##জোয়ার_ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১১।
পাখির কিচিরমিচির করছে, বাতাসে গাছের ডালপালা নড়ছে। মৃণাল গ্রীষ্মের পাশেই বসে আছে। মৃণাল ঘেঁটে ঘুটে ওঁর মায়ের সাদা শাড়ি পড়া ছবি একটি বেড় করলো। বেশির ভাগ সময় মার্জান টপ, জিনিস বা কুর্তিতেই দেখেছে মৃণাল। তবে দেশের বাহিরে থাকা কালীন সময়, ওঁর মা একটি অনুষ্ঠানে বাঙালি শাড়ি পড়ে ডান্স করেছিলো ওঁর কিছু বিদেশি বান্ধবীদের সাথে। তখন মৃণাল ছবিটি তুলে ছিলো। মৃণাল ফোনটি বাড়িয়ে দিলো,
” আঙ্কেল দেখুন.. আমার মমি।”
গ্রীষ্ম না করলো। কোনো নারীর প্রতি, ওঁর কোনো ইন্টারেস্ট নেই বললেই চলে। কিন্তু এই পুচকে ছেলের পীড়াপীড়িতে চোখ বুলালো শুধু ছবিটিতে। চোখ পড়তেই কিছুটা চমকে গেলো ওঁ। বিড়বিড় করলো ওঁ,
” এই মেয়ে?”
গ্রীষ্ম অবাকতার শেষ চুড়ায়… এই মেয়েটি কি ওঁর সাথে কোনো রকম গেইম খেলছে? না-কি মেয়েটির প্রতি ওঁর নজর পরে, তা চাইছে। হতেও পারে, এজ এ সিঙ্গেল মাদার.. কারো শক্ত হাত ধরতে চাইছে? কিন্তু আদো কি তা সত্যি? যাই হোক না কেন? মেয়েটি সত্যি ওঁর নজরে পরে গেছে। এবার মেয়েটির নাগাল পেলে গ্রীষ্ম ছাড়ছে না ওঁ… বলেই বাঁকা হাসলো ওঁ।
——-
হাসপাতালের গুমোট পরিবেশের মাঝে হসপিটালের বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মার্জান। পবট পিট করে চোখ খুললো এবার। মাথার উপর সাদা সিলিং দেখে বুঝতে চেষ্টা করছে কোথায় আছে ওঁ। তখনি একটি গলা ভেসে এলো,
” মান.. আর ইউ ওকে? ”
মার্জান কন্ঠ পানে চাইলো। চমকে যাওয়া নজরে বলে উঠলো,
” রাফান? তুমি এখানে?”
রাফান মিষ্টি করে হাসলো। বলল,
” মান যেখানে রাফান সেখানে!”
মার্জান-ও হেসে ফেললো। পরমুহূর্তেই ওঁর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো মনে পড়তেই বিচলিত হয়ে পড়লো,
” আমি এখানে কিভাবে এলাম? আমি তো সেই রুমে? ধোঁয়া, । ”
রাফান মার্জানের হাতে হাত রাখলো। মার্জানকে সামলাতে বলে উঠলো,
” সব ঠিক আছে মান। ”
মার্জানের চোখে-মুখে অবিশ্বাস্যর ভাব,
“কিন্তু তুমি এখানে কিভাবে?”
“সারপ্রাইজ! ”
বলেই মুচকি হাসলো রাফান।
——
বড় পাহাড় ঘেষে স্নান দিগন্তে নানাফুলের মেলা। একটি মেয়ে ঝুঁকে আছে ফুলের সুগন্ধি নিতে। ভ্রমর-রা বেড়াচ্ছে আছে-পাশে। বাহারি পাখির গানের ভেসে আসছে ধীরে ধীরে। সফেদ বদনে সফেদ জামা। লালটুক টুকে ঠোঁট। দেখতে পরির চেয়েও কম মনে হচ্ছে না মার্জানকে। মার্জান এবার কিশোরীর মতো খিলখিল করে হাসলো। ঠোঁটে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো দুটো লাইন কবিতা,
” আবছায়া আলোয় তার দেখা মেলে,
ফুলের সুভাসে তার গন্ধ খুঁজে পাই
ভোমরের মতো করে উড়ি ফিড়ি তারই খুঁজে
অপেক্ষা, অপেক্ষা শুধু অপেক্ষায়
থাকি আমার তুমিটার..”
