চাদোঁয়া মহল পর্ব -৩১

#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ৩১
#অত্রি_আকাঙ্ক্ষা

-“বাবাকে কথা দিলেও আমি পারিনি এতোটা নিষ্ঠুর হতে!দায়িত্ব নেওয়ায় সাথে সাথে এই গোডাউনকে পরিত্যক্ত করে দিলাম।চাঁদোয়া মহল আর কোম্পানির পেছনে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম।প্রথম প্রথম সবাই যখন আমাকে সুধা বলে ডাকতো আমি চমকে উঠতাম।তাৎক্ষণাৎ প্রতি উত্তর করতে পারলাম না!যতোই নিজের কঠোর স্বভাব ফুটিয়ে তুলতে চাইতাম,ততোই যেন ব্যর্থ হতে লাগলাম।মেনে নিয়েছিলাম সবকিছু।উহু….আসলে বাধ্য ছিলাম আমি। ভালোবাসার মানুষটি যখন আমার আর আমার নকল সত্তার মাঝের পার্থক্য বুঝতে পারে নি!সেখানে তো দুনিয়ায় বাকি সব কিছু তুচ্ছ!বিয়ের ছ’মাসের মাথায় সুধা একদিন অফিসে এলো।আমার কাছে ক্ষমা চাইলো।আমি সাথে সাথে ক্ষমা করে দিলাম।যে সংসার আমার হওয়ায় কথা ছিলো,সে সংসারে সুধার অস্তিত্ব আমাকে পীড়া দিলেও মেনে নিলাম!প্রতিনিয়ত মনে হতো বুকের মাঝে কেউ ছুরি চালাচ্ছে।হৃদয়ে বিষাদ মাখা আলোড়ন সৃষ্টি হতো।বহুবার এসিডে দগ্ধ হওয়া মানুষের ন্যায় তড়পেছি।হাজারবার মনের আত্মহত্যা ঘটিয়েছি।বাবাকে দেওয়া ওয়াদা আমাকে ঘুমাতে দিতো না।শান্তি নামক অনুভূতি আমার জীবন থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছিলো।তিন বছর নিজের সাথে যুদ্ধ করে কাটিয়ে দিলাম।সুধাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম।সুধাও তার আর তাজওয়ারের বৈবাহিক জীবনের ব্যাপারে তেমন কিছু বলতো না।ততোদিনে চাঁদোয়া মহল তৈরি।সবাই একসাথে থাকা শুরু করলাম।ভাইদের আড়ালে সুধা মায়ের সাথে যোগাযোগ করতো।সে সুবাদে তার বন্ধ্যাত্বের কথা জানতে পারলাম।সারোগেসিতে প্রথমে আমার সম্মতি ছিলো না।তাজওয়ারের মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছিলো! যদি আমি তার সামনে দূর্বল হয়ে পড়ি!তাজওয়ার যদি সব বুঝে যায়!বুঝে গেলেও তখন আমার কিছু করার নেই।সবকিছুর উর্ধ্বে সে আমার বোনের স্বামী!চোখের সামনে সুধার সাথে তাকে কি করে মেনে নিতাম আমি?মা পুনরায় ইমোশনাল ব্যাক্লমেইল করা শুরু করলো। মা তো মাই হয়!তার অশ্রুকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিলো না।অবশেষে আমার পেট ভাড়া করা হলো।তোমাকে আমার গর্ভে ধারণ করলাম।আমার ঠিকানা হলো চৌধুরী বাড়িতে!ততোদিনে সুধা নিপুণ কৌশলে আমার সমস্ত ক্রিয়াকলাপ নিজের মাঝে ধারণ করে নিয়েছে।সেখানে কয়েক দিন থেকেই আমি তা বুঝতে পারলাম!প্রথম প্রথম আমি চুল দিয়ে আমার কপালের গর্ত ঢেকে রাখতাম।পরবর্তীতে সুধার কথামতো লেজার করালাম।অপরদিকে সুধা তাজওয়ারের কাছে নিজের মিথ্যা সত্তাকে, সত্য করে তুলে ধরার জন্য কপালের অল্প চামড়া ডাক্তারের সাহায্যে কেটে অপারেশন করে ফেলে।