অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২২.

0
347

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২২.

ইয়াসির এই মুহুর্তে বসে আছে ডাক্তারের কেবিনে। ল্যায়লাকে হসপিটালে নিয়ে আসার কয়েক ঘন্টা পরেই সে ফোন করে তার আব্বু এবং আমাল আন্টিকে ল্যায়লার সিজার অ্যাটাক সম্পর্কে জানিয়েছে। ইয়াসিরের আব্বু বলে দিয়েছে আপাতত সে একটা জরুরি কাজে আটকে আছে। অন্তত পাঁচ দিনের আগে দেশে ফেরা সম্ভবই না। কিন্তু তিনি হসপিটালে যোগাযোগ করে সব সুযোগ ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ ইয়াসির যখন ফারদিনের সাথে কলে কথা বলছিলো তখন পিছন থেকে আমালের মৃদু স্বরে বলা বিরক্ত মিশ্রিত কথাটিও তার কর্ণগোচর হয় নি।

” আপদটা একেবারে মরে যেতে পারে না! ”

আমালের বলা কথা শুনে ইয়াসির অবাক হয় না। উল্টো ল্যায়লার প্রতি তার মায়া হয়।

ইয়াসিরের ভাবনার মাঝেই ডাক্তার এসে তার সামনে নিজের চেয়ারে বসে। তিনি ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে বলে,

” তো তুমি পেশেন্টের স্টেপ ব্রাদার? ”

ইয়াসির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

” হ্যাঁ। ল্যায়লার এখন কি অবস্থা? ”

মহিলা ডাক্তারটি তার হাতের কাছে থাকা ল্যায়লার ফাইলের রিপোর্ট দেখতে দেখতে বলে,

” সিজার অ্যাটাকের সিরিয়াসনেস সম্পর্কে তোমার পরিবারের কোনো ধারণা আছে? ”

ইয়াসির উত্তর দিতে পারে না। চুপচাপ বসে থাকে। ডাক্তার নিজেই আবার বলে,

” ভাগ্য ভালো যে এট দ্যা সেম টাইম পরপর অ্যাটাক হয় নি ওর। নাহলে জীবন হুমকির মুখে পড়ে যেত। কিন্তু ওর বর্তমান কন্ডিশনও যে খুব একটা ভালো তা-ও নয়। শি ইজ মেন্ট্যালি ট্রমাটাইজড। এই ট্রমা মূলত ওর এই অ্যাটাকের প্রধান কারণ। এই ধরনের পেশেন্টের এক্সট্রা কেয়ার প্রয়োজন। অথচ এখানে আমি পেশেন্টের লিগ্যাল গার্ডিয়ান ছেড়ে ওর স্টেপ ব্রাদারের সাথে এই বিষয়ে কথা বলছি। এ থেকেই আমার ধারণা হয়ে গিয়েছে ওর গার্ডিয়ান ওর ব্যাপারে কতটা সচেতন। ”

ডাক্তারের শান্ত ভাষায় করা অপমান ইয়াসির চুপচাপ মাথা নত করে শুনতে থাকে। এছাড়া আর উপায়ও নেই। পিতা মাতার পাপের শাস্তি সন্তানকেই হয়তো পেতে হয়৷ এজন্যই আজ সে আর ল্যায়লা জীবনের এই পর্যায়ে এসে পড়েছে। ডাক্তারের কথায় তার ধ্যান ভাঙে।

” আপাতত মেডিসিন যেভাবে প্রেসক্রাইবড করে দিচ্ছি সেভাবে চলুক। আর এই সিজার অ্যাটাকের পারমানেন্ট কোনো সলিউশন নেই। যদি ওকে ট্রমাটিক লাইফ থেকে বের করে আনতে পারেন, একমাত্র তাহলে এই ধরনের আকস্মিক অ্যাটাক এড়িয়ে চলা যাবে। ”

__________

গত দু’দিন ধরে ইয়াসিরের ঠিকঠাক ঘুম নেই। ল্যায়লার গতকালকেই জ্ঞান ফিরেছে। মিথিলা আন্টি এসেই সারাদিন সাথে ছিলো। ইয়াসির আর ল্যায়লার সামনে যায় নি। যদিও তার আব্বু তাকে কল করে বলেছে যে হসপিটালে তার থাকার প্রয়োজন নেই, নার্সরা খেয়াল রাখবে। কিন্তু ইয়াসির নিজের আব্বুর কথায় এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করতে রাজি নয়। বরং এই বাহানায়ও যদি তার ভুলের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হয় তবে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে।

আজকে সারাদিনও মিথিলা আন্টি হসপিটাল ছিলো। রাত হয়ে যাওয়ায় তিনি বাসায় ফিরে যান। আপাতত হসপিটালের করিডরে সিটিং এরিয়াতে ইয়াসির একাই বসে আছে। প্রাইভেট হাসপাতাল হওয়ায় আশেপাশে তেমন একটা মানুষও নেই।