মার্জান চোখ বুঝে নিলো। ঠিক তখনি নাকের মাঝে ধাক্কা মারলো মা’তা’ল সুভাষ। অনুভব হলো কারো স্পর্শ।
” তুমি আমার সুভাষিনী। তুমিই আমার এক মাত্র অনুভূতি, তুমি আমার শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুবাস। শুধু তুমি-ই আমার ভালোবাসার আভাস।”
মার্জান পিছনে মুড়ে ঝাপটে ধরলো ওঁরে,
” আর তুমিই আমার অপেক্ষার অবসান। ”
ছলছল চোখ ভর্তি জল মার্জানের। মুখ তুলতেই রাফানের বাদামী বর্ণের মুখটা ভেসে উঠলো। এই ব্যক্তিটার প্রতি চিরঋণী ওঁ। ছোট বেলায় একবার জান বাঁচিয়ে ছিলো ওঁ। শুধু কি তাই, মৃণালের সময় -ও অনেক সাহায্য করেছে এই ব্যক্তিটি। কিন্তু সুটিং স্পটে রাফানকে দেখে কিছুটা চমকে গেলেও নিজের অভিনয়ে এক ফোঁটা বোঝায়নি ওঁ। ঠিক তখনি ডিরেক্টর বললেন,
“কাট!”
মার্জান তখন অবাক হয়ে বলে উঠলো,
” রাফান তুমি এখানে?”
রাফান হাসলো,
” বলেছিলাম না সারপ্রাইজ। ”
মার্জান চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো,
“এই জন্যই কি সায়ন স্যারকে এতবার জিগ্যেস করার পরেও আমাকে বলেনি নায়ক কে? ”
রাফান প্রত্যিত্তুর হাসলো। মার্জানো হাসলো। মার্জান আর রাফানের কথার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো মার্জানের। মার্জান “এক্সকিউজ মি ” বলে ফোন হাতে নিয়ে একটু দূরে চলে এলো। ফোন তুলতেই নির্ঝরের ক্রোদন শোনা গেলো। নির্ঝর হেঁচকি তুলে কাঁদছে,
” মার্জান মায়ের এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।”
মার্জান চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
” কোথায় এখন আন্টি? কেমন আছেন?”
নির্ঝর ফোনের ওপাশ থেকে হসপিটালের ঠিকানা দিতেই। মার্জান সায়নের সাথে কথা বলল। মার্জানের তেমন কাজ নেই আর বলে ওঁকে চলে যেতে বলল। মার্জান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো হসপিটালে। মার্জান জানে, যাদের মা নেই, তাদের কত কষ্ট। পৃথিবীতে যার মা নেই.. ওঁর জীবনের সব থেকে বড় ধন-দৌলত নেই। মার্জান নির্ঝরকে সামনে দেখতে পেরেই জিজ্ঞেস করলো,
” আন্টি এখন কেমন আছেন?”
“এখন ঠিক আছেন।তবে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে মার্জান।”
“কি ঝামেলা?”
