#আসক্তি২
পর্বঃ৫১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
রাত গভীর, জ্বলজ্বল করছে থানার প্রধান অফিসকক্ষ।শান গাড়িটা সাইডে পার্ক করে রেখে পা চালিয়ে ভিতরে ঢুকতেই সম্মুখেই দেখতে পায় কাচুমাচু করে দাঁড়ানো সালাম কে।পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা না করেই হাত যতোদূরে উঠানো যায়, যতো শক্তি প্রয়োগ করা যায় ততোটাই জোড়ে থাপ্পোর বসায় সালামের কান বরাবর।সিটকে কয়েকহাত দূরে পরে যায় সালাম।হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় পরশ। অন্যান্য অফিসাররা হতবাক।কারো মুখ দিয়ে যেন কোন কথাই আসছে না।পরশ চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে শানের কাছে ফিরে আসে। রাগে কাঁপতে থাকা শানের কাঁধে ভয়ে ভয়ে হাত রাখে পরশ।এরপর সবাইকে চোখের ইশারায় বাহিরে যেতে বলে।
“রিল্যাক্স,শান।এতো মাথা গরম করা যাবে না। বস এখানে”,বলতে বলতে পরশ শানকে পাশে রাখা চেয়ারটায় বসতে বলে।তখনও রাগে ফোঁস ফোঁস করছে শান।রাগীচোখে চেয়ে আছে সালামের দিকে।ফুঁপিয়ে নাক টেনে কেঁদে চলছে সালাম।
পরশ সালামকে এনে অন্য আরেকটি চেয়ারে বসায়।সালাম কাঁদো কাঁদো মুখে ভয়ে জড়সড় হয়ে খানিকটা দূরে বসে।
“এবার সবটা বলো তো”,সালামের উদ্দেশ্যে বলে পরশ।
সালাম কোন প্রতিউত্তর না করে চোরের মতো নজর এদিক সেদিক করে।
“কি হলো, বলবা নাকি অন্য ব্যবস্থা করব”,রাগে দাঁতে দাঁত পিষে বলে পরশ।চোয়াল শক্ত হয়ে আসে শানের।
উঠে আরেকবার সালামের দিকে তেড়ে যেতেই ও হড়বড়িয়ে বলে,”বলছি বলছি স্যার।তবু মাইরেন না”
বলতে বলতে গাল চেপে কেঁদে ফেলে সালাম।
“হুম বলো এবার”
“স্যার সেদিন সন্ধ্যার সময় আকাশডা খারাপ হইলো।সেই আন্ধার হইয়া আইলো। আমি প্রসাব করবার গেছি।ফিইরা আইসা দেহি ম্যাডাম বাড়ির ভিত্রে ঢুকতাছে।আমি ভাবলাম হয়ত কোন কামে হইবো।আমি আমার মতো খাড়ায়া আছি আমার ঐ ঘরে।আর সবখানে দেখতাছি।হেরপরে একজন মানুষ আইলো লম্বা মতোন।আমি আটকাইলে কয়’শান স্যার দরকারি কামে তারে পাডাইছে।’
পরে আমারে কিছু কাগজ দেহায়া কয় এই কাগজ গুলো দরকারি।যেগুলো রাখপার জন্যে শান স্যার নাকি হেরে পাডাইছে।আমি আর কিছু কইলাম না।
পরে জোড়ে ঝড় আইলো।আমি খালি কই ঐ ব্যাডা আহে না ক্যান।হের খানিকক্ষণ পরে রনি ভাই আর রাফি আইলো।আমার তহন আর কোন চিন্তা আইলো না।ভাবলাম রনি ভাই তো আইলোই!”
“তুমি কি রনি বা রাফিকে কিছু বলার দরকার মনে করলা না?এই ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় একা একটা মেয়ে বাড়িতে গেলো, তারপর একটা ছেলে ঢুকলো।তোমার তো বলা উচিত ছিলো ওদের”,জের ধরে প্রশ্ন করে পরশ।
“স্যার আমি অতোকিছু ভাবি নাই স্যার”
“আচ্ছা তারপরে বলো”
“তারপর স্যার বৃষ্টি থামার ১০ মিনিটের মইধ্যেই ঐ ব্যাডা বাইর হইয়া আহে।আমার বউ কল করছিলো হের লগে কথা কইতেই ব্যাডা বাইর হইয়া যায়। পকেটে ঐ সাদা কাগজ গুলা নিয়া।তার পরপরই রনিভাই আর রাফি গাড়ি কইরা আবারও বাইর হয়।আমি তহনো কতা কইতে আছিলাম স্যার।আমি বুঝবার পারি নাই স্যার।”,বলেই শানের দিকে তাকিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দেয় সালাম
“কান্না থামাও।”,রাগে বজ্রকন্ঠে বলে পরশ।
শান দু’হাঁটুর মাঝে মাথা নিচু করে বসে আছে।
শানের দিকে ভয়ার্ত মুখে বার বার চোরাচোখে তাকায় সালাম।এরপর আবার বলতে শুরু করে,”রনিভাইর গাড়ি বাড়ির বাইরে যাওয়ার সাথে সাথেই গেড দিয়ে আরেকটা ছ্যারা ঢোকে।আমি ফোনডা কাইট্টা হেরে আটকাইয়া দেই।তহন স্যার হেয় আমারে এই জাগায় একটা ঘুষি মারে “,চোয়াল দেখিয়ে বলে সালাম।
আবার বলে,”আমি তব্দা খায়া পইরা যাই। হেই ব্যাডা তহন বাড়িত ঢোকে।আমি উইঠ্যা গিয়া আবারও হের সামনে দাঁড়াইলে আমারে কয়’তোরে পিচ পিচ করমু।সামনে থেইকা সইরা যা’
আমি না সরলে আমারে…….. ”
“তোমায় কি?”,সরুচোখে সন্দিহান দৃষ্টিতে পরশ সালামের দিকে তাকায়।
শান এতোক্ষনে মাথা তুলে তাকায়।অনুভূতিহীন চোখে সালামের দিকে তাকিয়ে বলে,”আর দুটো দিন কি সময় দেয়া গেলো না সালাম ভাই?”
পরশ অবাক হয়ে শানের দিকে তাকায়।জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কিসের দুটো দিন ?”
