কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
৬.
আচ্ছা? নদীর কি কোনো দুঃখ নেই? সে পরম সুখে শুধু বয়েই বেড়ায়। কোনোদিন এক মুহুর্তের জন্যও থেমে থাকে না। তার কোনো পিছুটান নেই, বিধায় সে নিজ গতিতে প্রবাহমান। নৈঋতা এই নদীর নাম দিয়েছে ‘সুখী নদী।’ সে ভাবে, এই সুখী নদীর মতো সে-ও একদিন প্রচন্ড সুখী হবে। নদীর মতো অনায়াসে জীবন পার করবে। নদীর নাম শুনে রৌদ্রুপ মৃদু হাসল। হাটু অবধি পানিতে নেমে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বলল,
“তো নৈঋ? এই সুখী নদীর মতো সুখ তোমাকে কে দিবে?”
“জানি না,” মন খারাপ করে বলল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ পুনরায় হাসে। পানির বালতি নিয়ে ডাঙায় উঠে আসতে-আসতে বলল,
“আচ্ছা একটা কাজ করো। এই সুখী নদীর মতো আমারও একটা নাম দাও তো দেখি।”
নৈঋতা ভ্রুকুটি করে বলল,
“আপনের তো নাম আছেই। নতুন কইরা আবার নাম দিয়া কী করবেন?”
“আপনে কোনোদিন আমারে হেই নামে ডাকছেন?” নৈঋতার মতো করে বলল রৌদ্রুপ।
রৌদ্রুপের কথার ভঙ্গিমায় নৈঋতা ফিক করে হেসে উঠল। নৈঋতার প্রাণবন্ত হাসি দেখার সৌভাগ্য হলো রৌদ্রুপের। এ যেন সদ্য ফোটা সূর্যমুখী। রৌদ্রুপ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নৈঋতার মুখপানে। তাতেই নৈঋতা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। হাস্যোজ্জ্বল মুখটাকে লজ্জার আবরণ এসে ঢেকে দিলো। রৌদ্রুপ মুচকি হেসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে-মুছতে বলল,
“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি আমি। এখনও পর্যন্ত তুমি আমাকে ‘আপনি’ ছাড়া আর কোনো সম্বোধন করনি। এই যেমন, রৌদ্রুপ কিংবা ভাইয়া। কোনোটাই না। এজন্যই বলছি তুমি কোনো নাম দাও, যে নামে শুধু তুমিই ডাকবে। মনে করো এটা তোমার একান্ত ব্যক্তিগত নাম।”
‘তোমার একান্ত ব্যক্তিগত নাম’ কথাটা শুনেই নৈঋতা চমকে উঠল। দ্বিধাভরা কন্ঠে বলল,
“না, না। নাম তো একবারই রাহে, জন্মের পর। আমি আবার কী রাখমু? আমার আসলে লজ্জা লাগে দেইখা ডাকি না। আপনে বড়ো মানুষ। নাম ধইরা ডাকা যায়? আপনে যহন কইছেন, এহন থিকা ভাইয়া ডাকমু।”
“উঁহু, এখন আর মানব না। নতুন নাম রাখতে বলেছি মানে তুমি ওই নামেই ডাকবে,” নাকচ করে বলল রৌদ্রুপ।
“আমি পারমু না।”
“পারতেই হবে। তা না হলে তোমার সাথে কথা নেই।”
