তুমি অতঃপর তুমিই
৩১
Taniya Sheikh
আজ সারাদিন একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি তো কখনো মুষলধারে। আমেনা বেগম খাঁটি সরিষার তেল, চানাচুর, পেয়াজ,ঝাল দিয়ে বেশ করে মুড়ি মাখিয়ে বসলেন লুডুর আসরে। কোভিড আতঙ্ক কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দিতেই এই আয়োজন মৌ-য়ের। নচেৎ,আমেনা বেগম ও আহসান সাহেব সারাক্ষণ এই নিয়ে ভয়ে থাকেন। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা,সেই সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। স্বামী- স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় দিন পার করেন। মৌ সেই প্রথম দিন থেকেই তো দেখে আসছে। মাঝ রাতে,কিংবা দিনের কোনোভাগে স্বচক্ষে দেখেছে আমেনা বেগমের চোখের জল। এ জলের প্রতি ফোটা আল্লাহ তাআ’লাকে আর্জি জানায়, ক্ষমা করো মাবুদ। ক্ষমা করো এই পাপী বান্দাদের। বিপদ দূর করো। মৌ- ঠোঁট পড়তে পারত। এই মা-টি স্বার্থপর নয়। সে শুধু নিজের সন্তানের জীবনাশঙ্কায় ভীত নয় বরং সমগ্র মানব জাতির কষ্টে পীড়িত। মৌ-র মায়া হয়। সেদিন যখন নিজে এসে মৌকে হাত ধরে ডায়নিং এ বসিয়ে খাওয়াল- মৌ কেঁদেই ফেলেছিল। মৃত মায়ের মতো আমেনা বেগম তাকে বুকে টেনে বলেছিল,
” পাগলি মেয়ে, এভাবে কাঁদতে আছে?”
মৌ তবুও কান্না থামায়নি। মনখুলে কেঁদেছিল। ঐ ছিল গত কয়েক সপ্তাহের শেষ কান্না। এরপর আর কাঁদেনি সে। কাওকে কাঁদতেও দেয়নি। সারাক্ষণ হৈ হুল্লোড়ে মেতেছিল সবাইকে নিয়ে। শুধু ইমরোজ আসলেই কেমন লজ্জায় গুটিয়ে যেত। এতো লজ্জা কেন পেত ইমরোজকে তার ব্যাখ্যা নেই। পৃথিবীতে সবকিছুর কি ব্যাখ্যা থাকে! লুডুর সিরিয়াস সময় চলছে। তিনজনেরই একটা গুটি বাকি আছে। এরমধ্যে আহসান সাহেবের গুটি একটু আগে আমেনা বেগম খেয়ে দিয়েছিল। তাই নিয়ে দুজনের সে কি বাচ্চামো! বেচারার এখনো ছক্কা উঠছেই না। মৌ এবং আমেনা বেগমের দরকার ১,আশার ২। যারটা আগে উঠবে সেই বিজয়ী। দমবন্ধকর মুহূর্ত। এমন সময় আহসান সাহেবের হতাশ মনে আশার সঞ্চার হলো। ছয় পাঁচ উঠেছে তার। বাকিদের কাঙ্খিত নাম্বার ওঠার পূর্বেই ঘরে ঢুকে যায় আহসান সাহেব। হাড্ডা হাড্ডি লড়াই। ঠিক সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ঢুকল ইমরোজ। ঢুকেই এগিয়ে এসে মৌ- র হাত ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে গেল। আর খেলা! বাকিদের চোখে-মুখে বিস্ময়। পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে উঠে গেল সেদিক। ওদেরকে আসতে দেখে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় ইমরোজ। আমেনা বেগম চেঁচিয়ে ওঠেন। ইমরোজ সেসব গ্রাহ্যও করেনা৷
ইমরোজের এমন আচরণে হকচকিয়ে গেছে মৌ। আড়চোখে তাকাতেই বুক কাঁপে। রাগে কঠিন হয়ে আছে ইমরোজের মুখখানা। মনে মনে ভীষণ ভয় হচ্ছে মৌ-র। বিন্যস্ত জীবনটা অবিন্যস্ত হয়ে যাবে না তো আবার! মৌ আর ফিরে যেতে চায়না। প্রতিশোধও চায়না৷ একটু সুখ,স্বস্তি, শান্তি চায়। ইমরোজ শ্যেন দৃষ্টে চেয়ে এগোয়।
” কে তুমি?” ইমরোজের গম্ভীর গলার এই প্রশ্ন মৌ-কে অস্থির করে তোলে। সহসা জবাব দিতে ব্যর্থ হয়। ইমরোজ জবাব না পেয়ে ধমকে গলা চেপে ধরে,
” বল কে তুই? কেন এসেছিস এখানে, বল?”
