#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_১০
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
আফিয়া বেগম বেশ চিন্তিত্ব।তাহসানের ছটফট উনার চোখ এড়ায়নি। মাস ছয়েক পরে ছেলেটার বিসিএস পরিক্ষা,যেই পড়ার জন্য এতো ভালো চাকরি ছেড়ে দিলো এখন সেই পড়া ছেড়ে কি এমন চিন্তায় তাহসান এমন ছটফট করছে এটাই উনার বোধগম্য হচ্ছে না।কিছু দিন ধরেই এমন হচ্ছে,তাহসান কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে,কিছু বললেই রেগে যাচ্ছে।আফিয়া তরকারির কড়াইয়ে কাঠি নাড়তে নাড়তে ভাবে যে’না আর এভাবে চলতে দেয়া যাবে না ছেলের অমঙ্গলের এই কালো ছাঁয়া তাড়ায়ে হবে খুঁজে বের করতে হবে কিসের জন্য তাহসান চিন্তিত্ব’ভাবলেন আজকে থেকে ছেলেকে চোখে চোখে রাখবেন এতে যদি সমস্যাটা সামনে আসে।
তাহসান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী পড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পড়া হচ্ছে না।লাইন টু লাইন পড়ছে কিন্তু মাথায় কিছুই থাকছেনা। আসলে কোনো বিষয় পড়ার সময় কল্পনা করতে হয় যে স্বয়ং নিজেই বইয়ের মাঝে প্রবেশ করেছে,মনের দ্বারপ্রান্ত শুধু তখন বইয়ের মাজেই থাকতে হয় তাহলেই পড়া মনে থাকে,বুঝতে সহয হয় কিন্তু তার মনের দ্বারপ্রান্তে যে আরেকজনের উঁকিঝুঁকি!এইজন্যই তো পড়ায় মন নেই, পড়ার মাঝে বারংবার অমনোযোগী হচ্ছে,বিরক্তিতে মাথার চুল টেনে ধরে টেবিলে মাথা ঠেকায়।সে ছাড়া আর কেউ জানবে না কি অসহ্য যন্ত্রণায় সে দিন কাটাচ্ছে।ইচ্ছে করছে কোথাও চলে যেতে।সে টেবিল থেকে উঠে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে।তার মনে হলো সিলিংয়ে বন্যার হাসিমুখটা ভেসে উঠেছে।তাহসানের বুকটা কেমনতর ব্যাথায় ভরে উঠে সে চোখ বন্ধ করে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে চায় কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বন্ধ চোখের পাতায়ও বন্যার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে।তাহসান চোখ বন্ধ করেই বিরবির করে বললো,
“একবার ভালোবেসেই দেখতে!আমি ভালোবেসে সব কলঙ্গক ধুয়ে মুছে দিতাম।”
তাহসান জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে বুকে হাত রেখে বললো,
“আমার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়,বুকে যন্ত্রণা হয়,সারা শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসে,এসব অসুখের কথা কাউকে বলা যাচ্ছে না,এতো বড়ো ছেলের থেকে এমন অসুখের বিবরণ শুনতে পাওয়া সঠিক না।আমি একটুও ভালো নেই বন্যা একটুও না।”
রেনু বেগম বন্যার দিকে খেয়াল রাখছিলো।এমনিতেই তার মেয়েটা সব মেয়েদের থেকে আলাদা।এখন আরো নিশ্চুপ হয়ে গেছে।সেদিন তাহসানকে বলা কথাগুলো পুরোপুরি শুনতে না পেলেও এটা বুঝতে পেরেছে বন্যা আর তাহসানের মাঝে রাগারাগি হচ্ছিলো।আগ বাড়িয়ে উনি বন্যাকে একটু জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলো কিন্তু বন্যা বলেছে সে এসব ব্যাপারে কথা বলতে চায় না।রেনু বেগম আর জোড় করেনি কিন্তু স্বামীর কাছে গিয়ে বন্যার জন্য পাত্র দেখার তাড়া দেয়।মেয়েদের সঠিক বয়সে বিয়ে না হলে মন মেজাজ ঠিক থাকেনা তাই উনি সিদ্ধান্ত নেয় বন্যাকে অতী দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেবেন।
