#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৪২
#নন্দিনী_নীলা
জায়ানের জোরাজুরি এখন তৃষ্ণার কাছে রাগ লাগছে। লোকটা এমন কেন? সে বিছানায় পরে আছে অসুস্থ শরীর নিয়ে। আর ও এই অবস্থায় স্বামী ফেলে নাকি স্কুলে যাবে পড়তে। জায়ানের এক কথা আজকেই যেতে হবে কোন নড়চড় নয়। দুইদিন হলো ও ফিরে এসেছে জায়ানের কোন উন্নতি হয়নি। উল্টো তার শরীরে জ্বর বাড়ছে। ব্যথায় শরীর থেকে জ্বর সরছেই না। জায়ান নাকি ওকে ভর্তি ও করিয়েও ফেলেছে। কি অবস্থা! রাগ লাগছে ওর। লেখাপড়া টা এখন ওর কাছে মস্ত বড়ো বিপদ লাগছে। জায়ান একাই ওকে স্কুলে ভর্তি করে ফেলেছে। ওর এখন শুধু ক্লাসে যেতে হবে। কয়েকদিন পর নাইনের ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা। সেটাতে অংশগ্রহণ করে ওকে টেনে উঠতে হবে। রাগ, বিরক্ত নিয়ে তৃষ্ণা বোরকা- হিজাব পরে রেডি হয়ে নিল। ওর নাকের পাটা ফুলে আছে। ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে। জায়ান খাটে থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার রাগী বউয়ের দিকে। তৃষ্ণার রাগী চাহনি, দেখে ও মিটিমিটি হাসছে। তৃষ্ণা উঠে দাঁড়িয়ে জায়ানের দিকে তাকাতেই ওর রাগ আরো বেড়ে আসমানে উঠে গেল। রাগে ফুঁস করে উঠল। জায়ানের মুখের হাসি ওর কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো লাগছে। অসহ্য লাগছে ওর জায়ান কে।
জোভান দরজায় টোকা দিয়ে বলল,,” ভাবি হয়েছে তোমার?”
জায়ান উত্তর দিল,,” তুই নিচে যা। ও আসছে।”
জোভান নিচে চলে গেল। তৃষ্ণার সাথে স্কুলে যাবে জোভান। তৃষ্ণা পার্স হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
জায়ান রিমোট দিয়ে দরজা আটকে দিল। তৃষ্ণা রাগান্বিত গলায় তাকাল জায়ানের পানে।
” এদিকে আসো।” আদেশ গলায় বলল জায়ান।
তৃষ্ণা ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে এল। দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বলল,,” বলেন।”
” এতো রাগ?” জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে টেনে পাশে বসালো। তৃষ্ণা রাগ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। জায়ান টোপ করেই তৃষ্ণার নাকের ডগায় কামড়ে ধরল। তৃষ্ণা চোখ গোল গোল করে তাকাল জায়ানের চোখের দিকে। মুখটা বিষ্ময় এ কিশ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেছে। জায়ান তৃষ্ণার হা করা অধর দুটিতে গভীর ভাবে ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,,” সাবধানে যাবে। আর একদম আমার সামনে নাক ফুলিয়ে রাখবে না।”
” এটা কি করলেন?” নাকের ডগায় আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল তৃষ্ণা।
জায়ান কামড় দেওয়া স্থানে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে চুমু দিল।
জোভানের সাথে গাড়িতে বসে আছে তৃষ্ণা। রাস্তার সব লেখা পরীক্ষা প্রশ্নের মতো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। আর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে জোভান কে। দশ মিনিটের রাস্তা মাত্র। খুব তাড়াতাড়িই ওরা স্কুলে চলে এল।
