আকাশেও অল্প নীল পর্ব -২৪+২৫

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ২৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৭৩,
দিগন্ত আর ইফরাদের মুখোমুখি বসতে বসতে রাইমা ইফরাদকে জিগাসা করলো,

“এই লোককে কোথায় পেলেন ইফরাদ ভাই? আমি তো শুধু আপনাকে আসতে বলেছিলাম!”

“রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি রাই। তাই উনার গাড়িতে ঝুলে চলে আসলাম।”

“আমার জানামতে তো দুলাভাই বাস ড্রাইভার নয়। তাহলে গাড়িতে ঝুললেন কি করে?”

শারিন ইফরাদের উত্তর শুনে কথার মাঝে ফোড়ন কেটে প্রশ্ন টা করে। দিগন্ত হেসে ফেলে শার্লিনের কথায়। রাইমা শার্লিনের প্রশ্ন শুনে ওর হাতে চাপর ম’রে বললো,

“তোর মুখটা কি ভালো থাকে না বইন? এতো উল্টাপাল্টা কথাবার্তা আসে কি করে তোর মাথায়?”

“আমার কি দোষ! তোর ভাই বললো কেন, আমার ভাইয়ের গাড়িতে ঝুলে আসছে! দিগন্ত ভাইয়ের তো প্রাইভেট কার আছে। আর প্রাইভেট কার এ ঝুলে কে?”

“অফ যা বইন। এনাফ বকবক করে ফেলছিস।”

রাইমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শার্লিনকে থামতে বলে। ভাগ্য করে বান্ধবী পেয়েছে, যাকে সবটা সময় বলতে হয়, অফ যা বইন। এতো তারছিড়া কথাবার্তা তার মাথায় আসে, খোদা। শার্লিন মুখটা কাচুমাচু করে রাইমার দিকে তাকিয়ে বলে,

“জানিসই তো আমি একটু বেশি কথা বলি। এমন করে আমায় থামিয়ে দিস কেন বইন?”

“এই যে হ্যালো! আমরাও আছি। এদিকেও একটু মনোযোগ দাও।”

ইফরাদ আর দিগন্ত যে এখানে উপস্থিত আছে, বেমালুম ভুলে বসেছে শার্লিন। রাইমা কপালে বুড়ো আঙুল ঘষে বলে,

“,আপনার হবু বউকে থামান ভাই। আমি তো পাগল হয়েই গিয়েছি। আপনার ঘরে নিয়ে আপনিও এবার পাগল হোন। আমার মুক্তি প্রয়োজন।”

দিগন্ত বসে বসে দুই বান্ধবীর কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছিলো আর মিটিমিটি হাসছিলো। নিজে চুপচাপ, গম্ভীর স্বভাবের হওয়ার দরুণ পড়াশোনার পুরোটা সময় সে একা একাই কাটিয়ে এসেছে। মানুষ ধোঁকা দেয়, চলে যায়, ছেড়ে যায়, মনোবল ভেঙে দেয়, এসব ভয় থেকেই দিগন্ত সবসময় একা থাকারই চেষ্টা করেছে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি লাইফে জীবনে থেকে যাওয়ার মতো ফ্রেন্ডশিপ! দিগন্তের করা হয়ে উঠেনি। ক্লাসমেইটদের সাথে টুকিটাকি যা কথা হতো পড়াশোনার জন্য! ঐ অব্দি পরিচয়। কিন্তু এখন কেনো জানি রাইমা আর শার্লিনের বন্ধুত্ব দেখে দিগন্তের আফসোস হচ্ছে। জীবনে এমন একটা ফ্রেন্ড সত্যি জরুরী, যে হু বলতেই সবটা বুঝে যাবে, আগলে রাখবে। দিগন্তের ওদের তিনজনের কথাবার্তার এই পর্যায়ে নিজের চিন্তাভাবনা রেখে গম্ভীর স্বরে বললো,

“তোমরা এবার একটু থামো। আমি স্কুলের কাজ সেরে বাসার দিকেই যাচ্ছিলাম। এরমাঝে রাস্তায় দেখি দাড়িয়ে আছে। নেমে জানতে পারি ইফরাদ রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। তো ইফরাদের সাথে কথা বলে ক্যাফেতে নামিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু নামিয়ে দিতে এসে নিজে আর যেতে পারিনি। বললো তোমরা আসবে! তো এই কারণে আমাকেও আঁটকে দিলো।”

