#চুপকথা
#১৩তম_পর্ব
আরশিয়া উত্তর খুঁজে পেলো না। কিন্তু পৃথুলকে হতাশ করতেও ইচ্ছে হল না। তাই নিধী আন্টিকে বলে দিল সে যাবে না। কিন্তু চরম অবাক হল যখন পৃথুল বলল,
“আপনা দরিয়ানগর যাচ্ছি”
“তাহলে তাদের সাথে যেতে কি অসুবিধা হতো?”
‘আমার অসুবিধা রয়েছে”
“সাংবাদিক আপনি অদ্ভুত আচারণ করছেন না? একা একা ঘোরার চেয়ে দলবলে ঘোরাটি ভালো নয়? ওদের সাথে গাইড ছিল”
“না ভালো নয়। কারণ ওখানে আমি ইনসিকিউর ফিল করি”
পৃথুলের কথায় মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে গেলো আরশিয়া। মানে টা কি? ইনসিকিউরিটির এখানে ঠিক কি আছে বুঝতে পারছে না। একটা সচ্ছল পরিবার, যারা যথেষ্ট শিক্ষিত, মার্জিত। তাদের কথাবার্তাতেই সেই স্বভাব পরিলক্ষিত হয়। নিধী আন্টি যদিও একটু বেশি মিশুক। যা সচারচর লক্ষ্য করা যায় না। তাই বলে তাদের নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করার কিছু নেই। এতো দামী হোটেলে তারা থাকছে নিশ্চয়ই তাদের যথেষ্ট আর্থিক সচ্ছলতা আছে। আরশিয়া অবাক স্বরে শুধালো,
“একটা ভালো পরিবারকে নিয়ে এতোটা সন্দিহান হওয়া ঠিক নয় সাংবাদিক। মানছি খবর পড়তে পড়তে আর খু/ন খারাবি দেখতে দেখতে আপনার সন্দেহ বাতিক রোগ হয়ে গেছে কিন্তু তাই বলে ভালো মানুষদের প্রতিও সন্দেহ করা উচিত নয়। এখানে ইনসিকিউরিটির কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না। আর আমি মানুষ চিনতে ভুল করি না। শিক্ষিকা হিসেবে মানুষ চেনার যোগ্যতা আমার আছে”
গড়গড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলল আরশিয়া। পৃথুলের চোখের তীক্ষ্ণতা বাড়লো, চোখ কুচকে তাকালো সে। এভাবে নিশ্চুপ তীক্ষ্ণ চোখে তাকানো পৃথুলের স্বভাব। যখন তার অপছন্দের কোনো কথা বলা হবে সে এভাবেই তাকাবে। সে কখনোই তর্কযুদ্ধে যাবে না, খুব বিরক্তিকর কিংবা অসহনীয় পরিস্থিতিতেও সে শান্ত থাকে। শুধু দৃষ্টি দিয়ে বধ করার চেষ্টা করে। আরশিয়ার মতে এই দৃষ্টি হল তার যুদ্ধাস্ত্র। আরশিয়া ভেবেছিল পৃথুল হয়তো উত্তর দিবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে খুব শীতল কণ্ঠে বলল,
“আপনি যে সবসময় ক বলতে কলকাতা ভাবেন সেটা কি জানা আছে আপনার? আমি তো তাদের নিয়ে কিছু বলি নি। হ্যা, আমি অলরেডি তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেছি। আমি তাদের নিয়ে মোটেই ইনসিকিউর নই। আমি আপনাকে নিয়ে ইনসিকিউর। আর এই ইনসিকিউরিটির কারণ ওই ছেলেটা, সৈকত। আপনি শিক্ষিকা হতেই পারেন তবে পুরুষদের আচরণ সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারণা নেই। ছেলেটি সর্বদাই মৌমাছির মতো আপনার চারপাশে ভনভন করে। আমার বিরক্ত লাগে। আরোও বিরক্ত লাগে যখন সেই ভনভন করার বিনিময়ে তাকে হাসি মুখে উৎসাহিত করেন। আমার ইনসিকিউর ফিল হয়। আমার মনে হয় আমি আবারো নিঃস্ব হয়ে যাবো। আবারো আমার জীবনের সুখগুলো কর্পুরের মতো উড়ে যাবে। আপনার দশ হাতের সীমানাতেও আমার তাকে সহ্য হয় না। আমার স্ত্রীকে সে নিজের স্লিপার খুলে দিচ্ছে, তার জন্য খাবার নিয়ে আসছে, কোথাও গেলে ছবি তুলে দিচ্ছে, আমি থাকতে আপনার হাত ধরার চেষ্টা করছে। আমার এগুলো সহ্য হয় না। আমি মানুষটা একটু পজেসিভ। আমার একান্ত দুনিয়াতে আরোও হস্তক্ষেপ আমার পছন্দ হয় না”
