#ঘুনপোকা
১.
টেবিলের উপর থাকা ফাইলগুলো সাইন করে সামনে এগিয়ে দিলো সৈকত৷ ফাইল হাতে নিয়ে ইমরান জিজ্ঞেস করলো,
– বাসায় যাবেন না ভাইয়া? আসুন একসাথে বের হই।
– নাহ্, তুমি যাও৷ আমি আরো পরে যাবো।
– সাড়ে নয়টা বাজে৷ কাজ তো নেই হাতে। শুধু শুধু বসে থেকে কি করবেন?
– বাসায় গিয়েও তো তেমন কাজটাজ নেই৷ থাকি কিছুক্ষন….
– ভাবী রাগ করবে না?
মুচকি হাসলো সৈকত৷ ইমরানের প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বললো না সে। সৈকতের হাসিটা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে ইমরান। মানুষটার স্ত্রীর প্রসঙ্গ তুললেই লোকটা তেমন কিছু বলতে চায় না কেনো বুঝে পায় না সে। কখনো ইচ্ছে হলে একটু আধটু উত্তর দেয় আর নয়তো এভাবে মুচকি হাসি হেসে কথার প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। হাসির মাঝে একরাশ বিষন্নতা লুকিয়ে থাকে। এত বিষন্ন কেন এই হাসিটা? এই অফিসে জয়েন করেছে ছয়মাস হলো। শুরু থেকেই সৈকতের সাথে তার বেশ সখ্যতা। আজ পর্যন্ত একবারও লোকটাকে স্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলতে শোনা যায়নি। স্ত্রীর সাথে কি লোকটার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে নাকি স্ত্রী মারা গেছে? মাঝে মধ্যে খুব কৌতুহল জাগে ইমরানের। ইচ্ছে হয় একটু জোর খাটিয়ে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে। অজানা কারণবশত কথাগুলো আর জিজ্ঞেস করা হয় না৷ ইমরানের পকেটে ভাইব্রেট হতে থাকা মোবাইলটা সৈকত সম্পর্কিত ভাবনায় ছেঁদ ঘটালো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ক্রিনে তাকাতেই বিরক্ততে চেহারা কুঁচকে এলো তার। ইমরানের কুঁচকে যাওয়া চেহারার ভাঁজগুলো দেখছে সৈকত। মানুষটা খুব বেশিই বিরক্ত হচ্ছে৷ ইমরান কলটা কেটে তাকে কি যেনো বলতে যাচ্ছিলো ঠিক সে মুহূর্তে আবারও কল এলো৷ চেহারায় নতুন করে আরো কয়েকটা ভাঁজ যুক্ত হলো৷ কলটা আবারও কেঁটে সুইচ অফ করে দিলো ইমরান। চেহারা স্বাভাবিক করে সৈকতকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি একা বসে থাকবেন অফিসে?
– হুম। প্রায়ই তো থাকি।
– ওহ্। তাহলে আমি চলে যাই?
– একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?
– জ্বি, অবশ্যই।
– যার কল পেয়ে চেহারা কুঁচকে গিয়েছে সে তোমার গার্লফ্রেন্ড না?
– হুম।
– দুদিন যাবৎ ঝগড়া চলছে তাই না?
বেশ চমকে যাওয়ার ভঙ্গিতে ইমরান জানতে চাইলো,
– আপনি কিভাবে জানেন?
– তুমি দিনের বেশিরভাগ সময় আমার সাথেই কাটাও। আমার সামনেই কল রিসিভ করে মাঝে মধ্যে কথাও বলো। কথার ধরন শুনলেই বুঝি কার সাথে কথা বলছো আর কি নিয়ে কথা বলছো।
মাথা নিচু করে বসে আছে ইমরান। কিছু মুহূর্ত চুপ থাকার পর সে বললো,
– আসলে ভাইয়া ওর আচরণ খুব অদ্ভুত। রিলেশনের শুরুর দিকে বুঝিনি। মাস দুয়েক যাওয়ার পর থেকে ও ধীরে ধীরে আমার সাথে ফ্রি হতে শুরু করলো। তখন থেকে একটু আধটু খেয়াল করতাম। মাস ছয়েক যাওয়ার পর ও যখন পুরোপুরি আমার সাথে মনখুলে মিশতে শুরু করলো তখন বুঝলাম এই মেয়ে আমার জন্য না৷ সম্পর্কটা বোঝা মনে হতে লাগলো। ওকে জানালাম ব্রেকআপ করবো৷ ও করবে না৷ যতবার ব্রেকআপ করতে চেয়েছি ততবারই কান্নাকাটি করে নাজেহাল কান্ড করে৷ আমার বাসার সামনে চলে আসে, অফিসের সামনে চলে আসে৷ আমার বন্ধুদের কল করে বিরক্ত করতে থাকে৷ বাধ্য হয়ে এই বোঝা আমি একটাবছর ধরে টেনে যাচ্ছি। আজ পর্যন্ত কত রুড বিহেভ করলাম ওর সাথে অথচ কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না৷ আমি টায়ার্ড। আমি ওর কাছ থেকে মুক্তি চাই।
– সমস্যা হচ্ছে কি নিয়ে?