“হয়েছে অনেক কথা হলো, এবার কাজের কথায় আসা যাক। ইফরাদ ভাইকে ডেকে তার কাজের ঘোলা তো করে দিয়েছি। এবার কথাবার্তা শেষ করে বাসায় যাওয়া উচিত সবার। আমার এমনি ক্লান্ত লাগছে।”

রাইমা ক্লান্ত ভঙ্গিতেই কথাগুলো বললো। ইফরাদ এবার সিরিয়াস হয়ে একটু ঠিকঠাক হয়ে বসলো। দিগন্তের মাথায় চিন্তা এসে হাজির রাইমার কথা শুনে। কি কাজের কথা থাকতে পারে? শার্লিন ঐ যে চুপ হয়ে বসেছে, চুপই হয়ে আছে। ইফরাদ আগে সবার জন্য ওয়েটার ডেকে কফির অর্ডার দিলো।

৭৪,
ওয়েটার কফি দিয়ে যেতেই রাইমা কফি খেতে খেতে বললো,

“মাহিশার চিহ্ন কি জীবন থেকে মুছেই দিলেন ইফরাদ ভাই? আপনার বোন হয়। আমি না হয় কিছু হতাম না, তাই চারটা বছর একটা মেসেজ অব্দি দেননি যে, বেঁচে থাকলাম না ম”রে গেলাম। কিন্তু আপনার বোন, আপনি যে মায়ের সন্তান, সেই মায়ের সন্তান সে-ও। তার খোজ কি একবারও নেওয়ার চেষ্টা করেননি? সে বেঁচে থাকলো না ম”রে গেলো? খোজখবর খুজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন? নাকি আমাদের থেকে দূরত্ব টানার সাথে তাকেও মনে দাফন করে ফেলেছেন?”

ইফরাদ অপরাধ বোধে মাথা নিচু করে রাইমার কথা শুনে। শার্লিন আর দিগন্ত তো রাইমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। তাই নিরব শ্রোতা হয়েই ইফরাদের উত্তরের অপেক্ষা করলো। রাইমা ইফরাদের উত্তর না পেয়ে ফের প্রশ্ন করলো,

“আমার কথাগুলোর উত্তর কি আপনার জানা নেই ইফরাদ ভাই?”

“জানা আছে রাই। তোমার বান্ধবী একটা ছেলের ভালোবাসায় এতোটা অন্ধ হয়েছিলো যে, তোমার কথা ভাবা তো দূরে থাকলো, পরিবারের কথাও ভাবেনি। ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয় তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তোমার বান্ধবী। তোমার বান্ধবী ঠিক ঐ ছেলের সাথেই পালিয়েছিলো। শুধু পুলিশ কেস, আবার ওকে সহজেই পেয়ে গেলে যদি জোড় এনে বিয়ে দেই! এই ভয়ে সুন্দর একটা প্ল্যান করেছিলো মাহিশা আর ঐ ছেলেটা। মাহিশা একাই বাসা থেকে পালিয়ে ঐ ছেলেটার আত্মীয় স্বজনের বাসাতেও খোজ করা হবে! এই আইডিয়া থেকে নিজে সাহস করে ছেলেটার এক ফ্রেন্ডের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকছিলো। সব থেমে গেলে, মানে আমরা থেমে গেলে ও ঠিকই বেরিয়ে আসে দুবছর পর। তা কি করে এসেছে! একেবারে বিয়ে করে বাচ্চা সহ। কি আলতু ফালতু আইডিয়া, বাচ্চার মুখ দেখলে নাকি বাবা মা মানতে নারাজ থাকবেনা আর। আর ঐ আইডিয়া টাও ঠিকই কাজে লেগেছে। বাবা মা আদরের মেয়েকে ফেরত পেয়ে দুবছরে পাওয়া কষ্ট গুলো ঠিকই ভুলে যায়। তার সাথে নাতনীর মুখ দেখে তারা খুশিতে গদগদ। মাঝখানে অপরাধ বোধে পু”ড়ে ম”রছি আমি। তোমায় তো কম অপমান করিনি। মহল্লার মানুষগুলোও তোমায় কম কথা শোনায়নি। এতো অপরাধ বোধ নিয়ে তোমার সামনে এসে দাড়ানোর ক্ষমতা আমার হয়নি রাই। জানো তো অপরাধ বোধ মানুষকে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করে দেয়।”

