#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৪||
১০৬.
সানায়া ইভানের হাত ধরে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। এই হাতটা তার কাছে পরম বিশ্বস্তের হাত। পাহাড়ে উঠেই সানায়া হাসতে লাগলো। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”
“আমার একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাই।”
ইভান মুগ্ধ দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যার কাছে প্রকৃতি দেখায় স্বপ্ন, সেই মেয়েটা কখনোই কৃত্রিম হতে পারে না৷ সে তো প্রকৃতির মতোই প্রাকৃতিক আর হাস্যজ্বল হবে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ইভানের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো। সানায়া ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইভান, তোমাকে হাসলেই ভালো লাগে। এভাবে মুখটা অন্ধকার করে রেখেছো কেন?”
ইভান হাসার চেষ্টা করতেই সানায়া বলল,
“বাসায় সবাইকে গম্ভীরমুখে দেখতে দেখতে আমি খুব বিরক্ত হয়ে গেছি। অন্তত তুমি আমার সামনে হাসলে আমার ভালো লাগবে।”
ইভান হেসে সানায়ার হাতটা ধরলো আর বলল,
“আই প্রমিজ, অন্তত তোমার সামনে আমি হাসবো।”
সানায়া ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইভানের স্পর্শ এতোটা গভীর যে তার ইচ্ছে করছে, এভাবেই কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে গেলে কোনো আপত্তি নেই।
তারা পাহাড় থেকে নামার সময় জুতার ফিতার সাথে পা আটকে সানায়া ধপ করে নিচে পড়ার আগেই ইভান তার বাহু আটকে ধরলো। সানায়া সাথে সাথে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“ইভান, আমি নিচে পড়লে মরে যাবো কিন্তু।”
ইভান সানায়ার ভীত চেহারা দেখে হেসে বলল,
“পাহাড়ের শেষ প্রান্ত এখনো তোমার দুই হাত দূরে আছে। এখান থেকে ধাক্কা দিলেও তুমি মাটিতেই পড়বে, পাহাড় থেকে নিচে পড়বে না। সো রিল্যাক্স।”
ইভান সানায়াকে সোজাভাবে দাঁড় করিয়ে নিচে তাকালো। দেখলো সানায়ার জুতোর ফিতে খুলে গেছে। ইভান নিজেই তার জুতোর ফিতে লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এখনো ফিতে লাগানো শিখো নি!”
এদিকে সানায়া ইভানের ঘন চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। সে আজ পর্যন্ত শুনে এসেছে, মেয়েদের খোলা চুল ছেলেদের খুব আকর্ষণ করে। কিন্তু আজ সে নিজেকে দেখে ভাবছে, মাঝে মাঝে ছেলেদের চুলও মেয়েদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সানায়া হঠাৎ কি ভেবে ইভানের ঘন চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিলো। ইভান মাথা তুলে ভ্রূ কুঁচকে সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে সালাম করছি না যে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া দিচ্ছো।”
সানায়া হেসে বলল,
“আমার দোয়া নিয়ে রাখো। মাঝে মাঝে বন্ধুদের দোয়ায় সফলতা আসে।”
ইভান দাঁড়িয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“কেমন সফলতা আসবে?”
“এই ধরো, প্রেমে পড়বে, বা বিয়ের তারিখ ঠিক হবে।”
ইভান কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে সানায়ার দিকে ঝুঁকে বলল,
“তাহলে মনে করো তোমার দোয়া কবুল হয়ে গেছে।”
এই কথা বলে ইভান পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। সানায়া ইভানের কথায় সেকেন্ড খানিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ইভানের পেছন পেছন এসে বলল,
“কি বললে? দোয়া কবুল হয়ে গেছে মানে? তুমি প্রেমে পড়েছো? নাকি তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? কোনটা?”
ইভান কিছু বললো না। সে হাসির রেখা মুখে টেনেই নিচে নামছে। সানায়া বিরক্তির সুরে বলল,
“বলো না, চুপ করে আছো কেন?”
ইভান সানায়ার হাত ধরে বলল,
“এতো প্রশ্ন করো কেন বলো তো? বললাম তো তোমার দোয়া কবুল হয়েছে। এখন বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো, কি হয়েছে।”
এদিকে কয়েকদিন পর অরুণিকা কলেজ থেকে বের হয়ে দেখলো তার কলেজ গেইটের সামনে ইমান দাঁড়িয়ে আছে। ইমানকে দেখেও না দেখার ভান করে অরুণিকা সামনে হেঁটে যেতে লাগলো। তখনই ইমান দৌঁড়ে তার কাছে এসে বলল,
“অরুণিকা, কেমন আছো?”
ইমান সামনে আসায় অরুণিকা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“আপনি এখানে?”
“তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“কেন?”
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“কথা থাকলে একদিন বাসায় আসেন। তারপর কথা হবে।”
অরুণিকা আবার হাঁটতে লাগলো। ইমান এবার তার পিছু পিছু হাঁটছে। অরুণিকা পেছন ফিরে ইমানকে দেখে বলল,
“আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন কেন?”
“চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”
অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না। আহনাফ আমাকে নিতে আসবে।”
ইমান হঠাৎ অরুণিকার অনুমতি ছাড়াই তার হাত ধরে বলল,
“মিথ্যে কথা কেন বলছো, অরু? আমি জানি আজ আহনাফ ভাইয়া আসবে না।”
ইমানকে মনে মনে পছন্দ করলেও অরুণিকার কেমন যেন ভয় লাগছে। সে কোনোভাবেই ইমানের সাথে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সে ইমানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আপনি আমার হাত ধরলেন কেন?”
“আহনাফও তো তোমার হাত ধরে। ওকে তো কখনো বারণ করো নি।”
“আহনাফ আর আপনি এক নন।”
“জানি, আমরা আলাদা। আর এটা জানি তোমার কাছে আমিই অনেক স্পেশাল।”
অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “মানে?”
