#চন্দ্রাণী(২০)
চন্দ্রকে বাড়ির সামনে পর্যন্ত দিয়ে এসে টগর দ্রুত পায়ে হেঁটে এলো নিয়াজের সন্ধানে। এসে দেখে নিয়াজ নেই।টগর অবাক হলো। নিয়াজ এখান থেকে কোথায় গেলো কিছু না বলে?
মনঃক্ষুণ্ন হয়ে টগর নিজের বাড়িতে এলো।মাথায় হাজারো চিন্তা খেলা করছে তার।নিয়াজের ভাবনা কিছুতেই মাথা থেকে দূর করতে পারছিল না।
চন্দ্র বাড়িতে গিয়ে আগে ভিডিও রেকর্ড দেখতে বসে গেলো।চন্দ্র নিশ্চিত ছিলো নিয়াজ নিশ্চয় টগরের বাড়িতে যাবে।
কিন্তু হতাশ হয়ে গেলো যখন দেখলো কোনো ফুটেজেই নিয়াজের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে না।
চন্দ্র আশাহত হয়ে বসে পড়লো।
মন কিছুটা খারাপ হলেও আবার মনে মনে ভালো ও লাগছে এই ভেবে যে টগর হয়তো অতটাও খারাপ না যতটা সে ভাবছে।
পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনায় নিজে লজ্জা পাচ্ছে চন্দ্র।টগর ভালো হোক বা খারাপ তাতে তার কি আসে যায়!
সে কেনো কিশোরী মেয়েদের মতো এসব নিয়ে ভাবছে?
নিজের এই বালখিল্যতায় নিজেই লজ্জা পেলো চন্দ্র।
ল্যাপটপ নামিয়ে রেখে ছাদে চলে গেলো।মাগরিবের আজান দিবে এখন।এলো চুলে চন্দ্র ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।সিতারা বানু উঠানে মোড়া পেতে বসে পান ধুচ্ছেন।ছাদে নাতনিকে দেখে ডেকে বললেন,”লম্বা লম্বা চুলডি ছাইড়া ছাদে গিয়া খাড়াই আছস কোন আক্কেলে,আজান দিবো এখন।তাড়াতাড়ি নাইমা আয়।সোমত্ত মাইয়া,জ্বিনে আছর একবার লাগলে বিয়া সাদী হইবো আর?”
শর্মী ঘরের সামনের সিড়িতে বসে থেকে হাসতে হাসতে বললো, “না হোক বিয়ে সাদী,আমার বাপের কি কম আছে না-কি দাদী?বইসা বইসা খাইলেও আমাদের ৭ প্রজন্ম খাইতে পারবো।”
চন্দ্র হাসতে হাসতে বললো, “আমরা দুই বোন বিয়া করমু না দাদী।আজীবন বাপের বাড়িতে থাকমু।”
বলেই দুই বোন হাসতে লাগলো খিলখিল করে। সিতারা বেগম অভিমান করে বললেন,”হ,আমার পোলার অন্নধ্বংস কর দুই বোইন মিইল্লা।এতো কইরা ছেলেরে কইতাছি চন্দ্ররে বিয়া দেওনের লাইগা।বিয়ার বয়স চইলা গেলে পরে আর কেউ পুছব নি?”
শাহজাহান তালুকদার ঘর থেকে বের হতে হতে বললেন,”মা,প্রতিদিন ৫-৬টা বিয়ের প্রস্তাব আমি প্রত্যাখ্যান করে দিই আমার চাঁদের।আমার চাঁদরে তো আর যার-তার হাতে তুলে দেওন যায় না।চাঁদরে নিতে হইলে পোলারে হইতে হইবো আকাশের মতো।
সবাই কি চাঁদের যোগ্য হয় মা?”