মৌ-র স্থির দৃষ্টির কোনা দিয়ে দু’ফোটা জল গড়ায়। যার চোখে অমূল্য হতে চেয়েছিল আজ তার চোখে হেয় সে। নিজের অবস্থান দেখতে পায় ঐ দুটি চোখে। কোনো জবাব আসে না৷ কণ্ঠস্বর থমকে যায়,চোখের পলক পড়ে না। কী হয় কে জানে! সেদিকে চেয়ে ইমরোজের কঠিন মুখাবয়ব ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। মুখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ থেমে বলে,
” আমাকে মারতে এসেছিলে? তো নাও। মেরে ফেলো।” কোমর থেকে রিভলবারটা বের করে ঘুরে দাঁড়ায়। এগিয়ে দেয় মৌ-র দিকে। মৌ- বিস্মিত বোবা নয়নে শুধু দেখছে। ইমরোজ সব জেনে গেছে! সব। হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে যায়। অবর্ণনীয় কষ্ট অনুভূত হয়। ইমরোজ জোর করে ওর হাতের রিভলবার ধরে বুকে ঠেকায়।
” কিল মি।”
মৌ তাকিয়ে আছে। ইমরোজকে দেখছে,দেখছে ঐ চোখের রঙ ভয়ানক লাল হয়ে ওঠার দৃশ্য। সে তো এসেইছিল ইমরোজের ক্ষতি করার প্লানে। এই তো সুযোগ। মাহিব পর্যন্ত নেওয়ার ঝামেলা নেই। শামীমকে এনকাউন্টার করার প্রতিশোধ নিয়ে মাহিবকে খুশি করার মোক্ষম সুযোগ। মার! মৌ,মার। মৌ-র শরীর অবশ হয়ে আসে। ট্রিগার কেন রিভলবারটাই ধরে রাখতে পারছে না ও। ইমরোজের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ওর হৃদয় তোলপাড় করছে। ঝড় উঠেছে সেখানে, কাল বোশেখী ঝড়।
স্বামী- স্ত্রী দুজন আজ বাগান পরিচর্যা করতে লেগে গেছে। গাছের আগাছা পরিষ্কার করে সেগুলোয় নতুনত্ব আনছে ওরা। শান গেল পাইপ টেনে আনতে। পাশে বসে ইমা গোলাপের ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল। শান গাছে পানি দিতে দিতে বলল,
” তারপর, কী ভাবলে?”
” কোনটা?”
” আমাদের বেবির নামের কথা বলছি।”
” এই যা! আমি তো ভুলেই গেছি।” ইমা জিহ্বা কাটতেই শান ওর দিকে পাইপ ধরে ভিজিয়ে দেয়।
” এটা কী করছেন?”
” স্মৃতি শক্তি প্রখর করছি। কবে থেকে লেগে আছ, অথচ জিজ্ঞেস করলেই বলো ভুলে গেছি।” শান পানির পাইপ ঘুরিয়ে আবার গাছে পানি দিতে থাকে। রাগে কিড়মিড় করে ইমা বলে,
” আপনাকে আমি দেখে নেব।”
” নেব আবার কী? এখনই দেখো,মন ভরে দেখো।” পাইপ নিচে ফেলে চট করে গায়ের টিশার্ট খুলে ইমার মুখে মারে। এগিয়ে গিয়ে বলে,
” দেখো,দেখো।”
রাগে শরীর জ্বলছে ইমার। শানের টিশার্ট টেনে দাঁড়িয়ে আছে। শান ওর খুব নিকটে আসতেই ইমা সরে দাঁড়াবে বলে ঘুরতেই হাত টেনে ধরে। ইমা গাল ফুলিয়ে বলে,
” ছাড়েন আমাকে।”
” আগে নাম বলো।”
” নাম ঠিক করি নাই।”
” তাহলে এখনই করো।”
” মাথা খারাপ আপনার।এখন কী করে করব। ভাবতে হবে না।”
” ওসব জানি না। আমি এখন শুনব।” ইমা নিরুপায় হয়ে অবশেষে ভাবতে শুরু করে। ভাবছে তো ভাবছেই। শান অধৈর্য্যে হয়ে বলে,
” এতো কী ভাবছ৷ একটা নাম ভাবতে এতো সময় লাগে।”
” হাস মুরগির বাচ্চার নাম না যে, ছোটো বাচ্চা, বড়ো বাচ্চা, লাল বাচ্চা, কালো বাচ্চা রাখব। মানুষের বাচ্চার নাম রাখব,সেটাও আমাদের। টাইম তো লাগবেই,নাকি?”
” ফালতু কথা বন্ধ করে যেটা বলেছি সেটা করো।”
” এতোই যখন তাড়াহুড়ো হলে আমি পারব না। আপনিই রাখেন গিয়ে যান।” দু’হাতে শানের বুকে ধাক্কা দিতে শান ওর ঠোঁট স্পর্শ করে সরে দাঁড়ায়। লজ্জায় এদিক, ওদিক তাকায় ইমা। শাসিয়ে বলে,
” কতবার বলেছি সবসময় এই কাজ করবেন না।”
” আমার ইচ্ছা।” ইমার ফুলিয়ে রাখা গালটা টেনে বাসার দিকে হাঁটে। পেছন পেছন ইমা এগোতে এগোতে বলে,
” আপনার ইচ্ছা! তবে আপনার ঠোঁটেই দেন।” শান ভ্রু কুঁচকে ঘুরে দাঁড়াতেই ইমা দাঁড়িয়ে যায়। শান হো হো করে হেসে ওঠে।
” সত্যিই পাগল তুমি।”
” পাগল বলবেন না।”
” ওপস, সরি পাগলি তুমি।”
” শান!” ইমার নাকে কান্না দেখে আরো জোরে হাসে। এগিয়ে এসে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরে বলে,
” নিজের ঠোঁটে নিজে কিভাবে চুমু খায়? পাগলী না হলে এসব কথা কে বলে?”
