এ তুমি কেমন তুমি পর্ব -০২

#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০২

❌কপি করা নিষেধ❌
৫ নাম্বার প্রশ্নে মার্ক করেছিস, এটা তুই সল্ভ করেছিস?

সামনে বসা অতি প্রিয় ফারহান ভাইকে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষ মনে হচ্ছে অনুর কাছে। পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসে যদি পুনরায় পরীক্ষা দিতে হয়ে এটা কার ভালো লাগে? কারোই না।

অনু চুপ করে আছে দেখে ফারহান মৃদু আওয়াজে ধমক দিয়ে বললো, “কথা বলছিস না কেনো অনামিকা?”

এই সামান্য ধমকে কেঁপে উঠলো অনু। ভয়ে হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে তার।

আমতা আমতা করে বললো, “আমি এটা দেইনি।”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফারহান, “না দিলে মার্ক করেছিস কেনো?”

ভেবেছিলাম দিবো কিন্তু পরে আর দেইনি।

ফারহান বিরক্ত হয়ে বললো, ” ১,২,৪,৫ একটাও সল্ভ করতে পারিসনি। তুই কোনটা কোনটা সল্ভ করেছিস সেটা দেখা আমাকে। আমি যেটাই জিজ্ঞেস করছি সেটাই তো দেইনি বলছিস।”

অনু কিছু বলছে না দেখে ফারহান হাতের কোশ্চেন পেপার টেবিলের উপর রেখে দিলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অনুর দিকে। সাদা স্কুল ড্রেস গায়ে অনুর, মাথার লম্বা দুই বিনুনি দুই পাশে দেওয়া। ঘামে শ্যামবর্ণ মুখটা তৈলাক্ত হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি পায়ের আঙ্গুল দিয়ে ফ্লোর খুঁটানোর দিকে। ফারহান মুচকি হাসলো অনুকে দেখে।

পরক্ষণে গলার আওয়াজ গম্ভীর করে বললো, “গত এক্সামে ম্যাথমেটিক্সে কত নাম্বার পেয়েছিলি অনামিকা?”

অনু ছোট ঢোক গিলে বললো, “৩২।”

ফারহান অবাক হওয়ার ভান করে বললো, “কী বলিস তুই ৩২ নাম্বার পেয়েছিলি? আর আমাকে দেখ জীবনে ৩২ নাম্বার চোখেই দেখিনি। শুধু আমি নাকি তোর বা আমার বংশের কেউ জীবনে ৩২ নাম্বার পেয়েছে। এতো নাম্বার পেলে কী আর একেকজনকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট হতে হতো বল। এই ঢাকা শহরের বড় বড় মূর্খ সমিতির সভাপতি হতে পারতো। যেমনটা তুই হতে চলেছিস ইন ফিউচারে।”

অনু হা করে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে, “মূর্খ সমিতি কী ভাইয়া?”

ফারহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “গবেট একটা। এই আহির তুই ওয়াশরুম থেকে বের হবি আজকে? তোর এই গবেট বোনকে কিছু জিজ্ঞেস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এর সাথে কথা বলে আমি নিজেও গবেট হয়ে যাবো।”

ফারহান রেগে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো আহিরের রুম থেকে। অনু কেবল হা করে তাকিয়ে ফারহানের চলে যাওয়া দেখলো আর ভাবতে লাগলো সে কী এমন করেছে যার জন্য ফারহান এমন রেগে গেলো?

আহির ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফারহানকে না দেখে অনুর কাছে জানতে চাইলো, “ফারহান কোথায়?”

অনু বললো, “চলে গেছে।”

কেনো?

সেটা তো আমিও ভাবছি।

আচ্ছা বাদ দে, এখন বল কোনটা কোনটা সল্ভ করেছিস আর কীভাবে করেছিস?