সিতারার মুখ ভার হয়ে গেলো। মেয়ে নিয়ে এতো আহ্লাদ তার ভালো লাগে না।আশেপাশের সব মানুষ সিতারা বানুকে জিজ্ঞেস করে চেয়ারম্যানের বড় মেয়ের বিয়া হয় না ক্যান।মানুষ তো বুঝে না চেয়ারম্যান যদি পারতো তার বড় মেয়েরে বুকের ভেতরে লুকাইয়া রাখতো।
সিতারা বানু বুঝতে পারেন না চন্দ্রকে কেনো এতো বেশি ভালোবাসে বাপ মা দু’জনেই। দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকা থেকে যেদিন শাহজাহান বাড়িতে এলো তখন চন্দ্রর বয়স ৪বছর আর শর্মীর ১ বছর। রেহানা আর শাহজাহানের বিয়ের ১২ বছর পরে চন্দ্রর জন্ম হয়।
সিতারা বানুর এখনো স্পষ্ট মনে আছে রেহানার সন্তান না হওয়ার আহাজারি কেমন ছিলো। বারবার কন্সিভ করতো আর আপনাতেই এবোরশন হয়ে যেতো।
এরপর ওরা ঢাকায় চলে যায় ডাক্তার দেখাতে। তারপর?
ভাবতেই সিতারা বানুর কান্না আসে।চন্দ্র পেটে আসার খবরটা ও শাহজাহান তাকে জানালো না,কাউকে জানালো না।
ছেলের মাথায় ঢুকছে নজর লেগে বউয়ের বাচ্চা হয় না।সিতারা বানু তখন খুব কষ্ট পেয়েছেন। ছেলে তাকেও জানালো না!
তিনি ও কি বাহিরের মানুষ যে তাকে বলা যাবে না!
কতো বড় পাষণ্ড হলে নিজের মায়ের কাছে লুকিয়ে যায় এরকম একটা সুখবর। ছেলে কি জানে না তার মা ও তো আল্লাহর কাছে কতো দোয়া করতেন ছেলের ঘরে যাতে সন্তান দেয় আল্লাহ।
চন্দ্রর ৩-৪ মাসের সময় ছেলের মুখ থেকে জানতে পারেন তার নাতনি হয়েছে।
নাতনিকে একটু দেখতে কেমন হাপিত্যেশ করেছেন অথচ ছেলে নাতনিকে নিয়ে বাড়ি আসে নি লোকে নজর দিবে বলে।
অবশ্য ছেলের ভাবনাকেও দোষ দিতে পারেন না।ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে তো ভয় পাইবোই।
আবার শর্মী হলো অথচ শর্মীর জন্মের পর জানতে পারলেন তার আরেক নাতনি হইছে।পেটে থাকতে জানতে পারেন নাই।
দুই মেয়েকে নিয়ে কি যে চিন্তা ছেলের।মাঝেমাঝে সিতারা বানু ভীষণ রাগ হতেন।বাড়ি আসার পর কাজের লোক দুইজন রাখলেন মেয়েদের দেখার জন্য।
লোকের কতো নিন্দেমন্দ তখন।মানুষ বলতো দুনিয়ায় আর কারো যেনো বাচ্চা হয় নাই। সিতারা বানু কতো দিন ছেল্রর সাথে এসব নিয়ে ঝগড়া করেছেন। আসলে তার ও হিংসে হতো।তাদের সময় একা হাতে ৫-৬টা বাচ্চা সামলে সংসারের কাজ ও করতে হতো নিজেকেই।কাজের মেয়ের কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না।আর এখনকার বউয়েরা এতো সুবিধা ভোগ করে মানতে পারেন না তিনি তাই।
সিতারা বানুর এসব ভাবনার মধ্যে চন্দ্র এসে বললো, “তোমার অযুর পানি দাদী।অযু করে নাও।”
সিতারা বানু অযু করে ঘরে গেলেন।
রাতে বিছানায় শুয়ে টগর নিয়াজের কথা ভাবছে।কয়েকবার কল দিয়েছে নিয়াজকে,কিন্তু ফোন অফ।চিন্তা হচ্ছে টগরের ভীষণ। পুলিশ ধরে ফেলে নি তো আবার!
ভাবতে ভাবতে চোখে তন্দ্রামতো এলো তখনই ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখলো।
স্বপ্নে দেখলো একটা ফুটফুটে পরীর মতো মেয়ে বাবুকে সে ঘাড়ে বসিয়ে উঠোনে ছুটোছুটি করছে আর পেছন পেছন চন্দ্র একটা শাড়ি পরে ছুটছে। চন্দ্রর হাতে একটা বাটিতে খাবার। চেঁচিয়ে চন্দ্র বলছে বাবুকে দাও ওর খাওয়া হয় নি এখনো।
বাবু খিলখিল করে হাসছে।
হঠাৎ করেই টগরের তন্দ্রা কেটে গেলো। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে হাঁপাতে লাগলো টগর।
কি ছিলো এটা!
