তনুশ্রী পর্ব ১১

#তনুশ্রী♥
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
#পর্ব_১১

ঝড়ের ন্যায় বৃষ্টি হচ্ছে পুরো মোড়লপাড়া জুরে। বৃষ্টিতে ছুটছে এক সুন্দরী রমনী। শাড়ীর দু আঁচলা হাতে করে ছুটছে মাকে একবার দেখার জন্য! কাটার কিঞ্চিৎ পায়ে ডুকে যায়। অবহেলার ন্যায় ছুটে রমনী। প্রবল ভারি বর্ষনে শরীর কাঁদায় মাখামাখি! মুখ বেয়ে পড়ে সাদা বিন্দু! খোলা দরজা ঠেলে ভেতরে ডোকে তনু। বৃষ্টিস্নাত নিজের মাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। পুলিশ চালিতে দাড়িয়ে। তনু সব লাশ এড়িয়ে লতিফার মৃত দেহ জাপটে নেয়। হাতের কাটা অংশ এখন অর্ধপচা। পুলিশের কেউ কেউ চালি থেকেই হাঁক ছাড়ে,
– ছোঁবেন না। কি করছেন? উঠে আসুন! ‘
কারো কোন কথা কানে এলোনা তনুর। মুরগির ঘরের ছটফটানি কমেনি! দুপুর হয়েছে প্রায়! সূর্য মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে! মোরগ-মুরগিকে এখনো খোপের দরজা খুলে দেয়নি কেউ। তারা বেরোতে চায়। পেটে খিদে তাদের।

বৃষ্টি আর তনুর নোনাজল মিশে গড়ে পড়ে মাটিতে। বরংবার তনু লতিফার কপালে চুমো দেন। তেরো বয়সি একজন মেয়ের পক্ষে এসব দেখা বড্ড কঠিন! চিৎকার দিয়ে কাঁদে তনু। আজিদের চোখ তনুর উপর। অপলক ভাবে মৃত চোখদুটি মেয়েকে কেমন দেখছে!

সময় বহমান! পেড়িয়ে যায় দু ঘন্টা। বৃষ্টি থেমেছে। রোদের কোন লক্ষন নেই! তনু ভেজা শরীরে চলিতে বসে। কেউই তাকে তুলতে পারেনি। কোনরকমে নিয়ে এসেছে চলিতে শুধু। পুলিশ লাশ তদন্ত করছে! তারা চালিতে কয়েকটা অস্ত্র জব্দ করেছে। যা ছিলো খুব নামী-দামী! এসব ঘেঁটু কিংবা মুগির পক্ষে কেনা একেবারেই অসম্ভব! উঠোনে দুটো ছুড়ি আর তিনটে রামদা পেয়েছেন উনারা। তনু এক চোখে তাকিয়ে তার মৃত মায়ের দিকে। আজ তার মা আর দুনিয়ায় নেই! তনু তনু বলে কেউ ডাকবে না কেউ জড়িয়ে নেবে না। কপালেও আর কারো চুমো পড়বে না! তনু বিরবির করে,
– কার এত বড় শত্রুর ছিলেন আম্মা আব্বায়? তারা কি মানুষ? সেদিন আম্মায় সবটা বললে আজ কি এসবের কিছু হতো? উনি ক্যান দেখতে দিলেন না? কে দায়ী? আম্মা ক্যান সেদিন পা ধইরা কইছিলো যেন আমি ঠিক থাকি? ‘
একখানে বসে শুধু বিরবির করে কথাগুলো তনু। পুলিশ স্ট্রেচারে করে লতিফা সহ সবাইকে নিয়ে যায়। তনু এগোয় না। হাত পায়ে যেন কেউ শেকল বেঁধেছে! তার ক্রোধ হচ্ছে খুব! খুনিকে সামনে পেলে যেন রক্ত চুষে নেবে তনু!

