#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৪৬
#নিশাত_জাহান_নিশি
রাত বেড়ে তখন দশটা প্রায়। হাউমাউ করে কাঁদছে অয়ন্তী। ভাবছে ঐসময় রাফায়াতের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে বিধায় রাফায়াত সেই যে দুপুরে বের হয়েছিল এখনও বাসায় ফিরে এলোনা! তবে কী রাফায়াত তার সাথে রাগ করে তার চোখের আড়াল হয়ে গেল?
এসব অবান্তর জিনিস ভাবতে ভাবতেই যেন অয়ন্তীর কান্নার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শ্বাসকষ্টের রোগীদের ন্যায় করুন অবস্থা প্রায়। অনুশোচনা নামক জিনিসটি কখনও কখনও মানুষকে মৃ’ত্যু’সম যন্ত্রণার স্বাদ দেয়! মৃ’ত্যুর মত যন্ত্রণা হয় এই অনুশোচনায়। খাওয়াদাওয়া ভুলে অয়ন্তী কেবলই রাফায়াতের নাম্বারে অনবরত ডায়াল করছে। কিছুক্ষণ রিং বাজছিল তো কিছুক্ষণ পর পর আপনাআপনি কলটি কেটে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর আবার ফোনটি রীতিমত বন্ধও আসছিল! এখন প্রায় তিন প্রকার দুঃশ্চিন্তা কাজ করছিল অয়ন্তীর মাথায়। এত মানসিক দুঃশ্চিন্তা সে একা নিতে পারছিল না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল। পাশাপাশি দুই পরিবারের সবাইও এখন পালাক্রমে অস্থির হয়ে উঠেছে! সময় যত বাড়ছে ততই যেন সবার মধ্যে হাহাকার কাজ করছে। কোথায় গেল? কোথায় যেতে পারে রাফায়াত? এই অচেনা শহরে তার পরিচিত আর কে-ই বা আছে? যার সাথে সে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারে?
ইতোমধ্যেই স্বস্তির কারণ হয়ে হঠাৎ আরিফের নাম্বার কল এলো অয়ন্তীর ফোনে! দিশা খুঁজে পেয়ে অয়ন্তী হন্ন হয়ে কলটি তুলল। আশাবাদী গলায় অয়ন্তী হ্যালো বলতেই আরিফ ঐ পাশ থেকে দ্রুত গলায় বলল,,
“ভাবি। রাফায়াত ভাইকে দেখলাম গা”ঞ্জা শরীফের গ্যারেজ থেকে বের হতে। দেখে মনে হচ্ছিল নেশা করেছে!”
ভেতরে ভেতরে অয়ন্তী অতি রুষ্ট হলেও বাহিরে তা প্রকাশ করলনা। বরং স্বাভাবিক গলাতেই ধৈর্যহারা হয়ে আরিফকে শুধালো,,
“এখন কোথায় সে?”
“বাড়ির দিকেই হেঁটে যাচ্ছে ভাবি। আপনি চাইলে সামনে এগিয়ে যেতে পারেন। নেশা টেশা করলে তো রি’স্ক আছে!”