“সবই তো বুঝলাম ইফরাদ ভাই। কিন্তু যেখানে আপনি আপনাদের এতো খোজার চেষ্টা করেও পেলাম না! মাহিশা কি করে খুজে পেলো? আপনারা তো পুরাতন সব কন্টাক্ট নাম্বার, ভার্চুয়ালি খুজে পাওয়ার রাস্তা সব বন্ধ করে ফেলেছিলেন? সেখানে মাহিশা কি করে পেলো?”

“তোমার বান্ধবী তোমার থেকে সবসময় বেশি বুদ্ধিমতী আমি আগেও বলতাম রাই। বুদ্ধি তো তার কম নেই! সেই বুদ্ধি কাজে লাগিয়েছে।”

“মানে?”

“তুমি তো আমার পরিবারের প্রতিটা মানুষের সব সীমের নাম্বার জানতে না। সবসময় যেগুলো ইউজ হতো, সেগুলোরই নাম্বার জানতে। বাবার যে কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত সীম! ওটা তো আর পাল্টানো যায়নি। কারণ বাবার ব্যবসা ক্ষেত্রে সবার সাথে কথা বলতে হতো। মাহিশা তো ঘরের প্রতিটা নাম্বার মুখস্ত রেখেছিলো। আবার নোট করেও রেখেছিলো কাছে। বাবা তো তার মেয়ের গলা শুনেই গলে গিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে মেয়েকে দেখে মানিয়ে বাসায় আনে। ছেলেটা ছিলো বড়লোক বাবার আদুরে দুলাল। ছেলের পছন্দ তার বাবা মা ফেলেনি। আমার বাবা আর কি ফেলবে বলো!”

“বাহ ইফরাদ ভাই। মাঝখানে এতে ঘটনা হলো, আমি রাইমা সবকিছুর অনবগতই রয়ে গেলাম। শালুর সাথে আপনার সম্পর্ক না হলে বোধ হয় এসবও আমার জানা হতো না। কি সুন্দর সিনেমাটিক ঘটনা। তালিয়া জারুর বানতি হ্যায়।”

৭৫,
রাইমা কথাটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে আস্তে করে কফির মগ রেখে দুই হাতে তালি বাজায়। শার্লিন এতোক্ষণ চুপ করে ছিলো। কিন্তু এবার আর চুপ থাকতে পারলো না৷ ইফরাদের উদ্দেশ্যে বললো,

“আপনার এই গুণবতী বোনের কথা তো আগে কখনও আমায় বলেননি? আমিও জানতে পারি রাইয়ের কাছে। আপনাকে বলবো বলবো করেও মাহাদ ভাইয়ের বিয়ের চক্করে বলা হয়নি। আপনার সাথে পরিচয়ের এতোদিন হয়ে গেলো! অথচ আমি তাকে দেখিইনি। আবার মাহাদ ভাইয়ের বিয়েতেও সে আসেনি, অথচ পরিবারের বাকি সবাই এসেছিলো। তখনও কেউ কিছু আমাকে না হোক, রাইকে তো জানানো যেতো! ওকেও জানাননি। আজ রাই ডেকে জানতে না চাইলে তাও তো বলতেন না। আপনার বোনের ঘটনা তো নাটকের, গল্পের ঘটনাকেও ফেইল করিয়ে দিচ্ছে। বাহ?”