“আমি তো বলেছিলাম তোমার বোনের বিয়ের সম্পূর্ণ খরচ আমার।শুধু মিটিং টা শেষ হতে দাও।এটুকুই তড় সইলো না তোমার?সামান্য কয়টা টাকার জন্যে নিজের বিবেককে বিক্রি করলে?”,অসহায় কন্ঠে প্রশ্ন করে শান।
একাধারে কেঁদে চলেছে সালাম।নাক টেনে টেনে বলে,”আমার ভুল হয়া গেছে ভাইজান।আমার তহন কিচ্ছু মাথাত আছিলো না।বউডা বার বার ফোন কইরা কচ্ছিলো বোনডার বিয়া ভাইঙ্গা যাইবো টাকার অভাবে।তাই… ”
“তাই তুমি মালিকের সাথে এতো বড় নিমোকহারামি করলে?”,রাগে গর্জিয়ে বলে পরশ।
স্বগতোক্তি করে পরশ বলে,”তারপর কি হলো বলো?”
“স্যার ঐ ব্যাডা আমার হাতে অনেকগুলা টেহা ধরাই দিলো।কইলো ‘এইহানে হাজার পঞ্চাশেক টেহা আছে,রাহো।আর কেউ আইলে আমারে খবর দিবা’।টেহা দেইখা আমার মাথা আউলাই গেলো।আমি আইস্সা বইলাম গেডের ধারে।এরপর কিছুক্ষন ম্যাডামের চিল্লানির আওয়াজ কানে আইলে আমি ভয় পাইয়া যাই।তহন দৌঁড়ে বাড়ির দিকে ছুটতেই ঐ ব্যাডা বারায়া আহে।আমি জিগাইলাম ‘ম্যাডামের কি হইলো’
কয় তোরে এতো কতার কৈফিয়ত দিমু না’
বইলাই আরো অনেকগুলা টেহা দিলো।হেরপর এক সেকেন্ড দেরি না কইরা হনহন কইরা চইলা যায়।আমি ভয়ে দোয়া দরূদ পড়তাছি বইসা বইসা।মনে কইলো একবার ভিত্রে যাই আরেকবার কইলো না থাউক।এইসব ভাবতেই ভাইজান আয়া পরে।আমি ভয়ে ভয়ে গেড খুইলা দেই।ভাইজান আমারে জিগায় ‘কেউ আইছিলো কিনা’
আমি সোজা বইলা দেই ‘আহে নাই’
হেরপর ভাইজান ভিত্রে গেলে আমি বইয়া বইয়া ভাবি আমি কি করমু অহন।ম্যাডামের কি হইলো?ভাইজান যদি আমায় ধরে!
এইসব ভাবতে ভাবতেই মেলা সময় পরে কানে ভাইস্সা আহে ভাইজানের গালা।আমি দৌঁড়ে ভিত্রে যাই।দরজার আড়াল দিয়া দেহি ম্যাডামের হারা গায়ে রক্ত।রান্নাঘরে রক্তর ছড়াছড়ি।আর ভাইজান ম্যাডামরে বুকে জড়ায়া কানতাছে।আমি ভয় পাইয়া যাই।দৌঁড়ে বাইরে আইসা টেহাগুলা নিয়া দেশের বাড়িত চইলা যাই।বিশ্বাস যান স্যার আমি কিচ্ছু করি নাই”
“এতোবড় কাজ করেও বলছো কিচ্ছু করো নাই?”,সজোড়ে আরেকগালে চর মেরে বলে পরশ।
আবারও কেঁদে ওঠে সালাম।
________________
আবারও মুখোমুখি বসানো হয় শান আর আয়ানকে।কারন এখন স্পষ্ট আয়ান রেইপ করে নি। আয়ানের পরে আরো একজন বাড়িতে ঢোকে।তাহলে সেই ব্যক্তি টা কে?
“যা যা জিজ্ঞেসা করব সবটার সোজা উত্তর দিবা,ওকে”,চোখ রাঙ্গিয়ে বলে পরশ
আয়ান কটাক্ষের স্বরে হেসে বলে,”বাঘ যতোক্ষন খাঁচায় বন্দি ততোক্ষনে যা ইচ্ছে করো।খাঁচা থেকে বের হলে কিন্তু রক্ষা নেই”
“বেশি ভাট না বকে আগে বের হয়ে দেখা।এমন মামলা সাজাবো না সারাজীবনেও জেলের ঘানি টেনে শেষ করতে পারবি না”
শানের মন বলছে আয়ান সবটা জানে।টেবিলে দুইহাত রেখে একটু এগিয়ে বলে,”আমার বাচ্চাটাকে মেরেছিস তুই। বাকিটা অন্য কেউ করেছে।এবার বল অন্য লোকটা কে ছিলো?কি ঘটেছিলো সেদিন? শুরু থেকে সব বল”
আয়ান কিছুক্ষন শানের দিকে তাকিয়ে বলে,”ঐ মাল নিয়ে সংসার করবি তুই?হাহাহা…..এতোটা নিচুু রুচি তোর?”
শান রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না।একটা ঘুষি মারে নাকের ডগা বরাবর।নাক থেকে রক্ত গড়িয়ে পরে মূহূর্তেই।
“যা বলছি তার উত্তর দে ”
এরপর হাসি মুখে বজায় রেখে আয়ান বলে,”সেদিন আমাদের মাসিক মিটিং ছিলো উত্তরার মেইন অফিসে।আই মিন তোর বাড়ির পাশেই।আমি তোর ব্যপারে সব খবরাবখবর নিয়ে তবেই কাগজপাতি সমেত সিলেট থেকে ঢাকা আসি।কমিউনিটি সেন্টারে ঢোকার পরে তোর পরিবারের প্রত্যেকটা লোকের উপর আমার নজর ছিলো।সেকেন্ডের খবর সেকেন্ডেই পেয়ে গেছি।যখন জানতে পারলাম পাখি আবারও বাড়িতে আসে তখন আমি আর সুযোগের লোভটা সামলাতে পারি নি।পুলিশ যে আমাদের গোপন ভাবে ফলো করছিলো সেটা কখনোই মনে পড়ে নি।এরপর আরকি, ঝড় শুরুর আগেই পাখি বাড়িতে ঢুকলো।আমিও পিছন পিছন ঢুকলাম কিছুক্ষন পর।।তোর ঐ ছাগল দারোয়ানটটা বড্ডো বোকা।তোর কথা বলাতেই সুরসুর করে ভিতরে যেতে দিলো।তোর বাড়িতে পা রাখতেই ঝড় শুরু হয়ে যায়।চলে গেলো বিদ্যুৎ। আশাপাশে চোখ বুলিয়ে ফোনের ফ্লাশ জ্বালালাম।তখন দেখি উপর থেকে ফোন হাতে কেউ নামছে।পরে কন্ঠের স্বরে বুঝলাম সেটা পাখি ছিলো । আমিও কিছু না বলে চুপচাপ দুই পা আগালাম।আর ও তখনি উপরে যাচ্ছিলো;হয়ত ভয়ে।কারেন্ট আসায় ও থেমে পিছনে আমার দিকে একবার দেখলো।ভয়ে চুপসে যায় মূহূর্তেই। ফোন, ব্যগ সবটা হাত থেকে পরে যায় ওর। পিছন ফিরে দৌঁড়াতেই আমি ওর নাগাল পেতে দৌঁড়ে আঁচল ধরি।ও শাড়ি খুলে ছুড়ে মারে আমার মুখের উপর।ভেবেছিলো আমি ওর জন্যেই এসেছি। হাহাহাহাহা”,
“নির্লজ্জের মতো না হেসে বল”,দাঁত কিড়মিড় করে বলে পরশ।
“তারপর কি আর!দরজা লাগালো। অনেক ধাক্কাধাক্কি করলাম খুললো না। আমিও একটা চালাকি করলাম।চলে যাওয়ার ভান করে পাশের ঘরে এসে দরজার আড়ালে দাঁড়ালাম।আমি জানতাম ও বের হবে।যা ভাবা তাই।১৫ মিনিট পর সে দরজা খুললো।আর পাখি এসে নিজেই ধরা দিলো আমার খাঁচায়।বিপদ থেকে বাঁচতে শিটকিনি লাগালো।কিন্তু জানতো না ঘরে আমি আছি।আমি ওকে আটকে ফেলি।বার বার বলেছি আমি তোর কিছু করব না;দাঁড়া।কিন্তু ভয়ে ও এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিলো।আমারও রাগ আর ধরলো না।সোজা বসালাম দুইগাল বরাবর দুইটা।”
“আর বলতে হবে না, বাকিটা আমি জানি”,চোখ মুখ কুচকে বলে শান।পরশ শুকনো মুখে চেয়ে থাকে শানের দিকে।
শান সেদিকে একবার চেয়ে বলে, “পাখিকে রেখে জানালা দিয়ে পালাইলি।তারপর কি হলো?”