গাড়ি থেকে নেমে তৃষ্ণা বলল,,” এইটুকু রাস্তা তো আমি হেঁটেই আসতে পারব।”
জোভান বলল,,” ভাইয়া কয়দিন পর এমপি হবে। আর তার একমাত্র ওয়াইফ নাকি হেঁটে স্কুল এ আসবে কি যে বলো না ভাবি। কাছে হোক তোমায় গাড়ি করেই আসতে হবে। আর তাছাড়া জানো তো ভাইয়ার কত শত্রু আছে। তাই তোমায় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। এতো দিন ঘরের ভেতরে ছিলে বিপদের সম্মুখীন হওনি। কিন্তু এখন তোমায় বের হতে হবে।”
তৃষ্ণাকে নিয়ে অফিস রুমে আসলো জোভান। তৃষ্ণার সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তৃষ্ণা কে ক্লাসে পাঠালো। তৃষ্ণার সব বই বাসায় আছে। কিন্তু আজ কিছুই নিয়ে আসে নাই। ও শুধু ক্লাস চিনলো আর সবার সাথে স্যার’রা পরিচয় করিয়ে দিল ও নতুন স্টুডেন্ট বলে। আধা ঘন্টার মধ্যে ওদের কাজ শেষ হয়ে গেল। তৃষ্ণা এক কালারের স্কুল ড্রেস পরা একাধিক মেয়েদের দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। স্কুলের বাতাস ও ওর কাছে এতো সিগ্ধ লাগছিল মনটা নেচে নেচে উঠছিল।
জায়ান তৃষ্ণার নাম্বারে কল করল। তৃষ্ণা তখন মাঠের মাঝখানে দাড়িয়ে ছিল। ওকে দাড় করিয়ে রেখে জোভান অফিস রুমে গেছে আবার। তৃষ্ণার ফোনে রিংটোন বাজতেই ও তাকিয়ে দেখল হাজব্যান্ড লেখা। জায়ানের নাম্বার ও হাজবেন্ড দিয়ে সেভ করেছে।
” হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম!”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি করছো?”
” মাঠে দাঁড়িয়ে আছি।”
” স্কুল পছন্দ হয়েছে।”
” হ্যা খুব।”
” আসবে কখন?”
” কখনি আসব।”
কথা শেষ করে কল কেটে দিল জায়ান। তৃষ্ণা দেখতে পেল অনেক ছেলে মেয়েরাই মাঠের এদিকে ওদিকে হাঁটছে। সবাই ফিরে ফিরে ওর দিকে তাকাচ্ছে। ওর অস্বস্তি হচ্ছিল। জোভান আসতেই স্বস্তি পায়।
” ভাবি চলো।”
” তুমি কোথায় গেছিলে?”
” তোমার পরীক্ষা ডেট জানতে।”
” কবে পরীক্ষা?”
” সামনে মাসের ১৪ তারিখ।”
” পরীক্ষা তো চলেই আসছে।”
” হুম।বাসায় গিয়ে বই নিয়ে বসবে। আর স্কুলে এসে আগামীকাল নোট নিয়ে যেও।”
” আচ্ছা।”
জোভান তৃষ্ণা কে জিজ্ঞেস করল স্কুলটা ঘুরে দেখবে নাকি। তৃষ্ণা রাজি হলো। জোভান তৃষ্ণা কে নিয়ে স্কুলটা ঘুরে দেখল। আরো মিনিট কুড়ি কাটিয়ে ওরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আসার সময় যতটা মন খারাপ নিয়ে এসেছিল যাওয়ার সময় ততটাই প্রফুল্ল হয়ে বাসায় ফিরে এল। তৃষ্ণা বাসায় এসেই লিয়ার থেকে জানতে পারল জায়ান নাকি কফি চেয়েছিল। লিয়া মাছ কাটায় ব্যস্ত ছিল শেফালী নাকি কফি করে নিয়ে গেছে। তৃষ্ণা বলল,,” তোমাকে বলেছিলাম ওই মেয়েকে উনার কাছে যেতে দিও না।”
” আমি মানা করেছিলাম কিন্তু ও আমার কথা শুনলো না। কফি চেয়েছে জানা মাত্রই চলে গেল কফি হাতে।”
তৃষ্ণা রাগ মাথায় নিয়ে দ্রুত পায়ে উপরে এল।শেফালী তখন রুমে নাই ও জায়ান কে বিছানায় একা পেয়ে স্বস্তি পায়।
ট্রি টেবিলের ওপর কফির কোন মগ দেখে না। ও কপাল কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজ করে। শেফালী কফি নিয়ে উপরে এলে সেই কফি কই।
জায়ান ল্যাপটপ এ কিছু করছিল তৃষ্ণা কে দেখে ল্যাপটপ রেখে বলল,,” কি হয়েছে?”
