“মিস. রুশানি! কংগ্রাচুলেশন,আপনি মা হতে চলেছেন”
কথাটা শুনে রুশি থম মেরে বসে রইলো, ডাক্তারের এগিয়ে দেয়া রিপোর্ট হাতে নিবে সেই সাহস হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে কোন এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখছে, চোখ মেললেই সব মিথ্যে হয়ে যাবে। রুশিকে চুপ করে থাকতে দেখে ডাক্তার বলে উঠলো
“আপনার হাজবেন্ড আসেনি সাথে?না আসলে তাকে বলে দিতাম আরকি আপনার খেয়াল রাখতে। আপনার শরীর বেশ দুর্বল তাই বেবির ক্ষতি হতে পারে, আমি কিছু ভিটামিন দিয়ে দিচ্ছি।”
রুশির কর্ণপটে হাজবেন্ড ব্যতীত অন্য শব্দ ঢুকেনি, কোনরুপ কাঁপা হাতে রিপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হসপিটাল থেকে। হসপিটালের চৌকাঠ পেরুতেই অবাধ্য চোখের জলগুলো গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। হাজবেন্ড! সেটা কোথা থেকে আসবে ওর?
সবেমাত্র আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দিয়েছে তার মধ্যেই জীবনে এতো বড় ঝড়!
সামনে থাকা পার্কের ঘাসে বসে পড়লো সামনে লেকের পানির উথালপাতাল ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ওর অন্তরের অশান্ত স্পন্দন। ঢুকরে কেঁদে উঠলো ও।
“বিধাতা! আমার সাথেই কেনো এমন হয়?জন্মের পর বাবা মা ফেলে চলে গিয়েছে, ছুড়ে ফেলে দিয়েছে অনাথ আশ্রমের দরজায়। যাও বাবাই দয়া করে আমাকে নিজের মেয়ে বানিয়ে তার গৃহে ঠায় দিয়েছে তাও আম্মু কোনদিন মেনে নেইনি আমায়! প্রতিনিয়ত আমাকে স্মরণ করিয়েছে আমি অনাথ, আমার কোন পরিচয় নেই। তাও তো ভালো ছিলাম, দু মুঠো ভাত তো কপালে জুটতো! কিন্তু আজ! এখন তো আমার মাথার শেষ আশ্রয় টুকুও থাকবে না। আম্মু তো আমাকে আর ওই বাড়িতে জায়গা দিবে না। কই যাবো আমি?”
রুশি পার্কে বসে কান্না করছে নিশ্চুপে তবে ওর কান্না দেখার মতো কেউ নেই। অনাথদের কেউ থাকে না ওরও নেই। যতো অনাথ শব্দটা মনে পড়ে তত নিজের আসল বাবা মায়ের জন্য ঘৃণা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। আজ ওর এই অবস্থার জন্য একমাত্র দায়ী ওর আসল বাবা মা, তারা যদি ওকে ফেলে না যেতো তবে আজ এইখানে এইভাবে বসে ওকে চোখের জল ফেলতে হতো না।
ওর পালক বাবা মায়ের আরো দুজন সন্তান আছে, একটা মেয়ে আর একটা ছেলে যারা ওর থেকে বড়।ছেলে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বেকার হয়ে বসে আছে আর মেয়েটি ওর থেকে দুই ক্লাস সিনিয়র। রুশি সবে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে। ইন্টার পর্যন্ত পালক বাবা খরচ চালালেও এর আর চালাতে পারছে না কারণ তার স্ত্রী এটা পছন্দ করেনা। আর স্ত্রীর কথার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তার নেই, তাই রুশি টিউশনি করে তিনটা তাতেই আপাদত খরচ চলে যায়। মাঝেমাঝে তিনি বড্ড আফসোস করেন ওর জন্য যে ওকে সঠিক ভাবে লালনপালন করতে নিয়ে আসলেও তিনি তার কথা রাখতে পারেনি। কিন্তু রুশিকে যে অনাথ থেকে এখানে এনে ঠায় দিয়েছে এতেই রুশি অনেক কৃতজ্ঞ তার কাছে তার উপর ছোট থেকে এই একটা মানুষই তাকে বড্ড ভালোবাসে!
