#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২৮
সন্ধ্যে শেষে রাত নেমেছে ধরণীর বুকে।জায়গাটা শহর হতে বেশ খানিকটা দূরে হওয়ায় যানজট ও কোলাহলমুক্ত।জানালা হতে ঠান্ডা হাওয়া প্রবেশ করে পুরো কক্ষটাকে শীতল করে রেখেছে।হৃদয় জুড়ে শান্তি ছেয়ে আছে নাফিয়ার।সবে মাত্র আফিমের কক্ষ হতে তার পাশের এই কক্ষে প্রবেশ করেছে মেয়েটা।দক্ষিণা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে তার।বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে কক্ষে থাকা আলমারির দিকে এগিয়ে যায় নাফিয়া।উদ্দেশ্য গোসল সেরে নেওয়া।আলমারি খুলতেই চোখ ছানাবড়া তার।আলমারিতে বেশ কয়েকটা শাড়ি ভাজ করে রাখা। সেই সাথে রাখা আছে বেশ কয়েক সেট সেলোয়ার-কামিজ।কিন্তু সেসবের দিকে চোখ গেলো না নাফিয়ার।তার চোখ তো শাড়িতেই আঁটকে আছে।সবগুলো শাড়ির মাঝে পিয়াজ রঙের একখানা শাড়ি ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করছে নাফিয়াকে।দেরি না করে সে শাড়িটা বের করলো আলমারি হতে।শাড়ির সাথে ব্লাউজ, পেটিকোট সব একসাথে রাখা।শাড়ির ভাজ খুলে তাতে চোখ বুলিয়ে নেয় নাফিয়া।অসম্ভব সুন্দর এ শাড়িটা গায়ে জড়ানোর লোভ সামলাতে ব্যর্থ হয় সে।শাড়িটা পড়বে বলে মনস্থির করবার পর পরই চোখমুখে চিন্তের ছাপ পরে তার।চিন্তে এ নিয়ে যে ব্লাউজ টা কি আদৌও ফিট হবে তার!এ চিন্তে মাথায় আসতেই ব্লাউজের ভাজ খোলে নাফিয়া।আরেক দফা অবাক হয় সে।ব্লাউজ খানা যেনো তার জন্যেই বানিয়ে রাখা হয়েছিলো।চোখমুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে নাফিয়ার।তবে কি আফিম তার জন্যেই এতো এতো শপিং করে রেখে দিয়েছে!কিন্তু কেনো?কি প্রয়োজন ছিলো?আর যদি এসব তারই হয় তাহলে আফিম এখনো তাকে দেয়নি কেনো?
!!
অনেকটা সময় পাড় হয়ে গিয়েছে।অপেক্ষার প্রহর গুনছে আফিম।নিজের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গিনীর অপেক্ষায় অপেক্ষেয়মান সে।কিন্তু অপেক্ষা দীর্ঘ হওয়ায় এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো তার।খারাপ মেজাজ নিয়ে ত্যাগ করলো নিজ কক্ষ।অনুমতি নিতে মনে নেই নাকি অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না তা ঠিক বুঝা গেলো না।বিনা অনুমতিতে কক্ষে প্রবেশ করলো সে।নত দৃষ্টি উপরে তুলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই যেনো বাকশক্তি হারালো এ যুবক।অবাক নয়নে নিজের সামনে দাঁড়ানো রমনীকে দেখে নিয়ে ঠোঁট চেপে নিজের আগত হাসি থামাবার প্রয়াসে ব্যস্ত হলো ছেলেটা।
হটাৎ নিজের কক্ষে আফিমের উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে গিয়েছিলো নাফিয়া।কিন্তু তাকে দেখে আফিমের ঠোঁট চেপে হাসা দেখে ক্রোধের উৎপত্তি ঘটলো কিশোরীর মনে।রাগে চেচিয়ে উঠলো,
“আফিমমমমম”
নাফিয়ার উচ্চ স্বরে উচ্চারিত নিজের নাম খানা শুনে হাসি থামাবার চেষ্টা করে আফিম।তবে সফলভাবে ব্যর্থ হয় সে।
আফিমের হাসিতে ক্রোধ বাড়লো নাফিয়ার।গাল ফুলিয়ে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো সে।মনস্থির করে নিলো,তাকাবেই না সে এই পঁচা লোকটার দিকে।যদিও শাড়ি পড়ার নাম করে শাড়িটাকে শুধু গোল করে নিজের শরীরে পেঁচিয়ে নিয়েছে সে,কুঁচি ছোট-বড় কোনো ঠিকঠিকানা নেই,দেখতে একটা খাম্বার মতো লাগছে তাকে তবুও হাসবে কেন আফিম?তাকে হাসার অধিকার কে দিয়েছে?