“বাব্বাহ, এতো কথা কে জানালো তোকে?তোর বউ? সুস্থ আছে তাহলে এখনো?
চোয়াল শক্ত করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতেই পরশ হাত ধরে ফেলে। আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,”যা জানতে চাইছে বল”
“আমি সাইন করা দলিলটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বের হয়ে যাই।আমাদের অফিসে ঢুকতেই বাবাকে দলিলটা এগিয়ে দেই।বাবা অনেক বেশিই খুশি হয়।বাবার হাত থেকে দলিলটা কেড়ে নেয় রায়ান।দলিলে আমার একার নাম দেখে ও খুব রেগে যায়। কিভাবে সাইনটা করিয়ে নিয়েছি সবটাই জানাই বাবাকে।পাখির অবস্থার কথা শুনে বাবাও কিন্তু একটু মন খারাপ করেছিলো।কিন্তু ওতগুলো সম্পদের কথা চিন্তা করে সবটা ভুলে যায় ।আমার সাথে রায়ানের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বাবা ওকে এসে থাপ্পোর দেয়।আর ও তখনি বাবার কলার চেপে ধরে।আমি রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে উরাধুরা মাইর শুরু করে দেই। তারপর ও রাগে ক্ষোভে বেড়িয়ে যায়।…….এক মিনিট….. পাখির ঐ অবস্থার সুযোগ একমাত্র রায়ানই নিতে পারে। কারণ ও একজন স্যাডিস্ট “,বলতে বলতে পরশের দিকে তাকায় আয়ান।
পরশ জহুরে চোখে আয়ানকে দেখে নিয়ে দৃষ্টি রাখে শানের দিকে
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আয়ান ঠিক বলছে”
“মনে হয় মানে?আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত।এটা রায়ানের কাজ।কারণ এতো নোংড়া, বিকৃত কাজ ও ছাড়া কেউ করবে না”
শানের কান তব্দা মেরে আসে।চোখের সামনে ভেসে উঠছে পাখির হৃদয়বিদারক করূন মুখটা।কানে ভাসছে গগন কাঁপানো চিৎকার।বুকের একদম গহীন থেকে বের হয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।
________
“স্যার, উপর মহল থেকে ফোন এসেছে।আপনাকে চাচ্ছে”,টেলিফোন চেপে ধরে পরশকে উদ্দেশ্য করে বলে জায়েদ।
পরশ পাংশুটে মুখে এগিয়ে ফোনটা হাতে নেয়।
“অতিরিক্ত সময় আমার হাতে নাই।কোন প্রশ্ন নয়, স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ী সহ তার ছেলেকে এভাবে আটকে রাখার সাহস হয় কি করে তোমার?এতো ঔদ্ধত্য পাও কোথায় তোমরা।”,কথাগুলো ভীষণ রাগ দেখিয়ে বলে ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা।
রাগে গা কাঁপতে থাকে পরশের। কিন্তু কিছুই যে করার নেই। আইনের ক্ষমতা তার হাতে থাকলেও প্রয়োগের ক্ষমতা তার হাত নেই।আয়ানের সেলের দিকে এগোতেই অট্টোহাসিতে ফেটে পরে আয়ান।
হাত বাড়িয়ে পরশের থেকে ফোনটা চায়।ফোনটা বাধ্যের মতো এগিয়ে দেয় পরশ।আয়ান একটা নম্বর ডায়াল করে ফোনটা কানে ধরে,”সবটার ব্যবস্থা করো। ভোরের আলো ফুটতেই আমি রওনা দেবো”
কথা শেষে দুই ঠোঁট গোল করে সিস দেয় আয়ান।পরশকে উদ্দেশ্য করে বলে,”সকালেই চলে যাচ্ছি আমেরিকা।পারলে এই সময়র মাঝে কিছু করিস”
এরপর ফোনটা এগিয়ে দেয় পরশের দিকে।
🌸🌸🌸
“এখন কেমন লাগছে? “,পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে শান।
শুকনো মুখে জবাব দেয় পাখি,”ভালো”
“আমরা তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাবো। ঠিকাছে!”
শানের কথায় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে পাখি।
তিনদিন হয়ে গেছে পাখিকে কেবিনে শিফ্ট করার।সবটাই এখন একটু হলেও স্থিতিশীল। নিজের ভালোবাসায় সবটা আগলে নিয়েছে শান।বাড়ি থেকে সবাই সকাল বিকাল আসছে। দেখে শুনে কথা বলে চলে যাচ্ছে।কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ইনায়াহ্’কে নিয়ে।সে কিছুতেই পাখিকে কাছ ছাড়া করতে চায় নি।খুব বেগ পেতে হয়েছে ইনায়াহ্’কে বাড়িতে পাঠাতে।শান সার্বক্ষণিক পাখির সাথে সাথে থাকছে।মেডিসিন থেকে শুরু করে সকল প্রয়োজনে এগিয়ে আসছে শান।সবসময় নানান কথায় ডুবিয়ে রাখছে পাখিকে।
__________
“তুমি ঘুমাও না কতোদিন?”