তৃষ্ণা থতমত গলায় বলল,,” আপনাকে কফি দিতে আসছিল শেফালী?”
” হ্যা আসছিল। কেন?”
” কফি কই?”
” ফেরত পাঠিয়েছি। মেয়েটার হাবভাব অপছন্দ আমার। তাই বারণ করে দিছি। চলে গেছে। কি হয়েছে তাতে?” অবাক গলায় বলল জায়ান।
” কিছু না।” বলেই তৃষ্ণা কথা ঘুরিয়ে স্কুলের কথা বলতে লাগল। জায়ান ও আর এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল না।
তৃষ্ণার এখন সম্পূর্ণ সময়টা পড়ালেখার মাঝে চলছে। ওদের একবছরের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে কেক কাটা হয়েছে। জায়ান খুব আফসোস করেছে নিজে অসুস্থ হয়ে কোন আয়োজন করতে পারল না। অনলাইনে অর্ডার করে তৃষ্ণাকে একটা নেকলেস সেট উপহার দিয়েছে। অনেক কিছু করার ইচ্ছে ছিল জায়ানের কিন্তু আটকে দিল ভাঙা পা। তৃষ্ণা বলেছে,” এতো টেনশন করছেন কেন? সামনের বছর না হয় আয়োজন করবেন। এসব নিয়ে মন খারাপ করবেন না।”
জায়ান আর কি করবে তাই মানতেই হয়েছে।
তৃষ্ণা স্কুলে যাচ্ছে নিয়মিত। ড্রাইভার গাড়ি করে প্রতিদিন দিয়ে আসে আবার নিয়ে আসে। জায়ানের ট্রিটমেন্ট চলছে। ও লাঠি ভর করে হাঁটার ট্রাই করে। কিন্তু এখনো পা ফেলতে পারে না। এক পা দিয়ে তো আর হাঁটা সম্ভব নয়। তৃষ্ণার পরীক্ষা আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে। রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয়। জায়ান বসে থাকে তৃষ্ণার সাথে।
রাত তখন প্রায় বারোটার উপরে বাজে। তৃষ্ণা জায়ানের নগ্ন বুকে আঁকিবুঁকি করছে। জায়ান তৃষ্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
” একটা কথা বলবেন সত্যি করে?”
জায়ান তৃষ্ণার কথার কপাল কুঁচকে বলল,,” কি কথা?”
তৃষ্ণা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,,” আপনার কোন গার্লফ্রেন্ড ছিল?”
জায়ান তৃষ্ণার কথায় অবাক চোখে ওর দিকে তাকাল।
” কয়দিন হলো স্কুলে যাচ্ছ! এখনি সন্দেহ ঢুকছে মনে?”