এসব ভেবে রাগ বাড়ছে নাফিয়ার।গাল বেলুনের মতো ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়েছে তো তাকিয়েছে আর ফেরানোর নাম নিচ্ছে না।
নাফিয়ার রাগ হওয়া দেখে হাসি থামায় আফিম।কিছু না বলে এগিয়ে যায় নিজের প্রেয়সীর ধারে।
হটাৎ পেটে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে ওঠে নাফিয়া।চমকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখতে পায় আফিম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।ছেলেটার হাত বাম পাশ হতে ক্রমশ তার নাভীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে মেয়েটার হৃদয়ে যা তীব্র বেগে ছড়িয়ে পরছে তার সমস্ত শরীরজুড়ে।ধীরে ধীরে আফিমের হাত নাফিয়ার নাভী স্পর্শ করে চলে যায় তার একটু নিচে গুঁজে রাখা কুঁচিতে।একটানে কুঁচি খুলে ফেলে আফিম।চমকে উঠে নাফিয়া।শক্ত করে নিজের আঁচল গায়ের সাথে আঁকড়ে ধরে সে।আফিম কি করতে চাইছে তা বোধগম্য হচ্ছে না তার।
নাফিয়াকে ভয় পেতে দেখে বাঁকা হাসে আফিম।হাঁটু ভাজ করে বসে নাফিয়ার সামনে।এবার একদম দৃষ্টির সামনে বরাবর নাফিয়ার উন্মুক্ত পেট।মৃদু ঢোক গেলে আফিম।দৃষ্টি নামিয়ে নেয় কুঁচিতে।সযত্নে শাড়ির কুঁচি করে তাকায় সে নাফিয়ার চোখ পানে।মেয়েটার চোখে মুগ্ধতা ও লজ্জা উভয়ের উপস্থিতি দেখতে পায় সে।দৃষ্টি সরায় আফিম।অধিকার নিয়ে নিজ হাতে গুঁজে দেয় কুঁচিগুলো।পেটে আবারও আফিমের হাতের স্পর্শ লাগায় শিহরণে কেঁপে ওঠে নাফিয়া।বুঁজে নেয় নিজের চোখজোড়া।নাফিয়ার মৃদু কম্পনে লোভ বাড়ে আফিমের।ঠোঁট ছোঁয়ায় পেটের মাঝ বরাবর।পেটে আফিমের ঠোঁটের স্পর্শ শিহরণ বাড়ায় নাফিয়ার।হাত মুঠোবন্দী করে নেয় সে।একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে উঠে দাঁড়ায় আফিম।আঁচল আরেকটু ঠিক করে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে নেশালো চাহনিতে তাকায় নাফিয়ার দিকে।মেয়েটা যেনো আস্তো একটা চুম্বক যা ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে আফিমকে নিজের দিকে।আর এই আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য যেনো নেই আফিমের।তাইতো অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এতোটা কাছে চলে আসে মেয়েটার।
ধীরে ধীরে নিজের ও নাফিয়ার মাঝের দুরত্ব কমায় আফিম।আলতো হাতে স্পর্শ করে মেয়েটার গাল।আফিমের চোখ পানে দৃষ্টি স্থির নাফিয়ার।মাদকতায় ভরা চোখ দুটো হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে চলছে মেয়েটার।আফিমের হাত গাল হতে ধীরে ধীরে নিচে নামতে আরম্ভ করে।এবার চোখ বুঁজে নেয় নাফিয়া।আফিমের হাত নাফিয়ার চিবুক অব্দি আসতেই হটাৎ কারো উচ্চ কন্ঠস্বর কানে আসে উভয়ের।ঘোর কাটে তৎক্ষনাৎ।
!!
গম্ভীর পরিবেশ!