” যান সরেন। শয়তান একটা।” ইমা ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যায়। শান হাসতে হাসতে ছোটে ওর পেছনে। ইমার দু-কাঁধে হাত রেখে খুনসুটি করতে করতে অন্দরে প্রবেশ করে। মতিন গেটে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে।
মৌ সেই যে কথা বন্ধ করে আর তার মুখ দিয়ে কথা ফোটে না। পরদিন কাওকে কিছু না জানিয়ে খুব ভোরে চলে যায়। আমেনা বেগম ছেলেকে বার কয়েক জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পাননি। বন্ধ ঘরে ওদের দুজনের মধ্যে কী হয়েছে এরা কিছুই জানে না। দুপুরে খাবার টেবিলে এ নিয়ে কথা আমেনা বেগমই প্রথম তোলেন। মেয়েটার প্রতি বড্ড টান সৃষ্টি হয়েছিল তার৷ হুটহাট চলে যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছেন খুব।
” ইমু, মেয়েটা এভাবে কেন চলে গেল? কি বলছিস তুই ওকে?”
ইমরোজ মুখের সামনে তোলা খাবার প্লেটে নামিয়ে রাখে। মলিন চেহারায় একদৃষ্টে নিচে তাকিয়ে আছে।তাই দেখে আমেনা বেগম বলেন,
” খাওয়া বন্ধ করলি কেন? আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম। মেয়েটার প্রতি মায়া জন্মে গেছিল কি’না।”
” এতো তাড়াতাড়ি কারো উপর মায়া বাড়াবে না৷ কষ্ট বাড়বে। সবাই মায়া মহব্বতের অর্থ বোঝেনা, মা৷” চেয়ার ঠেলে হনহন করে রুমে ফিরে যায়। ইমরোজের এই কথার সঠিক অর্থ কেউই বুঝল না। সকলে বিষন্ন মনে বসে রইল খাবার টেবিলে।
দিন পেরিয়ে গেল, সপ্তাহও। বাসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। মৌ-র স্মৃতি ক্রমেই ধূসর হয়। এদিকে দেশে লকডাউন খুলে দেওয়া হয়েছে। জীবনযাত্রা আগের মতো না হলেও মানুষ বাঁচার তাগিদে স্বাভাবিক হচ্ছে। ইমরোজদের বাসায় নতুন মেহমান এসেছে। আশা এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সবাই খুশি৷ আমেনা বেগম পূর্ব নির্ধারিত পাত্রীকে পুত্রবধূ বানাবেন বলে মনস্থির করেছেন। আগামীকাল সপরিবারে মেয়েকে দেখতে যাবার প্লান সবার। ইমরোজ গড়িমসি করলেও আমেনা বেগম পুত্রকে মানিয়েছেন।
মৌ- কে নিজের কাছে ফিরে পেয়ে মাহিব প্রচণ্ড খুশি। ওর এই খুশিতে গ্রহণ লাগে আননোন নাম্বার থেকে থ্রেট আসতেই। কিন্তু কে করছে এমন? সামিরা! সামিরার সাথে তো মিউচুয়ালি সমঝোতা হয়ে গেছে। মা-কে হত্যার পর ওরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে। আর যা হোক বিয়ে পরস্পরকে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। মাহিব জানে এসব সামিরার মুখের কথা।শানকে হাসিল করার জন্যই বিপদে পড়ে মাহিবের সাথে হাত মেলাচ্ছে। পূর্বেও তো এমন করেছে সে। শান যখন ইমাকে নিয়ে মধুর সংসার উপভোগ করছিল তখন মাহিবই তো সেটা ওকে জানিয়েছিল। তারপর, রাহুকাল হয়ে ওদের জীবনে এলো সামিরা। শান, ইমা কিছু বোঝার পূর্বেই ওদের আলাদা করে দেয়। ইমার মা ছিল ওর হাতিয়ার। হাসপাতালে সামিরাকে দেখামাত্রই শিওরে ওঠেন৷ সামিরাকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। ইমাও চিনত,ভাইয়ের ফ্রেণ্ড হিসেবে। ইমার মাকে দিনরাত প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে অস্থির করে তোলে সামিরা৷ ইরার মৃত্যুর আসল কারনটাও ইঙ্গিতের বলে দেয়। ইরাকে পাবার জন্য কৌশলে আরশাদকে ব্যবহার করে। আরশাদের অর্থ লিপ্সাকে কাজে লাগিয়ে ইরার সাথে বিয়ের নাটক করায়। সেদিন আরশাদ প্লান মোতাবেক বেড়ানোর কথা বলে ইরাকে ওর হাতে তুলে দিয়েছিল। মান সম্মান বাঁচাতে ইরা ছাঁদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। সেটাকে ওরাই এক্সিডেন্ট সাজায়। সামিরা আরও জানায়,শান এসবের সাথে জড়িত,ইমাকেও ওরা মেরে ফেলবে এমন নানা গল্প শুনিয়ে বাধ্য করে ইমাকে নিয়ে চলে যেতে। মা’য়ের কথা ইমা অবিশ্বাস করতে পারেনা। ইমাকে বিশ্বাস করাতে শানের সাথে মিথ্যা কাবিনের ছবি এবং কাপল ছবি দেখায় সামিরা। ইমার ব্যথাতুর,সহজ- সরল মন ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার সব চেষ্টা অবশেষে সফল হয়৷
” তোমার কার উপর সন্দেহ হয়, ইমা নাকি ওর মায়ের উপর, না,সামিরার উপর?” মাহিবের বুকের উপর দু’হাতে ভর করে মুখ তুলে বলে মৌ। মাহিব ভেবে বলে,
” ইমা হবে না। ঐ মেয়ের সাহস আমার জানা আছে। আর ও তো সত্যিটা জানেও না৷ ওর মা শুনেছি অনেক আগেই মারা গেছে। বাকি থাকে সামিরা৷ হুম, এই কাল নাগিনীকে আমার বিশ্বাস নেই।” মাহিব বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মৌ-র কপালে চুমু দিয়ে আসছি বলে বেরিয়ে যায়। মৌ চুপচাপ পাশ ফিরে শোয়। চোখে বিতৃষ্ণা জাগে।
” তুই আমার সাথে এমন করার সাহস কী করে পেলি সামিরা?”
