গল্পঃ #অস্পষ্ট_সে ( ২য় পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার
কিভাবে এই পর্যায়ে বিয়েটা ভেঙে দিবে চিত্রা? আর কি বলবে সবাইকে?
সে ঠোঁট চেপে শত চেষ্টায়ও কান্না আটকাতে পারছিলোনা। তার পাশের মেয়েগুলো এসে ধাক্কা দিয়ে বললো..
___চিত্রা আপু কি হয়েছে? কে ফোন দিয়েছে,আর তুমি কাঁদছো কেন?
চিত্রা তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে বললো..
___ আরে আমার এক স্কুলের বান্ধবী ফোন দিয়েছিল, অনেকদিন পরে কথা তো তাই একটু ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম।
ঠিক তখনি চিত্রা ফোনের স্ক্রিনে খেয়াল করলো এই মাত্র কলটা কেটেছে। সে এতক্ষণ এইদিকে লক্ষ্য করেনি।
চিত্রার কাছে দ্বীপের নাম্বারও নাই। চারপাশে এখনো সাজসরঞ্জাম চলছে, চিত্রার বাবা মা খুব ব্যস্ত। এই অবস্থায় সে কাকে কি বলবে?
তার ঠিক ৫ মিনিটের মাথায় চিত্রার রুমে তার চাচাতো বোন চৈতীর প্রবেশ, চৈতীকে দেখেই চিত্রা উঠে দাঁড়ালো। কারণ এই মানুষটাকে সে চোখ বন্ধ করে সব কথা শেয়ার করে অভ্যাস্ত।
তার চৈতীর বিয়ে হয়েছে দুইবছর হলো বয়সে তিন বছরের বড়,, চৈতীর বিয়ের আগে চৈতী আর চিত্রা সারাক্ষণ একসাথে থাকতো এবং একজন আরেকজনের সুখ দুঃখ প্রকাশ করতো।
চৈতী এসেই চিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো..
___ কিরে কাল চলে যাবি বলে মন খারাপ?
___ আপু বসো,, আসলে তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল। এখানে সবাইকে একটু বাইরে যেতে বলো না?
চৈতী তখনি এখানে যারা ছিল তাদেরকে বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললো।
আর তার কথামতো সবাই চলে গেলো। এদিকে চিত্রার বুক কাঁপছে, কথাগুলো কিভাবে সে বলবে!
তাও কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলো..
___আপু কয়েকদিন আগে আমার বান্ধবী যে রাহি, তার সাথে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দ্বীপকে একটা মেয়ের সাথে দেখেছিলাম। সেই মেয়েটা একটু আগে আমাকে ফোন দিয়ে বলল তাদের দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক, আমি যেন বিয়েটা ভেঙে দেই। তুমি বলো আমি কি করবো আপু? আমার মাথায় কোনো কিচ্ছু কাজ করছেনা। একদিকে আমার পরিবারে অশান্তি নেমে আসবে,অন্যদিকে আবার আমার পরবর্তী ভবিষ্যত! এমন অনিশ্চিত জীবনে পা রাখাও কতটা যুক্তিসঙ্গত আমি বুঝতে পারছি না আপু। প্লিজ একটা উপায় বের করো।
চিত্রার ওমন অস্থির মনস্তাপে চৈতী নিজেও আহাম্মক হয়ে গেলো। চৈতী ভাবতে পারছেনা তারই বা এখন কি করা উচিত। কতক্ষণ রুমে ভেতর পায়চারী করলো, কপালে হাত হাত বুলাতে বুলাতে ছয়-সাতবার রুমটাকে একবার চক্কর দিলো। তারপর বলে উঠলো..
___ মেয়েটা তোকে বিয়ে ভেঙে দিতে বললো কেন? যদি দ্বীপের সাথে সত্যি মেয়েটার সম্পর্ক থাকে,তাহলে তো দ্বীপই বিয়েটা করতোনা।
___ আপু মেয়েটার সাথে দ্বীপের ঝামেলা চলছে, আর এটা ঠিক হলেই নাকি ওরা বিয়ে করে নিবে। তখন আমার কি অবস্থা হবে সেইটার ইঙ্গিতও দিলো।
___ আরে শুন, কি এমন কঠিন ঝামেলা হতে পারে ভাবতো? যার জন্য দ্বীপ সেই মেয়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে পরিবারের ইচ্ছেতে বিয়ে করছে! নিশ্চয়ই জটিল গোলমাল। আর বিয়ের পরে বেশিরভাগ ছেলেরাই রিলেশনশিপ বলতে কি ছিল ভুলে যায়, একদিন দুইদিন অতঃপর সব ইনশাআল্লাহ ঠিক হবেই!
চিত্রা জল টলটলে চোখে চৈতীর দিকে তাকিয়ে বললো,,
___আপু তুমিও বলতেছো এই অবস্থায় বিয়ে করতে?
তখন চৈতী চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে বললো.