এই পনেরো দিন বন্যা না কেঁদে একদিনও ঘুমাতে যায়নি আর ঘুম থেকে উঠেছে বুকের মাঝে অজানা চিনচিন ব্যাথা নিয়ে।সে চায়না তাহসান তার সাথে জড়িয়ে যাক কিংবা ভালোবাসুক তাইতো সেদিন মায়ের সামনেই কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু তাহসানের কথা না বলা একবারও দেখা না করাটা বন্যা মানতে পারছেনা।মনের আকুলিবিকুলি সে বেশ টের পায় মন চাইছে তাহসান আসুক জোড় করে হলেও পাশে বসুক,ভালোবাসা আদায় করে নিক কিন্তু সে আসছেনা, ভুল করেও বন্যাকে ডাকছে না।বন্যার দুঃখী মনটা হঠাৎ করে অভিমানী হয়ে গেলো,ঠিক তো ভুলে গেলো তাহলে এতো ভালোবাসা দেখাতে কে বলেছিলো?বন্যা হাসে তাচ্ছিল্য ভরা হাসি;হেসে ভাবে সে ধর্ষিতা এটা জানার পরে কোন ছেলে তাকে ভালোবাসবে এটা আশা করা বোকামী ছাড়া কিছুই না।বন্যা আসলেই বোকা।তখন দুপুর।শুক্রবার হওয়াতে সবাই বাসায় আর এখন সবাই ভাতঘুমে বিভোর।বন্যা ছাদে উঠে যায়,প্রায় পনেরো দিন পরে আজকে ছাদে গেলো,তাহসানের সাথে দেখা হওয়ার ভয়ে ছাদে অবধি আসেনি।আজকে সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে।আকাশের মেঘরাও বুঝি বন্যার আকাশের কালো মেঘের অস্তিত্ব টের পেয়েছে তাইতো বন্যাকে সঙ্গ দিতে সকাল থেকে এই আয়োজন।তাইতো বন্যা বাসায় থাকতে পারেনি বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ যেনো তাকে কানে কানে ডাকছে।সে আস্তে করে সিড়ির দরজা খুলে ছাদে প্রবেশ করে।ছাদের ফ্লোরে পানি জমেছে বন্যা তার ট্রাউজার গুটিয়ে পা ফেলে।হঠাৎ করে ঠান্ডা পানি গা স্পর্শ করতেই সারা শরীরের পশম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায়,জানান দেয় শীত লাগছে।বন্যা অবশ্য এসব তোয়াক্কা করে না,পা ফেলে সামনে যায় বৃষ্টির পানি চিরে চিরে তার গা ছুঁয়ে যাচ্ছে।সে ভাবে কেমন হতো যদি বৃষ্টির পানির সাথে মানুষের সব কষ্ট ধুয়েমুছে চলে যেতো!যদি এমনটা হতো তাহলে এই মূহুর্তে বন্যা হতো সবচেয়ে সুখী মানুষ।বন্যা দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দেয়;তারপর আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়।হঠাৎ মনে পড়ে সেদিন বৃষ্টিতে ভিজার সময় তাহসান পাশে ছিলো আর তাকে পাখির মতো ঘুরিয়েছে।আর সেদিনই বৃষ্টি ভেজা রাতে তাহসান তার এলোমেলো আবদার তার সামনে উপস্থাপন করেছে,এসব ভাবতে ভাবতেই বন্যা হু হু করে কেঁদে দেয়।বৃষ্টির শব্দে অন্যকেউ কান্না শোনার ভয় নেই বিধায় যে জোড়ে জোড়ে কাঁদে।অনেক বছর পরে বন্যা এমন গলা ছেড়ে কাঁদছে।সেই ঘটনার পর থেকেই তো বন্যা পালটে গেলো।সেই ঘটনাটা মনে করেও মনকে বুঝানো যাচ্ছে না যে তাহসানকে ভালোবাসার আশকারা দেয়া যাবেনা বরং প্রথম বারের মতো তাহসানকে নিয়ে তার ভয়ংকর সব ইচ্ছা হচ্ছে।এই যে এখন ইচ্ছা করছে ছেলেটার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে,ঠোঁট উলটে আহ্লাদী হয়ে অভিমানী বাক্যবাণ ছুড়ে দিতে কিন্তু সব ইচ্ছা তো পূরণ হয় না বন্যার এই ইচ্ছাও হবে না।