#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬২||
১০৩.
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে সাহিল আর রাহির এনগেজমেন্ট হয়েছে। কিন্তু রাহির মুখে কোনো হাসি নেই। আজ শাহেদ মির্জা রাহির বাবা-মার সাথে বসে আক্দের তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন। আগামী বৃহস্পতিবার তাদের আক্দ হবে।
এদিকে সাহিল রাহিকে একা ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না, তুমি হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করছো?”
রাহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমি কখন অদ্ভুত আচরণ করলাম? আমি তো আগের মতোই আছি।”
“তুমি মোটেও আগের মতো নেই। তুমি হঠাৎ আমার কাছ থেকে দূরত্ব রাখা শুরু করেছো! হোয়াই রাহি? হোয়াই?”
রাহি কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সাহিল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোমার এই আচরণের পেছনে আরাফ চৌধুরী নেই তো? ইদানিং তোমাদের মধ্যে খুব ভাব জমেছে দেখছি। কতোদূর এগিয়েছো?”
রাহি চোখ বড় বড় করে বলল,
“সাহিল, আমি তোমার উল্টোপাল্টা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। আরাফের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু দেখা হলে, টুকটাক কথাবার্তা হয়।”
“শুধু টুকটাক কথা বলার জন্য রেস্টুরেন্টে বসার কি খুব প্রয়োজন ছিল!”
রাহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“ও! তাহলে তুমি আমার পেছনে তোমার লোক লাগিয়ে দিয়েছো, তাই না?”
“তুমি আমার ভালোবাসার মানুষ। আমি কেন তোমার পেছনে লোক লাগাবো? আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি, রাহি। আমি তো তোমার সেইফটির জন্য কিছু লোক রেখেছিলাম।”
রাহি সাহিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আরাফের সাথে মাঝে মাঝেই দেখা করি৷ এমনকি ওর চেম্বারেও চলে যাই। কারণ আমার ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে।”
রাহির কথা শুনে রাগে সাহিলের মুখটা লাল হয়ে উঠলো। রাহি আবার বলল,
“যেখানে আমার তোমার সাথে সময় কাটানো উচিত ছিল। সেখানে আমি আমার সময়টা তোমাকে দিতে চাইছি না। কেন জানো? কারণ তোমার সাথে কথা বলে আমি কোনো মানসিক শান্তি পাই না।”
সাহিল শান্ত কন্ঠে বললো,
“ওই আরাফের সাথে কথা বলে তুমি খুব শান্তি পাও?”
“হ্যাঁ, কেন পাবো না? আরাফ মানুষটাই এমন। তুমি তো আর ওর মতো হতে পারবে না!”
“তুমি আমাকে এই অবস্থায় ভালোবেসেছিলে, রাহি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তখন এতো হিংস্র ছিলে না। আরাফ নিজেও মৈত্রী গ্রুপের একজন সদস্য। কিন্তু ওর মধ্যে কোনো অহংকার নেই। আর তুমি এতো অহংকার নিয়ে থাকো, মাঝে মাঝে আমার নিজেকে তোমার সামনে তুচ্ছ মনে হয়। আর তুমিই আমাকে সেই অনুভূতি দিয়েছ। তোমার চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, সবকিছুতে দাম্ভিকতা। আমি তোমার সাথে শান্তি পাচ্ছি না, সাহিল। আমি একজন প্রাকৃতিক মানুষকে চাই। কৃত্রিম মানুষকে নয়।”
সাহিল হাত মুঠো করে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। যাকে সে এতো ভালোবাসতো, যেই মেয়ের জন্য সে এতো উন্মাদ, সেই মেয়েটিই আজ তাকে তার শত্রুর সাথে তুলনা করছে। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সাহিল শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি ওই আরাফ চৌধুরীর সাথে আমার তুলনা করে ভালো করো নি। শুনো, বৃহস্পতিবার আমাদের আক্দ। তোমার ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক এই বিয়েটা তো হবেই। তোমাকে পাওয়ার জন্য যদি আমার কাউকে পৃথিবী থেকেই মুক্তি দিতে হয়, তাহলে আমি বিনা দ্বিধায় তাকে মুক্তি দেবো।”
রাহি সাহিলের হাত ধরে বলল,
“কি করবে তুমি? তুমি কিন্তু উল্টোপাল্টা কিছু করবে না, সাহিল।”
“তাহলে চুপচাপ আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিও, তখন আর আমি কিছুই করবো না। তুমিও ভালো থাকবে, বাকিরাও ভালো থাকবে।”
রাহি মলিন মুখে বললো,
“একবার যদি তুমি সব ভুলে আমার কথা চিন্তা করতে, তাহলে আমিও তোমার মাঝেই ডুবে থাকতে পারতাম। যাকে ভালোবাসি, সে একজন রাক্ষস। তাহলে জেনে বুঝে আমি একজন রাক্ষসকে বিয়ে করবো, তাই না?”
সাহিল ব্যথিত দৃষ্টিতে রাহির দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। নিচে নামতে নামতে সে একটা নম্বরে ফোন দিয়ে বলল,
“আমি এক্ষুনি আরাফ চৌধুরীকে আমার সামনে চাই। ডোন্ট বি লেইট।”
এদিকে বিশ মিনিটের মধ্যে সাহিলের লোকেরা আরাফকে তার চেম্বার থেকে তুলে এনে একটা রাস্তার মোড়ে নিয়ে গেলো। তারা আরাফের ফোনটাও নিয়ে ফেলেছে, তাই সে বাসায় কাউকে কিছুই জানাতে পারে নি। আরাফ গাড়ি থেকে নেমে দেখলো তার সামনে আরো তিনটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর মধ্যের গাড়িটা থেকে কেউ একজন বেরিয়ে এলো। আরাফ লোকটাকে দেখেই অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“সাহিল মির্জা!”
সাহিল আরাফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“সাহিলের সম্পদের দিকে নজর দেওয়ার খুব শখ তোমার, তাই না!”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে সাহিলের দিকে তাকিয়ে রইল। সাহিল আবার বলল,
“তোমার বন্ধু আর ভাই, ইমন আর আহনাফ ভালোই তো ইটা কোম্পানিকে একেবারে মৈত্রী কোম্পানির মতো উপরে উঠিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমার জায়গাটা ধরা ওতো সহজ নয়। যতোদিন আমার পজিশন ওয়ান, ততোদিন আমি নাম্বার ওয়ান, আর আমাকে তুমি কখনো হারাতে পারবে না। আমার বাবা, তোমার বাবা-চাচাদের সাথে কম্পিটিশনে সবসময় সেকেন্ড পজিশনে ছিল। কিন্তু আমি শাহেদ মির্জা নই। আমাকে তোমরা এতো সহজে সেকেন্ড পজিশনে আনতে পারবে না।”
আরাফ বুকে হাত গুঁজে বলল,
“এটা বলার জন্য আমার সব পেশেন্টকে বসিয়ে রেখে, আমাকে এখানে উঠিয়ে এনেছো?”
