#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২১
রুশি আজ প্রায় এক মাস পর খান বাড়ির বাইরে পা রাখলো, এতোদিন শরীরটা খুব একটা ভালো ছিলো না তাই আর বের হয়নি। বাড়িতে এতোদিন নিজেকে কেমন যেনো ভারী ভারী লাগতো, কোন কাজ ছাড়া সারাদিন শুয়ে বসে থাকা বড় কষ্টকর তাছাড়া ছোট থেকে ওর কাজ করার অভ্যস, তবে রান্নাটা খুব একটা করা হয়নি। পালক মায়ের চাপে মাঝেমাঝে করলেও বেশ ভয়েই থাকতো, কারণ ও আগুনকে ভয় পায় মারাত্মক ভয় পায়!
রুশি রিক্সা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হলো,খোলা বাতাসে প্রাণখুলে যেনো নিঃশ্বাস নিতে পারছে।রুশি সাবধানে বসে আশেপাশের প্রকৃতি দেখতে লাগলো,শীতে ঢাকা শহরের চিত্রই যেনো আলাদা। সবাই শীতের চাঁদর কিংবা জেকেটে নিজেদের মুড়িয়ে রেখেছে,ছোট ছোট বাচ্চারা বাবা-মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে।আর কয়েকবছর পর ওর বাচ্চাও এভাবে ওর হাত ধরে স্কুলে যাবে। রুশি একটা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে, স্কুল ড্রেস পরা বাচ্চাটি বাবার কাঁধে করে রাস্তা আর হচ্ছে আর পাশে মা ব্যাগ নিয়ে তাদের সাথে সমানতালে হেঁটে যাচ্ছে! রুশির রিক্সা ক্রস করে চলে গেলেও ফাঁকা দিয়ে ও তাকিয়ে রইলো সে দিকে,এই বাচ্চাটি একটা সম্পুর্ণ পরিবার পেয়েছে যেখানে বাবা অফিস থেকে এসে হয়তো বাচ্চাটির সাথে খেলবে আর মায়ের সাথে রোজ সন্ধ্যায় বাচ্চাটি পড়তে বসবে!
কিন্তু ওর বেবি!সেতো এইরকম সম্পুর্ণ পরিবার পাবে না, কারণ তিনবছর পর তো রুশিকে এই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। রুশি এতোদিন এটা ভেবেছে ও চলে যাবে অনেক দুরে এসব ছেড়ে কিন্তু এখন ও ছেড়ে যেতে চায়না। বারবার মনে এইসব কিছু তো ওর তাহলে ও কেনো সরে যাবে?ওর মা, ওর বোন, ওর পরিবার আর ওর…
নাহ সবকিছু ওর হলেও স্বামী ওর নয়, সে অন্যকারো হবু স্বামী তাকে নিয়ে ভাবাই হয়তো পাপ। কোন সম্পর্ক তো কাগজের টুকরো দিয়ে মাপা যায়না, সবচেয়ে বড় সম্পর্ক গড়ে উঠে আত্মার মিলনের মাধ্যমে আর রুশি তো সায়ানের মনের কোন এক কোনা জুড়েও নেই!
রুশি এসব কথা ভাবতেই সামনের দিকে তাকালো, ওর কাছাকাছি বয়সের একটা মেয়ে ব্যাগ কাঁধে হেঁটে যাচ্ছে। রুশি দ্রুত রিক্সা থামিয়ে সেটা থেকে নেমে পড়লো তারপর ওই মেয়েটির হাত ধরে ফেললো আর টেনে কর্নারে নিয়ে গেলো। ওকে দেখে মেয়েটি বড্ড বিরক্ত তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে, রুশি আর কথা বাড়ালো না। চোখ মুখ শক্ত করে রাগি কন্ঠে বললো
“কেনো করলি আমার সাথে এমন? তুই তো বেস্টফ্রেন্ড ছিলি তাইনা?কি করে পারলি এমন করতে? আমাকে তুই একটা অপরিচিত ছেলের ঘরে অনায়াসে রেখে আসলি!”
