চন্দ্রাণী (২৩)

0
273

#চন্দ্রাণী (২৩)
আকাশে মেঘের আনাগোনা বেশ ভালো দেখা যাচ্ছে। মেঘের গা ঘেঁষে এক ফালি রোদ এসে নিয়াজের মুখের উপর পড়লো।
গভীর মনোযোগ দিয়ে নির্ঝর নিয়াজের ডেডবডি পর্যবেক্ষণ করছে। নিয়াজের পরনে একটা আকাশীরং টি-শার্ট আর ধূসর রঙের জিন্স প্যান্ট।
গু/লি বুক ফুঁড়ে বের হয়ে গেছে। হয়তো পানিতে পড়েছে বুকটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে।
গু/লিটা পেলে জানা যেতো কোন পি///স্তল থেকে শ্যু/ট করা হয়েছে।

ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি লেগে আছে নিয়াজের। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ও বেশ উৎফুল্ল ছিলো নিশ্চয়। নির্ঝরের আফসোস হলো নিয়াজের জন্য ভীষণ। সে যেই মানুষটাকে দারুণভাবে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আস্তাকুঁড়ে, কারো কাছে সেই মানুষ পরম আরাধ্য। যস্র একটু ছোঁয়া পেতে কেউ কেউ আজীবন তপস্যা করতে ও রাজি।
প্রেম,ভালোবাসা ব্যাপারটা এমন কেনো!
কেউ পায় না আবার কেউ হেলায় হারায়।কেনো ভুল মানুষের সাথেই ভালোবাসা হয়?

নিয়াজের পকেট সার্চ করে কিছু পাওয়া গেলো না।নিয়াজের ওয়ালেট ও না।
নির্ঝরের সন্দেহ হতে লাগলো। এটলিস্ট ওয়ালেট তো সাথে থাকার কথা। একটা বাড়তি সুতাও নেই সাথে। ফোন ও না।

নিয়াজকে পুলিশ খুঁজছিলো সেদিন রাতের নিউজটা দেখার পর থেকে।সেই নিয়াজ এখানে খুন হলো কেনো?
তবে কি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বের হয়ে আসবে বলে নিয়াজকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে কেউ?
নিয়াজকে পেলে নিশ্চয় অনেক তথ্য বের হয়ে আসতো।

নিয়াজের ডে/ড বডি ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। নির্ঝর লাশ পাঠিয়ে দিয়ে নিয়াজদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।

টগর চা নিয়ে এসেছে। বাবুল দাশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টগরকে পর্যবেক্ষণ করছে। এতো দিন এই ছেলেটাকে সবসময় মাতাল বলে মনে হয়েছে অথচ আজকে তাকে অন্য রকম লাগছে কেনো?
এর চোখের ভাষা যেনো অন্য রকম। কেমন করে তাকিয়ে আছে চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে।
চন্দ্র পুরো বাড়ি ঘুরছে।বিশেষ করে নিয়াজের স্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাইছে।
ভেতরের দিকে অনেক মানুষ দেখতে পেলো।নিয়াজের খু/নের কথা শুনে হয়তো আত্মীয়রা আসছে।এর মধ্যে একজন মহিলাকে দেখলো আলুথালু বেশে ফ্লোরে বসে আছে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে। কেউ একজন তার মাথায় তেল পানি দিচ্ছে।
দেখেই বুঝতে পারছে চন্দ্র মহিলা নিয়াজের মা হবে।চন্দ্রর খানিকটা আফসোস ও হলো। কেনো এরকম ভুল পথে যায় মানুষ?
যেখানে তার জন্য বাবা মা পরিবার সবাইকে কষ্ট পেতে হয়।
এদিক ওদিক দেখে একজন বয়ষ্ক মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো চন্দ্র,”নিয়াজের স্ত্রী কোথায়?”

মহিলা বললো, “আপনি কে?ক্যান আপনি জানেন না ওর বউ তো আইজ এক বছর ধইরা বাপের বাড়িতে থাকে। আর আইবো না না-কি। এখন তো আর আসবোই না এই জীবনের জন্য। ”

চন্দ্র চলে গেলো। তার আর দেখার কিছু নেই।চন্দ্র ভেতরের দিকে যেতে নিতেই টগর এলো। এসে চন্দ্রর সাথে গল্প জুড়ে দিলো।চন্দ্রর বুকের কাঁপুনি থামছে না।টগর আড়চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে। খানিক পরে দেখতে পেলো বাবুল দাশ দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে আছে। টগরের ভীষণ হাসি পেলো।চন্দ্রকে বুঝতে দিলো না বাবুল দাশ এসে পাহারা দিচ্ছে যে।
চন্দ্রর কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো আব্বা আছেন এখানে।আব্বা যদি দেখেন তাহলে খারাপ ভাবে নিবে ব্যাপারটা।
চন্দ্র টগরের সাথে কথা শেষ করে ভেতরে গেলো।

এরইমধ্যে নির্ঝর এলো নিয়াজদের বাড়িতে।এসে দেখে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী একই সাথে বসে আছে। দুজনের সামনে চায়ের কাপ রাখা আছে।
মরা বাড়িতে নাকি চুলা জ্বালায় না।এরা চা খাচ্ছে?
নির্ঝরের মাথায় এই প্রশ্নটা এলো কেনো সেটা ও সে বুঝতে পারছে না। কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে ভেতরে গেলো। হাসিমুখে বললো, “দুজন একসাথে, বাহ!
দেখতে তো ভালোই লাগছে।”

