#কালো_রাত্রির_খামে (২১)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
আদিলদের বাড়ি থেকে ফিরে রাত্রি তানবীনদের বাড়িতে গেল। তানবীন, তুরিন ছাড়াও বাড়িতে আরও আছে তাদের মামা-মামি, নানি আর কাজে সাহায্যকারী মহিলা। সদর দরজা খুলে রাখা। কাজেই রাত্রি বাসার ভিতরে ঢুকে পড়লো। বসার ঘরে নানি, তুরিন ও তুরিনের এক মামাতো বোন বসে আছে। নানি রাত্রিকে ডেকে নিয়ে কাছে বসালেন। বললেন,
“আমার নাতিটা মা-বাবাকে হারিয়ে কেমন হয়ে গেছে গো রাত্রি। ও খায় না, ঘুমায় না, কারো সাথে তেমন কথা বলে না। তুমি ওর সাথে একটু কথা বলো। ওকে একটু বুঝাও। ও এমন করলে মরে যাবে। আমার রেহনুমার এত যত্নে গড়া ছেলে এভাবে শেষ হতে পারে না। মেয়েটাকে হারিয়েছি, এখন নাতি-নাতনি দুটোকেও হারাতে পারবো না। ওরাই তো আমাদের সব।”
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন নানি। শাড়ির আঁচলে জল মুছে বললেন,
“যাও রাত্রি, ওর রুমে গিয়ে ওর সাথে একটু কথা বলো। মা-বাবাকে হারালো, ভাইয়ের এমন অবস্থা, মেয়েটা একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে!”
রাত্রি তুরিনের দিকে তাকালো। মেয়েটার ফ্যাকাশে মুখ দেখলে হৃদয়ে বড়ো কষ্ট লাগে।
রাত্রি তানবীনের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো। দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ নয়। অল্প কিছুটা ফাঁক হয়ে আছে।
“ভিতরে আসবো?” অনুমতি চাইলো রাত্রি।
কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। ঘুমাচ্ছে না কি? রাত্রি আরও একটু ফাঁক করলো দরজাটা। দেখা গেল তানবীনকে। ঘুমাচ্ছে না, বসে আছে জানালার কাছে। যদিও সে শুনতে পেয়েছে রাত্রির কথা, কিন্তু প্রত্যুত্তর দেয়নি। রাত্রি ভিতরে ঢুকলো। এগিয়ে গিয়ে কিছুটা কাছাকাছি দাঁড়ালো তানবীনের। তানবীনকে দেখতে একদমই ভালো লাগছে না। কেমন পাথরের মতো নিশ্চল, প্রাণহীন! কী অবনতি চেহারার! ফ্যাকাশে মুখ, উশকোখুশকো চুল, লাল চোখ, চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল, ঠোঁট বিবর্ণ! এটা তো সব সময়ে দেখে আসা তানবীন নয়। রাত্রি জানতে চাইলো,
“কেমন আছেন আপনি?”
তানবীন ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো, যেন রাত্রি তার মুখ দেখতে না পায়। মুখ দেখাতে ভয় করছে। যদি মুখ দেখে রাত্রি বুঝে যায় সে নিজের বাবাকে খু’ন করেছে? রাত্রি এটা জানার পর কি তাকে ঘৃণা করবে? তার মুখ দেখতে চাইবে আর?
রাত্রির কষ্ট লাগছে। এই মানুষটা নিজ থেকে তার সঙ্গে কথা বলতো। নিজের কথার প্যাঁচে ফেলে তাকে প্রতিবার অপ্রস্তুত করে ফেলতো। আজ সেই মানুষটার মুখে কথা নেই। সে নিজ থেকে কথা বলতে আসার পরও কথা বলছে না। রাত্রি বললো,
“আপনি কথা বলবেন না আমার সঙ্গে?”
তানবীনের চোখ ভিজে উঠেছে। বুকের ভিতরটায় খুব তুলকালাম হচ্ছে কষ্টে। কিন্তু সে কারো কাছে কিছু প্রকাশ করতে পারছে না। এমনকি ভালোবাসার মানুষটার কাছেও না। হয়তো এমন কথা ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে আরও বেশি গোপন করে রাখতে হয়।
রাত্রি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও কিছু বললো না তানবীন।
রাত্রি বললো,
“আপনি এমন কেন করছেন? আপনার আশেপাশের মানুষজন যে কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারছেন না? আমি জানি এই সময়টা আপনার জন্য কত কঠিন, কত শোকের, কিন্তু তবুও আপনার এ সময় নিজের মন শক্ত করে তুরিনকে দেখা উচিত। কিন্তু আপনি ওর থেকেও অনেক বেশি ভেঙে পড়েছেন। দয়া করে নিজেকে একটু শক্ত করুন। এরকম করে জীবন চলতে পারে না। তুরিনও তো আছে আপনার জীবনে।”
তানবীন সব শুনলো। কিন্তু কিছু বললো না। সে মনে করে তার জীবন থেমে গেছে। আর কখনও এই জীবন চলমান হবে না। মাকে তার বাবা মে’রে ফেলেছে, আর বাবাকে সে! খু’ন করে ফেলেছে নিজেরই বাবাকে! এরপর সেও মরে যাবে। আবারও সবাই কাঁদবে তার মৃত্যুতে! তার চারপাশে শুধু অন্ধকার। খুব বেশিদিন যেন নেই তার মৃত্যুর!