বন্যা কখনো সে আশার বীজ বুকে পুষতেও পারবেনা কারন সে ধর্ষিতা।ঠিক তখনি বন্যা আবিষ্কার করে তার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।সে মাথা ঘুরিয়ে তাকানোর আগেই বুঝে যায় এটা তাহসান ;তাই আর তাকায় না,কান্না তখন বন্ধ,সে হাত দিয়ে মুখ রগরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
তাহসানের কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো বন্যা আজকে ছাদে যাবেই তাইতো সেও ছুটে এসেছে।প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ বেহায়া,বেশরম হয়ে যায় এই কথাটা সে এতোদিন লোকমুখে শুনে এসেছিলো বর্তমানে নিজেকে দিয়েই কথাটার সত্যতা প্রমাণিত হয়।হ্যাঁ;তার অনুমান ঠিক ছিলো সিড়ির শেষ পর্যায়ে এসে দেখলো দরজা খোলা;ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায় কানে আসে মেয়েলী কান্নার শব্দ।চোখ মেলে ছাদের বাম পাশে তাকায়।বন্যা!অঝোর ধারায় কাঁদছে।সে নিঃশব্দে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।মনের কুঠরিতে বাস করা রমনীকে এমন কান্নারত অবস্থায় দেখে তাহসানের ভালো লাগে না।বন্যা বোধহয় টের পায় তার উপস্থিতি তাইতো কান্না থামিয়ে কেমন শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।তাহসান আস্তে করে বললো,
“কাঁদছো কেনো?”
বন্যা সজোরে মাথা নাড়ায় কিন্তু কথা বলে না।কিছুক্ষণ পরে বললো,
“কাঁদছি না।”
“আমি দেখলাম কাঁদছো।”
বন্যা তাহসানের দিকে তাকায় না;না তাকিয়েই বললো,
“আপনি ভুল দেখেছেন।”
তাহসান ঘুরে বন্যার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“তাহলে চোখজোড়া এমন লাল কেনো?হুহ?”
“বৃষ্টিতে ভিজেছি তাই।”
তাহসান হাসে।আত্মবিশ্বাসের সাথে বন্যার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে বললো,
“মিথ্যা বললেই আমি বিশ্বাস করবো কেনো?আমি জানি তুমি আমার জন্য কাঁদছিলে।”
বন্যা চোখ ফেরাতে পারে না;তাহসানের দিকে তাকিয়েই বললো,
“আপনার জন্য কাঁদবো কেনো?”
“আমাকে ভালোবাসো তাই।”
বন্যা রাগতে চাইছে কিন্তু এই মূহুর্তে রাগতে পারছে না।তাহসানের সামনে না চাইতেও কোমল হয়ে যায়,নারীসুলভ ব্যবহার মাথা নাড়া দিয়ে উঠে।তাহসানের কথা শুনে বন্যার মনটা বলে হ্যাঁ আমি ভালোবাসি কিন্তু মুখে বলে,
“কেনো ভালোবাসবো?ধর্ষিতাদের ভালোবাসা কিংবা কারো ভালোবাসার মানুষ হওয়া বারণ।”
ধর্ষিতা!তাহসানের মাথা ঝি ঝি করে উঠে।এই মেয়েটা ইচ্ছে করে এই শব্দটা বারবার ব্যবহার করে নিজেকে ছোট করতে চায়।সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর বললো,
“নিজেকে এতোটা ছোট ভাবো কেনো বলোতো?”
বন্যার বুকের চিনচিনে ব্যথা যেনো তাহসানকে দেখে আরো বেড়ে যায়।মাথা নেড়ে বললো,
“ছোট ভাবিনা কিন্তু সবাই আমাকে তাই ভাবে।”
“কোন সবাই?”
“সবার মাঝে আপনিও আছেন।”
তাহসান অবাক হয়ে বললো,
“আমি!আমি কখন এসব বললাম?”
বন্যা অন্যপাশে ফিরে বললো,
“বাদ দেন তো।”
তাহসান বাদ দেয় না।নাছোড়বান্দার মতো বললো,
“আমাকে নিয়ে এই মনোভাব?”