নির্ঝর সব খুলে বলল,
” আমার মা আমার জন্য লোন নিয়েছিলো ওঁর মালিকের কাছ থেকে। এখন যদি মিস যায়? ঝামেলা পোহাতে হবে যে।”
মার্জান কিছুক্ষণ ভাবলো। ওঁর মা একজন সেফ। খুব ভালো রান্না করায় হায়ার করে ছিলেন ওনাকে এক ধনী পরিবার। সব থেকে বেশি খাবারের খেয়াল রাখতে হতো ওঁকে ওই পরিবারের কর্তীর। মার্জান নিজেও নির্ঝরের মায়ের কাছ থেকে কুকিং ক্লাস নিয়েছিলো। তাই নির্ঝরকে আশ্বস্ত করে মার্জান নিজেই গেলো নির্ঝরের মা’য়ের জায়গায় কাজ করতে। মার্জান একটি রেসিডেন্সিয়াল এলাকায় এসে পৌঁছালো। এই এলাকায় ঘর-বাড়ি এক কিলোমিটার দূরে দূরে মনে হয়..। আর প্রতিটা বাড়ি যেন বাংলো বাড়ির মতো। মার্জান গেট দিয়ে প্রবেশ করলো। বাড়িটি ওঁর কাছে খুব পরিচিত লাগছে। মনে হচ্ছে আরো একবার হয়তো এসেছে। কিন্তু নিজের ভাবনায় বেশি পাত্তা না দিয়ে বাড়ির কাজের লোকের সাথে সোজা চলে গেলো রান্না ঘরে। ঘন্টা খানেক পর মার্জান দেখতে পায়, একটি ব্যক্তি জোড়ে জোড়ে কাউকে ধমকাচ্ছে ফোনে। মার্জান কৌতূহল নিয়ে বাহিরে আসতেই চক্ষু চারাক গাছ। এই ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, গ্রীষ্ম। পিছন পিছন আসছে নোমান আঙ্কেল। মার্জান বিড়বিড় করলো,
” ইয়া আল্লাহ.. তুমি আমাকে আবারো পাঠালে এই সাপের গুহায়? না জানি কি করে ফেলে এবার দেখলে।”
মার্জানের কিছু দিন আগের কথা মনে পড়ে গেলো। দম আটকে মারতে বসে ছিলো পাগলটা…মার্জানের হাত কম্পন করতে থাকে। কঁপালের মাঝে মৃদু ঘাম ফুঁটে উঠে।
এদিকে গ্রীষ্ম ফোনে কথা বলা শেষ হতেই পানির জন্য এসে দাঁড়ায় রান্না ঘরে। মার্জান ততক্ষণে মুখে মাস্ক পড়ে নিয়েছে। নজর ঝুঁকে আছে ওঁর। কিন্তু গ্রীষ্ম তো গ্রীষ্ম। তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষন করছে ওঁ। মার্জান এতে আরো ঘাবড়ে যায়। এবং ওঁর হাত থেকে চপিং বোর্ড নিচে পড়ে যায়। গ্রীষ্ম নাক মুখ কুচকারো চপিং বোর্ড পড়তেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে যাওয়া সবজি গুলো দেখে বিগড়ে গেলো ওঁর মুখ। কিন্তু মার্জানকে এভাবে ভয়ে ভয়ে, আর চোরা চোখে তাকাতে দেখে গ্রীষ্ম এবার বাঁকা হাসলো। মেয়েটির একদম কাছে গিয়ে বসে পড়লো হাটু মুড়ে ওঁর সামনে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মার্জান আমতা আমতা শুরু করলো। গ্রীষ্ম সঙ্গে সঙ্গে ওঁর মাস্ক খুলে ফেললো। এবং ডেঞ্জারাস ভাবে হাসলো। মার্জানের চোখে পানির ফোয়াড়া। গ্রীষ্ম বলে উঠলো তখন,
” সত্যি করে বলো তো? তোমার কি আমার হাতেই মরা শখ হয়েছে? নাকি আমাকেই তোমার মায়াজাল ফাঁসাতে চাইছো? ইউ নো হোয়াট? ইউ ক্যান!”
শেষ কথা গুলো মার্জানের চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো গ্রীষ্ম। মার্জান তাৎক্ষণিক জায়গা ত্যাগ করতে নিতেই গ্রীষ্ম ওঁর হাতের কব্জি শক্ত করে চেপে ধরলো,
” দেখুন, আপনি আমায় ভুল বুঝেন, এর আগেই আমি ক্লিয়ার করে দিচ্ছি, আমি জানতাম না এইটা আপনার বাড়ি, জানলে কখনো পা রাখতাম না এখানে, কারণ সেদিনের ঘটনা আমার মনে আছে। মরতে চাইনা আমি!”