কক্ষে শুধু আফিম ও রিয়াদ।আফিমের সামনে দৃষ্টি অবনত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ।ভাবছে কিভাবে কথা শুরু করবে।এদিকে রিয়াদকে একবার দেখে নিলো আফিম।নিজের কক্ষে পাতানো সোফা টায় আরাম করে বসে স্বাভাবিক ও বেপরোয়া কন্ঠে সে বলে উঠলো,
-আমি তোমার উদ্দেশ্য জানি রিয়াদ।আর তুমিও জানো যে তোমার উদ্দেশ্য সফল হবে না।
-উম,সম্ভাবনা আছে স্যার।মানে ৯৯% চান্স আছে উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার।আর ১% চান্স আছে সফল হওয়ার।আপনি তো জানেন স্যার যেখানে ১% চান্সও থাকে সেখানে আমি হাল ছাড়ি না।
-তুমি আমার জিদ সম্বন্ধে জানো।
-আপনার বিবেক বুদ্ধি সম্বন্ধেও জানি।
-মানে?
-স্যার,আপনি আরহান স্যারের উপর রেগে আছেন ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক।আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও একই কাজ করতো।কিন্তু আপনি তো আলাদা তাই না স্যার?অন্যরা অকৃতজ্ঞ হলেও আপনি তো তা নন।আরহান স্যার হয়তো ইমোশনের দিক থেকে বাবা হওয়ার যোগ্য নন কিন্তু তিনি আপনার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করেছেন।আজ আপনি এতোটা সফল।স্যার ভাবুন,আরহান স্যার আর্থিকভাবে সাহায্য না করলে আপনি আজ এখানে পৌঁছাতে পারতেন?
রিয়াদের কথায় ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে আফিমের।হাসি খানা ঠোঁটে ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-সবাই টাকা টাই কেন চেনে রিয়াদ?
-কারণ স্যার,বেঁচে থাকার জন্য টাকা টাই লাগে।
-ভালোবাসা লাগে না?
-ভালোবাসা লাগে ভালো থাকার জন্য,বেঁচে থাকার জন্য না।
রিয়াদের কথায় বাকরুদ্ধ হয় আফিম।নিরবে ভাবে কথাখানা নিয়ে।আসলেই টাকা মানুষের মৌলিক ৫ টা চাহিদাই পূরণ করতে সক্ষম।অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা।সবগুলোর জন্যেই টাকা প্রয়োজন।আর সব থেকে মূল্যবান সম্পদ টাও টাকার উপর নির্ভরশীল।আর এ মূল্যবান সম্পদ টা হচ্ছে “সম্মান”। সমাজের মানুষ টাকার অংকের উপর ভিত্তি করেই একে-অপরকে সম্মান প্রদর্শন করে।যদিও এটা নিন্ম মানসিকতারই পরিচয় বহন করে তবুও বাস্তব সমাজের এক জঘন্যতম সত্য এটিই।আর মানুষের যত শখ আছে তা পূরণ করতেও টাকার প্রয়োজন বর্ণনাতীত।
তাহলে কি টাকাই সব?অনুভূতির মূল্য নেই?
এ প্রশ্ন মনে জাগতেই চোখ বুজে নেয় আফিম।চোখের সামনে ভেসে উঠে নাফিয়ার সাথে কাটানো সকল স্মৃতিগুলো।চোখের সামনে ভেসে উঠে সে স্মৃতি যখন নাফিয়া যত্নে করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিলো তাকে,মাথাব্যথা হওয়ায় টানা দু’ঘন্টা মাথা মালিশ করে দিয়েছিলো,নিজের কোলে তাকে ঘুম পারিয়ে দিয়েছিলো,কষ্ট প্রশমিত করতে জড়িয়ে ধরেছিলো চুমু এঁকে দিয়েছিলো দু’চোখে।মনে পরে তার কষ্টে কষ্ট পেয়ে অশ্রু জমেছিলো মেয়েটার চোখে।মনে এও পরে যে এই মেয়েটার জন্যেই ক’বছর পর মন খুলে হাসতে শিখেছে আফিম।সব স্মৃতি মনে করে আফিম অনুভব করে ভালোবাসাই তার মনকে মৃত থেকে সজীব করে তুলেছে।সে উপলব্ধি করে,মানুষের মন বাঁচে ভালোবাসায়।
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২৯
“আরহান স্যার দেশের মাটিতে পা রাখার পর মুহূর্ত হতে আপনাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন স্যার।”
আফিমের চোখে চোখ রেখে নিম্ন স্বরে কথাখানা বলে রিয়াদ।রিয়াদের কথাখানা কানে আসতেই তৎক্ষনাৎ আফিম বলে ওঠে,
-তুমি ঐ লোকটার ওকালতি করছো রিয়াদ?সব জানবার পরও?