“এমন করেন ক্যা?” ঠোঁট উলটে বলল নৈঋতা।
“তাড়াতাড়ি দাও। দেখি তুমি কেমন নাম দিতে পারো।”
“আমি আপনের মতো হুটহাট সুন্দর-সুন্দর নাম দিতে পারি না।”
“আচ্ছা, তাহলে যেতে-যেতে ভাবো। চলো।”
রৌদ্রুপ হাতে বালতি তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করল। অগত্যা নৈঋতাও কলসি কাঁখে তুলে রৌদ্রুপের পিছু নিল। রৌদ্রুপ নৈঋতার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“নাম না দিতে আমার সাথে কথা বলবে না।”
নৈঋতা মুখ ফুলিয়ে ভাবতে লাগল, এখন হুট করে এই পাগলের কী নাম দেওয়া যায়? তার বুঝি লজ্জা লাগে না এত বড়ো একজন মানুষের নতুন করে নাম দিতে? অর্ধেক পথ এসেও তার মাথায় কিছুই এল না। এদিকে রৌদ্রুপ চুপচাপ হেঁটে চলেছে। না নৈঋতার দিকে তাকাচ্ছে, না কথা বলছে। সে নিজেও জানে আদতে এই মেয়ে কোনো নামই দিবে না। লজ্জা পেয়েই তো কূল পায় না সে। তবু নৈঋতার বিপাকে পড়া চিন্তিত মুখটা দেখে তার মজা লাগছে। নৈঋতাকে একটু ঘাবড়ে দেওয়ার জন্যই তার উক্ত ফন্দি। বাড়ি অবধি চলে আসার পরও নৈঋতা একটা নাম খুঁজে পেল না। রৌদ্রুপ নিজেই প্রশ্ন করল,
“পেলে?”
নৈঋতা হতাশ ভঙ্গিতে ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে বলল,
“সম্ভব না।”
“ঠিক আছে, তাহলে বাদ দাও,” নিজেও হতাশ হওয়ার ভান ধরে বলল রৌধ্রুপ।
মিনিট খানেক চুপ থেকে হুট করে নৈঋতা বলে বসল,
“আপনে আমারে মেঘবতী ডাকেন ক্যান?”
রৌদ্রুপ হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
“কারণ তুমি মেঘের মতো সুন্দর। মেঘলা আকাশ তো তোমার পছন্দ, তাই না? মেঘ তোমার রূপ দেখে হিংসা করে, তা কি জানো?”
নৈঋতা লাজুক হাসল। হৃদপিন্ডটা বুঝি আবার কেঁপে উঠল। লোকটা কীসব যে বলে! তারপর দুজনেই চুপ। তবে নৈঋতার ঠোঁটের কোণে যে লাজুক হাসির রেশ লেগে ছিল, তা রৌদ্রুপের দৃষ্টির আড়াল হয়নি। বাড়ির উঠানে পা রেখে নৈঋতা রৌদ্রুপের থেকে বালতিটা নিয়ে গুনে-গুনে দুপা বাড়াল আর পিছু ডাকের অপেক্ষা করল। সে নিশ্চিত মানুষটা পিছু ডাকবেই। তার মুখে হাসি ফুটিয়ে দুপা এগোনোর সঙ্গে-সঙ্গেই রৌদ্রুপের পিছু ডাক,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা পেছন ফিরে তাকাতেই রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলল,
“মেঘবতীর প্রাণবন্ত মিষ্টি হাসির দমকে কারো বুকে ভ’য়ান’ক ব্যথা হয়। এই ব্যথার কি কোনো ঔষধ আছে?”