রুশির হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো মেয়েটি তারপর ঝাঝলো কন্ঠে বললো
“তুই আমার ফ্রেন্ড কখনো ছিলিই না বরং তোকে দেখে আমার হিংসা হতো।কলেজে একেতো তুই টপ ছিলি তারউপর সব ছেলেরা তোর পেছনে পড়ে থাকতো!আমি তোর থেকে বেশি স্মার্ট আর সুন্দর হয়েও আমি তোর কারণে ছেলেদের কাছে পাত্তা পাইনি, ছেলেরা তোকে লিখা লাভ লেটার আমাকে দিয়ে যেতো! তাই তোকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সুযোগ পাইনি,আর তাছাড়া তুই ভালো ছাত্রী তোর হেল্প তো পড়াশোনায় লাগতোই। তবে কলেজ শেষে আমি তোকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু একদিন ক্লাবে ছেলেদের কাছে বাজি হেরে যাই আর তারা আমাকে বাজে অফার দেয়। ঠিক তখনি মনে পড়লো তোর কথা আর আমি তোর সাথে যোগাযোগ করি আর সুযোগ বুঝে তোকে সেই ক্লাবে নিয়ে যাই!কিন্তু তোর ভাগ্য ভালো যে ওই ছেলেগুলো তোকে অন্য একজনের কাছে ভালো দরে বেচে দিয়েছিলো নাহয় ভাব পাঁচ ছয়টা ছেলে একসাথে…”
কথাটা শেষ করার আগেই রুশি তিথিকে থাপ্পড় মারলো খুব জোরে, তারপর আরেকটা মারতে গিয়েও সামলে গেলো। এইরকম জঘন্য মানসিকতার মেয়ের গায়ে আর হাত তুলে নিজের হাত নোংরা করতে চায়না। শুধুমাত্র জেলাসির বশে এই মেয়েটি একটা নারী হয়ে অন্য নারীর পুরো জীবন নষ্ট করে দিলো? ওর একটুও বুক কাঁপলো না, রুশির প্রতি কি ওর এক ফোটাও দয়া হলো না। মানুষের তো অনেকদিন থাকলে কুকুরের প্রতিও মায়া জন্মায় আর ওর জলজ্যান্ত মানুষের প্রতি দয়া হলো না? এতোটা পাষান্ড হয় কি করে মানুষ?
ও নিজের রাগকে শান্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“তুই এতোটা জঘন্য আমি ভাবতেও পারিনি, সামান্য জেলাসির কারণে তুই আমার সবচেয়ে জিনিস আমার সম্মান তুই কেড়ে নিলি?আমার তো তোর সাথে কথা বলতেও বিবেকে বাঁধছে!মনে রাখিস উপরওয়ালা সব দেখছে,তিনি সবকিছুর বিচার করবেন। আমি তারউপর সব কিছু ছেড়ে দিলাম।”
বলেই রুশি উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো তারপর দেখলো রিক্সাওয়ালা মামা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, ও সেটাতে উঠে রওনা দিলো।ভার্সিটির দিকে নয় বরং সেই পার্কে! যেখানে ও মন খারাপ হলেই বসে থাকতো। ও সেখানে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো, চোখের সামনে যেনো তিথির সাথে কাটানো সকল স্মৃতি ঘুরছে।ওদের একসাথে চলা, কথা বলা, কাড়াকাড়ি করে ফুচকা খাওয়া! সব মিথ্যে ছিলো সব, সবকিছু অভিনয় ছিলো কি নিখুঁত অভিনয়! অথচ ও সব সত্যি ভেবেছে কিন্তু সবকিছু একপাক্ষিক ছিলো বরং সবাই ওকে ব্যাবহার করেছে।
ওর চোখদুটো লাল হয়ে আছে, কিন্তু ও কাঁদছে না বরং রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে। এতো বোকা কি করে হলো ও, ওদের করা অভিনয় ও বুঝতে পারলো না?রুশি মাথা চেপে বসে আছে, খুব অসহায় লাগছে নিজেকে! পাশে ফোন বেজে যাচ্ছে কিন্তু ও তুলছে না। এভাবে কতোক্ষণ বসে ছিলো ওর জানা নেই, হঠাৎ কারো ছোঁয়ায় চমকে উঠলো। পাশে তাকিয়ে সায়ানকে দেখে যেনো আরো অবাক হয়।সায়ান কি করে জানলো ও এখানে?আর তাকে এতো টেন্স দেখাচ্ছে কেনো। সায়ান রুশির গালে আলতো হাত রেখে বললো
“তুমি ঠিক আছো?এই সময়ে এখানে কি করছো?”
কথাটা শুনতেই রুশির গাল বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো, ও জানেনা কেনো কাঁদলো কিন্তু এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে বড্ড! রুশির চোখের পানিগুলো সায়ান সযত্নে মুছে দিলো তারপর গালে হাত রেখে বললো
“কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে?কেউ কিছু বলেছে?”