মইনুল সহ মোড়লবাড়ির সকলে দরজা দিয়ে ডোকে। তনু একপলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয়। রিমি বাদে সকলে বোরখা পড়েছে। তূর তনুকে ওভাবে দেখেই ছুটে যায়। সাথে তার সকল চাচীরা। তূর ঘারে হাত রাখে তনুর,
– কি অবস্থা করেছো তুমি তোমার হ্যা? কি চাইছো? ওঠো! চাচী শাড়িটা পাল্টে আনুন তো! ‘
– খাড়া।
বলেই জুঁই ভেতরে নিয়ে যায় তনুকে। সাথে আনা সুতি কাপড় একটা পড়িয়ে দেয় জুঁই। হঠাৎ প্রশ্ন চাপে তনুর মাথায়,
– সেদিন নিজে কষ্ট নিলেন। আর সত্যটা লুকাইলেন ক্যান? ‘
জুঁই ঘাবড়ালেও প্রকাশ করে না। সোজাসুজি বলে,
– ওইডা তূর টানছিলো তাই কাটছে।
– আমি যে নিজে দেখেছি!
জুঁই কিছুক্ষণের জন্য থামে। তারপর বলে,
– মনে করো প্রয়োজন আছিলো।
– তির্থ ভাই যে আপনার প্রতি এমন অন্যায় করে আপনি কাউরে কিছু কন না ক্যা? ‘
উত্তরে হাসে জুঁই।
– শোন তনু, যদি তূর কোনদিন তোমারে কোন হাসপাতালে নিয়ে যাইতে চায় তাইলে যাইবা না। তূর এসবে জড়িত ছিলো না আদেও! আমার শুশুড় একটা কচু*খোর! ‘
তনুর আগ্রহ বারে। জুঁইয়ের হাত ধরে বলে,
– কোন কাজ? উনিতো ব্যাবসা করেন। ওইহানে..’
– কিছুনা।
– কিছু তো বঠেই। কন না আফা।
– তূরের বয়স আটেরো যখন তখনি পড়ালেখানোর জন্য বিদেশে পাঠায় তোমার শশুড়। তিনারা তখন ফুলের মতন সুন্দর। চাইছিলো তূররে দিয়া একখান ভালো ব্যাবসা করাবো বিদেশে আর মোড়লপাড়ার উন্নতি করবো। ছোট থেইকাই হ্যাতে বিজ্ঞান শাখা নিয়া ফড়ছে। সারাদিন কিসব জিনিসপত্তর নিয়া পইরা থাকছে। সে নাকি একদিন…’
থামে জুঁই। মনে করার চেষ্টা করেই বলে,
– বিজ্ঞানী! বিজ্ঞানী হইবো একদিন। সারাদিন বইয়ে মুখ গুইজা থাকতো। মোড়লপাড়ায় তখন সবে এসব শাখা আর নতুন বিল্ডিং এর ইস্কুল তৈরি হইছে। কিসব গবেষণা ও করছে কয়দিন। সিলেট গেছে সে..সেমি..নার হ্যা সেমিনার করতে! আমি বুঝি না আবার এইসব কিছু। তারফর সরকারের পক্ষ থেইকা সে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পায়। এতে মইনুলের বেশ কাটখড় পোড়াতে হইসে। আর সেইখানে কাল হয়! ইশয়াখ নামক এক ছেলেও ছিলো বিদেশে। পড়ালেখাকারী। প্রায় তেরো বছর দুইজনে একসাথে বিদেশে বেশ ভালো বন্ধু হিসেবে থাকছে। আশেপাশের জায়গার বারছে চেনাজানা। আর…’
কেঁদে ওঠেন জুঁই। কথাগুলো বলতে বলতেও একবার চোখ দিয়ে পানি পড়েছে। তনু খেয়াল করেনি। ইশয়াখ নামটা কানে বাজছে তনুর। তনুর কৌতুহল বেড়েছে লক্ষ কোটি গুন! জুঁইয়ের এসব বলা সম্পর্ন নিষিদ্ধ। তবুও মন ভালো করতে বলেছে জুঁই। তনুকে তার বড্ড আপন মনে হয়। হারানো পরিবার,হারানো বোন মনে হয়। শুধু তার সৃতিটুকু মুছেছে!
– তারফর কি আফা?
– আমার বিয়ে হয় ১৯৬২ সালে। তখন বয়স প্রায় নয় কাছাকাছি। পথের ভিখিরি আমি তখন। যে পারতো ঘাই গুতা দিয়া চইলা যাইতো। আমার একটা রোগ আছে অ্যালঝেইমার ডিজিজ! নামখানা আমি জানি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব ক্রমান্বয়ে লোপ পায়। আমারও পাইছিলো। আমি এখন একটু সুস্থ কার জন্য জানো? তূরের জন্য! ওই বিদেশ থেইকা ঔষধ নিয়া আসছিলো। যাইহোক,এই রোগের জন্য আমি কম লাঞ্চনা শুনি নাই। তোমার চাচাশ্বশুর সুবল আমারে মারছে অনেক। রিমি আখতারও আমায় দু চোক্ষে সহ্য করতে পারতো না। কিছু হারাইলেই হইতো আমার দোষ! চোর বদনামও পাইসি আমি! তারপরে কিছুদিন পর তোমার চার চাচাশ্বশুরে উদাও হইয়া যায়। তির্থরে একদিন টেলিফোনে কথা কইতে শুনে ফেলি আমি। সাথে টগর ও ছিলো। তারা নাকি মারা গেছে। আমরা তিনজন আর মোড়ল মসাই ছাড়া এ কথা কেউ জানতো না। এমনকি রিমিও না। তিনজনে কাউরে কই নাই কোনকিছু। চম্পাও কিছু জানে না। জানলা শুধু তুমি। বাকি তিনজনের থেকে আমি ছোট সবচেয়ে। তির্থরও বয়স বেশি আমার থেকে। এটা আমরা জানছি শোনার পর থেকেই ও কু*র বাচ্চা প্রায়ই…! ‘
তবুও তনুর কৌতুহল কমে না। প্রশ্নের মেলা বসে মাথায়।,
– ইশয়াখ? সে কি করলো? ‘
জুঁই শান্ত দৃষ্টি ছুড়ে। সূচকটা বোধহয় প্রশ্নের,
– ইশয়াখ?
– চিনি আমি। আমার মামাতো ভাই। ‘
– তোমার মানাতো ভাই লাগে ইশয়াখ?
– হ।
– ওই তো প্রথমে মোড়ল আর তারপর যখন মাস দুয়েক আগে তূর আসলো। তখন মোড়ল বাবু তূরকে কি না কি বলে হাত করে নিলেন। জড়িত হলো তূরও! ‘
– কিসে জড়িত হইলো।
– আমি জানি না। শুধু জানি শরীরের অংশ কাটে নেয় তারা। ‘
তনুকে বাইরে আনেন জুঁই। আর প্রশ্নবিদ্ধ হতে চান না তিনি। বাইরে আসতেই তনু হেঁচকি তুলে কেঁদে দেয়। তূর পাশে দাড়ায়। তনু জল ভরা চোখ নিয়ে তাকায় একবার।
– চলো বাড়ি যাই। ওনারা লাশকে পর্যবেক্ষন করবেন। তারপর দিয়ে যাবে। ‘
এখানে থাকলে যে সে আর কোনকিছুর উত্তর পাবে না তা ভালো করেই জানে তনু। সে এক কথায় মাথা নারায়। বাড়ি গোছগাজ করে তারা রওনা হয় মোড়ল বাড়ি উদ্দেশ্য।
মোড়ল মইনুল ঠিক করে রেখেছিলেন দুটো ভ্যান। বউরা এক ভ্যানে আর পুরুষা যাবে এক ভ্যানে। ওঠার আগেই তনু কেঁদে দেয়। তাই তূরও সাথে যায় তনুর।