তৃষ্ণা অসহায় মুখে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। ও জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও করেই ফেলেছে। স্কুলে গিয়েই ওর অনেক ফ্রেন্ড হয়েছে। এমপির ছেলের বউ আবার। জায়ান ভবিষ্যৎ এমপি এজন্য স্কুলে তার ভালোই নামডাক হয়েছে। সবাই তো যেচে এসে বন্ধুত্ব করতে চাইছে। ওদের ক্লাসের ছেলে নাই। ছেলে মেয়েদের আলাদা ক্লাস। ওর ফ্রেন্ড রাই ওকে শিখিয়ে দিয়েছে জায়ান কে এসব জিজ্ঞেস করতে।
” না মানে এমনি জানতে চাইছিলাম।” মুখ নিচু করে বলল তৃষ্ণা।
জায়ান তৃষ্ণার কাঁধের উপর থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে গলায় মুখ ঠেকিয়ে অধর স্পর্শ করতে লাগে। তৃষ্ণা জায়ানের চুল খামচে ধরে কাঁপতে লাগে। আচমকাই কামড়ে ধরে তৃষ্ণা মৃদু চিৎকার করে উঠে। জায়ান মাথা উঁচু করে তৃষ্ণার হাত আঁকড়ে ধরে বলল,,” ওই সব ফ্রেন্ডদের সাথে মিশবে না। যারা আমাকে নিয়ে সন্দেহ ঢোকায় তোমার ফ্রেশ মাথায়। বুঝেছ।”
তৃষ্ণা থমকানো মুখে তাকিয়ে আছে। মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলল।
” গুড গার্ল। এই বোকা সোকা মেয়েটাই আমার পছন্দের। যত স্মার্ট, চালাক, চতুর হও সেটা বাইরের মানুষের জন্য ওকে। আমার এই বোকা তৃষ্ণাই চাই সারাজীবন।”
তৃষ্ণা ফ্যালফ্যাল করে ড্রিম লাল লাইটের আলোয় তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। জায়ান তৃষ্ণাকে আরো গভীর ভাবে কাছে টেনে নিল। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগল তৃষ্ণা কে। তৃষ্ণা সব ভুলে জায়ানের ভালবাসার নিজেকে সঁপে দিতে লাগল। তৃষ্ণা অসাবধানতায় জায়ানের পায়ে আঘাত দিয়ে বসল। জায়ান আর্তনাদ করে সরে গেল তৃষ্ণার উপর থেকে। তৃষ্ণা লাফ দিয়ে উঠে বসল। ভয়ে ওর হৃদপিন্ড কেঁপে উঠল যেন। জায়ানের পায়ের কাছে এসে বসল। অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছে না কি হয়েছে। তৃষ্ণা সরি বলতে বলতে কান্নায় করে দিল। কিভাবে যে লাথি মেরেছে।ও নিজেই খেয়াল করেনি। তৃষ্ণা শাড়ি নিয়ে গায়ে জড়িয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিল। রুমটা মুহূর্তে আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। তৃষ্ণা জায়ানের পায়ের কাছে বসে দেখল রক্ত বের হচ্ছে। ভয়ে ও ঘামতে লাগল। জায়ান একাই উঠে বসেছে। এগারো দিন হয়ে গেল এখনো পায়ের কোন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। রক্ত দেখে তৃষ্ণা কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলল পরিবেশ। জায়ান একেতে ব্যথায় কুলাতে পারছে না তার মধ্যে তৃষ্ণার কান্নায় ও বিরক্তে চ উচ্চারণ করল। ও গাঢ় গম্ভীর গলায় ফাস্ট এইড বক্স চাইল। তৃষ্ণা দৌড়ে ড্রয়ার খুলে এনে দিল। জায়ান নিজেই পুরাতন ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে নতুন ব্যান্ডেজ করল।
” আমার জন্য কি হয়ে গেল। বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে আপনাকে আঘাত দেই নি।”
” একেক সময় তোমার এই ছেলেমানুষি গুলো আমার বিরক্তির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। প্লিজ তৃষ্ণা স্টপ দেয়ার।”
তৃষ্ণা থামল না মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জায়ান কাজ শেষ করে বলল,,” দয়া করে কান্নাকাটি অফ করে বিছানায় আসো। লাইট বন্ধ করে। মাথা ধরিয়ে দিলে। ঘুমাতে দাও।”
