ও আমায় ভালোবাসেনি পর্ব ৭

#ও আমায় ভালোবাসেনি
৭.

আমাকে তো আট বছর বয়সেই ফুপ্পির বাসায় রাখা হয়েছিল তাই স্কুল জীবনটা পুরোটাই আমার ফুপ্পির বাসাতেই কাটে এমনকি কলেজ জীবনটাও ।
তো আজ থেকে সাত বছর আগের কথা তখন আমি ক্লাস স্যাভেনে/এইটে পড়ছি । আমি , ফুপা আর ফুপ্পি থাকি বাসায় । রাইদ ভাইয়া পড়াশোনার খাতিরে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন ।
ভাইয়া নেই জন্য সারাটাদিন ফুপ্পির আমাকে নিয়েই কাটতো ।
ফুপ্পি আর ফুপা খুব ভালোবাসতেন আমায় , আমরা সুখেই ছিলাম কিন্তু আমাদের সুখ বেশিদিন সইলো না ।
ফুপা হঠাৎ একদিন সকালে হার্ট আ্যাটাক করে মারা গেলেন ।
বাসায় কান্নাকাটির রোল পড়ে গেলো ।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো! পরে বাবাকে কল করে বললাম ফুপা আর নেই তুমি জলদি চলে আসো ।
বাবা তৎক্ষণাৎ রওয়ানা হলেন মা সহ!
কান্নাকাটি শুনে বাসার ভাড়াটিয়ারা সবাই চলে আসলো ।
রাইদ ভাইয়াকে জানানো হলো , মানুষটা খুব শক্ত মনের । তিনি ওখানে থেকেই শান্ত স্বরে ফুপ্পিকে বোঝাতে থাকলেন , স্বান্তনা দিতে থাকলেন ।
তার আসতে লাগলো পুরো দু’দিন , উনি আসার আগের দিনই মাটি হয়ে গেছিলো । মৃত বাবার জানাযাটাও করার সুযোগ পাননি উনি ।
উনি যখন বাসায় এসে উপস্থিত হলেন তখন ওনার চোখেমুখে অদ্ভুত ক্লান্তি আর কঠোরতা ভর করে আছে ।
ওনাকে দেখে বাবা, ফুপ্পি সবাই কান্নাকাটি করলেন কিন্তু ওনার কোনো হেলদোল নেই ।
আমাকে বলছেন কাজের লোকদের ডেকে লাগেজ ঘরে নিয়ে যেতে তারপর চা বানিয়ে দিতে ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আমিও অবাক অথচ কাঠের পুতুলেন ন্যায় ওনার কথা মেনে চলছি ।
উনি এসেছিলেন বুধবার ,তো পুরো দু’টো দিন উনি নিজের ঘরে শান্তিমত রেস্ট নিয়ে কাটালেন । আমাদের কথা তেমন হয়নি ।
শুক্রবার দিন তার মাঝে হালকা পরিবর্তন আসলো ।
সক্কাল সক্কাল সে উঠে নাশতা বানালো, ফুপ্পিকে ডাকলো আমাকে ডাকলো ।
নাশতা খেতে দিলো নিজেই তারপর আমাকে একটুখানি ধমকে পড়তে বসার হুকুম দিলো ।
আমার কেনো জানি খুব বেশীই ভালো লাগছিলো আবার কষ্ট হচ্ছিল এটা ভেবে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে ছেলেটা ।
সবাই জানতো রাইদ ভাই তার বাবাকে ঠিক কতখানি ভালোবাসে অথচ এই ছেলের চোখে একফোঁটা পানি নেই??
হালকা পাতলা পড়াশোনা করে আমি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম জনাব গাছে পানি দিচ্ছেন সুন্দর ।
বেশ আগ্রহ নিয়ে আমি গিয়ে বললাম_”ভাইয়া আমি হেল্প করি?”
আমার কথা শুনে উনি দিলেন একটা কড়া ধমক , বললেন_” তোরে আমি পড়তে বলছিনা? তুই আমারে হেল্প করতে আসছস? আমি চাইছি হেল্প?”
খালি ফাঁকিবাজি না? যাহ পড়তে বস!