ইমান মুচকি হেসে বলল,
“চলো, আমরা কোথাও বসি। তারপর সব কিছুর সমাধান হবে।”
অরুণিকা আবার এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আরাফের অভিমানী মুখ, আহনাফের রাগ, আর বাকিদের উপেক্ষা। অরুণিকা কোনোভাবেই তার কাছের মানুষগুলোকে কষ্ট দিতে চায় না। তাই সে মাথা নেড়ে বলল,
“না, আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না। যা বলার এখানেই বলুন। বলে এখান থেকে চলে যান।”
ইমান কিছু একটা ভেবে বলল,
“ওকে ফাইন। বলছি, শুনো।”
“হুম, শুনছি। বলুন।”
“আগে আমার দিকে তাকাও।”
অরুণিকা ইমানের দিকে তাকাতেই ইমান বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, অরু।”
অরুণিকা ইমানের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। তার মনে অজানা ভালোলাগা কাজ করছে। তবুও সে এই ভালো লাগাটি প্রকাশ না করে বিষ্ময়সূচক কন্ঠে বলল,
“এটা আপনি আমাকে কেন বলছেন?”
“তোমাকে না বলে কাকে বলবো?”
“দেখুন, আমার আপনাকে ভালো লাগে না।”
ইমান হেসে বলল, “মিথ্যে বলছো কেন, অরু?”
“আমি কেন মিথ্যে বলবো?”
“আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছো। আমি এটাও জানি তুমি আমাকে ভালোবাসে। আর এও শুনেছি, তুমি আহনাফকে বিয়ে করতে চাও না।”
অরুণিকা অবাক হলো। সে মনে মনে ভাবলো,
“এই কথা ইমান কিভাবে জানলো? আমি তো ওকে কখনোই এই কথা বলি নি। আর বাড়ির বাইরে তো কেউই এই বিষয়ে কিছুই জানে না। আরাফরা তো কখনোই এই ব্যাপারে ইমানকে জানাবে না, কারণ ওরা তো এই সম্পর্কই মানছে না। আর মৌ ভাবী তো ইমানকে ভালোভাবে চেনেও না। তাহলে ইমানকে এই কথা কে বলেছে? আরবান মামা? কিন্তু উনি কেন শুধু শুধু ওকে এসব বলতে যাবেন? এটা বলে উনার কিইবা লাভ হবে?”
১০৭.
আজ শহরে বৃষ্টি নেমেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থেকে ঝাপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সানায়া গাড়ি থামিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নেমে পড়লো। ইভান সানায়াকে আটকাতে পারলো না। শহরের নিস্তব্ধ পথ, গোধূলিবেলা আর ঝুম বৃষ্টি। একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ইভান তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছন থেকে ছাতা বের করে সানায়ার কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি কিন্তু তোমার গাড়ি নিয়েই বাসায় ফিরবে। আমি তোমাকে আর আমার গাড়িতে উঠাবো না।”
সানায়া বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বলল, “কেন?”
“আমার সিট ভিজে যাবে তাই।”
সানায়া ইভানের হাত থেকে ছাতা কেঁড়ে নিয়ে ছাতাটা বন্ধ করে দিলো। ইভান সানায়ার এমন কান্ডে খুব বিরক্ত হলো। সানায়া ছাতা নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। ইভান রাগী কন্ঠে বললো,
“দেখো এটা রাস্তা, তোমার বাড়ির গার্ডেন না যে এভাবে লাফাচ্ছো!”
সানায়া হেসে বলল,
“এখন কি আমাকে গাড়িতে উঠাবে না? তুমিও তো ভিজে গেছো। আমার ক্ষেত্রে যদি এমন নিয়ম থাকে, তাহলে তোমার ক্ষেত্রে কেমন হবে?”
ইভান কিছুক্ষণ রাগী দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, তখনই সানায়া ইভানের হাত ধরে বলল,
“আমি যতোদূর জানি, তুমি মানুষটা প্রাকৃতিক। তাহলে এতো চমৎকার মুহূর্ত হারিয়ে ফেলতে চাও কেন?”
ইভান সানায়ার মুখে এমন কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। সানায়া ইভানের ভেজা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“কি ভাবছো?”
ইভান সানায়ার প্রশ্নে ভাবনা থেকে বেরিয়ে সানায়ার হাত ধরে তাকে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে গেলো। সানায়া ইভানের এমন কান্ডে প্রচুর অবাক হলো। সানায়া কিছু বলার আগে ইভান বলল,
“তোমার দেখছি, চমৎকার মুহূর্ত সৃষ্টি করার খুব লোভ চড়ে বসেছে। আজকাল তোমার মনটাও হয়তো নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।”
সানায়া আমতা-আমতা করে বলল,
“এমন কিছু না।”
ইভান সানায়াকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“তোমাকে আজ একটা চমৎকার মুহূর্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। পরিচিত হতে চাও?”
সানায়ার গলায় কথা আটকে গেছে। সে কখনো কোনো পুরুষ মানুষের এতো কাছে আসে নি। আর আজ সেই কাছে আসার অনুভূতি তার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তুলছে। সানায়া ভাবছে, সে কি আজ ইভানকে বেশি পেয়ে যাচ্ছে?
অনুভূতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া ভালো। কিন্তু আজ তার অনুভূতি সীমা হারাচ্ছে। এদিকে ইভান সানায়ার মুখের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে উষ্ণ কন্ঠে বলল,
“আমি আগে কখনো বৃষ্টি সিক্ত কোনো মেয়ের দিকে তাকাই নি। আজ প্রথম দেখছি।”
সানায়া কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কেন দেখো নি?”