নিজের হাসির প্রশংসা শুনেও নৈঋতা হাসি আটকাতে পারল না। লাজুক হেসে ঘুরে দাঁড়িয়ে যত দ্রুত পারল উঠান পেরিয়ে ঘরে চলে গেল।
আজও রৌদ্রুপ নসিবকে সাথে নিয়ে বাজার করেছে। আজ আবার সে আরেক কাণ্ড করে বসেছে। পটল কাকার দোকানে গিয়ে সামসুদ্দীন বেপারীর দেনার কথা শুনে, সেই দেনা সে পরিশোধ করে দিয়েছে। এ কথা শুনে সামসুদ্দীন বেপারী লজ্জায় পড়ে গেলেন। ছলছল চোখে রৌদ্রুপের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এদিকে রৌদ্রুপের আচার-আচরণে মুগ্ধ আফিয়া বেগম নৈঋতাকে রৌদ্রুপের পেছনে লেলিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। নৈঋতা নাকচ করলেই ধমকে ওঠেন। মায়ের ভয়ে নৈঋতা উলটো কিছু বলার সাহসও পায় না। আজ সারাদিনে নানা অজুহাতে নৈঋতাকে রৌদ্রুপের কাছে পাঠিয়েছেন আফিয়া বেগম। যদিও নৈঋতাকে সবসময় কাছাকাছি পেয়ে রৌদ্রুপের দিনটা বেশ কে’টেছে। বিকেলের দিকে কুসুমিতার সাথে আরও দুজন মেয়ে নৈঋতাদের বাড়িতে এল। নৈঋতা তাদের দেখামাত্র দৌড়ে গিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“তোরা খেলতে ডাকতে আইছোস না কি? মায় হুনলে আমারে ঝাড়ু নিয়া দৌড়াইব।”
কুসুমিতা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“আরে না। আমরা এমনেই আইলাম হাঁটতে-হাঁটতে।”
পরক্ষণেই উঠানের কোণের মাচার দিকে দৃষ্টি চলে গেল কুসুমিতার। সঙ্গে-সঙ্গে সে উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠল,
“আরে, শহরের মেহমান যে। আয় কতা কইয়া আহি।”
নৈঋতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেয়েগুলো যে রৌদ্রুপকে দেখতেই এসেছে, সে বিষয়ে তার সন্দেহ রইল না। লজ্জা-শরমের বালাই নেই। নীলাভ টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরিহিত রৌদ্রুপ মাচায় পা ঝুলিয়ে বসে ডাবের পানি খেতে ব্যস্ত ছিল। কুসুমিতাদের এদিকে আসতে দেখে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করল। গতকাল মেয়েগুলোকে সেভাবে খেয়াল করা হয়নি, বিধায় চিনতে পারল না। কুসুমিতা মিষ্টি হেসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন ভাইয়া?”
রৌদ্রুপ সালামের জবাব দিয়ে বলল,
“ভালো আছি। তোমাদের পরিচয়?”
“আমরা এই গেরামেরই মাইয়া। রিতা আর আমরা একলগে মাঠে খেলি। ওই যে গতকাইল মাঠে দেখছেন না?”
“ও আচ্ছা। আসলে তখন তোমাদের খেয়াল করিনি আমি। অনেক মেয়ে ছিল তো। বসো তোমরা।”
কুসুমিতারা বসল। রৌদ্রুপ তাদের ডাবের পানি খেতে বলল, কিন্তু তারা খেল না। অদূরে দাঁড়িয়ে নৈঋতা খেয়াল করল রৌদ্রুপ কুসুমিতাদের সঙ্গে বেশ হেসে-হেসে গল্প করছে। হঠাৎ করেই এত বছরের খেলার সাথীদের নৈঋতার অসহ্য লাগতে শুরু করল। যেন ওরা চলে গেলেই তার শান্তি মিলবে। হঠাৎ তার মন এমন হিং’সা পরায়ণ হয়ে ওঠার অর্থ উদঘাটন করতে চাইল। সে তো কখনও কাউকে এমন হিং’সা করেনি। তবে আজ কেন করছে? মানুষটা রৌদ্রুপ বলে? রৌদ্রুপ বার কয়েক ডাকলেও নৈঋতা তাদের কাছে গেল না। গাল ফুলিয়ে দূরেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। কথাও বলল খুব কম। ব্যাপারটা রৌদ্রুপের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। নৈঋতার মুখের অভিব্যক্তি দেখে রৌদ্রুপ মনে-মনে হাসল। টানা পনেরো মিনিটের মতো কুসুমিতারা রৌদ্রুপের সাথে গল্প করে তবেই বিদায় হলো। তারা চলে যেতেই রৌদ্রুপ নৈঋতাকে কাছে ডাকল। এবার নৈঋতা কোনো রকম আপত্তি না করে চুপচাপ গিয়ে রৌদ্রুপের মুখোমুখি বসল। রৌদ্রুপ নৈঋতার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“আকাশের মেঘের মতো এই মেঘবতীরও হিং’সা আছে, জানতাম না তো।”
নৈঋতা কপাল কুঁচকে রৌদ্রুপের দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“মানে?”