দিগন্ত চুপচাপ বসে থেকে ওদের তিনজনের কথাবার্তা শুনে ছোট্ট করে বললো,

“ইফরাদকে পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার করতে দাও শার্লিন। এরপর না হয় যা বলার বলো। যতেটুকু জানাচ্ছে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসছেই। সব ক্লিয়ার করতে দাও। ইফরাদ তুমি বলো,

“আমায় ভুল বুঝো না রাই। বোনকে না পেয়ে তখন তো কি করেছিলাম! কিছুই আশা করি ভুলোনি। তোমায় তো কম হেনস্তা করিনি। আমার বোন কোথায় আছে এটা তুমি জানতে আইডিয়া করে পুলিশের তদন্তের জন্য তোমায় তো থানা আর বাসা কম হ্যারাজ করা হয়নি! এলাকার মানুষও তোমায় কম ছোটো করেনি। তোমার সঙ্গে ঘরের মেয়ে ন”ষ্ট হয়, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে! এমন কথাও তোমার কম শুনতে হয়নি। এলাকায় তো একপ্রকার হইচই উঠে যায়, তুমিই আমার বোনকে পালাতে সাহায্য করে আমাদের জানাওনি! তুমি চিটারি করেছো আমাদের সাথে। বন্ধুত্বের নামে মুখোশ পরে আমার বোনের ক্ষতিই করে গেছো! এমন কি তোমার উপর হিংসার বশে আমার বোনকে খু”ন করে দিয়েছো, এমন কথাও তো বলতে বাকি রাখেনি আমার পরিবার৷ যখন সম্পর্কের কথা সবাই জানে তখনও তোমায় কম অপমান করা হয়নি যে, জেনেশুনে কেনো সম্পর্কে জড়াতে দিলে এমন কম বয়সী একটা ছেলের সাথে, যে নিজেই ম্যাচিউর নয়, আমার বোনকে কি আগলাতো। সেই অপমানের জেড় ধরে খু”ন করার মতো মিথ্যা অপবাদও তুমি শুনতে বাকি ছিলে না। আমি তো এককাঠি উপরে চিন্তা করে তোমায় কম অপমান করিনি যে, তুমি আমায় পছন্দ করো এমন একটা ধারণা থেকে তোমায় বলেছিলাম, মাহিশাকে তার ভালোবাসার মানুষকে পাইয়ে দিয়ে, মাহিশার মাধ্যমে আমায় পাবে! এমন বাজে ধারণাও পুষে তোমায় কম কথা শুনতে হয়নি, যখন এসব এলাকার মানুষ রোজকার ঝগড়া নিয়ে সব জানতে পারে, তোমার চরিত্রেও আঙুল তুলতে বাকি রাখেনি। মাহাদ ভাইয়ের এক্সি”ডেন্টের জন্য তোমাদের যেতে হলে সবাই তো বলেও দিয়েছে, পুলিশের ভয়ে তোমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছো। এতো এতো অপমান বিনা কারণে করে, সব সত্যিটা জানার পর অপরাধ বোধে ভেতরে ভেতরে তোমার সামনে আসার সাহসটা আমার হচ্ছিলো না রাই। আমার বাবা মায়েরও সেইম অবস্থা। প্রথম ২বছর তো ধরেই নিয়েছিলাম মাহিশা আর নেই। থাকলে তো একটা খোজ অন্তত পেতাম। ঐ দু বছর এমন একটা দিন নেই তোমার প্রতি ঘৃণা আসতো না। ২বছর পর তোমায় বিনা কারণে ঘৃণা করার জন্য নিজেদের উপরই কেমন ঘৃণা জন্মে যায় যে! নির্দোষ একটা মেয়ে, তাকে তো হ্যারাজ করেইছি, সাথে তার পরিবারকেও। এই অপরাধ বোধের যে কি যন্ত্রণা! তোমায় বলে বোঝানো যাবেনা রাই। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখও আমার নেই। তবুও আমি ক্ষমা চাচ্ছি রাই।”