“সময়-সুযোগ একটাও হয় নি।”
“আজ হয়েছে?”
“তুমি সাথে থাকলে সব সুযোগ সহজে ধরা দেয়, সব সময় হাতের মুঠোয় চলে আসে।”
সানায়া লাজুক হেসে মাথা ঝুঁকালো। ইভান সানায়ার হাসি দেখেই বুঝলো, সানায়ার অনুভূতি শুধু বন্ধুত্বের মাঝে আবদ্ধ নেই, বহুদূর গড়িয়েছে। হয়তো সে প্রকাশ করার কোনো ভাষা পাচ্ছে না, হয়তো বা সাহস বা সুযোগ হচ্ছে না।
মিনিট পাঁচেক এভাবেই তারা একে-অপরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ গাড়ির হর্ণ শুনতেই ইভান সানায়াকে টেনে রাস্তার একপাশে চলে গেলো। আর কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ি তাদের অতিক্রম করে চলে গেলো। সানায়া বলল,
“এই রাস্তায় গাড়ি কম আসা-যাওয়া করে। তাই আমার এই জায়গাটা খুব প্রিয়।”
ইভান অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সানায়া তার কাছে এসে তার মুখটা নিজের দিকে ফেরাতেই ইভান সানায়ার হাতের দিকে তাকালো। সানায়া ইভানের এমন তাকানো দেখে হাত সরিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। হয়তো সে একটু বেশিই অধিকার খাটিয়ে ফেলছে। তারা তো শুধুই বন্ধু। বন্ধু হয়ে কি এতো অধিকার খাটানো উচিত? কিন্তু সানায়া তো ইভানকে শুধু বন্ধু ভাবে না। খুব কাছের মানুষ ভাবে। খুব আপন মানুষ ভাবে। তার ইচ্ছে করে সব বাঁধা ভুলে ইভানকে নিজের কাছে রেখে দিতে।
তারা এখন প্রতিদিনই দেখা করে। আর দিনশেষে ইভান যখন সানায়াকে বিদায় দেয়, সেই মুহূর্তটা সানায়ার জন্য খুব কষ্টকর হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে তার খুব কান্না আসে। তবুও পরেরদিন তো আবার দেখা হবে, এই ভেবে আবার নিজের মনকে বুঝিয়ে নেয়।
ইভান গাড়ির পেছন থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে সিটটা প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে নিলো। তারপর সানায়াকে বসতে বললো। সানায়া মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে বসলো। ইভানও গাড়িতে উঠে বসে বলল,
“গোধূলি বেলায়, মাঝ রাস্তায়, বৃষ্টিস্নাত মুহূর্তে একটা সুদর্শন যুবকের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করার অনুভূতিটা প্রতিটি যুবতীর কাছে একটা চমৎকার মুহূর্ত। আর মানুষটা যদি প্রিয় হয়, তাহলে সেই অনুভূতি মিষ্টি হাসিতে প্রকাশ পায়। কিন্তু যদি অপ্রিয় হয়, তাহলে এমন মুহূর্তে কোনো পুরুষের স্পর্শে চোখ ভারী হয়ে আসে। আর তোমার চোখ দেখে মনে হলো, তুমি খুব মজা পেয়েছো।”
ইভানের শেষ কথাটা শুনে লজ্জায় সানায়ার মুখটা লাল হয়ে গেলো। ঠান্ডার মধ্যেই সানায়ার মুখটা গরম হয়ে যাচ্ছে। ইভান সানায়ার লাজুক ভাব দেখে তার গাল টেনে ধরে বলল,
“তোমার এই হাসিটা আমার বেশি ভালো লাগে। বড় ঘরের মেয়েদের হাবভাব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা ভাব তোমার মধ্যে আছে। আর এটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে।”
সানায়া মনে মনে লাফাতে লাগলো। আজকে ইভানের সব কথায় যেন তাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিচ্ছে। আচ্ছা, ছেলেটা আজ এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে কেন? সানায়া বিড়বিড় করে বলল,
“থু থু থু, নজর না পরুক।”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি করলে তুমি এটা?”
সানায়া অবাক হয়ে বলল,
“কখন, কি করলাম আবার?”
ইভান শব্দ করে হাসলো। সে আর কিছু না বলে গাড়িতে চাবি ঘুরালো।
এদিকে উপমা রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ডেস্কে এসে বসলো। আজকাল রিয়াজুর রহমানের কাজকর্ম তার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। সারাদিন তাকে এটা-সেটা বলে নিজের কেবিনে ডেকে নিবে, আর তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। যদিও সে রিয়াজুর রহমানের পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট, তাই বলে কি এসিস্ট্যান্টকে এভাবে দেখে থাকতে হবে। ডেস্কে বসে উপমা হাঁসফাঁস করছিল তখনই রিয়াজুর রহমান তার চেয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। উপমা কারো উপস্থিতি পেয়ে পেছন ফিরে রিয়াজুর রহমানকে দেখে ভড়কে গেলো। রিয়াজুর রহমান দুই হাত সামনে এনে বললেন,
“রিল্যাক্স, রিল্যাক্স। এভাবে হনহনিয়ে আমার কেবিন থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণটা জানতে পারি?”