সাহিল কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“রাহি থেকে দূরত্ব রাখবে। ও আমার ফিয়োন্সে। তোমাদের আর যদি কখনো একসাথে দেখি, তাহলে এটা তোমার জন্য মঙ্গলজনক হবে না।”
এই কথা বলে সাহিল গাড়িতে উঠে বসলো। আরাফ বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছে। রাহিকে নিয়ে তার এমনিতেই কোনো আগ্রহ নেই। তবুও সাহিল মির্জা শুধু শুধুই তাকে এভাবে রাস্তার মোড়ে নিয়ে এসে হেনস্তা করেছে। এখন আশেপাশে কোনো গাড়িও নেই। অগত্যা তাকে বিশ মিনিট হেঁটে একটা লোকাল বাস ধরতে হলো।
দু’দিন পর। আরাফ তার চেম্বারে রাহিকে ঢুকতে দেখে অবাক হলো। রাহি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই বলল,
“বসতে পারি?”
আরাফ হালকা হেসে বলল,
“আবার কোনো সমস্যা?”
রাহি মুচকি হেসে বলল,
“কেন, সমস্যা ছাড়া কি আসা যায় না?”
“চেম্বারে এসেছেন, তাহলে তো অবশ্যই সমস্যা নিয়েই এসেছেন, তাই না? বাইরে অনেক রোগী আছে। তাদেরও দেখতে হবে। আমি গল্প করার জন্য তো এখানে বসি নি।”
আরাফের এমন কথায় রাহি কিছুটা দমে গেলো। সে আমতা-আমতা করে বলল,
“সরি। আমার এই সময়ে আসা উচিত হয় নি। আসলে আমি আমার আক্দের দাওয়াত দেওয়ার জন্য এসেছিলাম।”
“আচ্ছা। ধন্যবাদ।”
“কাল বিকেলে আমার আক্দ, আর রাতে অনুষ্ঠান। আসবেন কিন্তু।”
“চেষ্টা করবো।”
রাহি মুচকি হেসে উঠতে গিয়েও বসে পড়লো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আর কিছু বলবেন?”
আরাফের এমন ঠান্ডা কথাবার্তা শুনে রাহি ইতস্তত ভাব নিয়ে বসে রইলো। আরাফ আবার বলল,
“মিস রাহি, আর কিছু কি বলার আছে? বাইরে পেশেন্টরা অপেক্ষা করছে। এখান থেকে আমার আবার অন্য চেম্বারে গিয়েও বসতে হবে।”
রাহি হুট করে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমরা কি বন্ধু হতে পারি?”
আরাফ রাহির কথায় অবাক হলো। কিছু একটা ভেবে বলল,
“হঠাৎ বন্ধুত্ব!”
রাহি হেসে বলল,
“আমার আপনার বন্ধু হওয়ার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল। এখন কি বন্ধু হওয়া সম্ভব না?”
আরাফ রাহির আবদার ফেলতে পারলো না। সে নোট প্যাডে কিছু একটা লিখে রাহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এবার আপনি আসুন।”
রাহি কাগজটা খুলে দেখলো সেখানে লেখা আছে,
“আচ্ছা, হলাম বন্ধু। বেশি করে পানি খাবেন। এই সময়টাই বেশি পানি খেলে স্কিন ভালো থাকবে।”
রাহি মুচকি হেসে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো।
এদিকে ইভান আর সানায়া খোলা আকাশের নিচে পাশাপাশি হাঁটছে। আর সানায়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার সারাদিনই ইভানকে দেখে থাকতে ইচ্ছে হয়। দিনদিন সে ইভানের প্রতি অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রথম প্রথম ভালো লাগা থাকলেও, এখন এই ভালো লাগা ভালোবাসায় রূপ নিচ্ছে। শুধু বলার সাহস পাচ্ছে না। এদিকে ইভানও তাকে কিছু বলছে না। ইভানের যত্ন-আত্তি দেখে মনে হচ্ছে সেও সানায়াকে ভালোবাসে। কিন্তু এই ছেলে এতোটা চাপা স্বভাবের যে কিছুই বলে না।
অনেক দূর হাঁটার পর ইভান হঠাৎ সানায়ার হাতটা আলতোভাবে স্পর্শ করলো। আর সানায়া সাথে সাথেই চমকে উঠলো। ইভান হাতটা সামনে এনে হঠাৎ তার পকেট থেকে একটা সাদা কাঠের চুড়ি বের করে তা সানায়ার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ মেলায় গিয়ে এই চুড়িটা দেখলাম। ভালোই লাগলো। তুমি তো আবার টপ-জিন্স পরো। তাই চুড়ি জিনিসটা তোমার হাতে মানাবে না। কিন্তু এই কাঠের চুড়িটা হয়তো ভালো লাগবে, তাই নিলাম।”
সানায়া চুড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“তুমি যা দেবে, সবটাই আমার ভালো লাগে।”
ইভান সানায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“থ্যাংকস।”
সানায়া মনে মনে হাসলো। ইভানের চোখাচোখি হলেই তার হৃদপিণ্ডের কম্পন বেড়ে যায়। তার মনে হয় খুব দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলেছে। কারণ এই চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারাটাই তার কাছে অনেক বড় সাধনা।
এদিকে অরুণিকা কলেজ থেকে বের হয়েই রাস্তায় ইমানকে দেখলো। ইমানকে দেখেই তার খুব ইচ্ছে করছিলো ইমানের সাথে কথা বলতে। কিন্তু সে ইমানকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। কারণ ইমান তো তাকে ভালোবাসে না।
অরুণিকা কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে অনেক কিছুই ভাবতে লাগলো। তখনই ইমান তার সামনে এসে বলল,
“হাই, অরুণিকা, কেমন আছো?”
ইমানের কন্ঠ শুনেই অরুণিকা চমকে উঠলো। সে হালকা হেসে বলল,
“জ্বি ভালো আছি।”
“ক্লাস শেষ? বাসায় যাচ্ছো?”
“হ্যাঁ।”
“চলো, আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।”
“না, না। আহনাফ আসবে। ও বলেছে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে।”
“ওহ আচ্ছা।”
ইমান এবার অরুণিকার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?”
“তোমাকে পাহারা দিচ্ছি।”
অরুণিকা অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আপনি কেন আমাকে পাহারা দেবেন? আপনাকে তো কেউ এই দায়িত্ব দেয় নি।”
ইমান মুচকি হেসে বললো,
“দায়িত্ব দিতে হয় না। নিতে জানতে হয়। আর কিছু দায়িত্ব নিতে এমনিতেই ভালো লাগে।”
অরুণিকা মনে মনে বলল,
“কেমন খচ্চর! ভালোবাসে অন্য কাউকে, আর পাহারা দেবে আমাকে? আমার হবু বর অন্য কোনো মেয়েকে পাহারা দিলে, আমি তো তার পা গুঁড়ো করে দিতাম।”
ইমান অরুণিকার সামনে এসে বলল,
“মনে মনে কি ভাবছো?”
