিল। সানায়াও তূর্যের গান শুনার জন্য তার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। এসব দেখে উপমার অনেক খারাপ লাগতো, তবুও সে চুপ করে থাকতো। বরং সানায়া আর তূর্যকে আরো বেশি কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে নিজে রান্নাঘরে বসে চোখের জল ফেলতো। কিন্তু একদিন তারা হঠাৎ সানায়ার পরিচয় পেয়ে যায়। তারা জানতে পারলো সানায়া শাহেদ মির্জার ছোট মেয়ে। আর রাহি, সাহিল মির্জার বাগদত্তা। তবে আরাফ রাহিকে আগেও একবার সাহিল মির্জার সাথে দেখেছিল। কিন্তু সে এটা কারো কাছেই প্রকাশ করে নি। এরপর থেকেই ছ’জনই সানায়ার সাথে কথাবার্তা বলা কমিয়ে ফেলে। অন্যদিকে অরুণিকা আর উপমাকে বলে দিয়েছিল তাদের সাথে কম কথা বলার জন্য। কিন্তু অরুণিকা ছ’জনকে পালটা প্রশ্ন করে চুপ করিয়ে দিয়েছিল।
কেন সে সানায়া আপি আর রাহি মিসের সাথে কথা বলতে পারবে না?
অরুণিকার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছ’জনের কাছে ছিল না। তবে রাহির সাথে ছ’জনের তেমন একটা কথা হতো না। তাই সে এসব গায়ে মাখে নি। কিন্তু সানায়ার মনে প্রশ্নের দানা বাড়তেই থাকে। সে নিজেকেই প্রশ্ন করতে থাকে,
“কেন তারা আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে? কেন আমার সাথে আর আগের মতো কথা বলতে আসে না? তূর্যও আর গান শোনায় না। অজুহাত দিয়ে সরে যায়। তারা কি জেনে গেছে আমি খুনির মেয়ে? বাবা কি তাহলে সত্যিই খুনী?”

নিজের বাবাকে নিয়ে এমন বিতর্ক সে ছোটবেলা থেকেই সে শুনে এসেছে। তাই কেউ তার কাছ থেকে দূরত্ব রাখতে চাইলে, তার মনে হয় বাবার কারণেই তার সাথে এমন হচ্ছে।

এদিকে রাহি শাড়ির কুচির দিকে তাকাতে তাকাতেই সামনের দিকে হাঁটছিল। তখনই আরাফ বলে উঠল,
“সামনে তাকিয়ে হাঁটুন।”

রাহি চোখ তুলে আরাফকে দেখে চমকে উঠল। অল্পের জন্য আরাফের মুখোমুখি হয় নি। সে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই আরাফ বলল,
“ডায়নিংয়ে বসুন। নাস্তা করে নিন।”

রাহি মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। আরাফ আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। আর রাহি পিছু ফিরে আরাফের দিকে তাকালো, আর আনমনে হাসলো।

আরাফকে দেখলেই তার খুব শান্তি লাগে। মানুষটা কতো শান্ত! মানুষের কতো সাহায্য করে! কি সুন্দর করে এই সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছে৷ অরুণিকার কাছ থেকেই শুনেছে আরাফ অনেক দায়িত্ববান ছেলে। মাঝে মাঝে সে নিজ থেকেই আরাফ সম্পর্কে জানতে চায়। এতে তার একদমই বিরক্ত লাগে না। বরং সে আরাফ সম্পর্কে একই কথা বহুবার শুনেছে। তবুও তার স্বাদ মেটে নি। তার মধ্যে আরাফকে নিয়ে একটা ঘোর তৈরি হয়ে গেছে, যা রাহি নিজেই বুঝতে পারছে না। আর এই ঘোর তাকে ভিন্ন জগতে নিয়ে গেছে। যেখানে তার বর্তমানের কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু আছে সে আর তার আরাফকে নিয়ে বিশাল পরিসরের ভাবনা। রাহি টুকটাক লেখালেখি করে। আর ইদানিং তার লেখাগুলো আরাফকে ঘিরেই শুরু হয়।