“তোমার বান্ধবীরা আসায় তুমি অসন্তুষ্ট হলে কেন?”
রৌদ্রুপের এমন প্রশ্ন শুনে নৈঋতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সহসা কোনো উত্তর দিতে পারল না। রৌদ্রুপ উত্তরের আশায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে আমতা-আমতা করে বলল,
“অসন্তুষ্ট হমু ক্যান?”
“তাহলে তখন দূরে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?”
“এমনেই।”
“আচ্ছা? তাহলে গাল ফুলিয়ে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ছিলে কেন?”
নৈঋতা থতমত খেয়ে নড়েচড়ে বসল। লোকটার চোখ না যেন শকু’নের চোখ। এতকিছু খেয়াল করে কীভাবে? নৈঋতার অপ্রস্তুত ভঙ্গিমা লক্ষ্য করে রৌদ্রুপ শব্দ তুলে হেসে উঠল। নৈঋতা গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইল রৌদ্রুপের মুখের দিকে। কিছু সময় পর হঠাৎ ফট করে প্রশ্ন করে বসল,
“কুসুম অতিরিক্ত বকবক করে।”
রৌদ্রুপ হাসি থামালেও ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা রয়ে গেল। নৈঋতার প্রশ্নে সে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“তো? তাতে কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
রৌদ্রুপ প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“তুমি রাগও করতে জানো?”
“আমি আপনের লগে রাগ করার কে?”
নৈঋতার থমথমে গলা শুনে রৌদ্রুপ ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর হঠাৎ খানিক ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল,
“কী ব্যাপার বলো তো মেঘবতী? প্রেমে-ট্রেমে পড়ে গেলে না কি আমার?”
রৌদ্রুপের কথাটা কর্ণগুহরে পৌঁছনোমাত্র নৈঋতার বুকটা ধক করে উঠল। চকিতে নড়েচড়ে বসল। লোকটার কি লজ্জা-শরম কম? কোনো কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে না। নৈঋতা রৌদ্রুপের প্রশ্নের বিপরীতে কোনো উত্তর দিতে পারল না। মাথা নত করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইল। রৌদ্রুপ এখনও নৈঋতার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। মেয়েটা যে নিজের অজান্তেই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে, সে খবর এই মেয়ে নিজেও জানে না। নৈঋতা যে সুযোগ পেলেই চো’রা চোখে তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখে, তা রৌদ্রুপের অজানা নয়। মেয়েটা লজ্জায় পড়বে বলে সে চুপ থাকে। শহুরে নারীদের সামনে যে রৌদ্রুপ একজন শক্ত মনের মানুষ, সে কি না গ্রামের এই সাদাসিধে নারীর কবলে পড়ে শক্ত মনটাকে হারিয়ে ফেলল! এসব ভাবলেই রৌদ্রুপ আপন মনে হাসে। তবে সে পিছু হটতে চায় না। দেখতে চায় নিয়তি তার মেঘের মতো হঠাৎ উদয় হওয়া অনুভূতিগুলোকে ঠিক কী পরিণতি দেয়। লজ্জায় জড়োসড়ো নৈঋতার আর বসে থাকা হলো না। মাচা থেকে নেমে প্রস্থান করার জন্য পা বাড়াতেই রৌদ্রুপের পিছু ডাক,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা পা থামিয়ে শুকনো একটা ঢোক গিলল। রৌদ্রুপও মাচা থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুচকি হাসির রেখা মুখে ঝুলিয়ে বলল,
“কখনও মনের কোণে সূক্ষ্ম ফো’টন কণার য’ন্ত্র’ণা অনুভব করলে সংকেত দিয়ো। মেঘবতীর সংকেতের আশায় এক বর্ষণরাজ চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করবে।”
আজ এক সপ্তাহ হলো রৌদ্রুপ গ্রামে এসেছে। গ্রামের বিদ্যুৎ সংযোগ সবে ঠিক করা শুরু হয়েছে। এখনও সে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। বাবা-মায়ের কথা ভেবে তার খারাপ লাগে। আজ অবধি কোনোদিনও এভাবে তাদের সাথে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। সে কোথাও বেড়াতে গেলেও দিনে একবার হলেও তাদের সাথে কথা বলত। মুখে পানির ঝাপটা দিতে-দিতে বাবা-মায়ের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল রৌদ্রুপ। নৈঋতা তার হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে কলস আর বালতিতে পানি তুলল। সেগুলো ডাঙায় রেখে সেও মুখ ধুলো। পানি থেকে উঠতেই রৌদ্রুপ হঠাৎ ডাকল,
“নৈঋ?”