রুশি মাথা নাড়ালেও ওর কান্নার বেগ বেড়ে গেলো, কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে। সায়ান রুশির এই অবস্থা দেখে ওকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে গেলো আর রুশি সায়ানের বক্ষে মাথা রেখে হিচকি তুলা কন্ঠে বললো
“ও আমাকে শুধুমাত্র ব্যাবহার করেছে, আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়েও আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে অন্যছেলেদের কাছে। ওইদিন যদি আপনি ওইখানে না থেকে অন্য ছেলেরা থাকতো…”
রুশির জড়ানো কন্ঠে বলা শব্দগুলো শুনে সায়ানের বুক ছ্যাঁত করে উঠলো, ওইদিন শুধু ও না বরং রুশিও কারো বিশ্বাস ঘাতকতার স্বীকার হয়েছে। সায়ান হাত মুঠ করে ফেলেছে, সত্যি এমন ঘটনা ও কল্পনাও করতে পারছে না। অথচ রুশি একট অপরিচিত ছেলের হাতে পড়েছিলো সেদিন,এখন যতোই ওকে চিনুক না কেনো একসময় ওতো রুশির মনে হায়না থেকে কম ছিলো না! ও সত্যিই জঘন্য কাজ করেছে, প্রচণ্ড খারাপ কাজ। সায়ান মাথানিচু করে রুশির মাথায় আলতো হাত ভুলাতে থাকলো। এই ঘটনার পেছনে যারাই জড়িত তাদের কাউকে ছাড়বে না ও, কাউকে না।
রুশির কান্নার বেগ কমে আসলে সায়ান মৃদু স্বরে বললো
“কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক আছে দেখো! আমি তোমার কিছু হতে দিবো না, তুমি আর কান্না করো না প্লিজ”
সায়ানের কথায় রুশি বাস্তাবতায় ফিরে আসলো, আলতো করে সায়ানকে সরিয়ে দিয়ে ঠিক হয়ে বসলো। চোখের পানি মুছে সায়ান দিকে না তাকিয়ে বললো
“এভাবে আর আমাকে জড়িয়ে ধরবেন না আর না কেয়ার করবেন আমার।মাত্র তিনবছরের সম্পর্কে আমি কোন প্রকার মায়া জড়াতে চাইনা। এসব আপনার কাছে হয়তো স্বাভাবিক কিছু কিন্তু আমি মনের অজান্তেই এমন স্বপ্ন দেখে ফেলবো যা দেখার অধিকার আর যোগ্যতা আমার নেই। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন!”
রুশি হুট করেই দাঁড়িয়েই হাটা শুরু করলো, সায়ান সেদিকে অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছে হয়তো একবার হলেও ফিরে তাকাবে কিন্তু তাকায়নি, নিজের মতো করে চলে গেলো গাড়ির দিকে। সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো,রুশি ফোন না ধরাতে ও কতোটা চিন্তিত ছিলো তা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না, তারপর ট্রেকার অন করে বুঝতে পারলো রুশি এখানে আছে। একা একা রুশি বেরিয়েছে তাও এই অবস্থায় তারউপর গাড়িও নেই। সত্যি বলতে সায়ান বড্ড ক্ষেপে গিয়েছিলো কিন্তু রুশির অবস্থা দেখে আর কিছু বলেনি। ও নিজেও উঠে দাঁড়ালো, ও কাউকে ছাড়বে না ও যার জন্য রুশি এতো কষ্ট পাচ্ছে! কাউকে না।
দুটো মানুষ পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু তাদের মাঝে কোন কথা নেই। সায়ান কতোক্ষণ পর তাকালেও রুশি একবারের জন্যও তাকায়নি, যেনো পণ নিয়েছে দুনিয়ায় কেয়ামত হয়ে গেলেও পাশের মানুষটির দিকে তাকাবে না, ভুলেও না। কতো পাশাপাশি বসে আছে দুজন অথচ মনের দুরত্ব কতো বিশাল!
#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২২
সায়ানের পুরাতন বাড়িতে সায়ান সোফায় বসে আছে, চোখমুখ শক্ত করে কতক্ষণ পর পর মেইন দরজার দিকে তাকাচ্ছে ও। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে বসে আছে ওখানে কিন্তু চন্দ্রিকার আসার কোন খবর নেই!হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো আর সায়ান মেইডকে ইশারায় দরজা খুলে দিতে বললো। মেইড দরজা খুলতেই চন্দ্রিকা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো আর ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো!