ইয়াসির নিজের হাতঘড়ির দিকে একবার তাকায়৷ রাত দুটোর উপর বাজছে। ল্যায়লার এতক্ষণে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। ইয়াসির নিজের ক্লান্ত, অলস শরীরটাকে টেনে ল্যায়লার কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বেশ খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে সে দরজা খুলে কেবিনে প্রবেশ করে।

বিছানায় লেপ্টে থাকা ল্যায়লাকে দেখেই তার অনুশোচনা আবার জেগে উঠে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ল্যায়লার পায়ের কাছে দাঁড়ায়। এই মুমূর্ষু মুখশ্রী তাকে অপরাধবোধে দগ্ধ করে দিচ্ছে। ইয়াসির একহাত বাড়িয়ে ল্যায়লার এক পা ছোঁয়৷ পরমুহূর্তেই সে আরেক হাত বাড়িয়ে ল্যায়লার পা ধরে মনে মনে বলে উঠে,

” আই এম সরি। আই নো আমার ভুলের কোনো ক্ষমা নেই কিন্তু আই’ল মেক শিওর যেন ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু ফেস দিজ কাইন্ড অফ সিচুয়েশন এগেইন। ”

__________

তার পরের দিনই ইয়াসির বাসায় গিয়ে ল্যায়লার রুম চেঞ্জ করিয়ে দেয়। ডাক্তারের কথামতো ট্রমাটিক স্মৃতি যেন ল্যায়লার সামনে আর না আসে সেজন্য যা যা প্রয়োজন সব ব্যবস্থা করে। নিজেও বাসা ছেড়ে দেয়৷ ল্যায়লার সামনে ভুলেও আর কখনো যায়নি। কিন্তু সবদিক খেয়াল রেখেছে। মিথিলা আন্টিকে বলে দেয় যেন ল্যায়লার খেয়াল রাখে আর বাসায় যা-ই ঘটে সব যেন তাকে ইনফর্ম করা হয়।

আমাল আর ফারদিন দেশে ফিরে আসতেই সে ফারদিনের সাথে আলাদা দেখা করে। তাকে জানায় যে সে দেশের বাহিরে যেতে চায়। পরপর এতোগুলো ঘটনা নিয়ে ফারদিন আর আমাল দুইজনের মনেই সন্দেহ জাগে। কিন্তু ইয়াসির তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ঘরের শান্তি যদি বজায় রাখতে চায় তাহলে ল্যায়লার সাথে যেন কোনো প্রকার ঝামেলা না করা হয়। ছেলের হঠাৎ আমূল-পরিবর্তনে ফারদিন অবাক হলেও তা দমে গিয়ে ছেলেকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়৷

ইয়াসিরের ভিসা কার্যক্রম শেষ হতে একমাস লাগে৷ এই একমাস সে ঘরের বাহিরেই ছিলো। তারপর কেটে যায় সাত বছর। এই সাত বছরে ইয়াসির আর বাংলাদেশের মাটি মাড়ায় নি। নিজের করা ভুলের শাস্তি প্রতিনিয়ত অপরাধবোধে ভুগে পেয়েছে। অবশেষে অনেক সাহস জুগিয়ে যখন সে বাংলাদেশে ফিরলো তখন ল্যায়লাই নিরুদ্দেশ।

__________

” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই শি ওয়ান্টস টু গো ব্যাক? ”

অনেকটাই চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে ইসাম। ফাতিহ শান্ত স্বরে বলে,

” এটা ওর ডিসিশন। আর তাছাড়া যেই উদ্দেশ্যে ওকে এই সাতদিন আমাদের সাথে ঘুরতে বলেছিলাম সেটা পূর্ণ হয়েছে। ল্যায়লা প্রমিজ করেছে ও আর সুইসাইডের কথা চিন্তা করবে না। ”

ইসাম ফোনের অপর পাশ থেকে বলতে নেয়,

” কিন্তু… ”

” ওর ফ্লাইট আজকে রাত ৮ টায়। এয়ারপোর্টে সি অফ করতে চাইলে এসে পড়িস। ”

ইসামকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফাতিহ ফোনটা রেখে দেয়।

__________

ফাতিহর ফোন পেয়ে অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই এক ঘন্টার মধ্যে ইসাম তার বাসায় এসে উপস্থিত হয়৷ ল্যায়লার রুমে আসতেই দেখে সে ব্যাগ প্যাকিং প্রায় শেষ করে বসে আছে। ইসাম বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,

” হঠাৎ ফিরে যাওয়ার ডিসিশন কেন নিলে ল্যায়লা?”

ল্যায়লা ফিচেল হেসে সুধায়,

” নিজের দেশে ফিরবো না বলছো? ”

ইসাম অধৈর্য্য গলায় প্রশ্ন করে,

” এটা তোমার দেশ নয়? আমরা তোমার কেউ না? ”

ইসামের এরকম অদ্ভুত আর বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ফাতিহ বিরক্ত হয়। ল্যায়লা কঠিন স্বরে জবাব দেয়,

” না। ”

ইসাম আহত হয়৷ ফাতিহ দুজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

” লাঞ্চ টাইম হয়ে গিয়েছে। এসে লাঞ্চ করে রেস্ট নাও কিছুক্ষণ। পরে বেরোতে হবে। ”

ফাতিহর কথা শুনে মনে হচ্ছে তার ল্যায়লার চলে যাওয়া নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ইসাম একবার ফাতিহর দিকে তো আবার ল্যায়লার দিকে তাকায়। পরপর সে-ও রুম থেকে বেরিয়ে যায়। একা রয়ে যায় ল্যায়লা।

__________

চোখের পলকে সারাদিন পার হয়ে গিয়েছে। ইসামের দাদার কড়া নির্দেশ রাতে বাসায় পুরো পরিবারের সাথে ডিনার করতে হবে। তাই সে সন্ধ্যায় ল্যায়লার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছে।

এয়ারপোর্টে অন্তত দুই ঘন্টা আগে উপস্থিত থাকতে হবে। তাই ফাতিহ লিভিং রুমে বসে অপেক্ষা করছে ল্যায়লার। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরই সে উপর থেকে কিছু একটা শব্দ শুনতে পায়। ঘাড় ঘুরিয়ে উপরে তাকাতেই দেখে ল্যায়লা রেডি হয়ে ল্যাগেজ নিয়ে বের হয়েছে রুম থেকে। ফাতিহ উঠে দাঁড়িয়ে উপরে চলে যায় তড়িৎ গতিতে। ল্যায়লার হাত থেকে ল্যাগেজ নিতে নিলেই ল্যায়লা বলে উঠে,

” পারবো আমি। ”

ফাতিহ ল্যায়লার উত্তরের ধার ধারে না। সে ল্যাগেজ নিজের হাতে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

” জানি পারবে। এটাই শেষবার। এরপর থেকে তো একাই চলতে হবে। ”

ল্যায়লা ব্যথিত দৃষ্টিতে ফাতিহর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। এতদিন এতো মায়া দরদ দেখিয়ে এই শেষ মুহুর্তে এমন মুখের উপর সত্যি কথা না বললে কি ফাতিহর খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?

__________

সারাটা রাস্তায় ফাতিহ আর ল্যায়লা আর কোনো কথা বলে নি। দুজনের দৃষ্টিই রাস্তার দিকে নিবদ্ধ ছিলো। দুজনেরই কত কথা বলতে গিয়েও আর বলা হলো না।

এয়ারপোর্টের সামনে এসে গাড়ি থামতেই দুজনে চুপচাপ বসে রইলো। অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরও ল্যায়লার থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ফাতিহ নিজেই বলল,

” আমি গাড়ি ছেড়ে নামতে পারবো না। আশেপাশে মানুষ আছে৷ ”

ল্যায়লা সাথে সাথে ধীর স্বরে বলে,

” সমস্যা নেই। আই আন্ডারস্ট্যান্ড। ”

ফাতিহ চমৎকার একটা হাসি দিয়ে ল্যায়লার দিকে একহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

” ভালো থেকো ল্যায়লা। ”

এরকম এক মুহুর্তে ফাতিহর হাসি দেখে ল্যায়লার গা জ্বলে যাচ্ছে। ফাতিহর কি এক বিন্দুও খারাপ লাগছে না? ল্যায়লা ফাতিহর চেহারা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর এক দন্ড এই চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলে সে এখানেই কেঁদে দিবে। ফাতিহর বাড়িয়ে দেওয়া হাত আর চমৎকার হাসি উপেক্ষা করে সে গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়ে। নিজের ল্যাগেজ নিয়ে সে চুপচাপ এয়ারপোর্টের গেটের দিকে চলে যায়।

ফাতিহ চুপচাপ বসে রয়। নিজের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা গাড়ির স্টায়ারিং এর উপর শক্ত করে রেখে ল্যায়লার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। মনে মনে খুশি হয় ল্যায়লা তাকে উপেক্ষা করায়। হয়তো ল্যায়লা তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরলে সে আর ল্যায়লাকে যেতেই দিতে পারতো না।

যতক্ষণ ল্যায়লাকে দেখা যাচ্ছিলো ফাতিহ তাকিয়ে রয়। একবার এয়ারপোর্টের ভিতর প্রবেশ করতেই সে মনে মনে বলে উঠে,

” যা আমার না তা যেতে দেওয়াই উত্তম। ”

__________

বোর্ডিং পাস কালেক্ট করে এবং ইমিগ্রেশন কম্পলিট করতে করতেই ল্যায়লার ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছিল। তাই আর কোথাও দাঁড়ানোর সুযোগ পায় নি।

ফ্লাইট টেক অফ করতেই ল্যায়লা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়। রাতের মরক্কোর দৃশ্য দেখতে দেখতে অজান্তেই তার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে। ফাতিহর কথা মনে পড়তেই সে উপলব্ধি করে, ফাতিহ তাকে খুশির কাঙাল করে দিয়েছে। আরেকবার নিজের খুশি হারিয়ে ফেলার কথা মনে পড়তেই ল্যায়লার নিঃশব্দে কান্নার স্রোত বাড়ে। আরেকবার তার জীবন দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকারে ছেঁয়ে যায়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here