তুমিময় প্রেম পর্ব শেষ

#তুমিময়_প্রেম ❤
#LAST_PART
#FABIYAH_MOMO
(অংশ-১)

১৫.
— আমারে মাফ কইরা দেন স্যার, আমি আর কোনোদিনও মাইয়া মাইনষের দিকে তাকামু না, আমার ভালা শিক্কা হইছে স্যার..আমারে মাফ কইরা দেন!!
মুগ্ধ দরজা খুলে একদফা অবাক হলো। ড্রাইভার হাটুগেড়ে মাফ চাইছে কেনো? কিছুতেই সমীকরন মিলাতে পারছে না।
— আরে আপনি মাফ চাইছেন কেনো? কি হয়েছে? কিসের জন্যে মাফ চাইছেন?
ড্রাইভার এগিয়ে মুগ্ধের দুইপা ধরে আকুতিমিনতি করছে। এখনো বুঝতে পারছেনা সে।
— আরে আরে পা ধরছেন কেন! আচ্ছা পাগল তো দেখছি! আপনাকে বলছিনা উঠুন! কিসের জন্য মাফ চাচ্ছেন?
— স্যার আমার ভুল হইয়া গেছে স্যার…আমি ম্যাডামের দিকে ভুলভাল নজরে তাকাইছিলাম, স্যার গো কানে ধরছি, আমি আর মাইয়া মাইনষের দিকে খাসড়া নজরে তাকাইতাম না। সকল মাইয়াগো মা ডাকুম স্যার..

মুগ্ধের মাথায় রাগ চটে এলো! এক লাত্থি দিয়ে দূরে সরিয়ে ড্রাইভারের কলার চেপে ধরলো! ড্রাইভার দুইহাত জোর করে মাফ চাইছে, কাদছে, ভুলের জন্য পস্তাচ্ছে..মুগ্ধের সেদিকে নজর নেই একবিন্দু! বেধড়ক পেটাতে শুরু করলো! মারতে মারতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও মুগ্ধের একনাগাড়ে ঘুষি দেওয়া থামছেনা। রাস্তার আশপাশে ছোটখাট জটলা পাকিয়ে গেছে, ছোট ছেলেমেয়েরা উৎসুক নজরে দেখছে, বিল্ডিং থেকে মহিলা-কিশোরীরা বারান্দা ধরে, জানালা খুলে মুগ্ধের পেটানো অবস্থা দেখছে। কিছু এলাকাবাসী মুগ্ধের কাছ থেকে ঘটনা শুনে পুলিশ ডেকে ড্রাইভারকে তুলে দিলো। মুগ্ধ হাপাতে হাপাতে কপালের ঘাম কনা মুছে ভেতরে গিয়ে সোফায় বসলো। বোতলে মুখ লাগিয়ে সবটুকু পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে রামিমকে কল করলো,

— হ্যালো,
— বস হাপাচ্ছো কেন? এনিথিং রং?
— নাহ্ না, আ’ম ওকে। ও ঠিকমতো পৌছেছে? কোনো সমস্যা হয়নি তো?
— বস ভাবী কে উনার বাসায় সহি সলামত পৌছে দিছি। টেনশন নিও না। তুমি হাপাচ্ছো কেন প্লিজ লুকাইয়ো না! বলো?
— ড্রাইভার শালা! তোর ভাবীকে দেখে রক্ত গরম করছে! খারাপ ইশারা নাকি দিয়েছে!হারামজাদাকে দিছি ধোলাই! জবাই করতে পারলে কলিজা ঠান্ডা হতো! তার আগেই পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে..
— কি ডেন্জারাস! ভাবী তো আমাকে কিছুই বললো না!
— তোর ভাবী নিজেই একটা ডেন্জারাস পাব্লিক! সমস্যার কথা মুখে বলবে? তার আগেই শালাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিছে..
— কি বলো! ভাবী শিক্ষা দিছে?
— ইয়েস ডুড, শালার একেবারে জায়গামতো ইট ছুড়ে মেরেছে! বুঝতেই পারছিস বেচারা কোন লেভেলের পেইনে ছিলো?
— মাই গড! হালকা ঘুষিতেই কাম মাতাম হয়ে যায়! এইদিকে ভাবী তো দেখি পুরাই হিটলার!
— আমি তো এমনে এমনেই এই মেয়ের প্রেমে পড়িনি। হকিস্টিকের বারি কিন্তু এখনো করে,
— হা হা বস! আমি জীবনেও ভুলবো না! ভাবী যেই ঘুরান ঘুরাইছে! অন্য মেয়ে হইলে এতোদিনে তুমি তিনবাচ্চার বাপ থাকতা!
— ধুর ব্যাটা! কি যে বলিস না! মেয়েটার খেয়াল রাখিস। ওর কিচ্ছু যেনো না হয়! কোনো সমস্যা হলে জানাবি! হেড স্যারকে বলে দিছি ওর থেকে কোনো এমাউন্ট না নিতে। যা লাগবে আমি দিবো। তুই জাস্ট এটা কনফার্ম করিস ও যেনো স্কলারশিপ ভাবে! আমার হাত আছে ও ভুলেও যেন না জানে!
— টেনশন করো কেন বস? রামিম থাকতে এইসবের চিন্তা করা লাগবেনা। আমি আছি।

মুগ্ধ মৃদ্যু করে হাসলো। এই হাসির তৃপ্তিটা রামিম জানলো না। অদৃশ্য এক গোপন খামে ঢেকে রাখলো বিশ্বাসের সেই আবেগটা। বুন্ধু নামক আশ্বাসের সাথে যত্ন করে রাখলো ভরসাটা। মুগ্ধ এবারও রামিমকে বুক ফাটিয়ে বলতে পারলোনা, ‘তুই না থাকলে কি হতো দোস্ত?তুই ছিলি! তুই আছিস! জানি তুই থাকবি!’

১৬.
রাতের পর রাত বইয়ে মুখ ডুবিয়ে জোরদার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফাইনাল পরীক্ষা বলে কথা! রেজাল্টটা ভালো হলে নিজেই গড়তে পারবো উজ্জ্বল ক্যারিয়ারটা! এখন আর মুগ্ধের শোকে শোকে রাত্রি কাটেনা, একাকিত্ব দুঃখ দুর্দশায় মন বিষন্ন হয়না। ‘ব্যস্ত’ — নামক দুটি শব্দের কাছে ইতি টেনেছি অনুভূতির! দাবিয়ে দিয়েছি জীবনের সুক্ষতম সুখগুলি। ইসরাত নামক ফ্রেন্ডশিপ আর নেই। ত্যাগ করেছি তাকে, ভুলে গিয়েছি বহুদিন আগে। ক্যাম্পাসটা এখন শূন্যতায় ভরপুর খরার ন্যায় শুস্ক থাকে। সিনিয়রদের র‍্যাগিং ক্যাপাসিটি নিয়ে জুনিয়রদের ভয় নেই বললেই চলে। সবাই যার যার মতো আড্ডা দিচ্ছে, হৈচৈ করছে, নিয়ম ভাঙ্গছে, গুন্ডামি করছে। কিন্তু রাদিফ মুগ্ধের মতো কিলিং এসপেক্টস গুলো নেই আর ক্যাম্পাসের মাঠে। নেই ওর মতো ভাব গাম্ভীর্য মুখ, নেই কোনো দ্বিতীয় ক্যাম্পাস কাপাঁনো মুখরিত লোক! জেনি, রিমি এখন আমার সাথেই চলাফেরা করে। ওদের পোশাক আশাকে এতোদিনে সুশীল সভ্যতা ধারন করেছে। রামিমের উটকো পাগলামিতে কত যে ওকে চড়-থাপ্পর দিয়েছি! তবুও মনেমনে বড্ড হাসি রামিমের সেবাগুলিতে। ছেলেটা ভীষন ভালো। আই উইস সবার মনটা যদি ওর মতো ভালো হতো। তন্ময়, আহাদ এবং নাসিফের ঘটনা আরেকদিন বলবো। আজ না। এই তিনজন আমার জীবনের ঘোর শত্রু বলা চলে। মুগ্ধ এদের ছেড়ে দিয়েছেন ভাবতেই কেমন জানি লাগে। কিন্তু আমি তো সহজে অতীত ভুলিনা!! তাই মুগ্ধকে দেওয়া প্রতিটা পেটানোর দাগ! মন থেকে মুছিনা!!