ওনার এক ধমকে আমার অবস্থা কাহিল ।
সেদিন নামাজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত উনি আমাকে পড়িয়েছেন ।
তারপর নামাজ পড়তে গেলেন , কিন্তু দুপুরবেলা তার বাসায় আসার নাম নেই ।
আমরা অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য কিন্তু না সে আসলো আর না ফোন ধরলো ।
ফুপ্পিকে এটাসেটা বুঝিয়ে খাইয়ে ঘুমোতে পাঠিয়ে আমি নিজের ঘরে বসে অপেক্ষা করছিলাম ।
বলে রাখি ক্লাস স্যাভেন এইটে পড়ুয়া হলেও খুব অল্প বয়সেই আমি ম্যাচিওর হতে শুরু করেছিলাম ।
আমি তো আর অন্য পাঁচটা স্বাভাবিক ফ্যামিলির মতো বাবা-মা দু’জনের ভালোবাসা পাইনি তাই আমি বুঝতে শিখেছিলাম একা একা চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ।
ঐ বয়সে বুঝতে শেখাটাকে মানুষ পাকনামির নাম দিয়ে দিতো , সে ব্যাপারে আমার বিশেষ সমস্যাও ছিলো না ।
আর আমার গ্রোথ ছিলো ভালো , বেশ লম্বাচওড়া এবং স্বাস্থ্যবান মেয়ে আমি।
যাহোক আমি বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম ওনার জন্য ।
আসরের নামাজের একটু পরেই আসলেন তিনি বাসায় ।
এসেই সোজা রুমে ঢুকে গেলেন ।
মুখের নকশা ক্যামন পাল্টানো ছিলো!
আমি ভয়ে ভয়ে ওনার পেছনে গেলাম , দরজা ভেজানো ছিলো । হালকা নক করেই ভেতরে গেলাম , রাইদ ভাইয়া তখন পাঞ্জাবি ছেড়ে খালিগায়ে শুধু প্যান্ট পরে শুয়ে আছেন ।
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার দরুণ তার মুখটা ভালোমতো দেখা যাচ্ছিল না ।
আমি আস্তে করে ডাকলাম_ রাইদ ভাইয়া?
প্রথমে উনি জবাব দিলেন না ।
সাহস সঞ্চয় করে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং আবার ডাকলাম_ভাইয়া খাবেনা?
সে এবারে মাথা উঁচু করে তাকালো ।
চমকে উঠলাম আমি , টকটকে লাল চোখ , জল ছলছল করছে সেই চোখ দুটি তে ।
আমার ভয় উবে গেলো আর খুব মায়া হলো ।
উনি নিজে থেকে বললেন_ মিথি একটু বস তো?
একটু সরে গিয়ে আমায় বসার জায়গা করে দিলেন ।
আমিও বসে পড়লাম কি মনে করে!
পা ভাঁজ করে বসেছিলাম আমি , কয়েক মুহুর্ত পরেই উনি এসে আমার কোলের ওপর মাথা রাখলেন ।
আমি খানিক চমকে গেলে উনি বললেন_ চুলগুলো টেনে দে মাথা ব্যাথা করছে খুব ।
আমি কালবিলম্ব না করে দিচ্ছি বলে ওনার মাথার চুলগুলি টেনে দিতে লাগলাম ।
— কোথায় গেছিলে? ফুপ্পি অপেক্ষা করছিল তো..

উনি কিছু বললেন না । কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো উনি কাঁদছেন , ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমি কিছু বললে শব্দ করে কেঁদে ফেলেন আর বলতে লাগেন_আমার বাবাকে খুব দেখতে মন চাইছে , ওয়াদা করেছিলাম বাবাকে বাড়ি বানিয়ে দিবো একটা । আগের দিনও কথা হলো তবে কেনো হঠাৎ এতসব হয়ে গেলো? আমার বাবাকে চাই মিথি , একটা বিকেল বাবার সাথে কাটাতে চাই৷ কত হতভাগা ছেলে আমি , বাবাকে একনজর দেখতে অবধি পাইনি মৃত্যুর আগে উফফ এতো যন্ত্রণা আমি কাকে বলি?