পাখির মুখে তুমি ডাকটা যেন শত সহস্র বছর পর শুনতে পেলে শান।শীতল বাতাস বয়ে গেলো সারা শরীরে।নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।
“ঘুমকে আপাতত ছুটি দিয়েছি।কিছুদিন থাকুক, রেস্ট নিক।তারপর না হয় আবার চাকরিতে জয়েন করবে…..হুমম নাও”,বলেই ঔষধটা এগিয়ে ধরে পাখির মুখের কাছে।
“আমার আর ঔষধ খেতে মোটেও ভালো লাগছে না “,ঠোঁট উল্টিয়ে বলে পাখি।
গালে একটা মৃদু চুমু এঁকে শান বলে,”না খেলে সুস্থ হবে কি করে?আমাদের তো একসাথে বুড়া বুড়ি হওয়ার কথা! ”
ফ্যালফ্যাল করে অনুভূতিহীন চোখে চেয়ে থাকে পাখি।
শান মুখের ভাবটা কঠিন করে বলে,”বাই দ্য ওয়ে তুমি কি আবারও বাজে কিছুর চেষ্টা করছো নাতো?শোন পাখি যদি এরকম কিছু মনে থাকে…..”
“উহু, আমি বাঁচব।আমি বেঁচে থাকব।আমার যে বাঁচতেই হবে।আয়ানের কঠিন মৃত্যুটা আমায় বেঁচে থাকার পথে একধাপ এগিয়েছে।এবার রায়ানের মৃত্যুর অপেক্ষা।এরপর প্রাণভরে বাঁচব।তোমার জন্যে বাঁচব, আমার ইনায়াহ্’র জন্যে, আমাদের পরিবারের সকলের জন্যে বাঁচব।”,একধ্যানে কথাগুলো বলেই পাখি হা করে শানের হাত থেকে ঔষধ টা খেয়ে নেয়।
____________________
সেদিন রাতে বাধ্য হয়েই আয়ানকে ছেড়ে দিতে হয় কোন প্রকার কোন কথা ছাড়াই।আয়ানকে ছাড়াতে যে ব্যক্তি স্বশরীরে এসেছিলেন তাকে দেখেই ঘৃনায় নিজের পেশার উপর আস্থা উঠে যায় পরশের।অন্যকোন উপায় থাকলে এই পেশায় আর এক মূহূর্তও থাকতো না পরশ।থম মেরে বসে পরে চেয়ারে।ঠোঁটের ডগায় শুধু বিড়বিড় করে, “এদেশে আইন আছে, প্রয়োগও আছে তবে সেটার নির্দিষ্ট স্থান নেই”
ভোর হতে হতেই আয়ান প্রাইভেট কারে বেড়িয়ে পরে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।মাঝপথেই ভীষণ বাজেভাবে দূর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়।যে দূর্ঘটনা কেড়ে একজন দাম্ভিক, পাপি, খুনি আয়ান নামোক মানুষটার প্রাণ। বিভৎস ভাবে পুড়ে যায় পুরো অবয়ব।শেষ হয়ে যায় নরপিশাচ আয়ানের অধ্যায় এ পৃথিবীর বুক থেকে।
______________
“একটুখানি ঘুমাও না, তোমার চোখের নিচে কালি পরে গেছে তো।আমি তো এখন ঠিক আছি।”,অনুনয়ের স্বরে দূর্বল কন্ঠে বলে পাখি।
“তোমার রাতের ঔষধ আছে জান, সেটা খাওয়াতে হবে তো”
“রাত হতে অনেক সময় বাকি।সবে তো মাত্র সন্ধ্যা”
“উফফ,বউয়ের কাছে ঝগড়ায় কোন পুরুষটা পেরে ওঠে আমারে কেউ যদি তার ঠিকানা দিতো।কয়টা টিপ্স শিখতাম।আচ্ছা বউরা এতো খেচাখেচে টাইপ হয় কেন?খালি হুকুম করে”,বলেই শান কোমড়ে হাত দিয়ে মুখটা বাংলার পাঁচ ছয় সাতের মতো করে দাঁড়িয়ে থাকে।
পাখি ঠোঁট টিপে হেসে দেয়।শান আড়চোখে একবার তাকিয়ে সে হাসির শোভা আস্বাদন করে।পাখির মুখে শেষ হাসি দেখেছিলো রনির বিয়ের দিন সকালে। আর আজ পাঁচ টা দিন চলে গেলো। পাঁচদিন পর হেসে উঠলো পাখি।যেন ধরনীতে মরুর বুকে বৃষ্টির পূর্বাভাস।
পাখি হাত টেনে নিতেই হকচকিয়ে ওঠে শান।ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে পাখির দিকে তাকায়।পাখি হাত টেনে বিছানায় নিজের পাশ ঘেঁষে বসতে দেয়।শানের ডানহাতটা মুঠোভরে নিয়ে ঠোঁট ঠেকিয়ে দেয়। কিছুক্ষন নিশ্চুপ থাকতেই বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গরম জল গড়িয়ে পরে দুই কানের পাশ দিয়ে
“এই যে, দেখো আবার শুরু হয়ে গেলে তাই না!এসব কি পাখি?এতো স্ট্রং একটা মেয়ে কখনো এভাবে কাঁদে না।তোমার পরিবার তোমায় ছাড়ে নি,আল্লাহ্ তোমায় পৃথিবী ছাড়ার ডাক দেয় নি,তোমার স্বামী তোমায় একটা সেকেন্ডের জন্যেও দূরে সরালো না তাহলে কেন কাঁদছো?তাহলে কি ধরে নিবো আমার ভালোবাসায় কমতি ছিলো?”,গলার স্বর একদম খাঁদে ফেলে বলে শান।
পাখি নাক টেনে লাল লাল চোখ দুটো খুলে শানের দিকে তাকায়।মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না পাখির।হাজার কথা বলার ছিলো শানকে।হাজার শব্দ যেন গলার কাছে এসে হুরমুর করছে বেড়িয়ে আসার জন্যে।ঠোঁট খুলে কিছু বলতেই শান ঠোঁটে হাত রাখে।
“উঠব”,অত্যন্ত ভেঙ্গে আসা কন্ঠে বলে পাখি।
শান ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি রেখে পাখির মাথার পিছনে সন্তোর্পনে হাত রেখে ধরে বসায়।পিঠের নিচে একটা বালিশ ঠেকিয়ে বলে, “এবার বসো”
“আমি জীবনে নিজেকে অনেক বেশিই হতভাগি ভাবতাম।বাবা মা যখন ছেড়ে গেলো, খুব অসহায় হলাম…..”
