একজন সঙ্গে ছিলো পর্ব ৬

#একজন_সঙ্গে_ছিলো
#লেখাঃনিপা
পর্ব- ৬
শুভ্র চলে যাওয়ার চার বছর পর তাহমিদের সাথে আমার বিয়ে হয়। তাহমিদ আমাকে কোথাও দেখে হয়তো পছন্দ করেছিল। তারপর তাহমিদের মা আমাকে দেখতে আসে, তারও পছন্দ হয়ে যায় আমাকে দেখে। আমি তাকে আমার সবকিছুই বললাম। এই যেমন, সংসার করতে একটা মেয়ের যা যা জানতে হয় তা আমি কিছু জানিনা। আমি রান্না বলতে শুধু ডিম সেদ্ধ করতে পারি, এক কাপ চা ও বানাতে পারি না।
আমার শাশুড়ি মা আমাকে বললেন, আমি জানি যে, মেডিকেল কলেজে যারা পড়ে তারা ঠিকঠাক ভাবে খাওয়ার সময় পায়না, সেখানে তুমি রান্না কিভাবে শিখবে? এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বিয়ের আগে আমিও রান্না জানতাম না কিন্তু বিয়ের পর আস্তে আস্তে সব শিখে নিয়েছি, তুমিও শিখে নিবে!
কিন্তু আফসোস যে আজও আমি কিছু শিখতে পারিনি!

আমি আর বিয়েতে অমত করলাম না। একা থাকা অনেক কষ্টের! সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। আর তাছাড়া বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হতো।

বিয়ের আগে তাহমিদকে জানার জন্যে তিনমাস সময় নিলাম। এই তিনমাসে বুঝলাম, তাহমিদ খুব ভালো ছেলে। অনেক বেশী কেয়ারিং আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং। আমি ওকে সময় দিতে পারতাম না সেটা নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না।
ফারজানা থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি তাহমিদ কে কখনও প্রনব বা শুভ্রর কথা বলেছিলেন?
-আমি শুধু বলেছিলাম যে আমার জীবনে আগে ভালোবাসা ছিলো, কিন্তু কারও নাম বলিনি।
-তাহমিদ কি বলেছিল?
-আমার অতীত নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
যাইহোক, আমার বিয়ে হয়ে গেলো। শ্বশুরবাড়ি লোক বলতে তাহমিদ, ওর মা আর আমি। আর দুজন কাজের লোকও আছে।
বিয়ের পর আমি বুঝতে পারলাম তাহমিদকে আমি বিয়ের আগে যতটা ভালো ভেবেছিলাম, ও তার থেকেও বেশী ভালো। ও কিভাবে যেন আমার চাওয়া গুলো বুঝে নিতো। আর আমার পছন্দগুলো ও কিভাবে যেন বুঝে নিতো।
আমি সুখী হওয়ার জন্যে প্রানপনে চেষ্টা করতাম।
-চেষ্টা করতেন মানে?
-আমি আসলে কি চাইতাম নিজেই বুঝতে পারতাম না! একা থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তো, তাই মাঝে মাঝে তাহমিদের ভালোবাসা খুব বিরক্ত লাগতো।
-আচ্ছা তারপর???
তাহমিদ তারাতাড়ি বাচ্চা নিতে চাইলো। আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
-এক মিনিট, আপনি কি শুভ্রর সাথে কখনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন নি?
-না, তবে প্রথম দিকে ফেসবুকে ওর টাইমলাইন ঘুরে দেখতাম কিন্তু তারপর আর ওর একাউন্ট টা খুঁজে পেলাম না। হয়তো আমাকে ব্লক করে দিয়েছিল।
-তারপর?
আমি কনসিভ করলাম। প্রেগন্যান্সিতে শুরু থেকেই কমপ্লিকেশন ছিলো। এই সময়টায় আমার শাশুড়ি আর তাহমিদ খুব খেয়াল রাখতো। তাহমিদের জন্যে তখন আমার মনে সম্মান বাড়তে লাগল। আমার জীবনে আরও একবার সত্যিকারের ভালোবাসা এসেছিলো। আমি মনে মনে ঠিক করলাম, এবার আর আমি আমার ভালোবাসাকে নষ্ট হতে দেবনা, বরং নিজের জীবন দিয়ে আগলে রাখবো।