গ্রীষ্ম ঘাবড়ে যাওয়া মার্জানকে দেখে মজা পাচ্ছে। মার্জানের গালে হাত বুলিয়ে, কঁপালে পড়ে থাকা চুল গুলো কানে পিছনে গুঁজে নিয়ে বলে উঠলো,
” তোমরা করতে চাইছো টা কি বলোতো? মা বলছে আমাকে ওঁর পছন্দ না, আমি ভালো না, অন্য দিকে ছেলে এসে ঘটকালি করছে!”
মার্জান চকিতে মুখ তুললো। বলল,
” কি বলতে চাইছেন?”
গ্রীষ্ম মার্জানের চারপাশে ঘুরে বলে উঠলো,
” এটাই, তুমি আমার নজরে পড়ে গেছো। এখন তোমাকে আমার গার্ল ফ্রেন্ড হতে হবে।”
মার্জান বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বলল,
” আর ইউ ম্যাড। আপনি যখন জানেন আমার বাচ্চা আছে তার পরেও এসব বলছেন?”
গ্রীষ্ম চুলোর টেবিলের সাথে ঘেষে দাঁড়ালো। বুকের উপর আড়াআড়ি ভাবে হাত বেঁধে বলে উঠলো,
” কেনো? তুমি তাই চাউনি?”
মার্জান ক্ষেপে গেলো,
” মোটেও চাই না। একদম না। কারণ একজন অসভ্য, বদমেজাজি মানুষের সাথে আর যাই হোক বসবাস করা যায় না।”
গ্রীষ্মের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। ওঁ সটান দাঁড়িয়ে মার্জানকে এঁকে বারে কাছে টেনে নিলো। মার্জানের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। গ্রীষ্ম মার্জানের মুখের উপর ঝুঁকে পড়লো পড় মুহূর্তেই। মার্জানের গোলাপি ঠোঁটে ওঁর ঠোঁট স্পর্শ করে গেলো মার্জান বুঝে উঠার আগেই। এবং খুব রুক্ষ ভাবে চুমু খেলো ওঁর ওষ্ঠদ্বয়ে। মার্জান বেঁধেয় কুকিয়ে উঠছে। শরীরে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে এক ধাক্ক মারতেই কিছুটা সরে এলো গ্রীষ্ম। নিজের ঠোঁট মুছে মার্জানের দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
” এখন তুমি আমাকে অসভ্য বলতে পারো মিস। এঁকেই তো বলে অসভ্যতা তাই না!”
মার্জান রাঙ্গানিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো গ্রীষ্মের দিকে। হাত তুলে এক চর বসাতে যেতেই হাত ধরে ফেললো। মার্জান খানিকটা চিৎকার করেই বলে উঠলো,
” আপনার সাহস কত হয়, আমার সাথে এমন করার? আই কিল ইউ!”
মার্জান কথাটি বলে শেষ করতে পাড়ার আগেই গলা চেপে ধরলো গ্রীষ্ম। মার্জানের মনে পড়ে গেলো সেদিনে রায়হান বলেছিলো ওঁকে এই লোকটি রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না। মানুষ মেরে ফেলা যেন ওঁর দু’মিনিটের কাজ। মার্জান চায় না আর রাগাতে। তাই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
” দেখুন আমার বয় ফ্রেন্ড আছে। আর আমরা দু’জন দু’জনকে অনেক ভালোবাসি।”
গ্রীষ্ম মার্জানের বলা বাক্যে ওঁকে ছেঁড়ে তো দিলো? কিন্তু হুংকার করে বলে উঠলো,
” ব্রেকআপ করে নাও। কারণ এখন থেকে তুমি শুধু আমার!”