৭৬,
সব ঘটনা শুনে শার্লিন আর দিগন্ত হতভম্ব। একটা মেয়েকে এতো বাজে ভাবে বিনা কারণে পুরো সমাজের সামনে অপমানিত হতে হয়েছে? এসব ঘা আদৌও শুকোয় তো! মনের মাঝে চাপা কষ্ট থাকে না? সেই কষ্টের ভার রাইমা বয়ে বেড়াচ্ছে কি করে? দিগন্ত বিষয়টা ভাবতেই তার কেমন একটা মনের মাঝে ধরফর অনুভূতি হয়৷ আচ্ছা রাইমাকে যে উপর থেকে দেখা যায় সে ভালো আছে! ভেতরে ভেতরে সে আদৌও ভালো আছে? চিন্তা করে কূল পেলোনা দিগন্ত। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে রাইমার দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখের কোণে জল ভাসছে। হয়তো অতীতের তিক্ত স্মৃতি তার চোখের পাতায় ভাসছে। দিগন্ত তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখলো রাইমার চোখ ছাড়িয়ে অবাধ্য জলরাশী গাল বেয়ে নিচে পরছে। অতীতের স্মৃতিগুলো যে একটু বেশিই তিক্ত। নারীর আত্মসম্মানে দাগ লাগলে যে সে এমনিই ভেতর থেকে গুড়িয়ে যায়! সেখানে রাইমা তো নরম স্বভাবের মেয়ে। আত্মসম্মানে আঘা”ত করলে তো আ”ঘাত ফেরানো যায়! কিন্তু দাগ লাগালে সেই দাগ মোছার চেষ্টা করলেও একদল লোক বলবে, এই মেয়েটার উপর একসময় এই অপবাদ দেওয়া হয়েছিলো, সত্য মিথ্যা কেউই যাচাই করবেনা। শার্লিন রাইমার কাঁধে হাত রেখে রাইমাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। ইফরাদ অপরাধ বোধে মাথা নিচু করে বসে আছে। রাইমা নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করে বললো,

“আপনারা অপরাধ বোধে সামনে আসেননি ভালো কথা, আপনার বোন কেনো আসেনি ইফরাদ ভাই? ও তো জানে ও আমার কাছে ঠিক কি?”

“সে না হয় তোমার বান্ধবীর থেকেই জেনে নিও রাই। ওর সাথে আমি কথা বলিনা, আমার বোন আছে এটাও আমি ভুলতে চেষ্টা করি। ওর জন্য কম কান্না করিনি আমি, ওর জন্য তোমায় এতো অপমান করেছি, ভেঙেচুরে দিয়েছি ভেতর থেকে। একবারও বোঝার চেষ্টা করিনি, আমার পরিবার তার মেয়ে হারালে তুমিও তোমার আত্মার সাথীকে হারিয়েছিলে! এতো এতো রিজন নিয়ে আমি আজও ওর সাথে কথা বলে উঠতে পারিনি। ক্ষমাও করতে পারিনি। না নিজেকে, না ওকে।”

“ঠিক আছে ইফরাদ ভাই। ওর থেকেই সব শুনবো, আমায় ওর কাছে নিয়ে যাবেন প্লিজ?”

চলবে?
#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ২৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৭৭,
রাইমার প্রশ্ন শুনে ইফরাদ উত্তর দিলো,

“আজ নয় রাই, আগামীকাল বা ছুটির দিনে গেলে হয়না? আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে।”

“আমি আজকেই যাওয়ার কথা বলিনি ইফরাদ ভাই। সবকিছু মিলিয়ে আমিও বড্ড ক্লান্ত। বাসায় যাওয়া যাক এবার?”

রাইমার কথা শেষ হতেই ইফরাদ ওয়েটার ডেকে বিল মিটিয়ে দেয়। দিগন্ত দিতে চাইলো, কিন্তু ইফরাদ মানা করে নিজেই দেয়। এরপর সবাই উঠে দাড়ায়। রাইমা আর শার্লিন আগে আগে হাঁটা ধরে। পিছনে ইফরাদ আর দিগন্ত। ইফরাদের ফোনে কল আসায় সে একটু দ্রুতপদে হেঁটেই আগে আগে ক্যাফে ছেড়ে বের হয়। দিগন্ত রাইমার পাশে এসে হাঁটা ধরে। শার্লিনও নিজের ফোন নিয়ে একটু ব্যস্ত। বাসায় মেসেজ করে জানালো তারা একটু বাইরে বেরিয়েছে ভার্সিটি শেষে। ক্যাফে হতে বের হতেই দিগন্ত সুযোগ বুঝে রাইমার হাত টা চেপে ধরে। রাইমা চমকে দিগন্তের দিকে তাকায়। দিগন্ত রাইমার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলায়। চোখের ইশারায় রাইমাকে আশস্ত করে, ভরসা দেয়। রাইমা দিগন্তের চাহনীতে ভরসা খুজে পেয়ে মৃদু হাসে। অবশেষে তাদের সম্পর্ক ভরসা দেওয়ার মতো উন্নতির দ্বারে পৌঁছেছে। ইফরাদ কথা বলা শেষ করে ক্যাফের বাইরে অপেক্ষারত শার্লিন, রাইমা আর দিগন্তের কাছে আসে। সে আসতেই দিগন্ত বললো,

“চলো তোমাদের সবাইকে এক এক করে বাসায় ছেড়ে দিই!”