আফিমের প্রশ্নে কিছুটা দমে যায় রিয়াদ।তার মন জানে আরহান সাহেবের ভুল ছিলো কিন্তু তার বিবেক এও জানে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাগ্য কতটা নিষ্ঠুর হয়,পরিস্থিতি একটা মানুষকে কতটা বাধ্য করে, বাস্তবতা কতটা নির্দয় হয়!সে অনুভব করতে পারে আরহান সাহেবের অপারগতা যা আফিম পারছে না।কারণ ছেলেটা নিজের জীবনের সব থেকে কঠিন সময় টা একা পাড় করেছে।সে আপন কেউকে নিজের পাশে পায়নি।সে নিজে নিজের চোখের পানি মুছতে বাধ্য হয়েছিল, বাধ্য হয়েছিলো নিজে নিজের কাঁধে হাত রেখে নিজের মাঝে সাহস জোগাতে।এই মানুষটার কষ্ট, অভিযোগ, অভিমানের আড়ালে দৃষ্টির অগোচরে পড়ে আছে তার পিতার অপারগতা বা বাধ্যবাধকতা।রিয়াদ চাইছে আফিমের সামনে তার পিতার দিকটি উপস্থাপন করতে কিন্তু সদাসর্বদার ন্যায় আফিম শুনতে নারাজ।
-স্যার আমি জানি আমি এখন আপনাকে যাই ই বলি আপনি শুনবেন না, বুঝার চেষ্টাও করবেন না।কিন্তু আপনি শুধু এতোটুকু ভাবেন আরহান স্যার আপনার জন্য কি কি করেছে!আন্টির মৃত্যুর পর আপনি যখন একদম কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন,সারাক্ষণ অন্য মনস্ক হয়ে থাকতেন,অস্বাভাবিক আচরণ করতে আরম্ভ করেছিলেন তখন এই মানুষটাই আপনাকে স্বাভাবিক করতে আমাকে আপনার জীবনে এনে দিয়েছিলেন।স্যার, বিদেশে থেকেও তিনি বুঝেছিলেন তার সন্তানের একজন বন্ধু দরকার, একজন এমন কেউকে দরকার যার সাথে অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া যায়।
রিয়াদের কথাগুলো নিরবে শুনছে আফিম।চোখের সামনে ভেসে উঠতে আরম্ভ করেছে তার নিজ অতীত।
আফিমকে চুপ থাকতে দেখে রিয়াদ আবারও বলে ওঠে,
-আরহান স্যার আপনাকে সব অভাব থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন,ভালো খাওয়ানো-পড়ানো থেকে শুরু করে সব কিছুতে আপনাকে সেরা টা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন।জানি সময় দেননি, সপ্তাহে একদিন সময় করে আপনাকে কল দেয়নি,খবর নেয়নি আপনার মনের,আপনাকে কখনো জিজ্ঞেস করেনি আপনার চাচার বাসায় আপনি কেমন আছেন,কখনো জিজ্ঞেস করেনি আপনি কি চান,কখনো আপনার মনের খবর জানতে চায়নি।এগুলো ভুল ছিলো আরহান স্যারের কিন্তু তিনি আপনাকে ভালোবাসেন,স্যার।না বাসলে দূর থেকে যে আপনার প্রয়োজন মিটিয়ে গিয়েছেন তা হয়তো তিনি করতেন না।
রিয়াদের কথাগুলো শুনে নিয়ে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নেয় আফিম।কপালে দু’আঙুল দ্বারা মালিশ করতে করতে নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-কাল ফিরবো বাসায়।আজ রাতটা ম্যানেজ করো।
আফিমের কথাগুলো কানে আসতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে রিয়াদের।অবশেষে সে সফল হয়েছে আফিমকে বুঝাতে।কিন্তু পর মুহুর্তেই কপালে চিন্তের ছাপ পরে তার।চিন্তের কারণ দু’টি।প্রথম কারণ, আজ রাত আফিম যে বাসায় ফিরবে না তার কি অজুহাত দেখাবে সে আরহার সাহেবকে?
