চন্দ্রাণী (৩৩)

0
304

#চন্দ্রাণী (৩৩)
উপস্থিত জনতা সবাই হতভম্ব। চেয়ারম্যানের বড় মেয়ে বলে সবাই যাকে জানতো আদতে সে কি-না তার দত্তক নেওয়া মেয়ে?
কখনো কারো ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ হয় নি। সবসময় চেয়ারম্যান বড় মেয়েকে সবচেয়ে বেশি আদর দিয়েছেন। এতো আদরের পেছনে তাহলে এই উদ্দেশ্য ছিলো?

কাদের খাঁন ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহজাহান তালুকদারের দিকে। এক সময় এই মানুষটা ছিলো তার প্রিয় বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব তিনি নিজেই নষ্ট করে দিয়েছেন। কানিজের সাথে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কম ঝামেলা হয় নি বন্ধুর সাথে।
ভরসা করতে পারেন নি নিজের বন্ধুকে বোনের জন্য। অথচ সে-ই কি-না বোনের মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে লালন পালন করেছে।

শাহজাহান তালুকদার চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। বিয়ের ১২ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন কোনো সন্তান হচ্ছিলো না রেহানা তখন প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেলো। মানুষের বাচ্চা দেখলেই হামলে পড়তো কোলে নেওয়ার জন্য।
পাশের বাসায় একটা বাচ্চা হওয়ার পর রেহানা আরো উন্মাদ হয়ে গেলো। রাতে বাচ্চার কান্নার শব্দ পেলে রেহানা লাফিয়ে উঠতো।ছুটে গিয়ে বের হয়ে ওদের দরজা ধাক্কাতো,লাথি দিতে শুরু করতো। একদিন তো ওদের খোলা দরজা পেয়ে ছুটে গিয়ে বাচ্চাটা নিয়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে রইলো।
বাচ্চার মা রান্নাঘর থেকে এসে দেখে বাচ্চা নেই।পুরো বিল্ডিংয়ে হইচই বেঁধে গেলো।তিনতলা থেকে বাচ্চা চুরি হয়েছে রটে গেলো পুরো বিল্ডিং এ।
শাহজাহান তালুকদার খবর পেয়ে ছুটে এলেন। বাসায় এসে দেখেন ঘরের দরজা খোলা। রেহেনাকে ডাকতে লাগলেন।রেহানা কোনো সাড়া দিচ্ছে না।শাহজাহান তালুকদারের মাথায় নানা চিন্তা এলো।চিৎকার করতে লাগলেন তিনি। একে বাচ্চা হারিয়েছে তার উপর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বিল্ডিংয়ের লোক সব জড়ো হলো তাদের বাসায়।কয়েকজন মিলে লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে দেখে রেহানা ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে কোলে জড়িয়ে দেয়ালের সাথে লেপটে আছে চুপ করে।
বাচ্চার মা বাচ্চাকে দেখে ছুটে এসে কেড়ে নিয়ে গেলো।রেহানাকে লোকের গালাগালি, বকাঝকা তো আছে।

বিল্ডিংয়ের মালিক রাতে এসে বলে গেলো যাতে এই মাস শেষে তারা বাসা ছেড়ে দেয়।
শাহজাহান তালুকদার স্ত্রীর এই মানসিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন একটা বাচ্চা দত্তক নেওয়ার।
কাকতালীয়ভাবে কানিজের মেয়েকেই পেলেন দত্তক হিসেবে।

রেহানা জানতো চন্দ্র কানিজের মেয়ে।শাহজাহান তালুকদার আশ্চর্য হয়েছেন এটা দেখে যে কানিজের মেয়ে জানার পরে রেহানার চন্দ্রর প্রতি ভালোবাসা, আদর আরো বেশি বেড়ে গেছে। এমন ও দিন গেছে শর্মী কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে অথচ রেহানা চন্দ্রকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো।
চন্দ্রকে দত্তক নেওয়ার এক বছর পরেই শর্মীর জন্ম হয়।নিজের পেটের সন্তান হওয়ার পর প্রায় দেখা যায় মানুষ দত্তক নেওয়া সন্তানকে অবহেলা করে কিন্তু রেহানার ব্যাপার উল্টো হয়ে গেলো।
দেখা গেলো সবকিছুতে সে চন্দ্রকে বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছে।