জায়ান বিছানায় শুয়ে পরল। তৃষ্ণা সব সরিয়ে রেখে লাইট অফ করে জায়ানের থেকে দূরত্ব রেখে গুটিগুটি মেরে শুয়ে পরল। অপরাধ বোধে ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।
#চলবে….#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৪৩
#নন্দিনী_নীলা
জীবনের প্রথম বার স্কুলে কোন পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করল তৃষ্ণা। দুরুদুরু বুক দিয়ে ও ক্লাসে বসে আছে। ভয়, আতংক নিয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। বড়ো বড়ো বেঞ্চের দুই কর্ণার এ দুজন বসা। প্রথম কোন পরীক্ষা অংশগ্রহণ করছে কিন্তু প্রিয় মানুষটার সাপোর্ট পায় নি কাছ থেকে। বুকের ভেতরটা ভার হয়ে উঠল। জায়ান গত দুই আগেই দেশের বাইরে গেছে চিকিৎসার জন্য। পায়ের অবস্থা সিরিয়াস হয়ে গেছে। কোন উন্নতি না পেয়ে দেশের বাইরে ট্রিটমেন্ট এর জন্য গেছে। তার সাথে গেছে জেসমিন বেগম। আপন মা না হলেও ছেলেদের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা সেটা প্রতি মূহুর্তে তিনি প্রমাণ করেছেন। তৃষ্ণার ছলছল চোখে শুধু বিদায় দিয়েছিল।
জায়ানের সাথে ফোনে নিয়মিত কথা হয় কিন্তু মানুষটা কাছে নেই ভাবলেই বুকটা ফেটে যায়। তৃষ্ণা সব চিন্তা সরিয়ে পরিক্ষায় মনোনিবেশ করল। দুজন টিচার হলে ঢুকেই সবাইকে খাতা দিতে লাগল। তৃষ্ণা দিকে খাতা দিয়েই স্যার’টা দাঁত বের করে হেসে কেমন আছি জিজ্ঞেস করল। তৃষ্ণা বিব্রত বোধ করে ভালো আছি বলল। ছাত্র-ছাত্রী টিচার সবার এই আন্তরিকতা ওকে বিব্রত করে তুলে। এটার কারণ আছে এমন হলে সবাই ওর দিকে কেমন হিংসাত্মক চোখে তাকায় যেই চাহনি ওর মোটেও পছন্দ নয়।
পরীক্ষা শেষ হতেই ফাইল হাতে বেরিয়ে এল তৃষ্ণা। বাইরে এসে দেখল জোভান হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওকে দেখতেই বলল,,” ভাবি এক্সাম কেমন হলো?”
তৃষ্ণা বলল,,” সব লেখার আগেই সময় শেষ হয়ে গেল।”
” আরে ব্যাপার না।”
” তুমি এখানে এলে যে।”
” ভাইয়া কল দিছিল বলল তার বউকে যেন নিজ দায়িত্বে বাসায় নিয়ে আসি।”
” উনি এখন কেমন আছেন?”
” নিজেই কথা বলে জেনে নাও।”
” আমি তো ফোন আনিনি।”
জোভান নিজের ফোন থেকে জায়ান কে কল করল। আর তৃষ্ণার দিকে ফোন এগিয়ে দিল।
” হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
” আলহামদুলিল্লাহ। আপনার শরীর কেমন আছে? দেশে ফিরবেন কবে?”
” খুব তাড়াতাড়িই। পরীক্ষা কেমন দিলে?”
তৃষ্ণার মুখটা চুপসে গেল। জায়ান সেটা বুঝতে পেরে বলল,,” খারাপ হলেও সমস্যা নাই। মাথা ঠান্ডা রেখে পরীক্ষায় মনোনিবেশ করবে। আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। I’m absolutely fine.”
” আমি ভালো রেজাল্ট না করলে আপনি কি অনেক কষ্ট পাবেন?”
” তা তো একটু পাবো। আমি তো চাই তুমি ফার্স্ট হও।”
” আমি চেষ্টা করব।”
” আচ্ছা বাসায় যাও। ফ্রেশ করে কিছু খেয়ে নিবে।”
বলেই জায়ান কল কেটে দিল।
দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন ও জোভান গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। তৃষ্ণা ওর স্কুলের ফ্রেন্ডদের সাথে বের হয়েছিল।
একজন তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল,,” এই তৃষ্ণা, ওইটা তোর কি হয় রে?”