ঝট করে কলটি কেটে দিলো অয়ন্তী। রুমে থাকা দুই পরিবারের সবাইকে উপেক্ষা করে সে বিশৃঙ্খল ভাবে দৌঁড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় নেমে এলো। মনের মধ্যে ভ’য় বাসা বাঁধতে লাগল তার। নে’শা’ভা’ন করে এলাকায় না দুর্নাম রটায় তাই। বাড়ির রাস্তা ধরে প্রায় পাঁচ মিনিট পথ দৌঁড়ে যেতেই সে রাস্তার ফুটপাতে মাথা নুইয়ে বসে থাকা অবস্থায় রাফায়াতকে দেখতে পেল! ঢুলুঢুলু শরীর তার। একটু পর পর ঝাঁকুনি দিয়ে পড়ে যাচ্ছে ঠিক এমনটিই মনে হচ্ছে। শরীরের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তার। হালকা বাতাসেও সে ছিটকে পড়ে যাবে। মাত্রাতিরিক্ত নেশা করেছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে! অধীর হয়ে অয়ন্তী বি’ধ্ব’স্ত রাফায়াতের দিকে দৌঁড়ে গেল। পাশে বসে দু’হাত দ্বারা চেপে ধরল রাফায়াতকে। অমনি রাফায়াত তার নে’শা’যুক্ত র’ক্তি’ম চক্ষু দ্বারা অয়ন্তীর আ’হ’ত দু’চোখে তাকালো। বি’ম’র্ষ অয়ন্তীকে দেখে সে যদিও প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিল তবে পরে স্থবির হয়ে উঠল। ভাবশূণ্য গলায় শুধালো,,
“তুমি? তুমি এখানে কী করছ?”
কথার বলার সময় রাফায়াতের মুখ থেকে নে’শা জাতীয় দ্রব্যের বি’দ’ঘু’টে গন্ধ ভেসে আসছিল! বমি পেয়ে বসেছিল অয়ন্তীর। নাক সিটকে সে মুখে হাত চেপে ধরে নে’শা’গ্রস্ত রাফায়াতের দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তেজী গলায় বিপরীতে সেও প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“আবারও নেশা করেছেন আপনি?”
“হুম! ই’য়া’বা!”
“ইউ ব্লা*ডি! লজ্জা করছেনা আপনার? মুখ দিয়ে আবার এসব জিনিস উচ্চারণ করতে?”
“না! কারণ আমার লজ্জা নেই!”
“আজ কিন্তু আপনি সত্যিই অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেললেন রাদিফ।”
“ভাগ্য আমার সাথে বাড়াবাড়ি করে প্রতিবার। আমি না।”
“ভাগ্যকে অযথা দোষ দিবেন না। দোষ আপনার। আপনি চাইছেন না বলেই ভাগ্য আপনাকে দিচ্ছেনা। চাওয়ার মত করে চাইতে হয়। চেষ্টা থাকতে হয়।”
“ওহ্ হ্যাঁ, তাইতো। আমি চাইছি কই? চাইছিনা বলেই তো আজকের এই ব্যর্থতা আমি মানতে পারছিনা।”
“হ্যাঁ চাইছেন না। চাইলে আজ এত বড়ো সুযোগটা আপনি হাতছাড়া করতেন না। যেভাবেই হোক সুযোগটা কাজে লাগাতেন। নিজের দিকটা না ভাবুন অন্তত আমার দিকটা আপনার পরিবারের দিকটা ভাবতে পারতেন।”
“আমাকে একটু একা থাকতে দিবা প্লিজ?”
ব্য’থা’য় ভরা নিশ্চল চাহনি রাফায়াতের। করুন কা’তর’তা যেন প্রগাঢ় হয়ে উঠছে চুপসে আসা বিস্তীর্ণ মুখমণ্ডল জুড়ে। নেত্র কোটরে তার সীমাহীন টলমল জল। এখনি বুঝি টুপটাপ ছন্দে বৃষ্টি নামবে! ভেতরের অকথিত নিগূঢ় যন্ত্রণা বাইরে বেশ তোরজোরেই প্রকাশ পেয়েছে। অয়ন্তী কী বুঝবে সেই যন্ত্রণা? নিমিষেই শান্ত হয়ে গেল অয়ন্তী! ক্ষো’ভে ভরা চোখ দুটো তার শিথিল হয়ে উঠল। অকাতরে চোখ থেকে জল ফেলে সে স্থির চাহনিতে রাফায়াতের নেতিয়ে আসা মুখের দিকে তাকালো। ভরাট গলায় বলল,,
“বাসায় চলুন।”
“লিভ মি এলোন।”
“বাসায় চলুন!”
“লিভ মি এলোন!”
