#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫২
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
বাইরে রোদ উঠেছে। বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙেছে সেই কাক ডাকা ভোরে। নামাজ কালাম শেষে সবাই কাজে লেগে পড়েছিল । আজকে সুজানার বাপের বাড়ির সবাই আসবে। বাড়িতে মেহমান নেহাত কম নয়।
সকাল সকাল বাড়ি পরিষ্কারের লোকজনও চলে এসেছে। গত দুদিনে বাড়িটা ফুলের পাঁপড়ি আর ধুলোবালিতে যা অবস্থা হয়ে গিয়েছে।
নতুন বউ ঘুম থেকে উঠেছে কিনা তা দেখার জন্য আনিকা বাচ্চা দুটোকে বলেছে ডেকে দিতে। তাদের বলতে দেরী ওই ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে তাদের দেরী নেই।
দুজনেই সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাধাক্কি করতে করতে ডাকলো
সুজান দজজা খুলো। অভি দজজা খুলো। তাতারি খুলো।
তাদের ডাকাডাকির চোটে অভিকের চোখ ছুটে গেল। চোখ ঢলে হাত ঝেড়ে দুচোখ খুলতেই ব্যালকণির ওপাশের মিষ্টি রোদের উপস্থিতি টের পেল সে। দুজনেই ফজরের নামাজ শেষ করে শুয়েছে। তারমধ্যে বেলা গড়িয়ে গেছে। সে ঘড়ি দেখলো। সোয়া আটটা বাজে।
দরজা অনবরত ধাক্কাধাক্কি চলছে।
অভিক উঠে বসবে তখনি টের পেল তার বুকের কাছের শার্ট হাতের মুঠোয় নিয়ে সেখানটায় মুখ গুঁজে চুপচাপ ঘুমোচ্ছে সুজানা।
সে ঘুমন্ত নারীটিকে দেখে হাসলো। এই নারী আগে তার ঘুমের রাজ্যে থাকতো আর আজ বুকের সাথে লেগে ঘুমিয়ে আছে। সে মৃদু হেসে সুজানার হাত থেকে শার্ট ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। দেখলো এভাবে সম্ভব না। এমনি ধরতে চায় না, আর ধরলে ছাড়তে চায় না।
ওদিকে বাচ্চাদের চেঁচামেচিতে অবস্থা তখন তুঙ্গে। এখন দরজা না খুললে পুরো বাড়ির লোকজন জড়ো করতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না।
অনেক্ষণ পর সুজানার নড়েচড়ে উঠলো। অভিক ডাকলো
সু-জা-না।
সুজানা হু শব্দ করলো।
অভিক হেসে বলল
আপনার স্টুডেন্টরা যা তা শুরু করে দিয়েছে। পাজি দুটোকে ঘরে আনি।
হুমম।
অভিক তাকে ব্যঙ্গ করে বলল
হুমম।
ওদিকে আবিদ চেঁচিয়ে বলল
অভি সুজানকে ঘরে বাঁধি রাখছো কেন? তাতাড়ি দজজা খুলো।
অভিক হেসে উঠলো।
কি আজব কথা! আমি সুজানকে বেঁধে রেখেছি? আমার ইজ্জৎ সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে সুজানা।
সুজানা বলল
হু।
অভিক উপায়ান্তর না দেখে নিজে পাশ ফিরে সুজানার উপর ঝুঁকে নাকে নাক মিলিয়ে বলল
ম্যাডাম।
সুজানা নড়েচড়ে উঠে নাক ঘষা দিয়ে হাত পা টানা দিয়ে বলল
উম ।
তারপর চোখ খোলার সাথে সাথে অভিককে এত কাছে দেখে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। অভিক শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে মিচকে হেসে বলল
আমি নির্দোষ।
সুজানার ঘুম ঘুম চোখে মুখে লাজুক ভাব। সে খামচে ধরা অভিকের শার্টের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল। অভিক সেখানটাই তাকিয়ে বলল
ওভাবে না ধরলেও কোথাও ছেড়ে যাব না।
সুজানা একটুখানি হেসে কথা ঘুরিয়ে নীচু স্বরে বলল
বাচ্চারা চেঁচামেচি করছে কেন?
অভিক বলল
মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
সুজানা মনোযোগ দিতেই শুনতে পেল দুজনের গলা।
অভি সুজানকে বাঁধি রাখছ কেন? দজজা খুলো।
সুজানা খিক করে হেসে উঠলো। অভিকও হাসলো।
পিঠের নীচে হাত গলিয়ে সুজানার বাম গালের সাথে তার ডান পাশটা মিলিয়ে কানে কানে বলল
আজ আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই চাই।
তারপর মুখ তুলে সুজানার উত্তরের অপেক্ষায় রইলো কপাল কুঁচকে। দু তিন ইঞ্চির দূরত্বে থাকা মায়াবী মুখটা তখনও কিছু ভাবনায় মত্ত।
ভাবা শেষ হতেই মিষ্টি হাসলো সুজানা । বলল
আজ দেব।
সত্যি?
তিনটা।
দুজনেই একসাথে হাসলো।
নরম গালে ছোট ছোট ধারালো দাঁড়িগুলো আরও একবার আঁচড় কাটলো সাথে ঠোঁটের বলিষ্ঠ দংশনে সুজানা শাড়ির আঁচলে মুখ লুকোলো।
অভি উঠে গিয়ে দরজা খুললো।
দরজা খুলতেই দেখলো অনা আবিদ কোমড়ে হাত রেখে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনা ঘরে ঢুকেই সুজানার কাছে ছুটলো। আবিদ শুরুতেই অভিকের পায়ে কামড় দেয়ার চেষ্টা করে বলল
সুজানকে বাধি রাখছো কেন?
অভিক হো হো শব্দে হেসে উঠে দৌড় দিল। চাচা ভাইপোর ছোটাছুটি দেখে কে।
অভিক সুজানার পাশে এসে বসে বললো
সুজানা দেখুন আপনার ছাত্র আমাকে কামড় দিতে চাচ্ছে।
আবিদ বিছানায় উঠে অভিকের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার আগেই সুজানা টেনে এনে কোলে বসালো। বলল
দুষ্টুমি হচ্ছে?