জোভান কে দেখিয়ে বলল মেয়েটি। তৃষ্ণা জোভানের দিকে তাকিয়ে বলল,,” আমার ছোট দেবর।”
” বাবাহ তোর দেবর তো তোর খুব খেয়াল রাখে। প্রতিদিন তোকে দিতে আসে। তোর জামাই তো একদিন ও আসলো না।”
তৃষ্ণা বলল,,” উনি কিভাবে আসবে উনি তো অসুস্থ। দেশের বাইরে গেছেন চিকিৎসার জন্য।”
” তোর দেবরটা হ্যান্ডসাম আছে। সিঙ্গেল থাকলে নাম্বারটা দিছ তো মজা করতে পারব।”
তৃষ্ণা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মেয়েটির কথার ইঙ্গিত ও বুঝতে পারেনি। এদিকে জোভান ওকে হাত নাড়িয়ে ডাকছে। তৃষ্ণা কথার উত্তর না দিয়ে চলে এল।
” আজ আবার কেন এসেছ?”
” আজ তোমার সাথেই আমার কিছু কথা ছিল ভাবি।”
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে বলল,” কি কথা?”
জোভান আমতা আমতা করে বলল,,” বকুল তো অনেক দিন হলো গ্রামে গেছে। ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। তুমি ও এখন একাই আছো। ভাইয়া নাই তোমার নিশ্চয়ই বোরিং লাগে। ও আসলে ভালো লাগতো।”
তৃষ্ণা জোভানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ জোভান বকুলের আসা নিয়ে ভাবছে কেন?
সন্দেহ হলেও প্রকাশ করল না বলল,,” তা কীভাবে সম্ভব ও আসবে কি করে?”
” আমি আছি তো ভাবি। আমি যেয়ে নিয়ে আসব।”
” আচ্ছা যেও যদি তুমি ফ্রী হয়ে।”
জোভান তরিৎ গতিতে বলল,” আমি এখনি ফ্রী আছি তুমি রাজি থাকলে। আমি ওকে আনতে এখনি যেতে চাই।”
তৃষ্ণার মুখটা বিষ্ময় এ হা হয়ে গেল।
” কি ব্যাপার তুমি আমার বোনকে আনতে এতো পাগল হচ্ছো কেন?”
জোভান নিজের উত্তেজনাকে সামালে বলল,,” ভাবি আমি তো তোমার জন্যেই আনতে চাইছি।”
তৃষ্ণা আরো কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। বকুল কে দেখে না কবে থেকে আর বাসায় ও ভালো লাগে না একা একা। বাসায় এখন তৃষ্ণা একা থাকে। লিয়া ও বাসার নাই। কোথা থেকে লিয়ার আত্নীয় স্বজন এসে উপস্থিত হয়ে জায়ান থাকতে তাকে নিয়ে গেছে। আর বাসায় এখন শুধু তৃষ্ণা আর শেফালী। শেফালীর সাথে তৃষ্ণা ভাব হয়নি। উল্টো আর অসহ্য লাগে তাকে। আর শশুর তো নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে বাইরে। জোভান ও বাসার থাকে না। বকুল এখন বাসায় আসলে ভালোই হবে। নিজের একাকিত্ব কমবে।
তৃষ্ণা একাই বাসায় ফিরে এল ড্রাইভারের সাথে।জোভান নিজের গাড়ি নিয়েই গিয়েছিল স্কুলে সেখানে থেকে ওর পারমিশন পেয়ে আর চলে গেছে। তৃষ্ণা সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পায় শেফালী সোফায় বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছে আর হাতে নেলপালিশ পরছে। তৃষ্ণার উপস্থিতি টের পেতেই লাফ দিয়ে সোফা ছেড়ে ফ্লোরে বসে পরে। তৃষ্ণা প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে শেফালীর দিকে। শেফালী ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,” আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে ম্যাম?”