অরুণিকা কোণা চোখে ইমানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ের দাওয়াত দেবেন না?”
ইমান অবাক হয়ে বলল,
“যেখানে বউয়ের খবর নেই, সেখানে বিয়ের দাওয়াত তো স্বপ্ন।”
“মানে?”
“মানে আমি তো এখনো বিয়ে করার চিন্তাভাবনা করি নি। বিয়ে নিয়ে ভাবতে আরো সময় লাগবে।”
অরুণিকা অবাক হয়ে বলল,
“কিন্তু আহনাফ যে বলল, আপনার বিয়ে হবে!”
“কখন বলেছে?”
“বলেছিল তো। আপনি একজনকে পছন্দ করেন, তাকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
ইমান এবার অবাক হলো। ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি। ইনফ্যাক্ট, আমার কোনো মেয়ের সাথেই সম্পর্ক নেই।”
অরুণিকা আর কিছু বলল না। আহনাফ কি তাকে এতো বড় মিথ্যে কথা বলবে? বললেও বা কেন বলবে?
বাসায় এসে অরুণিকা চুপচাপ উপরে উঠে গেল। আজ পুরো রাস্তা সে আহনাফের সাথে কোনো কথা বলে নি৷ আহনাফ অরুণিকার ব্যবহারে কিছুটা অবাক হলো। সে উপরে উঠে অরুণিকার রুমে এসে বলল,
“কি হয়েছে, বলবে?”
অরুণিকা ব্যাগটা মেঝেতে রেখে আহনাফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ইমানকে নিয়ে তুমি মিথ্যে কথা কেন বলেছে? কেন বলেছ, ও অন্য কাউকে ভালোবাসে?”
আহনাফ অরুণিকার প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো। অরুণিকা বলল,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি, আহনাফ। তুমি আমাকে মিথ্যে কথা কেন বলেছো, বলো?”
আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“কারণ আমি চাই না তুমি ইমানকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখো। ইমান তোমার জন্য পারফেক্ট না।”
“তাহলে কি তুমিই আমার জন্য পারফেক্ট?”
“আমরা তোমাকে এমনিতেই বাইরে বিয়ে দেবো না, অরু। এটাই তোমার বাবার ইচ্ছে ছিল।”
অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“সম্পত্তি! ৫০ ভাগ অংশ! এগুলোর জন্য তোমরা আমাকে বেঁধে রাখছো?”
“না, অরু। আমাদের মূল সম্পদ তো তুমি। তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমাদের কি হবে?”
“আমার অনুভূতির কি কোনো মূল্য নেই তোমাদের কাছে? ইমন তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছে। তাহমিদ শতু আপুর জন্য সব করতে প্রস্তুত। উপমা ভাবী রকস্টারের জন্য নিজের সব খুশি ত্যাগ করে দিয়েছে। এদের সবার ভালোবাসা তোমাদের চোখে পড়ছে। আমারটা কেন দেখছো না, আহনাফ?”
আহনাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“কি বুঝো তুমি ভালোবাসার?”
“আমি ইমানকে পছন্দ করি, আহনাফ। আর তুমি আমাকে ওর সম্পর্কে মিথ্যে বলেছো। আমার কি এখন এই কথা আরাফকে জানানো উচিত নয়?”
আহনাফ বলল,
“জানাও আরাফকে। সবাইকে জানাও। যা করার করো। বিয়ে তো তোমার আমার সাথেই হবে। আর এই সত্যটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো।”
চলবে—-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৩: (১ম ভাগ)||
১০৪.
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অরুণিকার রুমটি ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। ভাংচুরের শব্দ শুনে সবাই অরুণিকার রুমের দিকে ছুটে এলো। ঘরের অবস্থা দেখে সবাই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের সাথে লাগানো বারান্দার দরজার পেছনে চুপটি করে অরুণিকা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। আরাফকে দেখে সে এগুতে গিয়েই থমকে গেলো। তার সামনে আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। আরাফের কাছে যাওয়ার জন্য আহনাফকে ডিঙিয়ে যেতে হবে, আর এই মুহূর্তে আহনাফের রাগী ভাবমূর্তি দেখে তার আর সেই সাহস হচ্ছে না।
আজ অনেক বছর পর সবাই আবার আহনাফের সেই ভয়ংকর রূপটি দেখেছে। ছোটবেলা থেকেই তার বদমেজাজ। আর রেগে গেলে সে অনেক বেপরোয়া হয়ে উঠে। আর এই কয়েক বছরে সে নিজের রাগটাকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ কি এমন হলো, যার জন্য আহনাফ তার এতো বছরের নিয়ন্ত্রণটা হারিয়ে ফেলেছে? মাওশিয়াত কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই ইমন তার হাত ধরে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। আরাফ আরবান তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মামা, আপনি রুমে যান। আমরা দেখছি, কি হয়েছে!”
আরবান তালুকদার কোনো শব্দ না করেই ঘরে চলে গেলেন। আরাফ এবার ধীর পায়ে ভাঙা জিনিসগুলোকে পা দিয়ে সরিয়ে রুমে ঢুকলো। অরুণিকা আরাফকে কাছে আসতে দেখেই শব্দ করে কেঁদে দিলো। অরুণিকার কান্নার শব্দ শুনে মুহূর্তেই আহনাফের পুরো পৃথিবীটাই থমকে গেলো। তার সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ দু’টিও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে সে ধপ করে ভাঙা ফার্নিচারের উপর বসে পড়লো। মেঝেতে আয়না আর টেবিলের পেরেক গুলো ছড়িয়ে আছে। আরাফ সাথে সাথেই আহনাফকে ধরে বলল,
“এখানে বসেছিস কেন? উঠ, উঠ। চল, ঘরে চল।”
আহনাফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি লোভী, আমার মন-মানসিকতা খারাপ, আমি মিথ্যুক।”
“এসব কি বলছিস, আহনাফ?”
তূর্য ঘরে ঢুকে অরুণিকাকে দরজার পেছনে থেকে বের করে রুমের বাইরে নিয়ে এলো। রুম থেকে বের হয়েই অরুণিকা মাওশিয়াতকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাওশিয়াত তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। ইমন ইশারায় অরুণিকাকে অন্য রুমে নিয়ে যেতে বলল। অরুণিকাকে নিয়ে যাওয়ার পর তাহমিদ অরুণিকার রুমের ফ্যানটা চালু করে দিলো। আরাফ আর ইভান মিলে আহনাফকে উঠিয়ে বিছানায় বসালো। তূর্য আর ইমন ভাঙা জিনিসগুলো উঠিয়ে একপাশে জড়ো করতে লাগল। ইভান রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“এখন বল, হয়েছেটা কি!”
আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমার বলতে ইচ্ছে করছে না।”
তূর্য বলল,
“না বললে বুঝবো কিভাবে?”