আব্বুর সাথে কথা কম বললেও আব্বু নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ ছাড়েন না। আম্মু এখন নেতিয়ে গেছেন বয়সের ভারে, সংসারের টানাপোড়নে। ছোটটা আমার বড় হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। প্রতি সপ্তাহে একদিন এসে আমার সাথে হাইট মাপবে। কতটুকু উচ্চতা ছাড়িয়ে টগবগ করে লম্বা হচ্ছে ইনিয়েবিনিয়ে খোচা মারে। আমি খিলখিল করে হাসি। কিন্তু রুমে গেলেই হাসির খোলস খুলে ডাস্টবিনে ছুড়ে মারি। ভালো থাকার অভিনয় আর কতো? আমি ভালো নেই — কথাটা সহজ হলেও বলার বিন্দুটুকু শক্তি নেই! কেন জানি মনেহয়, মানুষ আমায় বুঝবেনা! মূল্য করবেনা! শ্রদ্ধা তো দূরে থাক! কথা পেটে হজম করবেনা!

১৭.

শীতের সকালে উষ্ণ কফির কাপে ঠোট ছুয়িয়ে খাচ্ছে মুগ্ধ। ধোয়া উঠা গরম কফির মগটা আবদ্ধ আছে দু’হাতের বন্ধনীতে। গায়ে ভারী পশমী চাদর, গলায় কালো মোটা মাফলার। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে দেখছে ম্যান হ্যাটান শহর। নরম ঠোটদুটিতে কফির পানীয় শুষে নিতেই চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে প্রহর। সেদিনের প্রহর! যখন তার পাশে স্বপ্নের মেয়েটি ছিলো। পাগলের মতো খুজতে খুজতে একটি বিশেষ দিন উপহার দিয়েছিলো। মনে পড়তেই শিরশির করে উঠে মুগ্ধের লোমস্তর। কি অদ্ভুত সেই উষ্ণ অনুভূতি। কত সুখময় সেই ঠোঁটজোড়ার ছোয়া। শেষ বিদায়ের বেলায় শক্ত করে চেপে ধরে ঠোট ডুবিয়ে দিয়েছিলো পাগল মনটা। মুগ্ধ পিটপিট করে চোখ মেলে বরফ পড়ার দৃশ্যটা দেখে। কফির মগটা রেলিংয়ে রেখে দুহাতে চাদরটা ঘন করে টানে। বারান্দা থেকে নিচে তাকাতেই চোখ পড়লো একজোড়া নব্য দম্পতির দিকে। বরফ পড়া আবহাওয়াতে মানুষশূন্য একটি বেন্ঞ্চিতে তারা বসেছে। মেয়েটি শীতে কাপছে বিধায় ছেলেটা গায়ের শোয়েটার খুলে মেয়েটার শরীরে জড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার কত অভিমান! সে সোয়েটার নিবেনা! বারবার হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে! ছেলেটাও নাছোড়বান্দার মতো প্রতিবার গায়ে সোয়েটার জড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার ক্ষুদ্র অভিমানে ছেলেটা মিটিমিটি হাসলে মেয়েটা আরো রেগে উঠে। মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালে ছেলেটা ব্যস্ত হয়ে মেয়েটার সামনে হাটুগেড়ে কান ধরে বসে। দূর থেকে মুগ্ধ এসব দৃশ্য দেখে প্রফুল্লচিত্তে হাসছে। কফির কাপটা হাতে তুলে ঠোট বসিয়ে চুমুক দিতেই দেখল মেয়েটা টুস করে চুমু খেতে লাগল। উহু! এই দৃশ্য দেখা চলবেনা! প্রাইভেসির ব্যাপার বলে কথা! তাছাড়া মুগ্ধের বুকে চিনচিন করে আলাদা ব্যথা শুরু হলো। এই ব্যথা সহজে ছাড়বেনা বুঝতে পারলো। সে কফি খেতে খেতে ভেতরে চলে গেল। সোফায় ল্যাপটপ অন করে কনফারেন্স এটেন্টের প্রস্তুতি নিতেই ক্রিং ক্রিং ঘন্টা বাজল। খুবই আভিজাত্য বেলের শব্দ। মুগ্ধ ঠোঁটে কফির চুমুক বসিয়ে বললো, ‘কাম ইন!’
— থ্যাংক ইউ মিস্টার।
— মাই প্লেজার বিউটিফুল লেডি।

ধবধবে চামড়ার সুন্দরী একটা যুবতী প্রবেশ করলো। যুবতী মেয়েটা হোটেলটার মালিক হলেও কোনো এক বিশেষ আর্কষনে বিশেষ ব্যক্তির জন্য চাকরানীর বেশভূষা ধরেছে। মুগ্ধ ব্যাপারটা জানেনা এবং জানার জন্য তার মধ্যে কোনো অনুভূতিও নেই। মেয়েটার নাম মার্থা ক্রুজ। মার্থা আজ সুন্দর পরী সেজে দুপুরের লান্ঞ্চ ট্রলি সাজিয়ে এনেছে। সুযোগ মতো ব্যস্ত মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে মুচকি হাসছে। মার্থা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আজ রাদিফ মুগ্ধকে মনের কথা বলেই ছাড়বে! আর কতো অপেক্ষা করবে? দেখতে দেখতে পাচঁটা বছর পেরিয়ে যাচ্ছে বাট মুগ্ধ নিজে থেকে প্রোপ্রোজ করেনা। প্রোপ্রোজ করলে কত চমৎকার হতো! মার্থা হাসিমুখে নব্য কিশোরীর মতো লাজুক ভঙ্গিতে মুগ্ধের টেবিলে ভেজ-রোলসের প্লেটটা রাখলো। মুগ্ধ একবার খাবারটির দিকে তাকিয়ে আবার ল্যাপটপে মগ্ন হলো। মার্থা মুগ্ধের এটেনশন সিকের জন্য খুক খুক করে কাশলো। একবার, দুইবার, শেষে তৃতীয়বার কাশতেই মুগ্ধ ল্যাপটপ বন্ধ করে বললো, ‘ইয়েস?’
— হ্যালো হ্যান্ডসাম। একচুয়েলি আই ওয়ান্ট টু স্যা সামথিং। ক্যান ইউ গিভ মি সাম মিনিটস?
— ইয়াহ্ সওর। প্লিজ স্যা,
মার্থা মুগ্ধের সামনে হাটুগেড়ে গোলাপ ফুল এগিয়ে বললো,
— আই লাভ ইউ মিষ্টার রাড। আই ওয়ান্ট টু মেরি ইউ। উইল ইউ মেরি মি? প্লিজ একসেপ্ট মাই কর্ডিয়াল লাভ হ্যান্ডসাম।
মুগ্ধ আশ্চর্যের চোখে দাড়িয়ে পড়ে। মার্থা এখনো হাটুগেড়ে বসে আছে। মুগ্ধ কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো মার্থার সিচুয়েশন বুঝতে। মার্থার হাত থেকে গোলাপ ফুলটা নিয়ে ঘ্রাণ নিলো মনভরে। মার্থার ফুল একসেপ্ট করাতে মার্থা নিজেকে সবচেয়ে সুখী হিসেবে দাবি করতে লাগল। মুগ্ধ ফুলটা মার্থার হাতে গুজে দিয়ে বললো,

— থ্যাংক ইউ বিউটিফুল লেডি ফর দিস রোজ। বাট আ’ম সরি, আই কান্ট মেরি ইউ। আই হেভ হেভ টু ডাউন ইউর প্রোপ্রোজাল প্রিটি।

