#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৭
পূর্ব আকাশে লাল টকটকে আভা দেখা দিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো লাল সূর্যটা উঁকি দিবে। অনু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সেই পানে। দু’টো দিনের জ্বরের পর আজ নিজেকে ফুরফুরে লাগছে তার। ধীরে ধীরে লাল টকটকে গোল সূর্যটা সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হলো পূর্ব আকাশে। অনু তা দেখে মুচকি হাসলো। অন্ধকারের পরই আলোর দেখা মিলে, এ যে চিরন্তন সত্য। অনু ছাদের গাছে পানি দিতে লাগলো। কর্ণারের দিকে যেতেই সেদিনের কিছুটা ছাঁই চোখে পরলো। বৃষ্টির পানিতে অনেকটাই ধুয়ে গেছে। অনু নিচু হয়ে বসে কিছুটা ছাঁই হাতে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো ছাঁইয়ের দিকে। দু’দিনের রোদে শুকিয়ে গেছে আবার, তাই ধুলোর মতো লাগছে। অনু রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হাতের ছাঁই ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলো।
হাসি মুখে বললো, “মুক্তি দিলাম তোদের। কেউ আর কোনোদিন জানতেও পারবে না।”
সেদিন অনু কিছু বলার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। অনুর লুকানো সত্যিটা আড়ালেই থেকে গেলো। অনেকটা সময় ছাদে কাটানোর পর নিচে নেমে এলো। দু’দিন ভার্সিটি যায়নি, আজ যাবে ঠিক করেছে তাই রেডি হয়ে নিলো। আজকে সকাল ন’টায় ক্লাস আছে তাই তাড়াতাড়ি বের হতে হলো অনুকে।
নিচে যেতেই অনুর মা বললো, “খাবারটা খেয়ে তারপর যা।”
অনু তাড়াহুড়ো করে বললো, “সময় নেই ক্লাস আছে আমার। পরে খেয়ে নিবো বাইরে।”
নুরজাহান ধমক দিয়ে বললো, “কেবল জ্বর থেকে উঠেছিস। এমনই শরীর দূর্বল। বাইরে যেতে হলে আগে খেয়ে তারপর যাবি।”
অনু আর কথা বাড়ালো না। খাবার টেবিলে কথা বলা পছন্দ করে না এবাড়ির মানুষজন তাই চুপচাপ যে যার খাবার খাচ্ছে। অনু ভেবেছিল কোনোরকমে খেয়ে উঠে যাবে কিন্তু তার মা একটার পর একটা দিচ্ছে আর কটমট করে তাকিয়ে আছে। অনু কিছু বলারও সাহস পাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে সবটা শেষ করে তারপর বের হলো। বাইরে আসতেই গেইটের সামনে রিকশা দেখে দারোয়ানকে ডাক দিয়ে রিকশাটা থামাতে বললো। রিকশায় উঠতে গিয়ে থেমে গেলো অনু।
১১.
অবাক কণ্ঠে বললো, “এ কী আপনি?”
সেদিন তুমি তোমার রিকশা আমার সাথে শেয়ার করেছিলে আজ নাহয় আমি করলাম।
হাতে সময় না থাকায় বাধ্য হয়ে অয়নের পাশে উঠে বসলো অনু।
আপনি এদিকে কোথায় গিয়েছিলেন?
ঐ একটা কাজ ছিলো আর কী।
অনুর হঠাৎ মনে পরলো সেই রাতের ম্যাসেজের কথা। মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো বিষয়টা।
শুক্রবার রাতে আপনি ম্যাসেজ করেছিলেন মনে আছে?
করেছিলাম বুঝি?
হেয়ালি করবেন না অয়ন ভাইয়া। এত রাতে আমি বাইরে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম আপনি কীভাবে জানলেন?