রাত্রি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু তানবীন একেবারে নিশ্চুপ। এত নীরব কারো কাছে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। রাত্রি বেরিয়ে গেল রুম থেকে। বসার ঘরে আসতেই তুরিন বললো,
“ভাইয়া কথা বলেনি আপনার সঙ্গে?”
“না।”
তুরিন দাঁড়িয়ে গেল। রাত্রিকে বললো,
“আপনি এখানেই বসুন। ভাইয়া কথা বলবে।”
তুরিন তানবীনের রুমে গেল। দরজাটা চেপে রেখে চেঁচিয়ে জানতে চাইলো,
“কী হয়েছে তোমার? মরা লা’শের মতো কেন করছো তুমি?”
তুরিন টেনে দাঁড় করালো তানবীনকে। যেন সে তানবীনের অভিভাবক। বললো,
“কী অবস্থা তোমার? তোমাকে দেখতে মরা লা’শের মতোই লাগছে! কথা বলোনি কেন? তার সঙ্গে কীভাবে কথা না বলে থাকতে পারো? এটা সে ভাইয়া। যাকে তুমি ভালোবাসো। তার সঙ্গেও কথা বলবে না? তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? মরে যেতে চাও তুমি? ঠিক আছে, মরার আগে আমাকেও বলো। আমিও মরবো তোমার সঙ্গে।”
তুরিনের উচ্চৈঃস্বরের কথাগুলো বসার ঘরে পর্যন্ত শোনা গেল। তবে বেশিক্ষণ এরকম চেঁচিয়ে কথা বলতে পারলো না সে। কান্নায় ভেঙে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“এমন করো না ভাইয়া। তুমি যা করেছিলে ঠিক করেছিলে। তুমি ইচ্ছা করে করোনি ওটা। আমাদের মাকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত ওটা হয়ে গেছে!”
তানবীন ভীষণ অপরাধ বোধ নিয়ে বললো,
“কিন্তু আমি খু’নটা করেছি!”
তুরিন ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“ভুলে যাও না ওটা। আমাদের চোখের সামনে মাকে মে’রে ফেলেছে! আমাদের বাবা একজন ভালো মানুষ ছিল না। নিজেকে একটু সামলাও ভাইয়া। তুমি এরকম করতে পারো না। ভুলে যাও সব। আমরা সবাই আছি তো পাশে।”
তানবীন বোনের মাথায় ভরসার হাত রাখতে পারলো না। কারণ সে জানে, সে ভুলতে পারবে না ওই রাতের ঘটনাটা। খু’ন করে সে যে খু’নি এটা কি ভুলে যাওয়া যায়? আর সে যে অনুমান করতে পারছে, সেও শীঘ্রই মারা যাবে!
তুরিন ভাইকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“আমি ভাবিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি তার সাথে কথা বলবে।”
তানবীন না বোধক মাথা নাড়লো। কিন্তু তুরিন শুনলো না।
“আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।” বলেই সে বেরিয়ে গেল।
রাত্রি মামি ও নানির সঙ্গে কথা বলছিল। তুরিন এসে বললো,
“ভাইয়া আপনাকে ডাকছে। কথা বলে আসুন।”
একটু আগেও তো কিছুই বলছিল না, এখন ডাকছে? আজব লাগলো রাত্রির। হয়তো তাকে ডাকছে না, মিথ্যা বলছে তুরিন।
রাত্রি বসে আছে দেখে তুরিন বললো,
“যাবেন না?”
রাত্রি আবার গেল তানবীনের রুমে। তানবীন এখন বিছানার উপর বসে আছে। রাত্রি রুমের ভিতর ঢুকে দাঁড়াতেই তানবীন
বললো,
“আমি ভীষণ মন্দ আছি রাত। কেমন কষ্ট হচ্ছে, কতটা কষ্ট হচ্ছে, আমি প্রকাশ করতে পারছি না। আ… আমার মস্তিষ্কে প্রলয় ঘটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাব। এসব কেন হলো বলতে পারো? এক কারণে বুকের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে, আরেকটা কারণে মস্তিষ্কে লন্ডভন্ড অবস্থা! আমি কীভাবে বাঁচবো বলতে পারো?”
তানবীন কান্না আটকাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু তার দু চোখের অশ্রু বয়ে চললো বিনা অনুমতিতে।
রাত্রি টের পেল তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে অশ্রুতে। সে বললো,
“আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা!”