এসব কি দেখছে সে!
পরমুহূর্তে মনে হলো এসব অবচেতন মনের কল্পনা। বিকেলে চন্দ্রর বলা কথাটা অবচেতন মন ভুলতে পারে নি।নিজের অজান্তেই মনের একটা অংশ হয়তো এসব নিয়ে ভাবছে এজন্যই এই স্বপ্ন।
নিজের স্বপ্নের কথা ভেবে নিজেই হাসলো।তারপর উঠে গুনগুন করে গাইতে লাগলো, “বামুন কি আর হাত বাড়ালে চাঁদের দেখা পায়?”
বাকি রাত আর টগর ঘুমাতে পারলো না। হিউম্যান সাইকোলজির একটা বই নিয়ে বসে বসে রাতটা কাটালো।
শর্মী আর চন্দ্র শুয়ে শুয়ে গল্প করছে।সেই মুহূর্তে শর্মীর ফোন বেজে উঠলো। একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। শর্মী রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নিয়াজ খিকখিক করে হেসে বললো, “কেমন আছো শর্মী ডার্লিং? কি মনে করছো আমাকে পুলিশ খুঁজতেছে এই সুযোগে তুমি নিশ্চিন্ত হইবা?তোমার বাপ শান্তিতে ইলেকশন করবো?
তোমার আমার সব ছবি,ভিডিও আমি তোমার বাপেরে পাঠামু ভাবতেছি।তোমার বাপের খুব অহংকার না, সব গুড়িয়ে দিমু আমি।’
শর্মী শান্ত স্বরে বললো, ” তুমি কি চাও?”
নিয়াজ হেসে বললো, “চাই তো অনেক কিছু।তোমার তুল**তুলে দে**হ,তোমার বাপের চেয়ারটা এই দুইটা হলেই আপাতত চলে। আমি ১০০%শিওর আমার নামে পুলিশের কাছে তোমার বাপ অনেক কিছু বলছে।এজন্যই পুলিশ আমাকে খুঁজতেছে।”
শর্মী ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভয় পেলো।নিয়াজের কথা তার মাথায় ছিলো না। ভেবেছিলো পুলিশ ধরে শয়*তানকে শায়েস্তা করবে অথচ এখন দেখছে ও বেশ আরামে আছে।
নিয়াজ আবারও বললো, “রাখছি ডার্লিং, তোমার বাপকে ছবি পাঠাই নিই।”
শর্মী কিছু বলার আগেই কল কেটে গেলো। শর্মী আতঙ্কিত হয়ে চন্দ্রকে সব খুলে বললো। সব শুনে চন্দ্র ও অবাক।আব্বা যদি এসব ঘুণাক্ষরেও টের পায় কতো কষ্ট পাবে সেটা ভেবেই চন্দ্র আৎকে উঠলো।
ফোনে মেমোরি কার্ডটা লাগিয়ে নিয়াজ শিস দিতে লাগলো। নৌকার মাঝি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, “ভাইজান কি ম্যালা খুশি?”
নিয়াজ বললো, “দূর ব্যাটা।খুশির দেখলি কি!আসল খুশি হমু আমার বাপ চেয়ারম্যান হইলে।তার জন্য যা করা দরকার তা করতেছি।”
নদীর বুকে খোলা নৌকায় বসে আছে নিয়াজ।টগরের ডেরা তার খুব একটা পছন্দ হয় নি।ভাগ্যিস তার বস তাকে এই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো বলে।
মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপছে নিয়াজ,সেই মুহূর্তে একটা গুলি সাঁই করে এসে নিয়াজের হৃৎপিন্ড ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেলো।
ঝপাৎ করে দেহখানা নদীতে গড়িয়ে পড়লো।
চন্দ্র ছুটে গেলো বাবার রুমে।গিয়ে দরজা নক করতেই শাহজাহান তালুকদার উঠে এলেন।চন্দ্র আমতাআমতা করে বললো, “আব্বা আপনার ফোনটা একটু দিবেন,আমার একটু কাজ ছিলো। ”
আব্বার ফোন হাতে নিয়ে চন্দ্র আর দাঁড়ালো না।ছুটে এলো বোনের রুমে। দুই বোন মিলে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন নিয়াজের পাঠানো ছবি আসবে।
অথচ তারা জানে না নিয়াজ আর সেই অবস্থায় নেই।আর কখনো ছবি আসবে না।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান