আমার_পূর্ণতা #রেদশী_ইসলাম পর্বঃ ২০

0
583

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২০

প্রাচুর্য নিজের রুমে এসে একটি আরামদায়ক থ্রি-পিস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। শাড়ি বা গহনা যতই সিম্পল হোক না কেনো তবুও এসব পরে সে আর এক মিনিট ও থাকতে পারবে না। অলরেডি গায়ে কাটা কাটা ফোঁটা শুরু হয়েছে তার। সে প্রতিদিনের পরিধান কৃত জামা কাপড়েই স্বস্তি পায়।
প্রাচুর্য গোসল শেষে মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে ওয়াশ রুম থেকে বের হলো। তার শুধু তাফসিরের মুখটা মনে পরছে এবং ব্যপক হাসি পাচ্ছে। ইশ মুখটা কি দেখতেই না লাগছিলো তখন। প্রাচুর্য নিজের ভাবনায় ব্যস্ত থেকে বেলকনিতে চলে যায় তোয়ালে নেড়ে দেওয়ার জন্য। তার অন্য কোনো দিকে খেয়াল নেই।
প্রাচুর্য বেলকনিতে তোয়ালে নেড়ে দিয়ে ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনি হাতে নিলো। পাশ থেকে সুইচ টিপে লাইট জ্বালালো। এতোক্ষণ ঘরে মৃদু আলোর একটি টেবিল ল্যম্প জ্বলছিলো। প্রাচুর্য চিরুনি নিয়ে চুল আছড়াতে আছড়াতে আয়নায় তাকাতেই কারও প্রতিবিম্ব দেখে ভয়ে চমকে উঠলো।
মানে কি? সে ছাড়াও এতোক্ষণ এই ঘরে দ্বিতীয় একজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলো অথচ সে বিন্দু মাত্র টের পেলো না? সে কি কানা নাকি অন্য ভাবনায় থাকার জন্য বুঝতে পারলো না। প্রাচুর্য অবাক দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে পিছে ফিরলো। বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর তাফসির হাতে বালিশ নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকেই পর্যবেক্ষণ করছে। প্রাচুর্য চোখ বড় বড় করে মৃদু স্বরে চিল্লিয়ে বললো—

” আপনি? আপনি আমার রুমে কি করছেন তাফসির ভাই? ”

তাফসির ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো—
” আমার বউয়ের রুমে আমি কি করবো বা না করবো সেটা আমার ব্যাপার। কাউকে কৈফিয়ত দিতে পারবো না।”

” দেখুন তাফসির ভাই আপনি এক্ষুনি রুম থেকে বের হয়ে যান। বাড়ি ভর্তি লোকজন। কেউ যদি জানতে পারে তাহলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে। ”

” ও আমি আমার সদ্য বিবাহিতা বউয়ের কাছে আসলে সেটা খারাপ দেখাবে। আর বিয়ে করেও ব্যাচেলর থাকলে সেটা খারাপ দেখাবে না? কে বলেছে এমন কথা?”

তাফসিরের কথায় আবার হাসি পেলো প্রাচুর্যের। সে মুখে একহাত চেপে হেসে ফেললো। তা দেখে মেজাজ খারাপ হলো তাফসিরের। সে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে হেঁচকা টানে প্রাচুর্যকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। চোখ রাঙিয়ে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো—

” খুব হাসি পাচ্ছে তাই না? আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতিস কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করার পরও তার থেকে দুরে থাকার কষ্ট। ”

তাফসির প্রাচুর্যকে এভাবে টান দেওয়ায় প্রাচুর্য প্রথমে ভয় পেলেও পরমুহূর্তে তাফসিরের পরবর্তী কথাটা শুনে মাথা নিচু করে ফেললো। আসলেই তাফসির ভুল কিছু বলে নি। যে ভালোবাসে সেই বোঝে একতরফা ভালোবাসার কষ্ট কেমন।

প্রাচুর্যের নতজানু মুখটাকে দেখলো তাফসির। নিজেকে সামলে দৃষ্টি নরম করলো। মাথা নুইয়ে নিচুস্বরে প্রাচুর্যের এক গালে হাত রেখে বললো—

” বাইরে যাবি? আজকে রাতটাই তো আছি। একটা রাত কি আমাকে দেওয়া যায় না? প্লিজ? এটুকু সময় অন্তত আমাকে দে। দেখ বাইরে কি সুন্দর চাঁদের আলো ঝলমল করছে। তোর খারাপ লাগবে না এটুকু নিঃসন্দেহে বলতে পারি। ”

প্রাচুর্য এতোক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলেও তাফসিরের কথা শুনে সে ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাফসিরের দিকে তাকালো। অন্য সময় হলে সে ঘুনাক্ষরেও রাজি হতো না তবে আজ যেনো তাফসিরের কন্ঠস্বরে কিছু একটা ছিলো। প্রাচুর্য পারলো না প্রস্তাবটি নাকজ করতে। তাই অনায়াসেই রাজি হয়ে গেলো। তাতে বোধহয় তাফসিরের ঠোঁটে বিস্তৃত হাসির রেখা দেখা দিলো।