মার্জান নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
” এইটা কখনো সম্ভব নয়।”
গ্রীষ্ম এবার হাসলো,
” ইরফানুর মাসাবীহ গ্রীষ্ম চাইলে সব সম্ভব। ”
” তা আমার ছেলে চাইলে কি সম্ভব? ”
পিছন থেকে একটি গলা ভেসে আসতেই গ্রীষ্ম আর মার্জান তাকালো বাহিরে। এ বাড়ির কর্তীকে দেখে মার্জান নিজের কাজে লেগে পড়লো। গ্রীষ্ম ওঁর মা-জানের কাছে গিয়ে বললো,
” কিছু না মা-জান, তুমি এখানে কেন এলে? ”
অনিতা ছেলের চুল ঠিক করে দিয়ে বললেন,
” তুই মেয়েটিতে কেন ধমকাচ্ছিস বাবা? ও খুব ভালো মেয়ে। মা তুমি কিছু মনে করো না। আমার ছেলেটা এমনি রগচটা। ”
গ্রীষ্ম মায়ের কথায় মুখ বাঁকালো। কিছু না বলেই ধপাধপ পায়ে উড়ে চলে গেলো ওঁ। অনিতা মার্জানের কাছে এসে বলে উঠলো,
” আমার ছেলেটা খারাপ না মার্জান, তবে ওঁর মেজাজটা বড্ড খারাপ আর খিটখিটে। ছোট থেকেই অনেক কষ্ট মনের মাঝে জমা ওঁর। যার জন্য এমন হয়ে গেছে। কিছু মনে করো না প্লিজ! ”
মার্জান অনিতাকে শুধু হাসি ফিরিয়ে দিলো।ভাবতে লাগলো মা থেকে ছেলেটা বড্ড বড্ড রকম বাজে।
——–
লাভ আজ শীপ্রাকে নিয়ে প্রথমবার ডেটে এসেছে। চতুর্দিক সুন্দর করে সাজিয়েছে। শীপ্রার ডিপ্রেশন কাঁটাতে উঠবার এই যেন একটি পথ ভেবেই লাভের দিকে প্রথম কদম বাড়িয়ে ছিলো ওঁ। ঠিক তখনি লাভ বলে উঠলো,
” শীপ্রা। এই রেস্টুরেন্টটি আমার আঙ্কেলের। উনিই সব কিছু ডেকোরেশন করে দিয়েছেন। ”
শীপ্রা অবাক হয়ে বলল,
” উনি তোমাাে এসবের জন্য উৎসাহ দিচ্ছে? বাহ্! এই জন্য বখে গেছো।”
লাভ হাসলো,
” আজ না বখে গেলে, তোমায় পেতাম কই!”
শীপ্রা লজ্জা পেয়ে গেলো। লাজুক হাসতে লাগলো। লাভ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ওঁকে। ঠিক তখনি আকাশের বুকে আতশবাজি ফোটলো। শীপ্রা অবাক হয়ে দেখলো, আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করছে ” আই লাই ইউ ” লিখাটি। শীপ্রার চোখে পানি চলে এলো। লাভ ওঁর চোখের জলটুকু মুছে দিয়ে বলে উঠলো,
” আই লাভ ইউ!”
শীপ্রা আবেগে আপ্লুত। হয়ে কিছু একটা বলতে নিবে, তখনি পিছন থেকে ভেসে এলো একটি কন্ঠ,
” শেষ পর্যন্ত আমার ভাতিজা মনের মানুষ পেলো বলে?তা আমার কি সুভাগ্য হবে আপনার উড বিকে দেখার?”
লাভ খুশিতে গদগদ হয়ে ছুটে গেলো তায়নের কাছে,
” নো ডুড, তুমি ছাড়া ইম্পসিবল ছিলো সব!”