অনা বলল
সুজান সুজান চা খেতে আসো। দাদু ডাকে।
অভিক বলল
নতুন বউয়ের জন্য চা নিয়ে আসুন । যান।
সুজান যাবে।
না যাবে না। সুজান তো নতুন বউ। নতুন বউ ওখানে যায় না। যান।
যাবেনা কেন? সুজান আসো। অভি তুমিও আসো।
নো ওয়ে আম্মিজান। চলুন আমরা যাই। সুজানের জন্য চা নিয়ে আসি।
সুজানা বলল
আমি যাই। না গেলে খারাপ দেখাবে না?
এখন না। জিনিদের পাঠাচ্ছি। ওরা রেডি করে দিক।
সুজানা মাথা নাড়ালো। অভিক বেরিয়েই যাচ্ছিলো দুজনকে নিয়ে। সুজানা ডেকে বলল
আমার ফোনটা দেখি বন্ধ হয়ে আছে। আপনার ফোনটা দেবেন? আম্মাকে ফোন দেব।
বালিশের উপরেই আছে।
সুজানা ওদিকে তাকালো।
খুশিমনে বলল
আনলকড?
হুমম।
সব দেখে নেব আজ।
অভিক হেসে মাথা চুলকে বলল
আমি যে জনেতে আসক্ত সে ছাড়া আর কিচ্ছু নেই ওখানে।
সুজানা মিষ্টি হাসলো।
___
অভিক নীচে এসে দেখলো নাশতার টেবিল সাজানো। তাকে দেখে সবাই চোখ তুলে তাকালো। প্রশ্ন ছুটে এল
বউ উঠেছে?
অভিক মাথা দুলালো। বলল
এদের পাঠিয়েছ? আহ অবস্থা বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। কার মতো এত পাজি হয়েছে?
সবাই হাসলো। মামী বললেন
কিন্তু তুমি বউ ছাড়া এলে কেন? ও কি নাশতা পানি খাবে না। বউ খাবে বলেই তো এত আয়োজন।
জিনি নিয়ে এসো তো।
ফুপী বলে উঠলেন
আরেহ তুই গিয়ে নিয়ে আয়। বউ সাথে নিয়ে খেতে আসবি এটা শিখিয়ে দিতে হয়? আজব ছেলে হয়েছিস তুই।
তাহলে যেতেই হচ্ছে।
__________
সুজানা চুলে তিনবার চিরুনি চালালো। তখনি ফোনটা তুললো ওপাশে কেউ একজন। সাথে সাথেই মায়ের গলা ভেসে এল
ভালো আছিস আমার সোনা? ওদিকে সবকিছু ঠিক আছে? চা নাশতা খেয়েছিস? আমি তোর ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।
সুজানার গলা বুঁজে এল। মিনমিন সুরে জানতে চাইলো
তুমি ভালো আছ আম্মা?
ওপাশ থেকে তৎক্ষনাৎ উত্তর এল না। এল তার কিয়ৎক্ষণ পর।
আছি।
মায়ের গলা কেমন যেন শোনালো। সুজানা জানে এই সামান্য দূরত্বটাও কত দূরত্ব তাদের মা মেয়ের জন্য। তার এই অল্প সময়ের শূণ্যতায় মায়ের কতখানি পুড়ছে।
সে বুঁজে আসা গলায় জানতে চাইলো।
কবে আসবে আম্মা? তাড়াতাড়ি চলে এসো।
হ্যা আসব। জামাই কোথায়?
উনি নীচে। সবাইকে নিয়ে এসো কেমন।
আচ্ছা। কিছু খাসনি এখনো?
খাব এখন। মাত্রই উঠেছি। তুমি খেয়েছ?
হ্যা খেয়েছি। আচ্ছা রাখি এখন। অনেক কাজ পড়ে আছে।
আচ্ছা।
ফোনটা কেটে গেল টুট টুট শব্দে।
ফোনটা রেখে থম মেরে বসে রইলো সে। অভিক দরজা ঠেলে ঘরে পা রাখতেই সুজানাকে ওভাবে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখে ভড়কালো।
ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে হেয়ার ড্রায়ারটা খুঁজে নিয়ে সুজানার চুলে দিতেই চুল সব উড়ে মুখের উপর জটলা পাকালো। সে দাঁড়িয়ে পড়ে অভিকের দিকে ফিরলো। অভিক তাকে আয়নার দিকে ফিরিয়ে বলল
এখন দেখি আপনাকে সাজিয়েগুছিয়ে দেয়ার দায়িত্বও আমার।
সুজানা চুল শুকিয়ে আসতেই সে নিজের চুলে শুকোলো। সুজানা এলোমেলো চুলগুলো গুছাতে গুছাতে অভিকের কান্ড দেখে হাসলো।
অভিক ড্রায়ারটা রেখে তার চুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলল
এখন শুকিয়ে গেছে। পারফেক্ট। বেঁধে দেব?
সুজানা মাথা দুলালো। অভিক খোপা বাঁধার চেষ্টা করলো। হতাশ হয়ে বলল
আমার দ্বারা হবে না মনে হচ্ছে।
সুজানা আয়নায় তাকে দেখে হাসছে।
তখন মুখ গোমড়া করে বসেছিলেন! শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন নিশ্চয়ই।
সুজানার ঠোঁট থেকে হাসি সরলো। সামনে ফিরে বলল
হ্যা।
তাই বলে মুখ গোমড়া করতে হবে ম্যাডাম? আপনাকে মুখ গোমড়া করলে একদম মানায় না। একদম আমার বউয়ের মতো লাগে না।
সুজানা দুষ্টু গলায় বলল,
আচ্ছা! কার বউয়ের মতো লাগে?
অভিক প্রশ্নটা ভালো করে বুঝার চেষ্টা করলো। তারপর চোখ বড় বড় করে তাকাতেই সুজানা হেসে উঠে তার বুকে মাথা ঠেকালো। অভিক মাথাটা টেনে নিয়ে হেসে উঠে বলল
ওহ নো। শুধু এবং শুধুই আমার বউয়ের মতো লাগে।
________________
সুজানা নীচে যেতেই সবাই তার দিকে তাকালো। সে হালকা সেজেছে। সাজগোছ করে খাওয়াদাওয়া করতে আগ্রহ লাগেনা তার। সালমা বেগম, আনজুমা বেগম এসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। দাদু ফিসফিস করে জানতে চাইলো
কি দিল?