আজকে ও শুধু মাত্র চন্দ্র যাতে না জেনে যায় সে দত্তক নেওয়া মেয়ে,তার জন্য বিনা বাক্য ব্যয়ে শাহজাহান তালুকদার পুলিশের কথায় তাদের গাড়িতে উঠে এসেছে।
রেহানার দুই চোখে ছিলো পূর্ণ সমর্থন, যাতে শাহজাহান তালুকদার পুলিশের কথা মেনে নেয়।
মেয়ের থেকে লুকাতে এতো কিছু করেছেন,সব দোষ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।তবুও শেষ রক্ষা হলো না।

কিভাবে মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন এবার তিনি?
মেয়ে যদি বলে সে তার আসল বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবে কিভাবে সহ্য করবেন তিনি?
শাহজাহান তালুকদারের বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা করতে শুরু করলো ভাবতেই।
চন্দ্র,তার চন্দ্র হারিয়ে যাবে না তো?
রেহানা,রেহানার কি হবে?রেহানার এতো আদরের মেয়ে,কিভাবে সহ্য করবে রেহানা এই আঘাত?

বাবুল দাশ বললো, “হান্নান চৌধুরীর ছিলো ম//দ,মেয়েমানুষের নেশা।চাকরির পাশাপাশি ম///দের ব্যবসায় ও করতো।
আস্তে আস্তে আমি ও সব খবর জেনে যাই তার।তালুকদার সাহেব গ্রামে ফিরে আসার পর কিছুদিন গ্রামের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে যখন বুঝতে পারলাম এই গ্রামের মানুষ ভালো মাল চেখে দেখে নাই কখনো দেশি মাল ছাড়া তখন আমার মাথায় বুদ্ধি এলো।আমি আস্তে আস্তে গ্রামে এই ব্যবসা শুরু করি।আইএ পাশ করেছি আমি।লেখাপড়া জানা ছিলাম,মাথায় বুদ্ধি ও আছে তবে সবচেয়ে ভালো পারি অভিনয়। আমার সহজ সরল বোকাসোকা চেহারা ও আমার জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট ছিলো।
আমি ফোনে ফোনে ব্যবসার কাম করতাম।হান্নান চৌধুরীর থেকে এসব বুদ্ধি জানতে পারছি।যেই সিম,মোবাইল দিয়ে আমি কাজ করতাম ওইটা আমার নামে রেজিষ্ট্রেশন করা না।ঢাকায় গিয়ে কয়েকটা মোবাইল চু//রি করে এনেছি আমি।
মোবাইলগুলো আমি কোনো দিন আমার কাছে রাখি না। অন্য জায়গায় রাখি যাতে কোনো দিন পুলিশ আমার লোকেশন জানতে না পারে। আমার সাথে এই ব্যবসায় নিয়াজ ও জড়ায়।সে জানতো না আমি কে।ফোনে ফোনে কথা হতো যখন তখন বস বস করতো অথচ সামনা-সামনি আমারে বলতো নটির পোলা।

নীলি একদিন আমার কথা শুনে ফেলে,তাই নীলিরে আমার খু//ন করতে হয়।বেশি কিছু না, নিয়াজরে শুধু বলছিলাম এই মেয়েরে দুনিয়া থেকে সরাইতে হইবো।
হারামজাদা, মেয়েটারে খু//ন কইরা তালুকদার বাড়িতে লাশ রেখে গেছে।
চন্দ্র মায়ের জন্য লেবু আনতে গিয়ে নীলির লাশ দেখে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।