ডুকরে কেঁদে উঠলেন রাইদ ভাই । আমি অবাক হয়ে গেলাম ওনার কান্না দেখে , খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন ।
কান্না করতে করতে মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ।
আমি রাত আটটা পর্যন্ত ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি , খেয়ালই ছিলো না ক’টা বাজে! পরে ফুপ্পি ডাকায় হুঁশ হলো ।
পরে নিজের রুমে আসার পর আরো খারাপ লাগছিল আমার , আমার প্রথম দেখা কোনো ছেলের কান্না ছিলো সেটা ।
,
রাতের দিকে সে খেতে না আসায় আবার যখন ডাকতে গেলাম তখন দেখি সে বিছানায় শুয়ে গোঙ্গাচ্ছে ।
কাছে গিয়ে দেখি গায়ে ভীষণ জ্বর ।
মহা মুসিবত! ফুপ্পিকে সাথেসাথেই ডেকে মাথায় পানি ঢালা হলো , জল পট্টি দেয়া হলো ।
এসব করতে করতেই রাত বারোটা পার ।
ফুপ্পি বারবার আমাকে ঘুমোতে বলছিলেন , আক্ষেপ করে বলছিলেন ছোট মেয়েটা কত কষ্ট করছে আমাদের জন্য কিন্তু আমার ওরকম কোনো ফিলিংস হচ্ছিল না ।
জ্বরটা যখন নিয়ন্ত্রণে আসলো তখন আমি জোর করে ফুপ্পিকে খাইয়ে শুতে পাঠালাম ।
রাইদ ভাইয়ার কাছেই আমি বসেছিলাম , এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ।
সেদিন প্রথম তাকে অত কাছে থেকে মনযোগ দিয়ে দেখা ।
স্যাভেন-এইটের মেয়েরা কিন্তু ফ্রেন্ডদের অনুকরণ করে খুব বেশীই ।
স্কুলে গেলে প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম নাইন টেন বা কলেজ পড়ুয়া ভাইদের সাথে বান্ধবীদের প্রেম ।
ঐ বয়সেই তাদের এক্সও তৈরি হয়ে গেছে ।
ওদের প্রথম দেখা , গোলাপ দিয়ে প্রপোজ , চিরকুট আদানপ্রদান আবার সুদর্শন বয়ফ্রেন্ড এর নানারকম গল্প শুনে আমারও মন চাইত কারো সাথে প্রেম করতে ।
প্রেম আসলে কি এটা আমি তখন অত গভীর না বুঝলেও বুঝতাম আই লাভ ইয়ূ বলা আর লজ্জা পেলেই গোলাপ , চিরকুট পাওয়া যায় ।
এগুলো পাওয়া খুশির ব্যাপার!
হাস্যকর হলেও এগুলো সত্যি ।
যাহোক সে রাতে রাইদ ভাইকে মনযোগ দিয়ে দেখার পর আমার মনে হলো ভাইয়া দেখতে অনেক সুন্দর , ইশশ যদি সে আমার চিরকুট দেয়া মানুষ হতো!
আমার আকাশ কুসুম চিন্তা শুরু হয়েছিল তখনই ।
আনুমানিক রাত ২-৩ টার দিকে আবার গোঙাতে লাগলেন উনি ।
আমি তড়িঘড়ি করে কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখলাম ভীষণ জ্বর!
কি আর করার! ফের জলপট্টি দেয়া শুরু হলো , আশ্চর্য ভাবে আমার একদম ক্লান্তির সৃষ্টি হয়নি ।

উনি জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছিলেন ।
বারবার বলছিলেন আমার বাবাকে এনে দাও প্লিজ , একবার দেখতাম ।
কিছু বলার ছিলো না , আমি শুধু ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলাম ঘুমিয়ে পড়ো প্লিজ ।
,
আমার কন্ঠ শুনে উনি চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকলেন ।
তারপর যখনই আমি ভেজা রুমাল ওনার কপালে ছোঁয়ালাম তখন ডান হাত দিয়ে আমার হাতটা চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন_ তুই এতো পিচ্চি কেনো মিথি? আর একটু বড় হতে পারলি না? আমার কষ্ট যন্ত্রণা আমি সব জোর করে তোকে দিয়ে দিতাম , তোর মনেও তো অনেক কষ্ট । কাটাকাটি হয়ে ভ্যানিশ হয়ে যেত , বিষে বিষক্ষয়!
,
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম এটা শুনে ।
মনে মনে ভাসতে লাগলো এটার কি খুব সুন্দর একটা মিনিং থাকতে পারে??
.
এরপর দিন থেকে রাইদ ভাইয়ের সাথে আমার বেশী কথা হলো না ।
উনিও চুপচাপ , হঠাৎ করেই বললেন আবার ব্যাক করবেন ছুটি শেষ ।
ফুপ্পি যেতে দেবেন না কিন্তু উনি জোর করে গেলেন যাবার আগে শুধু বললেন_ এখানে থাকলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে , পাগল পাগল লাগে ।
আমার যে পাগলামি থামাতে বাইরে পাঠিয়েছিলে সেই পাগলামি দ্বিগুণ হলে আমি নিজেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবো মা এবং কথাগুলো উনি সম্পূর্ণ আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন ।
আমি তখন ওসবের মানে না বুঝলেও সবটাই বুঝেছি ঠিক দু’বছর পর ।
দু’বছর পর থেকেই আমার আর রাইদ ভাইয়ের গল্পের শুরু ।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here