সুজানা লজ্জিত হেসে মাথা নামিয়ে নিল।
এমা কিছুই দেয়নি? কত করে বললাম তাকে। দাঁড়াও একা পাই তাকে।
সুজানা নীচু গলায় বলল,
উনি দিতে চেয়েছিলেন আমি বারণ করেছি।
বারণ করেছ কেন?
আর কত উপহার নেব আমি? বেশি পেলে আবার হারিয়ে ফেলার ভয় হয়।
দাদু হাসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
আরেহ ওসব বর বউকে ভালোবেসে আদর করে দেয় ওই রাতে। আমার ভাইটা একদম বেকুব। যাইহোক আমার মিষ্টি নাতবৌ, মুখটা দেখলেই শান্তি লাগে আমার। চলো খেতে বসি।
সুজানা উনাকে ধরলো। বলল
আমি নিয়ে যাই আপনাকে।
সবাই একে একে চেয়ারে বসলো। জিনিয়া বলল
নতুন ভাবি ভাইয়াকে বলবেন আমাদের টাকা নিয়ে দিয়ে দিতে। কালকে ভয়ের চোটে আমরা চুপ ছিলাম। ওইতো এসেছে। বলেন।
সবাই অভিকের দিকে তাকালো। অভিক এসে চেয়ার টেনে বসলো।
কিসের টাকা? এত টাকা নিয়ে নেশা করবে নাকি?
জিনিয়া বলল
মামী দেখেছ?
সালমা বেগম বললেন
এসব কেমন কথা অভি? টাকা চায়ছে দিয়ে দিবি। ওরা পাঁচ ছয়জন। সবাইকে হিসেব করে টাকা দিয়ে দিবি। তোর বিয়েতে অনেক কাজ করেছে ওরা।
তরী সুজানাকে বলল
আপু তুমি তো কিছু বলো।
সুজানা কি বলবে বুঝে পেল না। অভিক আহনাফকে বলল
ভাই সবার জন্য ওই বুড়ো মতিন সাহেবকে ধরে আনলে হয় না? এদের শক্তি আছে। আছাড় মারলেই টাকা ঝড়বে।
আহনাফ বলল
একদম।
সিজানও সমর্থন জানালো।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
জিনিয়া বলল
ছিঃ ছিঃ ওই বুড়ো মতিনের কথা বলছ?
হ্যা। সমস্যা কি? প্রচুর টাকা আছে। একসাথে সবাইকে পেলে খুশি হয়ে যাবে ও। ও বউ পাচ্ছে আর তোমরা টাকার গাছ। ভালো না?
সবাই আরেকদফা হেসে উঠলো।
দাদু বললেন
তোমরা রাগ করোনা তো বোন। আমার ভাই মজা করছে।
ওরা সবাই রেগেমেগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। সুজানা অভিকের কথা শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। ইশশ প্রথম দিন কত বেকুব না ভেবেছিল সে এই লোকটাকে।
অভিকও তাকাতেই সুজানা লজ্জা পেল। অভিক ভুরু নাচাতেই সুজানা দু’পাশে মাথা দুলালো।
কিছু না।
আজীম সাহেব বললেন
কি আজব ব্যাপার। সবাই মজা করছে। আর নতুন বউ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এত আয়োজন তার জন্যই তো নাকি?
আনিকা তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে অভিকের পাশে বসিয়ে দিল। বলল
নতুন বউ ঠিক আছে। এই বাড়িতে তো নতুন না। এত লজ্জা পান কেন বুঝিনা।
আজাদ সাহেব বললেন
তোরা কথা বলছিস। আর ও একা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ভাবা উচিত নতুন মানুষ আছে আমাদের সাথে। এখন পুরো মনোযোগ তার উপর হওয়া উচিত না।
আনজুমা বেগম সুজানার প্লেটে নাশতা তুলে দিতে দিতে বললেন
ও কিছু মনে করবে না। ও চেনে জানে বুঝে এই বাড়ির সবাইকে। তাই না বৌমা?
সুজানা মাথা দুলালো। সে এই বাড়ির মেলবন্ধনগুলো দূরে দাঁড়িয়ে দেখতো তখন। এখন কাছে বসে দেখছে । এখন সেও তাদের একজন। এই মানুষগুলোর আপন হতে না পারলে অনেক বড় একটা অপূর্ণতা থেকে যেত তার জীবনে। আর পাশে বসা মানুষটাকে পেত না কথাটা ভাবতেও এখন দম বন্ধ বন্ধ লাগে। সব শান্তি যেন তার কাছে। সে আশেপাশে থাকলেই আনন্দগুলো ঘিরে ধরে রাখে তাকে।
এত হাসিখুশীর মাঝে মা ভাইকে মনে পড়লো তার। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো। মাকে এখন সব কাজ নিজের হাতে করে খেতে হবে। এক কাপ চা করে খাওয়ানোর জন্যও মেয়েকে পাবে না।
তার খাবার উঠলো না মুখে।
যাও তুুললো চোখের টলমল জলগুলো নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা। ওপাশ থেকে দ্রুত পায়ে ছুটে আসলেন আনজুমা বেগম। কন্যাস্নেহে সুজানার মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন
আহা মেয়ে খাওয়ার সময় এরকম করে কেউ ?
সুজানার ফোঁপানি দেখে সালমা বেগমও উৎসুক হয়ে তাকালেন। বাকি সবাইও নীরব হয়ে গেল।
দাদু বললেন
এমা কি হলো?