“আর একবার বলব। বাসায় চলুন।”
“যাব না।”
সঙ্গে সঙ্গেই রাফায়াতের গালে ঠা’স করে এক চ’ড় মে’রে বসল অয়ন্তী! বি’ক্ষু’ব্ধ চাহনিতে বিস্মিত রাফায়াতের দিকে তাকালো সে। হুট করে বসা থেকে ওঠে অয়ন্তী টে’নেহিঁচ’ড়ে দুর্বল রাফায়াতকে জায়গা থেকে ধরে উঠালো।ঘটনার আকস্মিকতায় রাফায়াত তব্দা লেগে গেল! বাকরুদ্ধ জড় পদার্থে পরিণত হলো। রাফায়াতকে টানতে টানতে অয়ন্তী বাড়ির রাস্তায় হাঁটা ধরল। দাঁত গিজগিজিয়ে বলল,,
“কত বড়ো সাহস। মুখের উপর বলে যাবেনা। এবার যাচ্ছেন তো? যেখানে জেদ দেখিয়ে পারবেন না সেখানে অযথা জেদ দেখাতে যান কেন? প্রেস্টিজেরও তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে।”
রাস্তাঘাটে উচ্ছৃঙ্খলতা করতে চাইল না রাফায়াত। অয়ন্তীর কথামত চলতে লাগল সে। চ’ড়’টাও অবিলম্বে হজম করে নিলো। তার উপর নে’শা করেছে সে। বিচার বিবেচনাবোধ এমনিতেও লোপ পেয়েছে তার। মস্তিষ্ক শূণ্য হয়ে উঠেছে প্রায়। যেখানে কাত হবে সেখানেই তার রাত হবে। মিনিট দশ একের মধ্যে পায়ে হেঁটে রাফায়াতকে নিয়ে রাফায়াতদের বাসায় উঠল অয়ন্তী। দুই পরিবারের সবাই রাফায়াতকে দেখেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল নেশা করেছে সে! অয়ন্তীর বাবা বিষয়টাতে খুবই ক্ষি’প্ত! নে’শাখোর একটা ছেলেকে মেয়ে জামাই হিসেবে মেনে নিতে হচ্ছে উনার! শুধুমাত্র মেয়ের জেদের কারণে। রেগেমেগে অয়ন্তীর বাবা অয়ন্তীর মা’কে নিয়ে রাফায়াতদের বাড়ি থেকে প্রস্থান নিলেন। রয়ে গেল শুধু অয়ন্তী। রাফায়াতের কাজে রাফায়াতের মা-বাবা এবং ভাবি খুবই লজ্জিত! ছেলের জন্য আবারও মানসম্মান নষ্ট হলো তাদের। বিশেষ করে রাফায়াতের মা খুবই ভেঙে পড়েছেন এই ব্যাপারটিতে। একটু আগেও কী-না তিনি ছেলেকে নিয়ে গর্ব করেছিলেন আর এখন সেই ছেলেই নতুন আত্নীয়দের সামনে উনার মাথা নিচু করে দিলো।
নেশায় টালমাটাল রাফায়াতের মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসল অয়ন্তী। হাতে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি ছিল তার। সেই গ্লাসভর্তি পানি সে রাফায়াতের মুখে ছু’ড়ে মা’র’ল। রি’মা’ন্ডে এনে রাফায়াতকে শা’স্তি দেওয়া হচ্ছে দেখে এমনটিই মনে হচ্ছে! চোখেমুখে পানি পড়তেই সঙ্গে সঙ্গেই রাফায়াত তার নে’শার ঘোর থেকে বের হয়ে এলো। মাথাটা ডানে বায়ে দু-তিনবার ঝাঁকিয়ে সে অয়ন্তীর দিকে খাপছাড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি অয়ন্তী দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“নে’শা কেটেছে?”