“আপনি অহেতুক চিন্তা করছেন”
“কখনো কাউকে হারিয়েছেন আরশিয়া? আমি হারিয়েছি। একমুহূর্ত কারোর হাসির কারণ হবার পর পরমুহূর্তেই যখন তার বিদ্রুপের গল্পতেও না থাকাটা যে কতটা কষ্টের আপনার ধারণা নেই। আপনার প্রানোবন্ত হাসির কারণ যখন অন্য কেউ হয় আমার কষ্ট হয়। আপনার স্বচ্ছ চোখে অন্য কারোর প্রতিচ্ছবি দেখতে আমি রাজি নই। দ্বিতীয়বারের মতো পাওয়া সুখকুড়ি গুলো আমি হারাতে রাজি নই। সৈকত নামক ছেলেটি আমার কাছে দুস্বপ্ন। আমি তার মত নই। আমি হাসতে পারি না, আমি হাসাতে পারি না। আমি চুপকথা বুজতে পারি না। আমার অপারগতার সিড়িকে মই বানিয়ে সে যদি আপনার হৃদয় অবধি চলে যায়, যদি কেড়ে নেয় আপনাকে…
কথাটা শেষ করতে পারলো না পৃথুল। তার পূর্বেই ভয়ংকর একটি কাজ করে বসলো আরশিয়া। উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ অধরে পেতেই শিরদাঁড়া বেয়ে উষ্ণ রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। নরম পাঁপড়ির মতো অধরের কোমল স্পর্শ হৃদয়ের বিক্ষত ঝড়কে থামিয়ে দিলো। হৃদস্পন্দন তরান্বিত হলো। অচিরেই চোখ বুজে এলো। মাদকতা পূর্ণ স্পর্শে নেই কোনো আড়ষ্টতা, জড়তা। শুধু নিষ্পাপ অনুরাগের পূর্ণতা____
আরশিয়ার অধর থেকে মুক্তি পেতেই সম্বিত ফিরলো পৃথুলের। বিমূঢ় নয়নে তাকিয়ে রইলো সে আরশিয়ার কোমল মুখশ্রীর পানে। হাজারো প্রশ্নেরা উঁকিঝুকি দিচ্ছে। আরশিয়ার দৃষ্টি স্থির, লজ্জায় লাল হওয়া শুভ্র মুখশ্রীখানায় কোনো আড়ষ্টতা নেই। ঘন শ্বাস প্রশ্বাস। ধীর স্বরে বলল,
“এখনো কি মনে হয় কেউ আমাকে কেড়ে নিবে?”
পৃথুলের অস্থির দৃষ্টি হামলে পড়ল সেই মুখশ্রীতে। ঠোঁটের কোনে জয়ের হাসি। তার সুখকুড়ি শুধু তার ই, কেউ কেড়ে নেবার সাধ্য নেই। রুক্ষ্ণ হাতের উষ্ণ স্পর্শ ছুলো কোমল লালচে গাল। কপালে ঠেকালো কপাল। ধীর কণ্ঠে বলল,
“আপনার এই অতর্কিতে কাছে আসাটাকে আমি ভুল বুঝতে শুরু করেছি শিক্ষিকা মহোদয়া। আমাকে শুধরে দিন, আমি কিন্তু আপনার উপর নিজের অধিকার জমাতে শুরু করবো। এখন ই সুযোগ, আমার ভুলটা ভেঙ্গে দিন”
“আমি চাই আপনি আরোও ভুল বুঝুন, আরোও অধিকার জমান। আপনার সর্বত্রে আমার রাজত্ব চাই সাংবাদিক”
আলতো হাতে আগলে থাকা মুখশ্রী শত উষ্ণ ছোঁয়ায় রাঙ্গালো পৃথুল। হৃদস্পন্দন তখন তীব্র। দুজনের শ্বাস গাঢ় হলো। নিস্তদ্ধতায় প্রগাঢ় ভালোবাসা পরিস্ফুটন হল। যে ভালোবাসায় কোনো জড়তা নেই, আড়ষ্টতার ছিটেও নেই। থমকে যাওয়া সম্পর্কটার নাও আবারো পাল তুললো_______
********
সকাল হতেই খবর এলো মোতালেব সাহেব অসুস্থ। রাতের বেলায় মসজিদ থেকে আসার সময় থেকে বুকে ব্যাথা। ব্যাথার পরিমান বাড়তেই তাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। আজ তিন দিন যাবৎ সেখানেই ভর্তি তিনি। ক্ষণে ক্ষণে হাসান সাহেবের সাথে কথা বলার ইচ্ছে তার। ফলে খবর এলো হাসান সাহেবের কাছে। যতই অভিমান থাকুক না কেনো, অসুস্থতার কথায় বিচলিত হয়ে উঠলেন হাসান সাহেব। যতই হোক মানুষটিকে প্রচন্ড সম্মান করেন তিনি। তাই নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না। ছুটে গেলেন হাসপাতালে। আত্মিকা এবং আনহাও গেলো। বাবার মেজাজ সম্পর্কে জানা আছে। বলা তো যায় না যদি কথা কাটাকাটি হয়?