এদিকে তায়ানের কন্ঠ শোনে সেই জায়গায় জমে যায় শীপ্রা। লাভ তায়ানকে নিয়ে শীপ্রার সামনে আসতেই নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে দু’জনকে দেখতে থাকে শীপ্রা। তায়ান শাহ্ হাসছে। শীপ্রার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই লাভ, তায়ান হাত বাড়ায় শীপ্রার দিকে। উতসুক দৃষ্টি তাকিয়ে থাকা লাভকে দেখে চাপা হাসলো শীপ্রা। মনে মনে নীজে ভাগ্যকে হাজার টা গালি দিয়ে বসলো ওঁ। হাতে হাত মিলাতেই তায়ান শাহ্ শক্ত করে চেপে ধরলো শীপ্রার হাত। বলল,
” আপনার সাথে দেখে হয়ে ভালো লাগলো খুব!”
শীপ্রা জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলো,
” আ-মা-রো!”
কি করবে এবার শীপ্রা?
চলবে,জোয়ার-ভাটা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১২।
রঙ্গিন ফানুষ উড়ছে আঁধারিয়া অম্বরে। খোলা আকাশের নিচে টিম টিম করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোমবাতি বালুর উপর। চতুর্দিকে পাহাড়ঘেরা । থেকে থেকে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সাগড়ের তীরে। শীপ্রা সাগরের গর্জন শুনতে ব্যস্ত। দূর আকাশের জ্বলজ্বল করা কিশোরীর কঁপালের টিপের মতো তারকারাজি। শীপ্রার মলিন মুখ। ভালবাসা নামক অনুভূতিটা বুঝি ওঁর জন্য নই! হয়তো উপর ওয়ালা কারো ভালোবাসা ওঁর কঁপালে লিখেই নি। না মায়ের, না বাবার, আর… । ভাবতে পারছে না শীপ্রা। বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওঁর। ঠিক তখনি পাশে এসে দাঁড়ালো লাভ। শীপ্রার আঙ্গুলের হাতের ভাঁজে গুঁজে নিলো ওঁর হাত এক এক করে। যেন বুঝাতে চাইছে ওঁকে,
” আমি আছি তোমার পাশে। তোমার সব সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে।”
লাভ ওঁর গলায় সুর তুললো,
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো..
শীপ্রার হাসলো। লাভের হাতে হাত আর চোখে চোখ রেখে ওঁ নিজেও সুর তুললো,
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
দু’জনেই হাসলো।চোখে চোখে কথা হলো। শীপ্রা মুখ লুকালো লাভ এর বুকে। লাভ আবেশে জড়িয়ে নিয়ে বুক ভরা শান্তির শ্বাস ছাড়লো আকাশ পানে। ভালোবাসার মুহূর্তটুকু বুঝি এটাকেই বলে? লাভের ভালোবাসাই বুঝি শীপ্রাকে নতুন একটা অধ্যায় শুরু করবে? লাভ শীপ্রার কঁপালে গভীর চুমু খেলো। শীপ্রার অদ্ভুত শিহরণে চোখ বুঝে নিলো। লাভের দৃষ্টি নেমে এলো শীপ্রা গোলাপের মতো পাতলা ঠোঁট জোড়ায়। ঝুঁকে আসতেই অচেনা কারো গানের কন্ঠে ভেসে এলো,
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস
ভঙ্গ হলো ওদের ভালোবাসার মুহূর্ত। দু’টো নর-নারী অবাক হয়ে চাইলে ভেসে আশা গলার পানে। লাভের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠলেও। শীপ্রা স্তম্বিত হলো। তায়ান শাহ্ ওদের থেকে দাঁড়িয়ে খানিকটা দূরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে টানছে নিকোটিন। নিকোটিনের কালো ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে ফানুসের পিছনে। লাভ বলে উঠলো,
” আঙ্কেল, তোমার কন্ঠে আজ কতদিন পর গান শোনলাম।”
তায়নশাহ্ হাসলো। ওঁর তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া এবার শীপ্রার দিকে। শীপ্রা নিজেও তাকিয়ে সামনের ব্যক্তিটির দিকে। কি বোঝাতে চাইছে লোকটি ওঁকে? কেন দিচ্ছে ছেড়ে এঁকা ওদের? কেন ফিরে এসেছে আবার শীপ্রার জীবনে? এত এত প্রশ্ন থাকলেও উত্তর নেই যেন।শীপ্রার ভাবনায় মগ্ন দেখে লাভ বলে উঠলো,
” আর ইউ ওকে শীপ্রা? খারাপ লাগছে তোমার? তাহলে চলো রিসোর্টে ফিরে যাই!”