“চিন্তা করোনা আমি ঠিক আছি আর বাসার ভেতরে পৌঁছে গেছি। তুমি…”
সায়ানের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রিকা থমকে গেলো, আমি রাখছি বলে ফোনটা খট করে কেটে দিলো। প্রথমে চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠলেও পরে তা হাসিতে পরিণত হলো। সায়ানের দিকে এগিয়ে এসে বললো
“তুমি কখন এসেছো?আমাকে বলোনি কেনো যে তুমি আসছো? তুমি এতোদিন ঠিক করে আমার সাথে কথা বলোনি আর না এখানে এসেছো আমি কতো রাগ করেছি জানো?স্যরি না বলা পর্যন্ত তোমার সাথে আড়ি”
সায়ান চন্দ্রিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কতোক্ষণ! কতো নিষ্পাপ চেহারা তার, চোখে মুখে মুহুর্তেই যেনো সরলতা ফুটে উঠেছে কিন্তু…
সায়ান নিজের চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো আর বললো
“ফোনে কে ছিলো?”
সায়ানের শক্ত কন্ঠ শুনে চন্দ্রিকা হচকিয়ে গেলো, আমতাআমতা করে বললো
“তেমন কে্ কেউ না, ওইতো ফ্রে্ ফ্রেন্ড”
“ফ্রেন্ড? আমার জানা মতে তোমার কোন ফ্রেন্ড ছিলো না এতোকাল যাবৎ। সবসময় বলো আমি তোমার ফ্রেন্ড, ভালোবাসা সবকিছু আর কারো দরকার নেই তোমার। হঠাৎ তোমার ফ্রেন্ডের দরকার হয়ে গেলো?কোথা থেকে পেলে এই ফ্রেন্ড?”
চন্দ্রিকা কিছুটা ভয় পেয়ে সায়ানের হাত চেপে ধরলো তারপর বললো
“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো সায়ান?”
“আমি শুধু প্রশ্ন করেছি!সন্দেহের কথা কোথা থেকে আসছে এখানে?”
“আমি আসলে… তুমি তো এখানে আসো না আর আমিও খুব লোনলি ফিল করছিলাম তাই সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিচয় হয় ওর সাথে। অনেক ভালো মানুষ ও”
“আসলেই অনেক ভালো ছেলে তাই নিজ দায়িত্বে তোমায় নামিয়ে দিয়ে গেলো আবার কপালে কিস করে গেলো। ইটস কমন ইন ফ্রেন্ডস! যাইহোক কোথায় ছিলে এতোক্ষন?”
চন্দ্রিকা সায়ানের কথা শুনে ওর হাত ছেড়ে দিলো তারপর ভয়ার্ত চোখে সায়ানের দিকে তাকালো। চন্দ্রিকার চাহনি দেখে সায়ান বলে উঠলো
“মেইড থেকে শুনলাম হসপিটালে গিয়েছিলে তাইতো? কেনো গিয়েছিলে?”
“রেগুলার চেক আপ এর জন্য, তুমি বিজি ছিলে তাই জানাইনি।আম স্যরি এরপর থেকে জানিয়ে যাবো!”
“হুম টেক কেয়ার”
বলেই সায়ান উঠে দাঁড়ালো তারপর বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে, চন্দ্রিকা কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দিলো না সায়ান। চন্দ্রিকা হতাশ হয়ে বসে রইলো সেখানে, ও বুঝতে পারেনি শাহেদ মানে ওর ছেলে হুট করে ওর কপালে কিস করবে তাও এখানে!আর সায়ান তা দেখেও ফেলেছে, কি ভাবছে সায়ান?
___________________________
সামু আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে, ছোট থেকেই ওর বড় চুল রাখার শখ ছিলো তাই লম্বা চুলগুলো হাটু অবদি ঠেকেছে!কোন একদিন ইনানকে বলতে শুনেছিলো যে ওর লম্বা চুল ওয়ালা মেয়েদের দেখতে ভালো লাগে, ব্যাস এরপর থেকে আর কখনো চুলে কাঁচি চালায় নি। খুব যত্নসহকারে বড় করেছে এগুলোকে। ভাবতেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো, সেই মানুষটি এখন আর ওর জীবনে নেই তাই তার সাথে জড়িত সকল কিছু ও নিজের থেকে আলাদা করে ফেলবে!