“সত্যি বলতে আসলে কেউ বুঝতে পারবে না আমি এখন কতটা খারাপ আছি। আমি এখন যতটা খারাপ আছি এই খারাপের পরিমাণ নির্ণয় করা যায় না। যদি মারা যেতে পারতাম হয়তো শান্তি পেতাম।”
“এটা আপনি কী বলছেন? দয়া করে আর কখনও এমন কিছু বলবেন না।” রাত্রির বুক ধুকপুক করছে তানবীনের শেষ কথাটা শুনে।
“আমার কি মনে হচ্ছে জানো? আমি এমন অনুভব করছি যে, হয়তো আমিও খুব শীঘ্রই মারা যাব!”
“চুপ করুন আপনি। কীসব বলছেন!”
রাত্রির খুব ভয় করছে। তানবীন এমন কথা কেন বলছে? এসব কথা খুব ভয়ংকর!
তানবীন বললো,
“রাত, তুমি কি আমার কাছে এসে একটুক্ষণ বসতে পারো?”
রাত্রি তানবীনের পাশে গিয়ে বসলো। কিন্তু তানবীন কিছুই বললো না। অনেকক্ষণ নীরবতার পর রাত্রির দিকে তার দুঃখী আঁখি দুটি মেলে তাকিয়ে বললো,
“তোমাকে একটা কথা বলবো, কথাটা শোনার পর কি তুমি আমাকে ঘৃণা করবে?”
তানবীনের এ কথায় একটু চমকালো রাত্রি। কী বলবে তানবীন যা শুনে সে তানবীনকে ঘৃণা করবে? রাত্রি বললো,
“আপনি কথাটা না বলা পর্যন্ত তো এটা বলা সম্ভব নয়।”
তানবীন বললো,
“তুরিন মিথ্যা বলেছে সবার কাছে। বাবাকে মা মারেনি। মা কোনো প্রকার আঘাত করেনি বাবাকে। কে মে’রেছে জানো? আমি!”
রাত্রির বুক ধক করে উঠলো। এমন কোনো লুকায়িত সত্য জানতে এই মুহূর্তে প্রস্তুত ছিল না সে।
তানবীন আরেক বার বললো কথাটা,
“আমি আমার বাবাকে খু’ন করেছি!”
রাত্রি এই অসহ্য সত্যটা সহ্য করতে পারলো না। ঝট করে উঠে দাঁড়ালো তানবীনের পাশ থেকে। তার চোখে ঘোর অবিশ্বাসের ছায়া। দারুণ বিস্ময়ে তানবীনকে দেখছে। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললো,
“আপনি মিথ্যা বলছেন!”
তানবীন ভীত কণ্ঠে বললো,
“কাউকে মে’রে আমি কীভাবে বেঁচে থাকবো রাত? আমি তো মরে যাব। হ্যাঁ, আমি খুব শীঘ্রই মারা যাব।”
রাত্রি আসলেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তানবীন নিজের বাবাকে মে’রে ফেলেছে? তুরিন মিথ্যা বলেছে মানে? সবাই যেটা জানে সেটা তাহলে ভুল? তানবীনের বাবাকে আসলে তানবীন মে’রেছে? রাত্রি যেন অসুস্থ বোধ করছে। তার শরীর ঘামছে। তানবীন একটা মানুষকে মে’রে ফেললো? তাও কি না নিজের বাবাকে?
তানবীনের বাবা খু’ন করলো তার মাকে, আর তানবীন খু’ন করলো বাবাকে? রাত্রি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না এখানে।
তানবীন মাথা নুইয়ে কাঁদছিল। সে হঠাৎ তাকালো রাত্রির দিকে। রাত্রির চোখে-মুখে ভয় ও অবিশ্বাস্য ভাব দেখে তার হঠাৎ দূরের নক্ষত্রের মতো মনে হলো রাত্রিকে। যে নক্ষত্রকে শুধু জমিনে পা রেখে দেখেই যাওয়া যায়, কিন্তু ওই নক্ষত্র এত দূরে থাকে যে ছুঁয়ে দেখা যায় না।
রাত্রি বেরিয়ে এলো তানবীনের রুম থেকে। মামি রাত্রিকে বেরিয়ে আসতে দেখেই প্রশ্ন করলো,
“কিছু বললো তানবীন?”