যাই হোক, তাতে আবার একটা ভালো দিক ও ছিলো। পুলিশের সন্দেহ কম হইছে আমাদের উপর। কেউ তো আর নিজে খুন করে নিজের বাড়িতে লাশ এভাবে রাখবো না।
তবে টগররে আমার সন্দেহ হইতো অনেক।ওর হিসাবটা আমি মিলাইতে পারতাম না।

ওর হিসাব মিলে গেলো যেদিন ওর বাড়িতে আমি ওর পিস্তল পাই।সেদিন বুঝছি ও একটা ছদ্মবেশী। এজন্য অবশ্য একজনকে বলছিলাম ওরে খু//ন করতে।কিন্তু সে ও পারে নাই।উল্টো নিজেই শেষ হইলো নিয়াজের হাতে।

আমি জীবনে অনেক অপরাধ করছি স্বীকার করি।কিন্তু ভালো কাজ ও করছি।এই যে ধরেন নিয়াজ,নিয়াজের খু//নটা কইরা আমি ভালো কাজ করছি।এই একটা কাজের জন্য আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত না।জানোয়ারের কতো বড় সাহস, আমার কলিজায় হাত দিতে চাইছে।”

কাচারি ঘরের এক কোণে চন্দ্র,শর্মী দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। শর্মী হতভম্ব হয়ে গেলো শুনে। তাহলে কি বাবুল কাকা জানতো নিয়াজের সাথে তার সম্পর্কের কথা।
শর্মীর দুই চোখ টলমল করছে। বাবুল কাকা,যারহাত ধরে হাটতে শিখেছে দুই বোন, যার পিঠে বসে ঘোড়া ঘোড়া খেলেছে সেই মানুষটাকে এতো বড় অপরাধী ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

কাদের খাঁন অপলক তাকিয়ে আছে বাবুল দাশের দিকে। এই লোকটা তার ছেলের হ//ত্যাকারী।অথচ কেমন নির্বিকার হয়ে কথা বলছে।
কাদের খাঁন জিজ্ঞেস করলো, “কেনো খু//ন করলি আমার ছেলেকে?”
বাবুল দাশ বলতে লাগলো, “পৃথিবীতে অনেক রকম শয়তান আছে তবে নিয়াজের মতো জাত শয়তান দ্বিতীয়টা নেই।ঘরে বউ রেখে যে আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ করে তার বাঁচার অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না।
নিয়াজ মিথ্যা বিয়ের নাটক করে সহজ সরল মেয়েটারে ফাঁসায়।আর এরপর নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য শেষ পর্যন্ত মেয়েটারে ব্ল্যাকমেইল করে।
ওরে আমি পুলিশের হাত থেকে বাঁচাইতে চাইছি।ওরে বাঁচানোর জন্য আমি টগরের আস্তানা থেকে আমি ওরে সরিয়ে নিছি।কিন্তু নিজের মৃত্যু ও নিজেই ডেকে এনেছে। ও জানতো না ওর উপর আমি ২৪ ঘন্টা নজর রাখতেছি।ওর নৌকার মাঝি যে সে ও আমারই লোক ছিলো। অন্ধকারে আরেকটা নৌকা ওর উপর নজর রাখতো।

মেয়েটার বাবার কাছে কয়েকটা ছবি পাঠাইতে চাইছিলো হারামজাদা।
কতো নোংরা মনের মানুষ হইলে এই কাজ করতে চায় সে বুঝতে পারেন আপনারা ?
ওর স্বভাবের জন্য ওরে আমি শেষ করছি।আমি জানতাম ওই ছবিগুলো দেখলে মেয়েটা কাউরে মুখ দেখাতে পারতো না।

আর এর পরে টগরের উপর হামলা ও আমি করছি।কিছু করার ছিলো না আমার, টগর দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাই ফেলছে।আমি বাধ্য হইছি ওর উপর হামলা করতে।চাইলে সেদিন প্রথম বারেই আমি টগরের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারতাম কিন্তু আমি পিছু হাঁটছি আমার কলিজার টুকরোরে দেখে ওর সাথে। আমার নিশানা যদি কোনো ভাবে ব্যর্থ হয়ে কোনো দুর্ঘটনা হতো, এজন্য আমি রিস্ক নিতে পারি নি।”

কাদের খাঁন জিজ্ঞেস করলো, “কে ছিলো সাথে তখন?”