মাথা নাঁড়িয়ে না বুঝালো রাফায়াত! হাল ছাড়ল না অয়ন্তী। অন্য পাশে থাকা গ্লাসভর্তি লেবুর শবরতটা অয়ন্তী জোর করে রাফায়াতের মুখে ঢেলে দিলো! সম্পূর্ণ লেবুর শরবতটি সরাসরি রাফায়াতের পেটে পড়তেই রাফায়াত মুখ ভাসিয়ে বমি করে দিলো! সামনে বসে থাকা অয়ন্তীকে প্রায় ভাসিয়ে দিলো! পানি ছাড়া আর কিছুই বের হচ্ছিল না রাফায়াতের পেটের ভেতর থেকে। দুপুর থেকেই খালি পেটে রয়েছে সে। তবুও নাক সিটকালো না অয়ন্তী। রাফায়াতকে ইচ্ছেমত বমি করতে দিলো। দশ মিনিট অন্তর বমি করার পর রাফায়াত ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দুর্বল শরীর নিয়ে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে বুকে হাত চেপে ধরে হালকা কাশতেও লাগল। এর ফাঁকে অয়ন্তী ওয়াশরুমে গিয়ে প্রথমে তার জামাটা পাল্টে নিলো। কাবার্ড থেকে রাফায়াতের একটি টি-শার্ট গাঁয়ে পড়ে নিলো! রুমে প্রবেশ করে অজ্ঞানের মত পড়ে থাকা রাফায়াতকে অয়ন্তী আস্তেধীরে টেনে ধরে শোয়া থেকে উঠিয়ে বসালো। গাঁ থেকে শার্টটা খুলে ঠাণ্ডা পানি দ্বারা ভালোভাবে রাফায়াতের গাঁ টা মুছে দিলো। পাতলা একটা টি-শার্ট গাঁয়ে পড়িয়ে দিলো। রাফায়াতকে পুরোপুরি ফ্রেশ করিয়ে সে রান্নাঘরে গেল রাফায়াতের জন্য খাবার আনতে। অমনি রাফায়াতের মা মাথা নুইয়ে অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালেন! নত হয়ে নিচু গলায় বললেন,,
“অয়ন্তী মা। তুমি কী এখনও চাও আমার ল’ম্প’ট ছেলেটাকে বিয়ে করতে?”
“আপনি এসব কী বলছেন মা? আপনার ছেলে ল’ম্প’ট হতে যাবে কেন?”
“ল’ম্প’ট নয়ত কী? এখনও তো পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। আজও নে’শা করে বাড়ি ফিরল।”
“নে’শা করেছে আমার দোষে মা! আমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি তাই। আপনার ছেলে এখন ভালো হয়ে গেছে মা। আর মাঝেমাঝে এমন একটু আধটু ভুল করে ফেলাটা স্বাভাবিক।”
“কিন্তু তোমার মা-বাবা তো এই বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না মা! তারা হয়ত খুশি না তোমার সিদ্ধান্তে!”