উপমা দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো,
“আপনার এভাবে তাকিয়ে থাকাটা আমার পছন্দের না।”
“পুরুষ মানুষ মেয়ে লোকের দিকে তাকাবেই। এটা স্বাভাবিক। বাট ট্রাস্ট মি, উপমা, আমি খারাপ দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকাই না। এটা ভালো দৃষ্টি। শুভ দৃষ্টি।”
উপমা রিয়াজুর রহমানের দিকে সেকেন্ড খানিক রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডেস্ক থেকে বেরিয়ে চলে এলো। রিয়াজুর রহমান উপমার পিছু নিতে গেলে নিয়াজ হোসেন তার হাত ধরে আটকালো আর বলল,
“রিয়াজ, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখ। তুই বাস্কার গ্রুপের এম.ডি।”
রিয়াজুর রহমান নিয়াজ হোসেনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উপমার পিছু পিছু নেমে গেলো। উপমা নিচে নামতেই সিঁড়িতে তূর্যকে দেখে থমকে গেলো। তূর্যও উপমাকে দেখে দৌঁড়ে উপমার কাছে এসে বলল,
“উপমা, কেমন আছো তুমি? কতোদিন পর তোমায় দেখলাম। আমার ফোন ধরো না কেন তুমি? পাঁচমাস হয়ে গেছে, এখন তো অন্তত বাড়ি ফিরে আসো। আর কতো অভিমান রাখবে?”
উপমা কিছু বলার আগেই রিয়াজুর রহমান পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তূর্য রিয়াজুর রহমানকে দেখে অবাক হলো। রিয়াজুর রহমান হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“হাই, আমি রিয়াজুর রহমান, উপমার বস।”
রিয়াজুর রহমান অদ্ভুত দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়েছে, যা দেখে তূর্যের খুব সন্দেহ হলো। এদিকে উপমা তূর্যের পাশ কাটিয়ে বের হতে যাবে তখনই তূর্য তার হাত ধরে বলল,
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
উপমা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“অন্য কোনো একদিন। আমার এখন তাড়া আছে।”
উপমা এই বলে চলে গেলো। তূর্য তার পিছু নিতে গেলে রিয়াজুর রহমান বললেন,
“আমি খুব সোজাসাপ্টা কথা বলা পছন্দ করি।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে রিয়াজুর রহমানের দিকে তাকালো। রিয়াজুর রহমান তার সামনে এসে বললেন,
“আমি উপমাকে পছন্দ করি।”
রিয়াজের কথা শুনেই তূর্যের রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো। সে শান্ত কন্ঠে বললো,
“আপনি পাগলের প্রলাপ বকছেন, মিস্টার রিয়াজ।”
রিয়াজুর রহমান হেসে বললেন,
“অবশ্যই। আরূপার পর এই প্রথম কেউ আমার মনে স্থান করে নিয়েছে। প্রলাপ বকা তো স্বাভাবিক।”
“সি ইজ মাই ওয়াইফ, মিস্টার রিয়াজ।”
“আই নৌ, আই নৌ। বাট মনে হয় না তোমাদের সম্পর্কে আর কিছু বাকি আছে।”
তূর্য হাত মুঠো করে রিয়াজের দিকে এগিয়ে এলো। আর বলল,
“ওর দিকে নজর দিলে আমি আপনার প্রাণ নিয়ে নেবো।”
রিয়াজুর রহমান অট্টহাসি হেসে বললেন,
“আগে নিজের প্রাণ বাঁচাও, তূর্য। তোমাদের জীবন ঝুঁকিতে আছে। স্পেশালি অরুণিকার। আর মুরশিদ জুবাইয়ের আমার বন্ধু। ওর কাছ থেকে আমি সব শুনেছি, জেনেছি। কিন্তু আদিলের মৃত্যুর রহস্য একটা রহস্য হয়ে রয়ে গেলো।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। রিয়াজ বললেন,
“আমি অনেক কিছুই জানি, যা তুমি জানো না। বরং তোমরা কেউই জানো না। আর উপমার জন্য আমি তোমাকে সেই তথ্যটা দিতে চাই।”
“কোন তথ্য?”
“আমি নিশ্চিত নই, তবুও আমার মনে হচ্ছে আরূপার মৃত্যুর সাথে তোমাদের পরিবারের খুন হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে।”
“এটা আপনি কিভাবে বুঝলেন?”
“আরূপা, আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল। আমি একাই ওকে ভালোবেসেছিলাম, আর ও ভালোবাসতো একটা সাধারণ দোকানদারকে। ওর আত্মহত্যার পর তোমাদের বাড়িতে অনেক কিছুই ঘটেছিল। আর তার মধ্যে একটি হলো, সেই দোকানদারকে বাসায় এনে মারধোর করা। লোকটা তোমাদের বাড়িতেই সবার সামনে নিজের গলায় নিজেই ছুরি চালায়। আর আমার যা মনে হয়, এই পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডটা, সেই দোকানদারের মৃত্যুর জের ধরেই হয়েছিল। আর সেই রাতে সবাই বাড়িতে ছিল। স্বাভাবিকভাবে সবাই বাড়িতে থাকার কথা নয়। জিসান, জিহান ওরা তো ক্যাম্প থেকে ফিরেছিল। তাহলে বুঝা উচিত, সেদিন বাড়িতেই কেউ একজন ছিল, যে এসব তথ্য বাইরে দিয়েছে। আর তোমাদের বাড়িতে যারা ছিল সবাই মারা গেছে, এটা তোমরা কিভাবে নিশ্চিত হয়েছো? তোমাদের বাড়ির গুপ্তচর তো এখনো বেঁচে আছে।”
“কে?”
“রহমতুল্লাহ।”
“মানে? উনি তো আমাদের বাড়িতে থাকতো না। ইনফ্যাক্ট উনাকে আমরা আগে কখনোই দেখি নি।”
“রহমতুল্লাহকে দেখো নি, কিন্তু রুকনকে তো দেখেছো!”
“রুকন!”