ইফরাদ মাথা চুলকে হালকা হেসে বললো,

“দিগন্ত ভাই, আপনি রাইকে নিয়ে বাসায় যান। আমার শার্লিনের সাথে একটু দরকার ছিলো। ওকে মা বাসায় নিয়ে যেতে বললেন। মা কল করেছিলো, শুনলেন শার্লিন সাথে আছে। বললেন নিয়ে যেতে।”

রাইমা ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে শার্লিনকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,

“যাও, হবু শাশুড়ীর আদর খেয়ে এসো। আদরের চোটে আমায় ভুলোনা যেনো!”

শার্লিন তার ঠোঁটকাটা স্বভাব বজায় রেখে বললো,

“শাশুড়ী চরম লেভেলের একটা ভুল করেছে বইনে। আমার দেবর ভাসুর কিচ্ছু নাই। নয়তো দুই বান্ধবী এক বাসায় থাকতাম।”

“তাহলে সেটা বাসা আর বাসা থাকতো না। পাগলাগারদ ফেইল করাতো।”

ইফরাদ কপালে বুড়ো আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে কথাটা বললো। দিগন্ত গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো,

“তাহলে আমার কপালে তোমার বান্ধবী থাকতো না শালীকা। জোড়া তো উপরওয়ালা বেধে দিয়ে পাঠিয়েছেন।”

রাইমা বললো,

“হয়েছে থামো তোমরা। যাওয়া যাক, বাসায় সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।”

রাইমার কথায় সবাই গসিপ থামিয়ে দিগন্ত আর ইফরাদ মিলে এক রিকশা ঠিক করে ইফরাদ আর শার্লিনকে বিদায় জানালো ওরা। এরপর রাইমা এবং দিগন্ত, দিগন্তের গাড়িতে উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রাইমা দিগন্তের সাথে সামনের সীটে বসে সীট বেল্ট লাগাতেই দিগন্ত গাড়ি স্টার্ট দেওয়া রেখে রাইমার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে জিগাসা করে,

“আমি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”

৭৮,
রাইমা দিগন্তের কথায় চকিতে তার দিকে তাকায়। দিগন্তের দৃষ্টি তার দিকে নিবন্ধ৷ চোখে তার উত্তরের অপেক্ষার আকুলিবিকুলি। রাইমা মৃদু হেসে উত্তর না দিয়ে জিগ্যেস করলো,

“আমায় জড়িয়ে ধরবেন! আপনি আপনার হবু বউকে, যাকে ক’দিন পর বিয়ে করবেন! তাকে জড়িয়ে ধরতেও অনুমতি প্রয়োজন হলো?

” অবশ্যই হলো রাই। আমি আচমকা আপনাকে ধরলে যদি আমায় ভুল ভাবেন! যে এই লোকটা এতো নির্লজ্জ যে একটা মেয়ের অনুমতি ব্যতিতই তাকে জড়িয়ে ধরেছে। বিষয়টা কেমন একটা উইয়ার্ড হয়ে যাচ্ছে না? এজন্য রেস্টুরেন্টে আপনাকে কাঁদতে দেখেও জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হলেও আমি ধরতে পারিনি।”

রাইমা দিগন্তের কথায় চমৎকার ভাবে একটু হাসলো। নিজের হাত বারিয়ে দিগন্তকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। দিগন্তের বুকের মাঝে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললো,

“আপনার প্রতি আমার অনুভূতি গুলো দায়িত্ব বোধ থেকে নয়, একটা সুস্থ সম্পর্ক, ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসার জায়গা হতেই আসতে শুরু করেছে। ইনশা আল্লাহ একদিন সংকোচ বিহীন ভাবেই বলে দিবো ভালোবাসি।”