এতো সতর্কতার পরেও তাজওয়ারের মনে সুধাকে নিয়ে সন্দেহ ঢুকে গেল।সুধা আমার কাছে এসে অনুরোধ করলো।যাতে আমি বাচ্চা নষ্ট করে,চাঁদোয়া মহলে ফিরে চলে যাই।আমি রাজি হলাম না।সাত মাসের সময় বাচ্চা নষ্ট করার মানে,আমার মৃত্যু নিশ্চিত।তাজওয়ারের কানে পৌঁছতেই সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো।এ নিয়ে তাদের দুজনের মাঝে কলহ বেঁধে গেল।তাজওয়ার তখনও সুধাকে আমি ভেবেই সংসার করছিলো।তাদের দাম্পত্য জীবনে তখন ঘোর আধার!নিত্যদিন ছোটখাট বিষয় নিয়ে ঝগড়া হলো।সেই ঝগড়া অনেক দূর যেয়ে গড়াতো।এমন সময় তাজওয়ারের ছোট ভাই তামিম এব্রোড থেকে ফিরে এলো।সুধা তখন আমাকে একেবারেই সহ্য করতে পারতো না।সুধার সাথে তামিমের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল।মর্নিং সিকনেস,ফিজিক্যাল ইস্যু,প্রেগন্যান্সি কমপ্লিকেশন,মুড সুইং সব জটিলতা নিয়ে আমি চৌধুরী বাড়ির এক কোণায় পড়ে রইলাম। এক পরম করুণাময়,দুই নিঃসঙ্গতা আর তিন পেটের বাচ্চা ছাড়া আমার আর কেউ ছিলো না।ইয়াসমিন চৌধুরী তখন গ্রামে।তাজওয়ার দিনরাত অফিসে পড়ে থাকতো।এদিকে কেবল বাচ্চার কথা চিন্তা করে আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।অবশেষে দীর্ঘ আট মাসের শেষে আমার গর্ভ থেকে জাজ্বল্যমান এক কৌমুদীর জন্ম হলো।নাম রাখলাম চন্দ্ররেখা!কোমল,তুলতুলে,স্নিগ্ধ মায়াবতী আমার! পৃথিবীর সেরা উপলব্ধি হলো মা হওয়া। সবচেয়ে দুঃখী মাও সুখকর এই অনুভূতি আস্বাদন করতে পারে!সন্তান মানেই সুখানুভূতি।যাকে কোলে নিয়ে আমি সবকিছু ভুলে গেলাম।এক বছর নিজের কাছে থেকে বড় করলাম।আচমকা মায়ের চিঠি এলো।আমাকে তাদের প্রয়োজন। ছুটে গেলাম চাঁদোয়া মহলে।ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার নিষ্পাপ শিশুটি কারো চক্ষুশূল!বুক ভর্তি হাহাকার নিয়ে কোম্পানি দেখা শোনার কাজ চালিয়ে গেলাম।বড় ভাই গিয়েছিলো সুধাকে ফিরিয়ে আনতে।কিন্তু সুধা ততোদিনে তাজওয়ারকে ডিভোর্স দিয়ে তামিমের সাথে দেশের বাহিরে চলে গেছে।তাজওয়ারেরও সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম।তোমাকে আমার কাছে আনতে চাইলাম।তাজওয়ার বেঁকে বসলো।সব সত্যি জেনে গিয়েছিলো।তার ধারণা আমি আর সুধা মিলে তাঁকে ঠকিয়েছি।তার অনুভূতির অসম্মান করেছি।ভালোবাসার মিথ্যা অভিনয় করেছি।আমি বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম।অনেক কাকুতি মিনতি করলাম।সে আমার কোনো কথা-ই শোনে নি।উল্টো তোমার সাথে দেখা করার সব পথ বন্ধ করে দিলো।একা হাতে তোমাকে মানুষ করতে লাগলো।আর আমি!কেবল দূর হতে চোখের দেখা দেখতে লাগলাম।তোমাকে কাছ থেকে ছুঁতে না পারার আক্ষেপ আমার যে চিরকালের।””