অনু একইভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উত্তর দিতে লাগলো। আহির এবার বুঝতে পারলো ফারহানের যাওয়ার কারণ।

আহির হতাশ গলায় বললো, ” হায় আল্লাহ এটা আমার বোন তো? নাকি হসপিটালে কারো বাচ্চার সাথে চেঞ্জ হয়ে গেছে।”

অনু এবারও হা করে তাকালো আহিরের দিকে।

৩.
একা একা এভাবে হাসছিস কেনো?

আহিরের কথায় পুরনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো অনু। হাতে তার পাঁচ বছর আগের সেই কোশ্চেন পেপার। ফারহান কত ভালো ছিলো আগে, ধমক দিয়ে হলেও কথা বলতো। কিন্তু হঠাৎ করেই কেমন বদলে গেলো।

কী হলো কিছু বলছিস না কেনো?

অনু দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, “পুরনো কথা মনে করে হাসছিলাম। তুমি কিছু বলবে ভাইয়া?”

আহির ভেতরে ঢুকে বেডে বসে বললো, “সবাই আড্ডা দিচ্ছে, তুই রুমে কী করছিস?”

মা বলেনি আমার মাথা যন্ত্রণা করছে?

ছোট আব্বু তো মেডিসিন দিয়েছে, সেটা খাসনি?

খেয়েছি, এখন একটু কমেছে।

তাহলে নিচে চল, সবাই সেখানে আছে।

আমার এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না। সামনে আর ফাইনাল এক্সাম, একটু পড়াশোনা করবো।

আহির অবাক হয়ে বললো, “আরে বাপ রে তুই আমার পড়াশোনা নিয়ে কবে ভাবতে শুরু করলি।”

অনু রাগী চোখে তাকালো ভাইয়ের দিকে।

তা দেখে আহির বললো, “ওকে সরি৷ তুই পড় কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলিস।”

আহির উঠে চলে যেতেই অনু পড়ার টেবিলের সামনের চেয়ার টেনে বসলো। আবার তাকালো সেই কোশ্চেন পেপারটার দিকে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের এটা, ক্লাস নাইনের। এক্সাম দিয়ে আসার পর বাড়িতে আবার এক্সাম দিতে হতো আহিরের কাছে। সেদিন আহির ওয়াশরুমে চলে যায়, ফারহানকে সেই দ্বায়িত্ব দিয়ে। অনুর উত্তর শুনে বিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছিলো। আসলে অনু ছাত্রী খুব একটা ভালো না। পরিবারের এতো মেধাবী মানুষজনের মাঝে অনু হচ্ছে একমাত্র গবেট। তবে সব এক্সামে আলু পেলেও ফাইনালে ঠিক পাশ করে যায়। কোশ্চেন পেপারটা আগের জায়গায় যত্নে রেখে দিলো অনু। নীল রঙের ডায়েরিটা থেকে ফারহানের একটা ছবি বের করলো। ছবিটা সে ফ্যামিলি এলবাম থেকে চুরি করেছে। ছবিতে ১৮ কিংবা ২০ বছরের হ্যাংলা পাতলা কিউট ফারহান ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বই হাতে। চশমার ভেতরের বড় বড় চোখ দু’টো বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ। একজন মানুষ মনোযোগ সহকারে বই পড়ছে, খুব আহামরি কিছু তো নয়, তবু ছবিটা দেখার সময় অনুর চোখে বিরাজ করে এক আকাশ সমান মুগ্ধতা। টুপ করে এক ফোটা নোনাজল ছবির উপর পড়লো।