মার্থার ঠোট থেকে হাসি মিলিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। আহত কন্ঠে বললো,
— হোয়ায়? হোয়াটস দ্যা রিজন বিহাইন্ড দিস ডিসিশ্যান? প্লিজ ডোন্ট মেক ইট হারি। ইফ ইউ ওয়ান্ট সাম টাইম, প্লিজ টেক। বাট ডোন্ট রিজেক্ট মি অর মাই প্রোপ্রোজাল রাড। আই লাভ ইউ।
— আ’ম এ্যা ম্যারিড গায় বিউটিফুল লেডি। আই লাভ সামওয়ান। আই লাভ মাই গার্ল। সি মিন্স টু অল ফর মি। আই কান্ট একসেপ্ট ইউ।
— দ্যা গার্ল ইউ লাভ ইজ সি এ্যালাইভ? হোয়ায় আর ইউ টেলিং লাই রাড? দ্যাট গার্ল ডাজেন্ট একজিস্ট! আই নো ইউ আর লায়িং!
— নো আ’ম টেলিং দ্যা ট্রুথ। আই হেভ মাই লাভ! মাই ওয়াইফ। প্লিজ গো আউট! লিভ মি এলোন মার্থা!
— প্লিজ ডোন্ট লেট মি ডাউন রাড। প্লিজ।
— আ’ম সরি প্রিটি লেডি। আ’ম রিয়েলি ভেরি সরি।
মার্থা কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে গেল। মুগ্ধ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। পায়ের নিচ থেকে ভাজ করা ব্ল্যাঙ্ককেট নিয়ে গায়ে জড়ালো। মনটা আবার ব্যথা পাচ্ছে। বুকে ব্যথার শিহরন শুরু হলেই চোখ ছলছল হয়ে আসে। মাথার নরম বালিশটির নিচে হাত দিয়ে কিছু বের করে আনলো। দুইহাতে জিনিসটা ধরে চুমু বসালো। মনেমনে বলতে লাগলো, দেখছো আরো একটা মেয়ে এসে তোমার মুগ্ধকে প্রস্তাব দিলো। আমার খুব খারাপ লাগে বুঝছো! এভাবে একটা মেয়ের মন ভাঙ্গতেও আমার খুব খারাপ লাগে। তুমি কিভাবে আছো জানিনা। কিন্তু তোমাকে ছাড়া দিনের শুরু হয়তো আমার কখনোই হয়না। একটু আগে একটা কিউট কাপল দেখে মনটা ভালো লাগল, আবার বিষাদে ঘনীভূত হয়ে মনটা নিঃস্ব হয়ে গেল। কি যে বিরাট জ্বালা! কোনো কাপল দেখলেই তোমার শূন্যতা অনুভব হয়। কোথাও গেলে তোমাকে ছাড়া যেতে হয়। কাউকে বলতেও পারিনা আমার ওয়াইফ বেঁচে আছে ভাই। আমি নিজেকে মিথ্যে বলে ম্যারিড দাবী করিনা। আমার বেডের পাশের জায়গাটা, গাড়ির পাশের সিটটা, রেস্টুরেন্টের পাশের চেয়ারটা সদা সর্বদা তোমার জন্য খালি রাখি। নিজের মনের মধ্যেও তুমিময় নামক জায়গাটা খালি। আমি পাঁচটা বছর পার করে ফেলেছি পাকনি। পাচঁটা বছর! এই পাচঁ বছরে প্রতিটা সময়, প্রতিটা মূহুর্ত, প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে আমি তোমায় স্মরন করেছি। কত স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে থাকার আশা বুনি! যার কোনোদিন শেষ নেই। মুগ্ধ তো তোমারই। প্রমিসটা সে কখনো ভঙ্গ করবেনা। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ মাই ওয়াইফ!

এ্যালবাম সাইজের লেমিনেট ছবিটা বুকে রেখে ঘুমিয়ে পড়লো মুগ্ধ। আজ দুপুরে খাওয়া হবেনা একবারো। মুগ্ধ ঘুমের মধ্যে ‘লাভ ইউ লাভ ইউ ‘ উচ্চারণ তুলে বিড়বিড় করে ঘুমিয়ে গেলো।

১৮.

চারটা বছর পার হলেও বাংলাদেশে গ্রীষ্মের প্রকট থেকে কখনো পার পাওয়া সম্ভব না। যেভাবেই হোক গ্রীষ্মের উষ্ণতা পোহাতেই হবে। ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দাপুট মার্কা গরমে ছাতা হাতে হাটছে মম। মাথার চুল ঘেমে কানের পাশ দিয়ে চুয়ে চুয়ে পানি ঝরছে। রাস্তার দুধারে ভালোই পসরা সাজিয়েছে ঠান্ডা শরবত বিক্রেতারা। দোকানে কাস্টমারও আজ তুলনামূলকভাবে বেশি। শাড়ির আচঁলে বারবার মুখ মুছছে মম। গন্তব্যে পৌছতে পারলেই ঠান্ডা পানিতে গা ভাসিয়ে গোসল দিবে কঠিন সিদ্ধান্ত। এই গরমের প্রচন্ড যন্ত্রণা একদমই সহ্য হয়না ওর। বিশ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে বড় একটা গেট দিয়ে ঢুকলো সে। বড় বড় অক্ষরে স্পষ্ট করে লিখা, ‘হাফেজা অরফানেজ’। একঝাঁক বাচ্চার দল ঘিরে ধরতেই ছাতাটা বন্ধ করে ব্যাগ খুললো। পনের-বিশটার মতো চকলেট বের করে সবাইকে ভাগযোগ করে বিলিয়ে ভেতরে গেল। দূর থেকে একজোড়া চোখ দূরবীন দিয়ে ফলো করছিলো বহুক্ষন যাবৎ। মম হাসিখুশি ভেতরে ঢুকে যেতেই স্বস্তির ভারী নিশ্বাস ছাড়লো। চোখ থেকে দূরবীন সরিয়ে গাড়ির সিটে মাথা হেলে বললো,
‘ বস আপনার জন্য এখনো কষ্ট পায় ভাবী! আপনি একটাবার ওয়াদার বিরুদ্ধে বসকে ডাকতেন! বস সব ফেলে চলে আসতো! আফসোস!’

আয়নার সামনে ভেজা চুলে তোয়ালে ঘষছে মম। চুল বেয়ে ঝরে পানি চুয়ে চুয়ে ফ্লোরেও পড়ছে টপটপ। আনমনে চুল মুছতেই হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত করলো। চুলে তোয়ালে মুড়ে দরজা খুললে দেখে একটা লোক কিছু কাগজ এগিয়ে দিচ্ছে। পরিচয় দিলো পিয়নের লোক। মম কাগজগুলো নিয়ে দরজা আটকে বিছানায় বসে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। কাগজগুলোতে ওর আব্বুর হাতের অক্ষর বসানো। তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে মেয়ে উদ্দেশ্যে চিঠি পাঠিয়েছেন নিয়ম মতো। চিঠির প্রথমেই বড় করে প্রিয় বাক্য লেখা, ‘আমার মা’, পড়তে বুকে চাপাকষ্টের ব্যথা অনুভব করলো।

আমার মা,
কেমন আছিস রে? কতদিন তোকে দেখিনা, চোখদুটো এখন জ্যোতি হারিয়ে ফেলেছে মা। আমি বুড়ো হয়ে গেছি হাঁটতেও পারিনা। তোর আম্মু ধরে ধরে বাথরুমে বসায়। তোর ভাইটা এখন ভালোই ব্রিলিয়ান্ট হয়েছে জানিস? সবসময় বলে আমি মম আপুর মতো হতে চাই। আপুর মতো কষ্ট করে পড়াশোনা করবো আর একদিন আপুর মতো ভালো আর্কিটেক হবো। ছেলেটা এইটুকুন বয়সে তোর মতো ম্যাচিউর কথাবার্তা বলে। তুই তো আমার সোনার টুকরা। তোর সাথে ওর কেন জানি তুলনা দিতে পারিনা। মেয়েরা বাবার হীরার রত্ন, এমন স্বর্গীয় হীরা যখন মেয়ের চাহিদা পূরন করতে না পারলেও মেয়ে মুখফুটে কিছু চাইবেনা। বলবেনা, আব্বু আমার এটা চাই, ওটা চাই! তোমাকে দিতেই হবে! মেয়েরা কঠিন মুখে বায়না করেনা। আমার বুকটা খালি হয়ে আছে রে মা, তুই আমাদের সাথে থাখিস না। তোকে দেখতেও পারিনা, মা বলে পরান জুড়িয়ে ডাকতেও পারিনা। মারে তোর প্রথম বেতনের টাকায় যে ফোনটা দিয়েছিলি, ফোনটা দেখলে এখনো কাদিঁ রে মা। আমি বাবা হয়ে আজ পযর্ন্ত ভালো একটা ফোন কিনে দিতে পারিনি। তুই তো মুখ দিয়ে বলতিও না আব্বু একটা ভালো ক্যামেরার ফোন কিনে দাও। অথচ দেখ, তোর ফোন দিয়ে আমি ডিএসএলআরের মতো ক্লিন ছবি তুলি। মারে জীবনে কত কষ্ট করলাম তোর শখগুলোই পূরণ করতে পারলাম না। গরীবের ঘরে মধ্যবিত্ত ট্যাগ নিয়ে তুই যে কষ্টটা করেছিস তার কিন্ঞ্চিত কষ্ট যদি আমি করতাম, আমার বাচ্চাগুলির সব ফরমাশ পূরন করতে পারতাম। মা আমার হাতের জোর নেই রে। ঔষুধের উপর বেঁচে আছে তোর বাবা। কবে যে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাই জানিনা। কিন্তু আল্লাহর কাছে লাখ কোটি শুকরিয়া জানাই আমার ঘরে এমন মেয়ে জন্মেছে যে কখনো আমাকে দুঃখ পেতে দেয়নি। জীবনের এই স্তরে এসে বুঝতে পেরেছি একটা মেয়ে সন্তান পাওয়া কতটা সৌভাগ্যের। আল্লাহ প্রতিটা ঘরে মেয়ে পাঠায় বাবার কষ্ট বুঝার একেকটা উপহার হিসেবে। এই কষ্ট বাবার মেয়েগুলোই বুঝে রে মা। আদরের ছেলেরা তা পারেনা। মারে, ও মা, চট্টগ্রাম থেকে একবার এসে নাঃগন্জ ঘুরে যা। তোর মাকে দেখে যা। বেচারী পায়ের ব্যথায় ঘুমাতে পারেনা। রাতভর ছটফট করে কাঁদে। হাতের লেখাগুলি পচা হয়েছে রে, একটু কষ্ট করে পড়ে নিস। হাত কাঁপে ব্যথা করে, একটানে চিঠি লিখতে পারিনা। বয়সের ভারে চারদিন মিলিয়ে এই চিঠি টুকটুক করে লিখছি। মারে? ছেলেটাকে একবার দেশে ফিরতে বল। দেখিস তোর এই আব্বু ওর পায়ে পড়ে ভুলের ক্ষমা চাইবে। আমার ভুলের জন্য ছেলেটাকে কষ্ট দিস নারে। ওকে ডাক, দেশে ফিরতে বল। তোরা সংসার শুরু কর, ভাতিজিকে মেয়ের মতো বড় কর, আমার কোনো আপত্তি নেই মা। অতীতে করা ভুলটা আমার সুখশান্তি কেড়ে নিয়েছে, মনে দুঃখ ছাড়া কিছুই উপলব্ধি করিনা। মরনের জন্য গুন গুনছি। আল্লাহর কাছে ফিরে যাবো সময় ঘনিয়ে আসছে হয়তো। ভালো থাকিস আমার মা। পরপারে পাড়ি দিলে একটু লাশটা দেখে যাস।