” ওহ,কাম অন মাহিব, সামিরার সাহস সম্পর্কে তোমার দেখছি এখনো আইডিয়াই হলো না। জিজ্ঞেস করছ কী করে পেলাম! পাওয়ার কী আছে! সাহস তো জন্মগত ভাবেই আমার রক্তে মিশে আছে। তোমার মতো ভিতু নাকি।” মাহিব ছুটে গিয়ে ওর হাতের হুইস্কির গ্লাস ফেলে দিয়ে কটাক্ষ করে,
” এতোই যখন সাহস তবে আননোন নাম্বার থেকে থ্রেট কেন দিচ্ছিস? আমি জানি তুই স্বীকার করবি না। সাহস, সাহস বলে যেসব জাহির করিস ওসব তোর শো অফ। আসলে তুই নিজেও জানিস তুই কী! একজন ভীতু,দূর্বল নারী।”
” মাহিব।” আচমকা মাহিবের গলা চেপে ধরে অগ্নিচোখে তাকায়। মাহিব নিজেকে ছাড়িয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সামিরার সহ্য হয়না মোটেও। বজলুর কোমরে ঝোলা রিভলবার খুলে শুট করে মাহিবের ডান হাঁটুতে। মাহিব চিন্তাও করেনি সামিরা এমন করতে পারে। ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে। সামিরা ওর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মুচকি হেসে বলে,
” দেখলে তো আমি কী! বলো তো আরও ডেমো দেখাই। দেখাব বলো?” মাথার সাথে রিভলবার ঠেকাতেই মাহিব দাঁত পিষে ক্ষমা চায়। এই ক্ষমা সে মন থেকে চায়নি। এই মুহূর্তে বাঁচতে চায়। সামনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। মৌকে নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন সফল করতে হবে। অবস্থা বুঝে নত হয় মাহিব। সামিরা অবস্থা, পরিস্থিতি দেখে না৷ সে শুধু আবেগ দেখে। নিজের মন বোঝে। মন যা চায় তাই করে। মাহিব সবটা খুলে বলতেই সামিরা কিছুক্ষণ কী যেন ভাবে। বজুলকে ফিসফিস করে কিছু বলতেই বজলু বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার, নার্স এসে হাজির। মাহিবের ট্রিটমেন্ট শুরু হয়। ব্যাণ্ডেজ শেষে ডাক্তার চলে গেল। ব্যথায় বিছানায় কাতরায় মাহিব। সামিরা এসে বসে ওর পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” শানকে ভালো না বাসলে তুমিই আমার একমাত্র ভালোবাসা হতে মাহিব৷সুভাগ্য তেমনটা হলো না। তবুও তোমার প্রতি আমার হৃদয়ে এখনো সফট কর্ণার আছে আজ আবার বুঝলাম। তুমি শানের মতো কেন হলে না মাহিব?” সামিরা দু’হাতে ওর মুখটা তুলে চেয়ে আছে। আদর করে বলে,”খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?” মাহিব অবাক হয়ে সামিরাকে দেখছে। ওর মাঝে মাঝে মনে হয় সামিরা ওর মতোই পাগল। এখন মনে হচ্ছে ওর চেয়েও বেশি পাগল এই মেয়ে। বোঝার উপায় নেই কখন কী চলে ওর মনে। সামিরা কাছে আসে মাহিবের। হাঁটু ব্যথায় দাঁত কামড়ে পড়ে আছে মাহিব। সামিরাকে ভয় করে ও। অন্তত আজকের পর থেকে। সন্ধ্যার পর মাহিবের সামনে হাজির করা হয় আরশাদ শিকদারকে। সামিরার ইশারায় বজলু কয়েক ঘা দিতেই আরশাদ সব স্বীকার করে। সে বলে, টাকার জন্য মাহিবকে থ্রেট দিয়েছে। ক্ষমা চায় আরশাদ। ক্ষমা মেলে না। সামিরা সবার সম্মুখে শুট করে। সেখানেই মারা যায় আরশাদ। মাহিব ঘাবড়ে যায় সামিরার মুখের দিকে চেয়ে। ভয়ংকর এক নারীমূর্তি। মুখটাতে পৈশাচিক হাসি। যেন সব ধ্বংস করতেই এসেছে ও।
তুমি অতঃপর তুমিই
৩২
Taniya Sheikh
মাথার উপর টিমে টিমে তারা জ্বলা আকাশ। ভরা পূর্ণিমার রাত। ঝিঁঝি পোকারা ডেকে চলছে অবিরাম। শানের বুকে মাথা রেখে বসে আছে ইমা ছাঁদে,দোলনার উপর। অদূরে যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি তারপরেই ঝোপঝাড়। তারমধ্যে বুনো গাছের সারি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জোস্না নেমেছে সেখানে। জোনাকিপোকা জ্বলছে আর নিভছে। চোখের সাথে সাথে মনটাও জুড়িয়ে আসে। থেকে থেকে দমকা বাতাসে ইমার শরীর সংকুচিত হয়। গুটিশুটি মেরে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে শানের বুকে। শান দু’হাতে পরম ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরে আছে। এক একবার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কপালে আলত করে ঠোঁটের উষ্ণ পরশ দেয়৷ ইমার ভালো লাগে তখন। বিড়াল ছানার মতো নড়েচড়ে আবার চুপ হয়ে যায়।
” ইমা।”
” হুম।”
” চলো রুমে যাই।”
” কেন?” ইমা মুখ তোলে। শান ওর নাকে আলতো চুমু দিয়ে বলে,
” নাকটা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। অসুখ করবে তো এভাবে বাইরে রাত কাটালে।”
ইমা আয়েশ করে বুকে মাথা রেখে মৃদু হাসে।
” না, অসুখ করবে না। আপনি আছেন না! আপনি পাশে থাকতে আমার কিছু হবে না।”
” এতো বিশ্বাস?”
