আরশিকথা-৫
পিয়ার বাসায় সবাই অনেক গল্প করলেও সুপ্রভা বেশি কথা বলছিল না। শুভ্রর বারবার ফোন আসছিল, আর ও বাইরে গিয়ে কথা বলছিল। সুপ্রভার কেন যেন কান পেতে শুভ্রর কথা বা কণ্ঠস্বর শোনার চেষ্টা করছিল অবচেতন মনে।
প্রভা বসেছিল একদম বারান্দা লাগোয়া সোফায়, বসে একটা ম্যাগাজিন দেখছিল।
সবাইকে হাতে হাতে প্লেট দিয়ে গেল পিয়া। শুভ্র তখনো বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, নিশ্চয়ই বিদেশিনী বান্ধবীর সাথে, প্রভার হুট করেই মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল। বিষয়টা এমন, চাইলেও মাথায় না ঢুকিয়ে পারা যাচ্ছে না। আর শুভ্র এতদিনে কোনো যোগাযোগ না রাখলেও এসে থেকে গায়ে পড়ে কথা বলার চেষ্টা করছে মনে হয়। সুপ্রভাট পাশের চেয়ারটাই ফাঁকা আছে শুধু।
সুপ্রভা দীপ্রকে ডাকল, এখানে চলে আয়।
দীপ্র আসছি বলে, ড্রিংকসের গ্লাস আনতে গেল৷ শুভ্র এসে ফাঁকা দেখে প্রভার পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। প্রভা উঠে দাঁড়াল।
শুভ্র বলল, আমি বসেছি বলে উঠে যাচ্ছ?
সুপ্রভা বলল, না। আমি ডাইনিংয়ে বসে খাব৷
-ওহ আচ্ছা।
সুপ্রভা চলে গেল। একটু পরে পিয়ার মা এসে বললেন, শুভ্র তুমি এখানে কেন বসেছ, ডাইনিং তো ফাঁকা, চলে এসো।
শুভ্রকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলেন ডাইনিংয়ে। তিনিও বসলেন। শুভ্রকে ডাকার একটা কারণ আছে, পিয়ার বিষয়ে ভাবছিলেন, ছেলেটাকে তার পছন্দ।
অবশ্য পিয়া এসব জানে না।
পিয়া, এখানে বস। আমি দিয়ে দিচ্ছি।
পিয়া বলল, আমি পরে বসব মা। তুমি বসে কথা বলো।
সুপ্রভার দিকে তাকিয়ে শুভ্র হাসল।
শুভ্র বিয়ের কথা কিছু ভাবছ? তোমার বিয়ের জন্য তোমার মা মেয়ে খুঁজছেন না এখন?
শুভ্র সুপ্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার তাড়া নেই আন্টি, মা চাইলে দীপ্রকে আগে বিয়ে দিয়ে চলে যাব।
তুমি কি দেশে বিয়ে করবে না?
ভাবিনি কিছুই আন্টি!
সুপ্রভা উঠে গেল তাড়াতাড়ি। শুভ্রও হাত ধুতে সিংকে গেল।
সরি, আমার জন্য কোথাও খেতে পারছ না, আধখাওয়া প্লেট রেখে চলে আসছ! এত রিএ্যাক্ট কেন করছ সুপ্রভা! সব তো শেষ হয়ে গেছে!
সুপ্রভা কিছু বলল না। অসহ্য এই ছেলেটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে।
সুপ্রভা বারান্দায় গিয়ে দীপ্রকে ডেকে নিলো। পিয়ার কোনো এক রিলেটিভ পিয়ার মা কে বলল, এই ছেমড়ি এমন জামাকাপড় পরছে, একটা ওড়নাও নেয় নাই!
পিয়ার মা বললেন, দেইখো না, ঢাকায় যাইয়া এদের পাখনা গজায়া গেছে।
আবার দেখেন, ওই ছ্যামড়ার সাথে গল্প জুড়ছে!
হুম, সম্পর্ক আছে তো মনে হয়!
শুভ্রর খুব রাগ হলো। ও বারান্দায় গিয়ে দীপ্রকে বলল, চল, ফিরতে হবে।
এত তাড়াতাড়ি? তুমি চলে যাও, আমি প্রভাকে দিয়ে আসব।
পিয়া বলল, চল, চটপটি খেয়ে আসি। ভাইয়া চলেন, এত আগে গিয়ে কি করবেন?
শুভ্র বলল, না, আমি যাব না৷ এত খাবার পরে চটপটি পেটে সহ্য হবে না৷
সুপ্রভা দীপ্রকে বলল, চল যাই।
সুপ্রভার আগ্রহ দেখে দীপ্র বলল, ভাইয়া যেতে না চাইলে বাদ দে ওকে। আমরা চল।
শুভ্র চলে গেল। বাকিরা গেল কলেজ মাঠের পাশে চটপটি খেতে।
এই জায়গাটায় লোকাল ছেলেপেলেরা আড্ডা দেয়।
মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুভ্র দীপ্রকে ফোন করে বলল, এই জায়গায় অনেক ফালতু ছেলেপেলে আছে, ওদের নিয়ে আসিস না৷
কিন্তু শুভ্রকে তেমন গুরুত্ব দিলো না দীপ্র। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে আসলে একটু অন্যরকম হয়ে গেছে ভাইয়া। ক্রাউড পছন্দ করছে না।
কিন্তু সত্যিই সুপ্রভাকে দেখে কয়েকটা ছেলে টিজ করতে শুরু করল।
-আরেএএএ, অস্থির, জটিল, ঝাক্কাস!