ইতি

তোর আব্বু।

টপটপ করে চোখের অশ্রুতে ভিজে গেছে হাতের চিঠিটা। অশ্রুজলের কারনে কলমের কালি লেপ্টে যাচ্ছে গোলাকার। বাবা এই নিয়ে অসংখ্যবার চিঠি পাঠালেও নারায়ণগঞ্জ ফিরেনি বিগত দুই বছরে আর। পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা গ্রেড তুলে আজ বহুদূরে বসবাস করে। আর্কিটেক হিসেবে চাকরীর সুবাদে চট্টগ্রাম থাকছে। নিজের কর্মক্ষেত্রে ঘুমকাড়া ব্যস্ততায় ডুবে থেকে পুরোনো কষ্টগুলো লাঘব করার প্রয়াস করে। কিন্তু একবার না একবার হলেও পুরোনো ক্ষতগুলো নাড়া দিয়ে উঠে। ভেজা চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের ড্রয়ারে রাখে মম। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে চুল শুকাতে বসে পড়ে ফ্যানের নিচে।

মম ভাবলো, গ্রীষ্মের ভেকেশ্যান এলেই লম্বা ছুটি এপ্লিকেশন করে নারায়ণগঞ্জ যাবে। অনেকদিন হয়ে গেছে আব্বু, আম্মুকে দেখে না সে। সর্বদা কাজের ব্যস্ততা নিয়ে গুটিয়ে রাখে নিজেকে। ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুমকাড়া সব চিন্তা এসে মাথায় ঘন্টা বাজালো। পুরোনো অতীতে ডুবে যেতে লাগল বন্ধ চোখপাতার জোড়ায়।

আমি ক্যাম্পাসে যেতাম দুটো ভয়ংকর উদ্দেশ্য নিয়ে! এক. নিজের পড়াশোনায় হাইয়েস্ট র‍্যাংকিং করতে! দুই. তন্ময়,আহাদ ও নাসিফকে পাই পাই করে শিক্ষা দিতে! আমার মাথায় এক নাম্বার উদ্দেশ্য অনড় থাকলেও রক্তে রক্তে দুই নাম্বার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যকুল থাকতাম। রামিমের কিছু কৌশলের কারনে ওরা আমাকে চাইলেও ক্ষতি করতে পারতো না। একটা জিনিস ভালো করে জানতাম, রামিমের মতো হাবার মাথায় ফার্স্ট ক্লাস বুদ্ধির পেছনে কার হাত বা কার মাথা থাকতে পারে। কখনো মুখে সেটা আওড়াতাম না। কিন্তু রামিমের জন্যই বেচে যেতাম হাজারবার।

ক্যাম্পাসে ওদের র‍্যাগ ডে’র জন্য বর্ণিল আয়োজন করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের গেট থেকে শুরু করে প্রতিটা একাডেমিক ভবন রঙ বেরঙের সজ্জাদ্বারা সাজানো হয়েছে। হেডস্যার সহ অন্যান্য স্যার সকাল আটটা টু রাত আটটায় পার্টি করার আবেদন মন্জুর করে দেন। সবই ছিলো ওদের দখলে। আমি, অর্পি, জেনি, রিমি ও রামিম মিলে একটা প্ল্যান করি। যদিও এতে কি পরিনাম হতে পারে জানা নেই। ফুল ভলিউমে গান বাজনার সৌহার্দ্যে পুরো ক্যাম্পাস জমকালো পার্টি শুরু করলো। সবাই নাচানাচি, মাতামাতি, হৈহুল্লোড়ে মাতাল। রিমি, জেনি পরিকল্পনার মুখ্যপাত্রী। ওরা তন্ময়দের সাথে মিশেমিলে প্ল্যান মোতাবেক সিলেক্টেড জায়গায় আনবে। সেটা হবে স্টেজের পেছনের জায়গা। অর্পি ও আমি গুড়ো রঙের মধ্যে কঠিন কিছু মেশাচ্ছি। রামিম আমাদের আড়াল থেকে দুরবীন নিয়ে আশপাশ দেখছে কেউ এখানে আসছে কিনা। কেউ আসলেই রামিম সর্তক বার্তা দেয়। দুরবীনে চোখ বসিয়ে রামিম বললো,
— ভাবী! অর্পি! সব রেডি? ওরা কিন্তু আসতেছে। জলদি জলদি!!
— হয়ে গেছে রামিম!! তুমি তাড়াতাড়ি দুরবীন লুকাও।
রামিম দ্রুত কোমরের পেছনে প্যান্টের সাথে গুজে নিলো দুরবিন। অর্পি ঢালাভরা রঙের স্তুপ ছেড়ে জলদি ওড়নার পুটলি থেকে বেগুন, সবুজ কালারের রঙ বের করলো। আমি এক খাবলা নিয়ে দুহাতে মুখে ঘষছি, অর্পিও সারা মুখে রঙ মাখছে। অর্পি রঙ মেখে জিজ্ঞেস করে,
— ওই মাইয়া! আমাকে চিনা যায়? আরো রঙ মাখবো?
— ‘না না দিস না! ঠিকাছে!!’ আমি চটপট উত্তর দিলাম।
— কিরে ছেমড়ি! তোরে তো মুগ্ধ ভাইও চিনবো না!! এত্তোদি দিছোস কেন!
— চুপ! ফাতড়া পেচাল পারিস না! ভেটকি মাছের হাসতে থাক! ওরা ডাউট করলে কিন্তু শেষ বুঝিস!
রিমি, জেনি চোখ ঘুরিয়ে ইশারা দিলে রামিম যেয়ে তন্ময়, নাসিফ ও আহাদের সাথে গলাগলি করে। ওরা খুশিতে আরো হৈহৈ করে উঠে। তন্ময়ের নজর সবাইকে ছেড়ে আমাদের দিকে পড়ে। অর্পি অপ্রস্তুত হাসি দিলে তন্ময় কিছুটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে কাছে আসতে নিলে রামিম বাধা দেয়।
— আব্বে ডুড! যাও কোথায়? ওরা ফ্রেশার স্টুডেন্ট! র‍্যাগ দিতেছি বুঝছো!