“না, একটা কথাও বলেননি তিনি। আমাকে এখন যেতে হবে। বাড়িতে কাজ আছে। ভালো থাকুন আপনারা। ইনশাআল্লাহ সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।”
কথাগুলো কোনোরকম ভাবে বলে বেরিয়ে এলো রাত্রি। তানবীন কাউকে খু’ন করেছে এটা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
রাত পর্যন্ত তার মাথায় এই নিয়ে খুব চিন্তাভাবনার উদ্রেক চললো। সে শান্তি পাচ্ছে না। তানবীন নিজের বাবাকে মে’রেছে কেন? স্বেচ্ছায় মে’রেছে? বাবা তার মাকে মে’রেছে বলে সেই রাগে? না কি দুর্ঘটনাবশত? সে তো কিছুই জানে না। তবে তানবীনকে দেখে মনে হয়নি স্বেচ্ছায় বা সজ্ঞানে সে কিছু করেছে। তাকে বিষয়টা ভালোভাবে জানতে হবে। তখন ওভাবে ওই বাড়ি থেকে চলে আসা উচিত হয়নি তার।
রাত্রি তানবীনের নাম্বারে কল দিলো। কল রিসিভ হলো না। যেখানে তানবীন এখন সামনাসামনি কারো সাথে কথা বলতে চায় না, সেখানে কল রিসিভ করবে এ ভাবাও বোকামি। তবুও রাত্রি আরও একবার কল দিলো, কিন্তু রিসিভ হলো না এবারও।
রাত্রি এরপর তুরিনকে কল করলো। প্রথমে সামান্য টুকটাক কথা সেরে তানবীনের প্রসঙ্গ উঠালো। যদিও প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত বোধ হচ্ছিল, তবুও শেষমেশ সে প্রশ্ন করেই বসলো,
“তোমার বাবাকে কি তোমার ভাইয়া মে’রেছে তুরিন?”
এ প্রশ্নে চমকে উঠলো তুরিন, থমকে গেল। রাত্রি কীভাবে জানলো এ কথা? এ কথা কি সে, ভাইয়া ও মামা ছাড়াও অন্য কেউ জানে? কীভাবে? এটা তো গোপন। তুরিনের কপালে ঘাম জমতে শুরু করলো। জানতে চাইলো,
“কে বলেছে এই কথা?”
“তোমার ভাইয়া।”
তুরিন অবাক হলো এটা শুনে। ভাইয়া? এই কথা সে রাত্রিকে জানিয়ে দিয়েছে? কেন জানাতে গেল? আসলেই কি মাথা সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে গেছে? তুরিন বুঝতে পারলো রাত্রি বেশি কিছু জানে না। তাহলে তার কাছে প্রশ্ন করতো না। কতটুকু জানে রাত্রি? শুধু যদি জানে বাবাকে তানবীন মে’রেছে তাহলে তো ভুল বুঝবে। কীভাবে কী হলো, কীভাবে মারা গেল তা কি জানে?
রাত্রি আবার জানতে চাইলো,
“কেন মা’রলো সে নিজের বাবাকে?”
তুরিন সে রাতের ঘটনা খুলে বললো রাত্রিকে। বলতে গিয়ে অনেক কাঁদলো।
অপরাধ বোধ হলো রাত্রির! সে এ কথা জিজ্ঞেস করলো বলেই মেয়েটা সেই রাতের কথা মনে করে এত কাঁদছে। রাত্রি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু কষ্ট আসলে সান্ত্বনা দিয়ে দূর করা যায় না।
রাত্রি এবার ভালো ভাবে বুঝতে পারছে তানবীনের মানসিক অবস্থাটা। একদিকে মায়ের মৃত্যুর কষ্ট, ও আরেক দিকে তার করা আ’ঘাতে বাবার মৃত্যু! সবটা মিলিয়ে তানবীন এত বেশি মানসিক ট্রমায় ভুগছে। একটা মানুষকে মে’রে ফেলা অত্যন্ত ভয়ংকর একটা ঘটনা। সুতরাং বিষয়টা তানবীনকে প্রচণ্ড মানসিক ট্রমায় ভোগাবে এটা স্বাভাবিক।
___________________
দরজা খোলা মাত্রই অপরিচিত একটা মেয়েকে দেখতে পেল রাত্রি। এ বিল্ডিংয়ের কেউ নয়। হয়তো কারো আত্মীয় হবে, বেড়াতে এসেছে।
মেয়েটা বললো,
“এটা অয়নদের বাসা না?”
মেয়েটার এ প্রশ্নে একটু আগের ধারণা যে ভুল তা বুঝতে পারলো রাত্রি। মেয়েটা হবে হয়তো অয়নের ভার্সিটির কেউ। কিন্তু মেয়েটার বয়স কম মনে হচ্ছে। রাত্রি বললো,
“হ্যাঁ, এটা অয়নদের বাসা।”
“উনি বাড়িতে আছেন?”
“না, কিছুক্ষণ আগে বাইরে গেল।”
“আচ্ছা, আমি তাহলে ভিতরে গিয়ে বসি?”
মেয়েটা রাত্রিকে প্রায় ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লো। খুব উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ঘরের ভিতর ঢুকে মেয়েটা ঠিকই বসে পড়েছে। রাত্রি মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো,
“তুমি কে?”
মেয়েটা চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
“রোশনি।”
মেয়েটার নাম এর আগে শোনেনি রাত্রি। অয়ন কখনও কোনো মেয়ের কথাই বলেনি তার কাছে। তবে মেয়েটার এমন আকস্মিক আগমন মোটেই ভালো ঠেকছে না। মেয়েটা কি অয়নের প্রেমিকা?