আজ তিনদিন হলো ইনানের সাথে ওর দেখা হয়েছে, সেদিন ও অনেক জায়াগায় ঘুরেছে। রোলার কোস্টারে উঠেছে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেয়েছে,রমনার বড় গাছটায় নিজের আর ইনানের নাম লিখে এসেছে আর কতোকি!সেই এখন অতীত, বর্তমানে এর কোনকিছুই অবশিষ্ট নেই। ও ওর জীবনের বেশিরভাগ সময় ইনানকে নিয়ে ভেবেছে, কিন্তু আর ভাববে না। জীবনটাকে নিজের মতো করে সাজাবে আর কারো জন্য অপেক্ষা করবে না আর কারো জন্য কাঁদবে!মানুষ ভালোবেসে মরে যায়না,তাই ও মরবে না। হয়তো একটু কষ্ট হবে কিন্তু ঠিক নিজেকে সামলে নিতে পারবে ও। এখন থেকে একটু একটু করে নিজেকে ভালোবাসা শিখবে, নিজের আর তাদের জন্য বাঁঁচবে যারা ওকে ভালোবাসে। ও ওই সবকিছু করবে যা ওর ভালোলাগে, অন্যের ভালোলাগায় নিজের জীবন সাজাবে না!
কথাগুলো ভাবতেই সামুর চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো ধীর পায়ে ড্রয়ার থেকে কাঁচি বের করলো তারপর চুলগুলো ধরে কোমর অবদি কেটে ফেললো, অন্যের ইচ্ছায় থাকা কোন জিনিস ও নিজের কাছে রাখবে সেটা যতো শখেরি হোক না কেনো?চুলগুলো গুছিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে একটা লম্বা শাওয়ার নিলো তারপর ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিচে নেমে এলো। কয়েক সিঁড়ি বাকি থাকতেই সোফায় নজর গেলো, ইনানের আম্মু আন্টি বসে আছে। সামু ছোট থেকেই মিসেস চৌধুরীর সাথে খুব ফ্রি তাই তার পাশে গিয়ে তার সাথে গল্প করা শুরু করলো। ওর মনটা এখন বড্ড হাল্কা লাগছে, মনে হচ্ছে অনেকদিন পর প্রান খুলে হাসছে। এতো সব জঞ্জালের মাঝে নিজেকে খুজে পেয়েছে, হ্যা ও নিজেকে খুজে পেয়েছে!ও বিড়বিড় করে বললো
“আই নিডেড টু লুজ ইউ টু ফাইন্ড মি”
সামু মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখে ইনান খাবারের ডিশ হাতে রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছে আর মিসেস খান বারবার তার হাতে দিতে বলছে। এই দৃশ্য আগে প্রায়ই দেখা যেতো ওদের বাসায় কিন্তু হঠাৎ করেই ইনানের আনাগোনা কমে যায় খান বাড়িতে। ঠিক হঠাৎ করে নয়, সামু নিজের মনের কথা বলার পর। সামু সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, আর পেছমে ফিরে তাকাবে না ও। হুট করে উঠে ঘরে চলে এলো, দরজা চাপাতে যেতেই বাঁধা পেলো। তাকিয়ে দেখে ইনান দাঁড়িয়ে আছে, ও চেষ্টা করেও দরজা লাগাতে গিয়েও যখন লাগাতে পারলো না তখন হাল ছেড়ে দিলো আর সরে দাঁড়ালো। ইনান কি চায়? কেনো এসেছে এখানে? কোন কিছুই ওর কাছে স্পষ্ট নয় এখনো।
সামু সরে দাঁড়াতেই ইনান ঢুকলো ভেতরে আর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। হুট করেই সামুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো
“তোর চুলের এই অবস্থা কেনো? এতো বড় বড় চুল এইটুকু করে ফেলেছিস কেনো তুই?”
সামু তাচ্ছিল্য নিয়ে বললো
“আমার চুলের দিকে আবার তোমার নজর গিয়েছিলো নাকি?নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে আমার, দ্যি গ্রেট ইনান চৌধুরী আমার চুল নোটিস করেছে!”
“আমার উপর রাগ করে নিজের চুল কেটে ফেলেছিস? মায়া হয়নি তোর?”