জেনি ও রিমি ওদের পাশ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। এদিকে রামিম ওর কথার জালে তিনজনের ধ্যান আর্কষন করলে ধামম করে দুটো বিকট শব্দে গগনবিদারী চিৎকার উঠে! তন্ময়, নাসিফ মাথায় হাত দিয়ে বেহুঁশ। আহাদ আশ্চর্যের সপ্ত আকাশে পৌছে গেছে! ভীত ভীত চোখে আলতো ঢোক গিলে দেখে জেনি ও রিমির হাতে মোটা বাশঁ! তারাই মেরেছে তন্ময় ও নাসিফকে! আহাদ ভয়ে কুজো হয়ে যাচ্ছে! একবার তন্ময়ের দিকে আরেকবার রিমির দিকে তাকাচ্ছে। রিমি দুহাতে বাশঁ ধরে তন্ময়ের বুকের উপর দিয়ে হেটে এগিয়ে আসছে। আহাদ ঘাম ছুটিয়ে একপা দুইপা করে পেছাতেই আরেকটা অস্ফুট শব্দে আঘাত দিয়ে বসে। আহাদ রক্তাক্ত মাথা নিয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। রিমি ও জেনি একসাথে বাশঁ ছুড়ে ফেলল। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ওদের চামড়া এমনভাবে দংশন করবা যেনো আমাদের মুগ্ধের উপর টর্চার করা প্রতিটা দাগ চামড়া ভেদ করে ফুটে উঠে! মেরে ফেলো!

রামিম একটা বক্স এনে মাটিতে রাখলো। সবাই সেখান থেকে গ্লাভস নিয়ে পড়ছে। গ্লাভস গুলো মোটা, শক্ত, বলিষ্ঠ! আমরা পাচঁজন হাতে গ্লাভস পড়ে রঙের ঢালা থেকে খাবলা খাবলা রঙ নিচ্ছি। দুইহাতে মুঠোভরা রঙ তন্ময়ের গালে ঘষতেই চামড়া চিড়ে তরল লাল রঙ বেরিয়ে আসছে। জেনি বজ্রচাহনিতে একঢালা রঙ দিয়ে চামড়া খসিয়ে ফেলেছে নাসিফের। রামিম বাকি দুই ঢালা রঙের স্তুপ এনে মাটিতে রাখতেই ওরা হামলে পড়ে ওদের উপর নৃশংস তান্ডব চালায়! শেষে জেনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লে বহুকষ্টে থামানো হয়। আর অত্যাচার চলবেনা। সমাপ্ত! আমরা সব গুটিয়ে জিনিসপত্র গুছাই। ওদের উপর ভালো রঙ ঢেলে সেখান থেকে চলে যাই। পরদিন জেনি, রিমি ও রামিমের বাসায় পুলিশ গেলেও লাভ হয়নি কোনোটাই! বড়লোক পরিবারের ক্ষমতার জোরে তিনজনের একজনকেও পুলিশ ধরতে পারেনি।তাছাড়া পুলিশের কাছে প্রমাণসাধ্য কিছু না থাকার কারনে আইনি কাজ সম্ভব হয়নি। আমি ও অর্পি এ প্ল্যানের অংশীদার ছিলাম, তন্ময়রা আঁচ করতে পারেনি। কেননা জেনি, রিমি আমাদের সাথে মিশেছে, ওদের জানা নেই। সবই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়েছিলো। তন্ময় আর কোনোদিনও ফ্রেশ দাগহীন চেহারা পাবেনা। পাবেনা কোনো মেয়ের কাছে কুপ্রস্তাবের ভোগ অবস্থা। আয়নায় দেখলে বীভৎস লাগে তন্ময়, নাসিফ ও আহাদকে। তবে আহাদের ক্ষেত্রে কিছুটা কম চোট দিলেও ভয়ে মুখ খুলবেনা কোনোদিনও। সময়ের সাথে সাথে দমে গেছে তিনজনের অহংকার! গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লালসা করার চেহারা! সব শেষ! তোমরা মুগ্ধকে একবার মেরেছো! আমি তোমাদের অজস্রবার মারছি! এই মারার শেষ তোমাদের কোনোকালে পরিশেষ হবে কিনা! জানা নেই আমার।

মম ঘুম থেকে চট করে উঠে বসলো। পুরোনো স্মৃতি কেন যে বারবার তাড়ায়? ভালো লাগে না অতীত নিয়ে ঘাটতে। কষ্ট লাগে। অসহনীয়, অব্যক্ত, অপ্রকাশ্য কষ্টানুভব হয়! মম চুলে হাতখোপা পাকিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসে। বিছানায় বসে জানালায় ডানকাত করে মাথা হেলিয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসায়। বিকেল গড়িয়ে লাল আভায় ঢেকেছে আকাশ। কি সুন্দর এই আকাশটা! কি শান্ত পরিস্কার চুপচাপ! মুগ্ধের কথা মনে পড়ছে তার। মুগ্ধ যদি হুট করে আসতো! যদি আসতো চমকে দিয়ে! কিন্তু সে তো আসবে না। সে আর কোনোদিন আসবেনা। আসার ইচ্ছে হলে পাঁচটা বছরে না আসতো? একা একা থাকতো? এই পাঁচবছরে অবশ্যই সে দেখা দিতো! কিন্তু সকাল শেষে রাত হলেও মুগ্ধের আশা করা যায় না।

১৯.

চকচকে আভিজাত্য কালো গাড়ি থেকে বের হলো দুটি বুট পড়ুয়া পা। দরজা ঠেলে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে গলায় ঝুলালো মেয়েটা। কালো লং জ্যাকেট, নেভি ব্লু জিন্স, পায়ে কালো বুটস। চুলগুলো নায়িকাদের মতো সিল্কি ও প্রাণবন্ত। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— বিডিতে এতো গরম! থাকেন কিভাবে? আমার তো জ্যাকেট খুলে খেলতে ইচ্ছে করছে! উফ!
ড্রাইভার ঠোট হাসি ঝুলিয়ে বললো,
— গরমের সিজন চলে ম্যাম। বাংলাদেশের টেম্পারেচার এমনই হয়।
মেয়েটা প্রতিউত্তরে কিছু না বলে মাটিতে গটগট শব্দ করে চলে গেল। রিসেপশনের সামনে দাড়িয়ে একগাল প্রশ্ন ছুড়লো,
— এক্সকিউজ মি? ক্যান ইউ হেল্প মি?
রিসেপশনে বসা যুথিঁ মেয়েটার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দেখলো। মেয়েটাকে দেখে মনেহচ্ছে সদ্য দেশের মাটিতে পা ফেলেছে। কেমন শুভ্র শুভ্র ভাব চোখে, মুখে, গায়ে। যুঁথি হাসিমুখে বললো,
— ইয়েস।
— আমি একজনকে খুজতে এসেছি। নাম স্নিগ্ধা মম। চিনেন? উনার এড্রেসটা লাগবে প্লিজ!
— জ্বি? কিন্তু আপনার নাম?
— সাফিয়া তাবাস্সুম। আমাকে একটু ঠিকানাটা দিন।
— সওর।
রিসেপশন থেকে এড্রেস পেয়ে মেয়েটা ড্রাইভারকে দেখিয়ে বলল ঠিকানুয়াযী নিয়ে যেতে। ড্রাইভার সম্মতি জানিয়ে বলল, রাত পার হবে জায়গায়টায় যেতে। মেয়েটা তবুও অটল ভাবে জানালো ‘যাবে!’
— হ্যালো? তুমি একজেক্টলি কোথায় আছো?
–………
— ওহ্ মাই গড! নো চিটিং! প্লিজ আমার সাথে চিটিং করবেনা!
–……..
— আমি তোমার আগেই পৌছাবো! বায় হুক অর বায় ক্রুক! আই উইল ফাইন্ড হার ফার্স্ট! ইটস মাই চ্যালেন্জ!
#তুমিময়_প্রেম❤
#পার্ট_৩০
#LAST_PART
#FABIYAH_MOMO

(শেষ অংশ)