আসলে জানো তো, আমার না বেশ কয়েকটা পালিত জ্বীন আছে৷ ওরাই এসে বললো অনামিকা নামের যে ধুলাবালি আছে সে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, বৃষ্টির যা বেগ ভেসে যেতে পারে। তাই আর কী মানবিক দিক চিন্তা করে কল দিলাম, ম্যাসেজ করলাম কিন্তু কেউ উত্তরও দিলো না।
অয়ন কথা শেষ করে পাশে তাকিয়ে দেখে অনু সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অয়ন তা দেখে একটা বোকা হাসি দিলো।
এভাবে কেনো তাকাচ্ছো? ভয় লাগে তো।
অনু চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “আপনি সত্যিটা বলবেন নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো তালপাতার সিপাহি কোথাকার?
ছি ছি অনু, সিনিয়রদের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? তোমার মত ভদ্র মেয়ের থেকে এটা আশা করে না সমাজ।
অনু রেগে বললো, “এবার কিন্তু সত্যি সত্যি ধাক্কা মেরে দিবো আমি।”
অয়ন মুচকি হেসে বললো, “ওকে বলছি। সেদিন মনটা একটা খারাপ ছিলো তাই বাইক নিয়ে বের হয়েছিলাম রাতের শহর ঘুরতে। বাইক খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাইক ঠেলে ঠেলে আসছিলাম। হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো তাই বাইক রেখে বৃষ্টি আড়াল করে দাড়ালাম। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম জায়গাটা তোমার বাড়ির সামনে। আবার হঠাৎ করেই তোমার বেলকনিতে চোখ পড়তেই দেখি তুমি দাঁড়িয়ে আছো। তাই ম্যাসেজ করলাম, তারপর মনে হলো কেউ নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভেজার সময় ফোন সাথে আনবে না। এটা ভেবে কল দিলাম কিন্তু তুমি শুনতেই পেলে না। অনেক সময় পর যখন ভেতরে গেলে ভাবলাম কল দিবো কিনা। পরে একটু চিন্তা ভাবনার পর ম্যাসেজ দিলাম।
অয়ন লম্বা কথা শেষ করে অনুর দিকে তাকিয়ে দেখে সে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
অয়ন শুকনো ঢোক গিলে মনে মনে বললো, “মনে যা এসেছে বলে তো দিলাম। এবার বিশ্বাস করলেই হয়। আল্লাহ এবারের মতো রক্ষা করো।”
অনু সন্দেহাতীত ভাবে বললো, “সত্যি বলছেন?”
অয়ন বোকা হাসলো, “তোমার মিথ্যে মনে হলো?”
অনু স্বাভাবিক হয়ে বললো, “না তেমন কিছু না। তো আপনার বাইক থাকতে রিকশা করে ভার্সিটি আসেন কেনো এখন?”
পরীক্ষা শেষ হলে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবো। তাই এখন বাইক নিয়ে রিস্ক নিতে চাইছি না। এক্সিডেন্ট হয়ে গেলে আবার নতুন ঝামেলা আর চলে যাবো বলে বাইক বিক্রি করার চেষ্টা করছি।
অনু ছোট করে বললো, “ওহ্।”
তো তুমি এত রাতে দেবদাসের ফিমেল ভার্ষন হয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিলে কেনো?
বৃষ্টি আমার ভালো লাগে তাই রাত দিন মানি না। বৃষ্টি হবে আর আমি ভিজবো না সেটা কীভাবে হয়।
ওহ্ তাও ভালো আমি ভাবলাম পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার নিউ টেকনিক।
সেটা কীভাবে?
এই যে বৃষ্টিতে ভিজবে তারপর জ্বর হবে তাই আর পড়তেও হবে না। ভার্সিটিও আসতে হবে না।
আপনার কথা শুনে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মাথায় তুলে আছার দিতে।
অয়ন চোখের চশমাটা একটু উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো, “সেটা তুমি করতেই পারবে। ওয়েট আমার থেকে তোমার বেশীই হবে।”
অনু কিছু বলবে তার আগেই অয়ন নেমে চলে গেলো। অয়নের সাথে কথা বলতে বলতে কখন ভার্সিটি চলে এসেছে অনু টেরই পাইনি। অয়ন আজও ভাড়া না দিয়েই চলে গেছে। অনু রাগের মাঝেও হেসে ফেললো। অয়ন পাশে থাকলে অনু পুরো দুনিয়া ভুলে যায় অয়নের কর্মকান্ডে। অয়ন চলে যাবে ভেবে অনুর মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো। ভাড়া মিটিয়ে দৃষ্টি নত রেখে ক্লাসের দিকে যেতে লাগলো।
১২.