নৈঋতা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দিলো,
“জি।”
রৌদ্রুপ কোনো কথা না বলে এক ধ্যানে নৈঋতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নৈঋতা কিছুটা অবাক হলো। অস্বস্তিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলল। মিনিট দুয়েক পর রৌদ্রুপ হুট করে বেশ নম্র কন্ঠে বলল,
“আমার ব্যাক্তিগত মেঘবতী হবে? এক ফোঁটা প্রণয় বর্ষণে সমস্ত হৃদয়ে প্রণয়ের তান্ডব সৃষ্টি করবে? আমার হৃদয় মরুভূমিতে তোমার এক ফোঁটা প্রণয় বর্ষণের অভাবে তীব্র হাহাকার জমায়েত হয়ে আছে মেঘবতী। তোমার প্রণয় বর্ষণহীনা এ হাহাকার ফুরাবার নয়।”
নৈঋতার হাত-পা শিথিল হয়ে এল। সারা শরীর শিরশির অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। রৌদ্রুপের প্রত্যেকটা কথা এসে বুকের বাঁ পাশটা ছু’রিকাঘা’তে ফালা-ফালা করে দিলো। কম্পিত ঠোঁটে সে অস্ফুট স্বরে বলল,
“এইসব কী কইতাছেন?”
রৌদ্রুপ এক পা এগিয়ে গেল নৈঋতার দিকে। নৈঋতার চোখে চোখ রেখে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,
“সারাজীবনের জন্য আমার হাতটা ধরবে? কথা দিচ্ছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি ওই হাত মুঠোবন্দী করে রাখব। ভালোবাসার রংয়ে রাঙিয়ে রাখব আজীবন। এ সুযোগটুকু দিবে আমায়? বাকি জীবনের জন্য আমার হবে?”
এক ঝাঁক নতুন অনুভূতি এসে নৈঋতাকে জাপটে ধরেছে। চোখের কোণে চিকচিকে পানি জমা পড়েছে। কথা বলতে গিয়ে বুঝল কন্ঠনালিতে তীব্র তৃষ্ণা। অস্বস্তি আর লজ্জায় সে চঞ্চল দৃষ্টি মাটিতে বিচরণ করতে লাগল। কুসুমিতাদের সাথে রৌদ্রুপকে কথা বলতে দেখে যেদিন সে নিজের হিং’সুটে মনোভাব আবিষ্কার করেছিল, সেদিন থেকেই সে নিজের মনকে জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। এ কদিনে সে দিন-রাত করে ভেবেছে। এ-ও বুঝতে পেরেছে রৌদ্রুপের প্রতি তার মন সত্যিই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবু সে নিজের মনকে শান্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। বলা তো যায় না, হয়তো রৌদ্রুপ ভালো লাগা থেকে এত কথা বলে। দুদিন বাদে সে যখন নিজের শহরে চলে যাবে, তখন হয়তো গ্রাম ছাড়ার সাথে-সাথে গ্রামের নগন্য মেয়েটাকেও ভুলে যাবে। এই অনিশ্চিত অনুভূতির ফল তখন কী দাঁড়াবে? সে নিজেকে ভাঙতে চায়নি। রৌদ্রুপের সত্যিকার মনোভাব জানতে চেয়েছে, তাকে বুঝতে চেয়েছে। আজ বুঝি সে সময়ই ঘনিয়ে এসেছে। রৌদ্রুপ উত্তরের আশায় উন্মুখ হয়ে নৈঋতার মুখপানে চেয়ে থেকেও হতাশ হলো। ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজাসাপ্টা বলে উঠল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি নৈঋ। আমাকে নিয়ে তোমার মনে কি কোনো অনুভূতি আছে? ভালোবাসবে আমায়?”