আনজুমা বেগম সুজানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
আর কি হবে? মা ভাইয়ের জন্য হয়ত মন কেমন করছে। অভি তোর শ্বাশুড়িকে ফোন দে দ্রুত। বল তার মেয়ে এখানে খেতে বসতে কান্নাকাটি করছে।
অভিক বলল
অলরেডি বলে দিয়েছি সুজানার চোখের পানিতে নবকুঠিরে বন্যা নেমেছে।
সবাই তার কথায় হেসে উঠলো। আনজুমা বেগম কান টেনে দিয়ে বললেন
ওর বউ কাঁদছে। আর ও মজা নিচ্ছে। পাজি ছেলে।
কাঁদার সুযোগ দেয়া যাবে না জেম্মা। নইলে তো বন্যার পানিতে ভাসতে হবে।
সবাই তার কথায় হাসছে। আর সুজানা অনুভব করলো তার ডান পা’টা নিজের দু পায়ের দখলে নিয়ে দোল খাচ্ছে অভিক। পুরো শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠলো তার। সুজানা অদ্ভুত চোখে তাকালো। অভিক চুপচাপ খেতে খেতে মিচকে হাসলো।
সুজানার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়াটা তার জন্য দু সেকেন্ডের ব্যাপার। সে মেয়েটাকে গত এক বছর ধরে আগাগোড়া চিনে নিয়েছে। এতটা চিনেছে যতটা চিনলে মেয়েটা দুঃখ পেলে তার মন কেমন করে। এই মন কেমন করাটাকে প্রথম দিকে সে স্নেহ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিল তারপর বুঝেছিল এটা শুধু ছাত্রীর প্রতি স্নেহ নয় বরং এটা খুব ভয়ংকর মায়া। যে মায়ায় আঁটকে গিয়েছিল সে। তারপর আর কভু মনে হয়নি এই মায়ার জাল থেকে তার নিস্তার পাওয়া উচিত। সে আঁটকে থেকেছে এবং আঁটকেছে সুজানাকেও।
____
বারোটার দিকে সুজানাদের বাড়ির সবাই এল। ওর চাচীরা চাচাতো ভাইবোন, ফুপু, আর ফুপাতো ভাইবোন, খালাতো ভাইবোন। দাদুও এল। যদিও উনি তেমন হাঁটাচলা করতে পারেন না। সরিষাবাড়ি থেকে নবকুঠির বেশিদূর নয় তাই উনাকেও নিয়ে এসেছেন সাজিয়া বেগম। সুজানা তখন ওর ঘরে ছিল। পার্লারের মেয়েগুলো তখন তার চুল বাঁধছিল। মা এসেছে শুনে তার ছটফটানি বেড়ে গিয়েছিল। পরে আনিকা সাজিয়া বেগমকে ওর ঘরে নিয়ে এসেছে। মা মেয়ের এক আবেগঘন মুহূর্ত কাটলো সেখানে। মেয়ের ঘর, নতুন সংসার দেখে মন ভরে গেল মায়ের। যাক এবার মরেও যেন শান্তি। অন্তত তিনি শান্তিতে থাকবেন এই ভেবে যে, এই বাড়িতে কোনোদিন ভাতের অভাব হলেও শান্তির অভাব হবেনা। উনার মেয়েকে ভালোবেসে আগলে রাখার মানুষের অভাব হবে না।
সাজিয়া বেগমের ডাক পড়ায় উনি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পথে অভিকের সাথে দেখা মিললো। অভিক উনার সাথে দেখা করার জন্য ছুটে আসছিল। দেখা হয়ে যাওয়ায় সালাম করে বলল
মেয়েকে দেখার পর মন নিশ্চয়ই ভালো?
খুব। আমার জামাইরাজাটা ভালো আছে তো?
বন্যার পানি সেঁচে সেঁচে বেঁচে আছি।
আহারে আমি জানলে কলার ভেলা দিয়ে নৌকা বানিয়ে আনতাম। কত কষ্ট মাস্টারমশাইয়ের!
অভিক হাসলো মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে। বলল
মেয়ের কুঁড়েঘরটা দেখা হয়েছে?
দেখে নিয়েছি। সোনা ছেলের হাতে মেয়ে দিয়েছি না, তার কুঁড়েঘরটাও সোনার ঘর। সোনাই বাঁধা।
অভিক চমৎকার হাসলো। বলল
শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে আমার অদ্ভুত একটা কানেকশন আছে। এত ভাবের মিল হয় কি করে?
একদম। ওই যে বললাম আমার বাবা। করিমুল্লাহ সর্দার। আমি যেন আমার বাবাকেই দেখছি। যাকে আমি দুচোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারি। আস্থা রাখতে পারি। আমি জানি আমার পর সুজানা একদম সঠিক একজন অভিভাবক পেয়েছে। যে তাকে আগলে রাখবে।
এমন নিখাঁদ মনের মাতৃসম মানুষটার বিশ্বস্ত আর ভরসাস্থল হতে পেরে অভিকের গর্ব হলো। আনন্দ হলো।
সাজিয়া বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন।
আমার জামাই-রাজার হাজার বছর আয়ু হোক। নাতির ঘরে পুতি, আর পুতির ঘরের নাতি দেখার সৌভাগ্য হোক।
অভিক সশব্দে হেসে উঠলো। সাজিয়া বেগমও হাসলেন।
চলবে..
আর তিন চার পর্বে সুন্দর সমাপ্তি টানবো।#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫৩
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
সুজানার বন্ধু-বান্ধবরা সবাই এল বেলা দুটোর দিকে। সুজানা তাদের উপর ভীষণ রেগে গিয়েছে। বলেছে তাড়াতাড়ি আসতে এসেছে দুটোর দিকে। তার রাগ করা দেখে আহির বলল
এই শালী দুটো সাজতে সাজতে দেরী কইরা ফেলছে। আমাগো দোষ নাই স্যারের বউ।
শান্তা চোখ গরম করে বলল
আচ্ছা? তোরা এসেছিস ক’টায়? দেড়টায় এসেছিস। আমরা আর আধঘন্টা পর রেডি। নিজেরাই তো দেরী করে আসছোস।
মেহুল বলল
জানু রাগ করিস না। তোর ছেলেপুলের আকীকায় তাড়াতাড়ি আসুম।
সুজানা বলল
বেয়াদ্দব।
সবাই একসাথে হে হে করে হেসে উঠলো। সুজানা জায়িনকে বলল
তোর বোন কোথায়?
আমার বোন?
নিহাত?