তৃষ্ণা উত্তর না দিয়ে হনহনিয়ে উপরে চলে এল। কখনো লিয়া কে সোফায় বসতে দেখেনি ও আর এই মেয়ে দুই দিনেই। আজ বাসায় একেবারেই ফাঁকা তৃষ্ণা গোসল করে সেলোয়ার কামিজ পরে নিচে এল খাবার খেতে। শেফালী সেখানে বসেই সাজতে ব্যস্ত ওর দিকে তাকিয়ে শুধু হেসেছে। তৃষ্ণা টেবিলে বসে অল্প কয়টা ভাত ও মাংস নিয়ে খেতে লাগল। তৃষ্ণা ভেজা চুল না মুছেই খোলা রেখে খাবার খাচ্ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করল শেফালী হা করে ওর চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেল তৃষ্ণা বলল,” অন্য দিকে তাকাও। আমার দিকে তাকাবে না তুমি।”
শেফালী চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু আড়চোখে শেফালী তৃষ্ণার দিকে ঠিকই তাকিয়ে রইল। তৃষ্ণা সুতি কাপড়ের কালো কামিজ পড়েছে। সদ্য গোসল করে এসেছে। ওর ফর্সা গায়ে কালো রঙটা মারাত্মক সুন্দর লাগছে। কোন মেয়ে ও ওকে এই রুপে দেখলে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য। ঘন কালো রেশমী চুল, ডাগর ডাগর চোখ, সিগ্ধ সরল মায়াবী মুখশ্রী, গোলাপি পাতলা চিকন ঠোঁট। আড়ালে কয়টা পিকচার তুলে কাউকে সেন্ড করে দিল শেফালী।
তৃষ্ণা হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শেফালীর উদ্দেশ্য এ বলল,,” সব কিছু ফ্রীজে রেখে দাও। বাবা আর জোভান রাতে ফিরবে।”
শেফালী নড়ল না তৃষ্ণা শক্ত চোখে তাকিয়ে গটগট করে নিজের রুমে এসে দরজা লক করে শুয়ে পড়ল। জায়ান রাতে কল করবে এখন আর বসে থেকে লাভ কি ঘুমাই যাই। তৃষ্ণা চোখ বুজে ঘুমাই গেল। এদিকে শেফালী যাকে ছবি সেন্ড করেছে সে শেফালী কে কল করে বলল,,” এই ফুলের সুবাস আমি কাছ থেকে পেতে চাই। সামান্য ছবিতে আমার মন ভরবে না। এই ফুলটাও আমার করে চাই সাথে জায়ানের সারে সর্বনাশ ও চাই।”
তৃষ্ণার ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোন এ। বার কয়েক বাজতেই ওর ঘুম ছুটে গেল। ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করতেই ভিডিও কলে জায়ানের মুখটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। তৃষ্ণা লাফ দিয়ে উঠে বসল বিছানার উপর।
” হ্যালো মিসেস, ঘুম হলো আপনার?”
তৃষ্ণা মাথা নাড়িয়ে হয়েছে বলল।
” আপনি তো রাতে কল করবেন বলেছিলেন।”
” বাইরে তাকিয়ে দেখো তো এখনো রাত হওয়ার বাকি আছে নাকি।”
তৃষ্ণা জানালা দিয়ে বাইরে নজর বুলিয়ে দেখল অন্ধকার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সারে আটটা বাজে। ও ঘুমিয়েছিল পাঁচটায়।এতো সময় ঘুমালো। সন্ধ্যার আযান হয়ে গেছে ও সারা সন্ধ্যে ঘুমিয়ে কাটাল।
” আমার বাসায় একা একা দম বন্ধ হয়ে আসছে। লিয়া বাসায় থাকলে ভালো লাগত। সেও নাই।”
” লিয়া চলে আসবে বলেছে।”
” কবে আসবে?”