শাহজাহান তালুকদার গম্ভীর হয়ে বললেন,”কিছু জানা গেছে ইন্সপেক্টর? ”

নির্ঝর বললো, “নিয়াজকে গু//লি করা হয়েছে। ডেড বডি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। আমি এসেছি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে। ”

কাদের খাঁন সোজা হয়ে বসে বললো, “বসুন ইন্সপেক্টর। ”

নির্ঝর সোফায় বসতে বসতে চারদিকে তাকালো।বেশ সুন্দর করে সাজানো ঘরটা।এই ঘরটার বিশেষত্ব সম্ভবত এটা যে কেউ আসলেই আগে চারদিকে চোখ বুলায় এর সৌন্দর্য দেখতে।
নির্ঝর ও ব্যতিক্রম না।চারদিকে তাকিয়ে বললো, “নিয়াজ সম্পর্কে যা যা জানেন সবটা আমাকে বলুন,আমাদের ইনভেস্টিগেশনের জন্য সব জানা দরকার আমার। আশা করছি এখন আর কোনো কথা লুকাবেন না,কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন না।”

কাদের খাঁন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমার কখনোই কিছু লুকানোর মতো ছিলো না,এখনো নেই।কি জানার আছে আপনার? ”

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “নিয়াজ কাদের সাথে চলাফেরা করতো? আপনি ও জানেন,গ্রামের সবাই ও তেমন জানে নিয়াজ কি কাজের সাথে জড়িত ছিলো।ওর কাছে কারা কারা আসতো, ও কাদের সাথে কথা বলতো? ”

চন্দ্র আর টগর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ভেতরের দিকে।
কাদের খাঁন এক নজর টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “ও তো বাড়িতে তেমন একটা থাকতো না।বাড়িতে ওর সাথে টগর ছাড়া অন্য কেউ কখনো দেখা করতে আসতো না।সবসময় টগরই আসতো।অন্য দুই একজন দুই একবার এসেছে হয়তো আমার অতটা খেয়াল নেই তাদের। ”

চন্দ্র এক নজর টগরের দিকে তাকালো। মনে মনে বললো, “সব মিথ্যে হোক,টগর সব অপরাধের উর্ধ্বে হোক।এই মানুষটার দিকে তাকালে কেনো আমার এমন লাগে?আমি নিজেও জানি সে ক্রাইমের সাথে জড়িত তবিও কেনো আমার বুকের ভেতরে এমন উথাল-পাতাল ঝড়।কেনো এতো হাহাকার হচ্ছে? ”

টগর আগের মতো নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর টগরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সেই হাসি বলে দিলো তুমি আবারও ফেঁসে গেছো।

টগরের চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি নেই,কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।যেনো তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। কিছুই জানে না সে।

নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “নিয়াজের রুমটা আমি একটু চেক করতে পারি?”

কাদের খাঁন অনুমতি দিয়ে দিলো।নির্ঝর টগরকে বললো, “এবার কে বাঁচাবে তোমাকে?”

টগর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “আপনি যা যা জানতে চান বলুন,আমি আর কিছু লুকাবো না।নিয়াজ,নিয়াজের বস সম্পর্কে যতটুকু জানি সবই বলবো আপনাকে।
চন্দ্র চমকে উঠলো টগরের এই সহজ স্বীকারোক্তি শুনে।নিজের অজান্তেই দুই চোখ টলমল হয়ে গেলো।

চন্দ্রর টলমল চোখের দিকে তাকিয়ে টগর মুচকি হাসলো। মনে মনে বললো, ” তুমি আমার জন্য কেনো কাঁদছো বোকা মেয়ে?ভুল মানুষের সাথে মনের লেনাদেনা করতে নেই জানো না?আমাদের হৃদয়ের লেনাদেনা এই জন্মে হবে না।তুমি ওই দূর আকাশের চাঁদ,আমি বামুন হয়ে কিভাবে হাত বাড়ানোর দুঃসাহস করবো?”

শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়িয়েছে। চন্দ্র কাদের খানের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো।

ফেরার সময় চন্দ্রর কাছে বাবাকে কেমন গম্ভীর মনে হলো। হয়তো নিয়াজের আব্বার সাথে কিছু হয়েছে তাই গম্ভীর হয়ে আছে।চন্দ্র আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। তার নিজের ও ভালো লাগছে না। কেনো সব এলোমেলো লাগছে এরকম!
সে নিজেও তো চেয়েছে টগরের থেকে সবটা জানতে,অথচ কেনো আজ তার এতো অস্থির লাগছে টগরের স্বীকারোক্তি শুনে।
কেনো মন বলছে টগরের কাছে ছুটে যেতে।এই অবাধ্য মনকে ফেরাবে কিভাবে চন্দ্র?

চলতে চলতে চন্দ্রর হঠাৎ করে মনে হলো টগরের সামনে কোনো বিপদ নেই তো!
নিয়াজ তো একটা চুনোপুঁটি ছিলো আসল রাঘব বোয়াল নিজেকে নিরাপদে রাখার জন্য যদি টগরকেও শেষ করে দেয়!

চলবে….
রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here