___দেখ বোন,,চাচা একটা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, সরকার থেকে যে বেতন পায় সেটা প্রতিমাসেই শেষ হয়ে যায়। তোর বিয়ের জন্য কতো টাকা লোন তুলেছে। যাবতীয় খরচ অলরেডি করে ফেলেছে, যা কেনার সব কিনে ফেলেছে! এই অবস্থায় যদি এমন কথা শুনে উনার কি হবে ভাবতে পারিস? দেখ বোন ভাগ্যের কথা বলা যায়না। ৫ বছর প্রেম করে বিয়ে করার পরও কিন্তু ১৫ দিনের সংসারেই সব তছনছ হয়ে যায়। আবার অচেনা অজানা একটা মানুষের সাথে হঠাৎ বিয়ে হওয়ার পরেও কতো কতো যুগ পার হয়ে যায়। আমি জানিনা তোর ভাগ্যে কি আছে,তবে তুই তো কোনোদিন বেপথে যাসনি, দেখিস তোর সাথে খারাপ কিছু হবেনা৷
চিত্রা চৈতীর দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে সত্যিই তো এই অবস্থায় কোনোভাবেই সে তার বাবার সামনে এমন কথা বলতে পারবেনা। হতে পারে এটা শুনে তিনি অসুস্থ হয়ে যাবেন।
চিত্রা মন স্থির করলো, যাই হোক তার পক্ষ থেকে বিয়ে ভাঙবেনা। আর দ্বীপের পরিবার তাকে পছন্দ করে বিয়ে করাচ্ছে, পরবর্তীতে কিছু হলে এর দায়বার তারাই নিবে৷
গায়ে হলুদ, মেহেদী পরানো,নাচগান এই পর্যন্তই সেদিনের কেটে গেলো।
বিয়েরদিন..
চিত্রা যেদিকে তাকাচ্ছে শুধু কান্না পাচ্ছে। এই পরিচিত আবাস্থল ছেড়ে একটা অচেনা বাড়িতে, অচেনা মানুষের সাথে সে কিভাবে থাকবে? সকালে তার মায়ের বকুনিতে আর হয়তো ঘুম ভাঙবেনা। তার বোনের সাথে প্রতিদিন ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া হবেনা। আরো অজানা যতসব কারণ তাকে ডুকরে কাঁদিয়ে তুলছে!
বিয়ের আগ মূহুর্তে তাকে যখন তার পছন্দের গাঢ় খয়েরী শাড়ীতে সাজিয়ে আয়নার সামনে বসালো।
তখন চিত্রা নিজের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারছিলো না। তার চোখে পানি চিকচিক করছে!
আহ! এই মূহুর্তটার কথা চিত্রার জীবনে কতবার ভেবেছে, তাকে বউ সাজে কেমন লাগবে! এটা ভাবতেই তার মনে কতো পুলক জাগতো, অথচ আজকে এমন বেরসিক লাগছে কেন সবকিছু?
চিত্রা আয়নার সামনে থেকে ঘুরে বসলো। চারদিকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তাকে চাওয়া সত্ত্বেও হাসতে হচ্ছে। ভেতরে ভারী যন্ত্রণা আর বাইরে হাসির অভিনয়! আর সহ্য করতে পারছেনা সে!
কিছুক্ষণের মধ্যে বিয়ে পড়ানো সম্পন্ন হয়ে গেলো।
তারপর বিদায়ের জন্য চারদিকে ছুটাছুটি। কেন জানি চিত্রার মনে হচ্ছে এখানে বেড়িয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে বোধহয় ভালো হবে।
এতো অস্বস্তি, এত খারাপ লাগা সে নিতে পারছেনা। তার বুকের ধুকধুকানিটা কেবলই বেড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সে যে নিরুপায়,
বিদায় লগ্নে জোরে শব্দ করে কাঁদতে পেরে চিত্রা বুকের ব্যথাটা হালকা অনূভব করলো। যখন তার কান্না থামলো এবং হুশে ফিরলো তখন নিজেকে সে আবিস্কার করলো কারো আলিঙ্গনে। তার গায়ে আশ্চর্য নেশাক্ত একটা স্মিল, চোখ তুলে তাকাতেই চিত্রার সারা শরীর শিউরে ওঠলো, দ্বীপ!
হ্যাঁ কিছুক্ষণের জন্য সে ভুলেই গেছিলো সে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে আছে ,এবং তার পাশে দ্বীপ ছাড়া আর কেউ থাকতে পারেনা।
চিত্রা দ্বীপের হাতটা ছাড়িয়ে সরে গিয়ে পাশের সীটে অন্যদিক ফিরে বসলো। দ্বীপ নিচু স্বরে তাকে লক্ষ্য করে বললো..
___ আপনি হুঁশে ছিলেন না তাই ধরে রাখছিলাম,নয়তো এতক্ষণে গাড়ী ঝাকিয়ে নাক,কান ভোঁতা বানিয়ে দিতো।
দ্বীপের কথা শুনে অজান্তেই চিত্রার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি বেড়িয়ে আসলো। কিন্তু সেটা এক মূহুর্তের জন্য, পরক্ষনেই চিত্রার মনে পড়ে গেলো পেছনে ঘটে যাওয়া সবকিছু। তার জানা নেই এরপর তার সাথে কি হতে যাচ্ছে।
রাত ১১ টার দিকে চিত্রাকে নিয়ে যাওয়া হলো দ্বীপের রুমে। চিত্রা চারপাশে এত সাজসজ্জা দেখে ভাবলো এটাকেই বুঝি বলে বাসরঘর? তবে তার কাছে এটাকে এই সময় মর্গ মনে হচ্ছে।
সারাদিনের এতো ঝড়ঝাপটায় ক্লান্ত ছিল সে, বিছানায় বসতে যাবে তখনি পেছন থেকে দ্বীপের ঝাঁঝালো কণ্ঠে আওয়াজ..
যেটা শুনার জন্য চিত্রা তখন প্রস্তুত ছিল না।
চলবে…