#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ৩
#রেহানা_পুতুল
ঝিনুকের সারামুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো আরশাদকে দেখেই। আরশাদ ঝিনুককে না দেখার ভান করে মোবাইলে চোখ বুলাচ্ছে।
ঝিনুক গিয়ে তার সিটে বসলো। স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। এই ভেবেও মনটা ভারাক্রান্ত আজ। একটু পরেই সব শিক্ষকদের আবদারপূর্ণ আদেশে ঝিনুক আবার স্টেজে যেতে বাধ্য হলো। এখন তমাল গান গাইবে। সে গানের সাথে ঝিনুক একটু অভিনয় করবে। অভিনয় ও আবৃত্তি করে ঝিনুকের ঝুলিতে বেশ কিছু পুরষ্কার ও উঠে এসেছে।
” বাতাসে গুনগুনিয়ে এসেছে আজ ফাগুন।
বুঝিনি তোমার ছোঁয়ায় এত যে আগুন।
ও…ও…ও…এলোমেলো হয়ে যায় মন।
কেন যে আজ বুঝি না।
দাবানল আজ ছড়ালো
পার করে সীমানা।
এ মনের আকুল বাসনা
প্রিয় একবার ধরা দাওনা।
রবেনা তোমার একলা ফাগুন
সঙ্গী হতে চায় পিয়াসু মন।”
ছাত্র শিক্ষক সবার উপচানো করতালিতেও ঝিনুক উৎফুল্ল হতে পারছেনা। কারণ আরশাদের উপস্থিতি তাকে অসহিষ্ণু করে তোলেছে। যে মানুষটা তাকে স্ত্রী না ভেবে শুধু বোঝাই ভাবলো। সে কেন তার নাচ দেখে, কবিতা শুনে আনন্দ পাবে।
কিশোরী বয়সের আবেগ অবাধে দাফাদাফি করে চলে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ থেকে কোষে। একে নিয়ন্ত্রণ করার চাবি পৃথিবীর কোন মহামানবের হাতেও নেই।
সপ্তাদর্শী ঝিনুক নিজের উপর অভিমানে অনুযোগে গোপনে মুষড়ে যাচ্ছে। কেন যে সেদিন নিজেই এই বদের বিয়েতে গেলাম আব্বুর সাথে। বিশেষ করে গিয়েছি একটু খাওয়ার লোভে। বিয়েবাড়ির চিকেন ফ্রাই, কাবাব,চিংড়ি ভাজা,গরুর রেজালা, জর্দা,ফিরনি খেতে আমার খুব ভালোলাগে। বাসায় জীবনেও এত সুস্বাদু আইটেম একসাথে রান্না করা হয়না। গরুর মাংস খেতে পারি বছরে দুইবার মাত্র। একবার আব্বু কিনে আনে। তখন আম্মু আলুর বড় বড় টুকরো দিয়ে ঝোল করে রান্না করে। আরেকবার খেতে পারি কোরবানির সময় আত্মীয়স্বজন দিলে। তখন আম্মু রেজালা করে। মধ্যবিত্ত হলেই যত বিপদ। গরীব হতাম। ভালো হতো। সবার কাছে গিয়ে গিয়ে সব সময় সাহায্য চাইতে পারতাম। নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিতে লাগলো ঝিনুক।
মুনিয়া কনুই দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিলো ঝিনুককে। ঝিনুক ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো।
কিরে কিছু চিন্তা করছিস মনে হয়?
আমরা যে বিদ্যালয় ছেড়ে যাচ্ছি তাই খারাপ লাগছেরে। এই বিদ্যালয়ের সবুজ প্রাঙ্গন জুড়ে কতশত স্মৃতি আমাদের। কত দুষ্টমি করেছি। কত খেলা খেলেছি। কত কথার আড়ি নিয়েছি।
আমার ও খারাপ লাগছেরে ঝিনুক। সবাই কি আর পরে এক কলেজে ভর্তি হবো যে দেখা হবে। কার বাসা কোথায়। কোনটা কোথায় ভর্তি হয় কে জানে। এই ঝিনুক আমার সেই বিষয়টা এখন মনে পড়েছে।
ঝিনুক চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কোন বিষয়?
তখন বর্ষাকাল ছিলো। আমরা ক্লাস সেভেনে পড়ি। কাগজের নৌকা বানিয়ে আমরা বিলের পানিতে ছেড়ে দিয়েছি। পানির স্রোতে আমাদের নৌকা যখন দূরে চলে যাচ্ছে তুই পায়জামা খুলে ফ্রককে উরুতে গুঁজে পানিতে নেমে গিয়েছিলি নৌকাটাকে তুলে আনতে।
হইছে থাম মুনিয়া। ইডিয়েট একটা কোথাকার।
থামছি শুননা,কয়দিন আগে যে সবুজ টাক হয়ে স্কুলে এসেছে আর এশা ওর মাথায় পচাঁ ডিম ভেঙ্গেছে। তার প্রতিশোধ সবুজ কিভাবে নিয়েছে ওপেনলি। দেখেছিস?