বন্যা কথা বলেনা।তাহসান বললো,
“আমাকে নিয়ে এসবই ভাবো বুঝি?”
বন্যা তাহসানের চোখের দিকে তাকায় তারপর ফিসফিস গলায় বললো,
“আমার থেকে কেনো দূরে সরে গেলেন?আমি ধর্ষিতা এই কারনেই তো?”
তাহসান অবাক হয়ে বললো,
“তুমি তো এটাই চাইছিলে,।”
বন্যা কন্ঠটা কেমন অভিমানী শোনালো।
“তাই!কিন্তু আপনি তো আর অতীত জেনেই পিছিয়ে গেছেন।”
তাহসানের কন্ঠ কেমন কঠিন শোনায়।
“আমার ভালোবাসা এতোটাও ঠুনকো না,এসব জানার পর পিছানোর মতো মন মানষিকতা আমার নেই।”
বন্যা কোনো কথা বলেনা।তাহসান নিজেই আবার বললো,
“তুমি কাছে আসতে নিষেধ করেছো বলেই আমি কাছে আসিনি আর এটার জন্য ভাবতে হবেনা তোমার কালো অতীত জেনেই কাছে আসছি না।”
বন্যা তাহসানের গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আচ্ছা।”
“এসব ভেবেই কাঁদছিলেন?”
বন্যা স্বীকার করে না বরং দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“না না।”
তাহসান কোমল গলায় বললো,
“একবার ভালোবাসো।সারা জীবন আগলে রাখবো।”
বন্যা কিছু না বলেই বৃষ্টির মাঝেই তাহসানের দিকে কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে।তাহসান ফিসফিস করে বললো,
“আমি ভালো নেই বন্যা।একটুও ভালো নেই।”
বন্যা যেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলো তেমন গলায় বললো,
“আমিও তো ভালো নেই।”
তাহসান সাহস পায়।বন্যার কথায় সরাসরি না হলেও সে উষ্ণতার আভাস পাচ্ছে।
“ভালো থাকার দায়িত্বটা নেই?একটুও খারাপ থাকতে দেবো না।প্রমিস।”
তাহসানের বলার ভঙ্গিমা দেখে বন্যা কিছু না বলে হাসে।তাহসান এতোক্ষণে খেয়াল করে বন্যার শরীরের ভাজ।সাদা শার্ট পরিহিতা বন্যা বৃষ্টিতে ভিজার ফলে শরীরের সাথে শার্টটা লেগে গিয়ে গায়ের কালো অন্তবাস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।সবসময় ঢোলা শার্ট পড়ে বিধায় বন্যার শরীরের গঠন বুঝা যায় না আজকে না চাইতেও তাহসানের সামনে নারী দেহের নমনীয় রূপ ফুটে উঠেছে।তাহসান শুকনো ঢোক গিলে অন্যদিকে তাকায় তারপর আবারো বন্যার দিকে তাকায়।সে অন্য পুরুষদেরমতো নারীদেহ দেখেই চোখের তৃষ্ণা মেটাতে চায় না সে চায় পবিত্রতা;তাদের সবটা জুড়েই যেনো পবিত্রতা থাকে।তার গায়ে গেঞ্জি আছে তাই কোনোকিছু না ভেবেই তার গায়ের কালো শার্ট খুলে বন্যার হাতে দিয়ে বললো,
“এটা পড়ে নাও তো।”
বন্যা তার এমন কাজ দেখে অবাক।
“কেনো?”
তাহসান কিভাবে বলবে বুঝতে পারে না।যদি বন্যা আবার তাকে খারাপ ভাবে?
“মানে তোমার..”
বন্যা মাথা নিচু করে নিজের দিকে তাকিয়ে ছো মেরে তাহসানের হাত থেকে শার্ট নিয়ে অন্যপাশে ফিরে পড়ে নেয়।এই বৃষ্টির মাঝেও তার কান গরম হয়ে গেছে।তাহসান আস্তে করে বললো,
“বৃষ্টিতে ভিজলে ডার্ক কিছু পড়তে হয় তাহল আর এমন হবে না।”
এমন কথায় বন্যা কি উত্তর দেবে খুঁজে পায় না।মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললো,
“আচ্ছা।”
তাহসান বন্যার লজ্জামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমাকে লজ্জামাখা চেহারায় ভিষণ মিষ্টি লাগছে।”
বন্যা অন্যদিকে তাকায় তাহসান বন্যার হাত ধরে বললো,
“বন্যা!”