তূর্য কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও আমাদের বাড়ির দারোয়ান ছিল।”
“রহমতুল্লাহর ছেলে।”
তূর্য এই কথা শুনে অবাক হলো। রিয়াজ আবার বললেন,
“সেদিন তোমাদের বাড়ির সব দারোয়ান নিখোঁজ হয়ে যায়। তাদের সবার পরিবার তাদের খোঁজ নিতে আসে৷ শুধু রুকনের খোঁজ নিতে কেউ আসে নি। সবাই মনে করতো, সে অনাথ। কিন্তু সে এখনো বেঁচে আছে। আর আমি গত দু’দিন আগেই এই খবর পেয়েছি। তোমাকেই প্রথম জানালাম। আমার মনে হয় রুকনকে ধরতে পারলে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
তূর্যের মাথাটা ঘুরছে। সব কিছুই গোলকধাঁধার মতো হয়ে গেছে। রিয়াজ তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“লিসেন ইয়াং ম্যান, আমি যা করছি উপমার জন্য। কারণ আমি শিউর, আদিল সেই লোকটাকে চিনতো, যে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। আর তাই আদিলকে মেরে ফেলা হয়েছে। আর আমার ধারণামতে এবার তাদের টার্গেটে আছে, আহনাফ।”
চলবে—-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৫||
১০৮.
লাল রঙের বেনারসি শাড়ি পরে বসে আছে অরুণিকা। আজ প্রথম সে শাড়ি পরেছে। মাওশিয়াত তাকে ইচ্ছেমতো সাজিয়ে দিয়েছে। শতাব্দী হুইলচেয়ারে বসে অরুণিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজ অরুণিকার নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। তাই উপমাও সব অভিমান ভুলে অরুণিকার জন্যই আজ বাসায় ফিরেছে। সানায়া আর রাহিও অরুণিকার বিশেষ অনুরোধে অরুণিকাকে সঙ্গ দিতে এসেছে। এই পাঁচ জন মেয়ে অতিথি ছাড়া অরুণিকাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আর কেউই নেই। অরুণিকা বসা থেকে উঠে শতাব্দীর পাশে বসে তার হাতটি ধরল। আর বলল,
“শতু আপু, আমার ভীষণ ভয় করছে।”
উপমা অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“কেন ভয় পাচ্ছো, অরুণিকা? তোমাকে কোথায় আমরা বাইরে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি, বলো! শুধু তিনতলা থেকে দু’তলায় শিফট হবে।”
অরুণিকা উপমার কথায় মলিন হাসলো। কয়েকদিন ধরে আহনাফ তার উপর খুবই ক্ষিপ্ত। সেদিনের ঘটনার পর থেকেই আহনাফ খুব দূরত্ব রাখছে। অরুণিকাকে দেখলেই সে সরে যায়। এখন আহনাফ যে তাকে ক্ষমা করে নি, এটা সে নিশ্চিত। কিন্তু ক্ষমা না করেও যে আহনাফ তাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছে, এটা নিয়েই তার ভীতি। সে মনে মনে ভাবছে, বিয়ের পর আহনাফের সাথে সে কিভাবে ওঠাবসা করবে? আহনাফ কি এরপর তাকে ক্ষমা করে দেবে? আহনাফ যদি তার কাছে আসতে চায়, তাহলে সে কি করবে? কি বলবে? কিভাবে সম্বোধন করবে? আগে তো আহনাফের সাথে ছোটখাটো বিষয় নিয়েই খুঁনসুটিতে ব্যস্ত থাকতো। এখন আহনাফ যদি তার বর হয়ে যায়, তাহলে কি আগের মতোই আহনাফের সাথে ঝগড়া করতে পারবে, নাকি উপমার মতো সব রাগ-অভিমান মনের মধ্যে পুষে রাখতে হবে?
অরুণিকার মনে অনেক প্রশ্ন। এতোদিন সে ছ’জন পুরুষের কাছে আমানত ছিল। আর এখন সে শুধুই আহনাফের আমানত হবে। তাদের সম্পর্কের এতো বড় পরিবর্তনে অরুণিকার ঠিক কি করা উচিত, সে বুঝে উঠতে পারছে না। এমনকি সে কারো কাছে জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছে না। সানায়া আর রাহির সাথে তার সম্পর্ক এতো ঘনিষ্ঠ না। মাওশিয়াতের সাথেও চার বছরের দূরত্ব থাকায়, সেই ঘনিষ্ঠতা অনেক কমে গেছে। এদিকে শতাব্দী কথা বলতে পারে না। আর উপমা আজই এসেছে, তাই অরুণিকা এতো কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগও পায় নি৷
কিছুক্ষণ পর একজন হুজুর অরুণিকার কবুল নেওয়ার জন্য ঘরে এলো। অরুণিকা উপমার হাত শক্ত করে ধরে কেঁদে দিলো। অরুণিকাকে কাঁদতে দেখে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলো। রুমের বাইরে তূর্য আর ইমন দাঁড়িয়ে আছে। তারা অরুণিকার কান্নার শব্দ পেয়ে ভেতরে এলো। ইমন বলল,
“অরুণিকা, কবুল বলার পরই না হয় কান্নাকাটি করো। এখন কাঁদছো কেন?”
মাওশিয়াত ইমনকে উদ্দেশ্য করে ধমকের সুরে বলল,
“তুমি মেয়েদের কান্নার কারণ বুঝবে না। ও কাঁদলে কাঁদুক না। তুমি আটকাচ্ছো কেন?”
ইমন মাওশিয়াতের বকুনি খেয়ে মুখ ভার করে বলল,
“শুধু ধমকাবে!”
তূর্য বলল,
“তোর বউ তো তাও ধমকাচ্ছে। আর আমার বউ তো মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে বসে আছে। কথাও বলছে না, আমার দিকে তাকাচ্ছেও না।”
আরাফ পেছন থেকে এসে অরুণিকার পাশে বসল। অরুণিকা আরাফের হাত ধরে বলল,
“ও তো আমার সাথে রাগ করে আছে। কবুল বলার পর যদি আমাকে বকা দেয়, আমাকে যদি মারে? তখন কি তুমি আমাকে প্রটেক্ট করতে আসবে না?”
আরাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আহনাফ তোমাকে কেন মারবে, অরু?”
“ছোটবেলা থেকেই তো বকাঝকা করতো। মাঝে মাঝে আমার কান মলে দেয় না, বলো? তখন তো আমি তোমার কাছেই অভিযোগ নিয়ে যেতাম। এখন বকলে কি তুমি আমাকে আগের মতো প্রটেক্ট করবে না? আমার পক্ষ নিবে না?”
তূর্য বলল,
“টুইংকেল, আমরা সবাই তোমার পক্ষে আছি। আহনাফ যদি তোমাকে কিছু বলে, আমরা ওর নাক ফাটিয়ে দেবো।”
“তাহলে তোমরা কেন বারবার বলছো, বিয়ের পর আমার সব দায়িত্ব ওর একার। তোমরা কি আর আমার দায়িত্ব নেবে না?”
উপমা অরুণিকার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“অরুণিকা, শুনো। বিয়ের পর আমি তোমার রকস্টারের সাথে এই বাসায় এসেছি। মাওশিয়াতও ঠিক তেমনি ইমনের সাথে আছে। কিন্তু এরপরও আমার বাবা-মা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায় নি। এখনো তারা আমার সব বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন। আমাকে প্রটেক্ট করার জন্য নিজেদের সাথে রেখেছেন। তাহলে বাকিরা কেন তোমার প্রটেক্ট করার জন্য আসবে না? যখনই তোমার কারো প্রয়োজন হবে, তখনই সবাই ছুটে আসবে। তুমি তো তাদের প্রাণ। তুমি তো এখনো তাদের ছোট্ট অরুণিকাই আছো।”
অরুণিকা চোখের পানি মুছে বলল,
“আগে আহনাফকে বলো, আমার সাথে সুন্দর করে কথা বলতে। ও তো আমার সাথে কথায় বলে না। ও কথা না বললে আমি কবুল বলবো না।”
তূর্য বলল,
“আচ্ছা, আমি ওকে এখানে টেনে আনছি। দেখবে এখনই তোমার সাথে মিষ্টি ভাষায় কথা বলবে।”
তূর্য আর ইমন দু’জনই নিচে নামলো। নিচে নেমেই আহনাফকে সব জানালো। ইভান সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“শুরু হয়ে গেছে ভংচং করা। যাও দুলা মিয়া আহনাফ, যাও। গিয়ে হবু স্ত্রীকে কবুল বলার জন্য রাজি করাও। নয়তো তোমার মান-সম্মান থাকবে না।”
আহনাফ বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
“পৃথিবীতে আমিই মনে হয় প্রথম বর, যার বউ তাকে বিয়ের আগেই এমন উদ্ভট শর্ত দিয়েছে।”
ইমন আহনাফের কাঁধে বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“সবই কপাল!”
আহনাফ উপরে উঠেই অরুণিকাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি কি এখন আমাকে বিয়ে করবা নাকি করবা না।”
অরুণিকা মুখ ভার করে আরাফের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“দেখেছো, আরাফ, দেখেছো। আমার সাথে কিভাবে কথা বলছে?”
আরাফ আহনাফকে ইশারায় শান্ত হতে বললো। আরাফ বলল,
“আহনাফ, তুই অরুর সাথে সুন্দর করে কথা বল। এখন তো তোরা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিস। এখন আর পুরোনো বিষয় মনে না রাখায় ভালো।”
আহনাফ উত্তরে মাথা নেড়ে অরুণিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হালকা হেসে বলল,
“অরু, তুমি কি কবুল বলবে না?”
অরুণিকা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, এখন ঠিক আছে। এখন বলবো। কবুল, কবুল, কবুল।”
এরপর অরুণিকা বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সাক্ষর করলো। আহনাফ এবার বাঁকা হেসে নিচে নামতে নামতে ভাবলো,
“এবার বুঝবে মজা। এতো বছর আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছো। এবার সময় আমার হাতে আছে, এখন আমি তোমাকে সবকিছুই সুদেআসলে ফিরিয়ে দেবো, মিসেস আহনাফ।”
আহনাফ কবুল বলার পর বিয়ের কার্যবিধি সমাপ্ত হলো। তবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই অরুণিকাকে আহনাফের ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। আপতত সে নিজের ঘরেই থাকবে। এদিকে আহনাফের সাথে ছবি তুলতে তুলতে রাত একটা বেজে গেছে। তবুও অরুণিকার ছবি তোলার শখ মিটে নি। তাই সে নিজেই ঘরে বসে একা এক ছবি তুলছে। এদিকে শতাব্দী চোখ পিট পিট করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা বলল,
“শতু আপু, আমি তো নিজেকে দেখেই প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। আমাকে শাড়িতে অনেক ভালো লাগছে না?”
শতাব্দী চোখের ইশারায় হ্যাঁ বুঝলো। অরুণিকা শতাব্দীর হ্যাঁ শুনে আবার ফোন নিয়ে ছবি উঠাচ্ছে, আর বিড়বিড় করে বলছে,
“কিন্তু ওই আহনাফের বাচ্চাটা একটুও আমার প্রশংসা করে নি।”
হঠাৎ অরুণিকার ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে অপরিচিত নম্বর দেখে সে শতাব্দীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“এতো রাতে কে ফোন দিয়েছে বলো তো? হয়তো আমার কলেজ ফ্রেন্ড। ফেইসবুকে এনগেজড স্ট্যাটাস বসিয়েছি তাই হয়তো কল দিয়েছে।”
অরুণিকা কল ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল,
“অরু, বিয়েটা কেন করেছো? আমি কতোবার তোমাকে বোঝালাম, তবুও? তুমি কি আমার ভালোবাসা বুঝতে পারো নি?”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ইমান! আপনি?”