তাহমিদ বলল,
“থাক, এখন কিছুই বলতে হবে না। তোর যাকে ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে বলিস। কিন্তু মনের মধ্যে রাখিস না।”
আহনাফের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো। ইভান তার কাঁধে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“ও তোর সাথে বেয়াদবি করেছে?”
আরাফ ইভানের হাত ধরে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। সবাই আহনাফকে ঘিরে বসে আছে। সে তার অশ্রুগুলো আড়াল করার জন্য হাত দিয়ে মুখে ঢেকে রাখলো। অনেকক্ষণ পর সে বলল,
“অরু ইমানকে ভালোবাসে। ভুলটা আমারই হয়েছিল। আমি ওকে ইমানের সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলেছি। আমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলাম, ইমান অন্য কাউকে ভালোবাসে, আর সেই মেয়েকেই বিয়ে করবে। কিন্তু সত্যটা তো ছিল, আমি এসব বিষয় নিয়ে ওর সাথে কোনো কথায় বলি নি।”
তাহমিদ বলল,
“ইমানকে ভালোবাসে এটা তোকে অরুণিকাই বলেছে?”
“হ্যাঁ।”
ইমন জিজ্ঞেস করলো,
“ওদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে?”
“না, নেই। আজই প্রথম সে ইমানের সাথে একা কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। আর আজই সব সত্য জেনে ফেলেছে।”
“অদ্ভুত। আজই প্রথম কথা হলো, আবার ভালোও বাসে। এটা কেমন কথা?”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এটা অরুর কথা। ওকেই জিজ্ঞেস কর, কিভাবে ভালোবাসে! কি দেখে এতো ভালোবাসা উতলে পড়ছে যে আমাকে ও আজ লোভী, খারাপ মন-মানসিকতার লোক বলছে।”
ইভান বলল,
“যখন বলেছিল, তখন এই জিনিসপত্র না ভেঙে ওর গালে একটা চড় লাগিয়ে দিতে পারিস নি? চেয়ার-টেবিল না ভেঙে, ওর দাঁতগুলোই সব ভেঙে দিতি।”
আরাফ ইভানের দিকে চোখ গরম করে তাকাতেই ইভান বলল,
“ভালো। এভাবেই তাকিয়ে থাক, আর ওকে আস্কারা দিয়ে মাথায় উঠাতে থাক। তারপর মাথায় উঠে একদিন সব চুল টেনে ছিঁড়ে দেবে।”
ইমন বলল,
“ভাই চুপ কর না। ওর এখনো এতো বোঝ-জ্ঞান হয় নি।”
এবার তূর্য আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ও তোকে এসব কেন বলেছে?”
আহনাফ বলল,
“ও ভাবছে আমি সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার জন্য ওকে বিয়ে করছি। ও আমাকে নাকি সব সম্পত্তি লিখে দেবে, তারপরও যেন আমি ওকে মুক্তি দেই। আমার নাকি মন-মানসিকতা খারাপ। তাই আমার ওর…”
এতোটুকু বলেই আহনাফ আবার ফুঁপিয়ে উঠলো। সে বসা থেকে উঠে বলল,
“বাদ দে এসব।”
আহনাফ এরপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আহনাফকে রুম থেকে বের হতে দেখে অরুণিকা মাওশিয়াতের পেছনে আড়াল হয়ে গেলো। আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। এদিকে শতাব্দী লাইব্রেরী রুমে একা বসে আছে। ভাংচুরের শব্দ শুনে তাহমিদ ওকে ফেলেই চলে গেছে। বিশ মিনিট ধরে সে একা বসে ছটফট করছিল। বিশ মিনিট পর তাহমিদকে দেখেই সে শান্ত হলো। তাহমিদ শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“সরি, সরি। তোমাকে এতোক্ষণ একা বসিয়ে রেখেছি। সরি, শতাব্দী।”
শতাব্দী চোখের ইশারায় বোঝালো, সমস্যা নেই। তাহমিদ বলল,
“অরুণিকা আর আহনাফের মধ্যে হালকা পাতলা কথা কাটাকাটি হয়েছে। তুমি তো জানোই, ওরা টম এন্ড জেরির মতো যুদ্ধ করে। কিছুক্ষণ পর দেখবে, দু’জনই হাসাহাসি করবে।”
শতাব্দী এক দৃষ্টিতে তার মিষ্টি মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদ যে তাকে মিথ্যে বলেছে, তা সে ভালো করেই জানে। কারণ শতাব্দী অরুণিকার সাথেই থাকে। আর অরুণিকা তার মনের সব কথা তার শতু আপুকে জানিয়ে দিয়েছে। অরুণিকা যে আহনাফকে ভালোবাসে না, ইমান নামের একটা ছেলেকে ভালোবাসে, এটাও শতাব্দী জানে। কেন যেন তার এই মুহূর্তে আহনাফের জন্য খারাপ লাগছে। সে নিজেও একটা সময় আহনাফের জায়গায় ছিল। হয়তো এক পাক্ষিক ভালোবাসাগুলো এমনই যন্ত্রণাদায়ক হয়। শতাব্দীও তো তার মিষ্টিমশাইকে এক তরফাই ভালোবেসে গেছে। কখনো তাহমিদ তার ভালোবাসায় সাড়া দেয় নি। যদিও শতাব্দী জানে তাহমিদ তাকে খুব ভালোবাসে।
গভীর রাত। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। শুধু ঘুম নেই আহনাফের চোখে। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে পিছু ফিরে দেখলো আরাফ দাঁড়িয়ে আছে। আরাফ আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“অরু তোকে কি বলেছিল, আহু?”
আহনাফ শুকনো মুখে বললো,
“এটা শুনতে এসেছিস?”
“হ্যাঁ, কারণ আমি জানি, এটা না বললে তুই নিজেকে হালকা করতে পারবি না।”
আহনাফ হুট করে আরাফকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো। অনেকক্ষণ পর সে নিজেকে শান্ত করলো আর বলল,
“এইটুকুন মেয়েটাকে কতো যত্ন নিয়ে স্পর্শ করতাম। মন খারাপ হলে ওর ছোট ছোট হাতগুলো ধরে রাখতাম, ও আমার আঙ্গুল ধরে কলকাতার অলিগলি হাঁটতো, ওর অন্ধকারে ভয় লাগলে আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়তো। মেয়েটা এখন সব ভুলে গেছে। বলছে, আমার নাকি ওকে স্পর্শ করার লোভ চড়ে বসেছে, তাই আমি ওকে বিয়ে করতে চাইছি।”
আরাফ হাত মুঠো করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে সে নিচে নেমে সোজা অরুণিকার ঘরে চলে গেলো। দেখলো অরুণিকা বিছানার একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আরাফকে দেখে অরুণিকা তার পাশে এসে বলল,
“আরাফ, আমি…”
আরাফ হুট করে অরুণিকার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আরাফ রাগী কন্ঠে বলল,
“তুমি এতো বড় হয়ে গেছে যে আজ আহনাফকে এতো বড় কথা বলেছ?”
অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ বলল,
“তোমার বিয়ে আহনাফের সাথে হবে, এটা আমার ডিসিশন ছিল। তুমি এখন আমাকে এতোটাই বাধ্য করেছো যে, তোমাকে জোর করেই এখন এই বিয়েতে বসাতে হবে৷ তোমার বাবা-মা, ভাই, দাদা-দাদী এদের মধ্যে কেউ যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে তোমাকে এই বিয়ে মানতেই হতো। আমাদের বংশে এর আগেও এমন হয়েছিল। দাদার বন্ধু তাহেরজানের একমাত্র মেয়ে আরূপা ইসলাম আত্মহত্যা করে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন। এখন তুমি কি ইমানের জন্য নিজেকে মেরে ফেলতে চাও?”
আরাফ নিচে পড়ে থাকা ভাঙা আয়নার একটা টুকরো অরুণিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“হাত কাঁটো।”
অরুণিকা অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ পেছন থেকে এসে অরুণিকার হাত থেকে আয়নার টুকরোটি নিয়ে আরাফকে বলল,
“পাগল হয়ে গেছিস, আরাফ?”
আরাফ বলল,
“পাগল হই নি। ওকে বল, মরতে।”
অরুণিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আহনাফ অরুণিকাকে বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করবো না। তবুও এসব খারাপ চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দাও।”
আরাফ আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“বিয়ে তো হবেই। আর এই সপ্তাহেই আক্দ হবে। এখন ওর হাতে এই এক সপ্তাহ আছে। এখন ও মরে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিক।”
আহনাফ কিছু বলতে যাবে তখন আরাফ বলল,
“আমার মুখের উপর কিছু বলবি না। আমি শুধু দেখবো, ওর মনে ইমানের প্রতি ভালোবাসা কতোটুকু আছে। আমি দেখতে চাই, যেই ভালোবাসার জন্য সে তার জন্য প্রাণ দিতে পারবে এমন মানুষকে কষ্ট দিয়েছে, সেই ভালোবাসার জন্য সে নিজেকে কিভাবে ত্যাগ দিতে পারে।”
অরুণিকা পেছন থেকে এসে আরাফের হাত ধরে বলল,
“আমি ভুল করে ফেলেছি, আরাফ৷ তুমি যা বলবে, তাই হবে।”
আরাফ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“যার সাথে ভুল করেছো, তার কাছেই ক্ষমা চাও। আমি তোমাকে ততোদিন ক্ষমা করবো না, যতোদিন তুমি কবুল বলে আহনাফকে বিয়ে করবে না।”
আরাফ কথাটি বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অরুণিকা আহনাফের কাছে এসে বলল,
“তুমি আরাফকে এসব কেন বলেছো!”
আহনাফ অরুণিকার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“সিমপ্যাথি নেওয়ার জন্য।”
অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “আহনাফ!”
“হ্যাঁ, তোমার তো এটাই মনে হচ্ছে এখন! স্বাভাবিক, মনে হওয়ারই কথা। আমার সম্পর্কে তোমার মনে তো খুব নেগেটিভিটি জন্মেছে। এখন তোমার সবকিছুতেই আমাকে নিচুস্তরের মানুষ মনে হবে। এন্ড লিসেন, মিস অরুণিকা চৌধুরী, আমি নিজেকে এক্সপ্লেইন করতে চাই না। তোমার আমাকে নিয়ে যা খারাপ ভাবার, ভাবো। আই ডোন্ট কেয়া’র।”
আহনাফ হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মনে মনে সে নিজেকেই বকছে। আজ তার দিনটাই খারাপ ছিল। প্রথমে রাগের মাথায় সে আহনাফকে উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছে, তাই সে দুপুর থেকেই অনুশোচনায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আহনাফের রাগ দেখার পর থেকে অরুণিকা তাকে সরি বলার সাহস পাচ্ছিল না। এখন আবার আরাফ তাকে চড় মেরেছে। বুদ্ধি হওয়ার পর সে এই প্রথম আরাফের চড় খেয়েছে।
অরুণিকা পুরো রাত বসে কেঁদেছে। কিন্তু কেউ তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এলো না। অন্য কোনো সময় সে অভিমান করে থাকলে, সবাই তার পেছনে ঘুরঘুর করতো। আর আজ সে একা বসে আছে। অরুণিকা মনে মনে ভাবছে,
“হয়তো আমি সবাইকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি তো ইমানকে এতোটাও ভালোবাসি না যে ওর জন্য নিজের প্রাণ দিয়ে দেবো। আমারটা তো শুধুই ভালো লাগা। কিন্তু যারা আমার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, আমি তাদেরকেই কষ্ট দিচ্ছি। আমি আসলেই অনেক খারাপ। আমার তো মরে যাওয়া উচিত।”
পরেরদিন বিকেলে আরাফ চেম্বার থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই রাহি তার সামনে এসে দাঁড়ালো। রাহিকে দেখে আরাফ অবাক হয়ে বলল,
“আপনি?”
রাহি অভিমানী কন্ঠে বললো,
“আমি কিন্তু তোমার সাথে রাগ করেছি।”
রাহির মুখে তুমি সম্বোধন শুনে আরাফ অনেক অবাক হলো। রাহি বলল,
“ভুলে যেও না, আমরা এখন বন্ধু।”
আরাফ হেসে বলল,
“ওহ হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই তো।”
রাহি আরাফের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো। আরাফ বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“প্রথমত তুমি ভুলে গেছ, আমরা বন্ধু হয়েছি। দ্বিতীয়ত তুমি আমার আক্দে আসো নি। আবার এখন বন্ধুকে তুমি করে ডাকছো।”
আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“প্রথমত আমি সত্যিই এই বন্ধুত্বটা সিরিয়াসলি নেই নি। দ্বিতীয়ত, সাহিল মির্জার আক্দ অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতিটা অসন্তোষজনক হতো। আর আমি সহজে কাউকে তুমি করে ডাকতে পারি না।”
আরাফের কথায় রাহি কিছুটা লজ্জা পেলো। রাহি বলল,
“জানো, আমি কেন তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছি?”
“কেন?”
“কারণ তুমি অনেক ভালো। অনেক শান্ত, বিশ্বাসযোগ্য, সবার অনেক সাহায্য করো। তোমার মধ্যে কোনো অহংকার নেই।”
আরাফ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আমি মোটেও ভালো না। আমি যখন অশান্ত হই, তখন আমি সাহিল মির্জার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠি। আর আমি আমার বন্ধুদের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য। অন্যদিকে আমি একজন ডাক্তার, তাই সবাইকে শারীরিক আর মানসিকভাবে সাহায্যে করা আমার নীতি। আর অহংকর সবার মধ্যেই আছে। আমি হয়তো তা এখনো প্রকাশ করছি না।”
রাহি হেসে বলল,
“আর এই মুহূর্তে নিজের গুণগুলো লুকিয়ে তুমি আমার সামনে আরো ভালো হয়ে যাচ্ছো।”
আরাফ হাসলো। আর বলল,
“আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমি এখন যাই।”
আরাফ গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই পেছন থেকে আরাফের শার্টের কলার ধরে কেউ একজন তাকে পেছন দিকে টেনে এনে রাস্তায় ধাক্কা মারলো। আরাফ নিজেকে সামলে নিয়ে দেখলো সাহিল মির্জা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাহি সাহিলের হাত ধরে বলল,
“কি করছো তুমি, সাহিল?”