হাসপাতালে যখন পৌছালেন তখন মোতালেব হাসেব আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিলেন। হাতে থাকা ফলে ঠোঙ্গাটা সাইড টেবিলে রেখেই সেখানে বসলেন হাসান সাহেব। মোতালেব সাহেব চোখ তুলে চাইতেই ভারী গলায় বললেন,
“হাসান আসছো?”
“জি, ভাইজান”
“কেমন আছো?”
“ভালো”
“ভালো হলে ভালো। এতো কিছু আনছো কেন? আমি তো ফল খাই না”
“এখন ফল আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ভাইজান”
মোতালেব সাহেব বিজ্ঞ মানুষের মতো বলল,
“ঠিক বলেছো, ভালো করেছো এনেছো। এই হাসপাতালের মানুষগুলো চামার। একটা টুকরো আপেল দেয়, আর কি বিশ্রী রান্না। রুটি টেনে ছিড়া যায় না, মাছ থেকে গন্ধ বের হয়। বমি আসে। আমি তো বলেছি, এই রকম খাবার আরেকবার দিকে ওদের গায়ে বমি করে দিব। ভালো বলেছি না?”
“জি ভালো বলেছেন”
“তুমি আমার সব কথাতে হ্যা হ্যা করো কেন? তোমার এই স্বভাবটাই আমার অপছন্দ”
হাসান সাহেব এবার চুপ করে দিলেন। মোতালেব সাহেবের কণ্ঠ মিয়ে গেলো। তার মুখখানা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। ব্যথিত স্বরে বলল,
“তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো? অবশ্য রাগ করাটা কিন্তু স্বাভাবিক। তুমি আমার সব কথায় সায় দেও, অথচ আমি তোমার বিশ্বাসের গলা চা’প’লা’ম। আসলে হাসান আমি কিন্তু আরশিয়ার ক্ষতি চাই নি। আমি পৃথুলের সম্পর্কে সম্পূর্ণ খোঁজ নিয়েই তোমাকে বলেছি ছেলে ভালো। আমি জানতাম পৃথুলের আগের বিয়েটা তুমি মানবে না তাই লুকিয়েছি। কিন্তু কোথা থেকে তুমি জেনেই গেলে। হ্যা, এমন সত্য লুকানো উচিত নয়। আরোও খারাপ কিছুও হতে পারতো। কিন্তু ঐ সময় সেটাকেই উচিত মনে হয়েছে। ছেলেটা সত্যি ভালো। একবার সুযোগ দিয়ে দেখো না তুমি। ওদের একবার বাড়ি ডেকে নাও। বিয়ের পর থেকে তো এ বাড়ি আসে নি। প্রায় এক মাস হতে চললো। রাগটা এবার ছেড়ে দাও। দোষ তো আমার, তাদের নয়”
হাসান সাহেব এবারও “জি” তেই উত্তর দিলেন। মোতালেব সাহেব তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। এই একঘুয়ে মানুষ কখনো বুঝবে না। সে তার জিদ ঠিক ই রাখবে। মাঝ থেকে ওই মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। তাই তাকে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে______
******
দিনটি শনিবার, সকাল থেকেই তীব্র মেঘের ঘনঘটায় কাঁপছে পৃথিবী। বৃষ্টি নামার আন্দোলন চলছে। দক্ষিণা বাতাসে তোলপাড় হচ্ছে পৃথিবী। এমন আবহাওয়ায় স্ত্রীর ছবি দেখতে ভালোবাসেন হাসান সাহেব। স্ত্রীর সাথে বৃষ্টিবিলাস করার এক অদম্য ইচ্ছে তার অপূর্ণ। সেই নারীর বৃষ্টি ভালো লাগত না। তাই কখনো জোরও করা হয় নি। তাই এখন যখন সে নেই তখন তার ছবি দ্বারাই ইচ্ছেখানা পূর্ণ করে সে। বারান্দার বাগানবিলাসটা বারবার দুলছে। এমন সময় আনহার চিৎকার শোনা গেল,
“বাবা, বুবু দুলাভাই আসছে”…………
চলবে
[আচ্ছা, এতো কম কেনো রেসপন্স? ভালো লাগে না গল্পটি? একটি মন্তব্য তো দেওয়া যায়।]
মুশফিকা রহমান মৈথি