উফফস! থাম প্লিজ। শুনতে ভাললাগছেনা।
এই মুখে তালা দিলাম। দেখি কে চাবি দিয়ে খোলে। ঝিনুক পাকানো চোখে তাকায় মুনিয়ার দিকে। মুনিয়া চুপ হয়ে থাকে।
স্যারগণ বিদায়ী বক্তব্য দিলো। পরিক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে নানা মোটিভেশনাল কথা বললো। সব শেষে সবাই লাঞ্চ করলো। চিকেন বিরিয়ানির সাথে মিনি সাইজের ঠান্ডা পানীয়ের বোতল।
এদিকে আরশাদ হলরুমের পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। মনে মনে ভেবে নিলো ,
তুমি যতই ধড়িবাজ মেয়ে হওনা কেন এই আশুকে গায়েল করতে পারবেনা। তুমি ভালো করেই জানতে যে আজ আমি থাকবো। তাই আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য হেলেদুলে নেচেছো। তোমার অবস্থান ভেদে এমন করাটাও আবশ্যক বটে। ভেবেছো এরপর সিনেমার নায়কের মতো আমি গিয়ে তোমার ওই বাঁশের কঞ্চি মার্কা হাত ধরে স্যরি বলবো? লাভ ইউ বলবো? ব্লা ব্লা ব্লা। হুহু। মনে রেখো তোমাকে আমি পছন্দ করে ঘরে তুলিনি। আমার বাবা মা পছন্দ করে ঘরে তুলেছে।
অনুষ্ঠান শেষে যার যার মতো করে সবাই চলে গেলো। ঝিনুক দৃষ্টির সীমানায় আর দেখতে পেলোনা আরশাদকে। দেখতে পেলোনা বলে কোন দুঃখবোধ হলোনা তার মনে। বরং স্বস্তিবোধ হলো। এবং আরশাদ যে তাকে অপছন্দ করে এই বিষয়ে আরেকবার স্বচ্ছ একটা আভাস পেলো।
ভাগ্যিস! বিয়ের কথা ক্লাসের কাউকেই জানাইনি। ঝিনুক মনে মনে বললো।
ভগ্নস্তূপের মতো যে সম্পর্ক কেবলমাত্র সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে আছে, সে সম্পর্ককে প্রকাশ্যে প্রকাশ করা মানে নিজের কাছে নিজেকেই স্বস্তা করে ফেলা।
ঝিনুক নিজেকে মূল্য দিতে জানে। নিত্য টানাপোড়েনের সাথে যুঝে যুঝে বড় হয়েছে। জীবনের এপিঠ ওপিঠ খুব কাছ থেকে পরখ করে দেখেছে।
স্কুলের মাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে ঝিনুক বলে,
জামান খানের একমাত্র পুত্র আরশাদ। আপনি যদি মনে করেন,
আপনার গাড়ি, বাড়ি, বাসার চমক মারা আভিজাত্য, গহনা, ডাইনিং জুড়ে বাহারি পদের ব্যঞ্জন, আয়েসী জীবনযাপন এসবের মোহে কাবু হয়ে গিয়েছি আমি। তাহলে ধরে নিব আপনি নেহাৎ বোকা। মানুষ চিনতে ভুল করেন। আপনার ছায়া মাড়াতেও আমি অপ্রস্তুত।
একমাস পর ঝিনুকের পরিক্ষা শুরু হয়ে ভালোভাবে শেষ হয়ে গিয়েছে। পরিক্ষা চলাকালীন কেন্দ্রে রোজ তার বাবা পরশ তাকে নিয়ে গিয়েছে। এছাড়া তার সাথে যাওয়ার আর কেউই নেই। তার কোন ভাই নেই। একমাত্র বড় বোন জিনিয়ার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তার স্বামী রাকিব একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। মা পারুল বাইরে রাস্তাঘাটে চলতে ভয় পায়। ঝিনুকেরা আগে গ্রামেই বাস করতো। কয়েকটা জরুরী ইস্যুর জন্য ঝিনুকের বাবা পরিবার ঢাকায় নিয়ে আসে। তার বাবা মেসে বা বাইরে খেতে পারেনা। ঝিনুকের ক্লাস ফাইভের রেজাল্ট খুব ভালো হয়। সে বৃত্তি পায়। ঢাকায় একজনের ব্যয়ভার ও গ্রামের সংসার এ দুইয়ের সাথে আয়ের ব্যলেন্স করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলো তার বাবা৷
ঝিনুককে তার বাবা আরশাদের কথা জিজ্ঞেস করে,
কিরে ঝিনুক আরশাদকে পরিক্ষার হলের সামনে একদিন ও দেখলাম না যে? আমাদের কাছে ফোন ও তো করেনি?