দিগন্ত রাইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

“আপনি আর কাঁদবেন না রাই, অতিরিক্ত খারাপ লাগা ব্যতিত আপনি কাঁদবেন না। আমি সিনেমা, নাটকের হিরোর মতো বলতে পারবোনা, আপনাকে আমি কখনও কাঁদতে দিবোনা, এটাই আপনার শেষ কান্না! এমনটা আসলে হবার নয় বুঝলেন তো! মানুষের ভালো লাগা, মন্দ লাগা বিষয়গুলো থাকে। মানুষ অতি আনন্দেও কাঁদে, আবার অতি কষ্টেও নিজের হাসফাস লাগা অনুভূতি গুলো কান্নার মাধ্যমে ঝড়িয়ে দেয়। জীবনে চলার পথে কান্নাটুকুও জরুরী। এতে অন্তত মনের মাঝেই দ”হনের আ”গুণ প্রশমিত হয়। তবুও আমাদের হাসতে হয়, ভালো থাকতে হয়। আপনি হাসতে হয় বলে হাসবেন না, আপনি যেমন চঞ্চল চড়ুই পাখির মতো, আপনি তেমনই থাকবেন। আপনায় ঐ রুপেই মানায়, কান্নায় নয়।”

রাইমা মুগ্ধ হয়ে দিগন্তের বলা প্রতিটা কথা শুনলো। সে নিজেও ভেবে পায়না দিগন্ত এতো সহজ করে সবটা বোঝায় কি করে! যখনই সে মনে চাপা কষ্ট অনুভব করে, দিগন্ত এসে সামলিয়ে দেয়। এই নিয়ে ২য় বার। এর আগে তো সেই ইফরাদের সাথে চারবছর দেখা হওয়ার দিন তার কান্না থামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো। সেদিনের কথায় ভালোবাসা না থাকলেও জেদ ছিলো, আর আজ কিছু মিষ্টি অনুভূতি, এটা ভালোবাসা না ভালো লাগা বুঝতে পারছেনা রাইমা। নিজের চিন্তাভাবনা বাদ রেখে দিগন্তকে বললো,

“আমার না একটা কথা বিশ্বাস হয়না জানেন!”

“কি কথা?”

“এই যে একদিন ছিলো, যখন আপনাকে দেখতেই আমাদের ঝগড়া শুরু হতো! বাজে অনুভূতি, খারাপ লাগার কারণ হতাম আমরা একে অপরের। অথচ আজ ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে সব।”

“এটা হবারই ছিলে মিস রাইমা খন্দকার। নয়তো আমি দিগন্ত আহসান আপনাকে ভালোবাসার চেষ্টা করতাম না।”

“ভালোবাসা সুন্দর মি: দিগন্ত আহসান, একটু বেশিই সুন্দর।”

“এবার তবে গাড়ি স্টার্ট দিই!”

“হুম দিন।”

কথা বলা শেষে রাইমা দিগন্তকে ছেড়ে নিজের সীটে বসে গা এলিয়ে দেয়। সে সচরাচর কান্নাটা করেনা। মাহিশাকে হারিয়ে বোধ হয় লাস্ট বার কেঁদেছিলো। এরপর ইফরাদের সাথে দেখা হওয়ার দিন। তারপর তে তার লড়াই শুরু হয় ভালো থাকার। ভালো আছি বললেই তো ভালো থাকা হয়না, মন থেকেই ভালো থাকতে হয়। এই মন থেকে ভালো থাকার লড়াই এ নেমে রাইমা কাঁদতে ভুলে বসেছে। এতোদিন পর কান্না করায় তার মাথা ব্যথা করছে একটু। এজন্য সীটে গা এলিয়ে বসলো। দিগন্ত রাইমাকে এক পলক দেখে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রওনা দেয় নিজেদের গন্তব্যে।