১৯.
ঝড়ো হাওয়া বইছে সকাল থেকে। ভয়ংকর কালো মেঘের আড়ালে দিনের আলো ঢেকে গেছে। আকাশের দিকে তাকালেই বুক ভয়ে দপাদপ করে। একটু আগে এলাকায় মাইকিং করে ‘সর্তক সংকেত’ দিয়েছে। সমুদ্রসৈকতে উথালপাথাল প্রাণচাঞ্চল্য অবস্থা হচ্ছে সুউচ্চ ঢেউয়ের জোরে। সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়া ঘোর আহ্বান জানানো হয়েছে। আমি রুমে জানালা আটকে, দরজা লাগিয়ে চুপচাপ বসে আছি। হালকা বাতাসেই কারেন্ট ফুরুৎ! টিভিও দেখতে পারছিনা এই শোকে। আজ মনটা অদ্ভুত ভাবে তোলপাড় করছে, বুঝতে পারছিনা কিছু। বিচিত্র অস্থিরতায় এ পযর্ন্ত কতগ্লাস পানি খেলাম হিসাব নেই! মোবাইলে জরুরি কলটা করবো নেটওয়ার্ক নেই! বাইরে যাবো সেই পরিস্থিতিও নেই! দরজায় হুট করে কেউ নক করলো। আমি অবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম! বাইরে যেই তুলকালাম ঝড় হচ্ছে এমন স্তব্ধ পরিস্থিতিতে কে আসবে বাইরে থেকে? আমি দরজা খুলে দিলাম। দেখি কাজের বুয়া।

— আপা আপনার সাথে কেউ দেখা করতে চায়। উনারে আসতে বলবো?
— এই খারাপ আবহাওয়ায় কে আসলো দেখা করতে?
— আপা পিচ্চি মেয়ে একটা। নাম বলছে সাফিয়া।
— আচ্ছা দেখি আসতে বলুন তো। নাম শুনে তো মনে হচ্ছেনা চিনি..
আমি দরজা খুলাই রাখলাম। জানালার কাছে গিয়ে থাইগ্লাসের বাইরে ঝড়ের তান্ডব দেখছি। সুপাড়ি গাছের হাল বড্ড বাজে।ঝড়ের প্রতিটা ঝাপটায় নুয়েশুয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ছে। কি ভয়ংকর দৃশ্য! হঠাৎ কেউ মিষ্টি গলায় বললো,

— আমি আসতে পারি?

মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি অনেকটা চেনাচেনা মুখ। কোথাও যেনো দেখেছি! আচ্ছা কোথায় দেখেছি মেয়েটাকে? মনে করতে পারছিনা!! মেয়েটা একইসুরে আবার বললো,

— আমি আসতে পারি?

ভাবনার প্রহর ভাঙ্গলে আমি ভেতরে আসার জন্য অনুমতি সূচকে মাথা ঝাঁকাই। মেয়েটা ভেতরে না এসে দরজায় দাড়িয়ে কিছু একটা গভীরভাবে চিন্তা করছে। নজরটা পায়ের জুতোর উপর। কাদায় লেপ্টে খুবই নোংরা অবস্থা। আমি ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই বলে উঠি,

— জুতো খুলে আসতে হবেনা। ভেতরে আসো।
— থ্যাংকিউ।
— তোমার নাম কি? আমাকে কিভাবে চেনো?
— আপনি আমায় চিনতে পারেননি?
— না তো,
— সাফিয়া? নামটা মনে নেই?
— শোনা শোনা লাগছে তবে মনে করতে পারছিনা।
— আপনাকে খুব মনে পড়ে মিস। আপনি আমার জন্য চাচ্চুকে ছেড়ে দিয়েছেন। চাচ্চু ভালো নেই মিস।

কথাগুলো শোনার পর যেনো ঝড়ের বীভৎস ঝাপটাটা এবার আমার উপর পড়লো। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে পিছিয়ে জানালার সাথে ধাক্কা খাই। এই মূহুর্তে আমার ফাইজাকে দেখে আবেগান্বিত হওয়া ঠিক? ফাইজাকে দেখে হুহু করে কাঁদা উচিত? নাকি মুগ্ধের ব্যাপারে আগেভাগে জিজ্ঞাসা করাটা বেঠিক?আমি জবাবশূন্য হয়ে তীব্র উৎকন্ঠায় ছটফট করছি। ফাইজা আমাকে দূরে যেতে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে শক্ত হাতে জাপটে ধরলো। আমি আরেকদফা বিদ্যুপৃষ্ঠের মতো চমকে উঠি। হাত কাপছে, পা কাপছে, মুখ কাপছে, আমি যেনো আমাতে নেই। সমস্ত শরীর বিষাদের ঘোরে অবশ, বিপন্ন লাগছে।

— আপনাকে প্রচুর মিস করেছি মিস, আপনাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না, আমি সবসময় দেশে ফিরতে চাইতাম।কিন্তু চাচ্চু আসতে দিতো না। বারন করতো। বলতো, আপনি চাচ্চুকে দেখতে পারেননা, চাচ্চুকে দেখলে রাগ করবেন। আমার চাচ্চুকে আপনি আমার জন্য কেন ছাড়লেন মিস? বলুন না মিস!! আমি সব ছেড়ে আপনার কাছে জানতে এসেছি!!

আমি কঠিন অবস্থাগুলো হজম করার চেষ্টা করে মৃদ্যু কাপুঁনিতে কাঁপছি। দাতঁ শক্ত করে মাথা নুয়ে আমাকে জাপটে ধরা মেয়েটিকে দেখছি। ছোট্ট ফাইজা পাচঁবছরের দৃঢ়তায় বড় হয়ে গেছে, চিনতে পারিনি প্রথমে।। ফাইজা কাদঁছে, কান্নার সুরে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, আমি কি উত্তর দিবো? বলবো তোমার চাচ্চু নিজেই আমাকে ছেড়ে গিয়েছে? আমি চোখ মুছে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বিছানায় বসালাম। ওর চোখ মুছে দিতেই ফাইজা আমার হাত ধরে বললো,
— চাচ্চু আমাকে সব না বললেও আমি সব জানি মিস। আব্বুর নতুন বউ আমাকে সব বলেছে। জানেন মিস আব্বুর নতুন বউটা খুব খারাপ। আমার নামে মিথ্যা মিথ্যা কথা বানিয়ে আব্বুর কাছে মার খাওয়ায়। আজ আম্মু থাকলে ওই দুষ্টু মহিলা কখনো আমায় মারধর করতে পারতো না। জানেন মিস, চাচ্চুর উপরও একদিন মহিলাটা হাত তুলেছিলো। চাচ্চু সেদিনের পর থেকে ওই মহিলাকে আর সহ্য করতে পারেনা। আমি যে পাচঁ বছর ধরে আমেরিকায় আছি মনের ভুলেও খোঁজ নেয়নি। পচাঁ পরিবারের নোংরা মানুষ ওরা। মিস? আপনি আমার সাথে চলুন, আমি আপনাকে চাচ্চুর সাথে বিয়ে দিয়ে সুন্দর পরিবার বানাবো। চাচ্চুও কাদঁবেনা। আপনিও দূরে থাকবেন না। আপনাকে আমি নিতে এসেছি মিস। চলুন।

গুণে গুণে ‘বারো’ বছর বয়স হবে ফাইজার।অথচ মা হারা মেয়েটা এতো সুন্দর কথা কিভাবে শিখলো সেটাই বুঝতে পারিনা। পাচঁ বছরের ব্যবধানে মুগ্ধ ওকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে, দেখলে মনে হবেনা কেবল বারো বছরের মেয়ে। মুগ্ধের বড়ভাই কিভাবে পারলো ফুটফুটে নিষ্পাপ মেয়েকে ভুলে যেতে? নিজেরই তো মেয়ে তবুও কেন দূরে রাখে? লোকটার প্রতি ঘৃণা লাগছে আমার। এইসব পুরুষের বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই।। আমি ফাইজার মাথায় হাত বুলিয়ে গালে চুমু একে দিলাম। ফাইজা আচমকা আমার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে উঠলো,

— আপনি খুব বড় হয়ে গেছেন মিস। মেয়েদের মতো শাড়ি পড়েন। চাচ্চু আপনাকে শাড়িতে দেখলে পাগল হয়ে যাবে, সিরিয়াসলি!!

হঠাৎ মনের মধ্যে ঝংকার দিয়ে উঠলো ফাইজার কথা শুনে। অজানা উত্তেজনায় তৎক্ষণাৎ উৎকন্ঠা বোধ করছি আমি। শরীরে অদ্ভুত শিহরন বয়ে যাচ্ছে, নিজের মধ্যে অপ্রকৃতিস্থ ভাব রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করছি। মুগ্ধের কথা শুনে কি এমন ঝিমঝিম করে উঠলো? মুগ্ধ আমায় দেখে কেমন করবেন, জানার বহু আগ্রহ!!