বিয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি। ফারহানের অফিস আছে আর অনুর ভার্সিটি তাই লিজা ভাবলো তামান্নাকে নিয়ে কিছু শপিং করে ফেলবে। তাই মেডিকেলে ক্লাস শেষ করে সোজা ফারহানদের বাসায় চলে গেলো।
কলিংবেল বাজালে সেলিনা চৌধুরী দরজা খোলে দিলো, “আরে আমার লিজা মামুণি যে। আয় ভেতরে আয়।”
লিজা ভেতরে আসতে আসতে সেলিনাকে সালাম জানালে সেও উত্তর দিলো।
ভাবি কোথায় ফুপ্পি?
কোথায় আবার দেখ গিয়ে নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে মনে হয়। ইরফান তো এক নবাবজাদি বিয়ে করে এনেছিল। সে খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কিছু বুঝে নাকি? আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিলো।
লিজা কিছু না বলে চুপচাপ শুনতে লাগলো সেলিনার কথা। ইরফান তামান্নাকে বিয়ে করার সময় সেলিনা চৌধুরী রাজি ছিলো না। তামান্নার ফ্যামিলির আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। সেটাই তামান্নার অপরাধ। ইরফান মায়ের কথা না শুনে পড়াশোনা করার সময়ই তামান্নাকে বিয়ে করে আনে। ইরফানের বাবা সাপোর্ট করেছিলো ছেলেকে। লিজা এখন সেলিনাকে কিছু বলতেও পারছে না তাই চুপচাপ শুনতে হচ্ছে। তখনই রুম থেকে বের হলো তামান্না।
লিজাকে দেখে বললো, “আরে বিয়ের কনে যে। তা কেমন আছো?”
লিজা মুচকি হেসে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ ভাবি ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন আর আমাদের লিটল চ্যাম্প তানভীর সাহেবকে দেখছি না।
তামান্না এগিয়ে আসতে আসতে বললো, “তাকেই ঘুম পারিয়ে এলাম। স্কুলে নিয়ে গেলে রেখে আসা যায় না। আমি না থাকলে সেও থাকবে না। একটু আগেই স্কুল থেকে এসে গোসল করিয়ে খাইয়ে তারপর ঘুম পারিয়ে এলাম। নাহলে রান্নার সময় খুব জ্বালায়।”
লিজা ছোট করে বললো, “ওহ্।”
তামান্না বললো, “আচ্ছা তুমি মায়ের সাথে গল্প করো আমি তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসছি।”
না না ভাবি আমি কিছু খাবো না। তার আগে বলো তুমি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো না নাকি? আগের থেকেও শুকিয়ে গেছো তো।
তামান্না কিছু বলবে তার আগেই সেলিনা তাচ্ছিল্যের সুরে বললে, “কী বল তো লিজা? বড়লোক বাবার বাড়ি ভালো ভালো মাছ মাংস খেয়ে বড় হয়েছে তো। তাই আমাদের বাড়ির খাবার উনার মুখে রুচে না।”
তামান্নার চোখ মুহূর্তে ভিজে উঠলে সে নিজেকে সামলে নিলো, “আসলে লিজা ছেলেটা একটু জ্বালায় তো তাই। আচ্ছা তুমি মনে হয় কলেজ থেকে সোজা এখানেই এসেছো। তুমি বরং একটু ফ্রেশ হয়ে এসো আমি তোমার জন্য কিছু আনছি।”
লিজা জোরপূর্বক হেসে বললো, “এতো ব্যস্ত হতে হবে না ভাবি আমার তেমন খিদে পায়নি।”
তামান্না কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললো, “তা বললে কী হয়? তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।”