সাহিল রাহির হাত চেপে ধরে বলল,
“তুমি এখন আমার ওয়াইফ। আর আমার ওয়াইফের সাথে অন্য কারো সম্পর্ক থাকলে, আমি তাকে মুক্তি দিয়ে দেবো। এটা কিন্তু আমি তোমাকে আগেও বলেছিলাম।”
রাহি কিছু বলার আগেই সাহিল আরাফকে টেনে তুলে ধাক্কা মেরে তার লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
“ওকে নিয়ে আসো।”
রাহি সাহিলকে আটকাতে যাবে তখনই সাহিল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“রাহি, এখন তুমি সাহিল মির্জার স্ত্রী। তাই নিজেকে কান্ট্রোল করো। নয়তো মিডিয়ায় শিরোনামে আসবে, সাহিল মির্জার ওয়াইফ, মৈত্রী গ্রুপের সদস্য আরাফ চৌধুরীর সাথে সম্পর্কে আছে। কেমন সম্পর্কে আছে, তা তো তুমিই ভালো জানো। আর মিডিয়া তো মাখন লাগিয়ে নিউজ তৈরি করবে। কিন্তু, যদি তোমার মাখামাখি আমার রেপুটেশনে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে, তাহলে আমি তোমাকে নয়, ওই আরাফকেই খুন করবো। মাইন্ড ইট।”
সাহিল এই কথা বলে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। এদিকে রাহি চিন্তায় পড়ে গেলো। সে কি করবে, কি করবে না বুঝে উঠতে পারছে না। এখন সাহিল যদি আরাফের কোনো ক্ষতি করে বসে? রাহি কিছু একটা ভেবে তাড়াতাড়ি সানায়াকে ফোন দিয়ে সবটা জানালো। সানায়াও দেরী না করে ইভানকে ফোন করে আরাফের ব্যাপারে বললো। ইভানের তো এটা শোনার সাথে সাথেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে বাকিদের ফোন দিয়ে সানায়ার দেওয়া ঠিকানায় যেতে বলল।
আধা ঘন্টা ধরে সাহিল তার লোকেদের দিয়ে আরাফকে মেরেছে। আরাফের নাক ফেটে রক্ত পড়ছে। বেল্ট দিয়ে হাত-পায়ে এলোপাতাড়ি মারা হয়েছে তাকে। তাই এখন তার শরীর কাঁপছে। চোখের চশমটাও ভেঙে গেছে। তাই আশেপাশের সব কিছুই ঝাপসা লাগছে। মাথাটাও ভনভন করছে। তখনই আহনাফের কন্ঠ শুনে তার দেহে একটু হলেও প্রাণ ফিরলো। আরাফ ভালোভাবে কিছুই দেখছে না, শুধু হট্টগোলের শব্দ পাচ্ছে। সে মাথা তুলে ঝাপসা চোখে দেখলো অনেকগুলো মানুষ ধস্তাধস্তি করছে।
এদিকে মিনিট পাঁচেক ইমন, ইভান, তূর্য, আহনাফ আর তাহমিদ সাহিলের লোকেদের সাথে মারামারি করলো। আর সাহিল মির্জা পায়ের উপর পা তুলে তামাশা দেখছে। আহনাফ এবার সাহিলের লোকের নাক ফাটিয়ে দিয়ে সাহিলের দিকে এগিয়ে এসে তার গলা চেপে ধরে বলল,
“তোর সাহস কি করে হলো, আমার ভাইকে এখানে উঠিয়ে এনেছিস!”
সাহিল অট্টহাসি হেসে মুহূর্তেই হাসি থামিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“ওপস, ভয় পেয়ে গেলাম।”
সাহিল উঠতে যাবে তখনই আহনাফ ইচ্ছেমতো সাহিলকে মারতে লাগলো। সাহিলের লোকেরা আহনাফকে আটকাতে যাবে তখনই ইভান তার পিস্তল তাক করে সাহিল মির্জার দিকে ধরলো। আর বলল,
“তোদের এম.ডিকে এক সেকেন্ডে উপরে পাঠিয়ে দেবো, যদি আরেকবার আমাদের গায়ে হাত লাগাস।”
সাহিল হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বললো। আর নিজেও আহনাফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আরাফকে দেখিয়ে দিলো। সবাই আরাফকে দেখেই দৌঁড়ে গেলো। তাহমিদ আরাফকে উঠিয়ে বসালো। সামনে কয়েকটা গাড়ি থাকায়, তারা এতোক্ষণ আরাফকে খেয়াল করে নি। তারা আরাফের যেই অবস্থা করেছে, তা দেখে আহনাফের রাগ এবার সীমা ছাড়িয়ে গেলো। সে আবার এসে সাহিলের কলার ধরে বলল,
“তোকে আমি শেষ করে দেবো, সাহিল মির্জা।”
সাহিল আহনাফের হাত চেপে ধরে নিজের কলার থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তুমি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, আহনাফ চৌধুরী। কেউই আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তোমাদের পুরো পরিবার ধুলোয় মিশে গেছে। মিডিয়া বলছে, আমার বাবা এই খুনের জন্য দায়ী। কিন্তু কেউ আজ পর্যন্ত তার কোনো ক্ষতি করতে পারে নি। উলটো আজ সে মন্ত্রীর পদে আছে। ইয়াং ম্যান, আমি যদি তোমাদের মেরেও ফেলি, আমার কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ আমার হাতে অনেক পাওয়ার।”
ইভান সাহিলের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“তোর বাবাই আমাদের পরিবারকে খুন করেছে, তাই না?”
“যদি বলি, হ্যাঁ?”
“খুন করে ফেলবো তোকে!”
সাহিল মির্জা হেসে বলল,
“টাকা আমার সম্পদ, আর পলিটিক্স আমার সেইফগার্ড। আর এখন এই দুইটাই আমার হাতে আছে। তোমরা আমাকে খুন করলে, সবাই ফেঁসে যাবে। আর এর মধ্যে একা হয়ে যাবে তোমাদের অরুণিকা।”
আহনাফ আর ইভান অরুণিকার নাম শুনেই শান্ত হয়ে গেলো। সাহিল বলল,
“তোমরা একদিনের জন্য যদি জেলখানার কয়েদি হও, তাহলে তোমাদের অরুণিকা এক রাতের জন্য…”
সাহিলের মুখের ভাব দেখে পাঁচজনেরই রাগ উঠে গেলো। আরাফের মাথা ঘুরছে, তাই সে সাহিলের সব কথায় অস্পষ্ট শুনছে।
এদিকে সাহিলের কথা শুনে তূর্য চেঁচিয়ে বলল,
“তোর মুখ ছিঁড়ে দেবো আমি।”
“আগে তোমাদের বন্ধুর মুখটা ঠিক করে নাও। বেচারা, মার খেতে খেতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে। এখন হয়তো ডাক্তার সাহেবের জন্য আলাদা ডাক্তার লাগবে।”
তাহমিদ আর ইমন আরাফকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ইভান যাওয়ার আগে আরেকবার পিছু ফিরে সাহিলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আমাদের অরুণিকাকে নিয়ে তুই বাজে কথা বলেছিস। এখন দেখ, তোর প্রাণ নিয়ে আমি কি করি!”