আমার যখন পাঁচমাস চলছিলো তখন আমাকে শুভ্রর সেই বন্ধু একদিন ফোন করলো। বলল, আমার একটা চিঠি আছে।
আমি আন্দাজ করতে পারলাম চিঠিটা কার হতে পারে! উত্তেজনায় আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। আমি হাসান কে বললাম না যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

ড্রাইভার কে দিয়ে আমি চিঠিটা আনালাম। কাঁপা হাতে খুললাম। সেদিন যদি চিঠিটা না খুলতাম তবে হয়তো আমার জীবনটা এরকম তছনছ হতো না।

চিঠিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল,
আমি যদি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে ফিরে আসি তবে কি তুমি আমাকে আর একবার সুযোগ দেবে???

আমি হাসানের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, শুভ্রর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। ও আমাকেই ভালোবাসতো। আমাকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে এরকম করেছিল।

আমার তখন পাগল পাগল লাগছিলো, আমি আবারও ভুল করলাম! আমি কেনো শুভ্রর জন্যে অপেক্ষা করলাম না!
আমি দিন দিন অসুস্থ হয়ে গেলাম। সারাদিন কাঁদতাম, আর সারারাত না ঘুমিয়ে কাটাতাম। আমার কষ্ট দেখে তাহমিদ খুব কষ্টও পেতো। বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতো যে আমার কি হয়েছে কিন্তু আমি কিছু বলতে পারতাম না।

একদিন সাহস করে তাহমিদকে বলেই ফেললাম যে আমাকে ছেড়ে দিতে, তাহমিদ অপলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর চোখে সেদিন আমি স্পষ্ট কষ্ট দেখতে পেলাম।
আমি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমি ভালো নেই তাহমিদ! আমি ভালো থাকতে চাই। আমি তোমার সাথে ভালো থাকবো না, আমি অন্য কারো সাথে ভালো থাকবো। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও।
তাহমিদ সেদিন বলেছিল, আর আমাদের বাচ্চা?
আমি সেদিন বলেছিলাম বাচ্চা তোমার কাছেই থাকবে, আমি কখনও দেখতে আসবো না। তুমি ওকে বলে দিও আমি মরে গেছি।

আমি শুভ্রর চিঠির জবাব দেই নি ভেবেছিলাম, বাচ্চা হওয়ার পর দেব। কিন্তু তখনই আমার সাথে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
আমি হঠাৎ স্বপ্নে দেখতে লাগলাম কেউ একজন আমাকে হাত ইশারা করে ডাকছে। কিন্তু আমি তার মুখ দেখতে পারছি না।
এক স্বপ্ন প্রতি রাতেই আমি দেখতে লাগলাম। আমি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিলাম না। কারন প্রেগন্যান্সির সময় অনেক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে মেয়েরা।

ছেলে হওয়ার ১৮ দিন আগে থেকে আমি আর ওই স্বপ্নটা দেখতাম না। তখন আমি অন্য স্বপ্ন দেখতাম। যেটা ছিলো খুবই ভয়ংকর।
আমি দেখতাম একটা রক্তাক্ত হাত আমাকে ইশারা করে ডাকছে। প্রায় রাতেই আমার ঘুম ভেঙে যেত, আর তখন আমি ঘামে ভিজে যেতাম। ওই স্বপ্নটায় আমি এতো ভয় পেতাম যে আমি রাতে ঘুমানো বন্ধ করে দিয়েছিলাম। দিন দিন আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করলো।
তাহমিদ ব্যস্ত হয়ে গেলো আমার এই স্বপ্নের কথা শুনে। আমার শাশুড়ি দোয়া পড়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে দিতো কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না।
আমি প্রায় প্রতি রাতেই জেগে থাকতাম, আর তাহমিদ ও আমার সাথে জেগে থাকতো।