শীপ্রা সম্মতি জানালো। নিজ রুমে ফিরে গিয়ে চট করে দরজা লাগিয়ে দরজার সাথে হাটু মুড়ে বসে চাপা কান্না শুরু হলো। শীপ্রার কালো অতীত কি আদো ওঁর পিছু ছাড়বে? নাকি আবারো ধংস করে দিবে এবার পুড়োটা ওঁকে। কি চায় ওঁ? কি চায় ওঁর কাছে? আচ্ছা এমনওতো হতে পারে, এবার কোনো মতলব নেই ওই লোকের? না-কি অন্য কিছু? কেন ছেড়ে দিচ্ছে না শীপ্রা পিছু?শীপ্রা এবার নিজের চুল টেনে ধরলো শক্ত করে। কিছুক্ষণ আগের সুন্দর করে করা মেকাপ নিজের হাত দিয়ে ঢলে ঢলে তুলতে লাগলো। শীপ্রার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই ব্যক্তিটিকে ওঁ ধংস করে দিক। কিন্তু ওত সাহস কি ওঁর আছে? ওঁর মতো সামন্য মেয়ে কি মাফিয়া পরিবারের ছেলের সাথে লড়াই করতে পাড়বে? শীপ্রা এবার আয়নার সামনে দাড়ালো। যত দোষ! সব বুঝি এই চেহারার? তাই না? এই চেহারাইটা যদি নষ্ট করে দেয় শীপ্রা? শীপ্রা কাজলের কৌটা থেকে কাজল নিয়ে লেপ্টে দিলো মুখে। তাহলে কি তায়ানশাহ্ ওঁর পিছু ছাড়বে? আর লাভ? লাভ কি ওকে তখন ওই রূপে ভালোবাসবে? নাহ্ নাহ্ নাহ্… কেউ বাসবে না ভালো। কেউ না। তখন হয়তো আরো লাঞ্ছনা সইতে হবে ওঁর। ওর ভাই রাফি যে কিনা ওঁর চাচা-চাচাীর ছেলে হয়েও নিজের চাচাতো বোনদের আগলে রাখছে? তখনি কি ওঁর জীবন আরো কষ্টে পরিনত হবে না! শীপ্রা আর ভাবতে পারে না। অসাড়তা ঝেঁকে বসেছে শরীরে। কোনো রকম দেহটাকে টেনে নিয়ে দাঁড়ালো শাওয়ারের দিচে। জলযন্ত্র থেকে বৃষ্টির ধারার মতো পড়তে লাগলো ওঁর বদনে। সরে যেতে লাগলো মুখের কাজলের দাগ গুলো। কখনো কি এভাবেই মুছে যাবে, শীপ্রার জীবনের দুঃখ গুলো? শীপ্রা ঘন্টা খানেক পর বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। সাদা বাথ রুপ গায়ে। চুল গুলো মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো আবারো আয়নার কাছে। নিজের প্রতিছবি দেখে তাচ্ছিল্য ছূরে দিলো ওঁ। পাশে থাকা ফোনের বিপ বিপ শব্দে ভঙ্গ হলো ধ্যান ওঁর। ফোনটা হাতে তুলতেই ভেসে উঠলো জ্বলজ্বল করে,
” কাম টু মাই রুম!”
নিজে রুম নাম্বার লিখা। শীপ্রার আর বুঝতে বাকি নেই, এটি কার মেসেজ। শীপ্রা ভেবেই নিলো কোনো রেসপন্স ওঁ করবে না। নাহ্ এই লোকের মুখ ওঁ দেখবে। একদম না…!