___________
ইশয়াখ ছেলে দুটোকে পরপর দুটো থাপ্পর দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছে। রাগে শরীর রি রি করছে ওর। কত বড় একটা ক্ষতি করে দিয়ে এসেছে। ঘেঁটুটা কতই না কাজে লাগতো। আর সাথে মুগিও? কাজ থেকেই বিদেয় দেওয়া হয়েছে দুটোকে। ইশয়াখ ইশাকে চেঁচায়,
– পুলিশ কি করলো?
– সব তল্লাসি করছে। কিছু করতে পারবে না?
– করতে তো হবেই। গাধাগুলোকে কাজে দিয়েছি। ‘
ইশার চোখ ফোলা ফোলা। সেদিন ইশাকে কঠোর ভাবে বলে সব কথা বের করেছে ইশয়াখ। তাই দেরি না করেই সোজা এ্যাকশনে নেমেছে। হীতে বিপরীত হলো! আজিদ ও বেশ ভালো কাজ করতো। কমলো দক্ষ কর্মী তিনজন! ইশা চলে যায়। লতিফার মরার কথা শুনলেই তার বুক ফেটে কান্না আসছে। ইশয়াখ বের হয় মোড়ল বাড়ি উদ্দেশ্য। কাজ পুরোটাই করতে হবে!