“এই বন্যা!লিখে ফেলি?”
বন্যা কথার মানে বুঝতে না পেরে বললো,
“কি?”
তাহসান খুব ফিসফিস করে বললো,
“আমাদের ভালোবাসার সূচিপত্র।”
দুজনে হাত ধরে যখন চোখের মাঝে হারিয়ে যাবে তখনি তারা শুনতে পেলো আফিয়া বেগমের ছিটকে আসা গলা।উনি বিষ্ময়ে চিৎকার করে বললো,
“তাহসান!এসব কি?”
চলবে……
সবাই রেসপন্স করবেন।আপনারা রেসপন্স করলে আমার ভালো লাগে।#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_১১
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
আফিয়া বেগম দুপুরে খাবার খেয়ে রুমে যায়।মোবারক সাহেব তখন বিছানায় হেলে শুয়ে পড়েছে।আফিয়া স্বামীর পাশে বসে বললো,
“তাহসানের যেনো কি হয়েছে।”
মোবারক সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি হয়েছে?”
আফিয়া মন খারাপ করে বললো,
“সারাদিন মন খারাপ করে থাকে।টেবিলে বই নিয়ে বসে থাকে অথচ পড়ে না অন্যমনস্ক হয়ে কি যানো ভাবে।”
মোবারক সাহেব আফিয়ার কথা ততোটা আমলে নিলো না;বালিশ বিছানায় ঠিকমতো পেতে শুয়ে পড়ে।
“ছেলেদের একটু আকটু এমন হয়ই।এতো পেরেশানি হয়ো না তো।”
উনার কথায় আফিয়া সন্তুষ্ট হয় না।ভারী মুখে বললো,
“ওর কি আর এমন পাগলামি করার বয়স আছে?কিছুতো একটা গোলমাল আছেই।”
“শোন,ছেলে মেয়ে বড়ো হলে তাদের নিজস্ব একটা দুনিয়া হয় সেখানে নিজ মতামত ছাড়া অন্যকারো মতামত পছন্দ করেনা।তুমিও তাহসানের ব্যাপারে এতো বাড়াবাড়ি করোনা।বেশী সমস্যা হলে সে অবশ্যই বাবা মাকে বলবে।তাছাড়া আমাদের ছেলে ভুল কিছু করবেনা,সে বিশ্বাস আছে।ইনশাআল্লাহ।”
আফিয়া বেগম স্বামীর কথা মন দিয়ে শুনলেও মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় এর কারন তিনি বের করবেনই।মোবারক সাহেব ঘুমিয়ে পড়লে আফিয়া তাহসানের রুমে যায় উদেশ্য কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করা কিন্তু রুমে যে তাহসান নেই!আফিয়া বেগম ছুটে সারা বাসায় খুঁজেন কোথাও নেই।এমন কখনো হয়না;তাহসান কোথাও গেলে উনাকে অবশ্যই বলে যায় তাহলে আজকে বললোনা কেনো?খুব জরুরী কিছু নাকি?আফিয়া দরজা লক করে তড়তড়িয়ে নিচে নেমে যায়।বৃষ্টির কারনে দারোয়ান গেইটের কাছে বসতে পারেনি গ্যারেজে টুল পেতে সেখানে বসে আছে।আফিয়া উনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তাহসান আজকে বের হয় নি।উনার মাথা ঘুরে উঠে।বাসায়ও নেই ;তাহলে গেলো কোথায়?আস্ত একটা মানুষ বাসা থেকে উধাও হয়ে যায় কি করে?সেড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ছাদের কথা মনে হলো।দ্রুত গতিতে ছাদে যায় কিন্তু ছাদে উঠে ছাদের দৃশ্য দেখে উনার মাথা ঘুরে উঠে।বন্যার হাত ধরে তাহসান দাঁড়িয়ে কেনো?তিনি দারাজ গলায় তাহসানকে ডাকে,
“তাহসান এসব কি?”
এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে আফিয়া বেগমকে ছাদে তারা আশা করেনি উনাকে দেখে তাহসান বন্যার হাত ছেড়ে দেয়।দুজনেই হাসার চেষ্টা করে।তাহসান মায়ের কাছে এসে বললো,
“আম্মু! তুমি এখানে?”
আফিয়া বেগম তীর্যক চোখে বন্যাকে দেখে নিয়ে বললো,
“কেনো আমি আসাতে সমস্যা হলো নাকি?”
উনার কথার ধরনে তাহসান আর বন্যা দুজনেই অসস্থিতে পড়ে যায়।বন্যাও এগিয়ে আসে তখনো তার মুখ হাসি হাসি।তাহসান এখনি বন্যার ব্যাপারে তার মাকে বলতে চাচ্ছে না আগে দুজনের মনের আনাগোনা বাড়ুক পরে না হয় বলা যাবে।সে মাথা নেড়ে না করে মুখে বললো,
“আমরা একটা চুক্তি করছিলাম তখন;এখন তুমি এলে ভালোই হয়েছে,তুমি চুক্তির সাক্ষী হবে।”
আফিয়া বেগম বুঝতে পারে না উনার ছেলে কিসের চুক্তির কথা বলছে।ভ্রু খানিক কুঁচকে জবাব দিলেন,
“কিসের চুক্তি?”
তাহসান গাল ভরে হেসে বললো,
“বন্ধুত্বের চুক্তি।”
আফিয়া বেগম অবিশ্বাস্য চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই মেয়ে তোর বন্ধু?”
“হ্যাঁ।ওরও বৃষ্টি পছন্দ আমারো।
ওরও ঘুরতে পছন্দ আমারো
ওরও পাহাড় পছন্দ আমারো।আমাদের দুজনের এমন অনেকগুলো মিল আছে তাই দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা বন্ধু হবো।হাতে হাত রেখে প্রমিস করছিলাম।”
তাহসানের কথাগুলো উনার বিশ্বাস হতে চায় না কিন্তু উনার ছেলে মিথ্যা বলার মতো ছেলে না;তাছাড়া তাহসান যেভাবে বললো মনে হয়না মিথ্যা বলছে।মানুষ সাধারনত মিথ্যা বললে থেমে থেমে কথা বলে কিন্তু তাহসানকে দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যই বলছে।উনি বন্যার দিকে তাকিয়ে দেখে বন্যাও হাসি মুখে তাকিয়ে আছে।আফিয়া বেগম দুজনের ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভিজে ভিজে বন্ধুত্ব করতে হয়?”
তাহসান কি বলবে খুঁজে পেলো না।ঠোঁট উল্টে বললো,
“হয়ে গেলো তো।”
তাহসান শুধু গেঞ্জি পড়ে আছে।তাহসানের শার্ট যে বন্যার গায়ে এটা উনি বুঝতে পারলো না কারণ বন্যা লম্বায় প্রায় তাহসানের সমান তাই শার্টটা পুরোপুরি না লাগলেও হঠাৎ দেখে বুঝার উপায় নেই যে এটা অন্যকারো শার্ট।যেহেতু বন্যা সবসময়ই শার্ট,টিশার্ট পড়ে তাই আফিয়া বেগম বুঝতে পারলো না নদীর জল উল্টো যাচ্ছে।উনি তাহসানের গেঞ্জি গায়ে ছাদে আসা নিয়ে বিরক্ত হলেন,তার উপর একটা মেয়ের সামনে এমন করে দাঁড়ানোর মানে হয়?
“তুই গেঞ্জি পড়েই চলে এসেছিস?বাসায় শার্ট নেই?”