ওকে বলছি। ও কিছু বলেনাই।
নিখিল বলল
দাওয়াত করছিস ব্যস। আসলে আসবে না আসলে নাই। দ্যাটস ইট।
সুজানার মন খারাপ হলো। বলল
ও এল না। কত করে বললাম। ক্লাসে দেখা হলে দেখে নেব।
শান্তা বলল
হ্যা ভালো কথা। ক্লাসে কখন থেকে জয়ন হবি? ইয়ে মানে বটতলীতে আবার দেখা হবে নাকি স্যার মানে তোমার বরের সাথে যাবা?
সুজানা বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল
পাগলের মতো কথা বলিস? আমি কেন উনার সাথে যাব?
তাইলে ঠিক আছে। দোস্ত তোরে আজ রাণী রাণী লাগতেছে। আহা আমাগো স্যার দেখলে..
সুজানা হেসে বলল
ফাইজলামি রাখ।
শান্তা ঘরটা ঘুরে ঘুরে বলল
স্যার দেখি ভীষণ শৌখিন মানুষ। আচ্ছা বইও পড়ে। জানুরে তোর আর বই বই করা লাগবে না।
সুজানা বলল
হুমম।
ঘরে জিনিয়া উঁকি দিল। তার পড়নে লেহেঙ্গা। আজ নতুন ভাবির সাথে ওরা ননদিনীরা মিলিয়ে লেহেঙ্গা পড়েছে। সবার নজর ওর দিকে গেল। ও বলল
ভাবি নীচে একজন এসেছে। আপনার বান্ধবী। নিয়ে আসি?
সুজানা দাঁড়িয়ে পড়লো।
কে?
আমি নিয়ে আসি।
জিনিয়া গেল আর নিহাতকে নিয়ে এল। সুজানা খুশি হয়ে গেল তাকে দেখে। জড়িয়ে ধরে বলল
কার সাথে এসেছ?
বাবা নামিয়ে দিয়ে গেছে।
আঙ্কেলকে যেতে দিলে?
বাবার কাজ আছে।
জায়িনের সাথে এলেনা কেন তাহলে?
নিহাত সবার দিকে একপলক তাকালো। বলল
ওরা আমাকে ওদের দলে রাখতে চায় না। ওরা না কেউ কেউ। সো আমিও প্যারা হতে চাই না।
সুজানা সবার দিকে ফিরে তাকালো। সবাই ঠোঁট উল্টালো।
জিনিয়া বলল
ভাবি মামী বলছে আপনার বন্ধুদের নাশতা এখানে আনবে নাকি নীচে যাবে?
মেহুল বলল
না না আমরা নীচে যাব। অত কষ্ট করতে হবে না। আমরা সুজুকে নিয়ে যাব।
তাহলে ঠিক আছে। আপনারা সবাই আসুন। আমি আসি।
সুজানা নিহাতকে নিয়ে এসে বিছানায় বসালো। শান্তা দোলনায় বসে বসে দোল খাচ্ছে।
জিনিয়া যেতেই নিখিল বলে উঠলো
সুজু তোর ননদরে পছন্দ হয়ছে। লাইন করায় দে। আহির বলে উঠলো
যাহ শ্লা আমি বলার আগে বলে দিছোস।
নিখিল বলল
আরও দুটো দেখছি তুই ওগুলারে দেখ। ওগুলোরে মানাইবো তোর সাথে। এটার দিকে নজর দিবিনা।
সুজানা হেসে উঠলো
তোরা জীবনেও ভালো হবি না?
শান্তা বলল
এই লুচ্চা দুটোকে কোথাও নিয়ে যাওয়া মানে সর্বনাশ।
নিখিল বলল
মেয়েটাকে দেইখা মনে হইলো ভাবওয়ালী না। ভাব দেখানো মাইয়্যাগুলোরে দেখলেই মনে হয় কানের নীচে একটা দেই।
সবাই হে হে করে হাসলো।
নিহাত বলল
সুজানা চলো নীচে যাই। স্যারের সাথেও দেখা হয়নি।
মেহুল বলল
হ্যা, এবার যাওয়া দরকার। অনেক আগেই ডাক এসেছে।
সুজানা আয়নায় নিজের মুখশ্রী একবার দেখে নিল। তার গায়ের লেহেঙ্গাটা অভিক পছন্দ করে কিনেছে ওয়ালিমার দিন পড়ার জন্য। বেশ ভারী। সুজানা ধীরে ধীরে হাঁটলো।
ঘর থেকে বের হতেই ননদের দল ছুটে এল। সবাই আহির আর নিখিলদের দিকে তাকাতেই ওরা দু’জন হেসে উঠে দ্রুত প্রস্থান নিল।
বউ আসছে শুনে আগত মেহমানরা তাকালো। সুজানার দুচোখ যাকে খুঁজছে সে ওই দূরে দাঁড়িয়ে। ব্লুরঙা স্যুটবুট পড়া। গোছানো, ফিটফাট। মুখে একরত্তি হাসি রেখে কথা বলেই যাচ্ছে। সুজানা চোখ সরিয়ে নিল। দূরে থাকুক কিন্তু কাছে। তাও ভালো।
সুজানা সিঁড়ি বেয়ে থেমে থেমে নামলো। আনিকা ছুটে এল। সে গোলাপি রঙের শাড়ি পড়েছে। ভারী মিষ্টি হেসে বলল
এই দেখো সবাই বান্ধবীর ঘরে গিয়ে বসে আছে। খাওয়াদাওয়া কি করতে হবে না।
নিহাত, মেহুল আর শান্তা হাসলো।
অভিকের চোখ সুজানার দিকে তারদিকে পড়লো বলে।
বন্ধুদের বলল
চলে এসেছে। আপাতত আমাকে ওদিকে যেতে হবে। স্যারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। তোরা বাকিটা সামলে নিস।
বন্ধুরা সম্মতি জানালো।
সুজানার চোখ তার দিকে পড়তেই সে বরাবরের মতো ভুরু নাচাতেই সুজানা যেন আজ অন্যদিনের চাইতে ভারী লজ্জা পেল। হেসে মাথা নামিয়ে নিল দ্রুত।
সুজানাকে বসার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। সাজিয়া বেগম এসে মেয়ের পাশে বসলেন। মেয়েকে দেখলেন। হাতের তালুতে নিজের জিভজল লাগিয়ে বললেন নজর না লাগুক।
সুজানা মায়ের দিকে তাকিয়ে নির্মল হেসে বলল
ভাই কোথায়? তখন একটুখানি দেখলাম।
আছে আশপাশে। বন্ধু পেয়ে গেছে অনেক।
আনিকা এসে কানে কানে বলল
গয়নাগাটিগুলো আলমিরায় রেখেছেন তো।
সুজানা বলল
ওগুলো উনি রেখেছেন। চাবিও উনার কাছে।
তাহলে ঠিক আছে। ছোটমা বলছিল তাই। আরেকটা কথা অভি বললো যে আপনার পায়ে নাকি ফোস্কা পড়ায় ব্যাথা হয়েছে । জুতোগুলো পড়ে হাঁটতে পারছেন?