২১.
ঝড়ের ভারি বর্ষনে রাস্তা সব গোলমেলে লাগছে। বৃষ্টির প্রবণতা, ঝড়ের ঝাপটা — সব মিলিয়ে বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছে। গাড়ি চালিয়ে সামনে এগুতেই প্রচুর রিস্ক নিতে হচ্ছে। এই কর্দমাক্ত রাস্তায়, বৃষ্টির ঝাপটায়, গাড়ি যদি উল্টে পড়ে তাহলে উদ্ধার করার জন্য কেউ আসবেনা এখানে। খুবই খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে চট্টগ্রামের উন্নত শহরে। হঠাৎ দ্রুত স্পিডে মূল সড়কে একটি কালো গাড়ি চলতে নিলে এলার্ট সাউন্ড বাজিয়ে গাড়ি আটকায় ট্রাফিক কর্মী। ঠোঁটে বাঁশি ফুকতে ফুকতে বন্ধ জানালায় আলতো লাঠি মারে। জানালার কাচঁ নেমে গেলে রেইনকোর্ট গায়ে ট্রাফিক পুলিশটি চেচিয়ে বলে উঠে,

— এ্যাই মিয়া! ঝড়বৃষ্টি হইতাছে চোখে দেখেন না? এইভাবে কেউ স্পিড দিয়ে গাড়ি চালায়?দেখি লাইসেন্স!
ট্রাফিক পুলিশটা দেখল, ড্রাইভিং সিটে বসা ছেলেটি ঝড়ের চেয়েও তিনগুণ বেশি স্পিডে লাইসেন্স হাতে গুজলো।

— নাম কি? কোনদিকে যাচ্ছেন?
— স্ট্রেন্জ! আপনি আমার লাইসেন্স হাতে নিয়ে আবার নাম জিজ্ঞাসা করছেন? ওখানে নাম নেই?
— ওই মিয়া! মস্কারা করো!
— আপনার কি মনেহয় আমি ঝড়ের মধ্যে বিনোদন দিতে বের হয়েছি? চেহারা দেখতে কি আমার জোকার মনেহচ্ছে ? লাইসেন্সে ফটো নেই?
— বেশি বাড়াবাড়ি করছেন মিয়া! গাড়ি জব্দ করলে কিন্তু পার পাবেননা!
— দেখুন আমার তাড়া আছে! আপনার সাথে তর্ক করার টাইম নেই! সরি!

২০.

— সবাই কেমন আছে?
— সবাই আবার কে? আপনি ক্লিয়ারলি চাচ্চুর কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন মিস? চাচ্চু জানেন বিয়েও করেনি। বলেছে আমার চাচী আছে। তাই সে বিয়ে করবেনা। কিন্তু আমি না সব জানি মিস!! আপনি যে আমার চাচী সেটাও জানি!! কিভাবে জানি ওটা টপ সিক্রেট!! বলবো না।

ফাইজা হো হো করে হাসতে শুরু করলো। মেয়েটা বকবক করতে পারে খুব। কথাবার্তাও বেশ চটাং চটাং। ফাইজা আমার ছোটবেলার ডুপ্লিকেট ! ব্যাপারটা ভেবে আড়ালে হাসলাম! হঠাৎ দরজার দিকে কোন্ মনে তাকালাম জানিনা না, চোখ পড়তেই শক্ত হয়ে গেছি মূহুর্তের মধ্যে ! পায়ের নিচ থেকে ধীরেধীরে বুঝি মাটি সরে যাচ্ছে! সমস্ত শরীর দারুন দাপুটে শিরশিরিয়ে উঠছে। তীব্র উৎকন্ঠায় আমি বিবেকহীন হয়ে ঝটকায় দাড়িয়ে পড়ি। বিছানায় বসা ফাইজা আমার হাত ঝাকিয়ে অগণিত প্রশ্ন করছে। মিস কি হলো, আপনি দাড়ালেন কেন, কে ওখানে।। একটা জবাবও দিতে পারছিনা একদৃষ্টিতে স্থির হয়ে গেছি। অস্বাভাবিক হারে ধুকপুকের কারনে শিরা উপশিরায় রক্তের স্রোত উচ্চাঙ্গে টগবগ করছে। আমি পিছাচ্ছি, শুধু পিছাচ্ছি…
সুন্দর দেহের উপর কালো কুচকুচে শার্ট। শার্টের উপর নেভিব্লু হুডির অর্ধচেইন লাগানো জ্যাকেট, পায়ে পালিশ করা নতুনত্বের চকচকে সুজ। সেই সুপরিচিত চিরচেনা মনোমুগ্ধকর সিক্ত মুখ। একহাতে ভেজা চুল ঝেড়ে জ্যাকেট ঝাট দিচ্ছে সমান তালে। পায়ের জুতো না খুলে ভেতরে প্রবেশ করলে ধক করে ওঠে বুকে। উনার দৃষ্টিতে শুধু আমি আবদ্ধ। আশেপাশে কি আছে, কে আছে, ধ্যান দেয়নি একবারো। শরীর থেকে পানি চুয়ে পড়ছে। টপটপ করে ফ্লোর ভাসাচ্ছে মুগ্ধ। বর্ষনের এমন ভয়ঙ্কর কালোমেঘের দিনে উনি আমার সামনে দাড়িয়ে আছেপ বিশ্বাস করতেও কলিজা চুপসে যাচ্ছে আমার। চোখের পলক ফেলার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছি আমি।। উনি আগের চেয়ে আরো বেহিসেবী লেভেলে মারাত্মক সুন্দরের তকমায় লেপ্টে গেছেন। এতো সুন্দর হয়ে গেছেন যেটা আগে কখনো অভিভূত হয়ে নজরে পড়েনি আমার। উনার সামনে দাড়ালেও আমাকে রাস্তার ফালতু ভিখিরির মতো দেখাবে। নিন্দা, টিটকারি, তামাশা করবে। মুগ্ধ চুল ঝাড়তেই বলে উঠলো,

— আম্মাজান প্রাইভেট টক আছে! প্লিজ বাইরে যান!
ফাইজা চট করে দুহাত মেলে মুগ্ধের রাস্তা আটকে বললো,

— নো চিটিং! বেরিয়ে যাও চাচ্চু! গেম মোতাবেক আমি জিতেছি! আমি সর্বপ্রথম মিসকে খুজে পেয়েছি! তুমি লেট! নাও লিভ মি এলোন!
— আম্মাজান প্লিজ না? আপনার মিসের সাথে কাজটা খুবই জরুরী। আপনি তো কাজটা জানেন?
— চাচ্চু তুমি হেরে গেছো! আমি কোনো সাফাই চাইনা! সো গেট আউট! কালকে তোমার টাইম!
— আম্মাজান প্লিজ! ও আম্মাজান?? হাম্বেল রিকুয়েস্ট প্লিজ শুনুন না !
— নো!
— লক্ষী পক্ষী সোনা আম্মাজান!
— নো মিন্স নো!
— ও আম্মাজান, আমার কলিজার টুকরা প্লিজ। কাল থেকে পাক্কা আপনার সব কথা শুনবো! স্ট্রং প্রমিস!
মুগ্ধের আকুতি মিনতি দেখে ফাইজা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে মুখ ফুলিয়ে চলে যায়। উনি আমার দিকে স্থির দৃষ্টি ছুড়ে হঠাৎ বলে উঠেন,
— দাড়ান আম্মাজান! দরজাটা লাগিয়ে দিয়েন একটু।
মুগ্ধ বাঁকা হেসে কাছে আসছেন। ফাইজা দরজা লাগিয়ে চলে গেল। কথায়, কাজে, আচরনে বেশ আজ মুগ্ধ বেশ অন্যরকম।। উনি নেশাগ্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসলে আমি ভয়ে চাপতে চাপতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে চমকে উঠি। সর্বনাশ! পেছনে দেয়াল এখন পালাবো কোথায়? হঠাৎ আমাকে ভয়ের উচ্চশিখরে পৌছে দিয়ে উনি জ্যাকেটের চেইনটা একটানে খুলে ফেললেন। কি করবেন উনি? জ্যাকেটটা খুলে ছুড়ে ফেললেন বিছানায়। মোহনীয় দৃষ্টিতে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছেন উনি। শার্টের হাতার দুটো বোতাম খুলে পেচিয়ে মুড়িয়ে কনুইতে ভাঁজ করলেন। আমি ঢোকের পর ঢোক গিলে গা চুবিয়ে ঘামছি। মাথা শূন্য ফাকা বাসা হয়ে গেছে হঠাৎ এরকম করতে দেখে! কোমর থেকে একটানে বেল্ট খুলে ফ্লোরে ফেললেন মুগ্ধ। ধপ করে দেয়ালে দুই হাত লাগিয়ে আমায় মাঝখানে বন্দী করলেন। আমার মুখের উপর গরম নিশ্বাস পড়ছে উনার। নিশ্বাসের উষ্ণতায় চোখ খিচে আমি দাঁত কিড়মিড় করছি। তাকানোর জো পাচ্ছিনা একদমই। হঠাৎ আমার কানে তপ্ত ভারী নিশ্বাসের সাথে উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করলাম। ফিসফিসানি আওয়াজে কানে এলো,
— আই লাভ ইউ।
আমি চোখ খুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
— ককি..

উনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোমরে একহাত চেপে একটানে বুকে মেশালেন। আমি হকচকিয়ে কেঁপে উঠি। ভয়ার্ত গলায় বলি,
— আআপনি এএসব কি করছেন? ছাড়ুন আমায়!
উনি নেশাভরা কন্ঠে বলে উঠলেন,
— ছাড়ার জন্য আমেরিকা থেকে এসেছি? মাথা নষ্ট ভাবছো?
— কিকি ববলতে চাইছেন আপপনি?
— বলতে না করতে এসেছি।
উনি গালে নাক ঘষতেই বলে উঠলেন,
— শাড়ি পড়ছো কবে থেকে? উফ! দিনদিন কি হটনেস বাড়ছে তোমার?
— অসভ্যের মতো কথা বলবেন না! ছাড়ুন!

উনি আমার মুখ থেকে ‘অসভ্য’ ওয়ার্ড শুনে আরো কঠিন করে চেপে ধরলেন। আমি ছাড়ানোর জন্য বৃথা চেষ্টায় ছুটাছুটি করছি। সহ্য হচ্ছেনা উনাকে! কেন এসেছেন উনি? আসার কি দরকার ছিলো? আমাকে নিজের জীবন থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে আবার কেনো এসেছেন? উনি চুলের খোপায় হাত ডুবিয়ে চোখবন্ধ করে ঠোঁট কপালে ছোঁয়ালেন। নরম কন্ঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,

— প্লিজ আমার সাথে এমন করো না। আমি খুব খারাপ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছি। পাচঁটা বছরে কি কি করে নিজেকে সামলিয়েছি আমি তোমায় বলে বুঝাতে পারবো না। আমি মুগ্ধ কখনো ভেঙ্গে সন্দিহান হয়ে যাবো কখনো ভাবতে পারিনি। তোমার বাবার ওয়াদা ভাঙ্গতে খুব কষ্ট লাগতো, তোমার কাছে ফিরতেই পারতাম না। আমাকে প্লিজ তাড়িয়ে দিওনা। আমি তোমার কাছে নত হয়ে ফিরেছি, ভিখারির মতো নিঃশেষ হয়ে ফিরেছি। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। তুমি ফিরিয়ে দিলে কার কাছে যাবো?কে আছে আমার তুমি ছাড়া?একটু কাছে নাও?

আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বুকে মিশিয়ে ধরলেন উনি। কাধের কাছে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছেন। আমি ধরিনি। অশ্রুফোঁটা থুতনি গড়িয়ে উনার শার্টের উপর কাধে পড়ছে। উনি হাতের বাধন ঢিলে করে হাত আনলেন আমার গালের উপর। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে উনি অঝোরে কাঁদছেন। চোখের পানি আমার মুখের উপর পড়ছে। কিছুক্ষণ পর উনি ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ লুকান। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখে ডলছেন। আমি দাঁতে ঠোঁট চেপে আচঁলে চোখের কোণা মুছে চলছি। হঠাৎ আমার মনেহলো কেউ আমার পায়ের কাছে বসেছে। পায়ের কাছটায় ভারী ভারী ঠেকছে। চোখ মুছার হাত থামিয়েগে আমি ভ্রু কুচকে নিচে তাকাই। দেখি মুগ্ধ আমার পায়ের কাছে হাটুগুজে বসে আছেন। আমার মাথায় বাজ পড়লো দৃশ্যটা দেখে!দুমড়ে মুচড়ে আসছে ভেতরের পাজরে। আমি তড়িঘড়ি করে ফ্লোরে নুয়ে বসি।

— উঠুন মুগ্ধ! কি করছেন! ছিঃ আমার পাপ হবে মুগ্ধ প্লিজ!! আমার পা ধরবেন না উঠুন!! আমি আপনাকে..
উনি কান্না সিক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
— আমাকে..আমাকে মাফ.. মাফ করে দাও..
হুহু করে বাধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছি আমি। আমার সামনে উনিও মাথা নুইয়ে কাঁদছেন। পা ধরে মাফ পাওয়াটা আমার জন্য কষ্টদায়ক! আমার পা ধরে মাফ চাবে, সেই দৃশ্য দেখে দেখে উপভোগ করে আমি শান্তি পেতে চাইনা। আমি যতোই বলি উনাকে চাইনা, সহ্য করিনা, ভালোবাসিনা। কিন্তু দিনশেষে উনাকে ছাড়া আমি একমূহূর্তও চিন্তা করতে পারিনা। আমার অস্তিত্বের সাথে মিলেমিশে যাওয়া ব্যক্তিটির অসহনীয় কান্না, যন্ত্রনা, দুর্দশা আমি নিতে পারিনা।

মুগ্ধ আমায় বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। থেমে থেমে উনিও কাঁদছেন। কিছুক্ষণ পর পর শক্ত করে চেপে ধরেন বুকে, কখনো ঠোঁট ছোঁয়াতে থাকেন আলতো করে। আমি ঠিকমতো নিশ্বাস নিতে পারছিনা উনার চেপে ধরাতে। কিন্তু অনুভব করছি উনার অস্থিতি হৃৎযন্ত্র হুল্কোর মতো লাফাচ্ছে। বামপাশটায় হাত রাখলাম। উনি আরেকদফায় মাথায় ঠোঁট বুলালেন। নিরবতার প্রহর কাটিয়ে বদ্ধ চোখে বললেন,
আমার প্রাপ্তিতে, সমাপ্তিতে, প্রতিটি অনুভূতিতে শুধু তুমি। ভালোবাসি তোমাকে পাকনি। মনের উজান জুড়ে অজস্র প্রহরে আমি ভালোবাসি ❤

২১.
দরজার ওপাশে পিঠ লাগিয়ে ফ্লোরে বসে কাদঁছে ফাইজা। চোখে বিশাল বিশাল নোনাজলের সমুদ্র। ফাইজা নিজেকে দোষী ভাবে মুগ্ধের কান্নার জন্য।। ওর চাচ্চুর মতো ভালো মানুষটার সাথে খারাপ হয়েছে জীবনে।। নিজের বাবা যেখানে দ্বিতীয় বৈবাহিক জীবন পেয়ে অবুঝ ফাইজাকে ভুলে গিয়েছে, তখন চাচ্চু এসে নরম হাতদুটো ধরে কোলেপিঠে মানুষ করে। ফাইজার ছোট্ট মনটা মনেমনে বললো, ভালো মানুষরা খারাপ! আর খারাপ মানুষরা শান্তিতে থাকে কেন? ভালো মানুষ কত দুঃখ পায়, কষ্ট করে। তার এককোনা কেন খারাপ মানুষগুলা পায়না? আমার চাচ্চু খুব কষ্ট পেয়েছে আল্লাহ্। আমার চাচ্চুকে তুমি কষ্ট দিও না। আমার আব্বু তো আমায় স্মরন করলো না। তবুও আব্বুকে কষ্ট দিও না। আমি কারোর জন্য খারাপ দোয়া করিনা। শুধু চাই, ফাইজার জন্য কষ্ট পাওয়া মানুষগুলোকে সুখী করে দিও আল্লাহ্। আব্বু ভালো থাকুক। আব্বুর জন্য খারাপ দোয়া করতে পারিনা। আমি আব্বুকে মিস করি। না চাইলেও আব্বুকে মিস করি। আব্বু আমাকে চায় না। প্লিজ আল্লাহ্ আমার কারনে আব্বুকে কষ্ট দিওনা। আমার জন্য আব্বুকে দুঃখ দিও না। আমার মতো অনাথের কথা তুমি পূরন করে দিও। আমার জীবন থেকে সব সুখশান্তি, হাসিখুশি নিয়ে উনাদের সবাইকে দিয়ে দিও…

-‘সমাপ্ত’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here