“বাদ দাও না জান এসব,আমি তো সব জানিই”
মৃদু হেসে পাখি বলে,”আজ এমন কিছু বলব যা তুমি জানো না।তোমার জানাটা জরুরী ”
শান আর কিছু বলতে পারে না।
“বাবা মায়ের পর বড় বাবার সংসারে হাজার চেষ্টা করেও বড় মার মন জয় করতে পারতাম না।ঐ সংসারে শুধু ইরা ছাড়া কেউই আমায় ভালোবাসত না।তারপর এলো আয়ান।মনের সবটা জায়গা জুড়ে তাকে বসালাম।তারপর জানতে পারলাম ও পুরোটাই একটা মিথ্যে চরিত্র।মন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।বিয়ের দিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত জানতাম না আমি কোথায় যাবো।খুব ভয় লাগলো।রাস্তায় তোমার গাড়ি।কিন্তু আমায় তুমি সাহায্য করতে নারাজ ছিলে”
“আমি সত্যিই তোমার কাছে সারাজীবন ক্ষমা চাইবো এ কারণে”,নতমুখী হয়ে বলে শান।
“তারপর এসে পরলাম তোমার বাড়িতে।এখানে এসেও নিজেকে পদে পদে খুব অসহায় লাগল। মনে হতো এই পৃথিবী আমার জন্যে না।আর আজ! আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সর্বচ্চ সুখী, ভাগ্যবতি যদি একজন মানুষও থাকে সে মানুষটা হবে পাখি।
জীবনে বেঁচে থাকার সমস্ত আশা নিভে গেছিলো যখন অনুভব করলাম আমি ধর্ষিতা।শুধু মনে হতো আমার শানকে আমি কি জবাব দিবো!না পারলাম তার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে, না পারলাম তার প্রাণপ্রিয়ার সম্ভ্রম বাঁচাতে।মনে মনে হাজার বার নিজের মৃত্যু কামনা করেছি।আজ ভয় হচ্ছে আল্লাহ্ যদি আমার কামনাটা পূরন করতেন তাহলে খুব আফসোস হতো।এতো ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতাম।
কিভাবে পারলে আমায় নতুন করে এতোটা আপন করতে!কিভাবে পারলে আমায় মেনে নিতে?”
শান কোন জবাব না দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসা পাখির কোলে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে ধরে।সদ্য অস্ত্রপচার হওয়া স্থানে হাত বুলিয়ে আবারও আলতো হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে।গত কয়দিনের অযত্নে বেড়ে ওঠা লম্বা, রুক্ষ, শুষ্ক চুল গুলোয় হাত বুলিয়ে পাখি বলে,”বলবে না? ”
“তুমি আমার সেই শ্বাস যাকে ছেড়ে মূহূর্ত কাটানো দূর্ভিষহ। তুমি আমার সেই মূহূর্ত যাকে ছাড়া সকাল বড্ডো প্রাণহীন, দুপুর ক্লান্তিহীন, বিকেল বিষাদময়, আর রাত্রি নিদ্রাহীন।তুমি আমার সেই নিদ্রা যাকে ছাড়া রাতের অস্তিত্ব বড্ডো বিলীন।তুমি আমার সেই অস্তিত্ব যাকে ছাড়া আমার পৃথিবী রঙ্গহীন।আমার সাত রঙ্গে আঁকা জীবনের ক্যানভাস তুমি।আমার আসক্তি তুমি, যাকে ছাড়া শূন্য এই আমি।”
ছলছলে চোখে পাখি শানের মাথায় একটা চুমু দিয়ে চেয়ে থাকে নিষ্কলুষ,ভণিতাহীন একটা মুখোবয়বের দিকে।
অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,”কথা দিয়েছিলাম নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমাকে বাবা ডাক শোনাব।পারলাম না আমি”
শান স্বাভাবিক ভাবেই বলে,”একজীবনে সবার সব ইচ্ছে পূরণ হয় না জান।প্রত্যেকটা মানুষই অপূর্ণতা নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য হয়।আর এক জীবনে দেয়া সব কথা কি রাখা সম্ভব হয়!”
শান ঘুম জড়ানো চোখ দুটো টেনে খুলে পাখির দিকে তাকিয়ে আবারও বলে,” তোমার শেষ নিঃশ্বাসের শেষ বিন্দু পর্যন্ত আমায় পাশে পাবে।তুমি আমার সেই আসক্তি যাকে এক মূহূর্তও ভুলে থাকা যায় না ;উহু কোনমতেই না।মনে আছে কথাটা?”
“হুমমম”,চোখে উপচে পরা জল নিয়ে দ্রুত মাথা উপর নিচ করে বলে পাখি।
“হুমমম, আমরা কাল সকালেই বাড়ি যাবো জান”
এরপর চুপচাপ দুজন।এতোদিন পর মাথায় ভালোবাসার আকাঙ্খিত পরশ পেতেই এতোদিনের ক্লান্তি গুলো দলবেঁধে ঘুম হয়ে ধরা দেয় যেন।প্রশান্তিতে ঘুম চলে আসে শানের।
🌸🌸🌸
“স্যার, সিলেট থেকে বলছিলাম”
“আমি এক্ষুনি আসছি……..”