” আগামী কাল না আসলে পরশু আসবেই।”
” আপনি কবে আসবেন?”
” গতকাল থেকে কেবল ট্রিটমেন্ট শুরু হলো। এক সপ্তাহ চলবে।”
তৃষ্ণা মুখটা মলিন করে ফেলল।
জায়ান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা নিজেও চুপ করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তৃষ্ণা বলল,,” জানেন কি হয়েছে?”
” না বললে জানব কি করে?”
” আপনার ভাই/ জোভান আমার বোনের জন্য এতো পাগলামি করছে কেন বলেন তো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
” মানে বুঝলাম না।”
তৃষ্ণা জোভানের সব কথা বলল। সবশুনে জায়ান বলল,,” তুমি আমায় না দেখে কয়দিন থাকতে পারবে?”
” একদিনও পারব না। আপনি জানেন এখন আমার কেমন কষ্ট হচ্ছে। আপনার বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম হয় না। তিন দিন হলো আপনি চলে গেছেন। সেদিন রাতের পর আপনি আমাকে আর বুকে টেনে নেন নি। আমার খুব কষ্ট হয়েছে। সেদিনের জন্য কি আপনি আমার উপর রেগে আছেন বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছাকৃত এমনটা করিনি।”
জায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” রাগের জন্যে নয় তৃষ্ণা। আমি নিজেও কতটা সাফার করছি তুমি বুঝবে না। উল্টো নিজেকে কন্ট্রোল করার জন্য তোমার থেকে দূরে থেকেছি। যে বা যারা এটা করেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য হলেও আমায় সুস্থ হতে হবে। ভাঙা পা নিয়ে আমি তো অচল হয়ে গেলাম।”
” সব ঠিক হয়ে যাবেন দেখবেন।”
” আচ্ছা শোন তোমায় একটা কথা বলি। জোভান বকুলকে পছন্দ করে। আই মিন ভালবাসে। বকুলের খবর আমি ঠিক জানি না। এজন্য জোভান বকুলের জন্য এতো উতলা।”
তৃষ্ণা মুখে হাত দিয়ে শুনছে।
” সত্যি?”
” আমি তো এমনটাই জানি।”
” বকুল সব কথা আমার সাথে শেয়ার করে কিন্তু এমন কিছু এখনো বলেনি। আমিও এমন কিছু আঁচ করতে পারিনি। কি বোকা আমি।”
” আমার বোকা বউটাকে আমি ভালবাসি।”
তৃষ্ণার মুখশ্রী লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। জায়ান এটা ওটা বলে তৃষ্ণা কে লজ্জা দিচ্ছে। হঠাৎ দরজায় ধুপধাপ শব্দে চমকে উঠল তৃষ্ণা। এমন জোরে জোরে দরজা কে ধাক্কাধাক্কি করছে?
” কে যেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে আপনি লাইনে থাকেন আমি দেখি বকুল আসলো নাকি।”
কাঁচের সাদা দরজা হলেও ভেতরে থেকে বাইরে দেখা যায় না বাইরে থেকে ভেতরে দেখা যায় না। তৃষ্ণা হাতে দরজা লক করেছিল তাই হাতেই খোলে দিল। শেফালী কে আতঙ্কিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল।
” কি হয়েছে শেফালী?”
শেফালী ছুটে এসে তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। তৃষ্ণা হতভম্ব স্তব্ধ ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ শেফালীর কি হলো এতো ভয় পেয়ে আছে কেন? শেফালী কাঁদতে কাঁদতে তৃষ্ণার কাঁধে একটা ইনজেকশন পুশ করতেই তৃষ্ণা ঠলে পড়ল। এদিকে জায়ান তৃষ্ণাকে ডেকে যাচ্ছে সেটা কানে আসতেই শেফালী ভয়ে চমকে উঠল। আর তাড়াতাড়ি ফোনের স্ক্রিনে দূর থেকে নিজেকে আড়াল করে কল কেটে দিল।
#চলবে……