” হুমম। অনেক।”
” যদি এই বিশ্বাসের মর্যাদা না রাখি আমি?”
ইমা হঠাৎ নীরব হয়ে যায়। শান ঠোঁট কামড়ে শব্দ করে শ্বাস নেয়-ছাড়ে। বলে,
” কী হলো, জবাব দিলে না যে?”
ইমা সরে বসে। একদৃষ্টে সামনের আকাশে চেয়ে আছে। শান অপলক দেখছে ইমাকে। পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় বিধৌত ইমার মুখশ্রী। প্রেগন্যান্সির সময় নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য অন্যরকমের আলো ছড়ায়। শানের মনে হয় এ আলো পূর্ণিমার আলোর চেয়েও সুন্দর। ইমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু আগে বলা কথাগুলো ভুলে গেল। ইমা কিন্তু ভুললো না। মেয়েরা অনেক কিছুই সহজে ভোলে,আবার অনেক কিছুই আমৃত্যু ভোলে না। ইমা দৃষ্টি ঘুরিয়ে শানের দিকে তাকায়। পরস্পরের চোখে হারায় কিছুক্ষণ। ইমা চোখ নামিয়ে নিতেই শানের তন্ময়তা কাটে। ইমা ধড়া গলায় বলে,
” আমি জানি আমি ভুল করেছি। আমার উচিত ছিল আপনার মুখোমুখি হওয়া কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে সে অবসর দেয়নি। হয়তোবা আমি নিজেও নিজেকে সেটা দিতে চাইনি।” ইমা চোখ তুলে তাকায়। শান স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। ইমার চঞ্চল চোখ দু’টো কেমন জ্বলতে লাগে। ইমা ঢোক গিলে বলে,
” আমরা যতই বলি এই করব, সেই করব কিন্তু দেখা যায় উপযুক্ত সময়ে কিছুই করা হয়না৷ প্রিয় মানুষ কষ্ট দিলেও মুখ ফুটে সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাকে কিছুই বলা হয়না। অভিমান কণ্ঠরোধ করে দেয়। একমন তাকে কষ্ট দেবে বলে স্থির করলেও আরেকমন চায় সে ভালো থাকুক। আমার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। আমি আপনাকে ঘৃণা করব স্থির করেও দিনকেদিন আরও বেশি ভালোবেসেছি। আপনার শূন্যতায় রাতের পর রাত কেঁদেছি। যদিও আমি তখন জানতাম আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন,আমার,,,!” ইমার কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে। শান অবিচলিতভাবে বসে আছে সামনে। ইমা নিজেকে সামলে নাক টেনে লম্বা শ্বাস নেয়। তারপর আবার সামনের তারাভরা আকাশটার দিকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,
” আপনি যদি আমাকে মেরেও ফেলতেন তবুও আমার মন আপনাকেই ভালোবাসত, শান। ভালোবাসা এমনই হয়। ভালোবাসলে ঘৃণা করা যায়না,অভিমান করা যায় শুধু। তবে হ্যাঁ, ঠকালে বিশ্বাস শব্দটা আর অবশিষ্ট থাকে না। বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা কেবল শব্দ মাত্র। ভালোবাসার নামে তখন প্রহসন হয়। কারো প্রহসনের পাত্রী হবার আগে মৃত্যু শ্রেয় মনে করি।” ইমা মুখ ফিরিয়ে নিতেই বুকে টেনে নেয় শান।
” আমি মরে গেলেও জানবে এ দেহের শেষ অংশটুকু মাটিতে মিশে যাবার আগেও তোমাকে স্মরণ করেছে,তোমাকে ভালোবেসেছে। আমার অজান্তেই যে কষ্ট তোমাকে আমি দিয়েছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমি কী করে করব? কী করে নিজের মনকে শান্তি দেবো,স্বস্তি দেবো? আমি নিজেকে কথা দিয়েছি সরল পথে চলব, কিন্তু কী করে? আমার আশপাশটা গরলে ভরা। আমি সেসব এড়িয়ে যেতে পারি না৷ আশপাশের জঞ্জাল আপনা আপনিই সরে না। সেটা সরাতে হয়। নয়তো বাড়তে বাড়তে সবকিছু নোংরা করে দেয়।”
ইমা অশ্রুসিক্ত মুখতুলে বলে,
” এসব কেন বলছেন?”