“আপনার ছেলে একটা চাকরী পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে মা। আপনি এই নিয়ে চিন্তা করবেন না প্লিজ। অনেক রাত হয়েছে মা। আপনি ঘুমুতে যান। আপনার ছেলের খাওয়া হয়ে গেলে আমিও বাড়ি ফিরে যাব।”
সন্তোষজনক দৃষ্টিতে রাফায়াতের মা অয়ন্তীর দিকে তাকালেন। আবেগ আপ্লুত হয়ে তিনি চোখের জল ছেড়ে দিলেন! কাপড়ের আঁচল দ্বারা চোখ দুটো মুছতে মুছতে তিনি জায়গা থেকে প্রস্থান নিলেন। আর সম্ভাবনাময় গলায় বললেন,,
“সুখি হও মা। একদিন দেখবে আমার ছেলে অনেক বড়ো হবে। তখন তুমিই তখন তার সফলতার কারণ হবে।”
ম্লান হাসল অয়ন্তী। খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে সে রুমে প্রবেশ করল। রুমে প্রবেশ করেই একদফা অবাক হলো সে! বিছানার কোথাও রাফায়াত নেই। এমনকি রুমের কোথাও নেই। খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে অয়ন্তী হন্ন হয়ে ওয়াশরুমের দিকে উঁকি দিতেই ব্যালকনি থেকে রাফায়াতের মৃদু গলার স্বর ভেসে এলো। গম্ভীর গলায় সে অয়ন্তীকে বলল,,
“আমি এখানে।”
দৌঁড়ে গেল অয়ন্তী ব্যালকনিতে। সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে রাফায়াত। দৃষ্টি তার রাতের শূণ্য আকাশের দিকে। বিষণ্নতা ছেয়ে আছে তার করুন রিক্ততায় ঘেরা মুখের আদলে। ভীরু পায়ে হেঁটে অয়ন্তী রাফায়াতের পাশে বসল। অমনি রাফায়াত দৃষ্টি ঘুরিয়ে অয়ন্তীর দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভাবশূণ্য গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“তুমি খুশি তো আমাকে নিয়ে?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“আমি কী আদো তোমার যোগ্য?”
“এসবের মানে কী?”
“ছেড়ে দিতে পারবে আমাকে?”
“স্টপ ইট রাদিফ। অনেক হয়েছে।”
“আমি বেকার৷ নে’শা’খোর৷ ল’ম্প’ট। তবুও কেন পড়ে আছো আমার সাথে?”
“লিমিট ক্রস করছেন এবার।”
“বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অথচ এই অবধি তোমাকে নিয়ে ভালো কোনো জায়গায় ঘুরতে যাইনি, নামি দামি কোনো রেস্টুরেন্টেও খাওয়াতে নিয়ে যাইনি, কখনও কোনো ভালো কিছু গিফট করতে পারিনি, শূণ্য পকেটে তোমাকে নিয়ে ঘুরেছি। কখনও মন খারাপ হয়নি এতে?”
“কী হয়েছে আপনার বলুন তো? হঠাৎ এসব অস্বাভাবিক কথা কেন বলছেন?”
“জানো? সেদিন আরিফের সাথে শপিংমলে যাওয়ার পর একটা শাড়ি বেশ পছন্দ হয়েছিল আমার। নীল রংটায় দারুণ মানাত তোমায়। হাজার টাকার মধ্যে হলেও শাড়িটা কিনে নিতাম। কিন্তু তারা দুই হাজার টাকার কমে শাড়িটা ছাড়ছিল-ই না! খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছিল সেদিন। আমার সাথে থাকলে হয়ত এভাবে আরও অনেক ছোটো ছোটো শখ বিসর্জন দিতে তোমার! পারবে তো এত সেক্রিফাইজ করতে?”
ডুকরে কেঁদে উঠল অয়ন্তী। দুঃখী হয়ে ক্রন্দনরত অবস্থাতেই বলল,,
“আপনি পাশে থাকলেই হবে। আমার আর কিছু লাগবেনা রাদিফ। কেন এসব বিচ্ছিরি কথাবার্তা বলে আমাকে হার্ট করছেন বলুন তো?”
বুকে জমাট বাঁধা কষ্টরা যেন কিছুতেই কমছিল না রাফায়াতের! নিজের জেদে অনড় রইল সে। চোখে জল নিয়ে ভরাট গলায় পুনরায় বলল,,
“আর একটা কথা। আমি নিজের যোগ্যতায় যেদিন চাকরী পাব সেদিন-ই তোমাকে বিয়ে করব, ঘরে তুলব। তোমার পরিবারের হেল্প আমার লাগবেনা অয়ন্তী। সো তোমার বাবাকে বলে দিও আমার জন্য আর কোথাও চাকরী না দেখতে। দেখা যাবে আবারও আমার জন্য উনার মানসম্মান হারাতে হবে!”