তামান্না কিচেনে চলে গেলে লিজা সেলিনাকে বলে গেস্ট রুমে ফ্রেশ হতে যেতে চাইলে সেলিনা ফারহানের রুমে যেতে বললো। লিজাও কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো ফারহানের রুমের দিকে। লিজা যদিও জানে ফারহান রুমে নেই তবু কোথায় একটু অস্বস্তি হচ্ছে। এর আগে এই রুমে যায়নি ব্যাপারটা ঠিক তেমন না। আগেও অনেকবার গিয়েছে তবে তখন বিষয়টা আলাদা ছিলো। লিজা কাঁপা হাতে দরজার লক ঘুরিয়ে ভেতরে গেলো। লিজা যেমনটা আশা করেছিলো রুমটা ঠিক তেমনটা নেই। এর আগে যতবার এসেছে রুমটা গুছানো টিপটাপ পেয়েছে। তবে আজ একেবারেই এলোমেলো হয়ে আছে। লিজা কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে পুরো রুমটা দেখে নিলো। হাতের বই আর ব্যাগটা বেড সাইড টেবিলে রেখে রুম গুছানো শুরু করে দিলো। বেশ অনেকটাই সময় লাগলো পুরো রুম গুছিয়ে নিতে। কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে পড়লো।
তারপর পুরো রুম দেখে বললো, “নাউ পার্ফেক্ট।”
একটু রেস্ট নিয়ে লিজা চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে হাতমুখ মোছার জন্য কিছু না পেয়ে ফারহানের টাওয়েল নিলো। টাওয়েলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
লিজা ড্রয়িংরুমে কাউকে না দেখে কিচেনে চলে গেলো, “কী করছো ভাবি?”
তামান্না মুচকি হেসে বললো, “এই তো রান্না করছি। তা তোমার ফ্রেশ হতেই এতো সময় লাগলো? বরের রুমে গিয়ে আসতে ইচ্ছে করছিলো না বুঝি? আর কয়েকটা দিন সবুর কারো, তারপর ঐ রুমেই থাকতে পারবে।”
লিজা লজ্জা পেয়ে বললো, “ভাবি তেমন কিছু না। রুমে গিয়ে দেখি সব এলোমেলো হয়ে আছে তাই গুছিয়ে দিয়ে তারপর ফ্রেশ হয়ে এলাম।”
বাবাহ্ এখনই এতো খেয়াল। আমার দেবরের দেখি রাজ কপাল। তা আমার দেবর তো বাসায় নেই, কী মনে করে আসা হয়েছে?
কেনো এমনই আসতে পারি না?
এমা তা কেনো হবে? যখন ইচ্ছে আসতে পারো। কিন্তু দরকার ছাড়া তো ব্যস্ত মানুষদের দেখা পাওয়া যায় না তাই বললাম।
আসলে ভাবি দরকারেই এসেছি। আমার কিছু কেনাকাটা ছিলো। অনু আপুর সামনে এক্সাম আর ফারহান ভাইয়ার অফিস। তানিশাকে বললাম সে যাবে না তাই তোমার কাছে আসলাম।
মলিন হয়ে গেলো তামান্নার মুখ, “কিন্তু মা?”
ফুপ্পিকে আমি ম্যানেজ করে নিবো আর তানভীরকে ফুপ্পি রাখবে।
তামান্না লিজার দিকে তাকিয়ে প্রাণহীন হাসলো, “বলে দেখো কী বলে।”
তামান্নার ফ্যাকাশে মুখের মলিন হাসি চোখ এড়ালো না লিজার। ফর্সা মুখে চোখের নিচের কালো দাগও স্পষ্ট। এবার ভালো করে তামান্নাকে খেয়াল করলো লিজা। জীবন্ত একজন মানুষকে কেমন প্রাণহীন মনে হচ্ছে। বাইরেটা তো বেঁচে আছে কিন্তু ভেতরটা মরে গেছে।
লিজা হঠাৎ করেই তামান্নার হাত ধরে ফেললো, “তুমি ভালো আছো তো ভাবি?”
তামান্না কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকালো লিজার দিকে। সেই দৃষ্টি লিজার বুক কাঁপিয়ে দিলো। লিজা যেনো দেখতে পেলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর হাহাকার করা ভেতরটা। চোখ দুটো যেনো চিৎকার করে বলছে আমি ভালো নেই, ভালো নেই আমি।