মায়ের এমন প্রশ্ন শুনে না চাইতেও তাহসান বন্যার দিকে তাকিয়ে ফেলে।
“বৃষ্টিতে ভিজবো বলেই এভাবে এসেছিলাম।”
“আচ্ছা অনেক ভিজেছিস বাসায় চল,আজকে নির্ঘাত জ্বর আসবে।”
তারপর বন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তাহিয়া তো তোমার কাছে ছাড়া অন্যকারো কাছে পড়তে চাইছে না যদি সম্ভব হয় পড়াতে এসো।”
বন্যা আলতো হেসে বললো,
“দেখি আন্টি।”
তারপর আফিয়া বেগম তাহসানকে নিয়ে নিচে নেমে যায় নামার আগে অবশ্য তাহসান ফোন ধরার জন্য ইশারা দেয় আর বন্যাকে অবাক করে দিয়ে টুক করে বাম চোখটা টিপে দেয়।তাহসান চলে যাবার পরেও বন্যা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।তাহসান বেশ পাগলামি করছে এই যে একটু আগে চোখ মে রে বন্যার বুকে শীতল বাতাস বয়িয়ে দিয়ে গেলো।গায়ের শার্টটা যেনো সারা শরীরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে;বন্যা কেঁপে কেঁপে উঠে হাত দিয়ে খামচে ধরে শার্টের কোনা।দ্রুত পায়ে বাসার দিকে ছুটে এই শার্ট না খুলা অবধি নিস্তার পাবেনা।
আফিয়া বেগম বাসায় এসে রুমে যায়।মোবারক সাহেব তখন জেগে গেছে আফিয়া বেগমকে দেখে বললো,
“কি ব্যাপার কই গিয়েছিলে?এতো ডাকলাম কোনো সাড়া নেই।”
আফিয়ার মুখ অন্ধকার করে বললো,
“ছাদে গিয়েছিলাম।”
মোবারক সাহেব উঠে বসে।
“এই বৃষ্টির মাঝে ছাদে?”
“তোমার ছেলে গিয়েছিলো তাই গিয়েছিলাম।”
“অহ!তাহসান;ছেলে মানুষ ভিজতে ইচ্ছে হয়েছে হয়তো।”
আফিয়া বেগম অভিযোগের সুরে বললো,
“ভিজতে গিয়েছে আর বন্ধুত্বও করেছে।”
মোবারক সাহেব স্ত্রীর কথা বুঝতে পারলেন না
“কিসের কথা বলছো।”
“তোমার ছেলে নাকি বন্যার সাথে বন্ধুত্ব করেছে।এই বেয়াদব,উড়নচণ্ডী মেয়েটা নাকি তোমার ছেলের বন্ধু,কি চয়েস।”
মোবারক সাহেব স্ত্রীর ভাব ভঙ্গিমা দেখে বললেন,
“যাই বলোনা কেনো বন্যা কিন্তু ততোটাও খা,রাপ মেয়ে না।তাহসানের যদি মনে হয় বন্ধু বানানো যাবে তাহলে যাবে।আমার ছেলে বিচক্ষণ।”
আফিয়া স্বামীর কথায় সায় পায় না।মন খারাপ করে চিন্তিত্ব গলায় বললো,
“ওরা যদি প্রেম করে ফেলে তো?আমার কিন্তু একটাই ছেলে কতো শখ আহ্লাদ আছে।”
মোবারক সাহেব স্ত্রীর চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো,
“প্রেম করলে করবে।”
আফিয়া ক্ষেপে যায়।চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“অসম্ভব!বন্যার সাথে আমার ছেলের এসব হতে দেয়া যাবেনা।তুমি যানোনা বন্যার কাহীনি,অতীত ভুলে গেছো?”
মোবারক সাহেব কিছু বলেন না চিন্তিত্ব চোখে বাহিরের দিকে তাকায়।
রাতে তাহসানের গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে।জ্বরের মাঝেই বন্যার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।মানুষ অসুস্থ হলে তার প্রিয় মানুষের সানিধ্য চায়।আর তাহসানও এই মূহুর্তে বন্যার সানিধ্য চাইছে।সে কাথা গায়ে দিয়ে বন্যার নাম্বারে ফোন দেয়।কয়েকবার রিং হওয়ার পরে বন্যা ফোন রিসিভ করে।তাহসানের গলার স্বর জড়ানো।
“বন্যা!”
বন্যা তখন তাহসানের শার্টটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছে।শার্টটা তার হাতে থাকার কারণেই কিনা মনে হচ্ছে ঘরটা তাহসানের সুভাসে ভরে আছে আরো মনে হচ্ছে তাহসান এখানেই আছে।রাত তখন দশটা তাহসানের ফোন দেখে রিসিভ করে।তাহসানের জড়ানো গলার স্বর শুনতে পায়।আজকে তাহসানের গলায় তার নামটা শ্রুতিমধুর লাগছে।আস্তে করে বললো,
“শুনছি।”
তাহসান বাচ্চাদের মতো করে বললো,
“আমার খুব জ্বর।”
বন্যা চমকে যায় আন্টি বলেছিলো জ্বর আসবে তাই বলে সত্যি সত্যিই আসলো?