#আসক্তি২
পর্বঃ৫২
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
ছেলেদের শোকে পাথর আজ সেলিনা বেগম।দিনে কয়েকবার করে জ্ঞান হারাচ্ছেন।একছেলের মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতেই ছোট ছেলের গুম হওয়ার খবরে এক পৃথিবী সমান মূর্ছনা তার মাঝে স্পষ্ট হয়।সকাল বিকেল একা একা প্রলাপ বকেই তার সময় কাটছে যেন।
এদিকে নিজের ডান হাত, বড় ছেলে আয়ানের মৃত্যুর খবরে হার্টে এট্যাক আসে আজাদের।খুব বেশি একটা সুস্থ নন তিনি।পাপের বোঝা যেন কাঁধে এসে জেঁকে বসেছে শেষ বয়সে।আয়ানের মৃত্যুর সাত দিন পর ছোট ছেলেটার হারানোর খবর জানতে পারে আজাদ।পর পর এতো বড় ধাক্কাগুলো তিনি সহ্য করতে পারে নি।প্যারালাইজড হয়ে পরে রয়েছেন সেই ২৩ দিন থেকে।
“আম্মা, এমনে শব্দ করে কাঁদবা না একদম। তোমার ছেলেরা তোমাদের দুজনের আহ্লাদে অধঃপতে চলে গেছে।আর যার পাপের শাস্তি তারা পেয়েছে পাবেও”,রাগে গর্জন করে বলে ওঠে ইরা।
শ্বশুর বাড়ি থেকে সদ্য দুই দিন হলো বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে ইরা।ইচ্ছা ছিলো বেশ কিছুদিন থাকার, তা আর হয়ে ওঠে না।বাড়ির পরিবেশ বড্ডো বিষাক্ত লাগছে ।ভাইদের এতো পতনে তার মোটেও খারাপ লাগছে না। কারণ পাখির সাথে হওয়া সমস্ত অন্যায়ের স্বাক্ষী সে।ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে যায় আবারও শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
“যা যা, সবাই চলে যা।আমি একা একটা মানুষই এ সংসারে পরে মরি।আল্লাহ্ আমারে উঠায় না কেন?প্যারালাইজড মানুষটার সেবা করা।সংসার সামলানো তার উপরে ছেলেগুলোরে হারানো।আল্লাহ্ আমার আয়ানরে ভালো রাখো গো মাবুদ।আর আমার রায়ানরে ফিরায়া দেও।”
দাঁত কিড়মিড় করে আবার বলে,”আমার হায় লাগুক ঐ পোড়া কপালির সংসারে।ধ্বংস হোক ওর সংসার।জ্বলে পুড়ে যাক ঐ মা*”
“খবরদার আম্মা। পাখি আপা রে আর একটাও অবিশাপ দিবা না কইলাম।নিজের পাপের শাস্তি পাইতেছো।মেয়েটার জীবনটাই তো ছাড়খাড় করেছো।আর কি বাকি রেখেছো?ওর স্বামী কপাল বড্ডো ভালো ওরে এখনো কতো ভালোবাসছে”,পিছন ফিরে এসে সেলিনার সামনে এসে দাঁত কিড়কিড় করে বলে ইরা
_____
আয়ানের মৃত্যুর ৭ দিন পর হঠাৎ গুম হয় রায়ান।সেদিন পুলিশের দৌঁড়ানি খেয়ে গা ঢাকা দেয় নিজের গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।যখন আজাদ আর আয়ান জেল থেকে বের হয় তখন সে আবারও বুক ফুলিয়ে বেড়ানো শুরু করে।কিন্তু কি হলো, কে জানে?আর খুঁজে পাওয়া যায় নি রায়ানকে।সবার ধারনা হয়ত আবারও গা ঢাকা দিয়ে আছে কোন কারণে।
এই গত একটা মাসে গ্রামে ক্ষমতার প্রভাব কমে গেছে আজাদের।কেউ আর আগের মতো মান্য করে না।পোষা কুকুরগুলো পাশ কেটেছে সেই কবেই।রায়ান যে নিখোঁজ তাতে যেন কারোর কিচ্ছু যায় আসে না।সবটাই মুখ বুজে চোখের জল ফেলে সয়ে যায় আজাদ।বিছানায় যার সকাল শুরু বিছানায় রাত।মরার মতো পরে পরে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোন ক্ষমতাই তার অবশিষ্ট নেই।
🌸🌸🌸
ঘরময় সেদিনের তার আর্তনাদ গুলো কানে ভাসে শুধু।গত একটি মাস ধরে বিছানায় শুয়ে বসে কাটিয়ে, শানের সেবা যত্নে এখন একটু সুস্থ স্বাভাবিক পাখি।যতোটা না সুস্থ তার থেকেও কয়েকগুন বেশি সুস্থতার ভান করে।যাতে শানের মন খুশি থাকে।তবে কিছুতেই এ ঘরে তার প্রাণ টেকে না।আজ উঠে সারা ঘরে একা একা কিছুক্ষন হাঁটলো পাখি।সব ঘটনা যেন জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে।কিছুই ভালো লাগছিলো না।জানলার কাছে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে থাকে।
“কি ব্যপার, কি দেখছো ওখানে?”,
কানে ভাসে শানের বলা কথাটা। হকচকিয়ে চমকে ফিরে তাকায় শানের দিকে।হাফ ছেড়ে বলে,”তুমি!”
শান এগিয়ে এসে হাতের ঘড়িটা, ফোন দুটো, চশমা টা খুলে সাইড টেবিলে রাখে।এরপর এগিয়ে যায় পাখির দিকে।সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বোতাম খুলে দিতে ইশারা করে।পাখি কাঁপা কাঁপা হাতে বোতামে হাত রাখতেই হাত ধরে ফেলে শান।চকিতে মাথা তুলে তাকায় পাখি।
“এখনো এতো কিসের আতঙ্ক পাখি?ডাকলাম, চমকে উঠলে!গা কাঁপছে এখনো থরথর করে।কেন পাখি?আর তো কোন ভয় থাকার কথা নয়”,আহত কন্ঠে বলে শান।
পাখি নজর নামিয়ে বলে,”আমার না এ ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না।সেদিনের কথাগুলো খুব করে চোখে ভাসছে।এতোদিন বলি নি তোমায়।কিন্তু আজ না বলে থাকতে পারলাম না ”
শান বুঝতে পারে পরিবেশ পরিবর্তন করাটা অতীব জরুরী। পাখিকে বুকের সাথে মিশিয়ে সিঁথি বরাবর চুমু এঁকে বলে,”দেখছি কি করা যায়”
কিছুক্ষন দুজনে ওভাবে থেকেই পাখি প্রশ্নাতুর চোখে বলে,”আপনি বেশ কিছুদিন ধরে কোথায় যান?তখন ফোন দিলে ফোনেও পাই না আপনাকে।অনেকক্ষন করে বন্ধ রাখেন ফোনটা।কিছু জানতে চাইলে বলেন কাজ ছিলো।আমার কিন্তু ভালো লাগে না এতো কাজ ”
শান ভ্রুকুচকে বুক থেকে পাখিকে সরিয়ে বলে, “বাড়ির সবাই আসে না তোমার ঘরে?”