(চলবে)#কালো_রাত্রির_খামে (২২)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
রাত্রি ভাবতে পারছে না অয়নেরও প্রেমিকা আছে। অবশ্য সে তো এখনও নিশ্চিত না। মেয়েটাকে কিছু খেতে দিতে হয়। রাত্রি রোশনিকে বসতে বলে কিচেনে গেল। চা তৈরি করলো। চায়ের সঙ্গে টোস্ট নিয়ে ফিরলো সে। কয়েকদিন আগে শ্রাবণীর জন্য টোস্ট কিনেছিল। ভাগ্যিস দিতে পারলো এই জন্য।
রাত্রি এসে দেখলো রোশনির সঙ্গে কথা জুড়ে বসেছে শ্রাবণী। একদম পাশাপাশি। এমন সাধারণত পরিচিত না হলে বসা যায় না। সে শ্রাবণীর কাছে জানতে চাইলো,
“তুমি ওকে চেনো?”
“চিনবো না কেন? সে তো রোশনি আপু। পাশের বাড়িতে থাকে। ওই বাড়ির নতুন মালিক তারা।” শ্রাবণীর ঝটপট উত্তর।
পাশের বাড়িতে থাকে অথচ কি না সে একদিনও দেখেনি? এ ব্যাপারটা রাত্রির কাছে খুব অবাকের। সে আস্তে করে বললো,
“ওহ।”
রাত্রি চায়ের কাপটা রোশনির হাতে দিলো। সংকোচ বোধ হচ্ছিল তার। পাশের বাড়ির মেয়ে মানে ভালোই ধনী। ধনী ঘরের মানুষরা দরিদ্র ঘরের দেওয়া কিছু নাও খেতে পারে। তবে এ মেয়েটা খেলো। চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে খেলো। রাত্রি কোনো অহমিকা উপলব্ধি করতে পারলো না মেয়েটার মাঝে। বরং স্বচ্ছ মনের মনে হলো। শান্তি লাগলো রাত্রির। সে এবার জানতে চাইলো,
“অয়নের কাছে কী প্রয়োজন?”
“ওনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। কিন্তু বাইরে ওনার আজকাল দেখাই পাওয়া যায় না। সম্ভবত উনি বিকালের টিউশনিটারও সময় বদলেছেন। তাই উপায় না পেয়ে বাড়িতে চলে এলাম। আমি এসেছি বলে কি আপনারা রাগ করেছেন?”
“না না রাগ করবো কেন? ঘরে অতিথি আসা আনন্দের। কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”
“ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।”
“আচ্ছা।”
মিথিলা রুম থেকে বেরিয়ে একজন অপরিচিত মেয়ে দেখে প্রশ্ন করলো,
“মেয়েটা কে?”
রাত্রি প্রশ্নের জবাবে বললো,
“পাশের বাড়িতে থাকে। রোশনি।”
অয়ন ফিরেছে। প্রথমটায় রোশনিকে খেয়াল না করেই রুমের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ রোশনির উপর চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে গেল সে। কেন যেন মনে হলো মেয়েটা তার জন্যই বসে আছে। খুব রাগ লাগলো অয়নের।
রোশনি অয়নকে দেখে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিল। আপনাকে বাইরে কোথাও পাচ্ছিলাম না, তাই বাড়িতে চলে এলাম। আমি আপনাকে ছাড়া…”
“চুপ করুন।”
ধমকে উঠলো অয়ন। সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর থামলো রোশনির। কিন্তু বোনদের সামনে একটা মেয়েকে এরকম ধমকানো উচিত হলো কি না বুঝতে পারছে না। সবার চোখের তারায় কেমন বিস্ময়। মেয়েটা আসলেই কার্টুন। এভাবে তার বাসায় চলে এলো কোন আক্কেলে? অয়ন রোশনির দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো,
“বাইরে আসুন।”
বলে অয়ন বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। রোশনিও বেরিয়ে গেল অয়নের পিছন পিছন।
তিন বোনই অবাক হয়ে চেয়ে আছে তাদের যাওয়ার পানে। বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। মেয়েটার সাথে অয়নের সম্পর্ক কী?
অয়ন একদম গেট পেরিয়ে রাস্তায় চলে এলো। এরপর বললো,
“সমস্যা কী আপনার? আমার বাড়িতে এলেন কোন আক্কেলে?”
“আমি তো বললাম, আমার কিছু বলার আছে।”
“কী এমন বলার আছে আপনার যার জন্য বাড়িতে চলে আসতে হলো?”