সাহিল ইভানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো। ইভানও উত্তরে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
চলবে—-
(আগামীকাল ২য় অংশটা দেওয়া হবে)#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৩: (২য় ভাগ)||
১০৫.
গাড়ি থেকে নেমে বডিগার্ডদের ইশারায় সরিয়ে দিলো সানায়া। তারাও এতোদিনে জেনে গেছে সানায়া তার কাছের মানুষের কাছে কতোটা নিরাপদ। তারা চলে যাওয়ার পর সানায়া পেছন ফিরে ইভানের দিকে তাকালো। ইভান মুচকি হেসে তার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। তাদের মধ্যে দূরত্ব মাত্র দশ ফুট। তবুও এই পথটি সানায়া দৌঁড়ে পার করে ইভানের হাতটি ধরলো। ইভান বলল,
“পাহাড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?”
সানায়া এক গাল হেসে মাথা নাড়লো। ইভান সানায়াকে নিয়ে রওনা দিলো পাহাড়ের দেশে।
প্রভাবশালী শাহেদ মির্জার মেয়ে কখনো পাহাড় দেখে নি। সে ইভানকে খুব আবদার করেই বলেছিল তাকে পাহাড়ে নিয়ে যেতে। ইভান তার এই আবদারটি ফেলতে পারলো না। আর আজকাল সে সানায়ার কোনো আবদারই ফেলতে পারছে না। বরং সব ব্যস্ততা বাদ দিয়েই সে সানায়াকে সময় দেয়।
সানায়া আজ অনেক বছর পর বাসে উঠেছে। বাসে উঠেই সে জানালার পাশে গিয়ে বসে পড়লো। এরপর পুরো জানালাটা খুলে দিয়ে সে তার চুলগুলো খুলে দিলো। বাস চলতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে বাসের গতি বাড়ছে। আর বাতাসে তার চুলগুলো উড়ছে।
সানায়া চোখ বন্ধ করে তার স্বাধীনতা উপভোগ করছে। এই প্রথম সে নিজেকে স্বাধীন মানুষ ভাবছে। এদিকে ইভান অবাক দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সানায়া ইভানের দিকে ফিরে বলল,
“তুমি আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত দিয়েছো, ইভান। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
সানায়ার এই কথাটা বলতে গিয়েই চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো। ইভান আজ সানায়াকে দেখে শুধু অবাকই হচ্ছে। সানায়া চোখের পানি টিস্যু দিয়ে মুছে বলল,
“কিছু মনে করো না। তুমি হয়তো বুঝতে পারবে না, এটা আমার জীবনের কতো বড় প্রাপ্তি। তোমার হয়তো হাসি আসতে পারে আমার কথা শুনে। কিন্তু এটাই সত্য। আমার কখনো কোনো বন্ধু হয় না, রাহি ছাড়া আমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। বাবা সারাজীবন নিজের কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল। তিনি নিজেকেই বেশি ভালোবাসতেন। আমার মাকেও ধরে রাখতে পারেন নি।বাবা-মা থাকার পরও আমি তাদের কারো সাথেই ফ্রি হতে পারি না। বড় আপু নিজের পার্লার আর নিজের লাইফ নিয়েই ব্যস্ত থাকে, ভাইয়া বিজনেস নিয়ে। আমি খুব একা ছিলাম। তারা কেউই আমাকে কোথাও যেতে দিতো না। তবে যেখানে যেতাম, বডিগার্ডরাই আমাকে সঙ্গ দিতো। কিন্তু ওদের সাথেও কথা বলে কোনো মজা পাই নি। ওরা তো প্রয়োজনের বেশি কোনো কথায় বলতো না। বাবা নাকি তাদের আমার সাথে বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছে।”
সানায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আবার বলল,
“আমি একা একা শপিং করেছি, একা একা রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েছি। আর আমার আশেপাশে সবার কতো বন্ধু ছিল। তারা আমার সামনেই আড্ডা দিতো। আর আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।”
ইভান এবার সানায়ার হাতটি ধরলো। সানায়াও শক্ত করে ইভানের হাতটি ধরে বলল,
“আজ প্রথম আমার কোনো বন্ধু হয়েছে। যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি।”
ইভান সানায়ার কথায় সানায়ার হাতটি আলগা করে দিয়ে বলল,
“পুরুষ মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস করা উচিত নয়।”
সানায়া হেসে বলল,
“কিছু কিছু পুরুষ মানুষকে করা যায়।”
ইভান সানায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সানায়ার চোখের গভীরতা তাকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগেই ইভান নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আর সানায়া লাজুক হেসে আবার প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিলো।
এদিকে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অরুণিকা। আরাফ এখনো বিছানায় শুয়ে আছে। আজ এক সপ্তাহ ধরে সে বিশ্রাম নিচ্ছে। এখন সে অনেকটাই সুস্থ। ঝাপসা চোখে কাউকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরাফ চশমাটা চোখে লাগালো। অরুণিকাকে দেখে সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। অরুণিকা রুমে ঢুকে আরাফের পায়ের কাছে বসে আরাফের পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুলটি টেনে ধরলো। আরাফ অরুণিকার হাতের স্পর্শ পেয়ে আনমনে হাসলো। মূলত এভাবেই অরুণিকা তার ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। ছ’জনের কেউ যদি তার সাথে অভিমান করে, সে তাদের পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুল ধরে বসে থাকে।
আরাফ অরুণিকার দিকে তাকাতেই অরুণিকা কেঁদে উঠলো। আরাফ অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে তার পাশে বসালো আর বলল,
“কাঁদছো কেন?”
“তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন? রকস্টার আর মৌ ভাবী ছাড়া কেউ আমার সাথে কথা বলছে না। তুমি তো অন্তত আমার সাথে কথা বলো। কেউ কথা না বললে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আরাফ, তোমরা ছাড়া আমার কেউই নেই। তোমরাই যদি আমাকে দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে আমার কি হবে?”
“তুমিই তো আমাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছো। ইমানের জন্য আমার কথার অমান্য হচ্ছো, আহনাফের সাথে বেয়াদবি করেছো।”
“সরি। আমি আর তোমার কথার অমান্য হবো না। আমি আহনাফকে বিয়ে করবো, আরাফ। তবুও আমার সাথে কথা বলো, প্লিজ।”
অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ অরুণিকার এক হাত ধরে অন্য হাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো লাগলো। আর বলল,
“আহনাফের কাছে ক্ষমা চেয়েছো?”