দ্বিতীয় কারণ,নাফিয়াকে কি বলে পরিচয় দিবে?আরহান সাহেবও বা ব্যাপার টা কিভাবে গ্রহণ করবে?
কিছুটা সময় নিরব থেকে এ দু’টি বিষয় নিয়ে কিছুটা ভেবে রিয়াদ বলে ওঠে,
-স্যার, ভাবী কি কিছুদিন এখানেই থাকবেন তাহলে?মানে আরহান স্যার তো বিয়ের বিষয় টা জানেন না আর তাকে হুট করে এভাবে জানালে যদি তিনি উত্তেজিত হয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান আর তা কোনোভাবে আপনার শত্রু পক্ষ অব্দি পৌঁছায় তাহলে ব্যাপার খানা কোথায় গিয়ে ঠেকবে বুঝতে পারছেন স্যার?
রিয়াদের দিকে না তাকিয়েই আফিম শান্ত কন্ঠে কাটকাট গলায় বলে ওঠে,
-আমি যেখানে থাকবো আমার স্ত্রী সেখানেই থাকবে।প্রতিটা মুহূর্ত আমার সাথে থাকবে,অন্তত আমার মৃত্যুর আগ অব্দি।লেট মি ক্লিয়ার ওয়ান থিংক দ্যাট ওর ব্যাপারে আমি পৃথিবীর কারো পরোয়া করি না আর না ওর ব্যাপারে আমি এক বিন্দু পরিমাণও ছাড় দিতে রাজি।
দৃষ্টি মেঝেতে আবদ্ধ করে নেয় রিয়াদ।ভাবতে আরম্ভ করে সামনে পরিস্থিতি কি মোড় নিতে পারে!একটু ভেবে জিহ্বা দ্বারা নিজের ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিয়ে সে বলে ওঠে,
-স্যার, ভাবীর বয়স আঠারো হয়নি।আপনাদের বিয়ের ব্যাপার জানাজানি হলে আপনার রেপুটেশন নষ্ট হবে।মানুষ তো জানবে না কোন পরিস্থিতিতে পরে বিয়েটা করতে হয়েছে।আর মানুষের আলোচনা, সমালোচনা উপেক্ষা করলেও অনেক যুবক আছে যারা আপনাকে পছন্দ করে,আপনাকে ফলো করে।তাদের উপর একটা বাজে প্রভাব পড়বে।তারা দেখা যাবে বাল্যবিবাহকে জাস্টিফাই করবে।তাদের মনে হতে পারে যে যেখানে আফিম স্যার বাল্যবিবাহর মতো কাজ করেছেন সেখানে হয়তো এটা দোষের কিছু না।এমনটা হলে তো স্যার তারা ভুল পথে যাবে।একজন সফল মানুষ শুধু নিজের কথা ভেবে,নিজের মনমতো জীবন পরিচালনা করতে পারে না।তাকে নিজের ফলোয়ারদের কথা ভাবতে হয়,সমাজের কথা ভাবতে হয়।তার এটা মাথায় রাখতে হয় যে তার কাছ থেকে তার ফলোয়াররা কি পাচ্ছে বা শিখছে!স্যার প্লিজ থিংক এবাউট দিস?
রিয়াদের কথাগুলো শুনে ঠোঁটে আলতো হাসি টানে আফিম।স্বাভাবিক কন্ঠে বলে ওঠে,
-Am so proud of you.