শান ইমার চোখ- মুখ মুছে বলে,
” সব বলব তোমাকে। তার আগে কথা দাও দুঃশ্চিন্তা করবে না।” ইমা সামান্য মাথা নাড়ায়। শান ওর মাথাটা বুকের উপর রেখে হাত বুলায়। জোনাকিরা এসে ভীর করে চারপাশে। শান কথা শেষ করতেই ইমা ভীত চোখে তাকায়। দু’হাতে জোনাক বন্দি করে মুঠোটা ইমার মুখের সামনে এনে বলে,
” আলোটুকুকে কিছুসময়ের জন্য ঢাকতে চাই। তারপর ঠিক এভাবেই আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলবো ভুবন তোমার- আমার।” শান মুঠো খুলে জোনাকিপোকা ছাড়ে। আলোকিত করে তোলে জোনাকিপোকারা চারপাশ। ইমার কোলে মাথা রেখে শান বলে,
” জীবনে অনেক কিছু সয়েছি মুখ বুঝে, আর না। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে সেটা বাড়তেই থাকে। এড়িয়ে গিয়েও তা থেকে নিস্তার পাওয়া যায়না।” শান থেমে আবার বলে,” অতীত অন্যায়ের সব আমি শুধরাতে পারব না তবে যতটুকু পারা যায় তার চেষ্টা করব। চেষ্টা করব আমাদের ভবিষ্যতে সুন্দর করার। তোমার সাহায্য ছাড়া যা সম্ভব না,ইমা।”
মনে মনে ইমা চিন্তিত হলেও শানকে অভয় দেয়,সাহস যোগায়। পরদিন সকাল, সকাল ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে ওরা।
ইমরোজের পরিবারের ভীষণ পছন্দ হয়েছে রাত্রিকে। ছেলের নিষেধ উপেক্ষা করে আমেনা বেগম আংটি পড়িয়ে পাকা কথা দিয়ে এসেছেন। বাসায় এসে এ নিয়ে খুব কথা কাটাকাটি হয়েছে মা -ছেলের মধ্যে। ইমরোজ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে এ বিয়ে সে করবে না। আমেনা বেগম চড়া গলা জিজ্ঞেস করেছেন,” কেন করবি না? তুই তো কথা দিয়েছিলি বিয়ে করবি বলে।তাহলে এখন কেন এমন করছিস?” এখানে কথা শেষ হতে পারত কিন্তু রাগের বশে আমেনা বেগম হঠাৎই বলে বসলেন,
” জানি তো কেন এমন করছিস!”
ইমরোজ যেন চমকে তাকাল মায়ের কথার ধরন শুনে। কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করল,
” কেন করছি?”
আমেনা বেগম পুত্রের মুখ চেয়ে হঠাৎই শান্ত হয়ে যান। কী বলতে কী বলে ফেলছিলেন ভাবতেই চুপসে যান। আমেনা বেগম যেমন ছেলের মুখ দেখে মনের খবর বলতে পারেন,ইমরোজও ঠিক তাই। সে মায়ের হঠাৎ চুপসে যাওয়াটা স্বাভাবিক ভাবে নিল না। মনে যা আছে তা তো সে প্রকাশ করেনি তবে কেন সে কথা উঠবে? যা মনের এককোনে দাফন করে ফেলেছে তাকে এরা কেন খুঁড়ল? রাগে মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে। শান্ত, গম্ভীর প্রকৃতির ইমরোজ অশান্ত হয়ে ওঠে। রাগে ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ে। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না যেন। সামনে রাখা এন্টিকের ভাজটা তুলে আছাড় মারল।সাথে সাথে টুকরো টুকরো হয়ে সেটা ছড়িয়ে পড়ে লিভিং রুমে। আহসান সাহেব,আশা হতবিহ্বল। আমেনা বেগম নত মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন৷ ইমরোজ চলে যায়। ভাজ ভাঙার বিকট শব্দ শুনে পাশের রুমে শুয়ে থাকা আশার বাচ্চা মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কান্না জুড়ে দিল। আশা ছুটে যেতে যেতে মা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
” সবাই শুধু আমার ভাইটাকে ব্যথা দিতে মুখিয়ে থাকে।” আমেনা বেগম ব্যথিত চোখে মেয়ের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে স্বামীর দিকে তাকান।স্ত্রীর উপর রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুমে চলে যান আহসান সাহেব। স্বামী যেতেই উু উু করে নাক টেনে টেনে আমেনা বেগম বলেন,
” হ্যাঁ, আমি তো ইমরোজের শত্রু। সবাই এখন আমাকেই দোষ দাও। আমার কী কষ্ট হয়না ওর মুখ দেখলে। মায়ের মন তোমরা কী বুঝবে?”