“বেশী?”
বন্যার কন্ঠ শুনে তাহসান যেনো গলে যায়।
“তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“দুপুরে না দেখা হলো।”
তাহসান আবদারের সুরে বললো,
“এইটুকু দেখাতে হয়?আরো মন ভরে দেখা চাই।”
বন্যা বুঝলো তাহসানের মাথা ঠিক নেই।
“ওষুধ খেয়েছেন?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে ভালো হয়ে যাবেন।এখন মোবাইল রেখে চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা করেন।”
তাহসান বললো,
“ঘুমাতে পারছিনা তো।”
“চোখ বন্ধ করে রাখেন ঘুম চলে আসবে।”
তাহসান দুষ্টু গলায় বললো,
“টিনেজাররা প্রেমিকের জ্বর হলে কি করে জানো?”
বন্যা হেসে বললো,
“জানিনা,প্রেম করিনি কখনো।”
“চুমু দিয়ে জ্বর সারিয়ে তুলতে চায়।”
“তো?আমাকে এসব বলছেন কেনো?”
“আমি তোমার প্রেমিক না!এই ট্রিকটা এপ্লাই করাই যায়।”
বন্যা শক্ত গলায় বললো,
“আমি কখন বললাম আপনি আমার প্রেমিক?”
তাহসানের হাসিমুখ ঠুস করে চুপসে যায়।
“আমি তোমার প্রেমিক নই?”
“না।”
তাহসান নিশ্চুপ হয়ে যায়।কি বলা যায় খুঁজে পাচ্ছেনা।মেয়েটা কেনো বুঝেনা বুকে হাজারো আগুনের শিখা লকলক করে জ্বলছে।সে আস্তে করে বললো,
“আমি তোমার কি হই বন্যা?”
বন্যার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।ছেলেটার কন্ঠ আজকে এতো ভালো লাগছে কেনো?মনে হচ্ছে কথাগুলো তার কানে না বুকে দিমদিম করে লাগছে।তাহসানের এমন প্রশ্নে কি উত্তর দেয়া যায় বুঝতে পারে না।ভেবেচিন্তে বলল,
“জানিনা।”
“তুমি আমার কি হও জানো?”
বন্যা শুনতে চায় সে তাহসানের কি তাইতো বললো,
“কি?”
“আমার ভবিষ্যত বউ।”
বন্যা চুপ করে থাকে।এই ছেলেটা নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে।
“আপনি পাগল হয়ে গেছেন।”
তাহসান শব্দ করে হেসে বললো,
“হ্যাঁ।কিন্তু তুমি সেটা বুঝতে চাইছো না।”
বন্যার মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠে।মুখে বললো,
“রাখছি।ঘুমান।”
তাহসান বললো,
“শোন।”
“কি?”
“একবার বলো শুনে বুকের তৃষ্ণা মেটাই।”
বন্যা তাহসানের কথা না বুঝে বললো,
“কি বলবো?”
তাহসান ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসি।”
বন্যা তাহসানের মতোই ফিসফিস করে বললো,
“না।”
তাহসান আবদার করে বললো,
“একবার প্লিজ।”
“না,না।”
“আমিই বলি তুমি শোন।”
বন্যা নিশ্চুপ হয়ে থাকে।সে শুনতে চায়।নিজের বলতে সংকুচ হলেও তাহসানের মুখে এমন বাক্য শুনতে নিশ্চয়ই খারাপ লাগবে না।
তাহসান ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসি লক্ষীটা।”
চলবে….
❝অসুস্থ হলে কার কার প্রিয় মানুষের কাছে থাকতে ইচ্ছে করে?❞
❝আপনারা রেসপন্স করেন প্লিজ।তাতে আমার লিখতে ভালো লাগে।একটা লাইক কিংবা কমেন্ট করতে একটু সময় লাগে আর আমি ঘন্টার পর ঘন্টা লাগিয়ে গল্প লিখি একটা লাইক,কমেন্ট তো পেতেই পারি তাই না?❞
❝সকলকে ভালোবাসা।❞