“হ্যা আসে তো।সবসময়ই কেউ না কেউ আসে।আর ইনায়াহ্ তো সবসময় কাছে থাকে।তবুও আমি আপনাকে মিস করি “,ঠোঁট উল্টিয়ে অভিমানি স্বরে বলে পাখি।
শান দুষ্টু হেসে বলে,”তাই!!!!! ”
বলতে বলতে মুখ এগিয়ে আনে পাখির দিকে।লজ্জায় শানের বুকে মুখ লুকিয়ে নেয় পাখি। শান তবুও গালে আলতো চুমু এঁকে দেয় জোড় করে।
বুঝতে পারে পাখি কাঁদছে।শার্ট খামচে ধরে কাঁদছে।আপনাআপনি বুকের গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে শানের।পাখির এ কান্না নতুন নয়।ত্রিশ টা দিন এভাবেই শানের ছোঁয়ায় কেঁদে ফেলেছে পাখি।যতোবারই শান ছুঁয়েছে ততোবারই উপচে পরা কান্নার ঢেউ এসে বাসা বাঁধছে চোখে।
শান বুঝতে পারে এ কান্না অনুশোচনার।এ কান্না তাকে বোঝায় অপবিত্র শরীরে পবিত্র স্পর্শের গভীরতা কতোটা। কিন্তু শানের মনে কখনোই এ ভাবনার উদয় হয় নি।
দুইহাতে চোখ মুছিয়ে বলে, “দেখি এদিকে আসো”
বিছানায় এনে বসায় পাখিকে।
“এভাবে কাঁদলে সাগরও শুকিয়ে যাবে রে ভাই!দেখো কতোগুলো দিন হয়ে গেলো। তবুও তুমি এই একটা কারণে এখনো কাঁদো।আর যখন কাঁদো সত্যি বলছি আমার নিজেকে সব থেকে অক্ষম মনে হয়।মনে হয় আমার আকাশ সম ভালোবাসা দিয়েও ঐ সামান্য একটা রাতকে ভোলাতে পারছি না।এটা আমার কতো বড় ব্যর্থতা তা কি তুমি বোঝ?”
পাখি কোন কথা ছাড়াই চোখের জল ফেলে চলেছে।শানের বেশ ভালো করেই জানা এ অসুখের ঔষধ কি।তাই তো কিছুক্ষন চুপ করে একধ্যানে পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে।
এদিকে শানের আর কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মাথা তুলে তাকায় পাখি।আর তখনি মুখটা দুইহাতে আঁজলা ভরে তুলে ধরে শান।কান্নাজড়িত চোখের পানিতে ভেজা পাপড়ি দুটোয় চুমু খায়।প্রতিটা চুম্বনের গভীরত্ব বুঝিয়ে দেয় পবিত্র স্পর্শ কতোটা প্রশান্তিদায়ক।ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে সে স্পর্শ।
🌸🌸
সকাল বেলা ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে বালতিতে জমানো শানের গত রাতের শার্টে চোখ আটকে যায় পাখির।সচরাসচর শান আধোয়া কাপড় এতো গুছিয়ে বালতিতে রাখার মানুষ নয়।অন্তত বিয়ের পর একদিনও ওতোটা গোছালো পায় নি পাখি।কেমন যেন সুন্দর মতো কাপড়ের উপরে শার্টের পিঠটা বিছিয়ে রাখা।
মনের মাঝে খটকা লাগলেও ব্যপারটাকে মনের ভুল ভেবেই কাপড়গুলোকে মুঠোভরে হাতে নেয়।উদ্দেশ্য ওয়াশিং মেশিনে দেয়া।হাতে আঠালো কিছুর অস্তিত্বের অনুভূতি জানান দেয় মন মগজে।দ্রুত হাতের উপরের কাপড় গুলো ফেলে দেয়।একে একে সব কাপড় খুঁজতে থাকে।
চোখ আটকে যায় শার্টের বুক পকেটের কাছে ছিটেছিটি রক্তের বিন্দু দেখে।গা কাঁপা শুরু হয় পাখির।বুকে কেউ যেন বিশাল হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে।সেদিন রাতে চোখের সামনে ওতো ওতো রক্ত দেখার পর সামান্য রক্তের কণিকাও পাখির কাছে ভীতিস্বরূপ।
কাঁপা কাঁপা হাতে শার্টটা হাতে তুলে নিতেই শার্টের ভিতর থেকে চট করে নিচে পরে যায় সাদা রঙ্গের স্যান্ডো গ্যাঞ্জি টা।সেটা দেখে ক্ষীন চিৎকারে দুই কদম পিছিয়ে আসে পাখি।গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় মূহূর্তেই।মুখে দুইহাত চেপে সমানে ফুঁপিয়ে কাঁদে পাখি।
নিজের সারা শরীরের কাটা, ছেড়া জায়গা গুলোতে চোখ রেখে দেখে কোথাও কোন রক্ত বের হয়েছে কিনা।কিন্তু না কোথাও তো রক্ত নেই।
“তাহলে এতো রক্ত কিসের!”,আনমনে বিড়বিড় করে পাখি।
দৌঁড়ে ছুটে যায় ঘরে।বিছানায় বসে শানের সারা শরীরে খেয়াল করে। কোথাও কোন কাটাছেড়া নেই তাহলে রক্তের উপস্থিতি কেন গ্যাঞ্জিতে।
“এই উঠো না “,ক্ষীণস্বরে শানকে ডাকে পাখি।
গত কয়দিনে পাখির যত্নে এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যেন, পাখি সামান্য ঠোঁটের ডগা নাড়িয়ে কিছু বললেও শানের ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
হড়বড়িয়ে উঠে বসে শান।
“কি হয়েছে পাখি?”,পাখির হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে শান।
“তোমার গ্যাঞ্জিতে কিসের রক্ত ওগুলো”,বলতে বলতে রক্তের ছবি চোখে ভাসতেই ভিতর থেকে উল্টি আসে পাখির।দুহাতে মুখ চেপে ধরে।
শান ওর দুইবাহুতে হাত রেখে কপোট রেগে বলে,”তুমি ওসবে হাত দিয়েছো কেন?”
পাখি কোন প্রতিউত্তর না করে মুখ চেপেই শানের দিকে তাকায়।শান পাখির মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে আমতাআমতা করে বলে,”ওসব রং রে বোকা।কাল মেডিকেল রং করিয়ে নিয়েছি তো”
“রং?”
“হুমম রং।এতো ভয় পেতে হবে না।আর ওসবে হাত দিও না।আমি ধুয়ে দিয়ে মেডিকেল যাবো”
পাখির ততোক্ষনে কান্না থেমে যায়।কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসে।গলার কাছে মুখটা ঠেকিয়ে বলে,”আজ না গেলে হয় না!”