এতোক্ষণে চৌধুরী বাড়ির উজ্জ্বল ঝলমলে লাইট বন্ধ হয়ে জায়গা করে নিয়েছে একরাশ নিকষ অন্ধকারে। তার মধ্যে দিয়ে তাফসির সাবধানে প্রাচুর্যের হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসলো। সদর দরজা পেরিয়ে বাইরে আসতেই দেখলো মেইন গেটের সামনে দারোয়ান বসে আছে। তাদের দেখতেই দারোয়ান দাত বের করে হেঁসে সালাম জানালো। তাফসির সালামের উত্তর দিয়ে বললো—

” চাচা আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। আপনি বাড়ির দিকে খেয়াল রাখবেন। আর এ কথা কাউকে জানানোর দরকার নেই ”

তাফসিরের কথায় দারোয়ান পান চিবোতে চিবোতে বললো—

” ঠিক আছে স্যার। চিন্তা করবেন না। আমি কাউরে কিছু কমু না। কিন্তু এতো রাইতে কোনহানে যাচ্ছেন? ”

দারোয়ানের কথায় তাফসির প্রাচুর্যকে ইঙ্গিত করে বললে—

” ম্যাডামের বাইরে ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করছে তাই নিয়ে যাচ্ছি চাচা। ”

তাফসির মিথ্যা কথা বলায় প্রাচুর্যের চোখ ছোট ছোট হয়ে গেলো। তাফসিরের ধরে রাখা হাতটি জোরে চেপে ধরলো। কিন্তু তাফসির সেদিকে পাত্তা ও দিলো না। সে প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে বললো—

” তুই এখানে দাঁড়া আমি গাড়ি বের করে আনছি “__বলে ই সেখান থেকে চলে গেলো তাফসির।

তাফসির গাড়ি নিয়ে এসে প্রাচুর্যকে ইশারায় উঠে আসতে বললো। প্রাচুর্য উঠে বসতেই তাফসির গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিন্তু তারা ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না যে ঘরের বেলকনি থেকে কেউ একজন প্রথম থেকে সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করছে।
.
.
.
এতো রাতে সাধারণত কাকপক্ষী ও বাইরে থাকার কথা না। তবে ঢাকা শহরে প্রায় সারারাতই যানবাহন চলাচল করে। রাজধানী বলে কথা। কম মানুষের তো বসবাস নয়। না জানি কখন কার কি দরকার পরে বলা তো যায় না। তবে তাফসির যেখানে এনেছে সেখানে মানুষ যানবাহন তো দুরেরই কথা কাকপক্ষী ও দেখা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে দুর থেকে বাদুড় এবং ঝিঁঝি পোকার তীব্র আওয়াজ আসছে।
তাফসির গাড়ি থেকে নেমে প্রাচুর্যের পাশের দরজা খুলে দিলো। প্রাচুর্য নেমে দাঁড়াতেই প্রাচুর্যের এক হাত মুঠোয় পুরে নিলো তাফসির। প্রাচুর্য সে হাতের দিকে একপলক তাকিয়ে সামনে চোখ ফেরাতেই মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। একরাশ মুগ্ধতায় ঘিরে ধরলো তাকে।
সরু চিকন রাস্তা। মাথার উপর চাঁদ। দুপাশে সারি সারি সাদা কাশফুল। চাঁদের সোনালী আলো কাশফুলের উপর পরে চারদিকে অপরুপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে যা দেখতে রুপকথার জগৎ থেকে কম লাগছে না প্রাচুর্যের কাছে। ”

তাফসির প্রাচুর্যের হাত মুঠোয় পরে সেই চিকন রাস্তা দিয়ে খানিক হাটলো। পুরোটা সময় প্রাচুর্য আশপাশ পর্যবেক্ষণ করেছে আর তাফসির তার প্রাচুর্য রাণীকে। প্রাচুর্যের ঠোঁটের চওড়া হাসি যেনো শেষই হচ্ছে না তা দেখে তাফসির ও মৃদু হাসলো। তাফসির প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো—

” কেমন লাগছে? ”

প্রাচুর্য মুখে হাসি নিয়েই বললো—

” বলে বোঝাতে পারবো না এত্তোটা সুন্দর। ”

তাফসির আর কিছুই বললো না। তারা দু’জন হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির সামনে এসে থামলো। তাফসির দু হাত পকেটে পুরে গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। তার দেখাদেখি প্রাচুর্য ও পাশে এসে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ নিরবতা চললো দুজনের মধ্যে। হঠাৎ প্রাচুর্য কোমরে বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠলো। তাফসির প্রাচুর্যকে টেনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরলো।প্রাচুর্য কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো—

” তাত..তাফসির ভাই……”

কিন্তু প্রাচুর্য কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই তাফসির প্রাচুর্যের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে নিচু কন্ঠে বললো—

” হুশশ..জাস্ট ফিল দ্যা মোমেন্ট জান ”