রোশনির কথাটা বলতে ইতস্তত বোধ হচ্ছে। কিন্তু সে সেসব ঝেড়ে ফেলে বললো,
“আমি চেষ্টা করেছিলাম আমি আপনাকে ভুলে থাকবো, অনেক চেষ্টা করেছি বিশ্বাস করুন। কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম। আমার পক্ষে আপনাকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়।”
কথাগুলো পানসে লাগলো অয়নের কাছে। কোনো রূপ প্রভাব ফেলতে পারলো না তার মাঝে। সে বললো,
“এসব ফালতু কথা বলার জন্য আমার বাড়িতে আসা কি আপনার খুব জরুরি ছিল?”
“এগুলো ফালতু কথা?” খুব কষ্ট পেল রোশনি।
“আমার কাছে তো তাই-ই। এসব ভুলে যান। মন দিয়ে লেখাপড়া করুন।”
“আপনার কথা ভেবে আমি খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না, কোনো কাজই ঠিকঠাক করতে পারি না। আর লেখাপড়া? সে তো অসম্ভব।”
“আপনি যা ইচ্ছা তাই করুন, আমার কিছু করার নেই।”
“কেন কিছু করার নেই? আমাকে বিয়ে করে নিলেই তো পারেন।”
“আমি বিয়ে করলে এমন কাউকে করবো যে আমার জন্য পারফেক্ট।”
“আমি কি এতই অনুপযুক্ত যে আমাকে বিয়ে করা যাবে না? কেন আপনার চেয়ে দেখতে কি আমি খুব অসুন্দর? আমাকে নিজের বউ বলে মানুষের সামনে পরিচয় দিতে লজ্জা করবে?”
“হ্যাঁ, লজ্জা করবে। তবে সেটা আপনি সুন্দর-অসুন্দর কি না সেটার জন্য নয়। এটার জন্য লজ্জা করবে যে আপনি বোকা। সুখী জীবন ছেড়ে আমার দুঃখের জীবনে এসেছেন, এর জন্য লজ্জা করবে। যাই হোক, আপনার সঙ্গে আমি কথা বাড়াবো না। যা বলার আপনার মাকে বলবো।”
রোশনি ভয় পেয়ে বললো,
“মাকে কী বলবেন?”
“বলবো আপনাকে দ্রুত অন্যত্র বিয়ে দিতে।”
“কিন্তু আমি শুধু আপনারই স্ত্রী হতে চাই।”
রাস্তা দিয়ে একটা ছেলে যাচ্ছিল। রোশনির কথা শুনেই ফিক করে হেসে উঠলো সে। সম্ভবত হাই স্কুলে পড়া ছেলে।
অয়ন বললো,
“বাড়িতে যান, বেশিক্ষণ বাইরে থেকে লোক হাসাবেন না। আর আবেগ থেকে বেরিয়ে আসুন।”
অয়ন এ কথা বলে গেট দিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়লো।
অয়ন কি তাকে ‘বাইরে থেকে লোক হাসাবেন না’ এ কথা বলে অপমান করলো? তবে অয়নের অপমানেও অপমানবোধ হলো না রোশনির। সে বুঝতে পারলো কত বাজেভাবে ভালোবেসে ফেলেছে সে অয়নকে!
অয়ন বাসায় আসতেই বোনদের সম্মুখীন হলো। একেক জনের একেক প্রশ্ন। অয়ন একক ভাবে কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
“মেয়েটা পাগল। বুঝতে পেরেছো? ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। নেই মানে নেই-ই।”
মিথিলা বললো,
“বাড়িতে এলো কেন তাহলে? আর তুমিই বা ওর সাথে অমন ব্যবহার করলে কেন?”
“পাগল তাই। বড়োলোক বাবার পাগল মেয়ে। যখন আমি বলছি ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, তারপরও অবিশ্বাস করবে আমাকে?”
রাত্রি বুঝতে পারলো অয়ন মিথ্যা বলছে না। কারণ ও এমন কারচুপি করার ছেলে নয়। কিন্তু মেয়েটার বাসা অবধি চলে আসার নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল।
__________________
রাত্রি বোর্ড কোয়েশ্চেন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা রাইট ফর্ম অব ভার্বস চিহ্নিত করে দিচ্ছে শ্রাবণীকে। এগুলো শ্রাবণী প্রথমে পড়ে তারপর না দেখে খাতায় লিখে দেবে। ছয়টা বোর্ডের রাইট ফর্ম অব ভার্বস দিলো। এরপর ইংরেজি একটা বই নিয়ে বিছানায় বসলো সে। বইয়ের লেখাগুলো দেখছিল এর মাঝে কল এলো মোবাইলে। পাশেই মোবাইল রাখা ছিল। তানবীনের নাম দেখে সে চমকালোই বটে। আনন্দও লাগলো। সময় নিলো না কলটা রিসিভ করতে।
“আমি তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি কি আসতে পারবে?”