আমেনা বেগম যাওয়ার আগে হবু পুত্রবধূ রাত্রিকে ছেলের মোবাইল নাম্বার দিয়ে এসেছিল। ওর কাজিনরা মিলে রাতে খুব করে ধরেছে কল করার জন্য। রাত্রির খুব লজ্জা করছে, সে না,না করছে। ওর এক কাজিন এজন্য কটাক্ষ করে বলল,
” অনার্স শেষ করবি দু’দিন পর এখনো তোর লজ্জা গেল না। তোর মতো এমন ব্যাকডেটেড মার্কা মেয়েকে তারা পছন্দ করল কিভাবে বুঝলাম না।” রাত্রির এই কাজিনটা প্রচন্ড হিংসুক প্রকৃতির। পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে বোনের বিয়ে হবে এ যেন কিছুতেই হজম হচ্ছে না৷ রাত্রি সুন্দরী শিক্ষিতা হলেও অতোটা আধুনিক ধাঁচের মেয়ে নয়। সব কাজিনদের যেখানে গণ্ডা,গণ্ডা ছেলেবন্ধু, মেয়েবন্ধু সেখানে ওর হাতেগোনা দু-একজন মেয়ে বান্ধবী আছে। জন্ম থেকে ঢাকা থেকেও স্কুল,কলেজ ভার্সিটি ছাড়া আর কোথাও চেনে না সে। তার গণ্ডির বাড়ির চারদেয়ালেই সীমাবদ্ধ। এসব কারনেই কাজিনরা সুযোগ পেলেই ওকে ছোট করে,মজা করে। আর আজ তো সুযোগটা সোনায় সোহাগা। এক কাজিন জোর করে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে কল লাগিয়ে দিল। ও পাশে কয়েকবার রিং হতেই ইমরোজ রিসিভ করে। রাত্রির এক কাজিন নিজেকে রাত্রি বলে পরিচয় দিল। পাশে দাঁড়ান রাত্রি লজ্জায় লাল হয়ে আছে। বুক ধুকপুক করছে ওর৷ সব কাজিনরা গোল হয়ে বসে লাউডস্পিকার দিয়ে শুনতে লাগল। ইমরোজ জানে না তার হবু স্ত্রীর নাম। যাকে বিয়েই করবে না বলে ভেবেই নিয়েছে তার নাম জানার আবশ্যকতা আছে কী! সে সোজাসাপ্টা জবাব দিল এ নামের কাওকে সে চেনে না। রাত্রির কাজিনরা ধরে নিল হবু জিজু বউয়ের সাথে মস্করা করছে। সরাসরি রাত্রি এবং তার সম্পর্কের কথা বলে হবু স্ত্রীর নাম না জানায় তিরস্কারের সুরে কথা বলল। ইমরোজ এবার বুঝতে পারল। একটু আগের ঘটনায় মেজাজ এমনিতেও খারাপ তার উপর এই মেয়ের তিরস্কারে চটে গেল। রাত্রি ভেবে ওর কাজিনকে সরাসরি বলে দিল,সে এমন অভদ্র, গায়ে পড়া মেয়েকে বিয়ে করবে না। রাত্রি যেন তার পরিবারকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেয়। ইমরোজ কল কেটে দেয়৷ কাজিনরা মুখ চাওয়া- চাওয়ি করে আস্তে করে উঠে চলে যায়। রাত্রির কান্না পায়। কী এমন বলেছে ওর কাজিনরা! একটু দুষ্টুমিই করেছিল না হয়। তারজন্য এমন ব্যবহার! কিছুক্ষণ পরই আত্মীয় স্বজনরা জেনে গেল রাত্রির হবু বর রাত্রিকে কী বলেছে। এতোদিনের ভালো মেয়েটাকে সবাই আজ করুনার চোখে,বাঁকা চোখে দেখছে। রাত্রির বাবা- মা মেয়েকে বকেছে। তাঁদের ধারণা দোষ রাত্রিরই। সব দোষ মাথায় নিয়ে সেদিন কেঁদে কেঁদেই পার করেছে রাত্রি।
মানুষের শক্তি ক্ষণস্থায়ী। এই আছে তো এই নেই। তা স্বত্বেও মানুষের অহংকারের শেষ নেই। বোধবুদ্ধির কথা না হয় বাদই দিলাম। যেখানে নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই সেখানে পাপের পর পাপ করেও কারো ভেতর মৃত্যু ভয় জাগে না,জাগে না পরকালের চিন্তা। মাহিবের গুলি লাগা পা-টা ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। যথাসাধ্য চিকিৎসা করানোর পরও কোনো উন্নতি ঘটছে না। হুইলচেয়ারের সাহায্যে নড়াচড়া করতে হচ্ছে এখন। পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়ানো মাহিব খান আজ চলতে-ফিরতেও পারছে না সাহায্য ছাড়া৷ এতোকিছুর পরও লোভ,লালসা কিছুমাত্র কমেনি। কেউ যথার্থ বলেছে, ইল্লত যায় না ধুলে,স্বভাব যায় না মলে। নিজের এই পরিণতি জন্য সামিরাকে দোষী করে মাহিব। আর তাই মৌ-কে নয় সামিরাকে এখন চায় সে। এই অক্ষম জীবনটা সামিরাকে পেলেই সাচ্ছন্দ্যে কেটে যাবে। কিন্তু সামিরা তাকে মানবে কেন? সামিরাকে নিজের করতে প্লান কষে ভেতরে ভেতরে। পথের কাঁটা শানকে সরাতে পারলেই সামিরা ওর। এদিকে মৌ-কেও এতোদিন বউ করবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছে। মেয়েটার হাবভাবও ভালো ঠেকছে না। কেমন সাধারণ মেয়েদের মতো বিহেভ করছে ইদানীং৷ মাহিবের মনে হয়,মৌ সহজে হয়তো ছেড়ে যাবে না। সুতরাং ওকেও রাস্তা থেকে সরাতে হবে। এই সময় যদি শামীমটা পাশে থাকত! মাহিবের মনটা কেমন অসহায়বোধ করে। সাথে সাথে সেটা নিভে গিয়ে একরাশ ক্ষোভ জন্মে ইমরোজের উপর৷ মৌ-কে দিয়েও যখন কিছু করা গেল না তবে অন্য পথ ধরতে হবে। সবকিছু ভেসে যাওয়ার আশঙ্কায় মাহিব যেন বদ্ধপাগল হয়ে ওঠে। টিকে থাকার জন্য সব ধ্বংস করতে রাজি সে।