“ও তো আমার সাথে কথায় বলছে না।”
“ওর কাছে যাও। ওর কথা শুনো। এখন তোমার সব দায়িত্ব ওর উপর।”
“কেন? তুমিই তো আমার অভিভাবক। আমি ওর কথা শুনবো না। শুধু তোমার কথাই শুনবো।”
“বিয়ের পর একটা মেয়ের দায়িত্ব ওর স্বামীর কাছে চলে যায়, বাবা-মার কাছে থাকে না। আর আমি তো তোমার কাজিন।”
“আমি তোমাকে কখনো কাজিন ভাবি নি, আরাফ। তুমি তো আমার বাবা-মার জায়গা নিয়েছো। তুমি, তাহমিদ আর রকস্টার, তোমরা তিনজন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।”
“এখন এই জায়গাটা আহনাফকে দেওয়া শুরু করো। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, তোমার জন্মের পরই দাদা-দাদি ওসিয়ত করেছিলেন, তোমার বিয়ে আহনাফের সাথেই হবে। তোমার নামে ৫০ ভাগ সম্পত্তি, এই কারণেই লিখে দেওয়া হয়েছিল। যাতে তাদের ইচ্ছেটা পরবর্তীতে তোমার বাবা-মা আর আহনাফের বাবা-মা মেনে নেয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মেয়েদেরকে এতো ভাগ সম্পত্তি লিখে দেওয়া হয় না। তোমার ক্ষেত্রে হয়েছে, শুধু ওদের ইচ্ছেটার বাস্তবায়নের জন্য। আমাদের কোনো ফুফি ছিল না। দাদা-দাদি তোমার জন্মতে অনেক খুশি ছিলেন। তাই ওরা তোমাকে চৌধুরী বংশের বাইরে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। আজকাল কি কারো বিশ্বাস আছে? তারা ভাবতো, যদি বিয়ের পর তাদের আদরের অরুর কিছু হয়ে যায়? এখন আহনাফের সাথে বিয়ে হলে, ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে।”
অরুণিকা মুচকি হেসে বলল,
“দাদা-দাদি বেঁচে থাকলে, আমি ওদের পটিয়ে নিতাম।”
আরাফ হেসে বলল,
“আহনাফ দাদার ফটোকপি। এবার বুঝো, দাদার মেজাজ কেমন ছিল।”
অরুণিকা কিছু একটা ভেবে বলল,
“ওতোটাও খারাপ না। রেগে গেলেই তো ডাইনোসরের মতো হয়ে যায়। আর শান্ত থাকলে একদম কিউট বিড়ালের মতো।”
দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আহনাফ এতোক্ষণ অরুণিকার কথা শুনছিল। আরাফ আহনাফকে দেখে মুচকি হাসলো৷ আহনাফ অরুণিকা পেছন ফেরার আগেই সরে গেলো। অরুণিকা আরাফের চোখ অনুসরণ করে পেছন ফিরে দেখলো, কেউ নেই। অরুণিকা চোখ ছোট করে আরাফের দিকে তাকিয়ে, দরজার কাছে এসে ইমনকে দেখে চমকে উঠলো। ইমন অরুণিকার পাশ কেটে আরাফের রুমে ঢুকলো। আরাফ ইমনকে দেখে বলল,
“শুনলাম, তোরা নাকি আমার অরুর সাথে কথা বলছিস না।”
ইমন বাঁকা চোখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর অরুকে বল, আগে আমাদের বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইতে।”
অরুণিকা পা ধাপিয়ে বলে উঠল,
“ক্ষমা চেয়েছি, কিন্তু ওই ভূতটা আমার সাথে কথায় বলছে না।”
“এভাবে ভূত ডাকলে ক্ষমা করবে?”
অরুণিকা কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। সেটাই করি।”
অরুণিকা আরাফের রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো, আর আহনাফের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ অরুণিকাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“আমার রুমে কেন এসেছো?”
অরুণিকা আহনাফের ঘরে ঢুকে আহনাফের বিছানায় ধপ করে উঠে বসলো। আহনাফ বলল,
“যাও এখান থেকে।”
অরুণিকা গালে হাত দিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, আমি রান্না করছি, হঠাৎ তেলের কড়াই আমার পায়ে এসে পড়লো। ব্যস ওমনিতেই আমি….”
আহনাফ অরুণিকার হাত চেপে ধরে বলল,
“মিথ্য স্বপ্ন বলা বন্ধ করো। স্বপ্ন নিয়ে মিথ্যে বলা উচিত না।”
“তোমার সমস্যা কি! বললে বললাম।”
“এখন তুমি এটা ভাবছো, আমি তোমার মিথ্যে স্বপ্নের কথা শুনে, আবার আগের মতো তোমার পেছনে সময় নষ্ট করবো। এটা তোমার ভুল ধারণা। তোমার রান্নাঘরে গিয়ে হাত পুড়িয়ে আসতে ইচ্ছে করলে যাও, আমি তোমার সাথে কোথাও যাবো না। একা কাজ করতে না পারলে, বাসায় আরো অনেকে আছে, তাদের সাহায্য নাও। আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।”
“তুমি ছাড়া কে আছে আমার বলো!”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি বিরক্ত হও না, এই একটা লাইন সবাইকে কপি পেস্ট করে শুনাতে?”
“সবাইকে কোথায় শোনায়? শুধু তোমাদের ছ’জনকেই তো শোনায়। তুমি ছাড়া আমার কে আছে? তুমি ইজ ইকুয়েল টু আরাফ, ইমন, তাহমিদ, ইভান, রকস্টার। তো একই কথায় তো হলো!”
আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। অরুণিকা বলল,
“আমার বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু দেখো, আমি সব স্বপ্ন বাদ দিয়ে তোমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছি। আমি এতো বড় ত্যাগ দিচ্ছি। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করে তোমার জিরাফের মতো উঁচু মাপের ইগোকে ভুলতে পারবে না?”
আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে বলল,
“ইগো আর আত্মসম্মান দু’টি আলাদা বিষয়, অরু। তুমি আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছো। তোমার সাথে আমার কোনো ইগোর সম্পর্ক নেই। তুমিই তো আমার অহংকার। তুমি ছাড়া আমার কিসের অহংকার? কিন্তু এর উপরেও আছি, আমি নিজেই। আর আমি মানেই আমার আত্মসম্মান। তুমি আমার ক্যারেক্টর নিয়ে কথা বলেছো, অরু। তাই আমি এতো সহজে এসব ভুলে তোমার সাথে স্বাভাবিক হতে পারবো না। আমার একটু সময় লাগবে। আমাকে আপতত স্পেইস দাও।”
আহনাফ কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“সব কথায় মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইগো আর আত্মসম্মান সহজ দুইটা শব্দটাকে এভাবে পেঁচিয়ে দিয়ে চলে গেল?”
চলবে—-