নিধি মির্জা দু’হাতে মুখ চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।তার আহাজারিতে সেলে থাকা মানুষদের আত্মাও কেঁপে উঠলো।বজলু ঘাড় নুইয়ে রেখেছে।চন্দ্ররেখা ময়লা মেঝেতে হাঁটু মুড়িয়ে বসে আছে।সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে।চোখ দু’টো বুঝে আসছে তার।মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারছে না।সবকিছু স্বপ্ন হলে কতোই ভালো হতো!কোমল গালে খসখসে রুক্ষ হাতে স্পর্শ পেয়ে রেখা চমকে উঠলো।সামনে বসে থাকা এলোমেলো বসনের নারীটি চন্দ্ররেখার দিকে হলদেটে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে।

-“তুই এসেছিস নিধি?এখান থেকে নিয়ে যাবি আমাকে?”

সুধা মির্জা ফিসফিস করে বললো।রেখার বুক মুচড়ে উঠলো। কি শিশুসুলভ আবদার!অদ্ভুত শান্ত চোখ!পর মূহুর্তে তিনি বাঁধা দুই হাতের সাহায্যে রেখাকে ধাক্কা মেরে দিলেনন।দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে উঠলেন,

-“একদম মেরে ফেলবো তোকে।শেষ করে দিবো।”

রেখা নিজেকে সামলে নিলো।নিধি মির্জা টেবিলে থাকা একটি ক্যামিকেলের জার বোনের দিকে ছুঁড়ে দিলেন।

-“আমার মেয়ের কাছ থেকে দূরে থাকবি।না হয়,আমি তোকে মেরে ফেলবো।যেভাবে সারোয়ারকে মেরে ফেলেছি,ঠিক সেভাবে।”

নিধি মির্জা চিৎকার করে উঠলেন।বজলু সময়মতো সামলে নেওয়ায় সুধা মির্জা তেমন আঘাত পায় নি।চন্দ্ররেখার কোনো বোধ নেই। নিধি মির্জার কোনো কথা আদোও তার কানে পৌঁছেছে কি না সন্দেহ!এক দৃষ্টিতে কাচের ভাঙা অংশের দিকে তাকিয়ে আছে সে।সবকিছুর হিসাব মেলাচ্ছে।

-“উনি তো দেশের বাহিরে ছিলো।আপনি তাকে খুঁজে পেলেন কি করে?আর আপনি বাকি সবাইকে আঁটকে রেখেছেন কেন?আপনি তো নিজেই বললেন এই গোডাউন পরিত্যক্ত করে দিয়েছেন।তাহলে এসব কি?”

রেখার তীক্ষ্ণ কন্ঠের প্রশ্নে নিধি মির্জা থতমত খেয়ে গেলেন। কিছু সময় মৌন রইলেন।

-“পাঁচ বছর পূর্বে তামিম মারা যাওয়ার পর,সুধা ফিরে আসে।সরাসরি মা আর আমার সাথে যোগাযোগ করে।মির্জা গ্রুপে নিজের অংশ চায়।কিন্তু বাবা তার জন্য কোনোকিছুই রেখে যায় নি।যস সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে নি।আমাকে আঘাত করে বসে।তারপর আমি তাকে বন্দি করে রাখি। তিনবছর আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে সে।”

-“বাকি সবার কি দোষ তাদের কেন আঁটকে রেখেছেন?আর কবে থেকে আঁটকে রেখেছেন?

-“তুমি একটু আগে যে দুজন মহিলাকে দেখেছো তারা বিবাহিত হওয়া স্বত্তেও পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলো।তাদের দুজনের স্বামীর ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের এখানে আঁটকে রাখা হয়েছে।তারা এখানে দীর্ঘ সময় যাবৎ আছে।প্রায় দশ বছর!আর বাকি যারা আছে তাদের কেউ কেউ ধর্ষক,কেউ ইভটিজার, কেউ অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া আসামী।”

-“আসামী!দশ বছর?”

চন্দ্ররেখার বিড়বিড় করে আওড়ালো। চোখে তার বিস্ময়।নমায়ের এমন নিষ্ঠুরতম রূপ!কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না।নিধি মির্জা রেখার বাহু ধরে নিচ থেকে উঠালেন।মেয়ের রক্তিম চোখে নিজের লালচে আভাময় চোখ রাখলেন।

-“হে আসামী!বাবা যখন বলেছে তারা আসামী,এর মানে তারা সকলেই আসামী।আর তারা আজীবন এখানে থেকে তাদের শাস্তি পাবে।”

রেখা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে।বুঝতে পারছে না সে!তার নানা চাহান মির্জা কি তাহলে বেঁচে আছে?কিন্তু কি করে?

চলবে
আজকের পর্ব বেশ ছোট হয়েছে তার জন্য দুঃখিত।শেষ পর্ব ইনশাআল্লাহ তিন দিন পর দেওয়ার চেষ্টা করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here