কথাখানা বলে একটু থামে আফিম।সোফা হতে উঠে দাঁড়িয়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায় সে।অন্ধকারে মোড়ানো প্রকৃতিতে নিজের দৃষ্টি আবদ্ধ করে বলে ওঠে,
-আফিম ইবনান কাঁচা খেলোয়াড় না রিয়াদ।যা তুমি এখন ভাবছো তা আমি অনেক আগেই ভেবে রেখে দিয়েছি আর প্রতিকূল পরিস্থিতি কিভাবে সামলে নিতে হয় তা জানি আমি।মিঃ আরহান ইবনানের মতো পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে নিজের দায়িত্ব হতে সরে দাঁড়ানোর মতো কাপুরষ আফিম ইবনান নাহ।সে জানে তার স্ত্রী, তার প্রফেশন আর তার রেপুটেশন একসাথে কিভাবে সামলাতে হয়।
আফিমের কথাগুলো কানে আসতেই ঠোঁটে বড়সড় হাসি ফুটে ওঠে রিয়াদের।এবার নিজেকে ভীষণ হালকা মনে হচ্ছে তার।মনে হচ্ছে তার কাঁধ হতে অনেক বড় এক বোঝা নেমে গিয়েছে।এক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে রিয়াদ বলে ওঠে,
-তাহলে স্যার আপনি কাল সকালে ডিরেক্ট বাসায় যাচ্ছেন?
-হু।
ঠোঁটের হাসিটা বজায়ে রেখেই রিয়াদ আবারও বলে ওঠে,
-তাহলে স্যার,আমি আসি।আই হোপ আমার ডিউটি শেষ।
রিয়াদের কথায় তার দিকে তাকায় আফিম।জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-Are you done with your dinner?
আফিমের প্রশ্নে আলতো হাসে রিয়াদ।এই মানুষ টাকে এজন্যই ও এতোটা ভালোবাসে!আফিমের স্বভাব কখনো ভালোবাসি বলবে না কিন্তু কথার ফাঁকে বা কাজের ফাঁকে তার এই ছোট্ট ছোট্ট যত্নগুলোই সাক্ষ্য দেয় তার ভালোবাসার।
ঠোঁটে হাসি নিয়েই রিয়াদ বলে ওঠে,
-নো স্যার বাট বাসায় গিয়েই খেয়ে নিবো।
!!
আফিমের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে নাফিয়া।অদ্ভুত এক অস্থিরতা অনুভব করছে সে নিজের মাঝে।মন-মস্তিষ্ক জুড়ে আফিমের চিন্তে ছেয়ে আছে।প্রশ্ন জাগছে, “কি কথা বলছে রিয়াদ ও আফিম?কোনো সমস্যা হয়নি তো?সব ঠিকঠাক আছে তো?দু’জনের কথা বলতে এতো সময় লাগছে কেন?কোনো ঝামেলা বাঁধেনি তো?”
এমন হাজারো প্রশ্ন উদিত হচ্ছে নাফিয়ার মনে যা সময়ের সাথে সাথে তার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়িয়ে চলছে।
অস্থির মনে অনেকটা সময় অপেক্ষা করবার পর হুট করে কক্ষের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পায় নাফিয়া।এতোটুকু বুঝতে সক্ষম হয় যে আর যেই হোক আফিম আসেনি।কারণ এই ছেলে কক্ষে প্রবেশের আগে অনুমতি নেয় না।
আফিম নয় তো কে এসেছে? মনে প্রশ্নটি নিয়েই দরজার ধারে এগিয়ে যায় নাফিয়া।দরজা খুলতেই দেখা পায় এক গৃহপরিচারিকার।ঠোঁটে মিষ্টি হাসি নিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে,
-ম্যাম আফিম স্যার ডাকেছে আপনাকে তার রুমে।
মেয়েটির কথায় ঠোঁটে হাসি ফুটলো নাফিয়ার।সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে তৎক্ষনাৎ নিজ কক্ষ ত্যাগ করে এগিয়ে গেলো আফিমের কক্ষের দিকে।
ছেলেটির কক্ষে প্রবেশ করতেই নাফিয়া দেখতে পায় আফিম সোফায় বসে দু’হাতে নিজের কপাল চেপে ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে।আফিমকে এ অবস্থায় দেখতেই নাফিয়ার মুখশ্রী হতে ঠোঁটের হাসিটি নিজের অস্তিত্ব হারালো।মেয়েটা এগিয়ে গেলো আফিমের ধারে।মুখে চিন্তের ছাপ ফেলে আলতো হাতে স্পর্শ করলো আফিমের বাহু।নাফিয়ার স্পর্শ অনুভব করতেই আর দেরি করলো না আফিম।মাথা রাখলো নাফিয়ার কোলে।মেয়েটার ডান হাত টেনে নিজের বক্ষের মাঝ বরাবর রাখলো। বলে উঠলো,
-Can you feel anything Miss. Sheikh? [তুমি কি কিছু অনুভব করতে পারছো মিস. শেখ?]