এগুলো বিয়ের জুতোগুলোর চাইতে ভালো আছে। ব্যাথা লাগছেনা তেমন।
তাহলে ঠিক আছে।
অভিক সায়েমকে ধরে নিয়ে এল। সাজিয়া বেগমকে বলল
শালাবাবু লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে সারাদিন। সমস্যা কি?
সাজিয়া বেগম হেসে বললেন
লজ্জা পাচ্ছে হয়ত।
দু ভাইবোনের এত লজ্জা কেন? এত লজ্জা নিয়ে ঘুমায় কি করে?
হেসে উঠলো সবাই মিলে।
সাইফ আর রোজা আসলো। সুজানা বলল
কোথায় গিয়েছ তুমি সাইফ ভাই? এই আছ এই নেই।
এইতো আছি।
সাজিয়া বেগম বললেন
ছেলেটা না থাকলে আমার কি যে হতো। এত কাজ সে সামাল দিয়েছে।
সাইফ বলল
কি বলো না আন্টি। এসব কোনো কাজ হলো?
অভিক তার পিঠ চাপড়ে বলল
বোনের জন্য করতে হয়। রোজামণি ভালো আছে?
রোজা লজ্জা পেয়ে সাইফের পেছনে লুকিয়ে পড়লো।
ক্যামেরা ম্যান বলল
স্যার বসুন। ছবি তোলা হয়নি একটাও।
অভিক সুজানার পাশে গিয়ে বসলো। সায়েমকে পাশে বসালো। সাইফ আর রোজাও বসলো। সাজিয়া বেগম বললেন
আমি যাই তাহলে।
অভিক বলল
শ্বাশুড়ি মা জামাই-রাজার সাথে একটা ছবি থাকাই যায়।
উনি বসলেন। তারপর ছবি তোলা হলো। সুজানার বন্ধুরা সবাই এসে বললো
আরেহ সাইফ তুমি এখানে? স্যার আপনিও? আপনাকে খুঁজছিলাম।
অভিক বলল
কি খবর আপনাদের! আগে স্যারের সাথে দেখা করা উচিত না?
আপনাকে দেখতেই পেলাম না তাই।
বসো বসো সবাই।
সাজিয়া বেগম নেমে গেলেন।
সবাই হুড়োহুড়ি করে বসলো। সুজানার পাশের সোফায় রোজা, শান্তা, মেহুল আর নিহাত বসলো।
ছবি তোলা হলো সবার। সব শেষে অনা আবিদ এল আরও কয়েকটা বাচ্চা নিয়ে। সুজানার কাছে এসে সুজানাকে দেখিয়ে ওদের বলল
ইটা বউ। সুজান বউ। অভির বউ।
অভিক আর সুজানা হাসলো তার কথায়। সুজানা বলল
এরা কারা সোনা মণি?
অনা অভিকের কোলে উঠে বসে বলল
আমার বোন্ধু। আবির বোন্ধু।
সুজানা সবাইকে তার পাশে বসালো। আবিদ বলল
বোন্ধু সুজানের জুন্য চকলেত আনছে। গিফট। বউ গিফট।
ওমা তাই।
বাচ্চাদুটো চকলেট বাড়িয়ে দিল সুজানার দিকে। সুজানা চকলেট নিয়ে হেসে আদর করে দিয়ে বলল
বাহ আমার খুব প্রিয় চকলেট। আমি খাব।
ওরা খুব খুশি হয়ে তারপর একদৌড়ে চলে গেল। সুজানা হেসে বলল
পালিয়ে গেল কেন?
অভিক বলল
লজ্জা পেয়েছে। বাই দ্য ওয়ে, স্যারদের আনছি। পরিচয় করিয়ে দেব আপনার সাথে।
আমি যাব?
অত হাঁটাহাঁটির দরকার নেই। আমি নিয়ে আসছি।
ঠিক আছে।
দুজনেই মিষ্টি হাসলো।
খাওয়াদাওয়া, হৈ-হুল্লোড়, হাসি তামাশায় কেটে গেল পুরো দিনটা। মুহূর্তে গুলো বন্দী হলো স্মৃতির কৌটায়। শুরু হলো নতুন পথচলা। এই পথচলায় দুজন দুজনকে ভালো রাখার কারণ আবার দুজনেই দুজনের ভালো থাকার কারণ।
______________
রাত নামতেই মেহমান কমে এল। বন্ধুদের বিদায়ের সময় সুজানার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যদিও সবার বাসা নবকুঠির থেকে খুব দূরে নয়। এবং রোজ যোগাযোগ হয়। তারপরও কোথাও একটা খারাপ লাগলো।
তারপর চাচী, খালাম্মা আর ফুপুরা যখন চলে গেল তখন আরও খারাপ লাগলো। তারপর মা ভাই চলে যাওয়ার সময় সুজানাকে আর কেউ ধরে রাখতে পারেনি। বিয়ের দিনও এভাবে কাঁদার সুযোগ পায়নি সে। সাজিয়া বেগম নিজেও কাঁদলেন আবার সান্ত্বনা দিলেন মেয়েকে।
কাল তো বেড়াতে যাবি । আর কাঁদিস না।
আজ থেকে যাওনা আম্মা।
সবাই তার সাথে সাথে আবদার করলো।
থেকে গেলে কি হয়?