তানবীনের শান্ত কণ্ঠের কথাগুলো কানে আসা মাত্রই বিশ্বাস অযোগ্য ঠেকলো রাত্রির কাছে। তানবীন তো রুম থেকেই বের হতো না, আর আজ তাদের বাড়ি পর্যন্ত এসে গেছে? না কি স্বপ্ন? রাত্রি শ্রাবণীর দিকে তাকালো। ওই তো শ্রাবণী পড়ছে। তাহলে এটা তো বাস্তবই। রাত্রি বললো,
“নিশ্চয়ই আমি আসবো।”
তানবীন কথা না বাড়িয়ে কল কাটলো। রাত্রি বিছানা থেকে নেমে মাথায় ভালো করে ওড়না দিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। শ্রাবণী প্রশ্ন করলো,
“যাচ্ছ কোথায়? কে কল দিয়েছে?”
তবে রাত্রি প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলা লোকজনের কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকবে। কিন্তু তাতে কিছু করার নেই। তানবীন তার সঙ্গে যে দেখা করতে এসেছে এটাই অনেক। আর তার তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তানবীনের সঙ্গে।
গেট দিয়ে বের হলেই তানবীনকে দেখা গেল। আশেপাশে তার বাইক দেখা যাচ্ছে না। বাইকেই সব সময় যাতায়াত করে তানবীন, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে সে হয়তো বাইক চালাতে পারবে না।
তানবীনের চেহারার আরও অবনতি হয়েছে। চোখের নিচের কালো রং গাঢ় হয়েছে আরও। চুলগুলোয় চিরুনির আঁচড় পড়েছে বলে মনে হয় না। রাত্রির কষ্ট লাগছে তানবীনকে দেখে। আগে তানবীন কী রকম ভাবে চলাফেরা করতো বাইরে, আর এখন কী অবস্থা হয়েছে তার!
রাত্রি বললো,
“কষ্ট করে কেন আসতে গেলেন? আমাকে বলতেন, আমি যেতাম।”
তানবীন রাত্রিকে দেখছে। খুব গভীর চোখে। গভীরভাবে বুকে এঁকে নিচ্ছে চেহারাখানি। আর কখনও দেখা হবে কি-না সে যে জানে না। রাত্রির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললো,
“যেখানে তোমার সঙ্গে জীবনের একটা সুন্দর অধ্যায় শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমার অধ্যায়টা শুরু হলো অন্ধকারের সঙ্গে! এই অন্ধকার হাতড়ে আমি আমার মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাই না!”
তানবীনের মুখে আবারও মৃত্যুর কথা শুনে শিউরে উঠলো রাত্রির বুক। তানবীন ঘুরেফিরে শুধু এ কথা বলে কেন? রাত্রি বললো,
“এসব কী বলছেন? নিশ্চয়ই এই অন্ধকার অধ্যায় আপনার জীবনের স্থায়ী বিষয় নয়।”
“এটাই আমার জীবনের শেষ অধ্যায়!”
রাত্রির কষ্ট হচ্ছে এগুলো শুনতে। সে বললো,
“নিশ্চয়ই তা নয়। অন্ধকার চির স্থায়ী হবে না, সামনে আলোর দিন আসছে ইনশাআল্লাহ।”
তানবীন মাথা সামান্য নুইয়ে রেখেছিল। মাথা সোজা করলো এবার। তার চোখে পানি জমা হয়ে আছে। বললো,
“তুমি হঠাৎ করে আমার জীবনে এসেছিলে, আর আমি হঠাৎ করে তোমার জীবন থেকে চলে যাচ্ছি! রাগ করো না প্লিজ। ভালো থেকো বাকিদের সঙ্গে।”
কী ছিল তানবীনের কথায়? শুনে খুব কষ্ট লাগছে রাত্রির। আঁখি নীর আঁখি হতে লুটিয়ে পড়ে টুপ করে। বুকের ভিতর কঠিন যন্ত্রণার বিদ্রোহ চাপা পড়ে হৃদয় জমিন বিধ্বস্ত হয়। কিছু বলতে চাইলো সে, কিন্তু কণ্ঠ থেকে আওয়াজ বের হলো না।
তানবীনের চোখেও জল টলমল। আর সেই অবস্থায়ই সে হাসতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। বরং অশ্রু বড়ো ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়লো চোখ থেকে। বললো,
“কাঁদছো কেন? রাতের বৃষ্টি আমার খুব বিরক্ত লাগে।”
রাত্রি কাঁপা গলায় বললো,
“আ…আপনি…আপনি ওই কথাগুলো কেন বললেন? মানে কী এসবের?”
তানবীন বললো,
“শুধু একটা কথা জেনে রাখো, আমি তোমাকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসি। প্রচণ্ড!”