মৌ অনেকক্ষণ ইতস্তত করে শেষমেশ চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলল। কেউ দেখার পূর্বেই দ্রুত পদে সেখান থেকে চলে এসে গলির ভেতর হাঁটতে শুরু করে। কিছুদূর গিয়ে ওর মনে হয় চিঠিটা ডাকবাক্সে না ফেললেই ভালো হতো। ইমরোজ কী ভাববে! সে তো আর মৌকে ভালোবাসে না। ভালোবাসা! তার যোগ্যতা কী ইমরোজের মতো মানুষের ভালোবাসা পাবার। একটা খারাপ মেয়েলোক। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে ঐ পশুটার কাছে। মৌ-র চোখ জ্বলে। আস্তে আস্তে চোখের কোনায় জল জমা হয়। আবার পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। চিঠিটা যে করেই হোক নিয়ে আসতে হবে। মৌ আবার ইমরোজের বাসার দিকে হাঁটে।
শান ইমাকে ইমরোজের বাসায় রাখার জন্য এসেছে। ইমরোজের সাথে ওর এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ইমরোজই ইমার নিরাপত্তার কথা ভেবে এখানে রাখার পরামর্শ দেয়। আমেনা বেগম, আহসান সাহেব শানকে সন্তান তুল্য জ্ঞান করেন। ইমাকে পেয়ে তারা ভীষণ খুশি। ইমারও ভালো লাগে এদের৷ আশার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করছিল ইমা। আঙ্কেল আন্টির সাথে কথা শেষ করে শান আশার রুমে টোকা দিতেই আশা অভিমানি কণ্ঠে বলে,
” আসেন মহারাজা শান নিহান খান। আজকাল আপনার দেখা তো দূরের কথা খবরটাও পাইনা। এতো পাষাণ তুমি শান ভাই।”
শান ওর মাথায় হালকা চাপড় মেরে ইমার পাশে গিয়ে বসে। আশা ঠোঁট উল্টে ইমাকে বিচার দেয়। ইমার কাঁধে থুঁতনি ভর দিয়ে বাচ্চাটার গালে আলতো আদুরে পরশ দিতে দিতে শান বলে ,
” এক বাচ্চা মা হয়েও তোর ফাজলামি কমে নাই দেখছি।”
” আর আপনি এক বাচ্চার মামা,আরেক বাচ্চার হবু বাবা হয়েও ভাব নেওয়া কমান নাই।” শান হতবুদ্ধি হয়ে ইমার মুখের দিকে তাকাতেই আশা ফিক করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
” ইমা ভাবি ইউ আর গ্রেট। তোমার ওয়াও মার্কা ডায়লগ শুনে আমার শান ভাই টাস্কি খেয়ে গেছে। আম্মু, ও আম্মু তোমার ছেলের বউ তো মার্কামারা।” আশা রুমে ছেড়ে বেরোতেই শান ইমার গাল টেনে ধরে,
” ওর সামনে ওটা বললে কেন?”
” আহ! লাগছে শান, গাল ছাড়েন ।”
” না, আমার মান ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে ছাড়েন বললেই কী ছেড়ে দেবো?” ইমার কোলের বাচ্চা সহ জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। ইমার শরীরে সুরসুরি দিতে দিতে অস্থির করে তোলে। ইমা হাসতে হাসতে কোলের বাচ্চাটাকে সাবধানে দূরে শুইয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
” শান করছেন কী? আপনি ভুলে গেছেন আমি প্রেগন্যান্ট?”
” না,ভুলিনি৷ এই এক কথা বলে পার পাবা না। আশার সামনে ওটা কেন বললে? সরি বলো।”
” না,সরি বলব না। যা সত্যি তাই বলেছি। ভাবে বাঁচেন না আবার বললে দোষ।” শান সুরসুরি থামাতেই ইমা জোরে জোরে হাঁফায়। ইমার গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে শান বলে,
” ভাব দেখাই? ” ইমা মাথা নাড়িয়ে” হ্যাঁ”বলে ঠোঁট টিপে হেসে। শান মুখ নামাতে নামাতে বলে,
” আবার বলো।”
পরিস্থিতি সুবিধাজনক না বুঝে ধাক্কা দিয়ে শানকে সরিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
” আশা দেখো তোমার ভাই কী করে।”
” এই,এই চুপ।” শান ইমার মুখ চেপে ধরতেই ইমা ভ্রু নাচায়। শানের গলা জড়িয়ে ধরে চোখ পিটপিট করতেই সমস্বরে দু’জনই হেসে ওঠে পাশাপাশি শুয়ে। কিছুসময় পর শান হাসি থামিয়ে ইমার হাসতে থাকা মুখটা দিকে তাকিয়ে আছে৷ এক হাতে ভর দিয়ে কাঁত হয় ইমার দিকে। ইমা তাকাতেই ইমার গলায় মুখ লুকিয়ে দু’বাহুতে জড়িয়ে ধরে বলে,
” তোমাকে ছেড়ে কী করে থাকব আমি,ইমা!” ইমার হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাথে সাথে একরাশ বিষন্নতার ছায়া ভর করে। দু’জনের কেউ আর কথা বলে না৷ পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকে নীরবে।
চলবে,,,
চলবে,,,,