সাজিয়া বেগম বললেন
বাসায় তো মেহমান আছে। এখন কি থাকার সময়? অনেক থাকা যাবে।
সবাই সুজানাকে সান্ত্বনা দিল। বিয়ের ঝামেলা চুকে যাক। মা মেয়ে একসাথে থাকার সুযোগ হবে।
সুজানা সবার কথা শুনে শান্ত হলো। তারপর সাজিয়া বেগম যেতে পারলো। মেয়েটা আজও ছোট থেকে গিয়েছে। মা ছাড়া কিছু বুঝেনা।
______
বাড়ি খালি হওয়ার পর ভারী সাজগোছ ফেলে গোসল করে নিল সুজানা। তারপর শান্তি লাগলো। সবার একই অবস্থা। ছোট থেকে বড় সবাই গোসলটোসল সেড়ে ড্রয়িংরুমে আড্ডায় বসলো। কে এল, কে এল না তা নিয়ে। সুজানা আসতেই সবাই নড়েচড়ে বসে কথার সুর পাল্টালো। সব কথা নতুন বউয়ের কানে তোলা যায় না। অভিক সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলল
আপনি টায়ার্ড থাকলে এখানে থাকার দরকার নেই।
সালমা বেগম বললেন
ও ঘরে একা একা বসে থাকবে নাকি? বসুক এখানে। মায়ের জন্য এভাবে কেউ কাঁদে। ভেবেছি এই মেয়ের অনেক বুঝ। এখন দেখি সব উল্টো।
সুজানা অভিকের দিকে তাকালো। অভিক নরম হাসলো। সুজানা দাদুর পাশে বসলো। দাদু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
কত এমন বড় হয়েছে? মায়ের আঁচল ছাড়লে সব মেয়েই বাচ্চা হয়ে যায়। দিনগুলো মনে করে দেখো। তুমিও কম করোনি। কিন্তু আমার বোনের কান্নার কারণ নেই। দাদুভাই তোমাকে দিনে দিনে নিয়ে যাবে। তোমার যখন মায়ের জন্য মন পুড়বে তখন চলে যাবে। আর মন খারাপ করোনা ঠিক আছে?
সুজানা মাথা নাড়ালো।
এই শাড়িতে আরাম লাগছে?
হ্যা।
অভিক দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
মা আমি বেরোচ্ছি। আজ রাতে খাব না। সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো। ঠিক আছে।
সুজানা উৎসুক হয়ে তাকালো। অভিক বলল
খুব তাড়াতাড়ি ফিরব মা।
সালমা বেগম কিছু বলার আগেই অভিক বেরিয়ে গেল। সুজানার সময় কাটলো সবার সাথে। রাতে শ্বাশুড়ির হাতে খেয়ে ঘরে চলে গেল। সেখানে ননদ আর আনিকার সাথে অনেক গল্পসল্প হলো। তারপর তারা যার যার ঘরে চলে যেতেই সুজানা ঘরের আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালালো। মোমবাতি গুলো অভিকের ড্রয়ারে দেখার পর মাথায় বুদ্ধি এসেছিল এই মোক্ষম সুযোগে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মাস্টারমশাই অব্দি পৌঁছেছে সে। উনি নিশ্চয়ই খুব চমকে যাবে। ভাববে সুজানার এত বুদ্ধি হলো কবে থেকে? যদিও উনি জানেন সুজানা নির্বোধ নয় অতটা। সুজানা ঠিক তার মতো, যতটা দরকার ঠিক ততটা।
সে রাত এগারোটা হতেই ছোট্ট একটা মিসকল দিল অভিকের ফোনে। অভিক তখন বাড়ির গেইট পার হয়েছে। মিসকল দেখে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটলো তার।
পুনরায় মিসকল দিতেই সুজানা তার উত্তর পেয়ে গেল। দরজায় ঠোকা পড়ার অপেক্ষায় দিব্যি দাঁড়িয়ে রইলো সে দরজার পাশে খোলা চুলে খুশিমনে।
যখন ঠোকা পড়লো আর সে অনুভব করলো ওপাশের জন তার মানুষ তখন বুকের ভেতর অদ্ভুত দুন্দুভিধ্বনি টের পেল সে। দরজা খোলামাত্রই লাজুক মুখটা চোখে পড়লো অভিকের। মাথাটা বুকে এসে ঠেকতেই দু হাত দিয়ে সে বেঁধে নিল পরম যত্নে। কপালে পুনঃবার ঠোঁটের স্পর্শে হুশ ফিরলো সুজানার। সে মুখ তুলে বলল
চোখ বন্ধ করুন।
অভিক ভালো ছেলেটির মতো চোখ বন্ধ করলো। সুজানা তাকে ঘরে নিয়ে এল। দরজাটা বন্ধ করে বলল
এবার খুলুন।
অভিক চোখ খুলেই দেখলো অন্ধকার ঘরটা। মৃদুমন্দ আলোর উৎস খুঁজতেই দেখলো মোমবাতি জ্বলছে মিটিমিটি।
সুজানা মোমবাতির দিক থেকে চোখ সরিয়ে অভিকের দিকে তাকালো। অভিক তার নাকে দুম করে নাক ঠেকিয়ে বলল
হঠাৎ!
প্রথম প্রশ্নটা মনে আছে?
হুমম।
যে জিনিসটা শুধুমাত্র আপনার সেটা আপনি শুধুমাত্র আমাকে দিতে পারেন। উত্তরটা হচ্ছে…
অভিক হাসলো। সুজানা বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল
মন।
হুমম। তারপর।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে আপনি আমার কাছে লাইব্রেরি চেয়েছিলেন। হাজার বই দিয়ে সাজানো লাইব্রেরি দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু আমার সেই লাইব্রেরি দেয়ার সামর্থ্য আছে যেটা আপনি চেয়েছিলেন। একটা ভালো বন্ধু যে একটা লাইব্রেরীর সমান। আপনি আমার বন্ধুত্ব চেয়েছিলেন। উত্তরটা ঠিক আছে?
জিনিয়াস বউ আমার।
সুজানা হাসলো। অভিক তার চুল গুঁজে দিল কানের পেছনে। বলল
এবার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর।
এই ঘরে কি কি দেখতে পাচ্ছেন আপনি?