-হু,এক অশান্ত হৃদয়ের তীব্র বেগে কম্পিত হওয়া ধুকপুকানি অনুভব করতে পারছি।দুঃখে নিমজ্জিত এক জোড়া চোখে সিদ্ধান্তহীনতা,দ্বিধা,সংকোচ দেখতে পারছি।কি হয়েছে আফিম?কিসে কষ্ট পাচ্ছেন?
নাফিয়ার উত্তর শোনে আফিম।প্রশ্ন দু’টো কর্ণকুহর অব্দি এসে পৌঁছিয়েছে তার।তবে উত্তর নেই।চাপা স্বভাবের মানুষগুলোর এই এক সমস্যা।এদের বুক ফাটবে তবু মুখ খুলবে না।ছেলেটা চাপা স্বভাবের হওয়ায় না চেয়েও নিজের কষ্টগুলো,অনুভূতিগুলো প্রকাশে সদাসর্বদাই সফলভাবে ব্যর্থ হয়।এবারও ব্যর্থ হলো।নিরবতা বজায়ে রেখেই চোখ বুঁজে নিয়ে মেয়েটার ডান হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেলো সে।বলে উঠলো,
-মাথা ব্যথা করছে মিস. শেখ।
উত্তরে কিছু বলে না নাফিয়া।নিজের হাত দ্বারা আফিমের কপাল মালিশের পাশাপাশি চুলে হাত বুলিয়ে দিতে আরম্ভ করে সে।
নাফিয়ার হাতের স্পর্শে আরাম অনুভব করছে আফিম,ব্যথা প্রশমিত হচ্ছে ক্রমশ।সেই সাথে চোখ বুঁজে রাখায় অতীতের স্মৃতিরা একে একে ভেসে উঠতে আরম্ভ করলো আফিমের চোখের সামনে।
!!
আরহান সাহেবকে এই-সেই কাজের কথা বলে কোনো এক ভাবে বুঝিয়ে-পড়িয়ে নিজের বাড়ি ফিরেছে রিয়াদ।সবে মাত্র গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে নিজের ফোন খানা হাতে নিয়েছে সে।স্ক্রিন অন করতেই সে দেখতে পায় ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্টের নোটিফিকেশন এসেছে একটি।নোটিফিকেশনে ক্লিক করতেই একটি আইডি সামনে এলো রিয়াদের।আইডির নাম, “কৃষ্ণচূড়া”।বায়োতে লেখা,
“কৃষ্ণবর্ণা,কৃষ্ণ রঙেই নিজেকে ভালোবাসি।ফর্সা হওয়ার ক্রিমের পেছনে দৌড়ানো মর্ডান মেয়েদের কাতারে আমি নেই।”
এরপরে রিয়াদের চোখ যায় প্রোফাইল পিকে যেখানে আলতা মাখা এক কালো বর্ণের হাতের মুঠোয় এক গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া ফুল।ক্যাপশনে লেখা,
“সাহিত্যে শ্যামবর্ণাদের গুনগান করা হয়েছে সব থেকে বেশি।কবি-সাহিত্যিকেরা শ্যামবতীদের “মায়া” উপাধি প্রদান করেছেন।শ্যামবতীদের রূপের বর্ণনা দিয়েছেন কতশত বার।আর শ্বেতবর্ণের মানুষেরা তো এককথায় সবার চোখে রূপবতী।তবে কি অবহেলিত শুধু এই কৃষ্ণকলি?”
ক্যাপশন খানা পরে ছবিটির দিকে আরেকবার তাকায় রিয়াদ।আলতা রাঙা কৃষ্ণ রঙের হাতজোড়া দারুণ লাগছে দেখতে।যদিও চেহারা দেখা যাচ্ছে না ছবিতে তবুও এক মুগ্ধতা আছে ছবি খানায়।আর ভাবে না রিয়াদ।অপরিচিত কেউকে আইডিতে জায়গা না দিলেও এই প্রথম অপরিচিত কেউকে এড করতে ইচ্ছে হলো তার।ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট টা এক্সেপ্ট করে ফোন খানা রেখে দেয় সে টেবিলের উপর।মনোযোগী হয় নিজের কাজে।
চলবে।