নৈঋতা এবার জলস্রোতে টইটুম্বুর চোখ তুলে তাকাল। রৌদ্রুপ খানিক থমকাল। কিছু বলার আগেই নৈঋতা থমথমে গলায় বলল,
“আমরা গরিব মানুষ। আপনের মতো মানুষরে ভালোবাসা বেমানান। গেরামে আইয়া আমারে মনে ধরছে, দুইদিন পর শহরে গেলে তা ভুইলা যাইবেন। শহরের সুন্দরী মাইয়াগো কাছে আমি কিছুই না। তাই আমারে আর মনেও পড়ব না। আপনে আমারে ছাইড়া গেলেও ভালা থাকবেন। আর আমি? তিলে-তিলে মরণের লাইগা আপনেরে ভালোবাসমু? জাইনা-বুইঝা আ’গুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো বোকামি আমি করতে চাই না। আপনে আর আমারে এমন কতা কইয়েন না।”
রৌদ্রুপ হতভম্ব হয়ে নৈঋতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“লাইক সিরিয়াসলি নৈঋ! তুমি আমাকে এমন ছেলে মনে করো? এ কদিনেও তুমি আমাকে চিনতে পারলে না?”
“আমি খারাপভাবে কইতে চাইনাই। দয়া কইরা কিছু মনে করবেন না। আমি আপনের যোগ্যও না।”
“ভালোবাসাটা আসে মন থেকে। ভুলে গেলে বা ছেড়ে গেলে তাকে ভালোবাসা বলে না। আমার মন জুড়ে তুমি জায়গা করে নিয়েছ। আমি তোমাকে অনুভব করি। এ অনুভূতি সবার প্রতি আসে না নৈঋ। তুমি নিজের যোগ্যতা নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু আমার চোখে তুমি যোগ্য বলেই আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। সেখানে এসব নেগেটিভ ভাবনা এল কীভাবে তোমার মাথায়? আমি বুঝতে পারছি আমি শহরের ছেলে বলে তুমি এত ভয় পাচ্ছ। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার অনুভূতিগুলো একটুও মিথ্যে নয়। আবেগের বয়স আমি অনেক আগেই পার করে এসেছি। যোকোনো সম্পর্ক নিয়ে সিরিয়াস হওয়ার সময় এখন। শুধু একবার বিশ্বাস করে দেখো, ঠকবে না। গড প্রমিস।”
“আমার ডর লাগে,” অসহায় মুখে বলল নৈঋতা।
রৌদ্রুপ শান্ত স্বরে বুঝিয়ে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে তাড়া দিচ্ছি না। তুমি সময় নাও। এখনই কিছু বলতে হবে না। হুট করে এমন কিছু হয়তো তুমি আশা করনি, তাই ঘাবড়ে গেছ। সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় একটু ভেবে তারপর জানাও। মস্তিষ্কে চাপ দিবে না, শান্ত থাকবে। তোমার মন যা চাইবে, তুমি তা-ই বলবে। আমি একদম জোর করব না। তোমার উত্তরের জন্য আমি অপেক্ষা করব।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।