______________
– আমি আগে জানলে জিবনেও এই পড়াশোনা করতাম না! তুমি আম্মাকেও ছাড়ো নাই? তোমার সেই দান করা মন কোথায় আব্বা? শেষ বয়সে পাপের টাকা দিয়ে কি করবে? আব্বা আম্মাকে কবে হসপিটালে নিয়ে গেছিলে? বল! ‘
তূরের কথায় মইনুল মাথা নিচু করে নেন! উনি ধারনা করেননি ইশয়াখ এতগুলো খুন করবে। আজ যাওয়া যাবে না তার কাছে। তার উপর একটু আগে রিমি সবটা জানতে পেরেছেন এবং তূরকে বলেছেন। আর এখন তূর প্রশ্ন তুলছে। উত্তর নেই মইনুলের কাছে। সে নিরুত্তর!
– আব্বা চুপ থাকবেন না। কন আপনি ক্যান এমন করলেন? ‘
– কি জানতে চাস তুই?
– কেন আমায় বিদেশে পাঠালেন?
– দরকার ছিলো?
– টাকার? আজ যদি সাইন্টিস্ট হওয়ার সপ্ন না দেখাতেন,না পাঠাতেন বিদেশে তাহলে কি দেখা হতো ইশয়াখের সাথে? জড়াতে হতো এসবে? আপনিও জড়িত হতেন না কালপিঠ হিসেবে! আর না চাইতেও হতে হতো না আমাকে! ‘
– ভেবেছিলাম, তুই একজন সেরা বিজ্ঞানী হবি। ছোটবেলা থেকেই তুইতো অনেক ভালো মেধাবির তালিকায় ছিলিস! কত প্রজেক্ট করেছিস! আমিকি জানতাম যে ইশয়াখ…! ‘
– আম্মার কেন অপরেশন করালেন?
– বেশি বয়সি একজনের খুব প্রয়োজন ছিলো! আমি টাকার লোভে পড়ে নিয়ে যেতে..
– ছিহ্!
চলে যায় তূর। বিছানায় ধপাশ করে বসে পড়ে মইনুল। খারাপ কাজ থেকে যতই টাকা আসুক না কেন, মন থেকে কখনোই মানসিক শান্তি নামক জিনিসটা আসে না। কলিজা পুড়ছে মইনুলের। সে অপরাধী! দেশদ্রহী অপরাধী!

ঘন্টা দুয়েক পর ইশয়াখ মোড়লবাড়ির দারে উপস্থিত হয়। হেটে আসায় পা টনটন করছে ইশয়াখের! দরজায় দারোয়ান থাকে না। এমনকি মোড়লবাড়ির কোথাও তাকে না কেউ। ইশয়াখ ভেতরে আসে নিশ্চিন্তে। সুপারি গাছের পাশ বেয়ে সূর্যমুখী বাগান পেরোয়। অন্দরমহলে ডোকার আগেই চোখ পড়ে তনুর দিকে। বঠগাছের নিচে মাথা ঠেকিয়ে পাগলের ত্যায় বসে মেয়েটি।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here