আমি, আপনি, মোমবাতির আলো, আবছা আবছা আসবাবপত্র ইত্যাদি ইত্যাদি।
উহু। আপনি স্বপ্নে দেখেছেন। একটা অন্ধকার ঘর, একটা আমি অন্যটা আপনি আর কিছু ছায়ারা নৃত্য করছে।
একদম তাই।
সুজানা হেসে ঘরটা দেখিয়ে বলল
এই যে অন্ধকার ঘর। একটা আমি আরেকটা আপনি। আর ওই যে ছায়ারা নৃত্য করছে।
অভিক দেখলো মোমবাতির ছায়াগুলো নৃত্যরত অবস্থায় আছে।
সুজানা বলল এটাই আপনার স্বপ্নের ব্যাখ্যা। আপনার স্বপ্ন আপনার মতোই সুন্দর।
অভিক জড়িয়ে ধরলো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। ভেঁজা চুলে মুখ গুঁজে বলল
কি ভেবেছেন এটা ঘুমিয়ে দেখেছি?
তো?
অভিক হেসে উঠলো। বলল
এটা জেগে জেগে দেখেছি ম্যাডাম।
সুজানা অবাক চোখে বুক থেকে মুখ তুলে তাকালো।
কি! দুষ্টু লোক। আমাকে শুধু শুধু নাচালেন উত্তর খোঁজার জন্য?
ইয়েস।
সুজানা তার মাথাটা ধুপধাপ ঠেকালো অভিকের বুকে। অভিক হাসতে হাসতে বলল
আপনাকে আমার প্রয়োজন এটা বুঝাতেই তো অবস্থা খারাপ আমার। আমি চেয়েছিলাম যাতে আপনি নিজে নিজে বুঝতে পারেন।
সুজানা আবারও মুখ গুঁজলো। বলল
দুষ্টু লোক।
অভিক কপালের পাশেই ঠোঁট ছুঁয়ে বলল
আমার সারপ্রাইজটা দিতে দিন।
সুজানা মুখ তুলে বলল
কি?
অভিক তাকে পাঁজা খোলা করে তুলতেই সুজানা বলল
অ্যাহ এসব কি? যখন তখন।
ওই ড্রয়িং রুমে নেওয়া উচিত ছিল।
এ্যাহ কচু।
অভিক হাসলো। সুজানাকে বিছানায় বসিয়ে বলল
বসুন। আনছি।
লাইট দিন।
অভিক ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিল। ঘরটা গোলাপি রঙ ধারণ করলো।
আলমিরা খুলে দুটো বাক্স বের করলো অভিক। নিয়ে এসে পেছনে রেখে সুজানার সামনে বসলো। বলল
চোখ বন্ধ।
সুজানা চোখ বন্ধ করলো।
অভিক আনরেপ করতে করা শেষে বলল
চোখ খুলুন।
সুজানা চোখ খুললো। কালো রঙের ল্যাপটপ?
হাত দিয়ে ছুঁয়ে অভিকের দিকে তাকালো।
অভিক বলল
আপনার ল্যাপটপ। আর এটা চার্জার। বাকি সরঞ্জাম রাখা আছে ওখানে।
সুজানা ওটাতে হাত বুলিয়ে বলল
আপনার কেন মনে হলো এটা আমার প্রয়োজন?
আমি জানি এটা আপনার খুব প্রয়োজন। আমার বউয়ের আবার সোনাদানায় মন নেই।
সুজানা ওটা পাশে রেখে দিল। অভিকের নিকটে এসে জড়িয়ে ধরলো চুপচাপ। অভিকও চেপে জড়িয়ে ধরে বলল
আমি আপনাকে পড়তে পারি ম্যাডাম।
সুজানা মুখ লুকিয়ে রাখলো। অভিক বলল
এটা ওপেন করে দেখাই। সুজানা মাথা দুলালো। অভিক বুকের নীচে বালিশ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে ল্যাপটপটা ওপেন করলো।
সুজানা অভিকের পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে ল্যাপটপে চোখ রাখলো।
শুরুতেই তাদের বিয়ের ছবি দেখা গেল ডিসপ্লেতে।
অভিক বলল
এরা কারা?
সুজানা হাসলো। বলল
সব করে রেখেছেন?
হুমম।
এই নিন। আপনার কাজ এবার।
সুজানা ল্যাপটপে তাদের বিয়ের ছবিগুলো দেখলো একের পর এক।
অভিক নিয়ে নিল তারপর। বন্ধ করে রেখে দিয়ে বলল
এটা এখন আমার জায়গা নিয়ে নেবে না তো।
সুজানা বালিশে মাথা এলিয়ে হেসে উঠলো। অভিক বালিশটা টেনে নিয়ে আসলো। নাকে নাক ঘষে বলল
এমন হলে চলবে না। বউ আমার।
সুজানা আবারও হাসলো। চওড়া কপালটাতে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল
আপনার জায়গা অন্য কেউ কভু নিতে পারবে না। আপনি শুধুই আপনি। মাস্টারমশাই!
অভিক মুখটা আগলে ধরে প্রলম্বিত চুম্বনে রাঙিয়ে দিল। পিঠের নীচে হাত গলিয়ে গলায় মুখটা গুঁজতেই সুজানা স্তব্ধ হয়ে গেল।
ঘড়ির কাঁটার টিংটিং আওয়াজ ভেসে এল শুধু। কানে কানে কে যেন বলে গেল
ভালোবাসা ভালোবাসাবাসিদের কাছে সুন্দর।
সমাপ্ত।
যদিও আরও দুতিন পর্ব হওয়ার কথা ছিল কিন্তু
শেষ টানলাম আজ। বোনাস পর্ব আসবে। তবে দেরী হবে। তখন অনেক এগিয়ে যাবে তাদের পথচলা।
আজকে সবার মন্তব্য চাই। চুপ করে থাকলে চলবে না। এই গল্প প্রিয় হতে পেরেছে কি আপনাদের? কোন চরিত্র গুলো প্রিয়?
অতএব শুধু থেকে যারা ছিল তাদের জন্য অন্তরস্থল থেকে ভালোবাসা। এভাবেই পাশে থাকবেন শেষ পর্যন্ত। ভালো থাকবেন, ভালো রাখবেন আপনদের। ভালোবাসা ❤️❤️❤️