বাবুল দাশ মুচকি হাসলো। হেসে বললো, “কলিজা তো কলিজা ই হয়,নাম দিয়ে কি করবেন তার?”

শাহজাহান তালুকদার হতবাক। কেউ না জানলেও তিনি জানেন ওখানে তার মেয়েদের কেউ ছিলো। আর নিয়াজ যেই মেয়ের ক্ষতি করেছে সে ও তার মেয়ে।
শাহজাহান তালুকদারের দুই চোখ টলমল করছে।

বাবুল দাশ উঠে শাহজাহান তালুকদারের পায়ের সামনে গিয়ে বসলো। তারপর পা ধরে বললো, “আমারে ক্ষমা কইরেন স্যার।আমি অনেক অপরাধ করছি। টগরের আব্বাকে ও আমি নিজ হাতে শেষ করছি।
কি করমু বলেন,আপনার মনে আছে মৃত্যুর কিছুদিন আগে আপনার সাথে ওনার কথা কাটাকাটি হয়।টগর আর চন্দ্ররে আপনারা বিয়ে দিলেন। নিজেদের বন্ধুত্ব ভালো রাখতে।
এরপর টাকা পয়সা নিয়ে এক দিন ঝামেলা হয়। সেদিন উনি আপনাকে ধমক দিয়েছিলো কাদের খানের কাছে জানিয়ে দিবে চন্দ্রর কথা। চন্দ্রকে জানিয়ে দিবে ওর আসল বাবা মার কথা। আপনার গ্রামে সবাইকে জানাবে।

আমার চন্দ্র মা তখন এসব কথা যদি জানতে পারতো ও এসব সহ্য করতে পারতো না।
আমি তাই ওর উপর যাতে কোনো আঘাত না আসে,শেষ করে দিয়েছি।আমি যা করেছি নিজ থেকে করেছি,আমার চন্দ্র, শর্মীর ভালোর কথা ভেবে করেছি।তাতে অপরাধ হলে অপরাধ আমি পরোয়া করি না।যাদের আমি মা বলে ডেকেছি,তাদের উপর যাতে কোনো আঘাত না আসে আমি তার জন্য সব করতে রাজি।আমার আর কিছু বলার নেই।”

নির্ঝর টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভালোবাসা কতো ভয়ংকর না স্যার?
একটা মানুষ ওদের দুই বোনকে ভালোবেসে তাদের ভালোর কথা ভেবে সকল অন্যায় করে গেছেন, নিজের কথা ও ভাবে নি।
ভালোবাসা এতো বিচিত্র কেনো বলেন তো?”

টগর কিছু বললো না। অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছে সে।ইচ্ছে করছে বাবুল দাশকে এক রাউন্ড গু//লি করে এখানেই পুঁতে দিতে।অথচ পারছে না।আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণে চাইলেও বাবার খু/নীর শাস্তি দিতে পারছে না সে।
টগরের ভালো লাগছে না কিছু এই মুহূর্তে।
বাবার মুখটা আবছা আবছা মনে পড়ছে।কারো অতিরিক্ত স্নেহ কাউকে পিতৃহারা করে দেয় কি অবলীলায়।
বাবুল দাশ কি জানতে পারবে কখনো তার একটা হঠকারিতার মূল্য হিসেবে টগরকে সারাজীবন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে?
টগরের মা’কে জীবনটা কাটাতে হয়েছে ভীত হয়ে।

ভালোবাসা আসলেই বিচিত্র!

রাজিয়া রহমান
চলবে…..
আপনাদের কথা রাখতে গল্পটা আরো বড় করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here