“নিজেকে এতোটাও ইম্পর্টেন্স দিবেন না প্লিজ। আমি আমার জন্য কেটেছি অন্য কারো জন্য নয়!আমার চুল আমি যা ইচ্ছে করবো তাতে অন্যকারো যায় আসার কথা না”
ইনান সামুকে ছেড়ে দাঁড়ালো, এমন কঠিন কঠিন কথা কেনো যেনো অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে। সামু ইনানের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো
“কেনো এসেছেন এখানে? বলেতো দিয়েছে বিয়ে করতে হবে না আপনাকে”
“আম্মুকে নিয়ে এসেছি যাতে আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করে আজকে। আমি যথাসম্ভব দ্রুত বিয়ে করতে চাই”
“হঠাৎ?”
“আমি বাস্তবতা কে মেনে নিতে চাই”
“রুশি ভাবিকে এখনো ভালোবাসেন তাইনা?”
ইনান সামুর হাত নিজের হাতে নিলো তারপর শান্ত স্বরে বললো
“আমি জানি রুশির প্রতি আমার ফিলিংস ছিলো, এখনো আছে।অনেক বছরের সম্পর্ক এক দিনে ভুলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় এটা যেমন সত্যি, তেমন এটাও সত্যি যে ও এখন অন্যকারো বউ আর তারউপর আমার কোন অধিকার নেই। আমি চাই সে ভালো থাকুক। আমি ওকে ভুলতে চাই!”
“ওহ তারমানে তাকে ভুলার জন্য আমাকে সাবস্টিটিউট হিসেবে নিতে চান!আর তাই যথাসম্ভব আমাকে বিয়ে করতে চান”
“আমি সেটা বলিনি”
“তাহলে আমাকে ভালোবাসেন?”
ইনান চুপ করে আছে,সামুর প্রতি ওর মায়া কাজ করলেও ওকে ভালোবাসে না, এটা ও জানে! সামু সেদিকে তাকিয়ে হাসলো তারপর বলল
“যেদিন আমাকে ভালোবাসতে পারবেন সেদিন আমাকে বিয়ের কথা বলতেন আসবেন। আমার কি মনে হয় জানেন আপনি আমাকে ডিজার্ভ করেন না, আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি। অনেক কষ্ট করে আপনাকে ভুলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন। আমি কারো রিপ্লেসমেন্ট হতে পারবো না স্যরি। আপনি আসতে পারেন!”
ইনান কিছু বললো না, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে পড়লো। সামু তার জায়াগায় হয়তো সঠিক, এই কয়দিন ও অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ও আর রুশিকে নিয়ে ভাববে না, ওকে যথাসাধ্য ভুলার চেষ্টা করবে কারণ সে এখন অন্যের স্ত্রী আর সেই মানুষটি ওর বেস্টফ্রেন্ড! ও তাকে ঠকাতে পারবে না তবে সায়ানের সাথে কথা বলে বুঝাবে যে ওর রুশিকে মেনে নেয়া উচিৎ। কিন্তু সামু ভুল ভাবছে ও সামুকে কারো পরিবর্তে বিয়ে করতে চায়নি বরং ওর সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছে। কথায় আছে না
“আমাদের তার সাথেই থাকা উচিৎ যে আমাদের ভালোবাসে, তার সাথে নয় যাকে আমরা ভালোবাসি!”
যেখানে একটু একটু করে ওকে ভালোবাসার চেষ্টা করবে ও!ওর পুরো দুনিয়া জুড়ে সামু থাকবে। ও জানে সামু রাগ করেছে তাই বলে ও হার মেনে নিবে না বরং সামুর করা অভিমান ভাঙিয়ে ছাড়বে। এতোদিন সামু ওর জন্য অপেক্ষা করেছে এখন ওর অপেক্ষা করার পালা!
ইনান চলে যেতেই সামু ফিরে তাকালো,আবারও চলে গেছে সে! একটু তো থাকতে পারতো! নিশ্চই এখন গিয়েই সব কেন্সেল করে চলে যাবে। সেই যে যেতে চায় তাকে যেতে দেয়া উচিৎ,বেঁধে রেখে কি লাভ। দিনশেষে সে তোমার কখনোই নয়, তার চেয়ে নিজেকে ভালোবাসা উচিৎ। কেউ না থাকলেও তোমার সত্ত্বা তোমার সাথে থাকবে!
ও আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে গাইতে শুরু করলো
We’d always go into it blindly
I needed to lose you to find me
This dancing was killing me softly
I needed to hate you to love me, yeah
To love, love, yeah
To love, love, yeah
To love, yeah
I needed to lose you to love me…
“আমি আর তোমার দ্বারে যাবো না,
তুমি ফিরে আসলেই সই
নয়তো তোমার অপেক্ষায় দিন গুজার
আমার আর হবে না”