ঝিনুক বানিয়ে বলে, উনি রোজ এসে কি করবে? মাঝে মাঝে পরিক্ষা শেষে এসে পরিক্ষার খবর নিতো। আর আমি আগেই না করে দিয়েছি পরিক্ষা চলাকালীন যেন ফোন না দেয়। এতে আমার মাইন্ড ডাইভার্ট হতে পারে। তাই তোমাদের কাছে ফোন আসেনি।
ওহ আচ্ছা বলে ঝিনুকের মা বলল,
আমার মোবাইলে তোর শাশুড়ী মাঝে মাঝেই ফোন দেয়। সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। এই পরিবারটা খুব ভালো। বড় মনের।
ঘ্যাড়াকলে আটকে গিয়েছে বলেই, আমাকে নিয়েছে তারা। নইলে এ আকাশকুসুমের মতোই।
ওপরওয়ালার হুকুম ছিলোরে মা। নইলে এত উঁচু ঘরে আমাদের ঘরের মেয়ে কেমন করে বউ হয়ে যায়।
ঝিনুক মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী সুরে,
আম্মু আব্বুকে বলনা আমি গ্রামে যাবো বেড়াতে। পড়া,কোচিং, এই সেই করে করে তিনবছর হয়ে গেলো গ্রামে যাইনা।
ঝিনুকের মা বলল,এখন আর তোর আগের জীবন নেই। চাইলেই হুট করে যে কোথাও যাওয়া যাবেনা। তাদের অনুমতি লাগবে। তোর শাশুড়ীকে ফোন দিয়ে অনুমতি নিয়ে নিস।
ঝিনুক বলল, উনি হলে কথা বলতে রাজী আছি। অন্যকেউ হলে না। কথার টানে ঝিনুক এটা বলে নিজেই বেকুব হয়ে গেলো।
অন্যকেউ হলে না, এই অন্যকেউ টা কে? বুঝলাম না। কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলো তার মা।
ঝিনুক থতমত খেয়ে বললো, আরে দুষ্টমি করে উনার কথা বলছি আম্মু।
ওহ আচ্ছা। বুঝলাম। আমার মোবাইল দিয়ে তোর শাশুড়ীকে ফোন দে। নাম্বার সেভ করা আছে বেয়াইন লিখে।
ঝিনুক হেসে ফেললো। বলল তোমার বড়লোক বেয়াইন কদিন থাকে দেখো।
ঝিনুকের মা রেগে গেলো। এমন অলক্ষুণে কথা মুখ দিয়ে বের করাও পাপ। তওবা কর মেয়ে।
হোঃহোঃহোঃ তওবা করছি আম্মু মনে মনে। ঝিনুক ফোন দিলো জোবেদা বেগমকে। সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলল। গ্রামে যাওয়ার বিষয়ে বললো।
শাশুড়ী একবাক্যে অনুমতি দিলো। ননদ আরিশার সাথেও হুহু হাহা করে বেশ জমিয়ে গল্প করবো।
রাতে আরশাদ বাসায় ফিরলে, জোবেদা বেগম ঝিনুকের গ্রামে যাওয়ার বিষয়ে বললেন। শুনে আরশাদ জবাব দিলো।
আম্মু আমার কোন মাথাব্যথা নেই এই মেয়েটাকে নিয়ে। যাবে তাতে আমার কি?
তাজ্জব বনে গেলেন জোবেদা বেগম।
হেয়ালি করে এসব কি বলছিস তুই? আর তাকে অবশ্যই একটা মোবাইল কিনে দিস গ্রামে যাওয়ার আগে। এটা তোর মাথায় কেন আসলোনা বুঝলাম না। ওর কোন মোবাইল নেই আমি জেনেছি।
মনে মনে রাগে বেলুনের মতো ফেটে যাচ্ছে আরশাদ। গুনগুন করে,
তোমরা আসলেই বুঝবানা। বুঝলে কল্যাণ অকল্যাণের ঘাড়ে আশ্রয় নিয়ে যাকে তাকে আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিতেনা।
ঝিনুকের মায়ের ফোনে ফোন করে আরশাদ ঝিনুককে বাইরে একটা নিদিষ্ট স্থানে দেখা করতে বললো।
আরশাদ এলো। হাতে ঝিনুকদের বাসার জন্য বেশকিছু উৎকৃষ্টমানের ফলফলাদি। সেটা ঝিনুকের হাতে দিলো। আরেকটি ছোট প্যাকেট তার হাতে এগিয়ে দিয়ে,
এখানে নিউ মোবাইল সেট আছে তোমার জন্য। সিমসহ সব ওকে করা আছে।
ঝিনুক আন্তরিকতার সাথে,
কি দরকার ছিলো শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে আমার জন্য মোবাইল কেনার?
আমার জন্য দরকার ছিলোনা। আম্মু বললো তাই কিনে দিলাম।
আরশাদের মুখে নির্দয়ের মতো বাক্যটি শুনেই তেতে উঠলো ঝিনুক। প্যাকেটটি আবার আরশাদের হাতে দিয়ে বললো,
নিয়ে যান। আমার ও কোন প্রয়োজন নেই অন্যকারো টাকার মোবাইল ইউজ করার। বলে পা চালিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলো আরশাদের সামনে থেকে।
আরশাদের কোন গিফট কোন মেয়ে ফিরিয়ে দিতে পারে এটা সে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা। ঝিনুকের ব্যক্তিত্ববোধ আর জেদ আরশাদকে শুধু বিস্মিতই করেনি,ভাবনার অতলে তলিয়ে দিলো।
চলবে….