তাফসিরের এমন স্পর্শে প্রাচুর্যের শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। দ্রুততম হলো শ্বাস। তাফসির পেছন থেকে প্রাচুর্যের চুল একপাশে সরিয়ে মাথা নিচু করে প্রাচুর্যের গলার পাশে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো।
প্রাচুর্য সাথে সাথে নিজের কোমরে রাখা তাফসিরের হাত খামচে ধরলো।
হঠাৎ তাফসির প্রাচুর্যকে ছেড়ে দিয়ে দুরে এসে দাঁড়ালো। বার কয়েক শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো। পকেট থেকে ফোন বের করে সময় চেক করলো। পেছনে ফিরে গাড়ির সামনে দাঁড়ানো প্রাচুর্যের হাত টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।

অন্যদিকে প্রাচুর্য তখনও কোনো ঘোরের ভেতর ছিলো। শরীর কাপছিলো তার। তাফসির হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিতেই ঘোর ভাঙলো তার। ততোক্ষণে তাফসির ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে অলরেডি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে।
বাকিটা পথ আর কোনো কথা হলো না তাদের। প্রাচুর্য মাথা নিচু করেই থাকলো। তবে তাফসির বার কয়েক আড়চোখে প্রাচুর্যের ভাবভঙ্গি পর্যবেক্ষন করে নিয়েছে।

চৌধুরী বাড়ির সদর দরজার সামনে গাড়ি থামতেই প্রাচুর্য গাড়ি থেকে নেমে কোনো দিকে না তাকিয়েই দৌড়ে ঘরে এসে দরজা আটকিয়ে দিলো। বিছানার উপর শুয়ে বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।
.
.
.
.
আজ সোমবার। তাফসিরের বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেওয়ার দিন। বাড়িতে মেহমান এখনো গিজগিজ করছে। একবারে তাফসিরকে বিদায় দিয়ে তারপরেই বাড়ির পথ ধরবে তারা। সেদিনের মতো আজকেও শুরু হলো মিসেস ফারাহর কান্নাকাটি। তবে তার সাথে আজকে যুক্ত হলো আরেকজনও। সে হলো প্রাচুর্য। যদিও মিসেস ফারাহর মতো পারছে না চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কানতে তবে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে অনেক কষ্টে।
মিসেস ফারাহর অবস্থা দেখে মিসেস শাহানা এবং মুমতাহিনা বেগম রান্নাঘরে ঢুকতে দেন নি মিসেস ফারাহকে। তারা দু বউই সামাল দিচ্ছে সব। তাই মিসেস ফারাহ কোনো কাজ না পেয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বসে কান্না করছেন। আর তাকে ঘিরে শান্তনা দিচ্ছে সবাই।

অবশেষে চলে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সময়। তাফসিরের গাড়ি এসে থামলো এয়ারপোর্টের দোরগোড়ায়। সাথে আছে প্রাচুর্য, আবির,রাদিয়া এবং রিয়া। বাকিরা ও সাথে আসতে চেয়েছিলো তবে এতো মানুষের আসলে বেশি ভিড় হয়ে যাবে বলে সাথে আনেনি কাউকে। আজ শুধু তাফসির নয় সাথে শাহিন ও আছে সাথে। দুই বন্ধু একসাথেই যাবে। শাহিন আগের থেকেই এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিলো। তাফসিরদের দেখেই এগিয়ে আসলো। তাফসির সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রাচুর্যের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাফসিরের ঠোঁটে মলিন হাসি। প্রাচুর্যের চোখ ছলছলে। যে কোনো মুহুর্তে পানি গড়িয়ে পরবে। তারা দু’জন দুজনের দিক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। তারপর তাফসির হাত টেনে প্রাচুর্যকে কাছে নিয়ে আসলো। প্রাচুর্যের মুখ টাকে দু’হাতে আঁজলা ভরে ধরে বললো—

” একদম অবাধ্য হবি না কিন্তু। ছোট মা, ছোট বাবার কথা শুনে চলবি। বেশি দৌড়াদৌড়ি লাফঝাপ করবি না। এবং দ্যা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট থিং ইজ গাড়ি ছাড়া কোথাও যাবি না। আর কলেজে তো নাই। আমি ছোট মা’কে বলে এসেছি সব। তোকেও বলছি আবার। একা একা কোথাও যেনো না যাওয়া হয়। দেখলি তো কিছুদিন আগে কতো বড় একটা বিপদ হলো। ”

তাফসির কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে উঠলো —

” ভালো থাকিস ”

প্রাচুর্য এবার আর নিজেকে কন্টোল করতে পারলো না। তাফসিরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। তাফসির প্রাচুর্যের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঠোঁট ছোয়ালো কপালে।
সে মুহুর্তে শাহিন তাফসিরের কাঁধে হাত দিয়ে বললো—

” ভাই দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”

তাফসির প্রাচুর্যকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। দু’হাত দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো—

” একদম কান্নাকাটি করবি না। খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। মা’কে সামলিয়ে রাখিস। তুই বোঝালে বুঝবে মা। আসি। সাবধানে থাকিস। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here