থমকে যায় শান।মনে পড়ে সে দিনটার কথা।সেদিন সকালেও একই কথা বলেছিলো পাখি।শান রাখে নি।আর তার পরিমান এতো বড় ক্ষতি।শান ফোন হাতরিয়ে কল করে আনভীরের কাছে।
“আজ একটু সামলে নিও আনভীর।আমি সময় পেলে বিকেলে একবার যাবো ”
“ওকে স্যার, নো প্রবলেম”
🌸🌸🌸
“একটু পানি,একটু পানি দাও কেউ।এক ফোটা পানি দেও আমায়”,ক্লান্ত, শ্রান্ত, রক্তাক্ত শরীরে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলে রায়ান।
হাত পা খাটের চারদিকে ছড়িয়ে লোহার শিকলে বাঁধানো।দীর্ঘ একমাসের বাঁধনে একটি বারের জন্য সে শিকল থেকে মুক্তি পায় নি রায়ান।শিকলে বাঁধানো প্রতিটা হাতের কব্জি ও পায়ের গিড়ায় গিড়ায় ঘা হয়ে গেছে।লোহার ঘর্ষনে সে ঘা যেন মূহূর্তে মূহূর্তে দগদগে হয়ে উঠছে।
সেই দীর্ঘ তিন ঘন্টা একটা ফোঁটা পানির জন্যে তড়পাচ্ছে রায়ান। তৃষ্ণার্ত কুকুরের ন্যায় জিহ্বা একহাত নেমে এসেছে।তবুও উপস্থিত কারোরই একটু দয়া হচ্ছে না।সামনে শটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার দুটো মানুষ।যাদের একজনও কোন দেশী মানুষ নয়।
চোখ বন্ধ করে চোখের দুই কোণ দিয়ে ছেড়ে দেয় অজস্র চোখের পানি।ভাবতে থাকে সেদিনের কথা।
_______
সেদিন রনি রাফিরা অনেক খুঁজেও পায় না পাখিকে।এরপর হতাশ হয়ে চলে যায় তারা।সবই বুঝতে পারে পাখি কিন্তু কিছুই মুখ ফুটে বলতে পারে না।সেন্স হারিয়ে ফেলে পরপরই।নিজেতে ফিরে আসে কোন পিশাচের হাতের জঘন্য স্পর্শে।ব্যথার স্থানগুলোয় আরো বেশি ব্যথা দিচ্ছে লোকটা।চোখদুটো তখনো বুজে আছে পাখি।শক্তি হচ্ছে না লোকটাকে দেখার।গলা ছেড়ে কাঁদতেও পারছে না।কোমড়ের নিচ থেকে পুরো অংশ জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে প্রতিটা মূহূর্তে।দূর্বল শরীরের সমস্ত মনোবল দিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে নিজের এতো কাছে আবিষ্কার কারে রায়ানকে।দাঁতে দাঁত চিপে দুহাতে বুকে ধাক্কা দেয় পাখি।এতে আরো হিংস্র হয়ে ওঠে রায়ান।জীবন যেন যায় যায় তার।
এরপর অপূরণীয় ক্ষতিটা সম্পাদন করে রায়ান। আরো দুই তিন ঘা বসিয়ে দেয় পাখির ক্ষত বিক্ষত হওয়া প্রতিটা স্থানে।পাখির চিৎকারের গতিতে বেড়ে যায় রায়ানের পাশবিক নির্যাতন।প্রতিটা চিৎকারই যেন রায়ানকে এনে দেয় পৈশাচিক সুখ।।এরপর দ্বিতীয় দফায় সজোড়ে চিল্লিয়ে প্রাণ সপে দেয় রায়ানের কাছে।
রক্তে রঞ্জিত পাখির অবচেতন দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে কিচেন কেবিনেটে ঢুকিয়ে রাখে রায়ান।এরপর নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে রক্তে মাখা পুরো শরীর।ঘৃনায় নাক কুচকে রান্নাঘরের পানির খোঁজ করে রায়ান।যতোই রাত হোক কারো না কারো নজরে ঠিকই এই রক্তের চিহ্ন পড়বেই।পুরো রক্ত শরীর থেকে ধুয়ে দ্রুত বেড়িয়ে যায়।
সালামের সাথে কথা শেষ করে বাড়ির একদম বাহিরে চলে আসে।কিছুদূর এগোতেই বুঝতে পারে আয়ান কতোগুলো পুলিশের সাথে দাঁড়িয়ে ছবি উঠাচ্ছে।পাশে তার বাবাও রয়েছে।শুকনো ঢোকে গলা ভিজিয়ে পিছন পথেই দৌঁড়ে অন্য গলিতে ঢুকে পরে রায়ান।এরপর সে রাতেই চলে আসে সিলেটে।
দুইদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকে সীমান্তবর্তী এক জেলে বাড়িতে।স্ববাবতই প্রভাবপ্রতিপত্তি একটু বেশিই হওয়ায় রায়ানের খারাপ স্বভাব জেনেও জেলে তাকে বের করে দিতে পারে নি।এরপর একদিন জেলে বাড়িতে না থাকার সুযোগে নষ্ট করে দেয় তার একমাত্র আদরের ষোড়শী মেয়েটার জীবন।মাথা উচু করেই ছাউনি ছেড়ে চলে আসে রায়ান।খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তার বাবা ভাই ছাড়া পেয়েছে।আর ঠেকায় কে?আসমান যেন হাতের মুঠোয়।রায়ান বুক ফুলিয়ে চলে আসে বাড়িতে।বাড়িতে যাওয়ার পরদিনই সকালে খবর আসে আয়ানের নির্মম মৃত্যু।তাতেও ক্ষান্ত হয় নি রায়ান।নিজেকে তখন রাজ্যের একচ্ছত্র মালিক হিসেব জাহির করা শুরু করলো।ভাই মরার দিন বিকেলেই হ্যাং আউটের জন্যে বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পরে চা বাগানের দিকে।
সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় চোখ পরে চা বাগানের বুক চিড়ে বেড়িয়ে আসা এক নারী অবয়বের দিকে।সিগারেটা পায়ে পিষে এগিয়ে চলে সেদিকেই।যতোই এগোয় অবয়বটা ততোই বাগানের ভিতরে ঢোকে।একটু দূরে এসে চারিদিকে তাকাতেই রায়ানের খেয়াল হয় রাত নেমে গেছে।ঘুটঘুটে আঁধারে ঢেকে গেছে চারপাশে।কিন্তু সে এখন বিশালাকার বাগানটার মাঝখানে।দুইপাশে পাহাড়।রাস্তার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।এরপর চোখ দুটোর উপর চলে আসে কালো কাপড়ের পুরু আস্তরন।নাকে একটা শ্বাস নিতেই দুনিয়া ভুলে যায় রায়ান।নেতিয়ে পরে ঘৃন্য শরীরটা।
চলবে…..