সুপ্রভা বুঝতে পেরে বলল, দীপ্র কিছু বল তো ওদের!
দীপ্র বলল, বাদ দে, ওরা নিজেরা কথা বলছে।
কিন্তু হুট করেই শুভ্র কোথা থেকে এসে পড়ল মাঠের কোণে। গাড়ি থেকে নেমে ছেলেগুলোকে ডাকল, কি বলছিলে?
তাতে আপনার কি?
না, আবার বলো, আর কাকে বলছিলে?
সুপ্রভা দীপ্রকে বলল, ওনাকে ঝামেলা করতে বারণ কর। আমরা চলে যাচ্ছি।
কিন্তু শুভ্র ছাড়ার পাত্র না। অগত্যা ছেলেপেলের সাথে কথা কাটাকাটি শুরু হলো। একজন এগিয়ে এসে শুভ্রকে ঠেলা দিয়ে বলল, আপনে কে! ফাইজলামি করতে আসছেন!
শুভ্রর মাথায় রাগ উঠে গেল। রাগ কন্ট্রোল না করতে পেরে দিলো একটা ধাক্কা। ছেলেটা পড়ে গেল।
আরো কয়েকটা ছেলে এসে শুভ্রর সাথে ধাক্কাধাক্কি শুরু করবে এই সময়ে সুপ্রভা বিপদ বুঝে এগিয়ে এসে বলল, কি হচ্ছেটা কি! শুভ্র, চলো এখান থেকে!
দীপ্র বিষয়টা খেয়াল করল, কিন্তু মেলাতে পারল না। ভাইয়াকে প্রভা তুমি করে বলছে, তাও নাম ধরে, ওরও রাগে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে
শুভ্রর হাত টেনে গাড়িতে ঢুকিয়ে দিলো, দীপ্ররাও উঠে বসল। সবাই ঘটনাটা নিয়ে কথা বলছিল, কিন্তু শুভ্র বা সুপ্রভা একটাও কথা বলল না। একদম চুপ করে রইল।
সুপ্রভা মনে মনে ভাবল, পোশাকটা বদলে গেলে হয়তো এরকম আজেবাজে কথা বলত না। শুভ্রকে কি সরি বলবে! না থাক দরকার নাই! শুভ্র রেগে আছে, রাগটা সুপ্রভার উপর সেটা প্রভা বুঝতে পারছে৷ এটা এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তবুও প্রভার মন খারাপ লাগতে লাগল।
প্রভাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল।
পরদিন প্রভা ঠিক করল, শুভ্রকে সরি বলে আসবে।
প্রেম না থাকুক, শুভ্রকে ইগনোর তো করতে পারছে না, সম্পর্কটা এত ভারী করে রাখারও কোনো মানে হয় না। তাছাড়া দীপ্র সুপ্রভার কাছের বন্ধু। এই বন্ধুত্ব তো সুপ্রভা নষ্ট করবে না৷
তাই বিকেলের দিকে দীপ্রদের বাসায় গেল সুপ্রভা।
দরজা খুলে দিলো দীপ্র৷
প্রভা জিজ্ঞেস করল, তোর ভাইয়া কই?
– ও ভাবল আগে সরি বলে তারপর দীপ্রর রুমে বসবে।
-রুমে আছে। কোনো দরকার?
-কাল আমাদের জন্য ঝামেলা করল৷ সরি বলে আসি।
-যা, ইউএস বাসিন্দা তো, সরি টরি লাইক করবে। তারপর রুমে আয়।
সুপ্রভা তাই শুভ্রর রুমে উঁকি দিয়ে ফেলল।
এদিকে শুভ্রর ফোন এসেছে, নেভিন ফোন করেছে ইউ এস থেকে, ভিডিও কল। শুভ্র রিসিভ করেছে। নেভিন বিকিনি পরে আছে,
-হ্যালো, শু, কি করছ? আমাকে কী ভুলেই গেছ!
-না সুইটি, তোমাকে ভুলব কি করে! ফ্যামিলির সাথে টাইম স্পেন্ট করছিলাম!
-ইউ নো শু, আই মিস ইউ এ লট!
-আই মিস ইউ টু বেবস! বাট আই উইল কল ইউ ল্যাটার। আ্যাম এ লিটল বিজি নাউ।
-বাট আই ওয়ানা সি ইউ, প্লিজ ডোন্ট লিভ দ্য কল!
-দ্যান ওকে!
-টেক ইউর টাইম, নেভিন ফোন অন রেখে কিচেনে কাজ করছে, শুভ্র ঢুকেছে ওয়াশরুমে।
আর প্রভা উঁকি দিলো তখনি। শুভ্র বোধহয় ওয়াশরুমে। ফোনটা স্ট্যান্ডে সেট করা টেবিলের উপরে। প্রভা হাঁটতে হাঁটতে টেবিলের সামনে গিয়ে দেখল, ভিডিও কলে একটা মেয়ে, সে বিকিনি পরে সবজি কাটছে।
শুভ্র ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ওয়াশরুমে তো কেউ তৈরি হয়ে যায় না, খালি গায়ে একটা হাফপ্যান্ট পরা ছিল শুভ্র। প্রভাকে দেখে চমকে গেল শুভ্র, প্রভা টেবিলের সামনে।
সুপ্রভা একবার ফোনে আরেকবার শুভ্রকে দেখে রুম থেকে বের গেল।
চলবে
শানজানা আলম