“হ্যাঁ, আমি। এক সপ্তাহ সময় ছিল আমাদের হাতে। বাসার কেউ রাজি না হলে আমরা পালিয়ে বিয়ে করতে পারতাম। পরে সবাই এমনিতেই মেনে নিতো।”
“কি উল্টাপাল্টা বলছেন, হ্যাঁ? বললাম তো, আমি আপনাকে ভালোবাসি না। তবুও কেন বারবার আমাকে বিরক্ত করছেন?”
“আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি সব জানি, অরু। প্লিজ, এখনো সময় আছে। তুমি আমার কাছে চলে আসো। হ্যাঁ, আমি এতোদিন বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু তুমি যখন আমার কাছে চলে আসবে, আমি সব ঠিক করে নেবো। আমি তোমাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসতাম, অরু। শুধু বলার সাহস পাই নি। কিন্তু এখন যখন জেনেছি, তুমিও আমাকে ভালোবাসো, নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না।”
অরুণিকা কিছু না বলে ফোন কেঁটে দিয়ে নম্বরটি ব্লক করে দিলো। এই নিয়ে ইমানের সতেরোটি নম্বর সে ব্লক করেছে। সেই এক সপ্তাহ ধরে ইমান অরুণিকাকে পালিয়ে আসার জন্য জোরাজুরি করছে। কিন্তু অরুণিকার একটাই উত্তর সে কোনোভাবেই আরাফদের সাথে প্রতারণা করতে পারবে না। আরাফ যেখানে রাজি নেই, সেখানে ওর কোনো হ্যাঁ নেই।
অরুণিকা ফোন রেখে শতাব্দীর পাশে বসে বলল,
“শতু আপু, আমার না আজকাল সবকিছুই অবাক লাগছে। আমি ইমানকে পছন্দ করি, এই কথাটা ইমান কিভাবে জানলো, বলো তো? ইমান এসব জানার পর থেকে আমাকে একটুও শান্তি দিচ্ছে না। বারবার পালিয়ে আসার জন্য জোর করছে। আমি তো আগে থেকেই বুঝতাম ও আমাকে পছন্দ করতো। হয়তো এখন আমিও ওকে পছন্দ করি এটা জানার পর থেকে জোরাজুরি করছে। কিন্তু যা হচ্ছে তাতে আমি খুব অবাক হচ্ছি। কারণ এই বাড়িতে কেউ একজন তো চাইতো আমার আর আহনাফের বিয়ে না হোক। কারণ ইমান জোর করলে আমি পালিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক, তাই না। কিন্তু আমি পালাচ্ছি না, কারণ আমি আরাফদের কষ্ট দিতে চাই না। আর এটা আরাফরা ভালোভাবেই জানে, যে আমি ওদের ধোঁকা দেবো না। কিন্তু কে জানে না এটা? মৌ ভাবীও জানে আমি আরাফের কথার অমান্য হয় না। ভাবী তো আমাকে ছোটবেলা থেকেই চিনে। আমাকে চেনে না শুধু আরবান মামা। আর আমার উনাকেই সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না, উনি কেনই বা ইমানকে এসব বলবে?”
শতাব্দী অরুণিকাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারছে না। অরুণিকা শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“চিন্তা করো না, আপু। আমি পালাবো না। অরুণিকা তার আপন মানুষদের ছেড়ে কোথাও যাবে না৷ হ্যাঁ, আহনাফকে আমি ওমন ভালোবাসি না। হয়তো যেই ভালোবাসা তোমার আর তাহমিদের মধ্যে আছে, সেই ভালোবাসা আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু আহনাফকে আমি অনেক ভালোবাসি। যেই ভালোবাসায় শুধু বিশ্বাস আছে। আমার আর আহনাফের অনুভূতিহীন ভালোবাসা৷ চমৎকার না, শতু আপু?”
এদিকে মুরশিদ জুবাইয়ের আর রিয়াজুর রহমান মুখোমুখি বসে আছেন। মুরশিদ জুবাইয়ের গম্ভীরমুখে বললেন,
“তুই এতোকিছু কিভাবে জানলি, রিয়াজ?”
“শাহবাজ খান জানিয়েছে। উনাকে নাকি অরুণিকা আর আহনাফের বিয়েতেও নিমন্ত্রণ করা হয় নি। অরুণিকার সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় নি। সবাই ভাবছে উনি মির্জা গ্রুপের সাথে মিলিত হয়ে ওই রাতে খুন করিয়েছে। কিন্তু বিষয়টা পুরাটাই উলটো। খুন করিয়েছে রহমতুল্লাহ। আর রহমতুল্লাহকে সব তথ্য দিয়েছে তার ছেলে রুকন।”
“কিন্তু রহমতুল্লাহর এখানে কি লাভ হলো?”