এদিকে আবার বেলে বেজে উঠলো। ইভান আর তাহমিদ একে অপরের দিকে তাকালো। সব অতিথিই চলে এসেছে। এখন শুধু একজনের আগমন বাকি। হয়তো সে-ই এসেছে। তাদের দু’জনের সাথে আহনাফ আর ইমনও এগিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলতেই দেখলো কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটি। লোকটি ঘরে ঢুকেই ইমনের হাত ধরে তার সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন করলো। তারপর ইভান, তাহমিদ আর আহনাফের সাথেও তিনি আলিঙ্গন করলেন। আরাফ তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“আপনি এসেছেন তাই খুশি হয়েছি।”

ইমনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন সুলতান মুন্সী। সুলতান মুন্সীকে দেখে চমকে উঠলো ইমান। সে আস্তে করে নিজেকে আদিলের পেছনে আড়াল করে নিলো। ইমন মিরাজ হাসানকে উদ্দেশ্য করে সুলতান মুন্সীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল, ইনি মিস্টার সুলতান মুন্সী। আমাদের নেক্সট প্রজেক্টের ইনভেস্টর। উনি নিজেও একজন বড় ব্যবসায়ী। আমরা আমাদের নতুন প্রজেক্টের জন্য উনার সাহায্য নিচ্ছি। দেশে আসার পর উনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন।”

সানায়া আর রাহি সুলতান মুন্সীর পরিচয় শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। সানায়া রাহির হাত ধরে বলল,
“তার মানে ইনিই সুলতান মুন্সী, যার সাথে বাবার এতো শত্রুতা? আর তার ছেলেকেই আপু ভালোবাসে? ও মাই গড, বাবা যদি জানতে পারে, আমি এখানে এসেছি, যেখানে সুলতান মুন্সী এসেছে, নির্ঘাত আমার প্রাণ নিয়ে নেবে।”

রাহিও ভয়ার্ত চোখে সুলতান মুন্সীর দিকে তাকিয়ে রইলো। সাহিল যদি জানতে পারে, তাহলে তাকেও কোনো অংশে ছাড়বে না।

এদিকে অরুণিকা অতিথিদের ভীড়ে ইমানকে খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ইমান খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাচ্ছে। অরুণিকা ইমানকে চলে যেতে দেখে ঘর থেকে বেরুতেই আহনাফ তার হাত ধরে ফেললো। অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আহনাফ তার হাত আলগা করে দিয়ে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”

অরুণিকা আহনাফের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আহনাফও তার পিছু পিছু গিয়ে দেখলো, অরুণিকা ইমানের পিছু নিচ্ছে। আহনাফ দৌঁড়ে এসে অরুণিকার পথ আটকে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো, বলো?”

ততোক্ষণে ইমান গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অরুণিকা রাগী দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি সবসময় আমাকে বিরক্ত করো।”

আহনাফ আলতো করে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো, সেটা তো বলো? আর আমি কি তোমাকে একা বাইরে যেতো দেবো, হুম?”

“হ্যাঁ, এখন এটাই শিখে ফেলো। বিয়ের পর তো বউকেই সময় দিতে হবে।”

“হ্যাঁ, বউকেই তো দেবো। আমার বউ তো আমার সাথেই থাকবে। ওকে এক সেকেন্ডের জন্যও দূরে যেতে দেবো না।”

অরুণিকা পা ধাপিয়ে বলে উঠল,
“উফ! তোমার ফিল্মি ডায়লগগুলো আমাকে শুনাবে না, প্লিজ। আমার ভালো লাগে না এসব।”

আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে মলিন হাসলো। তারপর বলল, “বাসায় চলো।”

অরুণিকা গেইটের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আদিল ভাইয়ার বন্ধু চলে গেল কেন?”

আহনাফ অরুণিকার প্রশ্ন শুনে কিছুটা দমে গেল। সে ঠান্ডা গলায় বলল,
“হয়তো কোনো কাজে বেরিয়েছে। একটু পর চলে আসবে।”

আহনাফ তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতেই অরুণিকা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো। আহনাফ তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,
“অনেক কোমলভাবে তোমার হাতটা ধরেছিলাম, অরু। আর তুমি এভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার মনটাই ভেঙে দিলে! কিভাবে ভালোবাসলে তুমি আমার মায়ায় জড়াবে, বলো? আমি আর কিভাবে তোমাকে আমার ভালোবাসা বোঝাবো?”

আহনাফের বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অরু আমাকে ভালোবাসুক। শুধু একটুখানি ভালোবাসুক না হয়। আমার তাতেই চলবে।”

চলবে–

(বোনাস পর্ব রাতে দেওয়া হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here