বলেই সে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো। রাত্রি বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা টের পাচ্ছে। এত কেন কষ্ট হচ্ছে তার? কেন মনে হচ্ছে এটাই তানবীনের সঙ্গে শেষ দেখা? রাত্রি দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে তানবীনের সামনে দাঁড়ালো। ল্যাম্পপোস্টের আলো থেকে নিজের চোখ গোপন করতে চাইলো তানবীন।
রাত্রি জানতে চাইলো,
“কী হয়েছে আপনার? কী মানে কথাগুলোর? কেন শুনে এত খারাপ লাগছে আমার? কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তো আপনি? না, আপনি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কিছুতেই আপনি…”
তানবীন রাত্রির কথার মাঝে বলে উঠলো,
“আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে মনে রাখবো রাত।”
এ কথা বলে আর দাঁড়িয়ে থাকলো না তানবীন। এ যেন শেষ বিদায়। রাত্রি রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তানবীনের দিকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তানবীন চোখের অদৃশ্য হলো রাত্রি তাকিয়ে থাকলো। যেন চিরদিনের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল মানুষটা!
____________________
তুরিন আজ সন্ধ্যার পরপরই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্য সময় হলে তানবীন ওকে জাগাতো না। কিন্তু এখন ওকে জাগাতে হবে। তানবীন ওকে ডেকে তুললো। তুরিন চোখ মেলে ভাইকে দেখে উঠে বসলো।
“কী হয়েছে?” প্রশ্ন করলো তুরিন।
তানবীন তুরিনের মাথায় হাত রেখে বললো,
“কবে বড়ো হবি তুই? কবে নিজের দেখভাল নিজে করতে পারবি?”
তুরিন হঠাৎ তানবীনকে এমন কথা বলতে দেখে একটু অবাক হলো। সে আরও বেশি চিন্তিত হয়ে বললো,
“কী হয়েছে ভাইয়া?”
তানবীন বোনের কপালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরলো। কান্না চেপে বললো,
“তোকে অনেক ভালোবাসি তুরিন। ভাইয়ার উপর অভিমান করিস না। ভাইয়ার আর কিছু করার নেই। এমন চললে ভাইয়া যে-কোনো মুহূর্তে মরে যাবে, নয় তো পাগল হয়ে যাবে। রাগ করিস না। অনেক ভালোবাসি তোকে আমার আনন্দ।”
হঠাৎ এসব কথা কেন বলছে ভাইয়া? তুরিন মুখ তুলে বললো,
“কিছু কি হয়েছে ভাইয়া?”
তানবীন না বোধক মাথা নেড়ে বললো,
“কিছু হয়নি। এরপর থেকে সব ঠিক থাকবে। ভালো থাকবি তুই। শুধু…”
তুরিন বিস্ময় নিয়ে বললো,
“শুধু?”
তুরিন ভাইকে জড়িয়ে ধরলো, শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো তার গায়ের শার্ট। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু তুমি তো আছো এখনও। তুমি সাথে থাকলে আমি অবশ্যই ভালো থাকবো। অনেক ভালো থাকবো আমি।”
“আমি না থাকলেও ভালো থাকবি রে। মামা-মামি আছে, নানি আছে, বিদেশে খালামনিরা আছে। সবাই-ই তোকে অনেক ভালোবাসে। আমার আনন্দ সবকিছু কাটিয়ে উঠে সবার সাথে আনন্দে থাকবে, ভালো থাকবে। আমি না থাকলেও…”
তুরিন তানবীনের কথার মানে বুঝতে পারলো না। সে বললো,
“হুম সবার সাথে ভালো থাকবো আমরা। আমরা নিশ্চয়ই পারবো। আমাদের মা খুশি হবে।”
তানবীনের খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তুরিনের সামনে যে সে কাঁদতে পারবে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভিতর তীব্র যন্ত্রণায় লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে এই যন্ত্রণা সামলে উঠতে হবে। সে তুরিনকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে বললো,
“আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে।”
তুরিন খুশি হলো এটা শুনে। যে রুম থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, সে বাইরে বের হওয়া মানে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।
তুরিন জানতে চাইলো,
“কোথায় যাবে?”
“এইতো কাছেই একটা জায়গায় যাব। তুই ঘুমা।”
তানবীন বেরিয়ে এলো তুরিনের রুম থেকে। বেরিয়ে এসেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। বেশ কিছুটা সময় লাগলো নিজেকে ধাতস্থ করতে। চোখের পানি মুছে লিভিংরুম অতিক্রম করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। নানি ডেকে বললেন,
“তাড়াতাড়ি ফিরে এসো কিন্তু।”
_________________
সকালের রান্না হচ্ছে। লাউ কাটছে রাত্রি। লাউয়ের তরকারি আর ভাত তাদের সকালের খাবার।
“আপু!”
অয়ন ডাকছে। বার কয়েকই ডেকেছে সে। রাত্রি কিচেন থেকে বললো,
“আমি এখানে।”
অয়ন রান্নাঘরে এলো। ওকে খুব উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে। বললো,
“খবর শুনেছো?”
“কী খবর?”
“তানবীন ভাইয়া…” বলতে গিয়ে আবার থেমে গেল অয়ন। রাত্রি সচকিত হয়ে উঠলো। চিন্তিত গলায় বললো,
“কী হয়েছে তার?”
(চলবে)