রুশি উঠে দাঁড়ালো তারপর হাতে থাকা রিপোর্ট ছিড়ে টুকরো টুকরো করে লেকের পানিতে ভাসিয়ে দিলো। ও জানেনা কয়দিন পর্যন্ত এই সত্য লুকিয়ে যেতে পারবে তবে আপাদত এই রিপোর্ট হাতে বাড়ির ফেরার সাহস ওর নেই। ও কি করবে এই মুহুর্তে কিছুই জানেনা তবে বাড়ি ফেরা দরকার প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার আগে বাড়ি না ফিরলে রাতের খাবার কপালে জুটবে না আজ, ছোট থেকে এটাই নিয়ম, কোন ভুল করলেই খাবার বন্ধ হয়ে যেতো এমনও হয়েছে যে সারাদিন না খেয়ে আছে কিন্তু জিজ্ঞেস করার কেউ নেই। রাতে বাবা এসে তারপর চুপিচুপি খাইয়ে দিয়েছে।
রুশি বাসার উদ্দ্যেশ্য রওনা দিলো, রাস্তার ধারে আনমনে হাটছিলো হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। ওর কেনো যেনো মনে হচ্ছে কয়েকটা পা ওর পিছুপিছু আসছে। প্রায় সাথে সাথেই পেছনে তাকালো কিন্তু পিলার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। বাড়ির ফেরার পথে এরুপ কয়েকবার পিছনে তাকিয়েছো কিন্তু হতাশ হয়েছে। পরে মনের ভুল ভেবে আর তাকাইনি। বাড়ির দরজা খুলতেই তীব্র গতিতে একটা পাতিল ওর পায়ে এসে পড়লো, তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব হতেই কয়েককদম পিছিয়ে গেলো। আশে পাশে ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সামনে তাকিয়ে দেখে পালক মা রাগে ফুসছে তার হাতে কাঠের খুন্তি। সেটা হাতে নিয়েই এগিয়ে আসলো আর চড়া গলায় বললো
“মহারাণী কই থেইকা ফিরেছেন হ্যা?সারাদিন যহন বাইরে কাটাইবার ব্যাবস্থা হইয়াই গেছে তয় আর বাড়ি ফিরোনের দরকার আছে নি।হারাডাদিন আমি কাম কইরা কইরা খাটমু আর আপনে আইসা গিলবেন শুধু?এই নাহাররে কামের বেডি পাইছুন নি”
রুশি কিছু না বলে মাথা নিচু করে আছে, পালক মায়ের কথায় খারাপ ইংগিত প্রকাশ পেলেও খুব একটা ভাবান্তর হলো না ওর। বুঝ হওয়ার পর থেকে এসব শুনতে অভ্যস্ত ও তাই শরীরে সয়ে গেছে। ও সুন্দর মতো বসে ভাতের পাতিল ঠিক করতে লাগলো তখনি কানে একটি কন্ঠ ভেসে আসলো ওর পালক বাবার মেয়ে নিহা মায়ের সাথে তালমিলিয়ে বলছে
“দেখো মা টিউশনির নামে কার সাথে কি কি করে!এসব মেয়েকে আমাদের এখানে রাখলে মান সম্মান থাকবে বলে মনে হচ্ছেনা মা। বাবা যে এসব আপদ আমাদের ঘাড়ে কেনো এনে ফেলেছে বুঝিনা।একে তাড়াতাড়ি তাড়ানোর ব্যাবস্থা করো মা নাহয় রুপের মায়া জালে ভাইকে কখন ফাঁসিয়ে ফেলে!দেখোনি আগে কেমন সাইড নিতো ওর”
নিহার কথায় রুশির পিলে পর্যন্ত জলে উঠলো, ওর পালক ভাই নিহাল যাকে ও কোন কালেই পছন্দ নয়। তার সুদর্শন চেহারার পেছনে লুকিয়ে আছে আস্ত এক লম্পট। ছোট থেকে আদরের বাহানায় অসংযত স্পর্শ করার যেনো তার অভ্যস হয়ে গিয়েছে, প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছে। এখন সুযোগ পায়না বলে রুশি এখন তার চরম শত্রু।
রুশি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পাতিল সুন্দরমতে রান্না ঘরে রাখলো তারপর নিজের জীর্ণশীর্ণ কামরার দিকে রওনা হলো,দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে বললো
“অন্নকে সম্মান না করলে অকালে তা কপাল থেকে চলে যায়”
তারপর রুমে ঢুকে গেলো আর দরজা লক করে দিলো, বাইরে থেকে নাহার বেগম মানে ওর পালক মায়ের কন্ঠ ভেসে আসছে
“আমারে তর চাকরানী মনে হইতাছে, রাইতের খাওন কে রানবো?”
কিন্তু রুশির সেই কথার জবাব দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে বা অধিকার কোনটিই নেই কারণ ও পালক সন্তান, দুমুঠো খাবার দিচ্ছে তাতেই অনেক। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো, কয়েকদিন ধরেই শরীর ভালো যাচ্ছিলো না তাই টিউশনির টাকা পেতেই ডাক্তারের কাছে গেলো কিন্তু এতোবড় কিছু হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। এই বাচ্চাকে ও পৃথিবীর মুখ কি করে দেখাবে যেখানে নিজের থাকারই নিশ্চয়তা নেই?তাছাড়া বিয়ে ছাড়া কোন সন্তান জন্ম দেয়াকে এই সমাজ মেনে নিবে সেখানে মেয়েটার দোষ থাকুক আর না থাকুক। রুশি নিজের পেটের উপর হাত রাখলো, ও ভাবতেই পারছেনা ওর এই দেহে একটা ছোট্ট প্রান ধীরেধীরে বেড়ে উঠছে!
“তোর মা বড্ড অসহায় বাবু কিন্তু তুই চিন্তা করিস না, নিজের জীবন বাজি রেখে হলেও তোর কিছু হতে দিবে না তোর আম্মু। তুই শুধু আম্মুকে ছেড়ে যাস না”
#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১
(জানিনা কেমন হয়েছে, তবে মাথায় এমন একটা থিম হঠাৎ আসলো তাই লিখলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)