৭৯,
পরদিন সকালবেলায়, রাইমা শাহনাজ বেগমকে নাস্তা বানানোয় সাহায্য করে টেবিলে সব সাজিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে রুমে আসে। রুমে এসেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠে রাইমা। বিছানায় শার্লিন এলেমেলো অবস্থায় বসা। পা দুটো ঝুলিয়ে দুহাতে ভর দিয়ে তার বিছানায় বসে আছে শার্লিন। চুলগুলো এলেমেলো, ওরনাটা কাঁধের একপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চোখ দুটো কেমন ফোলাফোলা। অতিরিক্ত ঘুমালে বা কাঁদলে চোখ মুখের যা অবস্থা হয়, শার্লিনেরও তেমনই অবস্থা। রাইমা হন্তদন্ত হয়ে শার্লিনের সামনে গিয়ে হাটু মুড়ে বসে। ওর দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে রাইমার। গতোকালই কতো সুন্দর হাসিখুশি মেয়েকে ইফরাদের সাথে ওর বাসায় যেতে দিলো! আর আজই এমন অবস্থা! হয়েছে কি শার্লিনের? নিজের আগ্রহ দমন করতে না পেরে ব্যথিত চিত্তে রাইমা জিগ্যেস করে,

“বাসায় এসে আমার রুমেও এসে বসে আছিস! অথচ আমি জানি না! এটা কেমন হলো শালু? যাকে না দেখেই বুঝতে পারি, সে এসেছে৷ চজ তাকে দেখেও কেমন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সে এসেছে! কারণ না আছে সারাশব্দ না আছে মুখে হাসি। কি হয়েছে আমার শালু গোলআলুর বলতো?”

“আচ্ছা রাই আমি কি খুব বেশি ন্যাকামি করি? খুব বেশিই অবুঝপনা হয়ে থাকি? সত্যি করে বলবি কিন্তু! আমায় শান্তনা দেওয়ার জন্য নয়। আমার জানা জরুরী।”

“মানে কি এসব কথার? কে বলেছে তুই ন্যাকামি করিস! অবুঝপনা হফ থাকিস? কে বলেছে?”

“ইফরাদ বলেছে রাই। আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। ও তো জানতো আমি এমন। আমার এমন ন্যাচারের জন্যই তো এট্রাক্টেড হয়ে ভালোবেসেছিলো আমায়। আজ তবে আমার এতো চঞ্চল হওয়ায় তার আপত্তি বল তো? ইফরাদের জন্য ঐ কথাটা খাটলো নাকি! পাওয়ার আগেই যতো ঢঙ, পেয়ে গেলেই বেরোয় আসল রঙ?”

“হয়েছে কি আমায় খুলে বলবি? তোর কথা আমার বুকের মাঝে ধরফর অনুভূতি ধরিয়ে দেওয়ার কারণ। ভাইয়া আর তোর সম্পর্ক ঠিক আছে তো?”

“আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি রাই, যে সময়ে মেয়েদের অকারণেই মুড সুইং হয়, এই ভালো লাগছে তো সেকেন্ডও লাগেনা ভালো লাগা খারাপ লাগায় পরিণত হতে। আমরা সেই সময়ে লাইফ নিয়ে ট্রাভেল করছি, যেই সময়ে বেশিরভাগ মানুষ ভালো না লাগা নামক অনুভূতিতে আসক্ত। এমনিতে তো লাইফের বিভিন্ন ক্রাইসিস আছেই, অনেকের আবার অকারণেই ভাতের থালা সামনে নিলে আমাদের কান্না আসে। অকারণেই ওভার থিংকিং এ আমাদের গলা দিয়ে ভাত নামেনা। সমস্যা ছোট্ট, আমরা টেনে হিচরে বড়ো করে জীবনের আনন্দ টা নষ্ট করে ফেলছে সব। সবার জীবনে আলেসেমি শব্দটা কাঠালের আঠার মতো জাপ্টে ধরেছে। ডিপ্রেশন ছাড়া মানুষ পাওয়া দুষ্কর। আমি তো পারিনি এসব ভালো না লাগা, এতো ডিপ্রেশন ফিল করতে! আমি নিজের আনন্দ ঠিক রাখার পাশাপাশি আমার প্রিয় মানুষদের হাসানোর চেষ্টা করি, সিরিয়াস মোমেন্টে ফানি কথা বলে ফেলি যেনো অপর মানুষ টা ওভার থিংকিং এ তার সুন্দর আলোচনা টা নষ্ট না করে! এগুলো কি আমার ন্যাকামি রাই?”

“কি হয়েছে একটু ক্লিয়ার করবি? আমার চিন্তা হচ্ছে। ”

রাইমা শার্লিনের কথাগুলো শুনে অস্থির চিত্তে প্রশ্ন করে। শার্লিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here