“এটাই তো, বুঝতে পারছি না। তুই বললি রহমতুল্লাহ সেদিন তোর কথায় আমবাগান গিয়েছিল। তারমানে সে আগে থেকেই জানতো, তোকে মৈত্রী গ্রুপের কেউ একজন ফোন দেবে। এদের ছ’জনের বেঁচে যাওয়া, কোনো ভাগ্যের খেলা ছিল না। এটা ওদেরই পরিকল্পনার অংশ ছিল। কিন্তু অরুণিকার বেঁচে যাওয়াটা ওদের ভাবনারও বাইরে ছিল। এখন তোর কথামতে, ওদের ছ’জনের ভাষ্যমতে আর উপমা আর তূর্যের বিয়ের দিনের ঘটনা সবকিছু ক্যালকুলেশন করে বুঝলাম, ওদের বিয়ে হোক, এটা কেউ চায় না। যে ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে, সে-ই মূলত চায় না। শতাব্দী নামের ওই মেয়েটির বিয়ের দিন ওদের কিছু লোক পিছু নিয়েছে। তাই তাহমিদ দ্বিতীয়বার শতাব্দীকে নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ পায় নি। তূর্য আর উপমার বিয়ের দিন ওদের উপর হামলা হয়েছিল। ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের আগে আদিলের খুন হয়েছিল। আবার এখন অরুণিকা আর আহনাফের বিয়ের আগে নতুন কোনো ঝামেলা করার সম্ভাবনা থাকতেও পারে।”
“এর একটা কারণ থাকতে পারে। বিয়ে হলে ওদের সম্পত্তির ভাগ ওদের স্ত্রীদের নামে চলে যাবে। এরপর উইল অনুসারে, ওদের স্ত্রীদের মৃত্যুর পর তাদের সন্তান না থাকলে এই ভাগ কেউই পাবে না।”
“তাহলে সবকিছু ঘুরেফিরে সম্পত্তির ভাগে এসেই আটকাচ্ছে! কিন্তু ওরা বেঁচে থাকুক, বা মারা যাক, সম্পত্তি এমনিতেও বাইরের কেউ পাবে না। তাহলে…”
মুরশিদ জুবাইয়ের রিয়াজুর রহমানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“পাবে। অরুণিকা পাবে। অরুণিকার কিছু হলে তার স্বামী পাবে।”
রিয়াজুর রহমান টেবিলের উপর জোরে চাপড় মেরে বললেন,
“দেটস এ গ্রেট ইনফরমেশন। আমি এটাই জানতে চাচ্ছিলাম। অরুণিকা আহনাফকে বিয়ে না করলেই তো তাদের সব কাজ সমাধান হয়ে গেলো। আর হয়তো তাই রহমতুল্লাহ আহনাফকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে।”
“হ্যাঁ, এটাই তো। তাই রহমতুল্লাহ অরুণিকাকে আহনাফের বিরুদ্ধে অনেক কিছুই বুঝিয়েছিল। আর অরুণিকা নিজেই এসব আরাফকে জানিয়েছিল।”
“তাহলে তারা প্রথমে অরুণিকাকে এই বিয়ে থেকে দূরে সরাতে চেয়েছি। কাজ হচ্ছিল না, তাই এখন আহনাফকে মারার পরিকল্পনা করছে। এখন আমাদের এদের দু’জনের সাহায্যে খুনিকে বের করতে হবে। আর শাহবাজ খান এই কেইসে আমাদের সাহায্য করবেন।”
রিয়াজুর রহমান শাহবাজ খানকে ফোন করতেই তিনি আশ্বস্ত করলেন তিনি এই কেইসে সাহায্য করবেন, আর বললেন,
“মিডিয়া এতোদিন মনে করতো আমি মির্জাদের সাথে মিলিত হয়ে খুন করিয়েছি। কিন্তু মির্জাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি শুধু ওদের একটা কেইসে মৈত্রীদের বিরুদ্ধে গিয়ে সাহায্য করেছিলাম। এই নিয়ে মৈত্রীদের সাথে আমার কোনো সমস্যা হয় নি। সমস্যা ছিল মিডিয়ার। আর আমি মিডিয়াকে নিজের নিরপরাধ হওয়ার প্রমাণ দিতে আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু আমি শুধু আমার ছোট বোনের শেষ চিহ্নটাকেই আগলে রাখতে চেয়েছি। আমি চাই অরুণিকা তার মামার সাথে কথা বলুক। আর তাই আমার ভাগ্নির জন্য আমি আসল খুনিকে সামনে আনার সব চেষ্টা করবো।”
এদিকে অরুণিকা বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরিতে ঢুকেই থমকে গেলো। ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠলো, “আরবান মামা, আপনি এখানে?”
আরবান তালুকদার মুচকি হেসে বললেন,
“এই তো সময় কাটছিল না, তাই ভাবছি এখানে এসে বই পড়ি।”
“ওহ আচ্ছা।”
অরুণিকা খেয়াল করলো আরবান তালুকদার তাকের উপর কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছেন। আরবান তালুকদার সামনে থাকা একটা বই নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে গেলেন। অরুণিকা এবার ভেতরে ঢুকলো। আর সেই জায়গায় হাত দিতেই দেখলো একটা চাবি। অরুণিকা চাবিটা নিয়ে ভাবতে লাগল,
“এই চাবিটা তো…”
অরুণিকার কিছু মনে পড়তেই সে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে এলো। সে সারাদিন বসে বসে শুধু একটা কথায় ভাবছে,
“আরবান মামা এই চাবিটা কেন খুঁজছিল? এটাতে আহনাফের রুমের চাবি।”
মূলত লাইব্রেরিতে প্রতিটা রুমের আলাদা চাবি রাখা থাকে। আর আহনাফের রুমের চাবির গায়ে একটা চিহ্ন আছে। সেই চিহ্ন দেখেই অরুণিকা চিনতে পেরেছে, এটা আহনাফের রুমের চাবি।
সন্ধ্যায় আরাফের সাথে এই বিষয়ে কথা বলার জন্য তার রুমের কাছাকাছি আসতেই সে শুনলো ভেতর থেকে তাহমিদ বলছে,
“আহনাফকে এখন সাবধানে থাকতে হবে। ওরা চায় নি, অরুণিকার সাথে আহনাফের বিয়েটা হোক। এখন যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে, তাহলে ওরা আহনাফকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে।”
অরুণিকা মনে মনে ভাবলো,
“আহনাফকে কেউ মারতে চাইছে, কিন্তু কেন?”
অরুণিকা আবার সরে আসতেই আরবান তালুকদারের মুখোমুখি হলো। আরবান তালুকদারের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। অরুণিকা তাকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে সরে আসলো।
চলবে—-
(আগামী দুই পর্বে সব রহস্যের উন্মোচন হবে।)