পরমুহূর্তেই আবারো মেসেজ এলো,
” তোমার ভাই এখন মেডিকেলে আছে তাই না? আর বোন? হোষ্টেলে। আই থিংক বাকিটা তুমি বুঝদার। ”
শীপ্রার ভিতর থেকে গগনবিদারী চিৎকার বেড়িয়ে এলো। এই মুহুর্তে ওঁর নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। না পেরে রাগে মাথায় নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতেই ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে গেলো রক্ত। শীপ্রার নিজের হাতের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ফিচেল হাসলো। গড়িয়ে পড়া রক্ত দেখে যেন শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে ওঁর।
——————
দিনের মধ্যভাগ। কড়া রোদে তপ্ত চারিদিক। মার্জান ছেলের জন্য খাবার নিয়ে এসে উপস্থিত হলো ওঁর কেবিনে। মার্জান কেবিনে প্রবেশ করতেই হতবাক। কত গুলো নার্স দাঁড়িয়ে আছে মৃণালের পাশে। একে একে খাবার আর গিফট নিয়ে দাঁড়িয়ে। ছোট একটি নাদুসনুদুস সুন্দর মেয়েও এসে বসেছে মৃণালের পাশে। মৃণাল বিরক্তি নিয়ে বসে। মার্জানকে দেখেই স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো যেন। দু’হাত মেলে ধরে বলে উঠলো,
” জান.. প্লিজ হেল্প। নয়তো আমি এখানেই মারা যাবো”
মার্জানের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো,
” বাচ্চা কি সব বলছো এগুলো। এসব বলে না”
মৃণাল মুখ ফুলিয়ে বলল,
” জান দেখোই না এরা কি করছে আমার সাথে?”
মার্জান এক পলক ওঁদের কি তাকিয়ে প্রশ্ন করতেই বলে উঠলো একজন,
” আজ মৃণালের জম্মদিন তাই আমরা এসব নিয়ে এসেছি।”
মার্জান আর মৃণালের দু’জনেরি ভ্রু কুচকে গেলো। দু’জন এক সঙ্গে গলা ছাড়লো,
” কে বলছে?”
নার্সরা সবাই এবার আঙ্গুল তুললো বাচ্চা মেয়েটির দিকে। বাচ্চা মেয়েটিও সুর সুর করে নেমে। খিলখিল করে হেসে বলে উঠলো,
” আমি তো মজা করেছি তোমাদের সাথে।”
সবাই এবার রাঙ্গানিত ভঙ্গি করলো। মৃণালকে এই হসপিটালের সকলেই খুব ভালোবাসে। যখন এই বাচ্চা মেয়ে এনিছা ওদের বলে আজ মৃণালের জম্মদিন, সকরেই খাবার, ফল, গিফট নিয়ে হাজির। এনিছাকে এভাবে মিথ্যা বলতে দেখে খেপে গেলো ওঁরা। মৃণাল নিজেও ছুটলো ওঁর পিছু পিছু,
” এনিছা আজ তোমাকে ছাড়বো না। দাঁড়াও!”
ওঁদের কান্ডে হেসে দিলো সবাই। ঠিক তখনি রাফি এসে দাঁড়ালো ওঁর পাশে,
” মার্জান, ভালো হয়েছে তোমাকে পেয়ে গেছি, আমি তোমাকেই ফোন দিতাম।”
উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো,
“কেনো?”
“মৃণালের জন্য ডোনার পেয়ে গেছি আমরা।”
মার্জানের খুশিতে চকচক করে উঠলো চোখ-মুখ। মার্জান ভাবলো,
” এবার আর ধারে কাছে যেতে হবে না গ্রীষ্মের।”
এর পর রাফিকে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
” সে ডোনার টা কে?
রাফি কিছু বলবে ওঁর আগেই পিছন থেকে ভেসে এলো একটি গলা,
” আমি!”
চলবে,