কেনো আপনি আমার হলেন না? আপনাকে কীভাবে নিজেরই ছোট বোনের সাথে সহ্য করবো।

ছবিটা ডায়েরির ভেতর রেখে বেলকনিতে চলে গেলো অনু। ড্রয়িংরুমে লিজা আর ফারহানের বিয়ে ডেট ফিক্সড করা হচ্ছে। সেখানে গেলে অনু নিজের চোখের নোনতা তরল কন্ট্রোল করতে পারবে না, তাই এই লুকোচুরি। কিছুটা সময় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াশরুমে গেলো চোখমুখ ধুয়ে নিতে। টাওয়েলে মুখ মুছতে মুছতে বের হতেই কারো কান্নার আওয়াজে দাঁড়িয়ে গেলো অনু। থম মেরে দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করলো কান্নার আওয়াজ কোথা থেকে আসছে। বুঝতে সময় লাগলো না, আওয়াজ বেলকনি থেকে আসছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বেলকনির দিকে। তানিশাকে দেখে অবাক হলো অনু।

টাওয়েল বেলকনিতে বাঁধা দড়িতে ঝুলিয়ে তানিশার কাঁধে হাত রাখলো, “কী হয়েছে তানিশা, তুই কাঁদছিস কেনো এভাবে?”

তানিশা অনুর দিকে ঘুরে জড়িয়ে ধরলো তাকে, “আমি ফারহান ভাইয়াকে ভালোবাসি আপু।”

আজ বোধহয় অনুর শকড হাওয়ার দিন। কথাটা কানে যেতেই অনু কেঁপে উঠলো খানিকটা।

কাঁপা গলায় বললো, “কী বলছিস এসব তুই?”

হ্যাঁ আপু আমি ফারহান ভাইয়াকে ভালোবাসি।

অনু শুকনো ঢোক গিলে বললো, “তোর মাথা ঠিক আছে তানিশা? তুই কী বলছিস সেটা বুঝতে পারছিস আদৌও?”

তানিশা কিছু না বলে শব্দ করে কান্না করছে। অনু কী বলবে বুঝতে পারছে না। তানিশা কম হলে ফারহানের বারো তেরো বছরের ছোট হবে। তানিশা ফারহানকে এমন নজরে দেখতে পারে অনু সেটা কল্পনাও করতে পারেনি। অনু তানিশার মাথায় হাত রেখে তাকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো। অনু বুঝতে পারছে তানিশার কষ্টটা। অনুর ভয় হচ্ছে, তানিশার এখন আবেগের বয়স। কোনো ভুল না করে বসে। অনুর যেনো চারপাশটা ঘুরছে। তার মনের অনুভূতি কেউ জানে না, সে কখনো কাউকে জানতেও দিবে না কিন্তু তানিশা? সে কীভাবে সামলাবে তানিশাকে?

অনু ভাববো, তানিশা কেনো ভালোবাসতে গেলি ফারহান ভাইয়াকে?

একই প্রশ্নের উত্তর অনুর নিজের কাছেও নেই। সে কেনো ভালোবসেছে ফারহানকে?

৪.
অনু তানিশাকে নিয়ে বেলকনির দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসে আছে। তানিশা কাঁদতে কাঁদতে অনুর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনু এমন এক পর্যায়ে এসে পড়েছে কী করবে বুঝতে পারছে না। অনু নিজের মনের অনুভূতি মনেই কবর দিয়েছে। সেটা কোনোদিন কেউ জানতে পারবে না। কিন্তু তানিশা তো তার অনুভূতি কন্ট্রোল করতে পারছে না। এসব জানাজানি হলে তাদের পরিবারের সুন্দর সম্পর্কগুলো এলোমেলো হয়ে যাবে। অনু তাকালো তানিশার দিকে। মেয়েটা কেবল সতেরো বছরে পা রেখেছে। ফর্সা গোলগাল মুখ খানায় এক মায়ার রাজ্য। হাসলে দুই গালে কী সুন্দর দুটি টোল পড়ে। কুঁকড়ানো লম্বা চুলগুলো প্রায় হাটুর কাছাকাছি। অনু নাহয় রূপবতী নয় তাই সে তার ভালোবাসা পাবে না, কিন্তু তানিশা? সে তো রুপে গুণে কম নয়। কোন মোড় নিবে তাদের তিন বোনের জীবন?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here