“কী হয়েছিল আজ বলুন না? কেন আপনি সময়মত অফিসে পৌঁছাতে পারেন নি রাদিফ?”
“জ্যামে আটকে পড়েছিলাম তাই!”
“তাহলে বাবার কলটাও কেন তুলছিলেন না? একটা বার বাবাকে বলে দিলেই তো সব চুকে যেত।”
“আমি ঐ প্রসঙ্গ নিয়ে আর কোনো কথা বাড়াতে চাইছিনা অয়ন্তী। শুধু তোমাকে হারাতে পারবনা বলে তোমার বাবার সাথে এখন আমার বেহায়ার মত মিশতে হবে! নয়ত কবেই…..
থেমে গেল রাফায়াত। দাঁতে দাঁত চাপল সে। মুহূর্তেই কৌতূহলী হয়ে উঠল অয়ন্তী। রাফায়াতের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“কী হয়েছে? বাবা কিছু বলেছে আপনাকে?”
চেপে গেল রাফায়াত। মাথা ঠাণ্ডা করে শান্ত গলায় অয়ন্তীকে বলল,,
“বাড়ি যাও।”
“কী হয়েছে বলুন?”
পুনরায় ক্ষিপ্র হয়ে উঠল রাফায়াত। গরম দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। ঝাঁজালো গলায় বলল,,
“বাড়ি যেতে বলছি না?”
ভীষণ আঘাত পেল অয়ন্তী। জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো সে। কাঁদতে কাঁদতে রাফায়াতের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। একছুটে নিজের বাসায় ফিরে গেল। তার বাবার মুখোমুখি দাঁড়ালো। বিক্ষুব্ধ হয়ে তার বাবাকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“তুমি রাদিফকে কী বলেছ বাবা?”
ল্যাপটপে অতি মনোযোগের সহিত কাজ করছিলেন অয়ন্তীর বাবা। অয়ন্তীর এহেন প্রশ্নে তিনি চোখ তুলে তাকালেন অয়ন্তীর দিকে। বিরক্তবোধ করে তিনি পাল্টা অয়ন্তীকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“ইতি নাকি ঐ ল’ম্প’ট ছেলেটাকে ডিস্টার্ব করছে? তোমার বিশ্বাস হয় এসব?”
“ফার্স্ট অফ অল তুমি রাদিফকে ল’ম্প’ট কেন বললে বাবা?”
“ল’ম্প’টকে ল’ম্প’ট বলব না তো কী বলব অয়ন্তী? ইতির সাথে ফস্টিনস্টি করতে গিয়ে সে জাস্ট টাইমে অফিসে পৌঁছাতে পারেনি। এর থেকে ভালো কী আশা করো তুমি আমার থেকে?”
“যা বলার ক্লিয়ারলি বলো বাবা। আমি কিছু বুঝতে পারছিনা।”
“কেন? তোমার প্রাণের রাফায়াত তোমাকে কিছু বলেনি?”
“তোমাকে বলতে বলছি বাবা, তুমি বলো।”
“তাহলে শোনো। ভাইভার টাইম শেষ হওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তোমার ল’ম্প’ট উডবি আমার অফিসে যায়। তাও আবার উকিল সাহেবের বড়ো মেয়ে ইতির নামে অবান্তর বিচার নিয়ে! বলল ইতির জন্য নাকি তার লেট হয়ে গেছে ভাইভাতে এটেন্ড করতে। এমনিতেই আমার মেজাজ হট ছিল তার উপর এমন আনবিলিভএ্যাবল রিজন। তখন স্টাফদের সামনে আমি তাকে ইনসাল্ট করতে বাধ্য হই!”
জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে আর এক সেকেন্ডও ব্যয় করলনা অয়ন্তী। আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। বেহায়া ইতিকে চরম একটা শিক্ষা দিতেই হবে! রেগেমেগে তেড়েফুঁড়ে অয়ন্তী বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। অয়ন্তীর বাবা পেরেশান হয়ে অয়ন্তীর পিছু পিছু ছুটলেন। বি’ধ্বংসী দেখাচ্ছিল অয়ন্তীকে। জেদের বসে অপ্রত্যাশিত কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে অয়ন্তী সোজা হাঁটা ধরল ইতির বাড়ির উদ্দেশ্যে। মিনিট পাঁচেক বাদে ইতিদের বাড়ি পৌঁছেই সে বাড়ির কলিংবেল চাপল। উচ্চশব্দে ইতিকে ডাকতেই ইতি সদর দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এলো। অমনি অয়ন্তী দাঁতে দাঁত চেপে ঠা’স ঠা’স করে ইতির গালে পালাক্রমে চার থেকে পাঁচটি চ’ড় কষিয়ে দিলো! ঘটনার আকস্মিকতায় ইতি কেবল চ’ড়ের পর চ’ড় হজম করেই গেল! প্রতিবাদ করার সামান্য সুযোগ টুকুও পেলনা। ব্য’থায় কেবল চোখের জল ছাড়তে লাগল। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। লাগাতার চ’ড়ের আওয়াজ শুনে ইতির মা উদ্বিগ্ন হয়ে বাইরে বের হয়ে এলেন। চিৎকার করে অয়ন্তীকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তৎক্ষণাৎ অয়ন্তী চ’ড় মা’রা থামিয়ে ইতির মায়ের দিকে তেজস্ক্রিয় দৃষ্টি নিক্ষেপে করল। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“কেমন মেয়ে জন্ম দিয়েছেন আপনি হ্যাঁ? যে মেয়ে কী-না অন্য একটা মেয়ের সংসার ভাঙতে ওঠে পড়ে লাগে? যে মেয়ে কী-না নির্লজ্জ, বেহায়া, দুঃশ্চরিত্র মেয়ে মানুষদের মত অন্য মেয়ের স্বামী নিয়ে টানাটানি করে? পুরুষ মানুষদের গাঁয়ে পড়ে লুচ্চামি করে?”
ইতির মা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। আগুন ঝরা দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালেন। অয়ন্তীর ডান হাতটি শক্তভাবে চেপে ধরে তিনি চোয়াল উঁচিয়ে বললেন,,
“এত বড়ো স্পর্ধা তোর অয়ন্তী? তুই আমার সামনে আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত তুলিস? আমার সহজ, সরল মেয়ে সম্পর্কে উল্টো পাল্টা মন্তব্য করিস? তুই চিনিস তো আমার স্বামীকে? ঠিক কোন কোন ধারার কেইস তোর উপরে ঠুঁকবে চিন্তা করতে পারছিস তো তুই?”
উড়নচণ্ডী হয়ে ইতির মা অয়ন্তীর গালে যেইনা চ’ড় মা’রতে গেল অমনি রাফায়াত পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে ইতির মায়ের হাত টেনে ধরল! ভড়কে ওঠে অয়ন্তী এবং ইতির মা তাদের আগ্রাসী দৃষ্টি ফেলল রাফায়াতের দিকে। অমনি রাফায়াত তাদের উপেক্ষা করে শাণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ইতির দিকে। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,
“কী মিস ইতি? চুপ করে আছেন কেন হ্যাঁ? আপনার মাকে বলুন আজ আপনি ঠিক কী কী করেছেন আমার সাথে। কেন অয়ন্তী ক্ষুব্ধ হয়ে এসে আপনার গাঁয়ে হাত তুলতে বাধ্য হয়েছে। কেন সে আপনার নামে কুমন্তব্য করছে বলুন সব। সত্যিটা বলুন ওকে? আদারওয়াইজ আমি বাধ্য হব আপনার মায়ের হাতটা ভে’ঙে গুড়িয়ে দিতে!”
#চলবে….?
[আগামী ৫০ পর্বেই গল্পের ইতি টানা হবে।]