একদিন সকালে হাসান আমাকে ফোন করে বলল, তারাতাড়ি স্কয়ার হসপিটালে আসতে, শুভ্র খুব বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট করেছে বাঁচার সম্ভাবনা ৫% এরও কম। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম

এক প্রকার যমে মানুষে টানাটানি করে আমাকে বাঁচানো হলো। বাচ্চা সুস্থ থাকলেও আমি সুস্থ ছিলাম না, আমার কোনো সেন্স ছিলো না বললেই চলে। মাঝে জ্ঞান ফিরতো কিছু সময়ের জন্যে, তারপর আবারও অজ্ঞান হয়ে যেতাম
আমার জ্ঞান ফিরলো তিনদিন পর। জ্ঞান ফেরার পর হাসান আমার সাথে দেখা করতে আসলো। আমি হাসান কে দেখে কেঁদে ফেললাম। হাসান আমাকে বলল, তুমি বললে না কেনো যে তোমার বিয়ে হয়েছে? তুমি যদি চিঠির জবাব দিতে তাহলে হয়ত শুভ্র দেশেই আসতো না। আর এভাবে মরতেও হতো না। আমি তখনও কেঁদে যাচ্ছিলাম।
হাসান বলল, শুভ্র বেঁচেছিল ২৭ ঘন্টা। কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলো না কিন্তু বার বার হাত ইশারা করে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, হয়তো তোমাকে কিছু বলতে চেয়েছিল।
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, প্লিজ আমি আর শুনতে চাই না।
-রিশিতা শুভ্রর কাছে ৩৪ টা ডায়েরি আছে তুমি কি সেগুলো দেখতে চাও।
আমি তখন অসহায় গলায় বললাম, তুমি কি আমার বাচ্চা টাকে দেখেছো হাসান? ওর নিষ্পাপ মুখটা দেখে কি তোমার মনে হয় না যে আমার বেঁচে থাকার দরকার। আমি বাঁচতে চাই!

আমি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলাম। আমার ছেলের জন্যে সব ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম। তাহমিদ ও খুব সাহায্য করছিলো আমায়।
হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা আমি আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফেরার পর আমি কিছু চিনতে পারলাম না। না আমার ছেলে, আর না তাহমিদ কে।
আগের সবকিছু আমি ভুলে গেলাম। কিছু মনে করতে পারলাম না।

ডঃ বলল, আমাকে আমার মতো থাকতে দিতে। তাহমিদ আমাকে একা ছেড়ে দিলো। আমি দুদিন পর আবার সবকিছু চিনতে পারলাম।

এরপর থেকে প্রায়ই এরকম হতো। প্রায়ই আমি আগের জিনিস ভুলে যেতাম। দেখা যেত বাবুকে একবার খাওয়ানোর পর, একটু পর আবারও খাওয়ানো শুরু করতাম। মেডিকেল সায়েন্সে এক ধরনের অসুখ আছে যার নাম ডিমেনশিয়া। মস্তিষ্কে নিউরনের পরিমান কমে গেলে ভুলে যাওয়া এই রোগ হয়।
ডক্টরদের ধারণা আমারও সেটা হলো। তাই সেভাবেই চিকিৎসা চলছিলো। কিন্তু আমার অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না।

এতক্ষণ ধরে রিশিতার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন ফারজানা।
-আপনার গল্প বলার ধরন খুব ভালো ছিলো রিশিতা।
-আপনার কি মনে হয় আমি সুস্থ হবো?
ফারজানা একটু হেসে বলল, আপনি যদি অসুস্থ হতেন তবেই না সুস্থ হওয়ার কথা আসতো!
-মানে?
-মানে হলো আপনার কোনো রোগ নেই রিশিতা। আপনি শুধু অসুস্থ হওয়ার নাটক করে গেছেন,,,,,
রিশিতা চমকে উঠে ফারজানার দিকে তাকালো।
,,,,,,চলবে,,,,,,,

(শেষ পর্ব বাকী)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here