– আমার সবকিছুতেই খবরদারি করতে চায়।
– যেমন?
– খেয়েছি কিনা? কখন খেয়েছি? কেন দেরী করে খেলাম? শুধু মাংস দিয়েই কেন ভাত খাই? সব্জি, ছোটমাছ কেন খাই না? সিরিয়াসলি ভাইয়া? সবজি, ছোটমাছ এগুলো কি কথা বলার কোনো টপিক? আরো আছে। রাতে দেরী করে কেন ঘুমাচ্ছি? আমি একটু কাঁশি দিলেও সমস্যা। এটা নিয়েও শুরু হয় ঘ্যানঘ্যান। কেন আমি ডক্টর দেখাচ্ছি না। আধাঘন্টা পরপর কল করতে থাকে কি করছি সেই খবর নেয়ার জন্য। খুবজোর এক মিনিট কথা বলে কলটা কেটে দেয়। বারবার ফোন করে এই এক খবর নেয়ার মানে কি?
– ও তোমার যত্ন নেয়। তোমার খুশি হওয়া উচিত। তুমি এটাকে খবরদারী বলছো কেন?
– প্রয়োজনের চেয়ে বেশি যত্ন করা হলে সেটাতে আর ভালোলাগার ব্যাপার থাকেনা। তখন মাথাব্যথা শুরু হয়৷ এছাড়াও আরো কিছু সমস্যা আছে।
– কি সমস্যা?
– একটু ছ্যাচড়া স্বভাবের।
– এভাবে বলছো কেন?
– মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট তো থাকা উচিত তাই না? ওর এসব নেই। যে যা খুশি বলে চলে যায় কখনোই পাত্তা দেয় না। ও প্রচুর কথা বলে। একবার বলতে শুরু করলে আর থামে না৷ ওকে নিয়ে বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে এক বন্ধুর বউয়ের সাথে বকবক করেই যাচ্ছে। শেষমেশ ও আর সহ্য না করতে পেরে বলেই ফেলেছে, তুমি এত কথা কিভাবে বলো!
লজ্জায় আমি শেষ হয়ে গিয়েছিলাম৷ অথচ আমার প্রেমিকা দাঁতগুলো বের করে নির্লজ্জের মত হেসে বলছিলো আমি এমনই। এই বলে আবারও কথা জুড়ে দিলো। আমি বন্ধুর ওয়াইফের মুখটা বারবার দেখছিলাম। ও খুব বিরক্তভরা চেহারা নিয়ে চুপচাপ শুনে গিয়েছে আমার প্রেমিকার কথাগুলো। আমি ওকে কয়েকবার ডেকেছিও। ও সেখান থেকে উঠে আসবে না।
– কি কথা বলছিলো ও?
– এইতো আমাদের বিয়ে নিয়ে৷ বিয়েতে কি করবো না করবো সেসব। তারপর ওর ছোটবেলায় স্মৃতি নিয়ে বললো। ও যাকে পায় তার সাথে এই দুটো বিষয় নিয়ে গল্প করতেই থাকে।
– হয়তো ওর প্রিয় বিষয় এই দুটো। তাই বলতেই থাকে।
– হুম। খুব প্রিয়।
– কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জানতে চায় না তো তাই না?
– উহুম। সে অভ্যাস নেই।
– সবাই সমান হয় না ইমরান। একেকজনের অভ্যাস একেকরকম। তুমি আমি আমরা সবাই যদি একই স্বভাবের হতাম তাহলে হয়তো এই পৃথিবীটা আরো আগেই ধ্বংস হয়ে যেত আর নয়তো অসম্ভব সুন্দর হতো।
– হ্যাঁ, সমান হয় না। কিন্তু এতটাও বেমানান তো মেনে নেয়া যায় না।
– আজ যদি বাসায় না যাও তাহলে কি সমস্যা হবে?
– নাহ্। কিন্তু বাসায় যাবো না কেন?
– আমার সাথে অফিসে বসে থাকো।
– কোনো প্রয়োজন ভাইয়া?
– হ্যাঁ প্রয়োজন। তোমাকে আজকে গল্প শোনাবো।
– কিসের গল্প?
– আমার রুপুর গল্প।
– রুপু কে?
– যাকে নিয়ে তোমার খুব কৌতুহল।
– আপনার ওয়াইফ?
– হ্যাঁ, আমার ওয়াইফ।
– আমার খুব কৌতুহল সেটা আপনাকে কে বলল?
– বলতে হবে কেনো? আমিই বুঝি।
আগে বলো ডিনারে কি খাবে? খাবার অর্ডার করে দেই। তারপর বলছি।
(চলবে)
#মিম